শ্যামলকান্তি রাক্ষস হতে চেয়েছিল

।। আর্যনীল মুখোপাধ্যায় ।।

শ্রী শ্যামলকান্তি দাশ মহাশয়কে অবমাননার জন্য বাংলা কবিতা ‘সানডে টাইমস কলকাতা’কে সার্বিকভাবে বর্জনে প্রত্যয়ী আজ। শ্যামলকান্তি দাশ বাংলা কবিতার এক অপরিত্যাজ্য নাম অন্তত পাঁচ দশক। প্রায় দুদশক ধরে উনি পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র মাসিক বাংলা কবিতা পত্রিকা কবিসম্মেলন সম্পাদনা করে চলেছেন। কবি ও মানুষ যেখানে মিলে মিশে একাকার হয়ে ভালোবাসা, সম্মান ও শ্রদ্ধার শিরোপার নিশ্চেষ্ট প্রাপক হয়ে ওঠেন, অসংখ্য তরুণ ও তরুণতর কবি, প্রাবন্ধিক তাঁর অপমানকে কেড়ে নিয়ে নিজের করে নেন, এই পুরস্কারের আকাশসীমা নিচে কত বামনের ‘সম্মান’ হেঁটে যায় সার বেঁধে। ‘রাবণ’ তো বটেই, কীভাবে শ্যামলকান্তি একদিন রাক্ষস হতে চেয়েছিল, আজ তার সবিস্তার রইলো কবি আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের কলমে।

আর তার সঙ্গে রইলো ভুঁইফোঁড় বাজারি পত্রিকা ‘সানডে টাইমস কলকাতা’-এর প্রতি বড় বাংলার সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রতিপক্ষ’র প্রতিবাদ। সত্তর দশকের কবি, বড় বাংলার কবি শ্যামলকান্তি দাশকে যেভাবে অপমান ও হেনস্থা করেছে ওই ‘সানডে টাইমস কলকাতা’, তার জন্য বড় বাংলার সকল কবি, লেখক, চিন্তক ও পাঠকের কাছে আবেদন রইলো ওই পত্রিকাকে চিরতরে বর্জন করার। উল্লেখ্য, শ্যামলকান্তিকে অপমান করতে গিয়ে অনার্য আইকন ‘রাবণ’-এর প্রসঙ্গ তুলেছিল সানডে টাইমস। আমরা বলতে চাই, রাবণ কোনো অপমানসূচক শব্দ নয়, বরং রাবণ আমাদের গরিমা। আমরা যারা বড় বাংলার বাদামি আর কালো মানুষ, আমরা যারা আর্য দেবতাদের সমান্তরালে মধুকবি থেকে শুরু করে কবি শ্যামলকান্তির মতো রাক্ষস ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করে চলি।

– সম্পাদকমণ্ডলী, ‘প্রতিপক্ষ’।

ভুল বাংলায়, কবির নামের ভুল বানানে এবং কুৎসিত বয়ানে সামাজিক মাধ্যমে ভুঁইফোঁড় বাজারি পত্রিকার বিজ্ঞপ্তি!

ক্রমে ক্রমে শ্যামলকান্তি ‘রাক্ষস’ হতে চেয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন। গড়ে তুলেছেন রাক্ষসকে এক বহুরূপী করে, গণদেবতা করে। রাক্ষস হয়ে উঠেছে এক জনমানস।  কখনো এক মফস্বলী গড়পড়তা, এক অপ্রত্যাশিত ছাপোষা। এখন মাথার সব চুল ছিঁড়েও বোঝা যায় না এ লোকটার নাম ‘রাক্ষস’ কেন!  এক ধ্রুপদী মধ্যবিত্তের মতোই তার সব থেকেও কী যেন এক অসুখ একবগ্‌গা কালো ঘোড়া হয়ে মনের পেছনে কোথাও, তরমুজবাগানের প্রান্তে…

শ্যামলকান্তি রাক্ষস হতে চেয়েছিল

শ্যামলকান্তি দাশ

রাক্ষস বলতে কী? সাথে সাথেই কি খুব ছেলেবেলার মহাকাব্যের কার্টুনবই, উপেন্দ্রকিশোরের অঙ্কন, ছৌ-নাচের মুখোশ, দশমুন্ড রাবণদাহ – এসব মনে পড়ে না? এক বিকট, বিসদৃশ, বিকৃত, বিচিত্র, অসুর। যতোটা না সম্ভ্রম উদ্রেককারী, তার চেয়ে অনেক বেশি আতঙ্ক, ঘৃণা… আর, আরেকটু বড়ো হবার পর,  কেমন যেন পারিহাসিক!  যেন যা আমরা প্রথাগত সৌন্দর্য বলে মনে করি তারই এক comical antithesis।

সেই রাক্ষসের সাথে সম্প্রতি দেখা হয়ে গেলো পরিণত বয়সে। দেখা হলো বেশ কয়েকমাস ধরে বারবার। দিনের কোণে, কানাচে। শহরে, শহরান্তরে। তাকে নিয়ে গেলাম মিশিগানের হল্যান্ডনাম্নী শহরের টিউলিপ উদ্যানে, শিকাগোর হ্রদের ধারে, হিউস্টনের ধূসর বিশালাকারে।  বহুরূপে সে ফিরে ফিরে আসতে লাগলো, পাতায় পাতায়। ‘পাতা’ বলতে অবশ্যই ফরাস নয়, অটবীশাখার বাহার নয়, ফুলের ডাঁটি নয়, বরং প্যাপিরাস।  মানে, বইয়ের পাতায়। হ্যাঁ, বলাই বাহুল্য কবিতার বই। তার শিরোনামও ‘রাক্ষস’।

কিন্তু এ যেন কেমন রাক্ষস! বীভৎসরস বঞ্চিত, কমিকাল হলেও প্রধানত করুণ, কখনো উন্মত্ত ঠিক, উষ্মাময়, আবার কখনো স্বপ্নপ্রধান, দুঃখী, সবুজ, কামুক, দীর্ঘ ও কচি, খর্ব ও প্রাচীন, কলহপ্রিয় ও সাংসারিক, প্রেমজ ও সুধাময়। এ কোন রাক্ষস? আমি ক্রমাগত ধন্দে পড়ে যেতে থাকি। কখনো তাকে খুব চেনা লাগে, এক পারিবারিক সুহৃদের মতো। কিন্তু সে কি সুহৃদ? না কি রক্ষক, না ভক্ষক?; সে আমাদের বাবা? না আমাদের ‘মাদারচোত’? নাকি দুটোই…… সব গুলিয়ে যেতে থাকে, কেননা

রাক্ষস আমাদের বাবার বন্ধু। অনেকদিনের পুরনো।
সেই বন্ধুতা প্রতিদিন ঘষেমেজে
বাবা নতুন করে তোলেন।

রাক্ষদ আমাদের বাবার বন্ধু, কিন্তু মায়ের সঙ্গে
একটাও কথা বলেন না।
মা বলেন, উনি দেবতা, ভুল করে মাটিতে নেমেছেন,
ওঁকে প্রণাম করো।
মায়ের চোখ টলমল কতে কান্না ঠোঁটে রক্ত,
বুকে নখের আঁচড়।
আমরা রাক্ষসদেবতার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।

একেকদিন ঝড়বৃষ্টির রাত্রে বাবা যখন
বাড়ি ফেরেন না, আমাদের খুব ভয় করে।
আকাশের ভয়। ভূতের ভয়। নক্ষত্রের ভয়।
অনেকগুলো ভয় সাপের মতো আমাদের গলা পেঁচিয়ে ধরে।
সেই সময় জামগাছের মাথায় বাঁকানো আলো,
ভরা পুকুরের জলে বিদ্যুতের ফুলকি।
দেখি দরজায় দাঁরিয়ে রাক্ষস হাসছেন।

(‘বাবার বন্ধু’ কবিতার অংশবিশেষ)

একেক জায়গায় রাক্ষসকে মনে হয় যেমন চেয়েছিলাম, যেভাবে কবি হিসেবে দেখতে চেয়েছি তার প্রতি-সত্তা, তার প্রতি-মানবতা – সেভাবেই যেন দেখতে পাচ্ছি। এমনকি তার বীভৎসরূপ – এই তো, এই তো ধরা পড়ছে। কবি লিখছেন –

ভগবান আমাদের তৈরি করে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছেন।
আমাদের চারটে হাত আর আটটা পা।
বিন্ধ্য পর্বত কুঁদে কুঁদে তৈরি হয়েছে আমাদের মাথা।
আমরা রাক্ষস।

(রাক্ষসের কথা)


বলেই তো দিলাম কবিতার বই। অনেকেরই চেনা লাগলো। অনেকেই এ বই সম্বন্ধে আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন, অনেকবার পড়া। তবু শ্যামলকান্তি দাশের ২০০৩ সালের (প্রতিভাস) বই ‘রাক্ষস’ আমি আরো একবার পড়ছি, আমার মতো করে। ‘রাক্ষস’ নামে যে একটা বই আছে, ক’বছর আগে সেটাও জানতাম না। বিদেশে বসে বাংলা বই যোগাড় করা এক সমস্যা। কবিবন্ধুর অভাব নেই ঠিক, বই কিনে রাখতেও কেউ পেছপা না, কিন্তু এতদূরে পাঠানো এক সমস্যা। অনেক খরচ করে ডাকে পাঠালে যে আসবেই এমনো হলফ করে বলা যায় না। বইয়ের একটা কবিতা নিয়ে কোনো একটা পত্রিকায় একটা আলোচনা চোখে পড়ে বছর দশেক আগে। সেই কবিতায় চোখ আটকে যায়। অন্বেষণ শুরুর প্রথম সোপান সেটা।

রাক্ষসের কথা আমরা শুনলাম ঠিক। কিন্তু তার অপরিচিতি এখনো বাঘের চোখের মতোই জ্বলন্ত। যেমন আমরা বাঘের জ্বলন্ত চোখ দেখে কখনো ভয় পেয়েছি, ভাবিনি আসলে তার ওই চোখ সন্ত্রস্ত; সে অনেক বেশি ভয় পেয়েছে আমাদের থেকে – সেইভাবে রাক্ষসও ভয় পাচ্ছে; আমাদের প্রতি তার ঘৃণা, প্রতিবাদ লেখা হয়ে যাবার পরেও শেষ পর্যন্ত ভেসে উঠছে ভীতি।

মস্ত মস্ত ইমারত আর মোটরগাড়ি আমাদের ভয় দেখাচ্ছে
কম্পিউটার টুকে রাখছে আমাদের জন্মছক
আমাদের চারপাশে বিদ্যুতের তারকাঁটা
এতদিন ধরে আমরা মেঘ বিদ্যুৎ আর হেলিকপ্টারের চমকানি
সহ্য করেছি। আর নয়।
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষ আমাদের শত্রু। আমাদের গলার কাঁটা।
আমরা তাদের ছেড়ে কথা বলব না।

(রাক্ষসের কথা)

রাক্ষসের অস্তিত্ব, রহস্য লুপ্ত করে দিচ্ছে মানুষ। আর শ্যামলকান্তির কবিতাপুস্তক তাকে বাঁচাচ্ছে। হৃত রহস্য হৃদয়ভরে তাকে দান করছে। সে রহস্যের পলিতে পলিতে লেপে রাক্ষসকে দিচ্ছে সহস্ররূপ, অর্থের হাজার আস্তর।

বিগ্রহের সাথে মানবের যুদ্ধ চলেছে অবিরত। রাক্ষস তার রূপ। তার রূপক। মাঝে মাঝে মনে হয়, সবসময়ে নয়। জীবনের সে কটূ দিকটা, আমাদের চারপাশের সকালে ভিড়ে গিজগিজে, সে

আমাদের সূর্যকরোজ্জ্বল চিদাকাশ লক্ষ্য করে ছুঁড়ছে ইটপাটকেল!
তার কুলোর মতো কান, মুলোর মতো দাঁত, ড্যাবাড্যাবা চোখ
তালগাছের সমান পুরুষঅঙ্গ আমাদের কেবল তাড়িয়ে বেড়ায়’

  (রাক্ষস)

আবার যেই রাত হয়ে আসে, রাক্ষস বন্ধু; মসীর শ্রীতে কমনীয়, নম্র, কম্প্র।  সে তখন আমাদেরই স্বপ্নদ্রষ্টা, আশাভাগী। তাকে উদ্দেশ্য করেই আমাদের সকল কবিতা, এ প্রহরে –                                   

রাত্রি নিঝুম হয়ে গেলে পায়ে পায়ে রাক্ষসের পাশে এসে দাঁড়াই –
কাঁধে হাত রেখে বলিঃ এই যে নৌকো দেখছ, এই যে নদী,
এই বালির ঊপর রাজহাঁস ডিম পাড়ছে,
এই যে ডিমের ওপর চাঁদের আলো জমতে জমতে সরু হয়ে উঠছে,
বুঝলে স্যাঙাৎ, এগুলো কিন্তু সব তোমার!’

 (রাক্ষস)

                                   

কবিতা পড়তে পড়তে একটা voice over টের পাই। কোনো কোনো কবিতা যেন মনে হয় রাক্ষসের বয়ানে। যেমন ‘মায়ের জন্য’, যেখানে macabre, হিংস্রতার রূপ ধরে আগ্রাসী মাতৃপ্রেম। আরেক রকম কবিতা ‘গরল’ – বইয়ের প্রথম কবিতা, যে কবিতায় গোটা বইয়ের ভ্রমণ শেষ হলে ফিরে গিয়ে মনে হয় এই তো করুণরাক্ষসের গলা। কবিরাক্ষস সে, দেখো কী অপরূপ লাবণ্যে বলছে –

পাতা সরিয়ে দ্যাখো—পতনের নীচে জ্বলজ্বল করছে চোখ
মাথা পর্যন্ত উঁচু হয়ে আছে ঝরা ফুলের পাপড়ি—পাপড়ি সরিয়ে দ্যাখো
দৌড়ে বেড়াচ্ছে লকলকে সুগন্ধী আগুন
পুংকেশর ঠেলে বেরিয়ে আসছে প্রাণমাতাল করে দেওয়া অঙ্গার
অঙ্গার সরিয়ে দ্যাখো কাঁটার মতো একমুখী, তীক্ষ্ণ, সরু হাড়—
হাড়ের সঙ্গে কথা বলতে আমার সঙ্কোচ হয়, বুকের নরম
জায়গায় বিহ্বলতা ধাক্কা মারে, চোয়ালে খোঁচা লাগে
কণ্ঠায় ব্যথা চুলবুল করে—

(গরল)

চেনা পৃথিবীর ভালোমন্দের আরো অনেক রূপের মুখোশ পরে আসে রাক্ষস। মানুষের লোভের প্রতিফলনে সে এক সময় ‘মুদ্রারাক্ষস’ হয়ে ওঠে। টাকা ঝমঝমায় কানের কাছে। ধোঁয়া ওঠে সেই ধনরাশি থেকে (‘সংগ্রহ’, ‘মুদ্রারাক্ষস’)। আবার কখনো সে মিশে যায় শান্তসুনিবিড় রূপসী বাংলার গ্রামপ্রকৃতিতে, সেই প্রকৃতিরাক্ষস যেন পরিবেশের এককানা হয়ে ওঠে, ‘শান্ত রসধারায় ভেসে’ যায় সে। বাংলার খেজুরগাছের নিচে সে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে সে দেখছে –

নীলিমায় নীল হয়ে আছে বাংলার গোল গোল আকাশ
পুকুরপাড়ে ফুটছে অন্তত দশ পনেরো কুড়িটা লঙ্কাজবা।
খোলা জানলা বন্ধ করতে মনে নেই –
শান্ত রসধারায় ভেসে যাচ্ছে রাক্ষস!’

   (ভেসে যাচ্ছে)       

বাংলার নরমমাস, নাদুসনুদুস মেয়েদের কচিমাংসেও এই রাক্ষসের জিহ্বা ঠেকে। সে একদিন কামুক হয়ে উঠতে থাকে। মেয়েদের দিকে হাত বাড়াতে থাকে। মনে পড়ে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের কথা? সেই হ্রদের ধারে ফুলকুমারীর সাথে খেলা? খেলতে খেলতে, খেলতে খেলতে শেষ! শেষে শিশুর লাশ তুলে আনা শোকাধীর বাবা। এই সেই রাক্ষস।

রাক্ষস ইদানীং একটু কামুক হয়ে উঠছে
লোভ লালসা দিন দিন বেড়ে চলেছে
সে আমাদের ঘরের বউয়ের দিকে হাত বাড়ায়
বাংলার মা-জননীদের দিকে হাত বাড়ায়
এমকী বাড়ির কচিকাঁচা মেয়েদেরও… আঃ, বলা যায় না সে-কথা।
‘সহবাস’ শব্দটা যে তেমন সুবিধের নয়
রাক্ষস সে-কথা কিছুতেই বুঝবে না।
ভেতরে রসের ফোয়ারা থাকলে কী হবে,
‘স্তন’ কথাটা গুরুজনদের সামনে মুখ ফুটে বলতে নেই, একথা
রাক্ষসদের মতো একটা আকাট মূর্খকে কে বোঝাবে!

দূর দূর আর যা হোক, রাক্ষস নিয়ে ঘর করা যায় না!

(ইদানীং)

তার ‘শিশ্নের আগায়/অমন দপদপ করে জ্বলতে থাকে/ নক্ষত্রের মতো বাতি?’ (মনে হয় তুমি রাক্ষস)। একটার পর একটা বাংলার নরম মেয়েদের সে নষ্ট করতে বদ্ধপরিকর…এও এক রাক্ষস, রাক্ষস বাবুসোনা…

দেখে মনে হয় তুমি রাক্ষস না হয়ে যাও না
কাঁটাতারের বেড়া টপকে
হঠাৎই আমাদের এই আদাপুর গাধাপুর গ্রামে
ঢুকে পড়েছ
কিন্তু এদিকে আমার হয়েছে জ্বালা
আমি এখন ঠিক কোন ফুলের মালায় শরীর সাজিয়ে
তোমাকে বরণ করি বলো তো বাবুসোনা?

(মনে হয় তুমি রাক্ষস)

এইভাবেই ক্রমে ক্রমে শ্যামলকান্তি ‘রাক্ষস’ হতে চেয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন। গড়ে তুলেছেন রাক্ষসকে এক বহুরূপী করে, গণদেবতা করে। রাক্ষস হয়ে উঠেছে এক জনমানস।  কখনো এক মফস্বলী গড়পড়তা, এক অপ্রত্যাশিত ছাপোষা। এখন মাথার সব চুল ছিঁড়েও বোঝা যায় না এ লোকটার নাম ‘রাক্ষস’ কেন!  এক ধ্রুপদী মধ্যবিত্তের মতোই তার সব থেকেও কী যেন এক অসুখ একবগ্‌গা কালো ঘোড়া হয়ে মনের পেছনে কোথাও, তরমুজবাগানের প্রান্তে…

রাক্ষসকাহিনী

অথবা ‘নররাক্ষস’ কবিতায় যেমন দেখি – সেখানের রাক্ষসও এক সাধারণসুন্দর, যাকে বর্ণনা করতে গিয়ে কবি নিয়ে এলেন এক বীভৎস, বিকটরূপ; এক প্রতিনান্দনিকতাকে নিয়ে এসে ধ্বংস করা হলো কুরূপকেই। তার থেকে পালক ও আঁশের মতো, মাংসের মতো ভয়, অশুভতাকে ছাড়িয়ে নেওয়া হলো। বইয়ের বহু কবিতার শীর্ষক এক – ‘রাক্ষস’। ৫১ পাতার ‘রাক্ষস’ কবিতায় (‘শূন্য আর ঠং ঠং করে বাজে এমন একটা কলসির গায়ে…’)  সে এক প্রায় শিল্পধারণা হয়ে উঠতে চায়। এক বিমূর্ত লক্ষ্যবস্তু? এক অন্বেষণমাত্রা? জীবনের প্রতিবিম্বস্থানে রাখা আছে একটা dartboard যেন,

যার দিকে জীবনকে নিক্ষেপ করতে হয় স্বতঃস্ফূর্ততায়। রাক্ষস সহসা উড়ে যায়, মিলিয়ে যায়।

একটা অভাববোধের নামও হয়ে ওঠে রাক্ষস। এমন অন্যান্য কবিতাও আছে যেখানে রাক্ষসের সন্ধান চলছে, সে হয় বিলীয়মান, নয় বিতাড়িত, নয়তো ফেরার। উদাহরণস্বরূপ ‘কোথাও রাক্ষস নেই’, বা ‘রাক্ষসের কালো মুখ’ —

আস্তে আস্তে শিল্পের সংকটের জায়গাটায় পা রাখছে রাক্ষস। সে এক আশা, এক ত্রাণ। শাব্দার্থিক প্রথাগতকে একেবারে উল্টোমুখ করে দিয়ে সে এখন এক প্রতি-বিভীষিকা, এক anti-monster। মানবতাবাদী শ্যামলকান্তির রাক্ষস, সে কোনোভাবেই মনুষ্যেতরের সগোত্র নয়। রাক্ষস কবিতার রক্ষী। এক বাহক, দূত ও উদ্ধারকর্তা। বাঁধন খুলে দিয়ে সে আমাদের আকাশোন্মুক্ত করে। আর সাথে সাথে আমাদের চিরচেনা হয়ে ওঠে সে –  কবিতা স্বপ্নলোভী এক দূত, পালক ও প্রতিনিধি।  এক বহুরূপী জনরাক্ষস।

আর্যনীল মুখোপাধ্যায়

দ্বিভাষিক কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, চিত্রনাট্যকার ও সম্পাদক। বাংলা ও ইংরেজী মিলিয়ে ৯টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে Conversation about Withering (২০২১, ক্রিস্তিনা স্যাঞ্চেস লোপেসের সাথে), অনাম আন্দ্রেসের একক ইস্তাহার (২০২০), স্মৃতিলেখা (২০১৩, ২০১৫), সুনামির এক বছর পর (২০০৮), চতুরাঙ্গিক/SQUARES (২০০৯, প্যাট ক্লিফোর্ডের সাথে), late night correspondence (2008), হাওয়ামোরগের মন (২০০৪) ও খেলার নাম সবুজায়ন (২০০০,২০১১)। গদ্যগ্রন্থ ‘কিনারার রূপকথা’। চারটি প্রবন্ধের বই। ইংরেজী ও ইস্পানি কবিতা সংকলিত হয়েছে অসংখ্য বিদেশী কাব্য-আয়োজনে। কৌরব অনলাইন ও The MUD Proposal সম্পাদনা করেন। পেশা – কারিগরি গণিতের গবেষণা।

    

Share