খোপ

।। হামিরউদ্দিন মিদ্যা ।।

খড়ের ছাউনি দেওয়া দু-কুঠুরি উপর-নীচে মাটির ঘর ছিল আমাদের। ঘরের পেছন ধারে আব্বাকে বলে বুবু অনেকগুলো খোপ টাঙানো করিয়েছিল। কত যে পায়রা ছিল তখন! সারাদিন বাক-বাকুম বাক-বাকুম করে কলরব করত। পায়রাগুলো ছিল বুবুর জানের জান। প্রতিদিন নজরদারি করত। কতবার দেখেছি মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ড্রাম থেকে মুঠো মুঠো চাল বের করে ছড়িয়ে দিয়েছে। পায়রাগুলো খোপ থেকে নেমে খুটে খুটে খেত, বুবু কাছে গেলেও উড়ত না। তাতে বুবুর কী আনন্দ! ঝড়ে-পানিতে কোনো খোপ ছিঁড়ে গেলে কিংবা নষ্ট হয়ে গেলে আব্বাকে বলে আবার নতুন খোপ টাঙানো করাত। আব্বা বাঁশের পরতা লাগিয়ে চেপে খোপ টাঙিয়ে দিত। মাটির ঘরটা যখন ভাঙা হল, তখনই পায়রাগুলো বাসা ছাড়া। বেশ কয়েকদিন দিশেহারা হয়ে মাথার উপর চক্কর মারল। মা বেঁচে তখন। আকাশের পানে মুখ তুলে জিভ চুকচুক করে বলল, খোকা, ও খোকা। পায়রাগুলো কুথায় থাকবেক বাপ? কুনু ব্যবস্থা করতে লারবি? এতদিন ধরে আছে ওরা, আজ হঠাৎ…

খোপ

অনেকদিন পর দুলালপুরের বড়বুবু এসেছে। আগে পরবে-পালায় তাহলেও আসত। পৌষ পরবে আমাদের গ্রামে পীরপুকুরের পাড়ে মেলা বসে প্রতিবছর। দুলাভাই বুবুকে সঙ্গে নিয়ে মেলা দেখতে আসত, কখনো ঈদের সময়। এখন ভাগ্নে আর ভাগ্নিকে পাঠিয়ে দেয়। দুই ভাইবোনে আমদ-ফূর্তি করে যায় বছরের দু-চারটা দিন। বুবুর বাপের ঘর আসার ফুরসৎ নেই। কারও বিপদ-আপদ হলে খবর দিলে ছুটে আসে, নচেৎ এমুখো হয় না। 

এবারে আব্বার খবর শুনে পড়িমরি করে একলাই চলে এসেছে বুবু। কোলেপিঠে মানুষ করেছে বাপটা, তার খবর শুনে বুবু কী না এসে পারে! দুলাভাই আসতে পারেনি। দামোদরের পাড়ে গ্রাম। আলু চাষ, বাদাম চাষ, ধান চাষ, সবজি চাষ কতরকম কাজ! সেই সব ফেলে শ্বশুরকে দেখতে আসার সময় কোথায়? বুবুও ঘর ছেড়ে বেরতে পারে না। এখন ভাগ্নিটা বড় হয়েছে, রেঁধে-বেড়ে খাবে ওরা, তাই বুবু খানিকটা নিশ্চিন্ত। 

বললাম, একটা ফোন করে বেরতে পারিসনি বুবু! আমি খেয়াঘাট থেকে নিয়ে আসতাম। বাস-টোটো ধরে এত হায়রানি করে এলি, দুলাভাই শুনলে কী মনে করবে বল তো!
–না ভাই, আবার কষ্ট করা কেনে! ওই চলে এলাম। একটু পরেই তুকে ইস্কুল ছুটতে হবেক, আমি কী বুঝি না?
–তা যা বলেছিস বুবু। সকাল থেকে মাধ্যমিকের খাতা দেখতে বসেছিলাম, এই উঠলাম। কোমর-কাঁকাল সব ধরে গেল। শুধু তো স্কুল করেই ডিউটি শেষ নয়, হাতে রাশিরাশি কাজ! 

ঘরের মেঝেতে তালাইয়ের উপর শুয়ে আছে আব্বা। কয়েকদিন ধরেই বলছে, বড়খুকি আসেনি? আমার বড়খুকি! দেখতে চাইছে বড়বুবুকে। ছোটবুবুরা এসেছিল, ওরা কাল ঘর গেছে। আজ বড়বুবুকে সামনে দেখে গড়-গড় করে চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে আব্বার।
ববু আব্বার কপালে হাত বুলিয়ে শুধাল, এখন কেমন লাগছে গো আব্বা? জানটা ভাল নাই?
– না মা, উঠতে বসতে লারচি। গায়ে একদম বল নাইকো। তুকে দেখার জন্যে জানটা আমার খালি হাঁকপাক করছিল।
– আসতে কী মুন চাই না আমার! চাষাভুষোর ঘর-সংসার, রাতদিন খেটে খেটেই মল্লম।বাপের ঘরে দু-চারটা দিন যে জিরিয়ে যাব, তার সুময় কুথা?

বুবু আব্বার কাছ থেকে উঠে এসে আমাদের খাটের উপর বসল। বলল, তা ভাই, সেদিন কী হইল আব্বার? ডাক্তারে কী বলেচে?

– আব্বার স্বভাবটা তো জানিস বুবু। একেই স্পেসারের রোগী, তাও মাঠ-ঘাট করে বেড়াচ্ছে। কত বকাঝকা করি, মুনিষে কাজ করবে, তোমার এত ছুটাছুটির কী দরকার? তা আমার কথা কানে নেয় না। সেদিন প্রচন্ড রোদ-গরমে মাঠ গেছিল। মাঠ থেকে হাঁকপাঁক করে এসেই উঠোনে উলটে পড়ে গেল। বালতি বালতি পানি ঢাললাম মাথায়। তাতেও উঠেনি। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করি। এখন সম্পূর্ণ রেস্ট নিতে বলেছে।

– হঃ। তা ছুটাছুটি করবেক বইকি! নামাজ-রুজার ধান্দা নাই, এখনো উনি দুনিয়া দুনিয়া করে বেড়াচ্ছে। শুন ভাই আমি বলে যাচ্ছি, এবার ভাল হয়ে উঠুক, আর কুথাও বেরুতে দিস না। আজ উঠোনে পড়ল তাই দেখলি, মাঠে-ঘাটে পড়ে গেলে কে দেখত বলদিনি?

আমার বউ নুরেসা ভাত বাড়তে বাড়তে ফোড়ন দিল, তা হ্যাঁ বুবু, আমাদের তো বলে বলে ব্যাত পচে গ্যাছে। তুমি এবার আচ্ছা করে বলে যাবে দিকিনি।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম বুবু ঘরে নেই। নুরেসা বলল, তুমার বুবু গাঁ বুলতে বেরুল। নাসিমকেও সাথে লিয়ে গ্যাছে।

– সেকি! নাসিম টিউশন যাইনি?
– ফুপুর খুব লাগাটে হয়ে গ্যাছে। কত করে বললাম পড়তে যা। কথা কানে লেয়নি।
– ঠিক আছে নাও, আজকের দিনটা থাক।

বড়বুবুর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরই আমাদের ঘরে অন্ধকার নেমে এল। বুবুই ছিল সংসারের শিরদাঁড়া। মরদের মতো সব কাজে হাত লাগাত। চাষের সময় ওড়নাটা গামছার মতো কোমরে বেঁধে লেগে পড়ত। পায়ে ঝাড়া মেসিনে আমাদের জমির ধানগুলো নিজেরাই ঝেড়ে নিতাম। মুনিষ করতে হত না।

তখন ক্যানেলে, ডহরে, পুকুরে কত মাছ ধরে এনেছে বুবু! সকাল হলেই ছোট ছাকনি জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত বুবু। আর মায়ের কী গাল! আইবুড়ো বিটিছেলের এত বাড় ভাল লইকো। লোকে কী বলবেক লো মুখপুঁড়ি? 

বুবু কথা কানে নিত না। ছেকে ছেকে চুনোপুঁটি, চিংড়ি মাছে কোচর ভর্তি করে বাড়ি ফিরত। কোনওদিন পেঁছে ভর্তি শুশনি শাক, নুনুই শাক, খোলাংকুচি। মায়ের সামনে যখন ঢেলে দিত, তখন সমস্ত মান অভিমান উবে গিয়ে মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠত। ছোটবুবু এসব কিছুই করতে পাইনি। এ যুগের মেয়ে, স্কুল-কলেজ করেই পার করে দিল বাপের ঘরে। এখন বিয়ে হয়ে সংসারের ঘানি টানছে।

সন্ধেবেলায় উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে বুবু। নুরেসা দরজার কাছে দাঁড়িয়েই ডাক দিল, ও বুবু ঘরে এসো। সিরিয়াল দেখবে।
বুবু বলল, একদিন দেখে সিরিয়ালের আমি কী বুঝব বলদিনি। ওর বাপটা ছিল হাজি। এখনও টিভি ঢুকোইনি ঘরে। তার থেকে উঠোনে কিছু পেতে দাও, ফাঁকে বসি খানিক।

আব্বার খাটিয়াটা ঘর থেকে বাইরে বের করলাম। নুরেসা জামবাটি করে মুড়ি, শশা কুচি, পেঁয়াজ দিয়ে খেতে দিল আমাদের। বলল, তুমরা বসে গল্প করো, আমি কিরণমালাটা দেখেই চলে আসছি।

নাসিম খাটিয়ায় বসে উশখুশ করছে। ক্লাস থ্রির ছাত্র। স্কুল থেকে ফিরে বিকালে টিউশন, এসে খানিকক্ষণ টিভিতে কার্টুন দেখে। তারপর আমার কাছে পড়তে বসে। মাস্টার বাপ হয়ে ছেলেটাকে পরের হাতে ছেড়ে দিলে চলে? নুরেসার কড়া অভিযোগ।
– আব্বা চলো, পড়াবেনি?
– না খোকা, আজ তোর ছুটি। বস এখানে।

নাসিম হাসল। খুশি হয়েছে।

বুবুর সঙ্গে গল্প করছি, হঠাৎ পায়রার বাক শুনে আমাদের চোখ চলে গেল দালানের কার্নিশটার দিকে। বারান্দা থেকে বাল্বের সাদা আলোটুকু রান্নাশালের দেওয়ালে ঠিকরে পড়ে ঝুরঝুর করে ভেঙে গেছে। তারই ক্ষীণ আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে পায়রাগুলো। আজই আমার নজরে প্রথম পড়ল। কয়েকদিন ধরেই কোথা থেকে উড়ে এসে ছাদের উপর বসছিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে বসার জায়গা না পেয়ে উড়ে চলে যাচ্ছিল। কার্নিশের নীচে পানি আড়ালের জন্য সামন্য ঢালু ছাউনির মতো করা আছে টালি দিয়ে। পায়রাগুলো ওখানেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আশ্রয় নিয়েছে।

বুবু বলল, ভাই তুর কি চোখের পটি নাই? কয়েকটা খোপ টাঙাতে লেরেচিস?মাস্টারি চাকরী করচিস, এই তুর বিবেক!

–-তু বিশ্বাস কর বুবু, আজই চোখে পড়ল আমার।

হঃ, মিছেকথা আর বলিস না দিনি। আমিও এলাম, আর ওমনি পায়রাগুলো খবর পেয়ে ড্যাডেং ড্যাডেং করে হাজির হল। তুর ব্যাপারস্যাপার আমি বুঝি না?সারাদিন কানের গুড়ায় বকবক করবেক, হেগে হেগে পচিয়ে দিবেক, গন্ধে টিকতে লারবি-খুব ঘিন লাগে লাই?
–- তুই ভালোই বলেছিলিস বুবু। ঘরটা যখন করলাম চিলেকোঠায় কয়েকটা পায়রার খোপ বানিয়ে রাখলে হত।
–- এবার দেখ। বুবুর কথাটা ফ্যালনা নয়, তখন তো কথাটা কানে লিসনি।

খড়ের ছাউনি দেওয়া দু-কুঠুরি উপর-নীচে মাটির ঘর ছিল আমাদের। ঘরের পেছন ধারে আব্বাকে বলে বুবু অনেকগুলো খোপ টাঙানো করিয়েছিল। কত যে পায়রা ছিল তখন! সারাদিন বাক-বাকুম বাক-বাকুম করে কলরব করত। পায়রাগুলো ছিল বুবুর জানের জান। প্রতিদিন নজরদারি করত। কতবার দেখেছি মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ড্রাম থেকে মুঠো মুঠো চাল বের করে ছড়িয়ে দিয়েছে। পায়রাগুলো খোপ থেকে নেমে খুটে খুটে খেত, বুবু কাছে গেলেও উড়ত না। তাতে বুবুর কী আনন্দ! ঝড়ে-পানিতে কোনো খোপ ছিঁড়ে গেলে কিংবা নষ্ট হয়ে গেলে আব্বাকে বলে আবার নতুন খোপ টাঙানো করাত। আব্বা বাঁশের পরতা লাগিয়ে চেপে খোপ টাঙিয়ে দিত। মাটির ঘরটা যখন ভাঙা হল, তখনই পায়রাগুলো বাসা ছাড়া। বেশ কয়েকদিন দিশেহারা হয়ে মাথার উপর চক্কর মারল। মা বেঁচে তখন। আকাশের পানে মুখ তুলে জিভ চুকচুক করে বলল, খোকা, ও খোকা। পায়রাগুলো কুথায় থাকবেক বাপ? কুনু ব্যবস্থা করতে লারবি? এতদিন ধরে আছে ওরা, আজ হঠাৎ…
বিরক্ত হয়ে বললাম, নিজেরাই রান্নাঘরে বাস করছি এখন, আর উ করছে পায়রার চিন্তা! গাঁয়েতে ঘরের অভাব আছে নাকি? যেখানে হোক আশ্রয় পেয়ে যাবেক।

বুবু বলল, তা না হয় পাবেক ভাই, কিন্তু দালান ঘরটা করা হলে খোপ রাখবি তো?
–- তোর মাথায় গোবর পুরা আছে বুবু, জ্ঞানগম্যি নাই। দালানঘরেও পায়রা রাখবি বলছিস? ঘরের পেছনটা হেগে-হেগে কি করেছিল বল তো? নতুন ঘরে ওসবের ঠাঁই দিলে ঘরের কোনো শ্রী থাকবেনি।
মা চাপা শ্বাস ছেড়ে বলল, পায়রা হল সুখের প্রতীক। যেখানে সুখ পায় সেখানেই ওরা আশ্রয় নেয়। ঘরের আয়-বরকত বাড়ে। জোর করে সুখকে পায়ে ঠেলে দেওয়া কী ঠিক হবেক? দেখ বাপ যা ভাল বুঝিস কর। এখন বড় হয়েচিস, কী আর বলব!

আমি সবেমাত্র চাকরি পেয়েছি তখন। ধুকিয়ে ধুকিয়ে চলা সংসারটা নতুন গতি ফিরে পেয়েছে। ঘরটা তোলার একটা চাপ আছে মাথায়। রান্নাশালটা সারিয়ে অস্থায়ী বসবাস করছি। ছোট্ট ঘরে পাঁচটা মানুষের থাকা, শোওয়া খুব মুশকিল! খোপগুলোর মধ্যে একটাতে পায়রার দুটো বাচ্চা ছিল। এইসবে পালক গজিয়েছে।আব্বা পড়ল মহা চিন্তায়।
–- কী করব বলদিনি ছা’গুলোকে? কাদেরও খোপে দিয়ে আসব?

পায়রাগুলো বাসা ছাড়া হয়ে যাওয়াতে বুবু খুব কষ্ট পেয়েছিল। বাচ্চাগুলো পেয়ে অনেকটা হালকা হয়েছে। আব্বার যুক্তিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলে, তাতে কুনু লাভ হবেকনি আব্বা। অন্য পায়রাতে ছা’গুলো ঠুকারে ঠুকারে মেরে দিবেক আর মানুষের হাত দেওয়া ছা ছুবেকনি।
–- তাইলে কী করবি রে মা?
–- এনিয়ে তুমি চিন্তা কর না আব্বা। আমি খাইয়ে-দাইয়ে বড় করব এগুলো। পোষ মানাব।

টিনের একটা খোপের ভেতর নরম পোয়াল ভরে বাসার মতো বানাল বুবু। সেখানে বাচ্চাগুলো ভরে দরমার ছেঁচাতে ঝুলিয়ে দিল খোপটা। রোজ নিয়মিত সময় খোপ থেকে বের করে সরষে, খুঁদচাল খাইয়ে দিত।

একদিন ঝটপট শব্দ শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল। আমার পিছু পিছু বুবুও উঠে এসেছে। টর্চ জ্বেলে দেখলাম খোপের মুখটা খোলা, সেখানে একটি মাত্র বাচ্চা ভয়ে এককোণে সিঁটিয়ে আছে। আর একটা গেল কোথায়? যা আন্দাজ করেছিলাম তাই হল।খুঁজতে খুঁজতে টর্চের আলোটা এক জায়গায় থমকে গেল। মাটির উপর পড়ে আছে একথোক পায়রার পালক, আর ফোঁটা ফোঁটা তাজা রক্ত।

খোপ থেকে বের করে একানে বাচ্চাটা বুবু সে রাত্রে সিথেনের পাশে রাখল। সারারাত চোখের পানি ফেলল। মা বুঝতে পেরে বুকে টেনে নেয় বুবুকে। মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলে, তুই কি এখনো ছোট আছিস রে মা? একটা পায়রার জন্য চোখের পানি ফেলছিস। আর কয়েকমাস বাদেই না তুর বিয়ে! জীবনে বেঁচে থাকতে গেলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।
–- আমি ঘর ছেড়ে কুথাও যাবনি মা!
–- ধুর খেপি! মেয়েরা হল পাখির জাত। যেখানেই যাই বাসা বানিয়ে লেয়। বিয়েটা হোক, তারপর দেখবি বাপের ঘরটা ভুলেই যাবি।

পরেরদিন সকালে খোপটা খুলে রান্নাশালের চালে উঁচু জায়গা দেখে বেঁধে দিলাম। আর খটাশে নাগাল পাবে না।

দেখতে দেখতে পায়রাটা বড় হয়ে গেল। বুবুকে আর খাওয়াতে হয় না। নিজেই খোপ থেকে উড়ে উঠোনে নেমে পড়ে। চরতে চরতে উঠোন পেরিয়ে খামারে চলে যায়। সারাদিন পর সন্ধেই ঘরে ফেরে। বুবু চাল ছড়িয়ে দেয়। সারাদিন কোথায় কি খেয়েছে না খেয়েছে তার ঠিক নেই!

বুবু বলল, বুঝতে পারছিস ভাই, এটা ষাঁড়ি পায়রা।
–- কী করে বুঝলি?
–- যখন বাক দেয় গলার স্বরটা শুনিসনি?
–- আমি বুবু এতসব বুঝি না।

দালানঘরটা করা হয়ে গেছে। মসজিদের ইমাম সাহেবকে এনে ঘরে মিলাদ-শরীফ করালাম। কয়েকজন মুসুল্লিকে নিমন্ত্রণ করে রাত্রে খাওয়ালাম। নতুন ঘরে প্রবেশ করার এটাই চল।

হঠাৎ একদিন একটা ষাঁড়া পায়রা কোথা থেকে উড়ে এসে দালানঘরের ছাদে বসে বাক দিতে থাকল, বাক-বাকুম বাক-বাকুম। আমাদের সাঁড়ি পায়রাটা কোথায় ছিল কে জানে, ওই বাক শুনে উড়ে গিয়ে ওটার পাশে বসে খুনসুটি জুড়ে দিল।

বুবু যেদিন আমাদের ঘরটা ফাঁকা করে দুলালপুরে চলে গেল, সেদিন থেকে আর পায়রাটাকে খোপে দেখতে পাইনি।

বুবু বলল, গাঁটা আর চিনায় যায়নি রে ভাই!এর মধ্যেই কত বদলে গেছে।
–- কীরকম শুনি?
–- মাটির ঘর আর চোখেই পড়লনি-সব পাঁকা বাড়ি হয়ে গেছে। কুনু বাড়িতেই পায়রার খোপ চোখে পড়েনি। শুধু মকছেদ চাচার ছাড়া। বাবারে! চার-পাঁচটা খোপে কত যে পায়রা বসেছে!
–- মানুষ এখন নিজেদের থাকার ঘরই পাচ্ছে না, আর পায়রার চিন্তা কে করবেক বল তো?
–- সব স্বার্থপর হয়ে গেল, সব স্বার্থপর।

নাসিম বলল, সেলফিস।
বুবু আর আমি দু’জনেই হেসে ফেললাম। তা শুনে নুরেসা এগিয়ে এল।
–- এত হাসির কী কথা হচ্ছে শুনি?

বুবু পায়রাগুলো দেখাল নুরেসাকে। নুরেসা নাক সিঁটকালো। ছ্যাঁ ছ্যাঁ! আবার ওগুলো বসেছে? আমি রোজ তাড়াচ্ছি।
–- আর বাগাতে লারবে ভাবি, আর বাগাতে লারবে। ওই দেখো। -বলে বুবু আঙুল বাড়িয়ে দেখাল।

ভেন্ডিলেটারের ফাঁকটাতে দেখলাম দুটো পায়রা মাথা গোঁজার চেষ্টা করছে।

কিছুক্ষণ আগেই এশার আজান দিয়েছে মোয়াজ্জিন। আকাশে তারা ফুটেছে অনেক। এমন তারা ভরা আকাশের নীচে বহুদিন বসিনি। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে। তখন সন্ধে হলেই উঠোনে পানি ছিটিয়ে ঝাঁট দিয়ে মাদুর বিছিয়ে পড়তে বসতাম। একটা লন্ঠনে বুবু আর আমি। লন্ঠনের যেদিকের কাচটা বেশি উজ্জ্বল সেদিকটা বুবু ঘুরিয়ে নিত নিজের দিকে। বলত, আমি তুর থেকে উঁচু ক্লাসে পড়ি, তাই আমার বেশি আলো। আমাদের ঝগড়া থামত মায়ের বকুনি খেয়ে।

পাশেই গড়াগড়ি দিত মা আর আব্বা। তালপাতার পাখা নেড়ে বাতাস করত শুয়ে শুয়ে। দাদো আসত প্রতিদিন। লাঠিটা নিয়ে ঠুক ঠুক করে হাজির হত।বেতের মোড়াটা ছিল দাদোর আসন। কতরকম যে গল্প বলত! সকালে উঠেই তাহের চাচার মুদীর দোকান থেকে কয়েকটা বিস্কুটের খালি পেটি, খালি টিন কিনে আনলাম। তা দেখে বুবু খুশিতে ডগমগ।

বাঁটালি দিয়ে ঠুকে ঠুকে টিনের মুখগুলো কাটতে বসলাম। ওদিকে ঠক ঠক শব্দ শুনে ঘরের ভেতর আব্বা উঠে বসেছে।
–- কী হইছে গো? কীসের শব্দ?
বুবু বলল, জানো আব্বা, কার্নিশে অনেকগুলো পায়রা বসেছে। তাই খোপ বানাচ্ছে ভাই।
–- কতদিন পর ওরা এল! ঘরে সুখ ফিরে এল গো!

পাড়া থেকে একটা পরতা জোগাড় করে খোপগুলো কার্নিশে সেটে দিলাম পেরেক দিয়ে। সন্ধেতে পায়রাগুলো সব দখল করে নিল। আব্বা বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে, মনটা খুব খুশি।

সকালে হঠাৎ দুলাভাইয়ের ফোন এল। বুবুকে ডেকে দিলাম। কিছুক্ষণ কথা বলেই বুবু ব্যাজার মুখে ফোনটা আমার হাতে দিয়ে দিল। দেখলাম বুবুর মুখটা একরাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।
–- কী হয়েছে বুবু?
–- আজই ঘর যেতে বললেক আমাকে। বিকালে ঘাটে নামিয়ে দিয়ে আসবি ভাই।
–- দু’দিন না আসতে আসতেই ফোন? তাও তো ভাগ্নি-ভাগ্নে ঘরে আছে, রাঁধা-খাওয়ার তো কোনো ঝামেলা নাই।
–- মেয়ে মানুষের কী মরদের মুখের উপর কথা চলে রে ভাই? এতেই রেগে কাঁইকুঁই করছে। আবার আসব লে।
–- আর আসিস কই? ভাগ্নে-ভাগ্নিকে পাঠিয়ে দিয়েই দায় সারিস।
–- একথা কেনে বলচিস ভাই! তুই ক’দিন যাস আমার ঘর? আমি কী তুর পর?

স্কুলে এসেও পড়ানোই মন দিতে পারলাম না। কতগুলো অঙ্ক কষতে দিয়ে চেয়ারে বসে রইলাম ঠেস দিয়ে। বুবুর কথাটা খচখচ করে লাগছে বুকে। দিনকে দিন কেমন স্বার্থপর হয়ে উঠছি। এমন এক অদৃশ্য সুতোই বাঁধা পড়েছি, যা ছিঁড়ে বেরনো দুঃসাধ্য! 

বিকালে বুবুকে খেয়াঘাটে নামাতে এলাম। নদীটা এখানে ধনুকের মতো বাঁক নিয়েছে। দহ সৃষ্টি হয়েছে। এক গলা পানি। ঘাটের কাছে পারাপারের নৌকা বাঁধা। বিকাল পাঁচটাই খেয়া। ইতিমধ্যেই কয়েকজন যাত্রি চেপে বসেছে। বুবুকে উঠিয়ে দিলাম।

বাইকটা স্ট্যান্ড দিয়ে কিছুটা নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসলাম। আমার সামনে দামোদর। এখন কোনো জাগতিক টান অনুভব করছি না। দামোদরে সব ভেসে গেছে। ওই দূরে কত নাম না জানা গ্রাম। কত জনপদ! গ্রামগুলোকে ছোট ছোট খোপের মতো দেখাচ্ছে। পায়রার মতো ডানা মেলে মেলে বুবু এগিয়ে যাচ্ছে তার খোপের দিকে। এক সময় পশ্চিম দিকটা লাল হয়ে মুঠো মুঠো আবির ছড়িয়ে দিল দামোদরের পানিতে। দূর্গাপুরের কোনো কারখানার চিমনির আড়ালে সূর্যটা পেকে লাল টুকটুকে হয়ে টুপ করে খসে পড়ল। খেয়াল হল সন্ধে হয়ে গেছে। অমনি সুতোই টান পড়ল। উঠে পড়লাম। আমাকেও খোপে ফিরে যেতে হবে। 

হামিরউদ্দিন মিদ্যা

জন্ম ১৪ই জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর একটি প্রত্যন্ত গ্রাম রূপপালে। বাঁকুড়া খ্রীষ্টান কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক। প্রান্তিক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই মাঠঘাট চাষবাসের সঙ্গে তাঁর সখ্য ভাব গড়ে ওঠে। লেখালেখির নেশা স্কুল লাইফ থেকেই।  প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। সেই থেকেই লিখে চলেছেন বিভিন্ন বাণিজ্যিক অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায়। ওয়েব পোর্টালেও লিখে থাকেন।
গল্পগ্রন্থ: আজরাইলের ডাক(২০১৯) ও মাঠরাখা(২০২২)। ২০১৮ সালে ‘গল্পলোক’ পত্রিকা ‘প্রতিশ্রুতিমান গল্পকার সম্মান’ এ ভূষিত করে। এছাড়াও প্রথম গল্পসংকলন ‘আজরাইলের ডাক’ -এর জন্য ২০২১ সালে পেয়েছেন ‘দৃষ্টি সাহিত্য পুরস্কার। লেখালেখির জন্য ২০২২ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে পেয়েছেন ‘ইলা চন্দ স্মৃতি পুরষ্কার’। ‘মাঠরাখা’ গল্পগ্রন্থটির জন্য পেয়েছেন কৃত্তিবাস পত্রিকা প্রদত্ত ‘সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সম্মাননা ২০২২’ ও ২০২৩ সালে পেয়েছেন ‘সাহিত্য অকাদেমী যুব পুরস্কার পেয়েছেন।
তাঁর বেশকিছু গল্প ইংরেজি ও হিন্দিতেও অনুবাদ হয়েছে। ‘কবর’ গল্প অবলম্বনে একটি শর্টফিল্ম তৈরি করেছেন ভারতের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত পরিচালক রণজিৎ রায়।

Share