ধ্বংসস্তূপ জুড়ে শুধু মোসাদের ভারি বুট, শকুনের ছায়া

।। অর্ণব সাহা ।।

পিছল, ঢালু সিঁড়িতে পা রাখার মতো
শূন্য বরফের ফাঁদে হড়কে যাওয়া মন
মুহূর্তে রুখে দাঁড়ায়। ফিরে যেতে বলে
আমার গ্রাউন্ড জিরো, স্বপ্ন-সৌধের
বিস্ফোরক সমাধিতে শান্ত পাখিদের ওড়াউড়ি

আমারও বিভ্রম হয়। দৃশ্যের ভিতরে ঢুকে পড়ি…

যদি বাস্তুদেবতার কাছে প্রার্থনা করি: হে আমার
শৈশবের মলিন আকাশ
একটা দামি ইরেজার দিচ্ছি। সমস্ত কালিমা মুছে দাও!

অট্টহাসি। ধ্বনি থেকে প্রতিধ্বনি। বারুদের ধোঁয়া
অবরুদ্ধ ফিলিস্তিন উপত্যকা জুড়ে শুধু বাচ্চাদের লাশ…

তোমার হরিৎক্ষেত্র: এতোটুকু তুলনা তুমি রাখোনি ঈশ্বর!
আবাদের জন্য জমি, বাকিটুকু নৈমিত্তিক ফলাহার
সেচবর্জিত এই আনত ভূমিকে প্রণাম করি
অকর্ষিত মাটির ঢেলা ভেঙে যারা গড়েছিল নাবাল
বালুচর
অর্কিড বাগান, কুয়ো, বাচ্চাদের অবুঝ লুকোচুরি

মাত্র একটা ক্ষেপনাস্ত্রে গুঁড়িয়ে গেল পার্ক,
উপাসনালয়
ধ্বংসস্তূপ জুড়ে শুধু মোসাদের ভারি বুট। শকুনের ছায়া।

পা টেনে ধরেছে পূর্বজদের ছায়া
গতিরোধ করে স্মৃতির লোকাল ট্রেন
পুনর্জন্ম এ জীবনে ফিরবে না
বন্ধক রাখা পিছুটান, রোদ, মায়া

আমাকে শেখায় বড়ো দেরি হয়ে গেছে
শৈশব এক রুদ্ধ তুফান মেল
পেরিয়ে গিয়েছে তেপান্তরের মাঠ
ভুল কাটাকুটি সাদাকালো পর্দায়

একটা লেখাও দিগন্ত টপকাবে?
কেন মৃতপ্রায় ফেরারি অক্সিজেন?
কারা তার নামে হুলিয়া রটিয়েছিল,
বেঢপ, তীক্ষ্ণ বেপরোয়া সাইরেনে!

“তোর ওই দু-হাত খসে যাবে…”

অসহ্য ঘূর্ণির নীচে ভেসে ওঠে ধুলোর ক্যানসার!

সৌরপথ। কথা বলে লক্ষ লক্ষ শব্দের জীবাণু

একদিন জীবাণুগুলো আমার পরমপ্রিয় ছিল
আমি তাদের আঁচ মেখে রোদ পোহাতাম

আমাকে হজম করে নিয়েছিল নরকের কুমির

আমার নিয়তি ছিল ঢেউয়ের ধাক্কায় চূর্ণ হওয়া…

পাখির পালক ওড়া মেয়ে আমার শুয়ে আছে রুগ্ন,
বিছানায়!
রক্তে ভেসে যাচ্ছে মহাকাশ…

ফ্যাকাশে চামড়ায় ওর বিকেলের অবসন্ন ছায়া
খড়ের বাসায় ফিরবে মা-চড়ুই, বাচ্চা কোলে নিয়ে…

এরপরেও ঝড় উঠবে। বর্ষায় কলকাতা ডুবে যাবে
বুড়োদের পায়ে পায়ে কালো গামবুটের শহর

মৃত্যুর লোমশ হাত এসেছিল। রুখে দিয়েছি তাকে
মৃত্যুর দানব ফের হাত বাড়ালে আটকে দেব তাকে…

যে মৃত্যু চায়, তার ‘কসাই’ ডাকনাম

দুহাতে চ্যানেল। ঢুকছে সমুদ্র ছেঁচে স্যালাইন
ক্ষীণ জীবনের শব্দ। রক্তের গর্জন।

প্রত্যেক ফোঁটায় আমি মৃত্যুকে মুছে যেতে দেখি!

ফের উঠে দাঁড়াচ্ছে এক ঝিমিয়ে-পড়া ফুল

আকাশের দিকে তার পাপড়ি খুলে রাখা…

আঙুল ডুবিয়ে তোলো সমুদ্রের জল ছেঁচে নুন
নুনের পাহাড় ভেঙে পানপাতা মুখ ভেসে যায়
এ দেহ ভিতর থেকে কাঠামোয় ভেঙেচুরে গেছে
মগজে ঢুকেছে ঘূণ। পোকায় ছয়লাপ দুই হাতে
দমচাপা কান্না আর আশ্চর্য মেদুর বরাভয়…

তোমাদের দরজায় এসেও ফেরত যেতে হয়!

পিছল, ঢালু সিঁড়িতে পা রাখার মতো
শূন্য বরফের ফাঁদে হড়কে যাওয়া মন
মুহূর্তে রুখে দাঁড়ায়। ফিরে যেতে বলে
আমার গ্রাউন্ড জিরো, স্বপ্ন-সৌধের
বিস্ফোরক সমাধিতে শান্ত পাখিদের ওড়াউড়ি

আমারও বিভ্রম হয়। দৃশ্যের ভিতরে ঢুকে পড়ি…

সমস্ত বিগ্রহই ৯০ ভাগ মিথ্যে দিয়ে তৈরি
সমস্ত সাফল্যের ৮০ অংশ জল
স্মৃতিভেজানো বাড়ির ভিতর অনধিকার প্রবেশ
আততায়ীর
সে জানে ভাঙা কার্নিশ আর ফাটা শার্সিতে
ঠিকরে যাওয়া রোদে
স্তব্ধ হয়ে যাবে তার অপরাধপ্রবণ মন
তাকেও করে তুলবে স্মৃতিকাতর
অন্ধকারে কুঁচকে যাওয়া তার আত্মায়
নিকোটিনের ক্ষত
সেখানেই ফসল ফলিয়েছে শ্বাপদ
মুখ তুলেছে বাঁকা ঠোঁটের পানকৌড়ি, স্বপ্নে ঘাই
দিচ্ছে অজস্র মৌরলা!

১০

মা-বাবা, কোথায় তোমরা? এই নিঃস্ব মরজগতের
খানা-খন্দ, পথ ভুল ক্যামেরায় তুলে রাখছ
অজ্ঞাতলোক থেকে?

ইসরো আজ মহাকাশে চন্দ্রযান পাঠিয়ে দিয়েছে

চাঁদের মাটিতে গর্ত, গিরিখাত, বহু বছরের
অব্যবহৃত যোনি যেরকম শুকনো হয়ে থাকে!
জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে হাততালি দিচ্ছে কবন্ধেরা…

আমি মরে যাব, মাগো, হিম নৈঃশব্দ্যের
অচেনা বাতাবরণ বিষের লতার মতো পা বেয়ে উঠে আসছে
গলা কামড়ে নিতে!

কেউ নেই পৃথিবীতে যে আমায় শুশ্রূষা দিতে পারে…
—মা, তুমি কোথায়?

অর্ণব সাহা

কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গেনব্বই দশকের অন্যতম প্রধান কবি। পেশায় অধ্যাপক। তাঁর কয়েকটি কবিতার বই : ধর্ম নেই কোকাকোলা নেইব্ল্যাকহোলের বাকি অংশ, প্যারানইয়া, ২০ জুনের ডায়েরি, নিচু গিলোটিননীল রঙের হাভেলিস্বপ্নের কশেরুকা ।

Share