ঘনঘোর ইনসমনিয়ায়

।। শান্তা এফ আরা ।।

কালো দরজায় কড়া নড়ে উঠলো কি?
ডাকে কে চুপিচুপি ফিসফাসে?
বাতাসেরাও আড়ি পাতা জানে!

খুলবে কি দরজা তোমার?
তোমার একলার শহর
একাকী বাড়ি
উবে যায়
সহসা

তুমি পড়াইতেছো ছাত্র
ঘনঘোর ইনসমনিয়ায়

গুচ্ছ কবিতা- শান্তা হক, অলংকরণ- লুবনা চর্যা

ঘনঘোর ইনসমনিয়ায়

বিড়ালের সাথে

আমি প্রাণ ভরে বিড়ালের সাথে
কথা কই

তুমি তো মরে যাইতেছো মরণ

আমার পোষা গাছটা মারা গেছে

খুন হয়ে গেছে
গত দুপুরে

আমি এখন কার সাথে কথা কই?

রাত্রি
রাত
বোবা
নিথর

একফালি চিকন চান্দ
আকাশের গায়ে
ডানা ঝাপটায়

ডানা তার মেঘ
ওড়ে কি?

ঝটপটায়
গম গম
বেদনা
মোচড়ায়

ঝমঝম
দুঃখরা
ফিসফিসায়
কান্নায়

আমি এখন বিড়ালের সাথে কথা কই

বিড়াল পোষ মানে না

রহিমা

‘জুতু খুইলা ভেতরে আয়’ বইলা
সম্ভাষণ জানাইতো রহিমা
তার রুমে যাইতে গেলে

সে মাঝে মাঝে মণিহারে
সিনেমা দেখতে যাইতো
কলেজ পড়ার
সাথে সাথে

এইরকম একবার
‘মনপুরা’ দেখতে গেছিলো সে
ফর্সা হইলে হইতে পারতো প্রেম-
সেই না হওয়া প্রেমিক
আর তার বোনের সাথে

সে সোমবার রাতের খবরের পর ছায়াছন্দ দেখতো
এবং জুতাকে বা জুতোকে জুতু বলতো

চিকন কালো
সুতীব্র শরীর
প্যাঁচায়া রাখতো লাল,হলুদ,গোলাপী
নীল বা কচি কলাপাতা থ্রীপিসে

প্রেমে পড়ার বয়স তখন তার

সতেরোই হয়তো হবে
আঠারোও হইতে পারে

সেই যে সে পড়লো প্রেমে
উথালিপাথালি
ভীষণ কঠিনভাবে
না হওয়া সেই প্রেমের কথা

এখনো কি সে ভাবে?
প্রেম কি সে পাইছে তবে?
বিয়ে করছে?

বাচ্চা-কাচ্চা?

সন্ধ্যেবেলা খেলাশেষে যখন
ঘরে ফেরে তারা
সে কি বইলা উঠে
দরজার আবডালে

‘জুতু খুলে ভেতরে আয় সোনা!’

মেলানকলিক পদাবলী

১.
তোমারে কি চিনতে পারতেছো
তোমার ছায়ায়?

বাতাবী নেবুর জ্বর জ্বর গন্ধ
গায়ে মেখে
ডুবে যাইতেছো গন্ধরাজ

অব্যক্ত অবয়ব থেকে
ঝরে ঝরে পড়তেছো ফোঁটায় ফোঁটায়

এদিকে আমাদের লেবু চিপা সম্পর্ক
তিতা হয়ে যাইতেছে

বাঁশখালী সৈকতে
অন্ধকারে ওইগুলা ঝাউগাছ ছিলো কি?
সেদিনের সন্ধ্যা সাতটার পরে?
চারদিক এতো ফাঁকা
দূরে কী বিশাল অবয়ব!
দানব দানব জাহাজেরা দুলতেছে
কোনখানে মানুষ নাই
হাওয়ারা ফুলতেছে
সমুদ্র গজরাইতেছে
তিন নম্বর বিপদ সংকেত
সমুদ্রে

আমাদের স্যাড ফীলিংসেরা
গোরস্তান হয়ে যাইতেছে

মেঘ মেদুরেরা
ঝরো
ঝরো
এখন
ভীষণ তুমুলে

ঝমঝম ঝমঝম
বেদনার নুপুর বাজায়ো না বক্ষে

ওখানে
অশত্থ তলে
নাকি ঝাউ ছায়ে (?)
মৌনী হৃদয়
বিষাদের ধূপ জ্বেলে
কী জানি সে ধ্যান করে যায়

হৃদয় এখন
শ্মশান
শ্মশান

মহাদেব!
ডাকে সুমুদ্দুর
শব্দে শব্দ বাড়ি খায়

এতো আর্তচিৎকার!
তবু অপেক্ষা
তব তপস্যা এবার ভাঙবে কি তায়?

২.

সারা দিনমান স্বপ্নেরা জাইগা থাকতেছে

নয়নে তোমার কাটতেছে সাঁতার

কালিগোলা সমস্ত রাত্তির জুড়ে
মগজে গাইতেছে ক্যানারি

তুমি ঘুমাইতে পারতেছো না

তোমার দিন রাত
রাত্তির
রাত্তির

ইনসমনিয়া এক মাতাল ঘ্রাণ

ক্রমে অদ্ভুত এক শহর
জাগিয়া উঠিতেছে বুকে

মানুষেরা নাই
কেবল ছায়া হয়ে হয়ে আসে যারা

তারা মুখহীন

সেই শহরের আরো অদ্ভুতে
বানায়ে আরো আরো অদ্ভুত বাড়ি
মেঘের মতো ভাসিয়া টুপ করে
পড়তেছো খসে
তারি উঠোনে

পাতিয়া লয়েছো সংসার

এখন
এখানে
এই দিনমানে
পড়াইতে ছাত্র

তুমি উনুনে বসাইছো সামোভার
বলকাইতেছে পানি
ফুটতেছে শব্দেরা
টুপটাপ
হৃদয়ে

হৃদয়ের উত্তাপে

কালো দরজায় কড়া নড়ে উঠলো কি?
ডাকে কে চুপিচুপি ফিসফাসে?
বাতাসেরাও আড়ি পাতা জানে!

খুলবে কি দরজা তোমার?
তোমার একলার শহর
একাকী বাড়ি
উবে যায়
সহসা

তুমি পড়াইতেছো ছাত্র
ঘনঘোর ইনসমনিয়ায়

৩.

আমি তোমারে বললাম- ‘পাহাড়’
তুমি আটকায়ে গেলে কল্লোলে-
‘ তার’চে সমুদ্রে যাই।’

সমুদ্র বড় একা
ওইখানে একা একা মানুষেরা
একসাথে একাকী
ঢেউয়ে ভাঙে
কান্না ভেজায়

না হয় সুমুদ্দুর

তবু দূর দূর
অস্ত বিকেলে
এই যে আস্ত আমি
মানুষ একখানি

তোমার শৈশব খুঁজতেছি

আমার শৈশবের ভাঁটফুলে

ওখানে কোন গন্ধ নেই!

তবু এখন যৌবন জারুল

আমার কবিতা গায়ে মেখে
ছড়াইতেছো ঘ্রাণ

তোমাতে মৌমাছি
নাচি
নাচি

সে নাচে নাচতেছো তুমি

আমারই শব্দ নিয়া ধার
বানাইতেছো বাক্য
বর্শা বিঁধতেছো বুকে
আমারই

ডুবতেছো আদিম শূন্যতায়
বুদবুদ
ফেনায়িত লাস্যে

এখন এই নিদারুণ অন্ধ অন্ধকারে
হাতড়াইতে আলো
আঁকতে তোমাতে ভোর

ছড়ায়ে যাইতেছি রক্ত
কী ভীষণ লালে

আমরা এখন

আমরা
বান্ধবীরা
আমাদের হয় নাই বন্ধুত্ব
যখন
ভার্সিটি

ছাত্রত্ব ঘুচে গেলে পরে
হল -হোস্টেল -মেস
কারো কারো
বাপের হোটেল
চুকে গেলে পরে
আমরা বুঝতে শিখেছি
আমরা বন্ধু বটে

আমরা লেট টোয়েন্টিজ
কেউ ম্যারিড
কেউ বাচ্চা কোলে
কেউ সংসার পালে

একার সংসার
অল্প একা
ভীষণ একা

তারা এখন
গেটাপ করে
ইংলিশ মিডিয়াম
সদ্য ভার্সিটি
আঠারো উনিশ
মেকাপ
হেয়ার

বা সদ্য তরুণী
পার্টি যেনো
লেট নাইট

টাকা আছে
দামী শাড়ি
পার্টি গাউন
স্লীভলেস
টপ
ছেঁড়াফাটা জিন্স
ক্যাজুয়াল

স্বাধীনতা

কিচ্ছু বলে না কেউ

আমরা এখন বন্ধু ভীষণ

হারায়ে সময় খুঁজি

আমাদের নাই
নাই হয়ে গেছে
দশ দশটি বছর

মুন্সী আনোয়ারা বেগম

একটা কবিতা লিখব বলে
তোমারে ভাবলাম মুন্সী আনোয়ারা বেগম
কিন্তু তুমি তো গল্প হয়ে যাইতেছো

শাড়ির পাড়ে শীতের বিকেলে শুকাইতে বিষণ্নতা

মোলায়েম নরম সোনালী
রোদ হইয়া শুকাইতো তোমার শুভ্র শাড়ি
ও রোদ নাকি আশ্বাস
ছেলেপুলে নাতিপুতি?
সত্তর বছর সংসার টাইনা
এতোটুকু ক্লান্ত হওনি?

প্রেম তো পাইছো তুমি

তোমার মাস্টার স্বামী
অল্প পড়াশোনা জানা তুমি
সেই ‘পঞ্চাশে ক্লাস এইট
মা নাই, তিন মাস বয়স থেকে তাই সৎমা

তোমারে মিলাইতে গল্পে
বানাইতে উপন্যাস তোমারে
পাইলে প্রথম উপহার
প্রেমে

‘আনোয়ারা’

জানিলে জীবন আনন্দময়
জন্মাইলো সন্তানেরা
মরিলো কেউ কেউ
ছোট
ছোট
বড়কালে বেদনা জাগায়ে
জন্মিলো শূন্যতা
শূন্যতার দীর্ঘশ্বাসে

কালে কালে শাখা প্রশাখা ছড়াইলো তোমার
তবু পারিলে না গাঁথিতে শেকড়
তোমার ভিটায়
মাটিতে

এককালে তোমার ভরন্ত সংসারে
যেহেতু কাজের লোকের অভাব নাই
দুলাইতে চাবি, ঘুরাইতে ছড়ি
বুনে চলেছো একমনে
নকশা
নকশা
নকশী কাঁথা কেবলি

মুন্সী আনোয়ারা বেগম
কি গল্প তুমি এঁকে গেছো
জীবনের বছর চল্লিশ?
.
নাই হয়ে গেলে তুমি

রাইখা গেলে তোমার গল্পদেরে
কাঁথার নকশা ছাড়িয়া তাহারা
কী অদ্ভুত ফিসফাসে

গাছ
গাছ হয়ে
জন্ম লয়
আমারই মগজে

রাত রাত
ঘনঘোর ইনসমনিয়ায়

শ্বাসে শ্বাসে কাঁপে
শাখা প্রশাখা

পাতাদের আলাপ
শুনিতে সংগোপনে
আমি জেনে গেছি ঠিকঠাক

কোন রঙে
কতোটুকু জীবন
আঁকতে হয় নকশায়

এখন আমি নকশা বুনি
কবিতায়

শান্তা হক

জন্ম ১৯৯৩ সালে, যশোরে। বেড়ে উঠা মাগুরা, যশোর ও ঢাকায়। সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর । পেশায় শিক্ষক।

লুবনা চর্যা

জন্ম: ৩ ডিসেম্বর, ১৯৮১, খুলনায়। বেড়ে ওঠা ওখানেই। কৈশোরে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর একসময় থিয়েটার ছেড়ে নিজের লেখা ও আঁকার দিকে মনোযোগী হন। মাস্টার্সের পর ঢাকায় বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপি রাইটার হিসাবে কাজ করেছেন। একসময় সেটাও ছেড়ে দিয়ে এখন সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনভাবে লেখালেখি করেন, ছবি আঁকেন, লুবনার বক্তব্য, “নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই…”।

Share