ঈশ্বর দর্শন!

গদ্য সাহিত্য’

।। জেসমিন নাহার।।

কোভিড-১৯ ওদের বুঝিয়ে দিয়েছে কাজ না করলে ভিক্ষাবৃত্তি ওদের সম্বল। ওরা কখন ঘুমায় আর কখন ওঠে, না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। এবং ওদের যে টাকা নেই তাও কিন্তু না। কারো কারো নিজস্ব ভ্যান আছে। টাকা কম পড়লে ভ্যান বেচে। আবার বাড়লে কেনে। কেউ রাস্তায় পাটি পেতে ঘুমায়। আবার কেউ চৌকিতে। কেউ কেউ তাদের নিজস্ব ভ্যানের উপরে পাটি পেড়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে। তারা রাতেই ঘুমায়। দিনে তাদের পথচারীদের চলাচলের সুযোগ করে দিতে হয়। যদি খুব প্রয়োজন পড়ে ঘুমের তাহলে রেশমার মতো তৎক্ষণাৎ পাটি বিছিয়ে বালিশ মাথায় দিয়ে কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে ঘুম যায়। ওরা পথের বাসিন্দা। কেউ বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করে। কেউ  বারণ করলে বলতে পারে “ওতো বেশি কতা কওন কিল্লাইগগা। একডা মাইনষের উপকার করলে কিচ্ছু অয়না।”

ঈশ্বর দর্শন!

সম্ভবত শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, জীবনের পরমার্থ ঈশ্বর দর্শন। তাঁকে দেখবার জন্য প্রায়ই আমি কাতর হয়ে পড়ি। তখন ঈশ্বরকে রাস্তায় রাস্তায় খুঁজতে থাকি। সেইসব জায়গাও বাদ রাখি না, যা অবলা নারী হিশাবে আমার জন্য আসলেই বিপজ্জনক। কিন্তু যে অভিজ্ঞতা নিয়ে নিয়ে ফিরে আসি সেটা বেশ দামি অলংকারের মতো।

গ্রীনলাইফ হাসপাতাল, গ্রীনরোড। গ্রীনরোডের পাশে সামনে রাখা সারিসারি রিক্সা আর সি এন জি। হাসপাতালের মধ্যে আছে নানান রোগে আক্রান্ত রোগী, তাদের সেবায় নিয়োজিত সেবিকা, ডাক্তার এবং তাদের স্বজনেরা। রিক্সা-সি এন জির সাথে দাঁড়িয়ে আছে রোগী বহনকারী এম্বুলেন্স। রাস্তায় আছে সারি সারি চা, পান আর ফলের দোকান। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে রিক্সা, সি এন জি, লেগুনা, প্রাইভেট কার সহ ছোটখাটো যানবাহন। মাঝে মাঝেই লাগছে যানযট।

গ্রীনলাইফ হাসপাতালের বিপরীতে ডাস্টবিন। ডাস্টবিনের পাশে রিক্সা আর ভ্যানগাড়ি সারি করে রাখা। ডাস্টবিনের পঁচা ময়লার গুমোট-গন্ধ চারিদিকে কিন্তু সেই গন্ধকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। যেন এই গন্ধ এখানকার মানুষের চিরপরিচিত, নাকে সয়ে যাওয়া।

ডাস্টবিনের শেষে একটা এম্বুলেন্স দাঁড়ানো। এম্বুলেন্সের পেছনে মালবহনকারী দুটি ভ্যান। একটি ভ্যান খালি, আরেকটি ভ্যানে বসে তিনজন ব্যক্তি ফোনে লুডু খেলছে। আর সেই লুডু খেলার দর্শনার্থী আটজন ব্যক্তি। দর্শনার্থীদের মধ্যে একজন শিশু আরেকজন মহিলা। মেয়েটার কাপড় মলিন। শিশুটির গায়ের গরম কাপড়ও মলিন। কিন্তু মেয়েটার চুল গুলো মাঝে মাঝে ধূসর বর্ণের রঙ করা। নাকে নথ। চঞ্চল মেয়ে। আঠারোর বেশি বয়স নয়। কিন্তু এক সন্তানের মা। মাঝে মাঝেই খেলা দেখে হেসে ওঠছে মেয়েটা।

লোকগুলোর পেছনে আরেকটা ভ্যান এসে থামলো। দর্শনার্থী লোকগুলো হৈ হৈ করে সদ্য রাখা ভ্যানের উপরে বসে হঠাৎ কি যেন ফিসফিস  আলাপ শুরু করে দিলো। এই লোকগুলোই যেন খেলুড়ে তিনজনের খেলা জমিয়ে রেখেছিল। ওদের চলে যাওয়া মাত্র তাদের খেলা বন্ধ হয়ে গেল। তারা কথা বলছে কিন্তু কথার মধ্যে ঝগড়ার সুর। একজন বাকি দুজন কে বলছে, ”আমি কি তর টেহাই খাই বাইনচোত, আমি গাঞ্জা খাইয়া পইড়া থাহি আমার টেহাই, আমি নাকি প্রতি বেলা গাঞ্জা খাইয়া পইড়া থাহি, কও দেহি, এই হালার পুত হালা, আমার এম্বুলেন্স চালায় কেডা? তুই?” সঙ্গী লোকদুটোর একজন একেবারে চুপ। আরেকজন বললো, “তুর টেহাই তুই মক্কাত যা গা, স্যারো হুনলে তর চাকরি থাকব না, তাই কওয়া।”

এম্বুলেন্স চালক গাঁজা খায় শুনে আমি স্তম্ভিত। অসুস্থ বা কখনো মৃত মানুষের গাড়ি চালক নেশা দ্রব্যে আসক্ত! সারি সারি রিক্সা ভ্যানের শেষে একটা ফুচকা চটপটির দোকান। লেখা আছে এখানে স্পেশাল দই ফুচকা পাওয়া যায়। এই দোকানের ফুচকা চটপটি বেশ মজার। বেশি মজা টকটা। ডাস্টবিন, রিক্সা, ভ্যান, ফুচকার দোকানের আড়ালে মানুষের নিত্য যাতায়াতের পথ। যাকে শহরের মানুষ ফুটপাত বলে থাকে। এই ফুটপাতের অর্ধেক সরকারি কোয়ার্টারের দেয়াল ঘেঁষে পলিথিনের কাগজে ঢাকা দেয়া জিনিস। পাশেই ডাস্টবিন দেখে হঠাৎ মানুষ ভাবতে পারে ফেলে দেয়া বোতল হয়তো কাগজের ভেতরে রাখা। বোতলও আছে অবশ্য। ফুটপাত বড়ো। কিন্তু বর্তমানে পথটা সংকীর্ণ। ফুটপাতের উপরে তৈরি  সংকীর্ণ ফুটপাত দিয়ে পথচারী যাচ্ছে। তারই মাঝে পথশিশু পরিত্যক্ত টায়ার নিয়ে খেলছে। ফুচকা দোকানদারের দোকানে দলে দলে মানুষ আসা শুরু করেছে। তারা আসছে, অর্ডার দিচ্ছে, খাচ্ছে, আর চলে যাচ্ছে। ফুটপাতের ধার দিয়ে কারেন্টের খুটি। খুটিতে তার। তারে তারে নানান পোস্টার টাঙানো: চিরবিদায় স্টোর, আবাসিক হল, সিট খালি প্রভৃতির।

ফুচকা দোকানের পাশে ভ্যানে বসা মানুষ গুলোর মধ্যে এক গোছা টাকার হিশাব চলছে। কারেন্টের যে তার সেই তারের মাঝে কিছু ছেঁড়া, ঝুলে পড়া তারও আছে। এই তারে এবং তারের সাথে বাঁধা দঁড়িতে  জামা, লুঙ্গি নেড়ে দেওয়া আছে। ভ্যানের লোকগুলোর মধ্যে এখন লটারি চলছে। তাদের লটারির নিয়ম হলো বিশজন দশদিনে ২০০ টাকা করে জমা দেয়। দশদিনে চল্লিশ হাজার টাকা হয়। দশদিনের দিন লটারি করা হয়। চল্লিশ হাজার টাকা একজন পায়। এভাবে চলতে থাকে মাসের পরে মাস, দশদিন পর পর বিশজন টাকা পায়। কোন লাভ নাই। যে টাকা জমা দেয়, সেটাই উঠায়। লাভের মধ্যে এক নাগাড়ে অনেক টাকা হাতে পায়। সেই টাকা দিয়ে কোন একটা বড়ো কাজ করে বা গ্রামে পাঠায়।

ফুটপাতের দেয়াল ঘেঁষে যেন পথচারীদের কোনো সমস্যা না হয় এভাবে চার পাঁচজন মহিলা বসে গল্প করছে। তাদের সামনে আস্ত একটা কাঠে আগুন ধরানো। তারা আগুন পোহাচ্ছে। জ্বলন্ত আগুনের খুব নিকটে তারা; কিন্তু শরীর পুড়ে যাচ্ছে না। ওরা কেউ এক এলাকার নয়। ওদের একজনের সাথে অন্যজনের ভাষারও কোন মিল নাই। ওদের পরিচয় এই পথের মাঝেই। ওরা এই ফুটপাতের বাসিন্দা। ওদের ঘরের নাম ফুটপাত। ওই ভ্যানের লটারি করা বেটা মানুষ গুলো এই মহিলাদের ভাই, ছেলে, জামাই আর প্রতিবেশি। টায়ার নিয়ে খেলায় ব্যস্ত শিশুরা এদের সন্তান। কারেন্টের ঝুলে পড়া পরিত্যক্ত তারে এদের জামাকাপড় ঝুলছে। পলিথিনের নিচে ঢাকা দেওয়া ওদের আসবাব।

ওদের খুব কাছে না গেলে বোঝা যাবে না ওরা কী নিয়ে আলাপ করছে। ওদের আলাপ বেশি দূরে যাচ্ছে না। কিন্তু ওদের পাশে বসলে বুঝা যাবে যে ওরা ওদের ঘরকন্নার সুখ দুঃখ, একে অপরের  সাথে টিপ্পনি কাটাকাটি করছে। হাসি তামাশায় মগ্ন। ওরা একমনে চারজন একজনের কথা শুনছে। সেই একজন বলে চলছে, “বিশ্ব খানকি, নডির ঘরের নডি কিতা কইত্তাম হুদাই কাইজ্জা করে। একশো টাহার বাজার আমরা কইরা জামাইরে খাওয়াইছি না! বরিশাইল্লা নডির মতো নডি জিন্দেগিতে নাই। আমার পোলাডারে কয় তোমার মায়ে যেন আমার পুলারে কুলো না নেই। গুশতো দিইছি পুলাডারে,  হেই গুশতো নডি খাইছে না। পুলাডাও আমার আত্তা পুরে খাইছে না। বিশ্বখানকি খালি পারে কাইজ্জা করতো।” পাশের তিন মহিলা রাগান্বিত মহিলার সাথে সায় দিচ্ছে। এমনভাবে সায় দিচ্ছে যেন মহিলার রাগ আরো বাড়ে। এরকম সময় ভ্যানের কাছে মেয়ে নিয়ে যে কিশোরী ছিলো সে এসেছিল পাশে। মহিলার রাগান্বিত চেহারা এবং গালি শুনে ঠাস করে বলে চলে গেলো, “ও মা! মোর হাউড়ির দেহি আবার হুগার মইদ্যে পুকা উডছে।” বলেই তার বরকে চিৎকার করে ডাক দিলো, “এই যে সাব হুইনা যাও, তুমাগো মায়ের ভাষাডি হুনো আয়া। ঘুম থাইক্কা ওডো। হুনো মায়ের ভাষাডি। আমি নডি নাকি বিশ্বখানকি।”

ওদের ঝগড়ার মধ্যস্থতাকারী আমি হয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম আগুনের এতো নিকটে, গা পুড়ে যাচ্ছে না? ঠিক এই সময়ে উঠে দাঁড়িয়ে এক মহিলা প্রায় শাড়ির নিচে আগুন নিলো। বললো, পুড়েছে? আমি হেসে বললাম, না। হঠাৎ বললাম, “একটা ছবি তুলি আপনাদের।” বললেন, “না। সাম্বাদিক নাকি আপনে?” বলেই শুরু করে দিলো গালি। সকলে মিলে। “খানকির ছেলে, কয়েকদিন আইসা সেরে, আলাপ জমিয়ে ফুন নম্বর নিয়ে এহন খালি ফুন দেয়।” বেটার বউকে গালি দেয়া মহিলার নাম রেশমার মা। রেশমার মা বললেন, “হ, খানকির পোলা লামিয়া কে  ফুন দিয়া কয় বিয়া করবা নি?” যিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি সাংবাদিক কিনা তিনি বললেন, “হ আমারেও খালি ফুন দেয়। আমি ঠিক কইরালাইছি সিমডা পাল্টামু। খানকির ছেলে আর একদিন এহানে আসুক। দেখামু মজা হগলে মিইল্লা।”

ফুচকা দোকানের সামনে রাখা ভ্যানে বসে গল্পরত আমরা।

ওরা কেউ আমাকে পাত্তা দিলো না। বললাম যে আমি সাংবাদিক না। এবং বুঝে গেলাম সাংবাদিকদের প্রতি ওদের দারুণ বিতৃষ্ণা। কোন এক সাংবাদিক ওদের ফোন নম্বর নিয়ে এখন তাদের শোয়ার প্রস্তাব দেয়। রেশমার মা ঠিক তেমনই বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো, “মোগো তালা তালা ঘরের দরকার নাই। জীবন এনোই পার হয়ে গেলো, আরো যাইবো। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। মোগো সাহায্যে সহযোগিতার প্রয়োজন নাই। ওতে বরং বড্ডো ঝামালা।”

ওরা পাত্তা না দিলেও আমি ওদের পাশে বসে আগুন পোহাতে শুরু করলাম। ওরা চুপ করে গেলো। ওরা ওদের আসল নামে কেউ কাউকে ডাকে না। রেশমার মা, আকলিমার মা, মায়ার মা হলো ওদের ডাক পরিচয়। আকলিমার মা হঠাৎ বলে উঠলো, “কী করতে আইচুন আপনে পথের মইদ্যে, সাংবাদিকই তো?” আমি বললাম গল্প করতে আসছি আপনাদের সাথে। শুনেই আগুনের ধার থেকে উঠে চলে যেতে যেতে বললো, “কী গল্প করমু, আমরা কাম করি বাসাবাড়ি। সিট ভাড়া থাহি।” তার পেছনে পেছনে আমিও হাঁটলাম। মায়ার মাও উঠে এলো। তারা ফুচকা দোকানের নিকটে বসলো। আমিও বসলাম। এবার আমাকে একটা পিঁড়ি দিলো বসতে। ভালো করে বসার পরে বললেন, “খুইল্লা লও ডাকনাটা। এখানে করোনা আইতো না। আমার মুখের মাস্ক খুলে নিতে বললো। আমি বললাম সমস্যা নাই। অভ্যাস হয়ে গেছে মাস্কে।”

ওদের ঝগড়ার মধ্যস্থতাকারী আমি হয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম আগুনের এতো নিকটে, গা পুড়ে যাচ্ছে না? ঠিক এই সময়ে উঠে দাঁড়িয়ে এক মহিলা প্রায় শাড়ির নিচে আগুন নিলো। বললো, পুড়েছে? আমি হেসে বললাম, না। হঠাৎ বললাম, “একটা ছবি তুলি আপনাদের।” বললেন, “না। সাম্বাদিক নাকি আপনে?” বলেই শুরু করে দিলো গালি। সকলে মিলে। “খানকির ছেলে, কয়েকদিন আইসা সেরে, আলাপ জমিয়ে ফুন নম্বর নিয়ে এহন খালি ফুন দেয়।” বেটার বউকে গালি দেয়া মহিলার নাম রেশমার মা। রেশমার মা বললেন, “হ, খানকির পোলা লামিয়া কে  ফুন দিয়া কয় বিয়া করবা নি?” যিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি সাংবাদিক কিনা তিনি বললেন, “হ আমারেও খালি ফুন দেয়। আমি ঠিক কইরালাইছি সিমডা পাল্টামু। খানকির ছেলে আর একদিন এহানে আসুক। দেখামু মজা হগলে মিইল্লা।

ওরা প্রায় বিশ ত্রিশ বছর ঢাকায় এসেছে। মায়ার মা ময়মনসিংহ থেকে, আকলিমার মা টাঙ্গাইল থেকে, রেশমার মা জামালপুর থেকে। নূরজাহান এসেছে ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে। ওদের গ্রাম আছে। গ্রামে ছোট হলেও ঘর আছে। ওরা ঢাকায় বাসাবাড়িতে কাজ করে এবং ফুটপাতে থাকে। এই খবর ওদের একান্ত আপনজন ছাড়া গ্রামের লোক বা পাড়া প্রতিবেশি কেউ জানে না। ওরা প্রত্যেকেই নিজে পাত্র পছন্দ করে বিয়ে করেছে। জিজ্ঞাসা করাতে তামাশা করে বললো, “চলো তো যাই, তোমারও জামাই নাই, আমারও বউ নাই, চলো না সংসার করে খাই।” বলেই বললো, “মেয়ের বয়েসী আপনে, আর কী কমু যে!”

আকলিমার মায়ের নাম খোদেজা বেগম, মায়ার মায়ের নাম মোসাঃ রোমেনা। যখন ওরা আমাকে মন থেকে মেনেই নিতে পারিনি ওদের মাঝে ঠিক তখন রাস্তার দুই হিজড়া আমার খাতা কেড়ে নিয়ে বললো, “কিরে তুই পথে কী করস বে!” তাড়াতাড়ি নূরজাহান বেগম বললো, “ও আমার বোনঝি।” ওরা খাতা ফেরত দিয়ে চলে গেলে বললাম, “এই তো আপনি আমার খালা হয়ে গেলেন। আমি এখন আপনাদের সবার ভাগ্নি। আমার নাম জেসমিন।” সকলে আমার নাম ধরে ডাকবেন। মায়ার মা বললেন, “খালা কইলেও অইবো না, আগে চা খাওন তারপর অইলো গে কতা।” আমি চারজনের জন্য চা আনতে বললাম। আমি চা খাই না সাধারণত, বললাম আমার জন্য লাগবে না। ওরা চা আনার ফাঁকেই সকলে পান গালে দিলো। আমি হায় হায় করে বললাম, “আরে চা আসছে তো, আর পান খাওয়া ভাল না।” বললেন, “হুনো মাইয়া, আমরা তিনবেলা ভাত না খাইয়া থাকতারমু কিন্তু পান না খাইয়া পারমু না।”

যাদের নিয়ে কথা বলছি, তারা গ্রীনরোড, কলাবাগান, পান্থপথ এলাকায় বাসায় কাজ করে। বাস্তবের রক্তমাংসের মানুষ কেউ দিন রাত দুবেলা আর কেউ শুধু দিনে। ওরা সুখী, দুখের কোন ছায়া নাই। অনেকেই রাস্তা থেকে বস্তিতে চলে গেছে। তারাও এসে গল্প করে যাচ্ছে। বলছে,”এনোই থাকছি। বান্দা কাম করছি।পুলা মাইয়া বড়ো হইছে, আর কতো রাস্তা ত। তাই সাত হাজার টিহা দিয়া বাসা ভাড়া নিয়া থাহি।” ওরা অন্যের বাসায় কাজ করে কিন্তু ওদের বস্তির ঘরে সব আছে। কিন্তু ওদের দেখে বা কথা শুনে বুঝা যায় না। গ্রামে কী হয়েছিল যে ঢাকা আসলো জিজ্ঞাসা করায় বললো, “সোনা অইছিল।” নুরজাহানের বোন জবাব দিলো, “পেছন থেকে অইছিল না কিছুই। অভাবের তাড়নে সাবালক অইলেই ঢাহা চইল্লা আইসি। টিয়া পয়সা কামানের লাগি। এনোর হগলেই ওই একই তাড়নে আইছে, এনোই থাইকছে, টিয়া পয়সা বেশি অইলে কেউ বস্তিত গেছে গা আর কেউ এনোই থাহে। সকলে বলে উঠলো হ হ আমরা এনোই থাহি। আপনে থাউন কৈ?”

আকলিমার মা রাস্তায় থাকতেন। আকলিমা, তার দুই ছেলে এবং তার তিন ভাই নিয়ে। ভরা লকডাউনে তাদের বাসাবাড়ির কাজ ছিল না। বস্তিতেও তাদের রাখেনি বস্তির মালিকরা। তারা বাসাবাড়িতে বা বাইরে কাজ করতে গিয়ে যদি কোভিড-১৯ ভাইরাস সাথে নিয়ে আসে তাই তাদের কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। তারা কেউ কেউ গ্রামে অনিশ্চিত জীবন যাপনের দিকে পা বাড়ায় আর অনেকেই  পথকেই সঙ্গী করে নেয়।  তাদের ভাষায়, “বড়লোক গো মরার বেশি ভয় গো মাইয়া, বেশি ভয়। হেরা আমাগো ছাড়া চলতো পারে না আবার আমাগো লইয়াও বাঁচতে পারে না। মইধ্যেখানে আমরা বড়ি খান্দায়। পইড়া হাবুডুবু খাইয়া কুনোমতে বাঁইচা থাহি।” মায়ার মা, নুরজাহান, রেশমার মা সকলের পরিবার রাস্তায়ই ছিলো। লকডাউনে তাদের চলবার কষ্ট হয়েছে। তারা একে অপরের প্রতি সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ধার করে ঋণী হয়ে গিয়েছে। যার বোঝা বর্তমানে শোধ দিতে হচ্ছে। বাসাবাড়িতে কাজ করে মাসের শেষে যে টাকা পায় তা হাতে আসা মাত্র অন্যের হাতে চলে যায়।

পথে থাকা ওদের নতুন কিছু নয়। কিন্তু বস্তি থেকে বের হয়ে রাস্তায় ছেলেমেয়েগুলো নিয়ে থাকা কেন যেন ওদের মনে ছাপ ফেলেছে। আমি মাস্ক পরাতে তাদের খুব অসহ্য লাগছে।আকলিমার মা বলছেন, “মাস্ক না সোনা পরমু। হগলডি ভয়ে গ্রামো গ্যাসে গা। আমি একলা এনো থাকছি,  পুলিশ রেবো রাস্তাত ভর্তি আছিল, আমার কাছো আইছেও না। কিছু কইছেও না। কি করমু গ্রামো গিয়া। হেনো কে আছে আমার? আমি অফিসারের বাসাত কাম করি। তাও মাস্ক পিন্দি না।”  আকলিমার মা বিয়ে করেছিলেন তেরো চৌদ্দ বছর বয়সে। চতুর্থ বাচ্চা দুমাস পেটে আসার পরে তার বর তাকে ছেড়ে অন্য রাস্তার এক মেয়েকে বিয়ে করেছে। মাঝে মাঝে তার কাছে তার বর আসে কিন্তু সে তাকে জাগা দেয় না। তার তিনছেলের মধ্যে বড়োটা মাসের বিশদিন ফুড পান্ডায় জব করে, আর বিশদিন ভ্যানগাড়ির জোগাড়ে হিশেবে কাজ করে। মেজো ছেলে সকাল থেকে সন্ধ্যা একটা হোটেলে  বয়ের কাজ করে। ছোট ছেলে আর আকলিমা বাসায় থাকে। আকলিমার মা বাসাবাড়িতে কাজ করে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত। দুই ছেলের বেতন দিয়ে সে বাসা ভাড়া দেয়। আর বাসায় একটা ছোট বেড তৈরি করে একহাজার টাকায় ভাড়া দিয়েছে। সেই টাকা দিয়ে ডিশ ভাড়া আর তার ছোট ছেলের পড়ানোর বেতন দেন। তার ছোট ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।যদিও  লকডাউনে তাদের কষ্ট হয়েছে চলতে, অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি করেছে বাসাবাড়ির কাজ হারিয়ে তবুও তারা বেঁচে আছে। আকলিমাও ঠিক তেরো চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলো। নিজের পছন্দে। বর একছেলে হবার পরে অন্যে রাস্তায় গিয়ে আরেকটি মেয়ে নিয়ে থাকা শুরু করেছে। খোদেজা খাতুন দ্বিতীয় বার এক ভ্যান চালক দেখে তার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আকলিমার দ্বিতীয় সন্তান হবার দুইমাসের মাথায় ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সে মারা গেছে। আকলিমার কণ্ঠ উদ্ধত এবং কর্কশ। সে বলে, “বিয়ের হুগা আর মারুম না। আপনে অবিয়াইত্তা আছেন ত কি হইসে। না বিয়া করাই বালা। আমি বুঝিনাই কইরালছিলাম। একজন ভাগছে, আরেকজন মরছে।” আকলিমারা বস্তিতে চলে গেলেও প্রতি সন্ধ্যাতেই এই রাস্তাতে তাদের পূর্ব প্রতিবেশীদের সাথে গল্প করতে আসে।

এখানে এই রাস্তাতেই আলমগীর নামের একজন লোক থাকে।বিশ্বব্যাপী  করোনাভাইরাস আক্রমনের আগে সে বস্তিতে থাকতো এবং বাবুর্চির কাজ করতো। এখন কাজ পায় না সে। তাই ভ্যান চালায়। দিন প্রতি একশো টাকা মানে মাসে তিন হাজার টাকার চুক্তিতে। সে আকলিমার মায়ের কাছে তিনবেলা খায়। তিনমাস হলো সে বাকি খাচ্ছে। আকলিমার মা তাকে কিছু বলে না কিন্তু মায়ার মায়ের কাছে রাগ দেখায়। আলমগীর সব বোঝে কিন্তু কিছু বলে না। আকলিমাদের সাধারণ কথায়ও অনেক গালি থাকে। কিন্তু শুনতে মন্দ লাগে না। ওরা সকলে আমাকে আলমগীরের সাথে পরিচয় করায়ে দিলো। আলমগীর কে বলে দিলো, “এই মাইয়ার নাম জেসমিন। এ আইজ থাইক্যা আমাগো বোনঝি। এ এনো আসব। আমাগো না পাইলে তুমি হেরে দেইখ্যা রাখবা।” আলমগীর আমাকে বললেন ওখানে গিয়েই তার নাম বলতে তাহলে আমাকে কেউ কিছু বলবে না। ঠিক এরকম সময় পাশে এক মেয়ে গালি দেয়া শুরু করেছে। সে তার মেয়ের সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি খুঁজে পাচ্ছে না। সে চিৎকার করে বলছে, “আমার মাইয়ার স্যান্ডো গ্যাঞ্জি যদি কুনো বেশ্যামাগি মাসিকের ভাঙা বানায়ালাই, যুদি আমি পাই সেই ভাঙা রক্ত সুদ্ধা মুখের ভিতর পুইরা দিমু।” তার কথায় কেউ কান দিচ্ছে না গল্প করেই যাচ্ছে।

দূর থেকে একজন ”আকলিমার মা” বলে ডাক দিলো। আকলিমা তার মাকে বললো, “ওই যে তোমাক ডাহে।” আকলিমার মা  জবাব দিলো, “ডাহুক, গোলামের ঘরের গোলামের পুত কাজের কতা হুনে না, অকাজের কথা বেশি হুনে, তুই হের লাগি ফুচকা রাহিস না। মায়ার মারে দিয়ালা। ওদিকে মেয়েটা গালি দিয়েই চলছে, মাদারচোত, ও আগেই খামচাইছে।” পাশে তার ভাবি বলছে, “আমার ছেলেডার খামচাইয়ে মেরে ফেলতাছে, ওরে মাদারচোত, বাবুরে এনো লয়া আয়। আমার ছেরা বুকো লয়ে আমি বয়ে থাকি। ওদের ভাষা শুনে কেউ রাগে না। বলে না, গালি দিচ্ছ কেন?” যেন এই ভাষাই চিরন্তন। ওরা ফুচকা দোকানে আসা প্যান্ট টি শার্ট পরা মেয়ে দেখে হাসে। বলে, ও চাচি ঐডা বেডি না মায়া।

যাদের নিয়ে কথা বলছি, তারা গ্রীনরোড, কলাবাগান, পান্থপথ এলাকায় বাসায় কাজ করে। বাস্তবের রক্তমাংসের মানুষ। কেউ দিন রাত দুবেলা কাজ করে, আর কেউ শুধু দিনে। ওরা সুখী, দুখের কোন ছায়া নাই। অনেকেই রাস্তা থেকে বস্তিতে চলে গেছে। তারাও এসে গল্প করে যাচ্ছে। বলছে,”এনোই থাকছি। বান্দা কাম করছি।পুলা মাইয়া বড়ো হইছে, আর কতো রাস্তা ত। তাই সাত হাজার টিহা দিয়া বাসা ভাড়া নিয়া থাহি।” ওরা অন্যের বাসায় কাজ করে কিন্তু ওদের বস্তির ঘরে সব আছে। কিন্তু ওদের দেখে বা কথা শুনে বুঝা যায় না…

আগুন পোহাতে পোহাতে গল্প করছে রোমেনা খালারা।

মোসাঃ রোমেনা বেগম মানে মায়ার মায়ের স্বামীর প্রথম স্ত্রী আছে। তার স্বামীর বাড়ি ফরিদপুর। প্রথম স্ত্রীর চার জন আর তার একজন মেয়ে আছে। যার নাম মায়া। মায়াকে ময়মনসিংহ গ্রামের বাড়ি বিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে মায়া তার বাবার বাড়ি বেড়াতে আসে। মায়ার মার কাছেই মায়ার বাপ থাকে। প্রথম স্ত্রীর বাসায় যায় না। তারাও কাছেই রায়ের বাজার বস্তিতে থাকে। সেখান থেকে তার সতীনের ছেলেমেয়েরা আসে। সতীন এই গ্রীনরোডেই চা ফেরি করে বেড়ায়। লকডাউন থেকে কাজ বন্ধ আছে। আবার শুরু করবে। মায়ার মায়ের কাছে এসে তিনহাজার টাকা নিয়ে গেছে। সতীন দূরে থাকলেও সতীনের ছোটছেলে অবশ্য মায়ার মায়ের সাথে খায়। পাশেই পলিথিনের ঘর তৈরি করে রাতে থাকে। মায়ার মা কম কথা বলে। অন্যের কথা বেশি শোনে। আকলিমার মায়েরা তাকে বলে, ” হেইল্লা কুম কতা কয়। মিনমিন্না শয়তান।” মায়ার মা বলে অতো কতা মুর কইতো মনো চাই না। রোমেনা বেগম ফুটপাতের অন্যদের কাছে বিশ্বস্ত। যাদের বাসায় কাজ করে তাদের কাছেও বিশ্বস্ত। তাকে আর তার স্বামীকে সেই বাসার মানুষেরা পরিবার ধরে গ্রামে যাবার সময় রেখে যায় ঢাকায় না ফেরা পর্যন্ত। বাসা থেকে তার জন্য মাছ গোশতো মিষ্টি এনে রেখে যায়। কথা বলে না বেশি কিন্তু যখন গল্প করে তখন অনেক গল্পই করে। বিশেষ করে নতুন মানুষ গেলে তাদের নানান দিক দিয়ে সাহায্য করে। আমাকে বলে, “হুনো মাইয়া, কিসমত একটা জিনিস, বাড়া ভাতের আশায় কেউ থাহে না। এই বিশ্বাসটা কামাইতে অনেক সময় লাগে। তারা আমায় পরীক্ষা করে করে বিশ্বাস করে এহন।” তারপরে বলে, “বাসাবাড়ির কামের কথা বাদ যাক, আপনে একখানা গল্প হুনেন, একটা বেডা এক লাক টিয়া বেতন পায়। বাড়ি বোনের লগে নাকি ভাইবোনের লগে সমস্যা কইতারিনা। ছাদের থেকা পইড়া মরে গেছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জানে কি কারণে উনি আত্মহত্যা করছে। আমরা দেহি নাই। আমার জামাই দেইখা আইসে। এক বেডি কইলো মরার আগে ফোন দিসে,  তোমরা আয়ো, আমি আত্মহত্যা করছি।”

এই সময় একজন মায়ার মাকে কাজের বায়না দিতে আসে। কাজে যাবে মায়ার মা ও বাসায়। মহিলা পূর্ব পরিচিত। এসে রোমেনা বেগম কে বলে, “মায়ার মা, মামা হালিমের গলি তো চিনইন না,  কালকা থাইকা যাবেন। রান্না কইরা আনবেন। আসরের পরে যায়েন। আমাকে বলেন, কাজডি আমি করুম না, আনিসের মারে দিমু। কিন্তু আমি এখন কইলাম না বেডিরে। হের কাজ দরকার, আনিসের মারও কাজ দরকার। কাইলকা আনিসের মারে সঙ্গে কইরা লয়া দিয়ামু। আনিসের মায়ে তো হেরার লগে চলছে না। হেরা বুজবো না এইলার কথা। উলোট পালোট হলে শরম পাইমু না আমি?”

মায়ার মায়ের চৌকির নিচে একটা কুকুর এসে ঘুমায়। সে নির্দিষ্ট সময়ে এলে মায়ার মা তার সাথে মানুষের মতো কথা বলে। আমাকে নানান উপদেশ দিয়ে বলেন, “আমরা খাই তে চাইলেই খাওয়াইবেন না। কিছু দিবাইন ও না।  খাওন দেওনের সুমায় দেখবেন হগলে ভাগ বসাইবো। তয় কয় কাউরে খাওয়াবেন না। ভাগ বসানোডা অয়লো গরীবের রীতি। এই গ্রীনরোডের সমস্যা।”

নুরজাহান বান্ধা কাজ করে। মাসে চারহাজার টাকা পায়। তার প্রথম স্বামী মারা যায়। পরে সে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। বিয়ের পর থেকে রাস্তা থেকে বস্তিতে চলে গেছে। তার ভাইবউয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে সেখানে। সেই ঝগড়ার কারণ সে বর্ণনা করছে। গ্রাম থেকে তাদের ভাই আসবে তার যে ভাইয়ের বউয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে তার বাড়িতে। ভাইকে ভাবি যদি ননদের কারনে আদর না করে তাই ফোনে বলছে, ” ভায়ে তুই দশ তারিখ আয়া আমার বারিত আহিস, আমরার ঠাইন। আমরারা লগে আইসা পরে ওগো লগে দেহা করিস। কথাডা যাইন মনো থাহে। আগোই ভায়ের বাসাত যাহিস না। ত বালা থাক, রাইখা দেই, ও হুন চাইন, মায়ে কিরম আছে? পোলাপান কিরম আছে? হ, তো রাইখা দেই।” ভায়ের সাথে কথা বলা শেষ করেই আমাকে বলে, “যাই গা, কুমবালা আইচি, কাইজ্জা করবো। আজ পাঁচ সের মাচ কুডছি। এইল্লা উচা হইছে জামা কাপড় হেগুলা ধুইছি। পিটের ভিতরে বিষ করে। তোমারে তো দেইখা সারা সুখী মনো অয়তাছে মাইয়া। প্রেমিক আছেনি? হুনছো নি, ডলফিন গলির কামডা। ডলফিন গলির আনুস্কা দিহানের কথা তারা জানে। বলে পীরিতি করবা তয় শইল ছুতে দিবানা। মধু খাইয়া দৌড় পারমু নয়তো মাইরালবে।” বললাম, আচ্ছা।

“বড়লোক গো মরার বেশি ভয় গো মাইয়া, বেশি ভয়। হেরা আমাগো ছাড়া চলতো পারে না আবার আমাগো লইয়াও বাঁচতেও পারে না। মইধ্যেখানে আমরা বড়ি খান্দায়। পইড়া হাবুডুবু খাইয়া কুনোমতে বাঁইচা থাহি।”

ঠিক সেই সময় যে বাসায় কাজ করে সে বাসা থেকে ফোন আসে। ফোন ধরেই বলে, “আইতাছি গো আফা আইতাছি। কলাবাগানের কাজ কইরা আইসা সাইরা কেবল শইল ডা ধুইছি। কেবল গায়ে কাপড় জড়াইতাছি। আইতাছি রাহুন যে।” নুরজাহান চলে যাবার সময় বললেন, “যাইগা খালা আবার আসমু।”  আকলিমার মাও চলে যাবার উদ্যেগ করে। বললাম, “বসেন খালা, আরেকটু গল্প করি।” বললেন, “যামু কই, আমার পোলাগো এহনো কাম শ্যাষ হয় নাই। আমার মাইয়াও তো এহনো আনোঙ্গিরের ভাতের বাডি লয়ে আইয়ে নাই। ছেরাডারেও কুমবালা থেকে ডাকতাছি আয়ে না। মায়ার মা বলে, আয়া সারবো। মায়ার মা বলে, হ মাইয়া, নূরজাহান ঠিকই কইছে। শইল ছুতে দিলে পুটকি মাইরা যাইবো গা।” ওদিকে  আকলিমার মা বলতেই থাকে, “পুলাপানের লাইগা বাঁচি না। বেডা গেছে আমারেও মাইরা থুইয়া গ্যাছে।  আকলিমাকে আবার বিয়ে দেবে কিনা জিজ্ঞাসা করায় বলেন, কইতারিনা, গোলামের ঘরে গোলামরে থুইয়া গ্যাছে বাপে ফালাইয়া। বরেও হের ছাইড়া গেছিল গা। আরেকটা দিয়াছিলাম হেইডা মরছে গা।”

মায়ার মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, রোমেনা খালা, আপনারা গোসল করেন কোথায়? বাথরুম চাপলে কি করেন? বলে, হুনো মাইয়া, স্বামীর সাথে হুইলেও বেলা একডাত গুসল করি, না হুইলেও ওই একডাত গুসল করি। কাম করত যাইয়া যে বাড়িত একডা বাজে সে বাড়িত গুসল সাইরা আহি। আর বাথরুম করি বাসাবাড়িত বাসাবাড়িত, রাইতো হাসপাতালে নিচো ফ্লুরে, আমাগো কাছেপিঠের বাসার দারোয়ানরা কিছু কয়ে না। 

রেশমার মা আবার চিল্লাইতে চিল্লাইতে আসে, নডির ঘরের নডি, নডির বাচ্চা নডি পা খান পুইড়ালাইছে। বহা লেহে ক্যান। সে তার ছেলের বউ কে পুতনির গায়ে আগুনের ছ্যাক লাগছে বলে বকা দিচ্ছে। আমি তার দিকে তাকাতে বললো, যাও নাই এহনো? তার পাশে ছোট শিশু খালি পায়ে হাঁটছে। তার দিকে তাকাতেই বললো  আমার মাইয়ার এডি। ওইখানে আমার মেয়ে পান বেচতাছে। নাল ফকিরের গলি ভাড়া থাহে। সাত বচ্ছর বিয়া দিছি। গরিবের সংসার আমরার। এই বালা এই খারাপ।

রেশমার জামাইয়ের নাম ডালিম। কিছুক্ষণের মধ্যে সেও এসে হাজির। চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। এসেই মাটিতে একটা পাটি পেতে বালিশ মাথায় দিয়ে, কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। মায়ার মা আর আকলিমার মা সরে বসলো। মায়ার মা বললেন, কি যে রানবাম, বুজতাম পারছি না। হাগ রানবাম নাকি হুটকি রাইন্দা হালবাম। চাইল আছে এক কুডো। তিনজন মাইনসের অয়বো?  হে বেডার তো হবর নাই। বলেই বস্তা থেকে তিনটা টমেটো, দুটো ক্ষিরে সাইজ শশা বের করলো। শশা কেটে ফালি করে সকলের হাতে দিলো।

গল্প করতে করতে চা এবং ঝালমুড়ির অপেক্ষারত আমরা।

আমাকে বললো, “যাওগা জেসমিন। রাইত হইসে, মাইয়া মানুষ, তাড়াতাড়ি বাসাত যাওন বালা।” বললাম, আরেকটু বসি। রেশমা আমার দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ আবার বাটি বালিস তুলে মানুষের ফেলে দেয়া পুরানো একটা মোড়াতে বসে বললো, “মাস্ক হারা সময় পইরা থাওন লাগে। আমরার তো লাগে না।” বললাম, “তোমাদের কতো মানুষ। অসুস্থ হলে সবাই সবাইকে  খেদমত করতে পারবা। আমি তো একা। নিজেকে সুস্থ রাখি, যতোটুকু পারি।” বললাম, “এখন চোখে এতো ঘুম ক্যান?” বললো, “সারারাত দোকান করি যে, কেউ চা খাইতে আহে, কেউ নাস্তা খাইতে আহে। হাসপাতালের রোগী রাইখা কি কারো ঘুম আহে। তাদের লাগি আমাদেরও ঘুম আহ না। টিয়া পয়সাও কামাই হয়।”

একদিন ওদের গোশতো রান্না করে খাওয়াতে চাইলাম। রেশমা এবং মায়ার মা দুজনেই বললো, “মোডেও না। এহানের সব লুক খেইপা যাইবো আপনের উপরে। যে হে কথা কইলো হগলডির লগে। খাওন দিলো খালি মায়ার মারে।” সেই সময় মায়ার মায়ের স্বামী ফিরে এলো চাল ডাল নিয়ে। আমি রেশমাকে বললাম, “তোমাদের এখানে একদিন রাতে থাকতে দিবা আমাকে? তোমাদের সাথে ঢাকা শহরের রাত দেখব।” মায়ার মা আর আকলিমার মা রাজি হয়ে গেলো। রেশমা বললো,”অবিয়াত্তা মাইয়া হাউস কইরা কয় রাতে পথে থাকবো!” মায়ার বাপে বললো, “না রাখা যাইবো না। অল্প বয়েসী মাইয়া রাখা যাইব না। আমরা মেয়ের লাহান দেখবাম, কিন্তু অন্যেরা খারাপ ভাববো। যে হঠাৎ এই মাইডা এই দলে আইলো ক্যামনে?” বরকে মায়ার মা বললেন, “হুনেন, মায়ার বাপে, আইচকা রানলে লাড়কি নাই, কাইল্লা থে রান্না বন্ধ। কাট না আনলে রানতাম না আমি।”

ওদের জীবন দেখে তাদের কথা মনে পড়ে, যাদের কেউ কেউ বলে, ‘লাইফ ইজ সো ডিফিকাল্ট’ আবার কেউ বলে ‘লাইফ ইজ সো ইজি’… কঠিন এবং সহজ দুটোই ওদের মাঝে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত। কিন্তু ওদের ঘরকন্না দেখলে মনে হয় যেন একবেলার ‘ফিস্টিভাত’-এর আয়োজন। বাচ্চার ঘরকন্না খেলার ছলে যে ভাত-তরকারি রান্না করে খায়, তাকে ‘ফিস্টিভাত’ বলে। ওরাও যেন শিশুদের মতো রাস্তার ওপর ঘরকন্না খেলা বসিয়েছে। অথচ অনন্তকাল ধরে চলছে ওদের এই পথের সংসার। আসলে কি অনন্তকাল? ওদের গ্রামছাড়া আর ঘরছাড়া করেছে ওই বিশ ত্রিশতলায় বসবাসরত মানুষ। যাকে লোকে বলে এলিট। যে শ্রেণী এদের নাম দিয়েছে নিম্নশ্রেণী।

রেশমার মা ততোক্ষণে মায়ার মার ওপাশে রান্না বসায়েছে। দুজনের চুলায় ধরে উঠলো। রেশমার মাকে মাছ ভাজতে দেখে রেশমা তার মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “ওমা মাছ পাইলা কই?” প্রথমে তার মা জবাব দিলো তার বাবা আনছে। আবার জিজ্ঞাসা করায় বললো, “আসমান থাইকা পড়ছে। তাই ধইরা ধইরা আমি ভাজতাছি।” মায়ের মেজাজ দেখে রেশমা মেয়ে কোলে নিয়ে চলে গেলো। লামিয়া পান কিনে এনে পথের একধারে বসে একটা তার বরকে আরেকটা তার নিজের জন্য গালে দিলো। নুরজাহানের বোন লামিয়ার সামনে বসে গল্প শুরু করলো। লামিয়াকে বললো তাকেও দশটাকার পান কিনে দিতে। লামিয়া জবাব দিলো, “গুলের উপরে আছি। এহন দুশো টিয়ার মইধ্যে দশ টিয়া খরচ করলে বাংলা চোদন দিবো আমার সাবে।” আবার রেশমা ফিরে আসে, বলে, “লামিয়া কাইলকা খাবিনি? খাইলে কইয়া আয় স্যার রো।” লামিয়া ঠাস করে জবাব দেয়, “হেরাও বাথরুম ধুইয়া খাইবো, আমরাও বাথরুম ধুইয়া খামু, হেতের খাওয়ার গুষ্টি আমি চুদিনা।” 

ফুচকাওয়ালা আমাকে বললো ও আপা ফুচকা খাইয়া বাসায় যায়েন। আমি বললাম একদিন খেয়েছিলাম। ফুচকা দোকানির নাম বাবুল। আপনার বানানো টক টা মজার। আকলিমার মা বললো, “বাবুল্লা বেশি কথা কইয়ো না, যাইয়া চোখডা তুইল্লা আনমু গা। আমাগো মাইয়ারে খাইতো ডাহেন, আমাদের ডাহেন দেহি। যান গা আপনার হাউড়ির হুগাডা মাইরা আয়েন।” বললাম, ছিঃ! বললেন, “আহা শরম দেহি মাইয়ার!” মায়ার মা আমাকে আবার তাড়া দিলো, বললো, “জেসমিন যাউগা। আবার আইয়ো কাইল। সাবধানে যাইও।” আমি না উঠতেই বলেন তার স্বামীকে, “আলমগীর কইসে কাজ আছে। কুনো প্রকার ভাবসাব লইবেন না।” আমি উঠিনা দেখে মায়ার মা আবারো তাড়া দেয় “যাউগা মাইয়া। কাইল্লা আবার আয়ো। সুমায় ভালা না।”

এখানে বসবাসরত মানুষের জীবন সুখ আছে, আছে অসুখও। আনিসের মা যাবে সকালে বাড়িতে। স্বামী একসময় কর্মঠ ছিলো। লোকের বাড়িতে কাজ করতো। এখন হাঁপানির রোগ। নিঃশ্বাসে গন্ধ। চলতে কষ্ট হতো। পাড়ার মেয়েদের সাথে সে চলে এসেছে শহরে। এই রাস্তায় প্রথমদিন শুয়ে কেঁদেছিল সে। মনে পড়েছিল তার শৈশব আর কৈশোরে গ্রামের দস্যিপনার কথা। স্বামী সংসার সন্তান আর সংসারের দুখের কথা। এখন এই রাস্তায় ঘুমানো তার কাছে ডালভাত। দুটো টাকা বাঁচানোর প্রবল আকাঙ্ক্ষা। আলমগীর ছেলেদের শিক্ষিত করতে থাকে ঢাকা শহরের পানির পাম্পে কখনো রাস্তায়। সারবানু বোবা এবং কালা। নাম শুধু সই করতে জানে। তার হাসিতে জগতের কোন দুঃখবোধ নেই। চিরসুখী মহিলা সে। ওদের দেখে দুঃখের থেকে সুখ অনুভব করেছি বেশি। মনে হয়েছে বড়োলোক ওদের এই জীবন দিয়েছে। কিন্তু ওরা মেনে নিয়ে সুখী হয়েছে। বিপরীতে বড়োলোক সোনার চামচ আর কোটি টাকার বিছানায় আত্মার শান্তি হারিয়ে যখন ছটফট করে তখন শান্তিতে গভীর নিদ্রায় ফুটপাতে শায়িত থাকে এরা। জানেনা কারা দায়ী ওদের এই জীবনের জন্যে। জানতেও চায় না। ঘুমায়।

ওদের জীবন দেখে তাদের কথা মনে পড়ে, যাদের কেউ কেউ বলে ‘লাইফ ইজ সো ডিফিকাল্ট’ আবার কেউ বলে ‘লাইফ ইজ সো ইজি’… কঠিন এবং সহজ দুটোই ওদের মাঝে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত। কিন্তু ওদের ঘরকন্না দেখলে মনে হয় যেন একবেলার ‘ফিস্টিভাত’-এর আয়োজন। ছোট শিশু বা বাচ্চারা ঘরকন্না খেলার ছলে যে ভাত-তরকারি রান্না করে খায়, তাকে ‘ফিস্টিভাত’ বলে। ওরাও যেন শিশুদের মতো রাস্তার ওপর ঘরকন্না খেলা বসিয়েছে। অথচ অনন্তকাল ধরে চলছে ওদের এই পথের সংসার। আসলে কি অনন্তকাল? ওদের গ্রামছাড়া আর ঘরছাড়া করেছে ওই বিশ ত্রিশতলায় বসবাসরত মানুষ। যাকে লোকে বলে এলিট। যে শ্রেণী এদের নাম দিয়েছে নিম্নশ্রেণী।

এরা সকলে পথের বাসিন্দা। কেউ বাসাবাড়িতে কাজ করে,  আর কেউ ভ্যান চালিয়ে, কেউ ফুল বিক্রয় করে, আর কেউ ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করে। আপাত দৃষ্টিতে ওদের কাজকর্ম নজরে আসে না।  ওদের বিশেষ চোখেও পড়ে না, বিশেষ ভাবে না তাকালে, কিম্বা ডাস্টবিনের ধারের রাস্তা গুলো না দেখলে। পথে যে সব খালারা সবজি বেচে, পান বেচে, চা বেচে, ফুল বেচে তারাও এসব স্থানে থাকে। লকডাউনের দুমাস যারা গ্রামে যায় নি, বা গ্রামে যাদের বাড়ি নেই তাদের উপার্জনের মাধ্যম ছিলো ভিক্ষা। লোকের সাহায্য, বাসার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ভাতের আশায় বা নিজেদের গচ্ছিত টাকা ভেঙে খাওয়া।

ওদের মাঝে দারুণ একতা। কেউ চা খেলেও সকলের জন্য কেনে। কেউ পরোটা খেলে সকলকেই খাওয়ায়। কেউ কোন জামাকাপড় দান করে গেলে ওই ফুটপথে বসবাসকারী সকলে ভাগ পায়। এবং পেয়ে ওরা খুশি হয়। আমি বসে থাকাকালীন সময়েই একজন ছেলে ওদের পুরানো জামা শীতের জ্যাকেট দিয়ে গেলো। ওরা সকলে ভাগ করে নিয়ে টিপু নামের ছেলেটিকে জ্যাকেট টা দিলো। ছেলেটার মুখটা খুশিতে ডগমগ হয়ে গেলো। ছেলেটা লাশবাহী এম্বুলেন্সের সহযোগী হিশেবে কাজ করে। সে খুশিতে বলছে যাক, রাতে কাজে গেলে শীত লাগবে না।

গতরাতে এক বিষখাওয়া মৃত লাশের বর্ণনা দিচ্ছে সে সকলকে। বলছে, “মুখ থেকে  দেখি ফু দিয়ে থুতু বের করছে। আমি আলিম ভাইরে কইলাম কি ভায়ে এ তো জ্যান্তা। ভায়ে আমারে কয়, দূর হালাই, হের বিষ বাইর হচ্ছে গাল দিয়া। বইস থাক তুই চুপ মাইরা।”  ওরা সকলে ভদ্রবাড়ির কাজের মানুষ। ভদ্রদের আচরণ কখন অভদ্র হয় ওরা জানে। কাজে যেতে দেরি হলে নাকি বলে “তোমাদেরই কাজ কাম থাকে, আমাদের নাই?” শরীর অসুস্থ হলে আর না গেলে বলে, “তোমাদেরও রোগ হয় তাহলে!  আমরা ভাবি আমাদেরই হয় খালি।” এসব কথায় ওরা মন খারাপ করে না। বিশেষত এই সময়ে তো আরো না। কাজেও ফাঁকি দেয় না। হাসতে হাসতে গল্প করে। হাসতে হাসতে কাজে যায়। কোভিড-১৯ ওদের বুঝিয়ে দিয়েছে কাজ না করলে ভিক্ষাবৃত্তি ওদের সম্বল। ওরা কখন ঘুমায় আর কখন ওঠে, না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। এবং ওদের যে টাকা নেই তাও কিন্তু না। কারো কারো নিজস্ব ভ্যান আছে। টাকা কম পড়লে ভ্যান বেচে। আবার বাড়লে কেনে। কেউ রাস্তায় পাটি পেতে ঘুমায়। আবার কেউ চৌকিতে। কেউ কেউ তাদের নিজস্ব ভ্যানের উপরে পাটি পেড়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে। তারা রাতেই ঘুমায়। দিনে তাদের পথচারীদের চলাচলের সুযোগ করে দিতে হয়। যদি খুব প্রয়োজন পড়ে ঘুমের তাহলে রেশমার মতো তৎক্ষণাৎ পাটি বিছিয়ে বালিশ মাথায় দিয়ে কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে ঘুম যায়। ওরা পথের বাসিন্দা। কেউ বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করে। কেউ  বারণ করলে বলতে পারে “ওতো বেশি কতা কওন কিল্লাইগগা। একডা মাইনষের উপকার করলে কিচ্ছু অয়না।”

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একটা কথা মনে পড়ছে,  কিন্তু সেই কথার মূল্য এরা হীন করে দিয়েছে। মানিক বলেছিলেন, ঈশ্বর থাকেন ভদ্র পল্লীতে এখানে তাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।

কিন্তু এই রাস্তায়  সকলেই ঈশ্বর।

মায়ার মায়ের সংসার।

ছবি: লেখক

জেসমিন নাহার

ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। বাড়ি যশোহর জেলার শার্শায়। গোড়পাড়া সর্দারবাড়ির মেয়ে। বাবা নুরুল ইসলাম। চিশিতিয়া তরিকার ফকির ছিলেন। মা রওশানারা বেগম। গল্প লেখক। উপন্যাসও লিখছেন

Share