পাখির সাথে ফুলের সাথে মনের কথা কই রে

গদ্য সাহিত্য

।। নাদিয়া ইসলাম ।।

যদি জন বার্গারের কাছে যাওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে, তিনি বলেন, আমরা যা দেখি আর আমরা যা দেখার সূত্রে জানি, এই দুই কখনোই এক না। কারণ এই দুইয়ের মধ্যে ‘মুখের’ ভাষার ব্যবধান আছে। সেইকারণে ‘অন্ধের হস্তিদর্শন’ বলে যে প্রবাদ আছে, তা আক্ষরিক অর্থেই সত্য। একজন অন্ধ মানুষ, যিনি জীবনে কিছু হাত দিয়েও স্পর্শ করেন নাই, বা একজন মঙ্গল গ্রহের এলিয়েন, যিনি এইমাত্র পৃথিবীতে এসেছেন, তার কাছে আপনাকে যদি হাতি কী বা আম কী বা গাছ কী ব্যখ্যা করতে বলা হয় বা এমনকি হাতি বা আম বা গাছের বর্ণনা দিতে বলা হয়, তাহলে আপনার লেজেগোবরে অবস্থা হবে। আমরা শব্দের ব্যখ্যায় যা বিশেষণ ব্যবহার করি, অর্থাৎ মিষ্টি আম বা সাদা হাতি বা ডাইনি বুড়ির আঙুলের মতো গাছের ডাল, তাও আমাদের নিজেদের তৈরি করা এ্যামবিগিউয়াস শব্দ…

পাখির সাথে ফুলের সাথে মনের কথা কই রে

বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে পি-সি-আর-এর জন্য আমি কয়েকটা প্রাইমার আর প্রোব ডিজাইন করছিলাম। কাজটা খুব বোরিং, এবং এই কাজের জন্য বিশেষ জ্ঞান বা বিশেষ মনোযোগ বা বিশেষ বুদ্ধিমত্ত্বার প্রয়োজন নাই। কোভিডকালীন এ্যাসিস্টেন্টের অভাবে আমি নিজেই কম্পিউটারের সামনে বসে প্রোগ্রাম কমান্ড দিয়ে যাচ্ছি। আমার ডান হাত মাউসে, বাম হাতে ম্যানলি হলের বিখ্যাত বই ‘দা সিক্রেট টিচিংস অভ অল এজেস’। অবশ্য শুধুমাত্র ‘বিখ্যাত বই’ বলে ছেড়ে দিলে বইটার প্রতি ভয়ংকর লেভেলের অবিচার করা হবে। একজন মানুষ যদি মারা যাওয়ার ঘণ্টা দুই আগে দুইটা বই পড়তে চান, তাইলে তার মধ্যে একটা বইকে অতি আবশ্যিকভাবে ম্যানলি হলের ম্যাগনাম অপাস ‘দা সিক্রেট টিচিং অভ অল এজেস’ হতে হবে। অবশ্য একজন মানুষ কেন মারা যাওয়ার দুই ঘন্টা আগে বই পড়তে চাইবেন, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে।

মারা যাওয়ার পরে ঈশ্বর নামক কাল্পনিক পরীক্ষক বইয়ের পঞ্চাশ চ্যাপ্টার ধরে একশ উনসত্তরটা মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেন্স এর খাতা কলম ইনস্ট্রাকশান এ্যালার্ম ঘড়ি ধরিয়ে আঙুল দিয়ে কাঠের বেঞ্চ দেখিয়ে দেখার ব্যবস্থা না করে থাকলে আমি মারা যাওয়া নিশ্চিত হওয়ার আগেই জীবিত অবস্থায় মানুষকে এই বইটা পড়তে অনুরোধ জানাবো।

বইটা একজন ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষের লেখা। মূলতঃ কাব্বালা, আলকেমি, ট্যারো, নিও-প্লাটোনিক ফিলোসফি, রজাক্রুশানিজম, ইসলাম এবং ফ্রি-মেসোনারি সহ প্রাচীন অকাল্ট ও এসোটেরিক সংস্কৃতি বিষয়ে।

তখন চোদ্দ নাম্বার চ্যাপ্টার পড়ছি। ‘দা হিউম্যান বডি ইন সিম্বোলিজম’। হঠাৎ একটা বাক্যে আমার চোখ আটকে গেলো। “Many of the codes and laws believed by modern divines to have been direct revelations from Divinity are in reality the fruitage of ages of patient delving into the intricacies of the human constitution and the infinite wonders revealed by such a study.” এবং একইসাথে আমার চোখ পড়লো কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে। ফরওয়ার্ড এবং রিভার্স প্রাইমারের জিনেটিক কোডের ATCGGTACCTACCCGTATTC এবং CCGTTTACCTAGGGAATCGC সিকোয়েন্স দেখে আমার মাথায় যেই প্রশ্ন আসলো, সেটা হচ্ছে, এই A T C G নিউক্লিওটাইড কি কোনো ভাষার বর্ণমালা?

জিনেটিক এনজিনিয়ারিং-এর অ-আ-ক-খ হচ্ছে A T C G, এই দিয়ে জিনেটিক কোড লেখা হয়। মানুষের শরীর মূলতঃ বিভিন্ন প্রোটিনের সমষ্টি। এই কোড ঠিক করে কোথায় এবং কখন কতখানি প্রোটিন কী কারণে তৈরি হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শুধুমাত্র প্রোটিন কোডিং-এর মাধ্যমে জিনেটিক এক্সপ্রেশানের বাইরে কি এর আর অন্য ভূমিকা থাকতে পারে না?

ভাষা কাকে বলে এটা আমরা সবাই জানি। ভাষাবিদ চার্লস হকেট মানুষের ভাষার সংজ্ঞা নির্ধারণের জন্য ১৩টা বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ভাষাকে অর্থ তৈরি করতে সক্ষম হতে হবে।

অর্থাৎ আমি ‘আম খেতে চাই’ বললে আপনি বুঝবেন ‘আমি’ নামক (সম্ভবতঃ) ‘মনুষ্য’ চরিত্র ‘আম’ নামক কোনো একটা ফল ‘খেতে’ ‘চাচ্ছি’। খেতে চাওয়া অর্থও হাতির পিঠে চড়তে চাওয়া না। চাওয়া অর্থও মাটি খোঁড়া না।

ভাষার দ্বিতীয় প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ভাষা আর্বিট্রারি। অর্থাৎ আমের নাম আমও হতে পারে। হাতিও হতে পারে। আমের নাম হাতি হলে বা হাতির নাম আম হলেও আম বা হাতির কিছু যায় আসবে না। আমার এবং আপনারও কিছু যায় আসবে না। আনলেস অফকোর্স, বাংলা একাডেমির মতো কিছুদিন পর পর ইচ্ছামত বানান পাল্টানোর মত অর্থ পাল্টানোর পরদিন আপনি দোকানে আম কিনতে গিয়ে হাতি নিয়ে বাসায় ফেরত আসলেন।

কিন্তু ভাষার সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, স্থান কাল পাত্রের উর্ধ্বে ভাষার অর্থ তৈরি করার ক্ষমতা থাকতে হবে। অর্থাৎ ২ মিলিয়ন বছর আগে আম অর্থ আম হলে আজকের দিনেও আম অর্থ আম হতে হবে। ২ মিলিয়ন বছর আগের আম আজকের দিনে এসে হাতি হয়ে যেতে পারবে না।

এইক্ষেত্রে উল্লেখ্য, হকেট শুধু মানুষের মুখের ভাষা নিয়ে কথা বললেও ভাষা বলতে আমি শুধুমাত্র বাংলা ইংরেজি হিন্দি উর্দু ফার্সি বোঝাচ্ছি না। সকল প্রকার যোগাযোগের মাধ্যমই আমার আলোচনার বিষয়। এইক্ষেত্রে আমার চিন্তাপদ্ধতি ভাষাতত্ত্ববিদ নোম চোমস্কির কাছ থেকে খানিক ধার করা। তিনি বিশ্বাস করেন, এইসব বাংলা ইংরেজি হিন্দি উর্দু ফার্সি ভাষা বলে আদতে কিছু হয় না। তিনি বলেন, একেক অঞ্চলের মানুষ একেক পদ্ধতি এবং শব্দে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতেন। বাংলা ইংরেজি হিন্দি উর্দু ফার্সি বলে আমরা আজকের দিনে যেসব ভাষা জানি, তা মূলতঃ রাষ্ট্র এবং সেই সূত্রে জাতীয়তাবাদের আধুনিক ফল। তাই ভাষার সুরক্ষা, ভাষার পবিত্রতা, ভাষার বিকৃতি, মান বা প্রমিত ভাষা এইসবও হাস্যকরভাবে অপ্রয়োজনীয় ক্ষমতার রাজনীতি ও আধিপত্যবাদকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা। তিনি বলেন, ইস্কুলে গিয়ে যেই ভাষা এবং তার ব্যকরণ শিখতে হয়, তাই বানোয়াট জিনিস। মানুষের মুখের ভাষা আলাদা করে বই পড়ে শেখার বিষয় না। মানুষ যেভাবে চোখ দিয়ে দেখতে শেখেন, সেভাবেই তিনি ভাষার ব্যবহার শেখেন। চোখ দিয়ে দেখতে শেখার জন্য মানুষকে ইস্কুলে যেতে হয় না। (সূত্র: ইউনিভার্সিটি অভ ওয়াশিংটন ইন্টারভিউ, আপ’ন রিফ্লেকশান, ১৯৮৯, লিংক ১)

এবং শুধু বাংলা বা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে না, আমরা ছবির মাধ্যমে, চিহ্নের মাধ্যমে, মুখে মুখে বলা গল্পের মাধ্যমে, সাহিত্যের মাধ্যমে, ফিল্মের মাধ্যমে, গানের মাধ্যমে, সুরের মাধ্যমে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করি। এবং আমরা বলতে আমরা শুধুমাত্র মানুষরা না, আমরা বলতে আমরা গাছপালা পশুপাখি ব্যাকটেরিয়া আর্কেয়া ভাইরাসদেরও আমি বুঝি। এবং এমনকি মাটি পানি বাতাসও বুঝি।

‘দা হিউম্যান বডি ইন সিম্বোলিজম’। হঠাৎ একটা বাক্যে আমার চোখ আটকে গেলো। “Many of the codes and laws believed by modern divines to have been direct revelations from Divinity are in reality the fruitage of ages of patient delving into the intricacies of the human constitution and the infinite wonders revealed by such a study.” এবং একইসাথে আমার চোখ পড়লো কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে। ফরওয়ার্ড এবং রিভার্স প্রাইমারের জিনেটিক কোডের ATCGGTACCTACCCGTATTC এবং CCGTTTACCTAGGGAATCGC সিকোয়েন্স দেখে আমার মাথায় যেই প্রশ্ন আসলো, সেটা হচ্ছে, এই A T C G নিউক্লিওটাইড কি কোনো ভাষার বর্ণমালা?

চোমস্কি থেকে যদি জন বার্গারের কাছে যাওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে, তিনি বলেন, আমরা যা দেখি আর আমরা যা দেখার সূত্রে জানি, এই দুই কখনোই এক না। কারণ এই দুইয়ের মধ্যে ‘মুখের’ ভাষার ব্যবধান আছে। সেইকারণে ‘অন্ধের হস্তিদর্শন’ বলে যে প্রবাদ আছে, তা আক্ষরিক অর্থেই সত্য। একজন অন্ধ মানুষ, যিনি জীবনে কিছু হাত দিয়েও স্পর্শ করেন নাই, বা একজন মঙ্গল গ্রহের এলিয়েন, যিনি এইমাত্র পৃথিবীতে এসেছেন, তার কাছে আপনাকে যদি হাতি কী বা আম কী বা গাছ কী ব্যখ্যা করতে বলা হয় বা এমনকি হাতি বা আম বা গাছের বর্ণনা দিতে বলা হয়, তাহলে আপনার লেজেগোবরে অবস্থা হবে। আমরা শব্দের ব্যখ্যায় যা বিশেষণ ব্যবহার করি, অর্থাৎ মিষ্টি আম বা সাদা হাতি বা ডাইনি বুড়ির আঙুলের মতো গাছের ডাল, তাও আমাদের নিজেদের তৈরি করা এ্যামবিগিউয়াস শব্দ। মিষ্টি অর্থ যে মিষ্টি, ঝাল না, নোনতা না, তেতো না, তাও আমাদের তৈরি করা। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে মিষ্টি অর্থ মিষ্টি হলো কেন? মিষ্টি অর্থ ঝাল হলো না কেন? মিষ্টির জায়গায় ঝাল বসালেই কি মিষ্টির ঝাল হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে? চোমস্কি এইক্ষেত্রে বলেন, মিষ্টির ঝাল হবার ক্ষমতা নাই। কারণ মিষ্টি যে মিষ্টি তা আগে থেকেই নির্ধারণ করা।

এই বায়োলজিকালি প্রিসেট হওয়া বা জিনেটিকালি ইনহেরিট করা ভাষার ব্যখ্যাকে র‍্যাশনাল বলা সম্ভব হলেও এরমধ্যেই খুব প্রকটভাবে ‘এক্সটারনাল স্টিমুলাই’ প্রসূত থিওলজিকাল এবং এ্যান্টি-এমপিরিসিজম ফ্লেবার আছে।     

হান্স হোলবেইন দা ইয়াংগারের আঁকা ‘দ্য এ্যামবেসেডরস’ আমার খুব প্রিয় ছবিদের মধ্যে একটা। ছবিটা ১৫৩৩ এ আঁকা। ছবিতে দেখা যায়, জীবন সম্পর্কে উদাসীন এমন আত্মহত্যাপ্রবণ কিশোরী মেয়ের মতো ‘কিছুতেই কিছু যায় আসে না’ চেহারার দুইজন দাঁড়িওয়ালা মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক একটা টেবিল জাতীয় বইয়ের তাকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দর্শকের পার্সপেকটিভে বামের ভদ্রলোকের নাম জাঁ দো দান্তেভিল, এবং ডানের ভদ্রলোকের নাম হোর্হে দু সাল্‌ভ্‌। বইয়ের উপরের তাক বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা আঁকা গাঢ় লাল রঙের পারসিয়ান কার্পেটে ঢাকা, এবং তার উপর টরকেটাম নামের মধ্যযুগীয় জাহাজীদের দিক মাপার যন্ত্র, মহাকাশ এবং পৃথিবীর মানচিত্র, শেপার্ডস ডায়াল নামক সূর্যঘড়ি সহ দামী দামী বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। তবে সবচাইতে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে এই দুই ভদ্রলোকের পায়ের কাছে কার্পেটের উপর তেরছাভাবে ভেসে থাকা লম্বাটে রহস্যময় একটা আকৃতি, যেটা কী বস্তু তা বোঝার উপায় নাই। শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্টি কোণে (উপর থেকে ডানে, বা নিচ থেকে বামে) ছবিটাকে ঘুরালে বোঝা যাবে, ঐ অদ্ভুত জিনিসটা একজন মানুষের মাথার খুলি। এই নির্দিষ্ট কোণকে ‘এ্যানামরফিক পার্সপেকটিভ’ বলা হয়, যেটা রেঁনেসন্স শিল্পীদের তৈরি করা একটা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে দর্শকদের একধরণের ধাঁধায় ফেলা হয়। কী কারণে, সেটা শিল্পীরাই ভালো জানেন।

‘দ্য এ্যামবেসেডরস

পৃথিবীর মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা বেশিরভাগ সময় খেয়াল করি না যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু বিষয় দৃশ্যমান এবং কিছু বিষয় সম্পূর্ণ কাল্পনিক। যেমন ধরা যাক, হাতি দৃশ্যমান হলেও হাতিকে দেখার যে ‘কাজ’ তা কাল্পনিক। ঘড়ি দৃশ্যমান হলেও সময় কাল্পনিক, টাকা দৃশ্যমান হলেও অর্থ কাল্পনিক, মৃত্যুদণ্ড দৃশ্যমান হলেও শাস্তি কাল্পনিক, বিয়ের অনুষ্ঠান এবং কাচ্চি বিরিয়ানি দৃশ্যমান হলেও বিয়ে এবং সম্পর্ক দুটাই কাল্পনিক। রেঁনেসন্স শিল্পীরা এই বিষয়টা খুব ভালো বুঝতেন। আধুনিক মানুষ বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন, তারা আদিম মানুষের চাইতে উন্নত, আগের যুগের মানুষের চাইতে বুদ্ধিমান। কারণ বেশিরভাগ মানুষ সময়কে দেখেন সরলরৈখিক একগামী পদ্ধতিতে। অথচ সময় একগামী বিষয় না, সময় বলে যদি কিছু থেকেও থাকে, তাহলে তা বৃত্তাকার পথ, এবং যে কারণে আগের মানুষ আর পরের মানুষ বলে কিছু হয় না এবং যে কারণে সময় দিয়েও মানুষের বুদ্ধিমত্তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। রেঁনেসন্স যুগের শিল্পীদের দেখলেই বিষয়টা বোঝা যায়। তারা মানুষের এই কাল্পনিক পৃথিবীর জন্য বিভিন্ন চিহ্ন তৈরিতে সিদ্ধ এবং ভাজাভাজা হস্ত ছিলেন।

মানুষের মাথার খুলির সাথে মৃত্যুর সম্পর্ক কী? অথচ মাথার খুলি বলতেই আমরা মৃত্যু বুঝি। এই লজিক্যাল সম্পর্ক কার তৈরি করা? প্রাচুর্য্য যে উচ্চ সামাজিক মর্যাদার বা ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতীক, তাই বা কার মাথা থেকে বের হয়েছে? এই যে হান্স হোলবেইনের আঁকা ছবি, ‘দা এ্যামবেসেডরস’, ছবি দেখেই যে বোঝা যায় এই দুই ভদ্রলোক ‘সাধারণ’ মানুষ না, বরং তারা ‘উচ্চ’ সামাজিক মর্যাদার, ‘জ্ঞানী’ মানুষ, তারা অনেক দেখেছেন, অনেক দেশ ঘুরেছেন, অথচ তারা তো আমাদের সাথে শারীরিকভাবে, মৌখিকভাবে, এমনকি আকার বা ইঙ্গিতে ইশারায় কথা বলছেন না, তাহলে তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে কিভাবে? জন বার্গার তার ‘ওয়েজ অভ সিইং’ বইয়ে লিখেছেন, “and the visual desirability of what can be bought lies in its tangibility, in how it will reward the touch, the hand, of the owner.” অর্থাৎ অর্থারোপ, মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। (কেন স্বাভাবিক, তা নিয়ে পরে কথা বলা যাবে) আমাদের কল্পনাকে কোনো নির্দিষ্ট মেটাফিজিকাল চিহ্ন বা শব্দের মাধ্যমে আমরা প্রকাশ করি এবং বিশ্বাস করি সেই মেটাফিজিকাল চিহ্ন এবং শব্দ বাস্তব।

অবশ্য বাস্তবতা কী, সেটা অন্য প্রসঙ্গ।   

এইখানে যেটা মজার বিষয়, সেটা হচ্ছে, একটা ছবি ভালো না খারাপ, একটা গান শিল্পমানে উচ্চরুচি না নিম্ন, একটা ফিল্ম ‘সুপিরিয়র’ আর্টহাউজিয় ‘ক্লাসিকাল’ না রজনীকান্ত আর জসিম শাবানার ট্র্যাশ, একটা কবিতা রবীন্দ্রনাথিয় উচ্চমার্গ নাকি সর্পরাজ এমাজউদ্দিনের সর্বরোগের মহৌষধ বটিকা বিক্রির নিম্নমানের ছড়া, তাও নির্ধারিত হয় আমাদের বাস্তবতার সাথে কাল্পনিক মেটাফিজিকাল চিহ্ন আর শব্দের উপস্থিতির উপর। অর্থাৎ সোজা বাংলায় বলতে গেলে, যেই ছবি বা যেই কবিতা যত ভাবের জগতে (ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত) রহস্যময়, তা ততই উচ্চমার্গ। তা ততই সূক্ষ্ণ। তা ততই দামী। অথচ এই ভাবের রহস্যময় জগতও আমাদের কল্পনা। আমাদের নিজেদের মাথায় তৈরি হওয়া জগত। এই দাম আমাদের তৈরি করা। এই অর্থও আমাদের তৈরি করা। এই টাকাও আমাদের তৈরি করা।

এবং তাও কোনো নির্দিষ্ট লজিকাল প্যাটার্নে না।

এবং এই অর্থারোপের অনেকখানিই সুকুমারের ‘ছিলো বেড়াল হয়ে গেলো রুমাল’ স্টাইলে করা হয়েছে।   

শুধুমাত্র শিল্পের ক্ষেত্রেই না, খেয়াল করলে দেখা যাবে, আমাদের শরীর এবং ঈশ্বরকল্পনাতেও এইসব চিহ্ন এবং শব্দের উপস্থিতি আছে। লালনের গানেই তার নিয়মিত উদাহরণ পাওয়া যায়। প্রথিবীর প্রায় প্রতিটা মিথোলজি এবং কিছুক্ষেত্রে  আধ্যাত্মিকতাবাদ এবং ধর্মগ্রন্থে আমাদের শরীরের ৪টা প্রধান কেন্দ্রকে ৪টা ভৌত উপাদান (আগুন, পানি, বাতাস, মাটি), আমাদের মাথাকে ইথার, আমাদের ৭টা ভাইটাল অর্গানকে ৭টা গ্রহ, শরীরের ১২টা প্রধান অংশকে নক্ষত্রপুঞ্জের ১২টা রাশি হিসাবে দেখা হয়েছে। শরীরের ডানপাশকে পুরুষ এবং বামপাশকে নারী হিসাবে বলা হয়েছে। অনেক পেগান ধর্মে আমাদের মেরুদণ্ডের ভিতরের মজ্জাকে ঈশ্বর হিসাবে ধরা হয়েছে।

কথা হচ্ছে, আমাদের শরীরে ভাইটাল অর্গান কি মাত্র ৭টা?
না।

আর ভাইটাল অর্গানের সংজ্ঞাটাই বা কী?

সুতরাং আমাদের শরীরের ৭টা ভাইটাল অর্গানের সাথে ৭টা গ্রহের তুলনা দেয়া বুদ্ধিমান মানুষের খামখেয়ালি ছাড়া আর কিছুই না। আপনার ইচ্ছা করলে আপনি তর্ক করতে পারেন এই বলে যে মানুষের ভাইটাল অর্গান শুধুমাত্র ১টা। এবং তা হচ্ছে ব্রেইন। কারণ সমস্ত শরীর ‘মারা’ গেলেও ব্রেইন জীবিত থাকতে পারে। আর ব্রেইন জীবিত থাকার অর্থই হচ্ছে ‘আপনার’ জীবিত থাকা। তাই আপনি ১০-১০ করে আঙ্গুলে গোনেন বলেই পৃথিবীতে গোল্ডেন রেশিও দেখতে পান, গাছের পাতায়, মাছ আর পাখির ঝাঁকে ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স টের পান। যদি ১০ এর জায়গায় ৪ বা ১৬ দিয়ে গুনতেন, তাহলে পৃথিবীতে গোল্ডেন রেশিও বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকতো না। যদি বা থাকতো, তার অনুপাতও ভিন্ন হতো।

কারণ, আমরা যা দেখি, তা আমরা দেখতে চাই বলে দেখি। আমরা যা ভাবি, তা ভাবতে চাই বলেই ভাবি। আমরা যা বলি, তা দেখি আর ভাবি বলেই বলি। আমরা যা বুঝি, তা বুঝতে চাই বলে বুঝি। আমাদের ভাষা, তা শরীর বোঝার ভাষা হোক, ঈশ্বর বোঝা বা প্রেম বোঝা বা পাশের বাসার মোকলেসের মা কেন আপনাকে এবং আপনার পরকীয়া বা আপনার বুক থেকে সরে যাওয়া ওড়না নিয়ে সারাদিন ভাবেন- তা বোঝাই হোক না কেন, এইসব বোঝাবুঝির ভাষা আমাদের জিনেটিক মেমোরিতে গাঁথা প্রাচীন চিন্তার অনর্থক যোগাযোগ, যার উপর পরবর্তীতে অর্থারোপ হয়েছে।

আমাদের শরীরের ৭টা ভাইটাল অর্গানের সাথে ৭টা গ্রহের তুলনা দেয়া বুদ্ধিমান মানুষের খামখেয়ালি ছাড়া আর কিছুই না। আপনার ইচ্ছা করলে আপনি তর্ক করতে পারেন এই বলে যে মানুষের ভাইটাল অর্গান শুধুমাত্র ১টা। এবং তা হচ্ছে ব্রেইন। কারণ সমস্ত শরীর ‘মারা’ গেলেও ব্রেইন জীবিত থাকতে পারে। আর ব্রেইন জীবিত থাকার অর্থই হচ্ছে ‘আপনার’ জীবিত থাকা। তাই আপনি ১০-১০ করে আঙ্গুলে গোনেন বলেই পৃথিবীতে গোল্ডেন রেশিও দেখতে পান, গাছের পাতায়, মাছ আর পাখির ঝাঁকে ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স টের পান। যদি ১০ এর জায়গায় ৪ বা ১৬ দিয়ে গুনতেন, তাহলে পৃথিবীতে গোল্ডেন রেশিও বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকতো না। যদি বা থাকতো, তার অনুপাতও ভিন্ন হতো।

মানুষকে তার জাতি, রাষ্ট্র, গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গে বিভক্ত করে প্রত্যেককে একক সত্তা হিসাবে দেখার ভঙ্গি আধুনিক। এই পার্থক্য শুধু মানুষে মানুষে করা হয় নাই, প্রাণীজগতের প্রত্যেক প্রাণীকেও তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আলাদা করা হয়েছে। পৃথিবীকেও প্রাণীজগত, জড়জগত এইভাবে ভাগ করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণের জন্য এই পার্থক্য জরুরী বিষয় অবশ্যই, অর্থাৎ হিউম্যান এ্যানাটোমি পড়তে গিয়ে আমরা যেভাবে ক্রেনিয়াল রিজন আর থোরাটিক বা সেরভিকাল রিজন বলে মাথা আর বুক আর গলা আলাদা করে দেখি, সেভাবে প্রাণীজগত আর জড়জগতকে আলাদা করা সম্ভব নিশ্চয়ই। কিন্তু ফাংশনালিটির প্রশ্নে মাথাকে গলা থেকে বা গলাকে বুক থেকে আলাদা করা সম্ভব না। আধুনিকতাবাদের সমস্যা হচ্ছে, পড়ালেখার জন্য মাথা এবং গলা এবং বুক কেটে আলাদা করার পরে পড়ালেখা শেষ হলেও তা আর জোড়া দেয়া হয় নাই। আধুনিকতাবাদ তাই মানুষের মাথা, গলা এবং বুকের কাটা অংশ নিয়ে বসে বসে ভাবছে, মানুষটা উঠে হাঁটা শুরু করছেন না কেন?

গতবছর মরোক্কোর কাসাব্লাংকায় আমার মরিয়ম নামের একজন ইরাকি মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। মরিয়ম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে ঘুরে ঘুরে বাচ্চাদের ছড়া আর গান সংগ্রহ করছেন। সেই নিয়ে একটা বইও লিখছেন উনি। আটলান্টিকের পাড়ে বসে সূর্য ডোবা দেখতে দেখতে আমরা মাহিয়া নামের ডুমুরের মদ খাচ্ছি। মাহিয়া শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘বেঁচে থাকার তরল’। মরিয়ম আমার গ্লাসে নিজের গ্লাস টোকা দিয়ে হঠাৎ খুব নিচুস্বরে গান গাইতে শুরু করলেন। মদ খাওয়ার পরে আমার এক বাংলাদেশি বন্ধু আছাড়িপিছাড়ি দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করতেন। সেই হিসাবে মদ খেয়ে গান গাওয়া খারাপ কোনো বিষয় না। গানটা লিবিয়ান ভাষায় গাওয়া, আমি তার কোনো অর্থই বুঝলাম না। আমার জন্ম লিবিয়াতে হলেও লিবিয়ান ভাষা আমার শেখা হয় নাই। আর লিবিয়ার সবাই আরবীতেও কথা বলেন না। গান শুরু হতে না হতে আমাদের আশেপাশে একগাদা মানুষ জড়ো হয়ে গেলেন। একজন চুল লম্বা পাংক ধাঁচের মিশরি ছেলে কোত্থেকে একটা ‘ঔদ’ নিয়ে মাটিতে বসে গানের সাথে তাল দিতে শুরু করে দিলেন। ঔদ হচ্ছে উকেলেলে বা ম্যান্ডোলিন বা লিউটের মত দেখতে একধরণের আরবী বাদ্যযন্ত্র, যেটা সচরাচর রাস্তাঘাটে দেখা যায় না। তবে উকেলেলের চাইতে ঔদের সুর ভারি। আমি খেয়াল করলাম কোনো কারণ না থাকা সত্ত্বেও গানটা শুনতে শুনতে আমরা মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। গানটার নাম সং অভ সংস বা সং অভ সলোমন (শির-হা-শিরিম)। রাজা সলোমন এখানে রাজা না, তিনি একজন প্রেমিক। তার প্রেমিকা জেরুজালেমের মেয়ে, বেদুইন কাদিরদের তাবুর মত কালো তার গায়ের রঙ। তিনি বনের ভেতরে সলোমন আর নিজের জন্য পাতার বিছানা তৈরি করতে করতে তার সখীদের বলছেন বিছানা তৈরি হওয়ার আগেই যেন কেউ তার মত কেউ প্রেমে অন্ধ না হন। ইত্যাদি ইত্যাদি।  

গান শেষে আমি বেশ অবাক হয়ে মরিয়মকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই গান তোমরা বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর সময় শোনাও? এটা তো পিওরলি সেক্সুয়াল গান!”   

মরিয়ম এর উত্তরে যা বললেন, তা আরও আশ্চর্য্যজনক। তিনি বললেন, যৌনতার ঋণাত্মক সংজ্ঞা এবং ভাষা আমাদের তৈরি করা। শিশুরা যৌনজ্ঞান নিয়েই জন্মান এবং তাই স্বাভাবিক। ‘বয়স’ হিসাব করে যৌনতা নিয়ে কথা বলার ধারণা পশ্চিমাদের তৈরি করা, মধ্যপ্রাচ্য বা আরবে সেই চল ছিলো না কোনোদিন। যৌনতা এই অঞ্চলে স্বাভাবিক বিষয়। ধর্ম আর সংস্কৃতি একই বিষয় না, ওয়াহাবিজম আসার পরে— ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।  

আমি এই নিয়ে আরও কিছুক্ষণ গায়ের জোরে তর্ক করলাম। এবং খুব স্বাভাবিক কারণেই তর্কে হারলাম। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে বহু বছর কাটালেও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আমার মতামতের বেশিরভাগটাই পশ্চিমা মিডিয়ার তৈরি করে দেয়া মতামত।

রাজা সলোমন ইহুদি, খ্রিশ্চান এবং মুসলিম- এই তিন সেমেটিক ধর্মেরই নবী। সলোমনকে নিয়ে যেসব মিথ শোনা যায়, তার মধ্যে একটা হচ্ছে, তিনি পশুপাখিদের সাথে কথা বলতে পারতেন। তালমুদ সহ ত্বানাক এবং কুরানের আয়াতে দেখা যায়, সলোমন এবং হুদহুদ নামের পাখির মধ্যে কথা হচ্ছে।

যারা বাসায় কুকুর বা বিড়াল পালেন, তারা খুব নিশ্চিতভাবেই বলতে পারবেন, কুকুর বিড়ালরা মানুষের কথা এবং অনুভূতি বুঝতে পারেন। কুকুর বিড়ালের সাথে কথা বলার জন্য কাউকে ডায়ান ফসি বা স্যার ডেভিড এ্যাটেনবরাও হতে হয় না, কুকুর বিড়ালকেও ‘কোকো’ দা গোরিলা হতে হয় না। এবং এই যোগাযোগ মানুষের বাংলা বা ইংরেজি এবং কুকুর বিড়ালের নিজস্ব ভাষার বাইরে অন্য কোনো ভাষায় হয়, যেটা পর্যবেক্ষণ করেন এমন যেকোনো মানুষ টের পাবেন। গবেষকরা দেখিয়েছেন, প্রাপ্তবয়স্ক বিড়ালরা যে ‘মিউমিউ’ শব্দ উচ্চারণ করেন, তা তারা শুধুমাত্র মানুষের সাথে করেন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক বিড়াল অন্য বিড়ালের সাথে যোগাযোগের সময় কখনোই ‘মিউমিউ’ করেন না (সূত্রঃ লিংক ২)। এর কারণ বিবর্তনবাদ। ধারণা করা হয়, বিড়ালরাই সম্ভবতঃ একমাত্র প্রাণী, যারা নিজেরা মানুষের কাছে এসে ‘গৃহপালিত’ হয়েছেন। কুকুর বা ঘোড়া বা শুকরের মত প্রাণীদের মানুষ নিজ স্বার্থে ‘পোষ’ মানানোর ব্যবস্থা করলেও বলা হয়ে থাকে বিড়ালরা নিজ স্বার্থে মানুষকে ব্যবহার করে নিজেরাই গৃহপালিত হয়েছেন।

(বিড়ালরা বেশিরভাগ সময় কী কারণে মানুষদের সাথে রাজা বাদশাহ প্রভুর মত ব্যবহার করেন, সেটা নিশ্চয়ই এখন বুঝতে পারছেন।) 

প্রজাতি ধরে প্রাণীদের আলাদা করা হলে, অর্থাৎ ইংরেজরা ইংরেজিতে কথা বলবেন আর বাঙালীরা বাংলায় কথা বলবেন, এইভাবে ভাবলে বিড়াল বা কুকুররা আমাদের চাইতে ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন তাই ভাবা স্বাভাবিক। যেইসব মানুষ মানুষকে ‘শ্রেষ্ঠ’ প্রাণী বলে ভাবেন, তারা আত্মগর্বে এটাও বলতে পারেন যে মানুষের ভাষা যেভাবে বিকশিত হয়েছে, মানুষের ভাষা যেমন বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে জটিল বা উন্নত, তার ধারে কাছে বিড়াল বা কুকুররা আসতে পারেন নাই বলেই আমরা কুকুর বিড়ালের সাথে ইংরেজি বা বাংলায় কথা বলি না।

এইক্ষেত্রে যেই প্রশ্ন জরুরী, সেটা হচ্ছে, শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয়ের পদ্ধতিটা কী? কে নির্ণয় করছেন? আর তার প্রয়োজনীয়তাই বা কী? কথা হচ্ছে, কুকুর বেড়ালের মানুষের সাথে কথা বলার প্রয়োজন আছে কিনা? ইতালি বা ফ্রান্সে বা জাপানে গেলে দেখা যাবে, একজন ইতালিয়ান বা ফ্রেঞ্চ বা জাপানিজ মানুষ ইংরেজি জানা সত্ত্বেও ইংরেজিতে কথা বলছেন না। আপনি ইতালিয়ান বা ফ্রেঞ্চ বা জাপানিজ না জানলে আপনার সমস্যা, উনাদের না। কুকুর বেড়ালদের নিজেদের ভাষা আপনি না বুঝলে সেটাও আপনার সমস্যা, কুকুর বেড়ালদের না। আপনি কারুর ভাষা না বুঝলেই সেই ভাষা ভাষার বিচারে ‘দুর্বল’ বা ‘অনুন্নত’ হয়ে যায় না।   

প্রাচীন বিশ্বাসে ফুলকে আদর্শ সৌন্দর্য, পদ্মকে শ্বাশত প্রজ্ঞা, ফুলের কুঁড়িকে প্রজনন যন্ত্রের প্রতীক হিসাবে ধরা হতো। বারো পাঁপড়ির ফুলকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও ঈশ্বর, নয় পাঁপড়ির ফুলকে মানুষ, সাত পাঁপড়ির ফুলকে সৌরজগত ও আইন, পাঁচ পাঁপড়ির ফুলকে ইন্দ্রিয় ও রহস্য, তিন পাঁপড়ির ফুলকে দেখা হতো পৃথিবী হিসাবে। এছাড়াও ফুলের মাধ্যমে লিঙ্গ ও যোনিকে বোঝানো হতো। পৃথিবীর প্রায় সকল প্রাচীন পেগান ধর্মেই আজকের দিন পর্যন্ত লিঙ্গ এবং যোনি পূজা হয়। আর্ক, গার্ডেন অভ ইডেন, সপ্ত আসমানের আরশ, vesica piscis or oval nimbus নামের আলোর মেঘ, হোলি গ্রেইল এইসবই যোনির প্রতীক। অন্যদিকে পিরামিড, ওবেলিস্ক, কোন, ক্রুশ, মিনার এইগুলি লিঙ্গের প্রতীক।

প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী, পশুপাখিরা শুধুমাত্র ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী না। তারা প্রত্যেকে ঈশ্বর এবং সেই সূত্রে মানুষের একেকটা বৈশিষ্ট্য ধারণ করেন। যেমন, বিড়াল প্রাকৃতিক শক্তি এবং কিছুক্ষেত্রে অমরত্বের প্রতীক, গরু আত্মা স্থানান্তরের বাহনের প্রতীক, নেকড়ে অশুভর প্রতীক, কুকুর অতীন্দ্রীয় ক্ষমতার প্রতীক, ঘোড়া আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক, মাছ জীবন এবং সৌভাগ্যের প্রতীক ইত্যাদি।

ছবি- মৎসাবতার ও বিষ্ণু

শুধুমাত্র পশুপাখি নন, গাছপালাকেও প্রাচীন বিশ্বাসে ‘আলাদা’ ভাবার চল ছিলো না। গাছপালাকে আমাদের চরিত্রের বিকশিত রূপ হিসাবে দেখা হতো। সততা, ধৈর্য্য, শক্তি বলে আধুনিক আমরা চারিত্রিক যে গুণাবলির বিকাশ নিজেদের মধ্যে দেখি, তা প্রাচীন মানুষেরা প্রকৃতি থেকে খুঁজে নিতেন। অর্থাৎ মানুষের বৈশিষ্ট্য মানুষের ‘নিজের’ মধ্যে পাওয়া যাবে না, বরং তা প্রকৃতিতে পাওয়া যাবে। সম্ভবত এটাই নিজেদের শরীরকে বা জামাকে বা ঘরকে ফুলপাতা দিয়ে সাজানোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিলো। প্রাচীন বিশ্বাসে ফুলকে আদর্শ সৌন্দর্য, পদ্মকে শ্বাশত প্রজ্ঞা, ফুলের কুঁড়িকে প্রজনন যন্ত্রের প্রতীক হিসাবে ধরা হতো। বারো পাঁপড়ির ফুলকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও ঈশ্বর, নয় পাঁপড়ির ফুলকে মানুষ, সাত পাঁপড়ির ফুলকে সৌরজগত ও আইন, পাঁচ পাঁপড়ির ফুলকে ইন্দ্রিয় ও রহস্য, তিন পাঁপড়ির ফুলকে দেখা হতো পৃথিবী হিসাবে। এছাড়াও ফুলের মাধ্যমে লিঙ্গ ও যোনিকে বোঝানো হতো। পৃথিবীর প্রায় সকল প্রাচীন পেগান ধর্মেই আজকের দিন পর্যন্ত লিঙ্গ এবং যোনি পূজা হয়। আর্ক, গার্ডেন অভ ইডেন, সপ্ত আসমানের আরশ, vesica piscis or oval nimbus নামের আলোর মেঘ, হোলি গ্রেইল এইসবই যোনির প্রতীক। অন্যদিকে পিরামিড, ওবেলিস্ক, কোন, ক্রুশ, মিনার এইগুলি লিঙ্গের প্রতীক।

(যারা যোনি এবং লিঙ্গ শুনেই ছিঃছিঃ করেন, তাদের উদ্দেশ্যে রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের একটা কথা উল্লেখ করতেই হয়। সেটা হচ্ছে, “Honi soit qui mal y pense

আমি এর তরজমা দিতে আগ্রহী না)

নূহ নবীর গাছ

প্রাচীন এইসব বিশ্বাসকে কুসংস্কার বলে সহজেই উড়িয়ে দেয়া যায় সত্য, কিন্তু যেই জিনিস কোনো ভাবেই অগ্রাহ্য করা যাবে না, তা হলো, এই প্রতিটা বিশ্বাস, প্রতিটা টোটেম, প্রতিটা এমব্লেম আমাদের কালেক্টিভ আনকনশাসনেসের সাথে, আমাদের ভাষার সাথে যুক্ত হয়ে আছে। আমাদের একটা ধারণা হচ্ছে, ভাষা মানুষকে যুক্ত করে। না। ভাষা মানুষকে বা কাউকেই যুক্ত করে না। মানুষ বরাবরই যুক্ত। মানুষ মানুষের সাথে যুক্ত, প্রকৃতির সাথে যুক্ত, ঈশ্বরের সাথেও যুক্ত। ঈশ্বর, প্রকৃতি, মানুষ বলে আলাদা কিছু হয় না। ঈশ্বর, প্রকৃতি, মানুষকে তখনই আলাদা করা সম্ভব, যখন তারা নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে স্বায়ত্বশাসনের দাবী করে আধুনিকতাবাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের চর্চা করে নিজস্ব অঞ্চল আর নিজস্ব মুদ্রা ঘোষনা দিয়ে অন্যের সাথে বিজনেস ট্রানজ্যাকশান শুরু করার কথা চিন্তা করে। তাই মানুষের ভাষা, ইংরেজের ভাষা, বাঙালির ভাষা, চাকমার ভাষা, অহমীয়ার ভাষা, গাছের ভাষা, বিড়ালের ভাষা, সাহিত্যের ভাষা, সুরের ভাষা, ছবির ভাষা বলে কিছু হয় না। আমরা একে অন্যকে বুঝি না বলে আমাদের যোগাযোগের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়। আমরা একে অন্যের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় নাই বলেই ভাষা নিয়ে আমাদের আইডেন্টিটি পলিটিক্স তৈরি হয়। আধিপত্যবাদের রাজনীতি তৈরি হয়। ভাষা নিয়ে আন্দোলন করতে হয়। আমরা নিজেদের বুঝি না বলে একগাদা চিহ্ন দিয়ে কৃত্রিম ভাষা তৈরি করে আমাদের সত্যিকারের ভাষা হাতড়াই।    

যেইদিন আমরা নিজেদের টের পাবো, যেইদিন আমরা বুঝবো আমরা কেউ আলাদা না, সেইদিন হয়তো জিনেটিক কোডিং এর ATCGGTACCTACCCGTATTC এবং CCGTTTACCTAGGGAATCGC সিকোয়েন্স থেকেই আমরা নিজেদের ভাষা আবিষ্কার করতে পারবো। সেইদিন আমাদের আর বাংলা ইংরেজি ম্যান্ডারিন জার্মান আরবী ফ্রেঞ্চ তঞ্চংইগ্যা হিব্রু সংস্কৃত নামের আরোপিত ভাষার দরকার পড়বে না।

কারণ

যিনি নিজের কথা বোঝেন, তার নিজের সাথে কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না।

যিনি নিজেকে বোঝেন, তার ভাষা নৈঃশব্দের।       

সূত্র:

লিংক ১- https://www.youtube.com/watch?v=hdUbIlwHRkY
লিংক ২- https://sciencenorway.no/animal-kingdom-communication/your-cat-meows-mostly-for-you/1578244

গ্রন্থসূত্র:
1.Berger, J., Dibb, M., & BBC Enterprises. (1972). Ways of seeing. London: BBC Enterprises.
2. Hall, M. P. (1988). The secret teachings of all ages: An encyclopedic outline of Masonic, Hermetic, Qabbalistic, and Rosicrucian symbolical philosophy : being an interpretation of the secret teachings concealed within the rituals, allegeries, and mysteries of all ages. Los Angeles, Calif: Philosophical Research Society.

ছবির সূত্র:
Hall, M. P. (1988).

নাদিয়া ইসলাম

লেখক, গবেষক, ভিগান, অজ্ঞেয়বাদী, বিড়ালপ্রেমিক, নারীবাদী এবং কনস্পিরেসি থিওরির একনিষ্ঠ ভক্ত। জন্ম ১৯৮৫ সালে

  

Share