আজ বৃহস্পতিবার, ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

নিন্দুক

।। দেবাশিস কর্মকার ।।

তা এই তিনকড়ি সারাদিন এ পাড়া, সে পাড়া ঘুরে, দোকান-বাজারে আড্ডা মেরে শুধুই লোকের নিন্দা করে বেড়াত। নিন্দাতেই তার পরম সুখ। তার জন্য মানুষকে পর্যবেক্ষণ করার আশ্চর্য ক্ষমতাও আছে তিনকড়ির। আশ্চর্য এই জন্য যে, কারও মধ্যেই প্রশংসা করার মতো কিছু দেখতে পায় না সে। আর মিথ্যা প্রশংসা করার দায় তার নেই।

নিন্দুক

আশপাশে দেদার দোতলা-তেতলা আধুনিক বাড়ির মাঝে চৌধুরি পরিবারের এই জমিদার বাড়িটা অবাঞ্ছিত। প্রায় দু’বিঘার উপর বাগান-সমেত দোতলা ভবন। এককালে বসত জমি আরও বিস্তৃত ছিল, তবে তা কমতে কমতে এই জায়গায় এসে। তবে শতাব্দীপ্রাচিন বাড়িটা এখনও শিবরাত্রের সলতের মতো আভিজাত্য বহন করে চলেছে। বাড়িটা বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যাবে না। দেওয়ালের পলেস্তারা খসে ইঁট বেরিয়ে পড়েছে। তবে অন্দরের সাজসজ্জা যথাসম্ভব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা রয়েছে।
দোতলায় শ্বেতপাথরের মেঝের চওড়া বারান্দা শরতের সকালের ঝলমলে রোদ পড়ে চকচক করছে। সেই আলো বিচ্ছুরিত হয়ে পশ্চিমের দেওয়াল ও ছাদের কড়ি বর্গাগুলোতে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছে। ছাদ থেকে লম্বা দণ্ডে নেমে আসা একটা সিলিং ফ্যান সশব্দে ঘুরে চলেছে ক্লান্তিহীনভাবে। তার ঠিক নীচে আরাম কেদারায় আধশোয়া হয়ে গড়গড়ায় টান দিচ্ছিলেন জমিদার প্রতাপনারায়ণ চৌধুরি। বহুকাল আগেই জমিদারি গেছে। তবু তিনি জমিদার বাবুই রয়ে গেছেন। আর তাঁর স্ত্রী জমিদার গিন্নি। এমনটাই চলছে, তা প্রায় তিন পুরুষ ধরে।

প্রতাপনারায়ণের সামনে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বিগলিত মুখে বসেছিল তিনকড়ি। প্রতাপনারায়ণ গোঁফে বারদুয়েক তা দিতে সে বলল, “এ বার শুরু করি তাহলে কর্তা?”
তামাকের মৌতাতে প্রতাপনারায়ণের চোখ বন্ধ। তিনি মুখে কিছু না বলে শুধু হাতের পাইপটা একটু উপরে তুললেন।
তিনকড়ি ইশারা বুঝে বলতে শুরু করল, “জমিদারবাবু মহান। তিনলোকে তাঁর মতো লোক দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তিনি আমাদের জল ও অন্নদাতা। জমিদারবাবু ত্রিকাল….”

–থামো-থামো-থামো।
বিরক্ত মুখে সোজা হয়ে বসে প্রতাপনারায়াণ বললেন, “এতো আমার গুনগান। এ জন্য কী তোমায় রাখা হয়েছে।”
থতমত খেয়ে তিনকড়ি বলল, “আজ্ঞে না কর্তা।”
– তাহলে কীজন্য হয়েছে?
– আজ্ঞে কর্তা নিন্দা করার জন্য।
–কার নিন্দা?
– আজ্ঞে কর্তা নিধিরাম চাটুজ্জে‌র। মানে নিধারাম চ্যাটার্জির।
–হ্যাঁ, তাহলে সেইটেই তুমি করো।\

এই বলে আবার আরাম কেদারায় ভারি শরীরটা এলিয়ে দিলেন প্রতাপনারায়ণ।
তিনকড়ি চোখবুজে কিছুক্ষণ কী ভেবে নিয়ে বলতে শুরু করল–
–নিধিরাম চাটুজ্জে কেমন একটা যে!। পাঞ্জাবিগুলো পড়ে, খেয়াল করবেন কেমন যেন! লোকে তো দেখে হাসাহাসি করে। ঝুল আছে তো গায়ে চুপসে থাকে। ঢলা, তো সে আবার ট্যাঙট্যাঙে…
– না তিনকড়ি। ঠিক জমছে না।
চোখবুজেই প্রতাপনারায়ণ বললেন,
–তা ওর পাঞ্জাবির কারিগরটি কে?
–আজ্ঞে কর্তা, ওই যে মেটিয়াবুরজের সুলতান।
–আহ, তা তুমি এই সকালে বাড়ি বয়ে আসলে কি ওই মেটিয়াবুরুজের কোন সুলতান দর্জি, তার নিন্দে শোনাতে! তার জন্য কি তুমি আমার কাছে বখশিস পাও?
–আজ্ঞে মোটেই না কর্তা। আমি বলছিলুম কী, ওই চাটুজ্জে মশাইয়ের শরীরটাই না বেঢপের। ওই শরীরে ঝুতি-পাঞ্জাবি মানায় না। সত্যি বলতে কি, লুঙ্গি-স্যান্ডো ছাড়া ও শরীরে আর কিছুই মানাবে না। খেয়াল করবেন, উনি এগোলে ওনার পেটটা আগে আগে চলে। যেন জল….
–তিনকড়ি-ই-ই-ই।
গর্জন করে সোজা হয়ে বসলেন প্রতাপনারায়ণ। শরীরের প্রতিটি শিরায় যেন জমিদারির রক্ত ফুটছে। চোখ লাল।
গর্জন শুনে তিনকড়ি হামাগুড়ি দিয়ে বারো হাত দূরে সরে গিয়ে হাতজোর করে বসে রয়েছে। তাকে তর্জনি তুলে প্রতাপনারায়ণ বললেন,
–তুমি আমার কাছে আমার নিন্দা করতে এয়েচো? তোমার এ দুঃসাহস হল কোথা থেকে? তোমাকে কি এর জন্য চাটুজ্জে বখশিস দেবে?
আসলে নিধিরাম চাটুজ্জে‌র সঙ্গে প্রতাপনায়ারণের শরীরে কোনও ফারাক নেই। বয়সেও নয়। সে কারণে নিধিরামের শরীরে বিবরণে তাঁরও আঁতে ঘা লেগেছে।
তিনকড়ি কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল–
–আজ্ঞে কর্তা, আমি তো নিধিরামেরই নিন্দা করছিলুম। আপনি তো দেবতা। আপনার নিন্দা করার আগে ঠাকুর যেন আমাকে তুলে নেয়। এ বারটি ক্ষমা করে দেন কর্তামশাই। আমি কাল না হয় আরেকটিবার এসে আপনাকে খুশি করে যাব।
গড়গড়ায় পাইপে দু’বার টান দিয়ে প্রতাপনারায়ণ দেখলেন সেটা নিভে গেছে। মুখ বিকৃতি করে সেটা টান মেরে ফেলে দিয়ে বললেন–
–তাই বরং এসো। আজ ঠিক জমছে না।
তারপর ভৃত্য ভৃগুকে ডেকে বললেন–
–এই পাষণ্ডটাকে আটানা দিয়ে দে। আর কিছু খাইয়ে দে। আর আমার জল গরম বসা। স্নানে যাব।

লুচি-তরকারি-মিষ্টি সাবাড় করে কোঁচড়ে আধুলি ঢুকিয়ে জমিদার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে দক্ষিন দিক বরাবর হাঁটতে থাকল তিনকড়ি। তাঁর রোজগারপাতি বলতে তেমন কিছু নেই। একা মানুষ এদিক-সেদিক করে চলে যায়। জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোয় দুইপ্রস্থ সস্তার ধুতি-কুর্তা পায়। তাতেই চলে যায়। আর একবার একটা গেরস্থ বউ তাকে মায়া করে একটা ফুঁটো ছাতা দিয়েছিল। এছাড়া মাথা গোঁজার জন্য বাপ-ঠাকুরদার একটা দালান-ঘর আছে। তিনকড়ির সম্বল বলতে এটুকুই। তিনকূলে তার কেউ নেই। থেকে থাকলেও তাঁরা কেউ অকম্মা তিনকড়ির খোঁজ করেন না।

তা এই তিনকড়ি সারাদিন এ পাড়া, সে পাড়া ঘুরে, দোকান-বাজারে আড্ডা মেরে শুধুই লোকের নিন্দা করে বেড়াত। নিন্দাতেই তার পরম সুখ। তার জন্য মানুষকে পর্যবেক্ষণ করার আশ্চর্য ক্ষমতাও আছে তিনকড়ির। আশ্চর্য এই জন্য যে, কারও মধ্যেই প্রশংসা করার মতো কিছু দেখতে পায় না সে। আর মিথ্যা প্রশংসা করার দায় তার নেই। তবে আজকাল জমিদার ভানুপ্রতাপের প্রশংসা করতে হয়। তিনকড়ি এবার দায়ে পড়েছে। সামনে তো বটেই, পিছনেও। কারণ, তিনকড়ি মহানিন্দুক হতে পারে, তবে বেইমান বা অকৃতজ্ঞ নয়। ভানুপ্রতাপের খাস ভৃত্য ভৃগু তার এই হিল্লেটা করে দিয়েছে।
আজ বড় দোটানায় পড়ে গেছে তিনকড়ি। নিধিরাম চাটুজ্জে‌ তাকে তলব করেছেন। তাঁর ভৃত্য দু’দিন আগে রাস্তায় ধরেছিল তিনকড়িকে। নিধিরামও নিন্দে শুনতে চান। তিনিই ঠিক করে দেবেন কার নিন্দে করতে হবে। তিনকড়ি ভেবে দেখার জন্য দু’দিন সময় নিয়েছিল। আজ নিধিরামের সেরেস্তায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। সে কারণেই তিনকড়ি আজ প্রতাপনারায়ণের সামনে ঠিক মনখুলে নিধিরামের নিন্দা করতে পারছিল না।
তা না হলে অন্যদিন নিধিরামের নিন্দে করে প্রতাপনারায়ণের মন ভরিয়ে দেয় তিনকড়ি। আরাম কেদারায় গা এলিয়ে কেঁপে-কেঁপে হাসতে থাকেন প্রতাবনারায়ণ। তাঁর প্রকাণ্ড বপুর দুলনিতে দুলতে থাকে পুরো আরামাকেদারাই। সন্তুষ্ট প্রতাপনারায়ণ ভৃগুকে ডেকে তিনকড়িকে এক টাকা দেওয়ার হুকুম দেন।
নিধিরাম সেরেস্তাতেই ছিলেন। সাদা চাদরে মোড়া গদির উপর ক্যাসবাক্স। তার উপর জাব্দা খাতা খুলে সম্ভবত পাওনা-গণ্ডার হিসাব কষছিলেন। তাঁর ভৃত্য তিনকড়িকে নিয়ে ঘরে ঢুকতে তিনি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। সব শুনে চোখ চোখ থেকে চশমা খুলে হিসাবের খাতার উপর নামিয়ে রেখে বললেন, “বেশ-বেশ, তাহলে কিছু শোনাও দিকি।”

এইখানে নিধিরাম সম্পর্কে দু-একটা কথা জানিয়ে রাখা দরকার। নিধিরামের পূর্বপুরষরা চৌধুরি জমিদারদের মুনশি ছিলেন। তবে জমিদার প্রতাপনারায়ণের ঠাকুরদার সময়ে নিধিরামের ঠাকুরদা জমিদারির চাকরি ছেড়ে ব্রিটশদের ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে নুনের ব্যবসা শুরু করেন। আজ ব্যবসার অনেক শাখা-প্রশাখা। তবে নুনের ব্যবসা আর নেই। কালক্রমে জমিদারির জৌলুল যত ম্লান হয়েছে, তাদেরই এককালের মুন্সি পরিবারের জাঁকজমক বেড়েছে। ছোটবেলায় ভানুপ্রতাপ আর নিধিরাম একসঙ্গে স্কুলে গেছে। আমাবাগানে খেলেছে। জ্যোৎস্না রাতে চৌধুরি বিলে একসঙ্গে উলঙ্গ হয়ে সাঁতার কেটেছে। বড় হয়ে একসঙ্গে কলকাতার কলেজে গেছে। তবে কলেজের মাস্টাররা ভানুপ্রতাপের সঙ্গে অবিচার করে ফেল করিয়ে দিয়ে, নিধিরামকে পাস করিয়ে দেওয়া থেকেই দুজনের সম্পর্ক ভেঙে গেছে। দূরত্বটা প্রথমে তৈরি করেছেন ভানুপ্রতাপই। এখন নিধিরামও ভানুপ্রতাপের নিন্দায় এক গ্রাস ভাত বেশি খান।

তিনকড়ি দুই হাতের মুঠিতে ছাতাটা চেপে ধরে জোরহাতের ভঙ্গিতে বিনয়ের সঙ্গে বলল–
–আজ্ঞে কর্তা, কার নিন্দে করবো?
নিধিরামের ভাবাই ছিল। বললেন, ‘প্রতাপনারায়ণ চৌধুরী।’
একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল তিনকড়ি। জমিদার বাড়ির লুচি-তরকারি-মিষ্টি এখনও পেটে গিডগিজ করছে। কোঁচড়ে প্রতাপনারায়ণের দেওয়া আধুলিটা শরীরে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। কী মুখে এখন তাঁর নিন্দা করা যায়! অথচ, নিধিরামকে খুশি করতে না পারলে এ কাজটা হাতছাড়া হয়ে যাবে।
বারদুয়েক ঢোক গিলে তিনকড়ি বলল, “আজ্ঞে কর্তা, এই সবে আমি তো সে বাড়ি থেকেই এলুম। বাড়িটার কী ভগ্নদশা। নামেই জমিদার বাড়ি। প্রাসাদ। আসলে তো হানাবাড়ির মতো দেখতে। দেওয়ালের পলেস্তারা খসে ইঁট বেরিয়ে পড়েছে। লোহার সদর দরজায় জং ধরেছে। একটা তো ভেঙেই পড়েছে। কী করবেন আর, নামেই তো ভূস্বামী, বাড়ি রক্ষে করার মতো কানাকড়ি নেই।”
হা-হা করে হেসে উঠলেন নিধিরাম। সেই হাসির চোটে তাঁর ভুঁড়ি দুলে উঠলে। গোলগোল চোখের কোনে জল এল। দু’হাতের কব্জিতে সে অশ্রু মুছে চশমাটা আবার চোখে পড়ে নিলেন। তারপর মুখে প্রশান্তির ভাব ফুটিয়ে বললেন, “আরেকটা শোনাও দিকি।”
উৎসাহিত হয়ে তিনকড়ি গলাঝাড়া দিয়ে বলল, “জমিদারবাবু তো আর সন্তানের মুখ দেখতে পেলেন না। গিন্নি মা…”
–“রাসকেল…”, তিনকড়ির কথার মাঝে প্রচণ্ড হুংকার করে উঠলেন নিধিরাম।
সে থেমে দু’পা পিছিয়ে গেল। ছাতা মুঠোয় ধরে হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “কী বল্লুম কর্তা?”
–তোমাকে জমিদারগিন্নির নিন্দা করতে বলা হয়নি। তাছাড়া, কারও শারীরিক ত্রুটি নিয়ে কথা বলা ঠিক নয়।”
তারপর ক্যাসবাক্স খুলে দুটো টাকা বের করে তিনকড়ির দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
তিনকড়ি সেই টাকা দুটো তুলে নিয়ে কোঁচড়ে পুরে বলল, “পেন্নাম কর্তা।”
আশির্বাদের ভঙ্গিতে ডান হাত উপরে তুলে নিধিরাম বললেন, “এসো, মাঝে মাঝে প্রতাপনারায়ণের নিন্দে শুনিয়ে যেও।”

তিনকড়ি এতদিনে বুঝে গেছে কারও কাছে কারও নিন্দা করাটা মোটেই সহজ কাজ নয়। একজন একজনের কী রকম নিন্দা শুনতে চাইছে সেটা ধরে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতেহ। তিনকড়ি আগে নিজের পছন্দে নিন্দা করত। তার যা না-পসন্দ ছিল সেটাই সে দেখত। এখন মুশকিল হল অনে‌্যর অপছন্দের লোকের নিন্দা করা। এ বড় কঠিন কাজ।
তিনকড়ির নিধিরামের কাছে যাওয়ার খবরটা প্রতাপনারায়ণের কাছে গোপন থাকল না। একদিন সকালে ভৃগুকে দিয়ে তিনকড়িকে ডেকে পাঠালেন তিনি। তিনকড়ি হাতজোড় করে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালে প্রতাপনারায়ণ বললেন, “তুমি নাকি নিধিরাম চাটুজ্জে‌্যর কাছে গেছিলে?”
–“আজ্ঞে কর্তা, ঠিকই শুনেছেন। গেছিলুম।”
–“সেখানে আমার নিন্দা করেছিস।”
–“আজ্ঞে না তো কর্তা, প্রশংসাই করেছি। উনিও তো আপনার প্রশংসা করলেন।”
কথাটা বলে ইষ্টনাম স্মরণ করল তিনকড়ি। সে মিথ্যা বলতে চায় না, তবে মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিল যে কারও অনিষ্ট না হলে, সে মিথ‌্যা বলায় কোনও পাপ নেই।
–“নিধিরাম আমার প্রশংসা করল! তা কী বলল সে?
ভ্রু কুঁচকে বললেন প্রতাপনারায়ণ।
–ওই আরকি, বলছিলেন যে আপনি ওঁর কতবড় শুভাকাঙ্খী। পিতৃপুরুষের জমিদারি, পরম্পরা এখনও ধরে রেখেছেন আপনি। এইসবই বলছিল আরকি।
হুঁকোর ধোঁয়া ছেড়ে বেশকিছুক্ষণ কড়িকাঠের দিকে চেয়ে রইলেন প্রতাপনারায়ণ। সম্ভবত তাঁর ছেলেবেলা-কৈশোরের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গিয়ে থাকবে। তারপর, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আর কী বলল নিধু?”
বহুবছর পর আজ বন্ধুর ডাকনামটা বললেন প্রতাপনারায়ণ।
তিনকড়ি বলল, “বলছিলেন যে আপনার শরীরে জমিদারের রক্ত বইছে, আপনার মনও খুব বড়। আপনি কত মানুষের অন্নদাতা, ত্রাতা, রক্ষাকর্তা– এইসবই বলছিলেন।”
প্রতাপনারায়ণের চোখ ছলছল করছিল। সে ফতুয়ার হাতায় চোখ মুছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভৃগুকে বললেন, “সকালে বিল থেকে দুটো রুই মাছ উঠেছে। একটা একে দিয়ে দে। আর নায়েব মশাইকে আমার নাম করে বল দু’টো টাকা দিয়ে দিতে।”

পরের দিন নিধিরামের সেরেস্তায় ঢুকেই তাঁর পায়ে প্রায় আছড়ে পড়ল তিনকড়ি। নিধিরাম চমকে উঠেছিল। রে-রে করে সেরেস্তার কর্মচারীরা তাকে তুলে দাঁড় করালে তিনকড়ি কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “কত্তা মার্জনা করবেন। আমি জমিদারবাবুর নিন্দে করতে পারবো না।” চশমা চাপিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তিনকড়ির দিকে তাকিয়ে বেশকিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করলেন নিধিরাম। তারপর বললেন,
– ঠিক করে বলো তো কী হয়েছে?
– আজ্ঞে কর্তা জমিদারবাবু তো শুধুই আপনার প্রশংসা করেন। আমি আপনার নিন্দা করতে গলেই ধমক দেন। অমন ভগবানের মতো মানুষের নিন্দা আমি করতে পারবে না। আমাকে বিদায় করুন।

ফ্যালফ্যাল করে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে নিধিরাম চাটুজ্জে। মেঝেতে পড়ে থাকা ছাতা কুড়িয়ে নিয়ে ধীর পায়ে দরজায় এসে থমকে যায় তিনকড়ি। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন জমিদার প্রতাপনারায়ণ। তিনকড়ির কাঁধে হাত দিয়ে সেরেস্তায় ঢুকে পড়েন তিনি। গদি থেকে নেমে ছুটে এসে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেন নিধিরাম।

দেবাশিস কর্মকার

জন্ম একাত্তরের কলকাতায়। এক উদভ্রান্ত সময়ে। বর্তমানে পেশায় সাংবাদিক। যুক্ত আছেন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর সঙ্গে। টানা তেত্রিশ বছর ধরে সাংবাদিকতা ও সংবাদ সম্পাদনার পাশাপাশি লিখেছেন অজস্র ছোট ও বড় গল্প। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় কলেজ ম‌্যাগাজিনে। এরপর উৎসাভাস, নতুন গতি, সংবাদ প্রতিদিন, জাগো বাংলা, আনন্দবাজার পত্রিকা-সহ বহু পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা গল্প প্রকাশিত হয়েছে। সাংবাদিকতার সূত্রেই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা নিবিড়ভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। সে কারণে তাঁর প্রতিটি লেখাতেই তার ছাপ সুষ্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top