তন্ত্র থেকে সহজ: একটি আধ্যাত্মিক পরিক্রমা

অনুবাদ: সায়ন সেন

।। কুলাবধূত সৎপুরানন্দ ।।

“আধ্যাত্মিকতা কি বস্তুর থেকে পৃথক বা বস্তু কি আধ্যাত্মিকতার থেকে পৃথক? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রভু নাগার্জুন ‘প্রতিত্যসমুৎপাদ’-এর কথা বলেন। মহাজাগতিক বিবর্তনের  প্রক্রিয়ায় যা বাস্তব বনাম সত্যের ধাঁধা, সেখান থেকেই এই যুক্তির উৎপত্তি। বুদ্ধের মনে নির্বাণ চিন্তার আবির্ভাব হয়েছিল জাগতিক দুঃখের একটি বিপরীত তত্ত্ব রূপে। নির্বাণের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বস্তুসত্তা শুধুই মহাশূন্যের একটি অনিত্য প্রতিফলন এবং সেই মহাশূন্য নির্বাণেরই স্বরূপ। সুতরাং নির্বাণ থেকে বস্তুজগৎ বা সংসারের উৎপত্তি, একইসাথে সংসার থেকে নির্বাণের আকাঙ্খার উৎপত্তি, এই দুই অনুভূতিগত ধারণাই একে অপর থেকে উদ্ভূত এবং একে অপরে বিলীন। একেই নাগার্জুন বলেছেন শূন্যতা।”

একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অবধূত, বজ্রযানী তন্ত্রগুরু, চিত্রকর, কবি, গবেষক ও শিক্ষক কুলাবধূত সৎপুরানন্দের ইংরাজি ভাষায় দেওয়া একটি ভাষণের অনুলিখন থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সায়ন সেন — ‘প্রতিপক্ষ’র বিশেষ বর্ষপূর্তি সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হলো। খুব শীঘ্রই বাংলা ভাষায় লেখা কুলাবধূত সৎপুরানন্দের মৌলিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে চলেছে আমাদের পত্রিকায়।

তন্ত্র থেকে সহজ: একটি আধ্যাত্মিক পরিক্রমা

মানবসভ্যতার সেই ঊষালগ্ন থেকে, দুটি জিনিস মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্যরূপে  স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে ‘হোমোসেপিয়েন’- এর চয়নগত বস্তুসভ্যতার আবির্ভাব।  দ্বিতীয়টি হচ্ছে মানবিক উপলব্ধির ভিত্তিরূপে আধ্যাত্মিকতার উদ্ভব। এই দুটি জিনিসই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অন্বেষণে ব্রতী।

মানবমন সংক্রান্ত সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো এই দুই বৈশিষ্ট্যর উৎপত্তি নিয়ে। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অন্বেষণ ও আবিষ্কার করার জন্যই এই দুই বৈশিষ্ট্যর উদ্ভব হয়েছিল। এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিটি আদতে কী? আর সেই স্বাধীনতার অর্থই বা কী যার সন্ধান মানুষ করছে যদি মানুষ সত্যি তা পেয়ে থাকে! ‘হোমোসেপিয়েন’ মনের বস্তুবাদী বৈশিষ্ট্য তাকে ‘চয়নের স্বাধীনতা’ আখ্যা দিয়ে থাকে। আধ্যাত্মিক জগতের মানবিক উন্মেষ তার নাম দিয়েছে ‘মুক্তি’। আপনি যদি ‘চয়নের স্বাধীনতা’ মেনে বস্তুনিষ্ঠ মার্গে চলেন, সেক্ষেত্রে যে সমস্ত জিনিস আপনাকে সন্তুষ্টি দান করে আর সেইসমস্ত জিনিসের সঙ্গে যা কিছু সম্পৃক্ত আপনি সেসবের কামনার বাঁধনে বাঁধা পরবেন। আধ্যাত্মিক উন্মেষ সেই সমস্ত  ‘চয়নের স্বাধীনতা’ থেকে মুক্তি দিতে চায় এবং ‘চয়নের স্বাধীনতা’কে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা বৌদ্ধিক স্বাধীনতার পথে মূল প্রতিবন্ধকতারূপে স্বীকার করে। মন যদি কাম্য বস্তু্র প্রতি ধাবিত হয়, তাহলে মন কি আদৌ সেইসমস্ত কামনা এবং লক্ষ্যের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে?

কিন্তু কেউই জীবন গঠনের এই দুই সমান্তরাল পথের গুরুত্বকে উপেক্ষা করতে পারেন না । ”আমি দেহ নই, জৈব চেতনা নই, মানসিক উন্মেষ নই, বিচারমূলক বাস্তবতা নই, বা সর্বান্তে কোনো সত্তা নই”— তাত্ত্বিকভাবে এইরূপ স্বীকার করেও আদি শঙ্করাচার্য কিন্তু নিজের সত্যকে প্রচার করেছিলেন সত্তার আলোকে, তাঁর বুদ্ধির বিচার দিয়ে। তিনি তাঁর মানসিক বিচার দিয়ে গ্রহণ এবং মানসিক ত্যাগ দিয়ে বর্জন করেছিলেন। তাঁর জীবনগত চেতনার আবেগে স্তোত্র রচনা করেছিলেন এবং চারটি মঠ ও একটি নতুন বৃহৎ সংগঠন স্থাপন করেছিলেন যা দাবী করে যে এই জগৎ একটি বিভ্রম বা ইলিউশন অর্থাৎ কি না জগৎ মিথ্যা ! খুবই হাস্যকর। বুদ্ধ সত্যকে শূন্যরূপে আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও তিনি ধর্ম প্রচার করেন এবং মঠ নির্মাণে অনুমতি দেন যে মঠগুলি এই বস্তুজগতের অনুদানের উপর নির্ভরশীল। বেদ এবং বেদান্তের চূড়ান্ত রায় এই যে — সত্য বাক ও মনের অতীত! অথচ এই সত্যের আলোচনার জন্যে, চিন্তা করার জন্য এই সম্মেলনে আমরা মিলিত হয়েছি!

পৃথিবীতে যে সমস্ত শামান বা প্রকৃতি উপাসক বা প্রকৃতিবাদী মনস্তত্ববিদ বা আধ্যাত্মিক সাধুজনেরা আছেন, তাঁরা কিন্তু সেইসব আধুনিক বিজ্ঞান ও শিল্পায়নপ্রসূত পণ্যসামগ্রী ব্যবহার থেকে বিরত হননি যা পঞ্চতত্ত্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে । ধাতব যুগের প্রারম্ভ থেকে আজ পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন খননকার্য পৃথিবীর বিভিন্ন মৃত্তিকা স্তরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে এবং সৃষ্টি করেছে জটিল এক পরিস্থিতির যা পৃথিবীর ভর ও মাধ্যাকর্ষণের কম্পাঙ্ককে পাল্টে দিয়েছে , ফলস্বরূপ একের ফর এক হাজির হচ্ছে মহামারী ,ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক ও সামাজিক দুর্যোগ। যেহেতু নগরসভ্যতার বর্জ্যপদার্থ প্রতিনিয়ত নদীতে নিক্ষেপ করার মতো বিষয় জারি আছে, যেহেতু বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ রুদ্ধ করা হচ্ছে, আর তাই এসবের প্রতিক্রিয়ায় ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে জলের শক্তিপ্রবাহে। বিবিধ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। ধ্বংস হচ্ছে বর্ষা-সহ ঋতুচক্রের স্বাভাবিক রূপ। নিয়ত হাজির হচ্ছে খরা ও বন্যা।

শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে ‘কাইনেটিক এনার্জি’কে নানাভাবে ব্যবহার করার করে ফলে অগ্নিতত্ত্বে একটি বিরাট পরিবর্তন এসেছে যা কিনা নষ্ট করেছে ‘পোটেনশিয়াল এনার্জি’ ও ‘কাইনেটিক এনার্জি”র ভারসাম্য। এর ফলে উদয় হচ্ছে নতুন নতুন শারীরিক ও মানসিক রোগ। উদাহরণস্বরূপ আমরা জাপানের প্রযুক্তিগত সাফল্য এবং পারমাণবিক দুর্যোগের উদাহরণ দিতে পারি। শিল্পবিপ্লবের সময়ে থেকে বিভিন্ন রাসায়নিক উদ্গীরণ ও তার প্রতিক্রিয়ায় বায়ুদূষণে ভারসাম্য নষ্ট করেছে বায়ুতত্ত্বের ভারসাম্য নষ্ট করেছে, জন্ম দিয়েছে নতুন নতুন রোগের। এমনকি আকাশতত্ত্ব যা কিনা ব্যোমের একটি আস্তরণ তাও দুনিয়াব্যাপী অন্তর্জাল তরঙ্গ দ্বারা দূষিত হয়েছে এবং ব্রেন ক্যান্সার, উদ্ভিদ ও পশুদের নতুন ব্যাধি এবং ব্যক্তিসত্তার সংকট তৈরি করেছে। মানুষের এই তথাকথিত ‘চয়নের স্বাধীনতা’ প্রাকৃতিক বিবর্তন প্রক্রিয়াকে বিকৃত করে সংকর প্রজাতির উদ্ভিদ, দূষণকারী প্লাষ্টিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের জন্ম দিয়েছে। তার থেকে কি ‘মুক্তি’ সম্ভব?

এই ‘চয়নের স্বাধীনতা’ বা ‘মুক্তি’ কি নিছক একটি মানব-অনুভূতির মায়াজাল বা কোনো গভীর রহস্য? যেভাবে কিনা বারবার একই ধাঁধার পাকেচক্রে আমাদের ঘুরতে হচ্ছে? যদি আমরা বলি যে তা একটি ধোঁকা, বা এই দ্বৈত জগৎ নিছকই একটি মায়াজাল, তাহলে আসুন আমরা সকলে প্রাণ খুলে হাসি যে এমন একটি ধোঁকাকে আমরা এত গুরুত্ব দিচ্ছি। আর যদি আমরা মনে করি যে এই ধাঁধা আসলে একটি গভীর রহস্য, তাহলে আমাদের দায়িত্ব সেই রহস্য উন্মোচন করার এবং দেখা উচিত যে সত্য কি বাস্তব নাকি বাস্তব ও সত্য পৃথক?

”আমি দেহ নই, জৈব চেতনা নই, মানসিক উন্মেষ নই, বিচারমূলক বাস্তবতা নই, বা সর্বান্তে কোনো সত্তা নই”— তাত্ত্বিকভাবে এইরূপ স্বীকার করেও আদি শঙ্করাচার্য কিন্তু নিজের সত্যকে প্রচার করেছিলেন সত্তার আলোকে, তাঁর বুদ্ধির বিচার দিয়ে। তিনি তাঁর মানসিক বিচার দিয়ে গ্রহণ এবং মানসিক ত্যাগ দিয়ে বর্জন করেছিলেন। তাঁর জীবনগত চেতনার আবেগে স্তোত্র রচনা করেছিলেন এবং চারটি মঠ ও একটি নতুন বৃহৎ সংগঠন স্থাপন করেছিলেন যা দাবী করে যে এই জগৎ একটি বিভ্রম বা ইলিউশন অর্থাৎ কি না জগৎ মিথ্যা ! খুবই হাস্যকর।

আধ্যাত্মিকতা কি বস্তুর থেকে পৃথক বা বস্তু কি আধ্যাত্মিকতার থেকে পৃথক? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রভু নাগার্জুন ‘প্রতিত্যসমুৎপাদ’-এর কথা বলেন। মহাজাগতিক বিবর্তনের  প্রক্রিয়ায় যা বাস্তব বনাম সত্যের ধাঁধা, সেখান থেকেই এই যুক্তির উৎপত্তি। বুদ্ধের মনে নির্বাণ চিন্তার আবির্ভাব হয়েছিল জাগতিক দুঃখের একটি বিপরীত তত্ত্ব রূপে। নির্বাণের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বস্তুসত্তা শুধুই মহাশূন্যের একটি অনিত্য প্রতিফলন এবং সেই মহাশূন্য নির্বাণেরই স্বরূপ। সুতরাং নির্বাণ থেকে বস্তুজগৎ বা সংসারের উৎপত্তি একইসাথে সংসার থেকে নির্বাণের আকাঙ্খার উৎপত্তি, এই দুইই অনুভূতিগত ধারণাই একে অপর থেকে উদ্ভূত এবং একে অপরে বিলীন। একেই নাগার্জুন বলেছেন শূন্যতা।

শূন্যতা কোনো কিছুর অস্তিত্ব বা অস্তিত্বের খণ্ডন নয়। শূন্যতা অস্তিত্বের নিরপেক্ষ ও যথার্থ রূপ। এটি অনেকটা একটি গাণিতিক সংখ্যার মতো যা ধনাত্মক বা ঋণাত্মক রূপ নিতে পারে কিন্তু তার প্রকৃত সত্তা হলো শূন্য। এটি হলো মহাশূন্যে উত্তরণ। সবকিছুই চৈতন্যে রূপান্তরিত হয়। চৈতন্য হলো দ্বৈতসত্তা ও অদ্বৈতসত্তার ভিত্তিরূপ। চৈতন্য অনুভূতি দিয়ে বোঝা যায়না, চৈতন্য শুধু চৈতন্য দিয়েই বোঝা যায়। আত্মোপলব্ধির এই পরম্পরাটি বাস্তবকেই সত্যরূপে স্বীকার করে এবং তার ফলে এই মতবাদের নাম বিজ্ঞানবাদ। নাগার্জুন এই মনস্তাত্ত্বিক অভ্যাসের জনক এবং তিনি এর নাম দেন অচিন্ত্যযোগ অর্থাৎ অনুভূতির ঊর্ধ্বে বাস্তবতা ও সত্য ( দ্বৈত ও অদ্বৈত) এই দুই মেরুর একত্ব বা অদ্বয়।

শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে ‘কাইনেটিক এনার্জি’কে নানাভাবে ব্যবহার করার করে ফলে অগ্নিতত্ত্বে একটি বিরাট পরিবর্তন এসেছে যা কিনা নষ্ট করেছে ‘পোটেনশিয়াল এনার্জি’ ও ‘কাইনেটিক এনার্জি”র ভারসাম্য। এর ফলে উদয় হচ্ছে নতুন নতুন শারীরিক ও মানসিক রোগ…

নাগার্জুন

এই বিষয়টাকে অনুভূতি দিয়ে বুঝতে গেলে আমাদের অনুভূতি থেকে বিচার, বিচার থেকে চিন্তা, এবং চিন্তা থেকে একটি বস্তুগত আধ্যাত্মিকতার দিকে যেতে হবে। এর গড়নটি এমন যে বিশ্বের অধ্যাত্মবাদীরা একে বিশ্বায়িত বাস্তবতারূপে স্বীকৃতি দেবেন:

১) আকাশ মহাজাগতিক অস্তিত্বের সাথে যুক্ত যা কিনা মানবজীবনে ব্যক্তিসত্তায় (অহং) রূপান্তরিত হয়েছে
২) বায়ু বাষ্পীভূত অস্তিত্বের সাথে যুক্ত যা কিনা মানবজীবনে বুদ্ধি বা বিচারবৃত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে
৩) অগ্নি দাহ্যমূলক অস্তিত্বের সাথে যুক্ত যা কিনা মানবজীবনে মানসিকবৃত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে
৪) জল তরল অস্তিত্বের সাথে যুক্ত যা কিনা মানবজীবনে আবেগবৃত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে
৫) পৃথিবী কঠিন অস্তিত্ত্বর সাথে যুক্ত যা কিনা মানবজীবনে শারীরিকবৃত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে

অধ্যাত্মবিজ্ঞান হলো মানবচেতনার বিবর্তনের কাঠামো যা মহাজাগতিক বিবর্তন থেকে পৃথিবীর বিবর্তন, পৃথিবীর বিবর্তন থেকে প্রাণীক বিবর্তন, প্রাণীক বিবর্তন থেকে মানুষের বিবর্তন, মানুষের বিবর্তন থেকে মানুষের অনুভবের বিবর্তনের পরম্পরা। ভারতে একে ‘তন্ত্র নাম দিয়েছেন নাগার্জুন (খৃ.পূ. দ্বিতীয় শতক থেকে দ্বিতীয় ক্রিস্টাব্দ) যিনি তাঁর পূর্বের আগম বিচারধারা  বা জীবনের গড়ন নিয়ে প্রভূত গবেষণা করেছিলেন। তাঁর লেখা প্রথম তন্ত্র পুস্তক ‘গুহ্যসমাজতন্ত্র’ একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। পরবর্তীকালে অষ্টম খ্রিস্টাব্দে স্বয়ম্ভূনাথ এটিকে উন্নীত করেন একটি মানসিকবিজ্ঞানরূপে যা বস্তুজগৎ ও অধ্যাত্মজগতের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে। তাঁর শিক্ষা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে প্রসিদ্ধ। ভারতের কোথাও তা ‘নবনাথ সম্প্রদায়’ নামে প্রসিদ্ধ, কোথাও কৌলক্রম বা ‘কাশ্মীরী শৈবপন্থা’ নামে, কোথাও আবার বজ্রযানী বৌদ্ধধর্ম বা তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম নামে এবং কোথাও কোথাও সিদ্ধযোগ পরম্পরা নামেও প্রসিদ্ধ। এই মার্গের প্রাচীন সাধকেরা চুরাশি সিদ্ধ নামে পরিচিত। শৈবধর্ম, শাক্তধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মে এই সকল সাধকরা সম্মানিত। কিছু জীবনীমূলক তথ্য এমনকি যীশু খ্রিস্ট এবং হজরত মহম্মদকেও নাথপন্থার আদি সিদ্ধ রূপে স্বীকার করে। তন্ত্রযোগীদের এই পরম্পরা ভারতের সমস্ত শামান সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানকে মান্যতা দেয় এবং জগতের সকলপ্রকার চিন্তাভাবনাকে আমন্ত্রণ জানায়।

তন্ত্র মানে কাঠামো বা বলবিজ্ঞান। তন্ত্র হলো সেই মহাজাগতিক বলবিজ্ঞান যা মানবজীবনের প্রত্যেক আঙ্গিককে নিজের বিভিন্ন মাত্রায় স্থান দেয় এবং শূন্যতায় উত্তরণের এক সরল ছন্দের দিশা দেয়, এটাই ‘সহজ’ নামে পরিচিত। ‘সহজ’ হলো ভিন্ন মেরুর স্বাভাবিক ভারসাম্য যা সমন্বররূপে মানুষের আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতায় মধ্যে প্রতিফলিত হয়।

ভারতের কোথাও যা’নবনাথ সম্প্রদায়’ নামে প্রসিদ্ধ, সেটাই কোথাও কৌলক্রম বা ‘কাশ্মীরী শৈবপন্থা’ নামে, কোথাও আবার বজ্রযানী বৌদ্ধধর্ম বা তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম নামে এবং কোথাও কোথাও সিদ্ধযোগ পরম্পরা নামেও প্রসিদ্ধ। এই মার্গের প্রাচীন সাধকেরা চুরাশি সিদ্ধ নামে পরিচিত। শৈবধর্ম, শাক্তধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মে এই সকল সাধকরা সম্মানিত। কিছু জীবনীমূলক তথ্য এমনকি যীশু খ্রিস্ট এবং হজরত মহম্মদকেও নাথপন্থার আদি সিদ্ধ রূপে স্বীকার করে। তন্ত্রযোগীদের এই পরম্পরা ভারতের সমস্ত শামান সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানকে মান্যতা দেয় এবং জগতের সকলপ্রকার চিন্তাভাবনাকে আমন্ত্রণ জানায়।

সহজের স্বতঃপ্রকাশ

পৃথিবীর হলুদ এবং আকাশের নীল মিলে জীবনের শ্যামলের জন্ম দেয়। জীবনের শ্যামল হলো সেই দেহ-মন অদ্বৈতর সমান্তরাল। দেহমন একাত্মতা হলো সেই আদর্শ ভারসাম্যের ভিত্তি, যা একজন মানুষকে যথার্থরূপে সাধারণ করে তোলে। পৃথিবীর শৃঙ্খলা এবং আকাশের মুক্তির সেই একাত্মতা হচ্ছে সাধারণ নর ও সাধারণ নারীর সীমারেখা। এই দুয়ের সাম্য দেহের দ্বৈত এবং মনের অদ্বৈতর সেই ভারসাম্য, যা জীবনপূর্ণ সমাধি এবং সমাধিপূর্ণ জীবনের অধব্যসায় ছাড়া সম্ভব নয়। এটি একটি সহজ চেতনা যা বদ্ধ অহংকে কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই বন্ধনমুক্ত করে। প্রেম হলো সেই সাম্য যা নৈতিক প্রত্যাশা এবং পূর্ণমুক্তির প্রত্যাশা (যা কোনো হেতুর উপর নির্ভরশীল নয়)। সেই ভারসাম্যের কণ্ঠস্বর হলো আমাদের বিবেক।

ͽ●ͼ

যথার্থ স্বতঃস্ফূর্ততা সকল কামনা ও অনুভূতি থেকে মুক্ত।
যথার্থ স্বতঃস্ফূর্ততা তখনই সম্ভব যখন অনুভূতি একটি নিষ্কাম আনন্দর অভিজ্ঞতার দিকে প্রবাহিত হয়।
আধ্যাত্মিক সাধনার সবথেকে বড় ধাঁধা হলো যে তা অননুভূতির অনুভূতি চায় এবং আনন্দকে একটি অনুভূতির বস্তু বানাতে চায়।
সচেতনতার সার হচ্ছে আনন্দের প্রকাশ।

অনুভূতি যখন আনন্দময় অভিজ্ঞতার প্রকৃত প্রকাশ তখন তার নাম স্বতঃপ্রকাশ যা বিমূর্ত চেতনার মহাজাগতিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বয়ে চলে। তা বৌদ্ধিক পর্যবেক্ষণ দ্বারা আনন্দের প্রকাশকে বিচারের প্রকাশে রূপান্তরিত করে। তা প্রকাশের আনন্দকে বিচারের পর্যায়ে সেই চিন্তার শব্দপ্রকাশের এক মেলবন্ধন সৃষ্টি করে। যে আনন্দ স্বতঃপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে নিরন্তর প্রবাহিত, সেই আনন্দ বাকিদের সাথে ভাগ করে নেয়া যায়।

আধ্যাত্মিক সাধনার সবচাইতে বড় ধাঁধা হলো অধ্যাবসায়হীনতাপ্রাপ্তির অধ্যাবসায়, অননুভূতিপ্রাপ্তির অনুভূতি, অতীন্দ্রিয়তাপ্রাপ্তির ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতি- মহাশূন্যের সত্যতা।
মহাশূন্য যদি সত্য হয় যা বাস্তবতা রূপে বিবর্তিত হয়েছে, যা প্রত্যক্ষ, অনুভূত ও উপলব্ধ, তাহলে সত্য ও বাস্তবতার মধ্যে বিভিন্নতা ও একাত্মতা কতখানি? এই দুই সমান বিপরীত অন্তর্প্রকাশ এবং বহিঃপ্রকাশের মধ্যে ভারসাম্য ও অন্তর্প্রকাশ থেকে বহিঃপ্রকাশ এবং বহিঃপ্রকাশ থেকে অন্তর্প্রকাশের রূপান্তরের ভারসাম্য বজায় রাখে।

শূন্যতা হলো অন্তর্প্রকাশ এবং বাস্তবতা হলো আত্মার বহিঃপ্রকাশ। আত্মা যখন আনন্দের অন্তর্প্রকাশে মিশে যায় এবং আনন্দের কোনো বাঁধ থাকেনা, তখন তা মহাশূন্যের সাথে একাত্ম হয়ে যায়, যা বাস্তবতার মূল প্রকৃতি। অন্তর্প্রকাশ হলো মহাশূন্যের এক অণুক্ষুদ্র পরিসমাপ্তি।

বহিঃপ্রকাশ হলো অনন্তর মহাজাগতিক পরিসমাপ্তি। স্বতঃস্ফূর্ত উপলব্ধির সৎপ্রকাশ হচ্ছে সেই অনন্ত ব্রম্ভাণ্ড, যাকে পূর্ণমহিমায় আমরা আত্মার মধ্যে প্রত্যক্ষ করি। আত্মাকে বাদ দিয়ে কোনো প্রকাশ সম্ভব নয়। আত্মার একটি প্রবণতা আছে যে তা ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে এবং তার মাধ্যমে একটি ব্যক্তিসত্তার জন্ম হয়। ব্যক্তিসত্তার অনুভূতি সৎ নয়, আধ্যাত্মিক নয়, তা কেবলই দর্শনশাস্ত্র। দর্শনশাস্ত্র স্বসম্মোহনের এক মিথ্যা আনন্দের সঞ্চার করতে পারে, যা থেকে অনুভূতিজাত উপলব্ধির জন্ম হতে পারে, যা স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তা স্বতঃস্ফূর্ত কখনোই নয়।

আনন্দর সেই ধারা যা স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতি, বিমূর্ত থেকে মূর্তের প্রতি, বস্তু থেকে অধ্যাত্মর প্রতি সদা ধাববান, তা গুরু বা শিক্ষকের মুখনিঃসৃত বাণীর মাধ্যমে পূর্ণতা পায়। গুরুর স্বতঃপ্রকাশের প্রতিফলন থেকে জাত শিষ্যের অন্তর্প্রকাশ সুশৃঙ্খলভাবে এবং সুগঠিতভাবে প্রবাহিত হতে পারে স্বতঃস্ফূর্ততার লক্ষ্যে মহাজাগতিক বিবর্তনের পথ দিয়ে। সেখান থেকে পঞ্চতত্ত্বের গঠনমূলক বিবর্তন, সেখান থেকে মানুষের বিবর্তন, সেখান থেকে মানুষের অনুভূতির বিবর্তন… শিষ্যের অধ্যাবসায় যা জড় অনুভূতি থেকে সূক্ষ্ম অনুভূতি হয়ে জাগতিকবন্ধনমুক্তির পথে চলে, তা স্বতঃস্ফূর্ততালাভের প্রক্রিয়া। জাগতিকবন্ধনমুক্তি হচ্ছে একটি অননুভূত সাম্যময় স্থিতি যা অন্তর্প্রকাশ ও বহিঃপ্রকাশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং একইসাথে মহাশূন্য ও বিবর্তনকেও ধারণ করে।

মহাশূন্যের সত্যতা জীবের আত্মা রূপে প্রতিফলিত হয়। আত্মা নিজেকে প্রতিফলিত করে শূন্যরূপে। এই মায়াময় ধাঁধা হলো আধ্যাত্মিকতার মেরুদণ্ড যা মানুষ অজ্ঞানতাবশত মায়াজাল রূপে কল্পনা করে। আদ্যাশক্তি প্রকাশিত হয়েছে বস্তুভর ও গতিশীল শক্তির রূপে, যার মধ্যে একটি কাঠামোগত স্ববিরোধিতা রয়েছে যা এই বাস্তবতাকে সৃষ্টি করেছে।

গুরু শিষ্যের কাছে পৌঁছায় বহিঃপ্রকাশের দ্বারা এবং শিষ্য গুরুর কাছে পৌঁছায় প্রতিফলিত অন্তর্প্রকাশের দ্বারা।

চৈতন্য থেকে আত্মোপলব্ধির জন্ম। রূপ ও অরূপের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলে ‘সহজ’। সেই মহাশূন্য হলো ‘সহজ’ যেখানে শূন্যের সত্যই হলো অনন্তের বাস্তবতা এক।

ͽ●ͼ

চৈতন্যের মধ্যে যে চয়ন ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব, তারই নাম মন।
বাস্তবতা যেমন তেমনই। কিন্তু চয়ন নয়।
চয়ন চায় এমন কিছু যা বাস্তবতাতে নেই। সে এমনকি আত্মাকেও প্রভাবিত করে কিছু নির্মাণ করতে চায় যা কিনা বাস্তবতাতে নেই।

বাস্তবতা হলো উপস্থিতি এবং মন হলো সৃষ্টি। মন সৃষ্টির ধারণা ধারণ করে। চয়ন হলো সেই সৃষ্টির কামনা। ঈশ্বর যদি সৃষ্টির ইচ্ছাপোষণ করে থাকেন তাহলে ঈশ্বরের ইচ্ছাই আদম ও শয়তানের সৃষ্টির কারণ, প্রলুব্ধতা ও প্রলুব্ধ – উভয়ের সৃষ্টির কারণ। তাই ঈশ্বরের ইচ্ছা থেকেই ঈশ্বরপুত্রের সৃষ্টি যে কিনা কষ্টের দ্বারা নিজেকে মানবপুত্র রূপে পূর্ণ করবে, এবং নিজের ও নিজের পিতার সঙ্গে একাত্মতা সাধন করবে।

অনুবাদ- সায়ন সেন

কুলাবধূত সৎপুরানন্দ

অবধূত, বজ্রযানী তন্ত্রগুরু, চিত্রকর, কবি, গবেষক ও শিক্ষক। বাস করেন পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং-এ। বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায় পারিবারিক শিকড়। কমলকুমার মজুমদারের ছাত্র ও পুত্রসম। বাউল-ফকিরদের সঙ্গে একাত্ম থাকতে পছন্দ করেন। বিপ্লবী কমিউনিস্ট ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন এক সময়। গান করেন, মানুষের এবাদতে, প্রাণ ও প্রকৃতির ভজনায়।

Share