এবাদতনামা: একজন ভাষাকাপালিকের অভিসন্দর্ভ

।। গৌতম মণ্ডল ।।

ফরহাদ মজহারও একজন কমিউনিস্ট। একজন কমিউনিস্ট ফকির– যাঁর চিন্তা ও চেতনায় রয়েছে মানুষ। আর তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘এবাদতনামা’ আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও সংশয়ের ডিসকোর্স…

এবাদতনামা: একজন ভাষাকাপালিকের অভিসন্দর্ভ

হাজার বছরের আগে থেকে বাংলা কবিতা লেখা হচ্ছে। ২৪ জন সিদ্ধাচার্য লিখেছেন চর্যাপদ। তারপর কবিতার ভাষা ক্রমশ বিবর্তিত হয়ে ঈশ্বর গুপ্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখের হাত ধরে আধুনিক হয়েছে। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক পর্যন্ত বাংলা কবিতা বিভিন্ন রকমের লেখা হয়েছে ঠিকই কিন্তু একথাও অস্বীকার করা যাবে না তা হিন্দু জাতীয়তাবাদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এমনকি মুসলমান বাঙালি কবিরাও এই ধারার ব্যতিক্রমী ছিলেন না। দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম যিনি স্বার্থকভাবে এই সাহস দেখালেন, তাঁর নাম আল মাহমুদ। তাঁর কবিতায় উঠে এল বৃহৎ এক জনগোষ্ঠীর ভাষা। স্তব্ধতাও। শুধু বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভাষাকে তাঁর কবিতায় ধারণ করেছেন বলে নয়,কবিত্বর জোরেই, একক মানুষের নান্দনিকতা ও নৈঃশব্দ্যের কারণে পঞ্চাশের দশকের তিন প্রধান কবি উৎপলকুমার বসু, আলোক সরকার এবং প্রণবেন্দু দাশগুপ্তর মতোই আল মাহমুদও কবিতাপাঠকের হৃদয়ে চিরকাল থেকে যাবেন। কিন্তু বাংলাদেশে আল মাহমুদের উত্তরসূরি কে? বাংলাদেশে ষাটের দশকে আব্দুল মান্নান সৈয়দ একজন উল্লেখযোগ্য কবি। তিনিও বাংলাদেশের একটা ঘরানার পথিকৃৎ। তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় সুররিয়ালিস্টিক চেতনা।বাস্তব ও পরাবাস্তবের মিথস্ক্রিয়া। কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠী ভাষা পাই কি? সম্ভবত নয়। ফরহাদ মজহার হলেন ষাটের দশকের সেই কবি যিনি প্রবলভাবে মুসলমান সত্তা নিয়ে হাজির তাঁর কবিতায়। কিন্তু তিনি একইসঙ্গে মুসলমান হয়েও হিন্দু। এবং একজন কমিউনিস্ট। ভাব আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক।

তবে শুরুর দিকের কবিতায় এইসব ব্যাপার খুব যে ছিল , তা নয়। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ‘খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ’। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম– এইসব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো । নব্বইয়ের দশকের আগে আগে অব্দি তাঁর কাব্যগ্রন্থ হল যথাক্রমে ‘ত্রিভঙ্গের তিনটে জ্যামিতি’ ( ১৯৭৭), ‘আমাকে তুমি দাঁড় করিয়ে দিয়েছ বিপ্লবের সামনে'( ১৯৮৩), ‘সুভাকুসুম দুই ফর্মা’ ( ১৯৮৫), ‘বৃক্ষ মানুষ ও প্রকৃতিবিষয়ক কবিতা’ (১৯৮৫) ‘অকস্মাৎ রপ্তানীমুখী নারীমেশিন’ (১৯৮৫), ‘মেঘমেশিনের সংগীত’ (১৯৮৮)। প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই রয়েছে তৎকালীন বাংলাদেশের পটভূমি। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু এখানেই তিনি সীমাবদ্ধ থাকেননি। এনেছেন অবিভক্ত বাংলার ঐতিহ্য ও পরম্পরা। লালন। চৈতন্যদেব। সুফিবাদ। এবং প্রেমও। ‘সুভাকুসুম দুই ফর্মা’র অধিকাংশ কবিতাই প্রেমের কবিতা। এইসব কাব্যগ্রন্থগুলো ভালো কিন্তু ফারহাদিয় নয়। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় ‘এবাদতনামা’। ৪৪ টি কবিতা রয়েছে এতে। পরবর্তীকালের সংস্করণে আরও কিছু কবিতা সংযুক্ত হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থে তিনি শুধুমাত্র একজন কবি নন, হয়ে উঠেছেন ফরহাদ মজহার। তবে এই কাব্যগ্রন্থের মধ্যে যে খুব রহস্যময়তা আছে,তা নয়, তিনি চানওনি তা। তাহলে কী চেয়েছেন তিনি? এবাদত? এবাদত একটি আরবি শব্দ, এর মানে তো আনুগত্য, উপাসনা । আল্লাহর বিধি বিধান মেনে চলাই এবাদত। কুরআন ও সুন্নাহের মাধ্যমেই সেই বিধি-বিধান নির্দেশ করা থাকে। এটুকু পর্যন্ত এসে মনে হতে পারে এবাদতনামা একটি ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু তাই কি? একেবারেই নয়। এই কাব্যগ্রন্থে আরবি ফারসি শব্দের পাশে আছে হিন্দু পুরাণের অনুষঙ্গ। বৃহৎ বঙ্গের ঐতিহ্য। তিনি নিজে কে, তা দ্বিধাহীনভাবে বলছেন ৪ নম্বর এবাদতনামায়। আসুন, কবিতাটির কিয়দংশ পাঠ করি।

না,আমি মোঙ্গল নই,নই তুর্কি,মুঘলকি বীর
অহংকারী আর্য নই,নই খাস প্রাচীন দ্রাবিড়
ভূমিষ্ঠ হইনি আমি ব্রাহ্মণ বা মৌলবীর ঘরে
আমি নয়া অভ্যুদয় ভূমণ্ডলে মাটির অন্তরে

‘নয়া অভ্যুদয়’ই তিনি হতে চেয়েছেন। কিন্তু নয়া কেন? আল মাহমুদ এই পথে হাঁটা শুরু করলেও ফরহাদ মজহার এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। আর এই অভ্যুদয় যে মহাজাগতিক নয় বা শুধুমাত্র ইন্টেলেকচুয়াল অভ্যুদয় নয়,তাও তিনি পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তিনি অভ্যুদয় হতে চেয়েছেন ভূমণ্ডলে মাটির অন্তরে। অর্থাৎ মাটির কাছাকাছি তিনি সবসময় থাকতে চেয়েছেন। তাই তাঁর কবিতায় ঘুরে ফিরে আসে লোকজ উপাদান। গ্রামবাংলা। এবং মানুষ।

ফরহাদ মজহার হলেন ষাটের দশকের সেই কবি যিনি প্রবলভাবে মুসলমান সত্তা নিয়ে হাজির তাঁর কবিতায়। কিন্তু তিনি একইসঙ্গে মুসলমান হয়েও হিন্দু। এবং একজন কমিউনিস্ট। ভাব আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক।

রামকৃষ্ণ পরমহংস, চৈতন্যদেব,কৃষ্ণ ও রাধার অনুষঙ্গ এই কাব্যগ্রন্থে রয়েছে ঠিকই কিন্তু পাশাপাশি যেটা প্রবলভাবে আছে, তা হল, ইসলামিক জীবনযাপন। বিশ্বাস। তাহলে কি তিনি সত্যই নিজেকে আল্লাহর অনুগত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান? তার জন্যই এ কাব্যগ্রন্থের নাম ‘এবাদতনামা’? তিনি নিজেই এর উত্তর দিয়েছেন ১১ নম্বর এবাদতনামায়। আসুন,কবিতাটির কিয়দংশ পাঠ করি।

বিশ্বাসে ইমান নাই, তদুপরি তুমিও মালিক
বুদ্ধি দিয়েছ ঠিকই, অথচ খাটালে বুদ্ধি ভাবো
মস্তিষ্কে আসর করে বেতমিজ দুই ইবলিশ
ফাঁপরে পড়েছি মওলা কী-বা করি কোন রাহে যাই

বুঝতে অসুবিধে হয় না, আল্লাহর প্রতি যে কবির নিরঙ্কুশ বিশ্বাস রয়েছে, তা হয়ত নয়। তাহলে কার কাছে তিনি অনুগত? এর উত্তর ‘বুদ্ধি’। বুদ্ধি,যক্তি ও তর্ক। ইন্টেলেক্ট। এ নিয়েই তো একজন কমিউনিস্ট। ফরহাদ মজহারও একজন কমিউনিস্ট। একজন কমিউনিস্ট ফকির– যাঁর চিন্তা ও চেতনায় রয়েছে মানুষ। আর তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘এবাদতনামা’ আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও সংশয়ের ডিসকোর্স। আসলে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভাষাচৈতন্য দিয়ে তিনি একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছেন । এজন্য তাঁকে একজন ভাষাকাপালিক বলা যেতে পারে। আর ‘এবাদতনামা’ হল একজন ভাষাকাপালিকের অভিসন্দর্ভ। শ্বেতপত্র।

(ফরহাদ মজহারকে নিয়ে লিখতে গেলে যে সময় ও অভিনিবেশ প্রয়োজন,তা পাইনি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পড়ে লিখতে গিয়ে যেটা মনে হল,আরও নিবিড় পাঠ প্রয়োজন। এহিসেবে এই লেখাটি একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনার সূচনামাত্র।এর বেশি কিছু নয়।)

গৌতম মণ্ডল

জন্ম : ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪, পেশা : শিক্ষকতা
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : উজাগর আঁখি ১৯৯৪, রাত ও রাতের বিভা ১৯৯৫, কন্দমূলের আকাশ ১৯৯৯, কালপুরুষ ২০০০, ভূপাখি ভস্মপাখি ২০০৫, দুর্লভ শিখরদেশ ২০০৯, অলসরঙের টিলা ২০১২, বিবাহের, মন্থর আয়োজন ২০১৬, অরচিত অন্ধকার ২০১৯
প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক : আদম
সম্পাদিত গ্রন্থ- গদ্যসংগ্রহ গীতা চট্টোপাধ্যায়, কবিতাসংগ্রহ অরুণ বসু, কবিতাসংগ্রহ সুধীর দত্ত, কবিতাসংগ্রহ সমীরণ ঘোষ, কবিতাসংগ্রহ সঞ্জীব প্রামাণিক, কমলকুমার মজুমদারের চিঠি আমার স্বামী কমলকুমার দয়াময়ী মজুমদার

Share