মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক

।। আর্য সারথী ।।

বাংলার ভাব অনুযায়ী মানুষ হওয়া কেন দরকারি সেটা জুড়ে দিলে দেবতার মানবায়নের ব্যাপারটা পুরোপুরি বোধগম্য হবে। আমরা এক্ষেত্রে বাড়তি করে একটা কথা যুক্ত করতে পারি যে, বাংলার ভাবানুসারে দেবতাকে মানুষ হতেই হবে৷ মনসা কেন মানুষ, অবশ্যই বৃহৎ বঙ্গের ভাবভক্তির জায়গা থেকে, তা আর আমাদের বুঝতে অসুবিধা হবে না,…
…বৃহৎ বঙ্গের ভাবচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে মনসা হলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রেরণাদাত্রী৷ মানুষের অগ্রযাত্রার পথে সবচেয়ে সহায়ক পদক্ষেপ হল সাংস্কৃতিক বিপ্লব। সকল প্রকার স্থবিরতা, জড়তা, অন্ধত্ব এবং শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর লড়াই এটি। মানুষকে বিকশিত ও সাম্যবাদী সমাজের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার অভূতপূর্ব মহাযাত্রা। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ব্যাপ্তি তথাকথিত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ থাকে না। সাংস্কৃতিক বিপ্লব দীর্ঘজীবী সার্বিক বিপ্লব ছাড়া কিছু নয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সারকথা হল জীবনের সর্বস্তরে বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সংস্কৃতি আসলে কালচার বা চর্চা নয় ; এটা হল সম্যকরূপে কৃতি। রেনেসাঁ ও রিফরমেশন বলতে যদি কিছু থাকে তাহলে তার সার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অন্তর্ভুক্ত এবং তার থেকে আরও অগ্রসর।

“আমি কি করিব স্তব    তোমার সৃজন সব
জল স্থল স্থাবর আকাশ
সত্ত্ব রজঃ তমোগুণে     মনোরূপা মনে মনে
সৃজন পালন হেতু নাশ ।।
…………………………..
তুমি গো পুরুষ নারী    তুমি কাল সহচরী
সনাতনী সবাকার মাতা ।
ফণীন্দ্র সহস্রমুখে    স্তবন করিল যাকে
যার গুণ অগোচর ধাতা।।
…………………………..
সুমতি কুমতি যত     তোমার মাথায় সে তো
চারিবেদে তোমার মহিমা।
মহামায়া মহামন্ত্র সকলই তোমার তন্ত্র
ত্রিলোক না পারে সীমা।।”

– -কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ

মনস্+আ দিয়ে হয় মনসা। অর্থাৎ মন-মননের সম্পর্ক এখানে প্রধান। তিনি ‘মন’ থেকে উৎপন্না বা মনোজাতা৷ বিধাতার নারীরূপী সৃষ্টি হিসেবে তাঁকে ব্যাখ্যা করা যায় না, যাকে পুরুষ গড়ে তুলেছে সৌন্দর্যের তিল দিয়ে তিলোত্তমা হিসেবে। তাছাড়া কবিরা বসে বসে সোনার উপমাসূত্রে তাঁর বসন বুনেছেন এমনও নয় । তবে তাঁকে কেন্দ্র করে বাসনার প্রদীপ্ত শিখা অনির্বাণ হয়ে বঙ্গের জল-মাটি-হাওয়া থেকে সমগ্র বিশ্ব-চরাচরে ছড়িয়ে পড়েছে এটা অসত্য নয়। তিনি চেতনার ক্যানভাসে কল্পনার তুলিতে আঁকা মানবী ; যাঁকে আদর করে চৈতন্যময়ী ডাকতে দ্বিধা নেই। তবে তিনি নিজেই চৈতন্য একথা স্বীকার করে নিতে হবে৷ তিনি একইসাথে চৈতন্য ও চৈতন্যময়ী। ফলে চেতনার ক্যানভাস, কল্পনার তুলি আর চিত্রলেখা মানবী সবই আসলে একই মনসার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ৷ সর্পদের মা, চন্দ্রবদনা, সুন্দরকান্তি বিশিষ্টা, হংসবাহিনী, উদারস্বভাবা , লোহিতবসনা , সর্বদা সর্ব অভিষ্ট প্রদায়িনী, সহাস্য বদনা, কনক মণিমুক্তা প্রবালাদির অলঙ্কার ধারিনী, অষ্ট নাগ পরিবৃতা, উন্নত কুচযুগল সম্পন্না, সর্পিণী, ইচ্ছা মাত্র রূপ ধারিণী দেবী হিসেবে বন্দনা করা হয় মনসাকে। বুঝতেই পারছি এখানে অনেক বাড়তি কিছু আছে। কারণ কল্পনা ছাড়া তাঁকে মানস দেউলে সযতনে প্রতিষ্ঠিত করা কষ্টসাধ্য।

এত কিছুর পরও তিনি মানবী! শেষকালে কিনা মানবীর বিগ্রহের অর্চনা! এটা কি তবে পৌত্তলিকতার সীমাকে ছাড়িয়ে গেল? নাকি, বিমূর্ত প্রেমের বহিঃপ্রকাশের জায়গা থেকে এই দুরূহ দার্শনিক প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে? এর মীমাংসা যদি করতে হয় তবে ‘মানবী’-তেই দৃষ্টিপাত করতে হবে৷ এ কথা ভুলে গেলে চলবে কেন যে, মনসাকে দেবতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি মহাদেবের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও। মহাদেব মানুষ হওয়ার সাধনা করছেন। বঙ্গের মহাদেব সিক্স প্যাকওয়ালা বডি বিল্ডার নন কিংবা আইন হিসেবে বস্তা বস্তা শাস্ত্রীয় জ্ঞান চাপিয়ে দেওয়ার লোক নন। তিনি হলেন দয়াল। তিনি সহজ মানুষ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, সহজ হতে চেষ্টা করেন। মহাদেব জমিতে চাষ করেন, সেচের ব্যবস্থা করেন, পার্বতীর সাথে সংসার করেন আবার এসবের মধ্যে থেকেই নিজের পারমার্থিক কাজকর্ম চালিয়ে যান। সোজা কথায়, বঙ্গের কাণ্ডারী বা দয়াল মহাদেব মানুষ। মনসা শিবের ঔরসে জন্মেছেন, তবে তিনি অযোনিসম্ভবা৷ মানুষ বাপের মেয়ে মনসা ‘মানবী’ না হয়ে যায় না।

মনসামূর্তি

সাধারণ জীব হয় কেবল প্রকৃতি হয়ে নির্জীবতায় জীবন অতিবাহিত করে অথবা পুরুষ হবার বাসনায় আধিপত্য করে। তবে মূলে দুটোই এক, কারণ পারমার্থিক সত্তাকে বোঝার কোন প্রচেষ্টা থাকে না। নিজেকে জানা বোঝার কোন কাজ চোখে পড়ে না। তবে যারা করে তারাও জীবের ঊর্ধ্বে উঠতে সক্ষম নয় , কারণ তার কারবার শুধু চিন্তায়, কোন কর্ম তার নেই। নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকলে তো আর জীবের ঊর্ধ্বে ওঠা যায় না, বরং জীবত্বের পুনরাবৃত্তি হয়, যদিও সে পুনরাবৃত্তি যথার্থ বিচারে ইতিহাস নয়। কারণ সেখানে নতুন কিছু নির্মাণ নেই, বিকাশ নেই। বিকাশ বা নির্মাণের মাধ্যমে পুনরাবৃত্তি ঘটলে তা ইতিহাস পদবাচ্য। আমরা ‘মানুষ’ বলতে যে ধারণা পোষণ করি তিনি সাধনা করেন সেই মানুষ হতে। কারণ মানুষ হতে গেলেই সাধনা লাগে। দেবতার ফয়সালা মানুষ ছাড়া কেউ করতে পারে না। তাই শাস্ত্রে বা শাস্ত্রের বাইরে মানুষের মাহাত্ম্যই বর্ণিত হয়েছে। আমরা সাধকদের পদে শুনি: মানুষের উত্তর কিছু নাই। ইতিহাসে মানুষের কোনও স্থির ধারণা নেই। আবার সর্বকালেই যে মানুষ আমরা দেখি তার প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির মধ্যদিয়ে। কিন্তু ব্যক্তি কোনোভাবেই মানুষকে ধারণ করা ছাড়া ব্যক্তি হতে পারে না। মানুষ তার ইষ্টের ন্যায় রহস্যময় বিধায় ইষ্টের ফয়সালা মানুষের মধ্যদিয়েই হয়। সহজ কথায় বলা যায়, মানুষ বর্তমানে যা তা অবশ্যই মানুষের ধারণা দেয় কিন্তু মানুষ যা ভবিষ্যতে যা হবার সম্ভাবনা রাখে তা যুক্ত করে মানুষ সম্পর্কে আপাত দৃষ্টিতে পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করা যায়। মূলত, মানুষের সন্ধান করাই আসল সন্ধান। এই কারণে বৃহৎ বঙ্গের ভাবভক্তি চর্চায় ‘মানুষ’ ধারণাটা ব্যাপক শক্তির পৌঁছে গেছে। ফলে ইষ্টকে মানবায়িত করার প্রচলিত কারণের বাইরেও আরেকটা কারণের সন্ধান আমরা পেয়ে গেলাম। প্রচলিত কারণ বলতে বোঝায়, যা আমরা বইপত্রে পড়ে থাকি। বইপত্রের কথা হল, নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে বিচার করতে মানুষ দেব-দেবতার মধ্যে মানুষের বৈশিষ্ট্য চাপিয়ে দেয়। এটা যে অস্বীকার করা হচ্ছে এমন নয়। কিন্তু বৃহৎ বঙ্গ, তার কাছে আরেকটা দার্শনিক কারণ থাকতে, এই কথাতে সম্পূর্ণ একমত হবে কেন? বাংলার ভাব অনুযায়ী মানুষ হওয়া কেন দরকারী সেটা জুড়ে দিলে দেবতার মানবায়নের ব্যাপারটা পুরোপুরি বোধগম্য হবে। আমরা এক্ষেত্রে বাড়তি করে একটা কথা যুক্ত করতে পারি যে, বাংলার ভাবানুসারে দেবতাকে মানুষ হতেই হবে৷ মনসা কেন মানুষ, অবশ্যই বৃহৎ বঙ্গের ভাবভক্তির জায়গা থেকে, তা আর আমাদের বুঝতে অসুবিধা হবে না। কিন্তু ঝামেলার জায়গা হল তিনি নারী। তাঁকে নারী কেন হতে হল এর মীমাংসা না করলে অসুবিধা রয়েই যাচ্ছে।

নারী আকারে বোঝার সাথে তন্ত্রের দার্শনিক জায়গা জড়িত । কারণ তন্ত্রমতে শক্তিই সকল কিছুর মূল এবং পুরুষ ও প্রকৃতি অভেদ। জড় ও চৈতন্যকে তন্ত্র একই সত্তার দ্বৈত রূপ হিসেবে বিচার করে। আর সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় এই দ্বৈত সত্তার নাম শিব-শক্তি। শিব-শক্তি একই বিধায় শক্তিকে প্রাধান্য দিতে আপত্তি নেই; সৃষ্টি তো শক্তিরই লীলা। তন্ত্রে এই ধারণা এখনও বিদ্যমান যে, শিবের নয় সাধনাটা শক্তিরই। তন্ত্রমতে, শিব নিজেও শক্তির আরাধনা করেন এবং শক্তিবিহীন শিব শবমাত্র। শক্তিকে প্রধানের জায়গা থেকে বুঝতে গিয়ে এবং শক্তিরই লীলা আকারে জগৎ প্রপঞ্চকে বুঝতে গিয়ে শেষে দেবী ব্রহ্মময়ী বা নারীরূপে ধরা দিয়েছেন। বোঝানো হয়েছে দেবীই সব, দেবীর বাইরে কিছুই নেই এবং লৌকিক জীবন ও পারমার্থিক জীবন সর্বত্রই দেবী। এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন বারংবার ওঠে যে তাঁকে বিশেষায়িত করার মাধ্যমে ছোট করার পুরুষতান্ত্রিক ব্যাপার আছে কিনা। এই প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক এখনকার বিচারে । তবে মনে রাখতে হবে, তন্ত্রের যে দার্শনিক ও ঐতিহাসিক বিচারে এর উল্লেখ তাতে নারী তো পুরুষের চেয়ে ছোট নয়ই বরং অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে শক্তিশালী। কারণ সৃষ্টির বিস্তারই বলি আর জগৎ সংসার ঠিক রাখার কথায়ই ধরি তন্ত্রের কথায় নারী ছাড়া এগুলো সম্ভবই নয়। নারী বরাবরই প্রতিপালক ও পুরুষ আধিপত্যকামী। জগৎ টিকিয়ে রাখতে প্রতিপালন জরুরি। তান্ত্রিক সাধকরা এই এত কথা না বলে খুব সরল ভাষায় একটা কথা বলেন যে নারীর গর্ভধারিণী হতে পারে বলে নারী পুরুষের চেয়েও শক্তিশালী। আর তন্ত্রের দার্শনিক বিকাশের সাথে কৃষির সম্পর্ক ব্যাপক। আর কৃষির সাথে নারীর সম্পর্ক কৃষির জন্মলগ্ন থেকে। সে বিচারে নারীকে বিশেষায়িত করাটা কোনও নিপীড়নের চিহ্ন নয় বরং নতুনভাবে দার্শনিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। তাহলে দেখা গেল, নারী হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার বিধায় মনসা নারীরূপে আবির্ভূতা হয়ে দার্শনিক বিচারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন। মনসা মানুষ এবং নারী। তাই যথার্থ বিচারে তিনি মানবী।

মনসা সর্পের দেবী। মনসা উচ্চারণের সাথে সাথে সাপের কথা আমাদের মাথায় আসে। সাপ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র লভ্য, লভ্য কৃষি বাস্তুতন্ত্রে। বাংলার জল-জমি-জঙ্গলে সাপের আনাগোনা ছিল এবং ছিল সর্পাঘাতে মৃত্যুর ঘটনা। তাই সাপকে কেন্দ্র করে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক এবং ভয় থেকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়াও স্বাভাবিক। তবে গুরুত্ব শুধু ভয় থেকে আসে নি। মানুষ সাপের অনেক অঙ্গভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে সঙ্গীত-সহ বিভিন্ন কলার বিকাশ ঘটিয়েছে। জীবিকা তো অবশ্যই, এমনকি চিকিৎসা থেকে শত্রুনিধন পর্যন্ত সাপের ব্যবহার হতে লাগল। তাহলে আধ্যাত্মিক চর্চায় বাদ যাবে কেন? আধ্যাত্মিক চর্চায়ও সাপ রূপক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। দেহতত্ত্ব (যোগ ও তন্ত্রের বিচারে) অনুসারে সাপ হল কুলকুণ্ডলিনী। সাধনার দ্বারা একে সহস্রারে আনতে হয়। মজার ব্যাপার হল, সহস্রারে অবস্থানরত নির্গুণ ব্রহ্ম হলেন স্বয়ং শিব। মনসা সেই শিবের কন্যা আবার কুলকুণ্ডলিনীতেও তাঁর অবস্থান। সেই কারণে মনসাকে দেখে শিবের কামভাব জাগে। অর্থাৎ শিবের কামভাব জাগবার সাথে সর্পতত্ত্বেরই সম্পর্ক বিদ্যমান। পার্বতীর কথা ভাবতে ভাবতে শিবের বীর্যপাত হয়েছিল এবং তার থেকে মনসার আবির্ভাব। আবার সেই মনসাকে দেখে শিবের কামভাব জাগ্রত হচ্ছে। এখানে রূপক দ্বারা পার্বতী ও মনসার সাথে সমতা করে কুলকুণ্ডলিনী আকারে দেখানো হয়েছে। কিন্তু দেখা গেল মনসার মধ্যে কেবল শিবের অংশ এবং মনসার সাথে শিবের মিলন হচ্ছে না। এই জায়গাতে আবার ভিন্ন তত্ত্ব উপস্থিত হয়েছে। এখানে শিবের অংশ বলতে আবার বুঝে নিতে হবে শিবস্বরূপা। এই শিব আবার দ্বৈতের বিচারের শিব নয় আবার শুধু দেহের সহস্রারে আবদ্ধ শিব নয় । এইক্ষেত্রে শিব হয়ে গেলেন তন্ত্রের অদ্বৈত ব্রহ্ম শিব। খেয়াল রাখতে হবে, জড় ও চৈতন্য একীভূত হয়ে থাকা তন্ত্রের ব্রহ্মরূপী শিব নিজেই মনসা রূপে হাজির হলেন। তাই মনসা একই সাথে নারী ও পুরুষ দুটোই। কিন্তু প্রচলিত দেহতত্ত্ব বাদ দেওয়া যায় না বিধায় কামভাবের জায়গাটা রাখতেই হবে। তন্ত্র ব্যাখ্যা করতে গেলে দর্শন এবং দেহতত্ত্ব থাকবেই৷ হয়তো কাহিনীর ফলে পাশাপাশি থাকাটা খাপছাড়া হয়ে যায়। কিন্তু এটাই রহস্য। এই রহস্য ভেদ করার দায়িত্বটুকু নিতেই হবে। কিন্তু সাপ সম্পর্কে আলাপ এখানেই থেমে যায় না। সাপের আরও দিক আছে এখানকার তত্ত্বে।

জগতে চলা আকর্ষণ-বিকর্ষণকে বলা হয় সর্প বা ভুজঙ্গ। সর্পের সার হল বিষ। শিবই শেষ, শিব ছাড়া কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। তাই শিব অঙ্গে বিরাজিত শেষনাগ। সৃষ্টির সংহারে যা বিদ্যমান থাকে এবং যার আর বিকার সম্ভব না তাকে বলে শেষ। সৃষ্টির সর্বত্র এই শেষনাগ বাস করে। সৃষ্টিকে সে ধরে রাখে ও এর অন্তিম পরিণামও দেয়। দেহে কুলকুণ্ডলিনী হয়েও এই নাগই দেহকে ধারণ করছে। জগৎ যেহেতু নাগময় সেহেতু জগতের সার হল বিষ। আবার সংহারের উপাদানও বিষ। বিষ না থাকলে সংহার হয় না এবং কোনওকিছুই তার পরিণাম পায় না। কথায় বলে: বিষস্য বিষমৌষধং। এই কথাকে সমঃ সমং শময়তি আকারেও বোঝা যায়। বাস্তব জগতে এই তত্ত্বের প্রমাণ সর্বত্রই মেলে। তবে চিকিৎসা নিয়ে আলাপের সময় এই কথাগুলো আমরা বেশি বলে থাকি। বিষ কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা এই কথাগুলো থেকেই বোঝা যায়। বিষকে আমরা এখন যে শুধুই ক্ষতিকারকক অর্থে ভাবতে শিখেছি সেই ভাবনা দ্বারা শিবের বিষপান পুরোপুরি বোঝা যাবে না, কেবল একটা দিক বোঝা যাবে। তাই শুরুতে আমরা সেইদিকটা বলে নিলাম। কিন্তু বিষের সবটা বোঝা ছাড়া আমরা তত্ত্ব বুঝতে পারব না। আয়ুর্বেদ বলে জগতের কিছুই ঔষধীগুণের বাইরে নয়। কিন্তু রোগীর শরীর এবং চিকিৎসকের জ্ঞান দুটোর ওপর নির্ভর করে ওষুধের ব্যবহার হয়। তাই আয়ুর্বেদানুসারে গড়পড়তা ওষুধের ব্যবস্থা নেই। কেননা সবই বিষ এবং কোনটা কার শরীরে সহ্য হবে তা আগাম বলা কষ্টসাধ্য। বিষে বিষক্ষয় হয় কিন্তু কোনটা দিয়ে কোথায় হয় সেটা বিচার করে চিকিৎসা শাস্ত্র। তাই বিষ শেষবিচারে ওষুধ। শিব যেহেতু চিকিৎসাশাস্ত্রের উদ্ভাবক তাই জগতের কল্যাণে তিনি বিষ সংরক্ষণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। জগতে যখন সৃষ্টির বিকাশ হয় তখন সাপের কেলা শুরু হয় আবার সৃষ্টির সংহারে সাপ স্থির হয়ে যায়। শিব এই বিষ গলায় রেখেছেন। আর গলায় বিষ থাকার কারণে সাপও শিবের গলা জড়িয়ে থাকে। সৃষ্টির সার বিষ যাতে সহজে নিয়ন্ত্রিত হয় তাই শিব বিষ হজমও করেন নি আবার বাইরেও রাখেন নি। এই জায়গাতেও মনসা ও শিবের সাথে আমরা সম্পর্ক আবিষ্কার করতে পারি। কারণ দুজনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে সাপ। শিব সাপকে গলায় রেখেছেন এবং বিষ খেয়েছেন। আবারকাহিনী অনুসারে মনসা শিবদুহিতা ও সর্পদেবী। অর্থাৎ নীলকন্ঠ ও সর্পধারী শিবদুহিতা হলেন সর্পদেবী মনসা। শিব থেকে সরাসরি মনসা আবির্ভূতা হওয়ায় শেষ বিচারে শিব ও মনসা এক হয়ে যাচ্ছেন। বাঙলার ভাবচর্চায় নীলকন্ঠ ও সর্পধারী শিবই সর্পদেবী মনসা হয়ে ফিরে আসছেন।

মনসার পট

সাপ প্রজননের প্রতীক একথা অস্বীকারের জো নেই। মনসা যেহেতু সর্পের দেবী তাই প্রজননের সম্পর্ক তাঁর সাথেও আছে৷ মনসার মূর্তিতে তাঁর কোলে শিশুকে বসিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ সম্পর্কে কারো অজানা নয়। প্রজনন বলতে আমরা এখন যা বুঝি অর্থাৎ নারী-পুরুষের দৈহিক মিলন ও পরিণামে সন্তান জন্মানো, এটা পরিপূর্ণ ধারণা নয়। এটা বুঝতে গেলে আমাদের এই অঞ্চলের চিন্তাপদ্ধতি সম্পর্কে , বিশেষ করে তন্ত্র সম্পর্কে , ভাল ধারণা থাকতে হবে৷ প্রজননের আসল কথা সৃষ্টি। আর সৃষ্টি অর্থ গতি, গতি থেকে বিকাশ আর বিকাশ থেকেই সভ্যতা। আমাদের এই অঞ্চলে প্রজননের দার্শনিক অবস্থান ছিল এই রকম। তাই তো যাবতীয় প্রজননের চিহ্নকে ব্যবহার করে দুরুহ দার্শনিক চর্চার নজির স্থাপন করে গেছেন পূর্বজরা। মনসার সাথে এই প্রজননের সম্পর্কের আরেকটা রূপ হচ্ছে পূজায় গাছ ব্যবহার করা। মনসার গল্পেও গাছাপালা, বনজঙ্গলের সাথে মনসার সম্পর্ক দেখানো হয়। গাছাপালার সাথে শেষ বিচারে সৃষ্টিরই সম্পর্ক। তাই সর্পকে ছোট করে দেখা সম্ভব নয়।

আমরা প্রজনন না বলে সহজ বাংলায় বলতে পারি কাম। কাহিনী অনুসারে, কাম থেকে মনসার জন্ম এবং মনসাকে দেখেও শিব কামাসক্ত হয়েছিলেন৷ সারা জগৎ কাম-রতির লীলায় চলছে। যারা তত্ত্বদর্শী হন তারা বুঝে নিষ্কামী হন। কামের পথে না পিছলে নিষ্কামী কেউ হতে পারে না। কামের চাবিও মনসার কাছে আবার নিষ্কামের চাবিও মনসার কাছে। আমরা যে সারাবিশ্বে আমাদের কলা, সভ্যতা, উৎপাদনের কাজ করছি এগুলো কি কাম নয়? এগুলো কামেরই প্রকাশ। মদন-রতি নিত্য লীলা করছে বলেই না এসব সম্ভব হচ্ছে। আমরা আমাদের উদ্ভাবিত জ্ঞানকে নিজেদের মত করে ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছি। এই জ্ঞান তাত্ত্বিক বিচারে মনসারই অংশ।

বঙ্গে মনসা শেষ বিচারে চৈতন্যের স্ফূরণ বা চৈতন্যময়ী। তাই যথাযথভাবে মনসাকে বুঝতে গেলে আমাদের চৈতন্যের স্ফূরণ কিভাবে ঘটে সেটা বোঝা জরুরী । চৈতন্য একই সাথে ইচ্ছাশক্তির দ্বারা কর্মে রূপান্তরিত হয় আবার কর্মের বীজও ধারণ করে। অর্থাৎ চৈতন্য দুই ভূমিকায় অবতীর্ণা হয়। চৈতন্য নিজে স্ফূরিতা হয় আবার স্ফূরণ করে। অনেকটা শক্তির মত করেও বিচার করতে পারি৷ শক্তির দ্বারাই যেমন শক্তি নিজে নিত্য-নতুন হয়ে আবির্ভূতা হয় ও বৈচিত্র‍্যের আবির্ভাব ঘটায় ; চৈতন্যও তদ্রুপ নিজেকে নিজে নিত্য-নতুন রূপে হাজির করে ও কর্মের প্রণোদনা দেয়৷ শক্তির প্রভাবে জড়প্রপঞ্চের আবির্ভাব, জড়ের বিবর্তনে এল প্রাণ, প্রাণের এক বিকশিত পর্যায়ে শক্তি চৈতন্য রূপে আবির্ভূতা হলেন, সেই আবির্ভাবের দরুণ কর্তাসত্তার আবির্ভাব ঘটল, সেই কর্তা আবার তার উৎপত্তিস্থল হিসেবে আবিষ্কার করল ভাষা। ভাষা এই কর্তার সাথে লীলা করে জগৎপ্রপঞ্চকে মানুষের মধ্যদিয়ে বিকশিত করছে। মানুষের সার কথা আছে মনে। চৈতন্যের খেলা মনের মত উভয়েন্দ্রিয় ছাড়া অসম্ভব। তাই প্রাণের পরে মন বিকশিত হয়েছিল এই কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। এই মনের প্রভাবে এত বিকাশ ও বৈচিত্র্য সংঘটিত হতে পারছে। আর মনসার সাথে সম্পর্ক মনের। মনের সাথে মনসার সম্পর্কের জায়গাটা যদি আমরা ভালভাবে বিচার করি তাহলে আমরা সরলভাবে সিদ্ধান্ত দিতে পারি যে, মনসা চৈতন্যের সাথে একাকার। অন্তত বৃহৎ বঙ্গের ভাবচর্চার জায়গা থেকে মনসাকে কেবলমাত্র লৌকিক দেবী হিসেবে রেখে দেওয়া যায় না।

মনসার কাহিনীকে আমরা বেহুলা-লক্ষিন্দরের (লখিন্দর বানানও লেখা হয়) কাহিনী হিসেবে পাঠ করতে পছন্দ করি। আসলে মনসামঙ্গলকে বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী বললে খুব একটা ভুল বলা হয় না। মনসার ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছিল বেহুলা-লখিন্দরের দ্বারাই। সওদাগর বা বেনে সম্প্রদায়ের বেহুলা ও লখিন্দরের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন৷ অর্থাৎ সওদাগরদের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিপক্ষে লড়াইয়ে জিততে মনসার সহায়ক হিসেবে বেহুলা-লখিন্দরের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা অসামান্য। তন্ত্রের দার্শনিক মতামতকে আদর্শ ধরে বলতে পারি, মনসা বেহুলা ও লখিন্দরের রূপে এই ভূমণ্ডলে তাঁর কাজ করেছেন। এক্ষেত্রে লখিন্দর শবরূপী শিব এবং বেহুলা হলেন শক্তি সঞ্চারিণী পার্বতী। তাই তো মৃত লখিন্দরকে নিয়ে বেহুলা উজানে চলেছেন৷ উজানে গিয়ে তারপর স্বামীর প্রাণসঞ্চার করেছেন। বাংলায় বিদ্যমান (সাংখ্য ও তন্ত্র মিশ্রিত) যুগলের ধারণা এবং তন্ত্রের সাধনা এই দুটোই মিশে আছে বেহুলা-লখিন্দরের গল্পে৷ খেয়াল করার বিষয় হলো, বাসর ঘরে বা মিলনের সময় লখিন্দরকে সাপে কেটেছে। অর্থাৎ শক্তির সাথে ক্রীড়া করার সময় সাপের দংশনে মারা যায়। মারা যাওয়ার পর দেহটি বেহুলার সাথে ভেলায় উজানে চলতে থাকে। এখানে সাপে কেটে মারা যাওয়াটা আসলে লৌকিক মৃত্যু নয়। বরং সাধনভজনে প্রবেশ করে জ্যান্তে মরা হওয়া। জ্যান্তে মরা হবার পর আবার যখন প্রাণসঞ্চারিত হল তখন আবার দুজনেই ফিরে গেল অমৃতলোকে। কিন্তু যাওয়ার আগে মনসাকে প্রতিষ্ঠিত করে গেল।

কাহিনী অনুসারে বোঝা যাচ্ছে, বেহুলা-লখিন্দর মনসার ভাব প্রতিষ্ঠিত করেছে। তন্ত্রের আলোকে ব্যাখ্যা করলে মনসাকেই বেহুলা-লখিন্দর হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। তন্ত্রের এই জায়গা থেকেই আমরা এগিয়ে যেতে পারি কেন মনসার ভাব এদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতে হল বা বেহুলা-লখিন্দরের রূপ ধরেই কেন মর্ত্যে আগমন করতে হল । চিন্তা বা চৈতন্য জগতের সঙ্গে তার বৈষয়িক সম্বন্ধ সম্পর্কে কোনো খবর না রাখলে নিজেকে নিজে কখনই জানতে পারে না। কারণ চিন্তা পরিপূর্ণ হয় জগতের সাথে সম্বন্ধ বিচারের দ্বারাই। সেই সম্বন্ধ বিচার করার জন্যই এবং জগতে বর্তমান হওয়ার জন্যই বেহুলা-লখিন্দরের তৎপরতার প্রয়োজন ছিল। মনসার ভাবকে বর্তমান করে তোলা সম্ভব হয়েছে বা মনসার পূজা পাওয়া সম্ভব হয়েছে বেহুলা-লখিন্দরের কারণে৷ কাহিনী অনুসারে মনসা অনেক শক্তিশালী হয়েও নিজের স্বীকৃতি পাচ্ছেন না৷ অথচ বেহুলা-লখিন্দরের তৎপরতা দ্বারা নিজের লক্ষ্যে পৌঁছে গেলেন।

মানুষের ভেতরে কর্তাভাব প্রবল। এই কর্তাসত্তার ফলেই মানুষ উচ্চতর চিন্তাভাবনা করতে পারে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার চেষ্টা করে। চিন্তা আর কাজ দুই জায়গায় মানুষের ভূমিকা অন্যান্য জীব থেকে ভিন্ন। তাই মানুষ শেষ বিচারে কর্তা। মানুষ উচ্চতর চিন্তা করে মানে মানুষ উপরে উঠতে চায়। এটা তো কর্তাসত্তার জাগৃতি ছাড়া অসম্ভব। কিন্তু কর্তাসত্তাকে বুঝতে চাইলে শ্রমের জায়গাগুলো সচেতনতার সাথে বুঝতে হবে৷ কেননা, কর্তা হয়ে মানুষ শ্রম দেয়। সৃষ্টি-স্থিতি-লয়-পুনঃসৃষ্টি— এই সমীকরণ দ্বারা অতি সরলভাবে আমরা শ্রমকে বুঝতে পারি। কোনো প্রকার কঠিন দার্শনিক বিশ্লেষণ ছাড়া শুধু শ্রমের সামগ্রিকতা অনুভব করলেই আমরা দেখব শ্রমের দ্বারা আমাদের সৃষ্টি-স্থিতি-লয় ঘটছে আবার লয়ের পরে সৃষ্টি হচ্ছে। চিন্তাও শেষ পর্যন্ত শ্রমের বাইরে নয়। যে খাবার খেয়ে দেহগঠিত হচ্ছে ও আমরা চিন্তা করতে পারছি তা তো শ্রমেরই ফসল। আবার মানসিক শ্রম ছাড়া চিন্তাও অসম্ভব। অর্থাৎ সমগ্র জগতে শ্রম ছাড়া কিছুই করা সম্ভব নয়।

মনসা: অলঙ্করণে বৈশালী।

জাগতিকতা বলি আর আধ্যাত্মিকতা বলি শ্রম না বুঝলে কিছুই সম্ভব নয়। ভাষাতত্ত্ব বা ব্যাকরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করলেও কথাটা সত্য। কারণ শ্রম অর্থ কায়িক ও মানসিক কর্ম এবং তপস্যা। তাই তপস্বীদের, বিশেষ করে বৌদ্ধ ও জৈন তপস্বীদের, বলা হয় শ্রমণ। কিন্তু সমাজে মানুষ দেহ ও মনে বিভক্ত হয়ে যায়। বরাবরই কায়িক ও মানসিক শ্রমের আলাদা সত্তা আবির্ভূত হয়। এক পর্যায়ে মানসিক শ্রম কায়িক শ্রমের উপর আধিপত্য শুরু করে৷ কিন্তু কায়িক ও মানসিক দুই শ্রমই যে, সামগ্রিক বিচারে একই শ্রমের দ্বৈত রূপ তা স্বীকার করা হয় না। এর ফলে শোষণ-বৈষম্য তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। যার ফলে মানুষ তার কর্তাসত্তাকে চিনতে পারে না। মনসা চাঁদ সওদাগরের মহাজ্ঞান হরণ করে আমাদের এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখালেন৷ মনসা কাহিনীতে দেখা যায় যে, তিনি স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এসেছেন। অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ চাঁদ সওদাগরের কাছে পূজা চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু চাঁদ বণিক তা করতে অস্বীকার করলে এক পর্যায়ে তার মহাজ্ঞান হরণ করেন মনসা৷ ব্যাপারটা প্রতীকী। যে জ্ঞানের বাড়তি আবরণে দাম্ভিক হয়ে উঠেছিল চাঁদ তা মনসা হরণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন মানুষ যদি এই আবরণগুলো সরিয়ে না দেয় তাহলে সমাজে সমতা আনা যাবে না। জ্ঞান শেষ বিচারে সামাজিক। হঠাৎ করে ব্যক্তি মানুষে তা হাজির হয় না। মানুষকে যদি এই জ্ঞান থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয় তাহলে মানুষের কর্তাসত্তার জাগৃতি বা তার সাথে মানুষের পরিচয় ঘটতে অসুবিধা হয়। মনসা একে হরণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন মানুষের সাথে মানুষের বিভাজন তৈরি করে এমন যা কিছু আছে তা উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত মানুষের শান্তি নেই। তাছাড়া যা কিছু সামাজিক তা সামাজিক করাই উত্তম। মনসা যখন সওদাগরের বিরুদ্ধে লড়ছেন তখন প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন তার আধিপত্যের ক্ষেত্রগুলো৷ তাতে চাঁদ দূর্বল হয়ে গেছে এবং এক পর্যায়ে মনসার কথা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।

মনসা হলেন আরেক সরস্বতী। আমরা হয়তো খেয়াল করি না যে পদ্ম ও হংসের সাথে সরস্বতীর মতো মনসারও সম্পর্ক আছে। তাছাড়া গবেষকদের দাবী অনুযায়ী সরস্বতী ও মনসার সম্পর্ক বহু আগে থেকেই ছিল। বৃহৎ বঙ্গের ভাবচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে একথা আরও বেশি করে সত্য। শুধু আমরা আমাদের দার্শনিক বয়ান ভুলে গেছি। সরস্বতী যেমন আমাদের কাছে নিছক শাস্ত্রের দেবী নন, তেমনই মনসাও আমাদের কাছে শাস্ত্রের দেবী নন। মনসার সাথে পদ্ম ও হাঁসের সম্পর্ক বিচার কেন গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে গেলে পদ্ম ও হাঁসের অর্থ জানতে হবে।

পদ্ম হল অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত হবার প্রতীক। শক্তির লীলা পদ্মের মতো করেই বিকশিত হয়। পদ্ম উপর থেকে দেখতে চক্রাকার। চক্র বা বৃত্তের শেষ বা শুরু দেখানো যায় না। শক্তিকেও শেষ বা শুরু দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আবার শক্তির ক্রিয়াকেও আদি বা অন্ত দিয়ে বিচার করা যায় না। একইসাথে আদি ও একইসাথে অন্ত হল চক্র বা বৃত্ত। তাই মানবদেহেও চক্রকে বলা হয় পদ্ম। আর এই পদ্মের সাথেও শক্তিরই সম্পর্ক। পদ্ম পাঁকে জন্মালেও এর প্রকাশ কিন্তু দ্যুতিময়। তাই পদ্মকে পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। পদ্ম জীবন, বিকাশ, উর্বরতা, পবিত্রতা ও নির্লিপ্ততার প্রতীক। তাছাড়া পদ্মের দ্যুতিময়তা সুর্যকেও নির্দেশ করে। পদ্ম এমন এক উদ্ভিদ যাতে ফুল ও ফল একত্রে হাজির থাকে। ফুল-ফলকে কার্য-কারণ মানলেই বিশাল দার্শনিক তত্ত্ব খুব সহজেই বুঝে যেতে পারি। অর্থাৎ কার্য ও কারণ একইসাথে বিরাজ করে সেই তত্ত্ব খুব সহজেই পদ্ম দিয়ে প্রকাশ করা যায়। পদ্মের পাপড়ি ফলকে বেষ্টিত করে থাকে এবং পদ্ম ফলকে বহন করে। পরমজ্ঞান লাভ করতে হলেও এই জগতে পদ্মের ম্তো হতে হবে । শত-সহস্র আবর্জনার মধ্যে বাস করেও নিজেকে তার থেকে আলাদা রাখতে হবে, দৃঢ়তার সাথে নিজের সত্তাকে বিকশিত করতে হবে এবং নিজের সারবস্তুকে পদ্মের পাপড়ির মতো কোমলতার সাথে আগলে রাখতে হবে। অর্থাৎ পদ্মকে বুঝলে আমরা সরলভাবে অনেক গূঢ় রহস্য বুঝে যেতে পারি।

হংসের প্রজনন শক্তি অসাধারণ। হংস শব্দের সাথে হং ও স-এর সম্পর্ক ব্যাপক। আবার সোহং ও ওং এর সাথেও হংসের সম্পর্ক আছে। আবার অহং সঃ এর তত্ত্ব হল হংস। আমিই যে তুমি অর্থাৎ পরমই যে বহু হয়ে জীবরূপে হাজির হয়েছেন সেই তত্ত্বও হংস। তাছাড়া হংসে হরূপী পুরুষ ও সরূপী প্রকৃতি দুজনই আছে। তাছাড়া হংসকে ধরা হয় বিবেকের প্রতীক। দুধ ও জল মিশিয়ে দিলে হংস দুধ বেছে খায় আর জলে থাকলেও গায়ে জল লাগে না। অর্থাৎ হংসও পদ্মের মতো অনেক গূঢ় রহস্য প্রকাশ করে।

আরেকটা ব্যাপার আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, হাঁস ও পদ্মের সাথে জলের সম্পর্ক বিদ্যমান । জলকে প্রাণ সঞ্চারের প্রতীক ধরা হয়। আবার সরস্বতী নিজেই জল। সরস্বতী ভৌতিক দৃষ্টিতে জল, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে প্রাণ আর দৈবিক দৃষ্টিতে হয় চিন্ময় প্রকাশ। অর্থাৎ কোথাও না কোথাও মনসার সাথে সরস্বতী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক থেকেই যাচ্ছে। আমরা এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত টেনে বলতে পারি, মনসা বঙ্গের আরেক সরস্বতী৷ পদ্ম ও হংসে তাঁদের আসন তা যে পর্যন্ত জীব ও ব্রহ্মের মিলন ঘটিয়ে দেয়। আর যে জলে তাঁদের লীলা সেই জল অমর্ত্যলোক থেকে মর্ত্যে আসে। যার ভবের খেলা থেকে মন উঠে যায় সে এই জলের ধারা ধরে উজান পথে চলতে শুরু করে।

শরিয়তপুরের মনসামন্দির

বৃহৎ বঙ্গের ভাবচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে মনসা হলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রেরণাদাত্রী৷ মানুষের অগ্রযাত্রার পথে সবচেয়ে সহায়ক পদক্ষেপ হল সাংস্কৃতিক বিপ্লব। সকল প্রকার স্থবিরতা, জড়তা, অন্ধত্ব এবং শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর লড়াই এটি। মানুষকে বিকশিত ও সাম্যবাদী সমাজের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার অভূতপূর্ব মহাযাত্রা। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ব্যাপ্তি তথাকথিত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ থাকে না। সাংস্কৃতিক বিপ্লব দীর্ঘজীবী সার্বিক বিপ্লব ছাড়া কিছু নয়। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সারকথা হল জীবনের সর্বস্তরে বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সংস্কৃতি আসলে কালচার বা চর্চা নয় ; এটা হল সম্যকরূপে কৃতি। রেনেসাঁ ও রিফরমেশন বলতে যদি কিছু থাকে তাহলে তার সার সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অন্তর্ভুক্ত এবং তার থেকে আরও অগ্রসর।

মনসা বেহুলা-লখিন্দরের ভেলা দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চান জাগতিক ক্ষেত্রে মৃতবৎ ব্যবস্থাতে সর্পদংশন অমঙ্গল নয় বরং মঙ্গল। তাতে প্রাণসঞ্চার করার প্রথম ধাপ হলো সর্পদংশন। দংশনের শিকার হওয়ার পর এবার একে বেহুলার মত করে ভেলায় ভাসতে ভাসতে উজানে নিতে হবে। সেখানেই মনসা নতুন করে প্রাণের সঞ্চার করবেন এবং মনসার মহিমা সর্বত্র চর্চিত হবে। একটু খেয়াল করে দেখলে বোঝা যাবে ব্যাপারটাকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পাঠ হিসেবে আমরা গ্রহণ করতেই পারি।

এটাতো প্রতীকী অর্থবিচার মাত্র। আমরা যদি মনসার দার্শনিক অবস্থান বিচারকে আমলে আনি, ইতোপূর্বে আমরা যা করেছি, তাতে জাগতিকতা ও পারমার্থিকতার ভেদরেখা আমরা মুছে ফেলতে সক্ষম। এর ফলে আমরা পারমার্থিকতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে গণশক্তির উদ্বোধনের মাধ্যমে উচ্ছেদ করতে পারব সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার এবং ঘটিয়ে দিতে পারব সার্বিক বিপ্লব৷ মনসার মহিমা যদি প্রচার করতে হয় তাহলে সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে। আজ যদি আমরা এই শিক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে পারি তাহলে সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়ে অনেক পরীক্ষা করতে সক্ষম হব এবং পরিশেষে ঘটাতেও সক্ষম হবো।

লেখক পরিচিতি:
আর্য সারথী
আর্য সারথী

২৯ শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪০৭ বঙ্গাব্দে গাজীপুরের টঙ্গীতে একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদিনিবাস জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার রায়দেরপাড়া গ্রামে। বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি, সঙ্গীত প্রভৃতির প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় । তাঁর ইতোপূর্বে প্রকাশিত ‘মজলুমের সহজপাঠ প্রথম পর্ব’ ও ‘ভাব সমাহার’ সুধী মহলে সাড়া ফেলেছে। বর্তমানে ইউটিউবে ভিডিও তৈরি করে থাকেন।

Share