সাফো কি সফিস্টিকেটেড ছিলেন?

।। পৌলমী গুহ ।।

সাফোর যে ক’টি কবিতার অংশবিশেষ পাওয়া গেছে, সেটুকুই যথেষ্ট তাঁর কাব্যপ্রতিভাকে অমর করে রাখার জন্য। নারীর প্রতি প্রেম নিয়ে লেখা নারীরই কবিতা, সুতরাং নিঃসন্দেহে তাঁর যৌনচেতনা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। তা যদি ওঠেই, চুলচেরা বিশ্লেষণে প্রমাণও হবে তিনি সমকামী ছিলেন। তাঁর কবিতাই এর প্রমাণ, অতএব তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে সমকামী নারীদের যে অভিধায় ভূষিত করা হল, তা সাফোর জন্মস্থানের নাম থেকে উৎসারিত। এতেই যদি শেষ হতো তবে আর কীই বা হতো? তাই এর পরেও পণ্ডিতরা ঠিক মেনে নিতে পারলেন না। এক সমকামী নারী কবিতা লিখে লিরিক পোয়েটদের মধ্যে অন্যতম হয়ে বসলে ব্যাপারটা ঠিক মেনে নেওয়া যায় না! তাই, সাফোকে নিয়ে উদ্ভব হল এক নতুন লোককাহিনী।

হাতের স্মার্টফোনখানা খুললেই নিজের দেওয়ালে আছড়ে পড়তে থাকবে উচ্ছে-বেগুন বা হেমন্তের দুপুর বা শান্তিনিকেতনের কোনো বিকেল নিয়ে কবিতা। হয়তো কোনো গোপন কৈশোরে সুনীল-সন্দীপন ভালোলাগত। কিন্তু এখন কোনো এক ফেবুবোদ্ধার চুলচেরা বিশ্লেষণে বুঝে ফেললেন সেই ভালোলাগা নেহাতই ছেলেমানুষি ভালোবাসা; তাতে সাহিত্যরস নেই! যা যা পড়ে, বুঝে স্মার্টফোনে পৌঁছেছিলেন, এখন স্মার্টফোনের ততোধিক স্মার্ট মানুষদের বিচার বিশ্লেষণে ওগুলোকে বাদ দিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। কারণ কবিতা এখন স্ট্যাটাস। বঙ্গ-কবিরা সেই সতেশো-আঠেরো দশকেও এতো সমাদর পেতেন না, এখন যতখানি পান। সে ওই উচ্ছে-বেগুনের কবিতাই হোক বা পোস্টকার্ড, হারমোনিয়াম, শীতের দুপুরের।

তা বলে কি বাংলা কবিতা তথা বাংলা-সাহিত্যের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধিত হয়েছে? বাল্যে যে বাংলা ব্যাকরণ বইখানা উল্টেও দেখেনি সেও দু’চার লাইন স্মার্টফোনের দৌলতে লিখে ফেলতে পারে। তাতে পাঁচ-ছ’শো লাইক, কমেন্ট পড়েও যায়। তবুও কলকাতায় তথা পশ্চিমবঙ্গে পুজোবার্ষিকীর দাম দু’শো হলে লোকের কিনতে কেন ইচ্ছে হয় না কে বলবে? সম্ভবত এই বিপুল পরিমাণ পাঠক স্মার্টফোনের পর্দাতেই পড়তে স্বচ্ছন্দ, ছাপার অক্ষরে তাহাদের বিশেষ রুচি নাই! তাহলে বাংলা সাহিত্য বা বাংলা প্রকাশকদের আশার আলো জাগার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও আছে কিনা তা তর্কসাপেক্ষ। মোদ্দা কথা কবিতা এখন ভাষা, ছন্দ, ভাবরসের ধার ধারে না। কবিতা স্ট্যাটাসে পরিণত হয়েছে— এ বড়ো সুখের কথা, কিন্তু কেয়ারি করা বাগান ছেড়ে মার্বেলখচিত ড্রয়িংরুমে উঠে তার আদত স্বভাব গেছে বদলে। এখন কবিতার দর কবির চাইতে বেশি হয় না; অথবা, ঘুরিয়ে বললে কবিতার দর কবির দর দিয়েই মাপা চলে। কেন? কেন এই অকারণ বিদ্বেষ আমাহেন মানুষের? উত্তর ওই লাইক-কমেন্টেই খুঁজে পাবেন। অবশ্যই যদি কোনো লাইনে গড়ে দু’টো বানান ভুল পান, মাত্রাছাড়া কঠিন কঠিন বাক্য স্রেফ “ভাষাখানি ভালোই জানি হে!” ম্যানারে অথচ কমেন্টবক্সে প্রশংসার উচ্ছ্বাসে আপনিই একটি উজবুক বলে মনে হতে থাকে তবেই এসব চিন্তাভাবনা আসতে বাধ্য! টুক করে কবির স্ট্যাটাসটা দেখে আসুন। দামি পাঞ্জাবি বা নন্দনে, শান্তিনিকেতন বা দক্ষিণাপনেও পাওয়া যায় এমন গয়নায় তিনি সালংকারা কিনা, প্রোফাইলে কলকাতার বিখ্যাত কিছু ‘মুক্তচিন্তা’র আড্ডাখানার ছবি আছে কিনা, ছুটিতে দার্জিলিং-এর ম্যাল বা দোলে খোয়াইয়ে তাঁতের কুর্তা পরা ছবি পড়েছে কিনা, সকালে সাজানো ব্যালকনি ম্যান্ডাটরি কপির কাপ ও সন্ধ্যেয় আলো-আঁধারির মধ্যে ওয়াইন গ্লাস- এসব যদি থাকে, আপনি শিওর হতে পারেন এঁদের কবিতায় মাথা ও মুণ্ডু অনুপস্থিত থাকলেও প্রশংসা করাটা বাধ্যতামূলক!

আপনি যদি ততটা বোকা না হন, নজর করলে দেখবেন এদের লবিগুলি পয়সা দিয়ে রাখা পি আর এজেন্সিগুলোর চেয়েও বেশি করিৎকর্মা। একজন আরেকজনকে পিঠ চাপড়ানি দিলে তবেই পাল্টা পিঠ চাপড়ানি পাওয়া যেতে পারে। শুধু তাই নয়, আপনার হাতে সময় কম অথচ, আপনি সাহিত্যে নাম করবেন। এছাড়াও লেখার হাত আপনার বঙ্কিমসম নয়! তাহলে আপনাকে লবি ধরতেই হবে। টুকুস করে লবিতে নাম তুলে ফেললে কবি অথবা লেখক পরিচয় বাঁধা। আপনার ব্যাঙ্ক বা রাজ্য সরকারের চিটফান্ড বিজনেস ফেল মারতে পারে, কিন্তু এই লবির হিসেবে ভুলচুক নেই।

সাফো যে আসলে এক সাদাসিধে নারী, পুরুষ-প্রেমিকা, তিনিও যে আসলে পুরুষ কন্ঠালগ্না হতেই চেয়েছেন তা প্রমাণ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ স্বস্তির শ্বাস ফেলল।

কিন্তু হেমন্তের এই শীতমেদুর সময়ে খামোকা এ প্রসঙ্গ উঠবে কেন? এ তো হামেশাই হয়। তবে কিনা, একখানা অতিমারীর সময়ে চিন্তাভাবনায় কিঞ্চিৎ বদল আসাটা স্বাভাবিক ছিল। দেখা গেল অতিমারীও বাংলার কবিকুলকে বিন্দুমাত্রও দমাতে পারেনি। তাঁরা যে তিমিরে ছিলেন তাতেই গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন, শীঘ্র নড়বেন আশা নাস্তি! এব মধ্যে কূট প্রশ্ন মাথায় এল, এই যে বিপুল ও বিপুলা কবিগণ সর্বদা সচেষ্ট তাঁরা ব্যক্তিজীবনেও কতটা অনিন্দনীয় তার প্রমাণ রাখতে, তাঁদের ক্লান্তি আসে না? এঁদের প্রত্যেকের দেবদুর্লভ চরিত্র, অসামান্য রুচি ও পছন্দের বিজ্ঞাপনে মুখবই কেঁপে কেঁপে ওঠে। এঁরা সকলেই মুক্তচিন্তক, উদারমনা, সকলেই মানবজীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এত উচ্চমানের ও উচ্চ মনের মানুষ থাকলেও এই অভাগা দেশের মুক্তি নেই কেন এ এক আশ্চর্য রহস্য! এত শত উচ্চমানের কবির মধ্যে আমার জানতে ইচ্ছে করল এক গ্রীক নারীর কথা। লেসবস দ্বীপের সে কবি যদি এই শতাব্দীতে এই বঙ্গে কবি-রঙ্গভূমিতে পা রাখতেন কী হতো তাঁর মনোভাব?

সাফোর যে ক’টি কবিতার অংশবিশেষ পাওয়া গেছে, সেটুকুই যথেষ্ট তাঁর কাব্যপ্রতিভাকে অমর করে রাখার জন্য। নারীর প্রতি প্রেম নিয়ে লেখা নারীরই কবিতা, সুতরাং নিঃসন্দেহে তাঁর যৌনচেতনা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। তা যদি ওঠেই, চুলচেরা বিশ্লেষণে প্রমাণও হবে তিনি সমকামী ছিলেন। তাঁর কবিতাই এর প্রমাণ, অতএব তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে সমকামী নারীদের যে অভিধায় ভূষিত করা হল, তা সাফোর জন্মস্থানের নাম থেকে উৎসারিত। এতেই যদি শেষ হতো তবে আর কীই বা হতো? তাই এর পরেও পণ্ডিতরা ঠিক মেনে নিতে পারলেন না। এক সমকামী নারী কবিতা লিখে লিরিক পোয়েটদের মধ্যে অন্যতম হয়ে বসলে ব্যাপারটা ঠিক মেনে নেওয়া যায় না! তাই, স্যাফোকে নিয়ে উদ্ভব হল এক নতুন লোককাহিনী। বলা হল কান্ডারী ফাওনের প্রেমে পাগল হয়ে স্যাফো সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এতে সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। সাফো যে আসলে এক সাদাসিধে নারী, পুরুষ-প্রেমিকা, তিনিও যে আসলে পুরুষ কন্ঠালগ্না হতেই চেয়েছেন তা প্রমাণ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ স্বস্তির শ্বাস ফেলল।

এ হেন বিতর্কিত এক নারী আজকের বঙ্গ-কবিসমাজে ধরুন চলেও যদি বা আসেন তাঁর প্রাথমিক আপ্যায়ন কীরকম হবে? যদিও সুপ্ত পুরুষতান্ত্রিকতা, সমকামীদের প্রতি ঘৃণা বা অবজ্ঞা পায়খানা-পেচ্ছাপের মতো চেপেই বঙ্গ কবিসমাজ প্রগতিশীল হয়েছে, তবুও দোহারা চেহারার ছোট্টোখাট্টো স্যাফো লেখার মাধ্যমে আলোড়ন নিশ্চয়ই তুলে ফেলতেন। তারপর অবশ্য তাঁকে নিয়ে লবিতে লবিতে যুদ্ধ বেঁধে যেত। তাঁর ছবি বা পোস্টে লবির মাথারা কমেন্ট রাখতেন,”আপনার লেখার হাত সত্যিই মসৃণ!” অথবা, “আজ নন্দনে তমুক বিজ্ঞের নাটকের শো’তে আসবেন তো?” স্যাফো যদি সমকামীদের অধিকার নিয়ে পোস্ট করতেন ‘পুরুষ’ কবিরা একটু দুঃখ পেতেন ঠিকই, তবে নব-উদ্যমে ফিরেও আসতেন। স্রেফ এই ভরসাতেই যে, উনি সেরকম ‘পুরুষ’ দেখলে নিশ্চয়ই ‘গলে’ যাবেন। সাফোর রাতের ইনবক্স বিভিন্ন কামার্ত বাঘা কবিদের ব্যক্তিগত বার্তা ও গোপনাঙ্গের ছবিতে ভরে গেলেও যেতে পারত। আর কে জানে বইমেলা বা পৌষ উৎসবে অত্যুৎসাহী কবি, শিল্পীদের থাবা থেকে বেঁচে ফিরে ‘মি-টু’ পোস্টও লিখতে হতো! তাঁর কবিতা-ভাবনার চেয়ে বড়ো হয়ে উঠত রাজনৈতিক ভাবনা। কবিতার ছন্দের চেয়ে প্রাধান্য পেত তাঁর যৌনাচারণ। কবি তিনি নামেই হতেন, কারণ কবি আসলে একটি স্ট্যাটাস, তাতে শিল্পের নামগন্ধ খুঁজতে গেলে ভুল হবে।

তবে পরিবারের রাজনৈতিক ঘোঁটে ফেঁসে গিয়ে নির্বাসিত হওয়া সাফো সমাজতন্ত্র নিয়ে পোস্ট করতেন কিনা সন্দেহ আছে। সকালে সাজানো ব্যালকনিতে কফির কাপ বা সন্ধ্যের ওয়াইন নিয়েও ওঁর ইমেজ তৈরি করার প্রয়োজন পড়ত বলে মনে হয় না। মন ও মনন বোঝাতে ক্রমাগত নিজের উচ্চমানের রুচি, পছন্দের ক্লান্তিকর বিজ্ঞাপন দেখিয়ে অন্যকে হেয় করে আত্মপ্রসাদ লাভ করার চেষ্টাও মনে হয় না করতেন। কবির ধর্ম মেনে কবিতাচর্চাতেই জীবনের সমস্ত সুখ, আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করতেন, যা সে যুগের অতো ছিমছাম গ্রীসেও খুব সহজ হয়নি! মোট কথা, বঙ্গকবিকুলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় স্যাফো হারলেই কবিতার জিত হবে। কান্ডারির প্রয়োজন আসলে তাঁর কখনওই পড়েনি। তিনি একমাথা এলোচুলে সমুদ্রের দিকে চোখ রেখে স্বীয় অহংকারে দাঁড়াতে পারেন। সমাজের টিটকিরি সমুদ্রের গর্জনে চাপা তো পড়েই যাবে।

না, সাফো সফিস্টিকেটেড হতে পারবেন না!

এ হেন বিতর্কিত এক নারী আজকের বঙ্গ-কবিসমাজে ধরুন চলেও যদি বা আসেন তাঁর প্রাথমিক আপ্যায়ন কীরকম হবে? যদিও সুপ্ত পুরুষতান্ত্রিকতা, সমকামীদের প্রতি ঘৃণা বা অবজ্ঞা পায়খানা-পেচ্ছাপের মতো চেপেই বঙ্গ কবিসমাজ প্রগতিশীল হয়েছে, তবুও দোহারা চেহারার ছোট্টোখাট্টো স্যাফো লেখার মাধ্যমে আলোড়ন নিশ্চয়ই তুলে ফেলতেন। তারপর অবশ্য তাঁকে নিয়ে লবিতে লবিতে যুদ্ধ বেঁধে যেত। তাঁর ছবি বা পোস্টে লবির মাথারা কমেন্ট রাখতেন,”আপনার লেখার হাত সত্যিই মসৃণ!” অথবা, “আজ নন্দনে তমুক বিজ্ঞের নাটকের শো’তে আসবেন তো?” স্যাফো যদি সমকামীদের অধিকার নিয়ে পোস্ট করতেন ‘পুরুষ’ কবিরা একটু দুঃখ পেতেন ঠিকই, তবে নব-উদ্যমে ফিরেও আসতেন। স্রেফ এই ভরসাতেই যে, উনি সেরকম ‘পুরুষ’ দেখলে নিশ্চয়ই ‘গলে’ যাবেন। সাফোর রাতের ইনবক্স বিভিন্ন কামার্ত বাঘা কবিদের ব্যক্তিগত বার্তা ও গোপনাঙ্গের ছবিতে ভরে গেলেও যেতে পারত। আর কে জানে বইমেলা বা পৌষ উৎসবে অত্যুৎসাহী কবি, শিল্পীদের থাবা থেকে বেঁচে ফিরে ‘মি-টু’ পোস্টও লিখতে হতো! তাঁর কবিতা-ভাবনার চেয়ে বড়ো হয়ে উঠত রাজনৈতিক ভাবনা। কবিতার ছন্দের চেয়ে প্রাধান্য পেত তাঁর যৌনাচারণ…

পৌলমী গুহ

নিবাস পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে কোনোও পেশায় যুক্ত নেই। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ, ‘শিশির শিকারের পর’।

Share