আমেনা

ছোটগল্প

।। ফাতেমা রিয়া ।।

-তোর জামাই কই?
– ডাহায়।
আমেনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে জবাব দিল। এরপরই মনে হলো ধলা মিঁয়ার হাত নিচের দিকে নামছে। আমেনা কী করবে বুঝতে পারলো না। অসুস্থ ছেলের সামনেই ধলা মিঁয়ার হাত তার বুকের দিকে গেল।


আমেনা

তখন দুপুর। বাইরে হাঁসমুরগি ডাকছে। আমেনা বেগমের ঘরটা ছোটখাটো। বাইরে বাঁশচাটাইয়ের বেড়া। এই দিনে এমন ঘর থাকাটা মোটেও শোভন না। সবারই  টিনের ঘর আছে। উঠান আছে এক চিলতে। তার একপাশে লাউমাচা। অন্য পাশে হাঁসমুরগির খোঁয়াড়। একটু দূরে ছোট সবজি খেত। ছাগল দুটো খুঁটির সাথে বাধা। ব্যা-ব্যা করেই যাচ্ছে। উঠোনের কোণে আমেনা বেগমের মাটির জোড়া চুলা। সেখানে পিঁড়ি পেতে বসে আমেনা লাউশাক কাটছে।

হাতে ব্যথা, কারণ স্বামী সকাল বেলা ঘুষি দিয়েছে কনুই বরাবর। ঘুষি দিয়েছে কারণ সে ছাগলগুলো বিক্রি করতে চায়, চায়ের দোকান দেবে। রাসু মিয়ার সাথে ঘুরে এই বুদ্ধি তার মাথায় এসেছে।

তার স্বামী আগে কামলা খাটত ক্ষেতে ঘুরে ঘুরে, তারপর ঢাকায় গিয়েছিল, চাকরিবাকরিও করেছে কিছুদিন। তারপর দেশে চলে এসেছে। আমেনার একটা ছেলে ছিল, মরে গেছে কিছুদিন হলো!

সেজন্যও স্বামীটার মাথা খারাপ। আমেনা বেগম চুপচাপ সহ্য করে নেয়, পুরুষ মানুষ এমন তো করবেই। তবে ছাগলগুলো বিক্রি করতে দেয়া ভাল হবে না মনে হয়। তার এই স্বামীটার ব্যবসা বুদ্ধি নাই, সে স্বল্প জ্ঞানে যা বুঝে তাই করে।

এই বাপ দাদার ভিটেমাটিতে বউকে এনে রেখেছে, আমেনা সেখানেই তার রাজ্য গড়ে তুলেছে। হাঁসমুরগী পালে, ডিম বিক্রি হয়, ছাগল গুলোর দুধ বিক্রি হয়, লাউ বিক্রি হয় মাঝে মাঝে। সবজি ক্ষেত থেকেও দু চার টাকা আয় হয়। আমেনার নিজের কোনোরকমে চলে যায়। তবে ঘরটা এখনো তোলা হলো না, খড়ের বাসায় আমেনার লজ্জা লাগে। সে টাকা জমাচ্ছে টিনের ঘর বানাবে তাই, যদিও এই খবর সে স্বামীকে দেয় নি। জানলে এই টাকাও ব্যবসার পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাবে। এমন না যে আমেনা বেগম স্বামীকে ভালোবাসে না, বিশ্বাস করে না, তার স্বল্প জ্ঞানে এইটাই মনে হয় এই  বেটা অন্য পুরুষদের মত না। এখনো বাচ্চা রয়ে গেছে মনে হয়, সেই হিসেবেই ছাড় দেয় আমেনা। ছেলেটা হারিয়ে সব দরদ কি এখন স্বামীর ওপর গিয়ে পড়লো।

আমেনার হাত কেটে যায় লাউ কাটতে কাটতে, ইদানিং এত অন্যমনস্ক হয়েছে সে।
হাত কেটে গিয়ে আরো ব্যথা বেড়ে গেল। তবে আমেনার রাগও হয় মাঝে মাঝে। তখন স্বামীকে ইচ্ছেমত গালও দেয় সে। পুরুষত্ব নিয়ে গাল দিলে স্বামী তাকে মারতে ওঠে। আমেনার কিন্ত এই তেজটা ভালোলাগে।

দাদীর কথা মনে পড়ে, দাদী ছোটবেলায় বলতো, পুরুষ রাগ করলে হয় বাদশাহ, মেয়ে মানুষ রাগ করলে হয় বেশ্যা।
ওমা, কত বড় কথা। আমেনা অবশ্য রাগ কমাতে চেষ্টা করেছে মাঝে মাঝে। তবে জীবন সংগ্রামে এসে এটা বুঝেছে মেয়ে মানুষের হালকা বিষ না থাকলে হয় না। থাকতেই হবে।

যেমন এই যে মেম্বার ধলা মিঁয়া, এই লোক রাতে বিরাতে আমেনার কাছে আসতে চায়। একদিন সন্ধ্যায় আসলো।

তখন আমেনার স্বামী ঘরে নেই, সে ঢাকায়। আমেনার ছেলেটা অসুস্থ, কলেরা চলছে। সেই অসুখেই তো মরলো। ছেলেটা চৌকিতে বসে কোঁকাচ্ছে, আমেনা কী করবে বুঝতে না পেরে ছেলের মুখে পানি ধরছে। ডাবের পানি এনে রেখেছিল ছেলের মুখে দিতেই বমি হলো। আমেনার চোখ জলে ছল ছল করছে আর ছেলের চোখ কোটরাগত। আমেনাও বুঝছিল ছেলেটা বাঁচবে না।

ওই সময় বাইরে থেকে একটা চাপা কন্ঠস্বর শোনা গেল, কিরে আমেনা আছস?

আমেনা মাথায় কাপড় দিয়ে বাইরে নামতেই দেখলো ধলা মিঁয়া।

– হোনলাম তোর পোলায় অসুস্থ।
– জে। কলেরা।
– ডাক্তার দেহাও নাই?
– দেহাইসি, ওষুধে ধরে না।
– কী কও! দেহি দি।

ধলা মিঁয়া ঘরে ঢুকলো তড়িঘড়ি করে, ছেলেকে দেখলো।
ছেলের চোখ মুখ পরীক্ষা করে বলল, মনে হয় বাঁচপে না।
আমেনা নিজেকে আর রাখতে পারলো না, হু হু করে কেঁদে দিল। ধলা মিঁয়া কী করবে বুঝতে না পেরে আমেনার কাঁধে হাত রাখলো।

-তোর জামাই কই?
– ডাহায়।
আমেনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে জবাব দিল। এরপরই মনে হলো ধলা মিঁয়ার হাত নিচের দিকে নামছে। আমেনা কী করবে বুঝতে পারলো না। অসুস্থ ছেলের সামনেই ধলা মিঁয়ার হাত তার বুকের দিকে গেল।
– এক্কারে চুপ। কতা কবি না।
ধলা মিঁয়া হিসহিসিয়ে উঠলো। আমেনা শুধু ফোঁপাচ্ছিল আর কাঁপছিল।
ছেলে চৌকিতে শুয়ে আছে। মেঝেতে ধলা মিঁয়া আর আমেনা।

আমেনার মনে নাই ছেলে কিছু দেখেছিল কিনা, হয়ত দেখেছিল। আমেনা সেদিন কিছু বলে নি। সে কী মান সম্মানের ভয়ে চুপ ছিল নাকি তারও কিছু দরকার ছিল?

ধলা মিয়া চলে গেল, আমেনা উঠে শাড়ি ঠিক করলো আর ছেলের দিকে তাকালো। ছেলে তার দিকে কোটরাগত চোখ দিয়ে জ্বল জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে।
ছেলের অসুস্থতার ব্যাপার আমেনার মাথায় আর রইলো না।
সে রাগী গলায় জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুই কি তোর বাপরে কইয়া দিবি?’
তার ৫ বছরের ছেলে কিছু বলে না, একটু কাতরায়ও। সম্ভবত যন্ত্রণা বেড়ে উঠেছিল।

আমেনার মনে নাই ছেলে কিছু দেখেছিল কিনা, হয়ত দেখেছিল। আমেনা সেদিন কিছু বলে নি। সে কী মান সম্মানের ভয়ে চুপ ছিল নাকি তারও কিছু দরকার ছিল?

আমেনা উত্তর না পেয়ে পাগল হয়ে যায়, সে ছেলের গলা চেপে ধরে। ছেলে ‘উহ উহ’ করে ওঠে।
– তোর বাপে আমারে ফালাইয়া রাইক্ষা গেছে, আর তোরে গলায় ঝুলাইয়া দিয়া গেছে, তুই মরছিস না কেন?
ছেলে ‘মা মা’ বলতে চেষ্টা করে, সে কি পানি খেতে চায়?
আমেনা পাগল হয়ে যায়।
সে ছেলেকে চড় দেয়, ‘ওই চুপ কইরা আছস কেন? ওই হারামির বাচ্চা চুপ কইরা আছস কেন? তোর বাপরে কইয়া দিবি?’

ছেলে হয়ত ‘না না’ বলতে চেষ্টা করে। যন্ত্রণা মানুষকে নিষ্ঠুর বানিয়ে দিতে পারে। আমেনার যন্ত্রণা জেগে উঠেছে। ভয়, লজ্জা, অপরাধবোধ সবকিছুর মিশেলে এই যন্ত্রণা কেমন যেন অচেনা আমেনার কাছে। এই অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার কোনো জায়গা নেই, ছেলের সাথে সন্ধি করবার কোন উপায় নেই, সে আধামরা। তার স্বামী তো তাকে মেরেই ফেলবে, ছেলের কি মনে থাকবে না? আচ্ছা ৫ বছরের ছেলে কি বোঝে?

আমেনা শান্ত হয়। ছেলে ততক্ষণে আরো মিইয়ে পড়েছে। আমেনার তো মনে আছে তার ছোট বয়সে কে তার গায়ে হাত দিয়েছিল, তখন বোঝে নি, এখন তো বোঝে।
এই ছেলে তো মনে রাখবে, বোঝার বয়স হলে ঠিকই বুঝবে। আমেনা আবার পাগল হয়ে যায়। হয়তো ভয়েই।

কেউ জানে না আমেনার ছেলে খুন হয়েছিল।
শুধু ধলা মিয়া বুঝলো কী হয়েছে। সে আর আমেনার ছায়া মাড়ালো না।  আমেনাকে দেখে ভয়ে জীর্ণ হয়ে যায়। আমেনা নিজেও ভেবে কূল পায় না তাকে দেখে কথা না বলার কী আছে, ভেবেছিল ধলা আবার আসবে। আসে নি।
ধলাকে একবার পথ ও আটকেছিল আমেনা। সেই লোক, ‘ওরে পোলাখাকী মাগী, সর’ বলে দ্রুত চলে গেল।

সেদিন আমেনা সারাক্ষণ ভাবলো পোলা সে কিভাবে খেয়েছে? ছেলেটা মাকে অমন অবস্থায় দেখে ফেলেছে বেঁচে থাকলে তো আজীবন কষ্ট পেত, আল্লাহর কাছে পাঠায়ে দিলাম। আমেনা আল্লাহর কাছে কেঁদেকেটে দোয়া করে, ছেলে যেন তার বেহেশতবাসী হয়।

যেই এক ই যন্ত্রণা আমেনাকে খুনী বানিয়েছিল, সেই পুরনো যন্ত্রণা আমেনাকে স্বামীর প্রতি আরো নরম করে দিল। সেই যন্ত্রণার সাথে অপরাধবোধ আছে, ভয় আছে। আমেনা মাঝে মাঝেই ভয় পেয়ে ওঠে, মাঝে মাঝে তার ছেলের জন্য তার মন পোড়ে, দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘায়িত হয়। এই পুরো দুনিয়ায় কেউ জানে না তার মনে কীচলে, সে কি করেছে, কেন করেছে। শুধু জানেন অন্তর্যামী৷ সে নামাজে বসে মাঝে মাঝে৷ জায়নামাজে বসে কান্নাকাটি করে। তার স্বামী অবশ্য সেসব বোঝে নি কখনো। কেন কান্না, কেন দীর্ঘশ্বাস এসব তার স্বামী খেয়াল করে দেখে নি কোনদিন।

ছেলে মরে গেছে শুনে এসে বিলাপ করলো কয়েকদিন। তারপর আমেনাকে গালিগালাজ করলো কয়েকদিন, এখন দিব্যি ঘুরে বেড়িয়ে ব্যবসার চিন্তা করছে।
সেই ব্যবসার টাকাও আমেনার দিতে হবে।
আমেনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

স্বামীর কথা শোনা যায়। আমেনার লাউকাটা হয়ে গিয়েছে। ইদানিং এত ভাবনায় পড়ে যায় সে। ভাত উথলে ফেন পড়ে যাচ্ছে। আমেনা তাড়াতাড়ি উঠাতে যায়।
ঘুষির ব্যথা আর বটিতে কাটা হাতে গরম হাড়ির তাপ সামলানো গেল না, ভাত পড়ে গেল।
তার স্বামী ততক্ষণে এসে চুলার কাছে দাড়িয়েছে।

‘ কিরে মাগী, কোন দিকে চাইয়া কাম হরো?’

আমেনা চুপ করে থাকে। স্বামীর কথার আর কোন জবাব দেবে না সে ভেবেছে।
ঘর থেকে আবার চাল নিয়ে আসে, হাড়ি ধোয়, লাউ চড়িয়ে দেয়।
তার স্বামী কোন উত্তর না পেয়ে হতাশ হয়ে ঘরে চলে যায়।
সামনের চকিতে শুয়ে পড়ে। সে ভাবছে অন্য কথা।

***

আমেনা স্বামীকে ব্যবসার টাকা দিয়েছে অবশেষে। এখন সে চায়ের দোকান দেবার বন্দোবস্ত করছে, ধলা মিঁয়ার সাথে মিলেমিশে বুদ্ধি করছে।

ধলা মিয়া এখন বাড়িতেও আসে। আমেনা মুড়ি মেখে দেয়। আমেনার স্বামী আর ধলা মিয়া উঠোনে বসে পিঁড়ি পেতে মুড়ি চিবোয়। আমেনা এক হাত ঘোমটা দিয়ে রান্নার কাজ করে। মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকায় ধলার দিকে। দেখে ধলাও তাকিয়ে আছে। কথা হয় তাদের। অল্প স্বল্প।

অবশ্য আমেনা বেগম এখন স্বামীকে ভালোবাসে, আরো বেশি ভালোবাসে। ঝগড়া হয় না বললেই চলে। সে ভেবেছিল তার স্বামীর ব্যবসা বুদ্ধি নাই, তবে মনে হয় ভালই চলবে। আমেনা আবার পোয়াতি হয়।

আবার বসন্ত আসে।

কোনো এক সন্ধ্যা, অমাবস্যা, চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমেনা ঘরে একা। তার স্বামী শহরে গিয়েছে।

আবার  ধলা মিঁয়ার পরিচিত চাপা স্বর শোনা যায়!

– আমেনা আছস?

আমেনার বুক ধ্বক করে ওঠে!


ছবি: প্রয়াত শঙ্কর কর্মকার (চিত্রকর ও চলচ্চিত্রী, পশ্চিমবঙ্গ)

ফাতেমা রিয়া

তরুণ গল্পকার, উপন্যাসও লিখেছেন। জন্ম ১৯৯৫ সালে। দেশের বাড়ি বরিশাল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পড়েছেন। সাহিত্য, সঙ্গীত, দর্শন ও রাজনীতে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।

Share