ফলের সাথে পাখির আশিয়ানা

।। শুভাশীষ ভাদুড়ী ।।

জঠর ফেটে বীজের, হাওয়া-জলে
পাতা ফুলের রঙিন ছলেবলে
চারাও তবে বৃক্ষ হল…
এখন তার শরীরে পোকা,
শিকড়ে রস,
ফলের সাথে পাখির আশিয়ানা

গুপ্তচর

তুমি চলে গেলে। এতদূর যে মধ্যে-মধ্যে মনে হয় ব্যবধানটা অপার, নির্জন। দূরত্ব এতটা দেখে, আমি এই নির্জন কে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখি। এই যে নির্জনতা, তার সন- তারিখ, সালতামামি আমি জানিনা।
মনে পড়ে, এক গাজনের দিনে, সে কি বেহায়া ধুলোঝড়, যেন কেয়ামতের ক্ষণ, চারদিকে রাঙা আভা পাতলা হয়ে এলো, ভেসে চলা রেনুর মতো, বায়ে বায়ে উড়ে চলা ধুলোর পোকা-পতঙ্গ, আর তারপর বৃষ্টি না হওয়া গম্ভীর মেঘের ছায়া ফেলা চোত বিকেল। ঝড় উবে গেলে, তোমাকে দেখলাম নাট মন্দিরের সামনে,স্থির।
বিষণ্ণ, ধূসর ধুলোর ছাই-রঙে মাখামাখি কাপড়চোপড় ,সারা গতর। চারপাশ ছাইরাঙ্গা নির্জনে স্তব্ধ। নিমীলিত। তোমাকে যেন এই তিন ভুবনের কেউ ,এই ধরাধামের ,এই জল মাটির কেউ বলে চেনাই যায় না
তুমি চলে গেলে তারপর। সূর্য ডোবার আগে, ঢাকের আওয়াজে এলাকা যখন থরোথরো স্বরে বেজে উঠল, নীলার্কের নাম-ডাকে, দেখি চড়কের গাছে পা বেঁধে ,মুখ মাটির দিকে করে, ঝুলে রয়েছে এক গাজন সন্নেসি।
তোমাকে খুঁজতে যাইনি আর বৃথা।

কবিতার মতো কোনও পথশ্রম

এই যে রাস্তা দেখছো খোয়া-ইট বাঁধানো ,এটা আমার । রাস্তা বেড় দিয়ে নুয়ে পড়া দেশি খেজুর গাছগুলো, তাদের সাপটে লতিয়ে ওঠা অপরাজিতার নীল ছোপ, তাও। পাশে এই যে দীঘির মতো টানা পুকুর ,তার পানা ভরা শান্ত জলের উপর বয়ে চলা রাজহাঁসের মত স্বচ্ছ, অদৃশ্য হাওয়া-বাতাস, এসব আমার । যদিও বিরক্তিকর, তবু, ভাসমান প্লাস্টিকগুলো, আমার। প্লাস্টিকের অভিযোজন এড়িয়ে ইতি উতি ফুলেফেঁপে ওঠা দুটো একটা শাপলা -শালুক আমারই সেটা।
উল্টো দিকের যে ঘাটে তুমি এলে ,তাও আমার। ওই যে জলে পাতলা করে গা চুবিয়ে, আলতো ডুবে আছে যে পৈঠাখানি ,যার ওপর পা আধাভেজা করে ,তুমি এদিক পানে, আমার দিকে তাকিয়ে আছো, আমারই বটে।
কী যেন একটা ভাসান কাজে তুমি পাড়ে এসেছ। এরপরেই যাবে চৌমাথার দিকে, জানি আমি। এসেছ ,এসে তাকিয়ে আছ আমার দিকে, অথচ এই যে প্রাচুর্য ,এই যে বিস্তার ,সে যে কার বশে, সেটা জানলে না । অবিশ্যি, জানলেও মানতে না এত কিছু।
কিন্তু যদি বিশ্বাস করতে কথাগুলো ,তাহলে আর চৌমাথা যেতে দুপুর রোদ মাথায় করে, খোয়া-ইটের রাস্তা বেয়ে ,আধা-মাইল বেশি ঠেঙিয়ে ,বিঁড়ি টানতে টানতে, গজর গজর করতে করতে, ঘুরে আসতে হতো না তোমাকে। জলের ওপর দিয়ে সটান পা ফেলে হেঁটে আসতে পারতে,এই দিকে। কিছুটা পথশ্রম বাঁচত তোমার।

মণিকাঞ্চন

ছাই হয়েছে আমার, আমি
চলোচ্ছ্বাসের বশে
সকল কাঁটা ধন্য করা
নিত্যনতুন রসে
ভাঙ্গা কুলোর দোলায় চেপে
ছড়িয়ে পড়ে দেখি
ধুলোর পাশে জীবন আমার
চমকপ্রদ, এ কী!

ছাই যে হল আমার, আমি
ভাগ্যবান বটে,
দিন দুপুরে নিন্দে মন্দ
বুনো হাওয়ায় রটে,
গায়ের সোহাগ, পায়ের আগড়
খসলে তখন দেখি–
গাদার ভেতর সাপের মণি,
চমকপ্রদ, এ কী!

শ্রী মুখ

ডিমের আয়ু শেষ করে,
পাখিটি তার সুরক্ষার আচ্ছাদন
ফাটিয়ে ফেলে
উড়িয়ে দেয় ডানা

জঠর ফেটে বীজের, হাওয়া-জলে
পাতা ফুলের রঙিন ছলেবলে
চারাও তবে বৃক্ষ হল…
এখন তার শরীরে পোকা,
শিকড়ে রস,
ফলের সাথে পাখির আশিয়ানা

চতুর্মুখ সৃষ্টিশীল,
সামনে তার লালন
পাশে আলো আঁধার,
পিছন মুখে ধ্বংসে মোড়া চমৎকার

সৃষ্টি তার স্রষ্টাকেই
হত্যা করে মুখ দেখায়

যে মুখে বড় মায়া মেশানো আলো,
যে মুখ বড় কষ্টিপাথর কালো

বন্ধু

তোমায় বিনে পরান বাঁচে না,
ডান চক্ষুর পাতা নাচে কার!
ধান্দাবাজির কুটকোশলে
উপচে পড়ে বাজার থলে,
সুজন আমার কাপড় কাচে না।

দিনমানেও অন্ধকারে ঘর,
পড়শি পিরিত ভীষণই দুষ্কর,
তবুও দেখো অলপ্পেয়ে
সুপারি গাছ উঠছে বেয়ে,
লোকে, তোমায় চিনেছে তস্কর।

তোমায় ছাড়া এ জান বাঁচে কি?
খিড়কি দোরে গোঁসায় দিলাম খিল,
যেমন তোমার আসা-যাওয়া–
বদনামে নাম গাইছে হাওয়া…

চোখের পাতা আর তো নাচে নি।

কিসমত

দিন শুরুর আলো
আমায় বেদম চাবকালো,
বিকেল আলোয় শরীর রাঙাতাপ

আমি মা’য়ে খেদানো ছেলে
নাদান ,এলেবেলে ,
ছায়াবিমুখ রাতের কোলে
অযথা দিই ঝাঁপ

অন্ধকারে শুয়ে
গড় করেছি ভুঁয়ে, দেখো
ফোসকা পড়া দগ্ধ কৃতাঞ্জলি

আলো-কালোর শেষে
এই ফুর্তিবিলাস দেশে
জবার মালায় ,হাড়িকাঠে
বেহুদা রঙ্গোলি

শুভাশীষ ভাদুড়ী

জন্ম ১৭ মে, ১৯৭০, কলকাতায়। কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সমাজ কর্মী। শুভাশীষের কবিতা হিন্দি, ইংরাজি ও ফরাসী ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি পুরস্কার, কর্ণাটকের জ্ঞানোদয় সাহিত্যভূষণ ও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার অর্জন করেছেন।

Share