গোলাপী দৃশ্য বারংবার

ধারাবাহিক উপন্যাস (দ্বিতীয় পর্ব)

।। সম্বিত বসু ।।

প্রতি মুহূর্তে তারা আরও বেশী করে পেছনে ফেলে আসছে সিমলা স্টেট অ্যাসাইলাম, ফিমেল ওয়ার্ড, বিরক্তিকর গানা-থেরাপি, সঙ্গীতা অসান্থ আর যাবতীয় ন্যাকড়াকে। ফেলে আসছে আজকের বরবাদ ফাংশানকে, ফেলে আসছে সঙ্গিতার বয়ে আনা ‘কম্বাইন’-এর যাবতীয় ডিসফাংশানকে। বিপরীত দিকের বাস আর ট্রাকের হেড লাইটের আলোর ঝলসানিতে সেলজারের চোখ ঢুলছে…

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (দ্বিতীয় পর্ব)

ফিমেল ওয়ার্ড, সিমলা স্টেট অ্যাসাইলাম। সায়েরী অনেক চেষ্টা চরিত্র করে একটা লাল কলম জোগাড় করেছে, টিসু পেপার ছিঁড়ে-কেটে গানের লিস্ট তৈরী করছে। গতকাল সন্ধ্যাবেলায় ছেলেরা বাগানে বন ফায়ার করেছে, আজ মেয়েরা করবে। বাথরুমের জানলা থেকে সে গতকালের সান্ধ্য-আসর দেখেছে, শুনেছে, উপভোগ করেছে, আজ সে কেমন করে আগুন ঘিরে নেচে গেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে, বিশেষ করে সেলজা ম্যামকে, সেই কথা ভাবলেই উত্তেজনায় তার কান নড়ছে, ঠোঁট কাঁপছে, বুক দপ-দপাচ্ছে। সেলজা ম্যাম বলেছে, বন-ফায়ারে পকোড়া আর কফি হবে, শোনা ইস্তক বিস্কুট জমাচ্ছে মেয়েরা সেমিজের পকেটে, স্যাঁতালেই বা, বিস্কুট তো বিস্কুটই! আজ সবাই ইচ্ছে মতো জামাকাপড় পরবে, ফাংশান আজ মাঝারি মাপের, কিন্তু বকাঝকা করার কেউ না থাকায় এই তাদের বড়, সব চাইতে বড় উৎসব। এতদিনে এমন একটা দিন এসেছে যেদিন এই সিমলা স্টেট অ্যাসাইলামের চোহদ্দির মধ্যে থেকেও মনে হচ্ছে এইবার তারা সত্যি-সত্যিই খাস সিমলায় আছে, যে সিমলায় থেকেও তারা সেই সিমলার একটা চক্‌, একটা মহল্লাও দেখেনি, বারান্দায় হুমড়ি খেয়ে এক ঝলক গাড়ি আর তাদের ড্রাইভারদের দেখা, যে গাড়ি সিমলার রাস্তায় অনবরত ছুটেছে বাধাহীন, দ্বিধাহীন আর যাদের ডাইভারের চোখে-মুখে সারা শহরের খুল্লাম প্রেম ও আবেগসংকট। এমনই সব তির্যক দৃষ্টির ফলায় তারা যে সিমলার আভাস পেয়েছে, যে সিমলার হাহুতাস ও অট্টহাসির শব্দকে তারা তাদের নিত্যকার ঔদাসীন্য ও উন্মাদনায় স্বযত্নে লালন করেছে জেনে অথবা না জেনে সেই সিমলার অনন্তরসের ছিটেফোঁটা আজ দ্বিধাহীন শিশুর মতো তাদের বুকে চাপবে। পাহাড় কুঁদে শহর বানানোয় অচিরেই হিমালয়ের শৈত্যপ্রবাহ আজকের বন-ফায়ারে সিমলাওয়ালা জাড়া হয়ে যাবে। সন্ধ্যা নামলে তো তালাচাবি শুদ্দু গোটা ফটক অন্ধকারে ডুবে যায়, তখন গেট নয় বরং অভ্যাস ও পিছুটানজনিত ন্যাকামিতে প্রস্থরিত বাসিন্দারা  নট নড়নচড়ন। আজকে সেই অচলয়ায়তন ভেঙে পড়বে, উড়ে এসে জুড়ে বসবে এক অসম্ভব ও উতপটাং মনমৌজ যা কিনা একান্তই সিমলাই। এই ধরণের পুড়কি-প্রলাপ আর হঠাৎ খুশীর ভাঁটস্য ভাঁটের অবান্তরে ফিমেল ওয়ার্ডের তরুণীরা মশগুল আর তারই মাঝে নিরুত্তাপ রুবি বুড়ির মাথার পাকা চুল ফুলে ফেঁপে উঠছে। এই ধরণের ভাব ঘেঁষেই এক চোরা তরঙ্গ ছড়িয়ে যাচ্ছে সিমলা ভিলার ফিমেল ওয়ার্ডে। চুপ করে থাকা যে সায়েরীর ধাতে নেই সেই সায়েরী সিমলাভিলায় আসা ইস্তক প্রথমবার খবরের কাগজ হাতে নিয়ে জোরে জোরে খবর পড়ছে, না কোনো মৃত্যু সংবাদ নয়, বিশেষ বিশেষ খবরের মতো করে সে পড়ে চলে, “আজ শামকো গার্ডেন মেঁ পিকনিক হোগা। সেলজা ম্যাম বন ফায়ার যায়েগি, সায়েরী বন ফায়ার যায়েগি, সাঞ্জি বন ফায়ার যায়েগি, শর্মি বন ফায়ার যায়েগি, রুবি মওসি বন ফায়ার নেহি যায়েগি কিঁউকি উয়ো বুঢঢি হো গায়ি। সিমলাওয়ালা জারা স্যাহে নেহি পায়েগি, মার যায়েগি বেচারি…” অবশেষে সেই মৃত্যু আসে আর তাও আবার আজ সন্ধ্যের সিমলাওয়ালা জারার কারণে, এতদিন যেন তারা কলকাত্তাই শীতে আরামসে কেক্‌-কমলালেবু করছিল! আজকের সান্ধ্য পিক্‌নিকের সম্ভাবনায় যেন অকস্মাৎ সিমলা এসে গোঁত্তা মেরেছে তাদের বিচ্ছিন্ন ও সুরক্ষিত ডিমের খোলে।   

চুপ করে থাকা যে সায়েরীর ধাতে নেই সেই সায়েরী সিমলাভিলায় আসা ইস্তক প্রথমবার খবরের কাগজ হাতে নিয়ে জোরে জোরে খবর পড়ছে, না কোনো মৃত্যু সংবাদ নয়, বিশেষ বিশেষ খবরের মতো করে সে পড়ে চলে, “আজ শামকো গার্ডেন মেঁ পিকনিক হোগা…”

সেলজা সুকলা অফিসে বসে কাউন্সেলিং-এর ফাঁকে ফাঁকে গান ডাউনলোড করছে, তার খেয়াল নেই যে সায়েরীর নাচ-গানের বেয়ারা উৎসাহে গান চালাবার ফুরসত পাবে না সে। ওয়ার্ড বয়দের সে কাঠ জোগাড়ের দায়িত্ব দিয়েছে, শাকিল, কাদরিরা বাগান চষে কাঠকুটো জোগাড় করছে আর মাঝেমাঝে দূর থেকে জানলা দিয়ে তাদের দেখা যাচ্ছে, হাতে মোটা ডাল তুলে সেলজা শুক্লার দিকে তাকিয়ে হাসছে তারা, দিনের আলোয় দাহ্য ডালপালায় আগুন দেখাচ্ছে সেলজাকে। ইনচার্জ সঙ্গীতা আসান্থকে কোনোমতেই জানানো যাবে না তাদের এই প্ল্যান; আজ সন্ধ্যাবেলা সঙ্গীতা শহরে যাবে খৈনী আর জর্দা কিনতে, আরও হয়তো টুকটাক কিছু কাজ আছে, ঘন্টা দুই নিশ্চিন্তি, সেই ফাঁকেই সারতে হবে, অন্ততপক্ষে চালু করে দিতে হবে বন-ফায়ার। দু-রকম পকোড়া হবে, চিকেন আর ভেজ, কাদরিকে টাকা দেওয়া আছে, সে সময় মতো পকোড়া সাপ্লাই দেবে। কফি, চিনি আর গুঁড়ো দুধ কিনে রেখেছে সেলজা, ইমার্সান হিটারে বালতিতে জল গরম করে কফি বানাবে বলে মনস্থ করেছে। কিন্তু টেনশন ছাড়ছে কই? থেকে থেকে মনে হচ্ছে, পরিকল্পনা ঠিকঠাক উতরোবে তো? শেষ মূহুর্তে সঙ্গীতার কোনো এক বেয়াদপিতে সবটা বানচাল হয়ে যাবে না তো? এসব চিন্তাতে জ্বলে পুড়ে সেলজা এলিয়ে বসে মনে মনে সিগারেট ধরায়, কলেজের ক্যান্টিন ফিরে আসে তার কাছে আর হঠাৎ মনে হয় সে ভীষণ রকম মুটিয়েছে শেষ ক’বছরে। কিন্তু তাতে কী, বৈষম্যে ভরা এই অন্যায়ের তালের সে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে, কনভেন্টে ক্যাবারে করবে সে, এবার আসরে কফি হলে পরেরবার ওয়াইন হবে, কাঠ ফুরোলে এই সিমলাই ঠাণ্ডায় জামা-সোয়েটার পুড়িয়ে আগুন বাঁচিয়ে রাখবে তার মেয়েরা। একটা মেয়েকে বাগানে হাঁটতে নিয়ে গেলেও সঙ্গীতার পারমিশন লাগে, ওপেন-এয়ারে ক্যাজুয়াল কাউন্সেলিং-এর দোহাই দিতে হয়, মনে হতেই কুঁকড়ে-কঁকিয়ে ওঠে সেলজা শব্দ না করেই। বিন্দুমাত্র বিচলিত বা উত্তেজিত না হয়ে ভয়াল জননীর শীতল সন্ত্রাস কীভাবে নরম কলজেকে শলাকাবিদ্ধ করে, মূক করে দেয় সকল প্রগলভতাকে সেই কথা ভেবে শুধু শিউরেই খান্ত হয় না সেলজা, লো প্রফাইলের হাই রোম্যান্সে লালন করে তার নেমেসিসকে। জানলার ফ্রেমে বাঁধানো নিত্যকার বাগান পরিচর্যার বাস্তবিক অবস্থা আনমনে দেখছিল সেলজা, উচ্ছসিত সায়েরী টিসু পেপারের একটা ছোট্ট রোল নিয়ে ঘরে ঢোকায় সে দমাস্ করে শূন্য থেকে পড়ে। গানের লিস্টে যখন সে চোখ বোলাচ্ছিল তখন সায়েরী, তার ব্যাগ থেকে ইতস্তত আয়না বার করে নিজের মুখ ভয়ানক সব ভঙ্গি করে দেখছিল। গানের লিস্টের প্রথমেই সায়েরীর অল টাইম ফেভারিট, রুনা লায়লার ‘শুনো, শুনো মেরি ইয়ে কাহানী শুনো, হুম আহো, হুম আহো…’, তারপর ‘গুটুর,গুটুর’, ‘রাহো মে উনসে মুলাকাত হো গায়ি…’ বড়, বড় ধ্যাবড়া হিন্দি হরফে পঞ্চাশটা গান, প্রত্যেকটা ঝঙ্কার বিট, ঝিনচ্যাক ঢিনচ্যাক। সেলজার মনে পড়ে গত সন্ধ্যায় ছেলেদের বন-ফায়ারে রতন করনের লাগাতার সেন্টিমেন্টাল হিটস, কী দরদ দিয়েই না গাইছিল ওই গানটা, কোনটা যেন, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, “জানেওয়ালো যারা মুড়খে দেখো ইধার ম্যায় ভি ইনসান হুঁ তুমহারে তারাহ!” ভীষণ দরদ দিয়ে কিন্তু আসতে, খুব আসতে, এমন আসতে যে কান না পাতলে শোনাই যাবে না। ‘অনেক মুখ দেখা হয়েছে এবার খান্ত দাও’– ভাব করে সেলজা সায়েরীর হাত থেকে আয়নাটা কেড়ে নেয়।  তারপর ব্যাগ থেকে টিফিন বার করে, ছোলাভাজা আর মুড়ি, সায়েরীকে এক মুঠ ছোলা দেয়, সায়েরী দোনামোনা করে নিয়েই নেয়, পেট ভরে গিয়ে লাঞ্চ খেতে না পারলে কপালে দুঃখ আছে, কিন্তু এক মুঠো ছোলাভাজা এই অবেলায় খাওয়া যেতেই পারে। বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে সায়েরী ছোলা চিবোতে চিবোতে, মায়ের কথা, বরকত চাচার কথা বলতে থাকে; জিজ্ঞেস করে কবে তার মা তাকে নিতে আসবে। এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই শুক্লার কাছে। সায়েরীর মা তার খোঁজ রাখা তো দূরের কথা, টাকা পাঠানোও বন্ধ করে দিয়েছে। গভর্নমেন্টের দয়ায় জাতীয় উন্মাদিনী সিমলা ভিলায় দিন গুজরান করছে আর তারাসাং-দারাসাং-এ ফেরার ঢপ দুবেলা খাচ্ছে স্বয়ং পেয়ারের সেলজা ম্যামের কাছ থেকে। ছোলাভাজা চিবোতে চিবোতে সায়েরী সঙ্গীতার পায়ের আওয়াজ শুনতে পেরে ক্যোঁৎ করে গিলে নেয় থুতু মাখা ছাতু, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার। সঙ্গীতা ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে, “সেলজা, তুম কেয়া পাগাল হো গায়ে হো, লেড়কিলোগো কো লেকার বনউফায়ার কারোগে। জ্বালকে মারনা হ্যায় কেয়া? অউর তো অর কফি! দাওয়াইকে সাথ কফি পিনা কিতনা খাতারনাক হ্যায় তুমহে মালুম হ্যায়? সব ক্যানসেল কারো আভি…” সঙ্গীতা বলেই যাচ্ছিল, সেলজার রাগে, উত্তেজনায় দু-কান বন্ধ হয়ে গেছে; কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না সে, শনি-রবিদের রঙ চুরি যাওয়ায় বার নেই, বালিশ নেই ভেতরে কি বাইরে! পেপার ওয়েটে চাপা দেওয়া টিসু পেপারে গানের লিস্ট লত্পত করছে, সে লিস্ট ছোঁ মেরে কেড়ে নেয় সঙ্গীতা, দলা পাকিয়ে ফেলে দেয় ডাস্ট বিনে, শ্লেষের সঙ্গে বলে, “ওয়া ভাই, আজকাল ওয়ার্ড মে পেন অর টিসু পেপারভি ঘুস রাহা হ্যায়, ইয়ে আসাইলাম হ্যায় কি হোটেল? ম্যায় জরা শহর জাউঙ্গি কি ফায়দা উঠানা চালু! সায়েরী, ওয়ার্ড মে যাও, কোই বন-ফায়ার অন-ফায়ার নেহি হোগা” সেলজা সায়েরীর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে সঙ্গীতার দিকে তাকায়। তার মাথা ঘুরছে , যন্ত্রণা করছে, সে মেডিসিন রুমের চাবি চায় সঙ্গীতার কাছে। সেলজা টাইম টু টাইম স্টক নেয়, তাই কিছু না জিজ্ঞেস করেই সঙ্গীতা তাকে চাবি দিয়ে দেয়, সদ্য জিতেছে সে, বিজয়নী হয়ে বানচাল করেছে সেলজার বন ফায়ারের প্ল্যান, এতেই শেষ নয়, ওয়ার্ড বয়রা আগুনের জন্য যে কাঠ জোগাড় করেছে তাই দিয়ে ছেলেদের আরও একটা বন-ফায়ারের ব্যবস্থা করবে সে; চাপা গর্বে মাটিতে পা পড়ছে না সঙ্গীতার। আজ শহরে যাবে খৈনী আর জর্দা আনতে, উফ্, আজকের দিনটি কী করে যে এত খুশীতে ভরো-ভরো! ধুমসি সঙ্গীতাকে খুকিপনায় পায়, দু-দুটো পান সেজে এক সাথে দু-গালে ঠোসে সে; ওইদিকে তখন হাইপার সেলজা কাঁপা হাতে দশ স্ট্রিপ ঘুমের ওষুধ সরিয়ে দেয় মেডিসিন রুম থেকে। ঘুম চাই তার, গাঢ়, নিখাদ ঘুম।

দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে সিক রুমে শুয়ে পড়ে সেলজা। অসহ্য দপদপানিতে মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে, তবু তার কেমিক্যালে ঘুম আসে। সিমলা ভিলা গড়াতে থাকে তার তালে। সন্ধ্যাবেলায় যখন সঙ্গীতা বেরোচ্ছে তখনও ঘুমিয়ে থাকে সেলজা। ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যায়, দশ স্ট্রিপ ওষুধ খুলে মুখে পুরে দেয় অবলীলাক্রমে, ট্যাবলেট চিবিয়ে চিবিয়ে ছাতু করে দেয় ছোলাভাজা খাওয়ার মতো করে; তারপর সে ডাইনিং রুমে যায়। শাকিল বিশাল, বিশাল ক্যানে করে খাবার দিয়ে গেছে, ধোকার ডালনা, ডাল, পাঁপড় ভাজা। ধোকার ডালনায় সে মুখ থেকে বার করে ফেলে দেয় মোক্ষম ঘুমের ওষুধের লেই। তারপর সায়েরীকে অফিসে ডেকে কফি খাওয়ায়, বন ফায়ারের জন্য যে বড় প্যাকেটটা নিয়ে আসা হয়েছিল তার থেকে। নিজেও খায়, থকথকে চার-পাঁচ শট!

ঘড়ি যায় নয়ের ঘরে, সবাই ডিনার সারে, সেলজা, সঙ্গীতাও। সায়েরীর প্রিয় পদ ধোকার ডালনা সে চেটে-পুটে খায়। খেয়ে উঠে সঙ্গীতা সেলজাকে মিষ্টি পান খাওয়ায়। জিতে গেলে তার মন উদার হয়ে যায়। আর অফিস ঘরের টেবিল ল্যাম্পের আলো-আঁধারে সেলজার চোখে ঘুমের সাথে লড়াই আর সঙ্গীতার চোখে সমর্পন। ওয়ার্ডে ঘুপ-ঘাপ ঘুমিয়ে পড়ছে মেয়েরা, কফি আর সেডেটিভের যুদ্ধে পারেশান সায়েরী। সিস্টাররাও ঘুমিয়ে পড়েছে। সঙ্গীতাও কাটা কলা গাছের মতো লুটিয়ে পড়ে অফিস ঘরের মেঝেতে। সায়েরী তার কোমর থেকে চাবির গোছা নিয়ে ওয়ার্ডে যায়। সায়েরীর বেডের কাছে গিয়ে ব্যাগ থেকে গোলাপ বার করে তার নাকের সামনে ধরে। অতিকষ্টে চোখ খোলে সায়েরী। সেলজা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিশফিশিয়ে বলে, “চল, ঘর চল” মেন গেটের কাছে এসে, সেলজা সায়েরীকে একটা গাছের আড়ালে লুকোতে বলে, দারোয়ান মনোজ ঝাকে ডাকে। মনোজ উনুন পরিষ্কার করছিল, সেলজাকে দেখে এক গাল হেসে বললো, “ট্যাক্সি পাকাড়না হ্যায়তো, আভি গায়া অর আয়া” গার্ড রুমের গুপ্ত দরজা দিয়ে মনোজ বেরতে না বেরতেই সেলজা আর সায়েরীও বেরিয়ে উলটো পথে একটু এগিয়ে সায়েরীকে রাস্তার এক ধারে দাঁড় করিয়ে সেলজা আবার সিমলা ভিলায় ফিরে আসে। মনোজ ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে আসতে সেলজা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে, ট্যাক্সি হাঁকিয়ে বেরিয়ে যায়। পাঁচ মিনিট পর ফিরে এসে সায়েরীকে গাড়িতে তুলতে গিয়ে দেখে, সে রাস্তায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই ঠক-ঠক করে কাঁপছে কন্‌কনে শীতে। অপহরণ পর্ব যে এত সহজে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হবে তা সেলজা কল্পনাও করতে পারেনি কিন্তু এই সময়ের দিকে দৃকপাত করে সে সারৎসার দেখছে যে দেয়াল আর নেই। বাস ছুটছে তারাসাং অভিমুখে। প্রতি মুহূর্তে তারা আরও বেশী করে পেছনে ফেলে আসছে সিমলা স্টেট অ্যাসাইলাম, ফিমেল ওয়ার্ড, বিরক্তিকর গানা-থেরাপি, সঙ্গীতা অসান্থ আর যাবতীয় ন্যাকড়াকে। ফেলে আসছে আজকের বরবাদ ফাংশানকে, ফেলে আসছে সঙ্গিতার বয়ে আনা ‘কম্বাইন’-এর যাবতীয় ডিসফাংশানকে। বিপরীত দিকের বাস আর ট্রাকের হেড লাইটের আলোর ঝলসানিতে সেলজারের চোখ ঢুলছে-জ্বলছে, জল কাটছে; চকিতে খেলে যাচ্ছে গত পাঁচ বছরের ভিন্ন ভিন্ন ভালো-খারাপের ‘ঝালাক-এ-গুলাবী মাঞ্জার’ কল্পনাপটে। কোত্থেকে যেন বুনো মধুর মিষ্টি সুবাস ঝাপটা মারছে, ঘ্রাণ মেমব্রেনে। সে পেরেছে! সে পেরেছে আজ এক মাত্র যা পারার মতো হয়েও পারা যাচ্ছিল না, সেই না পারাকে। ঘুম জড়ানো ক্লান্তিতেও তার শরীর জেগে উঠছে আর তার কাঁধে এলিয়ে থাকা সায়েরীর ঘুমন্ত মুখ তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে আশ্চর্য এই চরাচরে হনন ও প্রাণদানে, যথাক্রমে খুনে ও অপারেশনে, ছুরির প্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী। যাদের কাছে জবাবদিহি করতে হতে পারে সেই সব যন্ত্রে-তন্ত্রে বশীভূত মানুষদের সেই ‘কম্বাইনকে পেছনে ফেলে তাদের নাগালের বাইরে ছুটে চলেছে তো ছুটেই চলেছে তারা ঘন্টায় আশি কিলোমিটার বেগে। ভিডিও কোচ বাসে ফুল ভলিউমে ফিল্ম চলছে; বাঘকে জালে বন্দী করতে না করতেই সেই জিন্দেগি লেনেওয়ালা-জিন্দেগী দেনেওয়ালা ছুরির আক্রমণ মিস্টার নটবর লাল পিকচারে।

প্রচ্ছদের ছবি: রাম কুমার
অলঙ্করণ: অতনু সিংহ

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (প্রথম পর্ব)

সম্বিত বসু

পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের গল্পকার, কথাসাহিত্যিক। নিবাস কলকাতার ভবানীপুরে। চলচ্চিত্রবিদ্যায় পড়াশুনা। গল্পপত্রিকা ‘পরিধি’তে নিয়মিত লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে কলকাতাকেন্দ্রিক বহু সমান্তরাল পত্রিকায় নিয়মিত গল্প লিখেছেন। প্রকাশিত উপন্যাস, ‘গৃহস্থগীতি’।

Share