।। সম্বিত বসু ।।
সায়েরী তার চোখের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে উত্তর দেয়, “দিদি! বন ফায়ার!” শঙ্কিত সায়েরী মন্দির ছেড়ে ছুট্টে বেরিয়ে যায়, পেছন পেছন সেলজা। যজ্ঞের আগুনে সায়েরী বন ফায়ার দেখেছে, যে বন ফায়ার সিমলা স্টেট অ্যাসাইলাম হলে তার তারাসাং-দারাসাং-এ আসা, সেলজাকে ভালবাসার কোনোটাই হতো না, কিচ্ছুটি নয়। হুড়মুড়িয়ে নামতে থাকে সায়েরী পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চিৎকার করতে করতে, “মুঝে নেহি জানা! মুঝে নেহি জানা বাপাস!” সেলজা তার চেয়েও জোরে চিৎকার করে তার নাম ধরে ডাকে, ‘স্টপ’ বলে। স্টপ শুনে সায়েরী দাঁড়িয়ে যায়। সেলজা হাঁপাতে হাঁপাতে তার কাছে গিয়ে বলে, “কউন তুঝে জানে কো বোলা পাগলী কাঁহিকে!”
গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৫)
And humans are no fool
Gravity happens to pull!
হোটেল থেকে বেরিয়ে সায়েরী মন্দির যেতে চাইলো। গাছের ফাঁকে হালকা কুয়াশার স্তর ভেদ করে পাহাড়ের ওপর দিকে মন্দির দেখা যাচ্ছে। সেলজারও মন্দির যেতে মন করে, শেষ কবে মন্দির গেছে তার মনে নেই কিন্তু প্রেমিকাকে নিয়ে মন্দিরে পুজো দেওয়ার, মাথায় তিলক কাটার লোভ হয় তার। এ এক অভিজ্ঞতা যা সে নিজের ঝোলায় নিয়ে খুশি মনে পাহাড়ি রাস্তার ঢাল বরাবর নামতে চায়। পাহাড় বেয়ে উঠতে হাঁফ ধরে, দু’কদম চলতে না চলতেই দাঁড়িয়ে গিয়ে হাঁপায় সেলজা, সায়েরী হাসে তাকে দেখে। প্রায় এক ঘন্টা পাহাড় বেয়ে যখন তারা মন্দিরে পৌঁছোয় তখন সায়েরী বলে বাইরে থেকেই প্রণাম করতে চায় সে, ভেতরে যেতে চায় না, ভেতরে গেলে তাদের অভিশাপ লাগবে। তার চেয়ে বরং মন্দিরের বাইরের চাতালে বসে মন্দিরে লোকজনের আনাগোনা দেখবে, চেনা কেউও বেরিয়ে যেতে পারে। সেলজা রেগে যায়, এত কষ্ট করে মন্দিরে এসেছে আর না ঢুকেই ফিরে যাবে? সায়েরী বলে এই মন্দিরের দেবতায় তার বিশ্বাস নেই, এ ঠাকুর তার ঠাকুর নয়। সেলজার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে, তোর ঠাকুর নয় তো মরতে এতটা রাস্তা খাড়াই হাঁটালি কেন হতভাগী? আর তখনই তার মনে হয় সে এত ঠাকুর ভক্ত হলো কবে থেকে? কোনো দিন কোনো মন্দিরে একটা টাকাও তো প্রণামী দেয়নি সে। সিমলা ভিলা থেকে পালাবার পর যা কিছু সে আগে কখনও করেনি সেই সব কাজ করায় প্রবল ইচ্ছে ক্রমাগত পেয়ে বসছে তাকে।
গত রাতের শরীরী সোহাগের ছবি থেকে থেকে ফিরে আসছে আর সে উত্তেজিত হয়ে চিন্তা না করেই অনুমান করার চেষ্টা করছে তার গল্প এই আকস্মিক মোড় নেওয়ার পর কোথায় নিয়ে যাবে তাকে, এরপর আরও বিস্ময়, অন্য বিস্ময় কী কী তোলা আছে তার জন্য? সায়েরীর মানষিক সুস্থতার জন্য মানত করবে সে নাকি তার সুমতির জন্য মানত করবে সায়েরী? হায়! যৌবন! ঘেঁটে যাচ্ছে তা সুস্থতা-সুমতির অমূলক বিচারে। মন্দিরের বাইরে একটা লোক ধূপ জ্বালিয়ে পূজো দেওয়ার ডালা, গাঁদা-রজনীগন্ধার মালা, পেঁড়া-এসব বিক্রি করছে। সেলজা দুটো গাঁদার মালা আর প্রসাদের আটটা সন্দেশ কিনলো। একটা মালা নিজে পরে আরেকটা মালা সায়েরীকে পরিয়ে তার মুখে সন্দেশ গুঁজে দিল। আহ্লাদে আটখানা হয়ে সায়েরী প্রসাদ খেতে খেতে অস্পষ্ট উচ্চারণে বললো, “মেরি পূজা কার রাহে হো কেয়া ? কারনাই হ্যায় তো আরতি উতারো মেরী।” বলতে বলতে এক হাতে ত্রিশুল আর আরেক হাতে আশীর্বাদ করে, চোখ পাকিয়ে দেবী পোজ দেয়। সায়েরীকে রসিকতা করতে দেখে সেলজার আমোদ হয় আর তাদের দুজনকে ঠাকুরের মালা পরে, প্রসাদ না চড়িয়েই খেয়ে মন্দির প্রাঙ্গনে প্রায় স্বর্গ নামিয়ে আনা দেখে আগত ভক্তরা কিঞ্চিৎ বিব্রত, কিঞ্চিৎ আমোদিত। সেলজা সিগারেট ধরিয়ে দেবী আরতি করতে শুরু করলে সায়েরী খিলখিলিয়ে ওঠে। সে হাসি পাহাড়ে-পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হতে না হতেই দুজন ধুতি পরিহিত দশাসই চেহারার পান্ডা গোছের লোক তাদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আওয়াজ দেয় যে এবার মন্দিরের সামনে মুম্ফালির দোকান দিলে লাভ আছে! দু-হাত দেবী পোজে রেখেই মাথা দোলাতে দোলাতে সায়েরী ততক্ষণে গান ধরেছে, “জয় জগদীশ হরে”। সুখটানের ফাঁকে-ফাঁকে সেলজা দেবীর আরতি করে। সায়েরী ‘জয় জগদীশ’ মাথা দুলিয়ে চোখে চোখ রেখে, মুখে দুষ্টু হাসি মেখে হঠাৎ বলে, “চালো সেলজা, আন্দার চালে” ম্যাম, দিদি, ছাড়া সায়েরীর মুখে নিজের নাম শুনে সেলজা অবাক ও পুলকিত হয়।
কিছু বলে না সে, সে এখনও ধাতস্থ নয় এই নতুন সময়ের সাথে; দুদিন আগেও সে কাউন্সেলিং রিপোর্টে ক্লায়েন্টদের উন্নতি অবনতির কথা লিখছে, জানি স্যারকে বোঝাচ্ছে যে সিয়াচেন এখন শান্ত, ভারত সরকার তাকে চায়নায় কোনো অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে পাঠাতে চায় না বরং চায় যে সিক্রেট এজেন্ট হিসেবে সফল কেরিয়ারের পর সে এবার অবসর নিক, আর এখন সেলজা গাঁদা ফুলের মালা পরে মন্দিরের চাতালে বসে সায়েরীকে নিজের হাতে করে প্রসাদ খাওয়াচ্ছে, সিগারেট দিয়ে আরতি করছে! টোটাল ভুলভালে ক্যাপিটাল ভোগে! দু’জন মন্দিরে প্রবেশ করে। চন্ডী মন্দির। ভেতরে গুচ্ছ পায়রা, তাদের ঝাপটা-ঝাপটি আর বকম-বকম-এর সাথে মন্দিরের ঘন্টার আওয়াজ মিলেমিশে অদ্ভূত সোরগোলে বুঁদ গর্ভগৃহ, যজ্ঞের আগুনের আলোতেই যা যা কিছু দেখা যাচ্ছে। প্রণাম করে সায়েরী সেলজার হাত ধরে যজ্ঞের আগুনের একদম কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, তার মনে যে কি চলছে তা বুঝতে গেলে বোঝার চেয়ে ভুল বোঝা বেশী হয় তাই তাকে দেখে, তার কথা বার্তায়, চালচলনে যে টুকু যা আন্দাজ। হঠাৎ সে সেলজাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। মন্দিরের বাকি দর্শনার্থীরা বিচলিত, সেলজা তার পিঠে হাত বুলিয়ে ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেয়া হুয়া? সায়েরী, কেয়া হুয়া”। সায়েরী তার চোখের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে উত্তর দেয়, “দিদি! বন ফায়ার!” শঙ্কিত সায়েরী মন্দির ছেড়ে ছুট্টে বেরিয়ে যায়, পেছন পেছন সেলজা। যজ্ঞের আগুনে সায়েরী বন ফায়ার দেখেছে, যে বন ফায়ার সিমলা স্টেট অ্যাসাইলাম হলে তার তারাসাং-দারাসাং-এ আসা, সেলজাকে ভালবাসার কোনোটাই হতো না, কিচ্ছুটি নয়। হুড়মুড়িয়ে নামতে থাকে সায়েরী পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চিৎকার করতে করতে, “মুঝে নেহি জানা! মুঝে নেহি জানা বাপাস!” সেলজা তার চেয়েও জোরে চিৎকার করে তার নাম ধরে ডাকে, ‘স্টপ’ বলে। স্টপ শুনে সায়েরী দাঁড়িয়ে যায়। সেলজা হাঁপাতে হাঁপাতে তার কাছে গিয়ে বলে, “কউন তুঝে জানে কো বোলা পাগলি কাঁহিকে!”
দুপুরে জামা-কাপড়ের দোকান থেকে সায়েরীর পছন্দ অনুযায়ী পোষাক কেনা হয়, সেলজার জন্য জিন্স, টি সার্ট, নিজের জন্য শাড়ি। সেলজাকে চুড়িদার পর্যন্ত কিনতে দেয় না সে। জামা-কাপড় কিনে ওরা হোটেলের ঘরে ফেরে। গুরচরণ অফিসে বসেছিল, “হেসে জিজ্ঞেস করে, “মন্দির গয়ে থে?” সেলজা মাথা নেড়ে ঢুকে যাচ্ছিল, হঠাৎ মনে পড়ায় চরসের খোঁজ করে। গুরু বলে আজ ‘চান্দা ম্যামকে সাথ পার্টি হ্যায়, চারাস অর ভদকা, আপ ভি আইয়ে। স্পেশাল মালানা ক্রিম আজ সামকো আয়েগা। তোলা তিন হাজার পুরা!” মন্দির থেকে বেরোনোর পর থেকে সায়েরী গুম মেরে গেছে। জামা কাপড়ের দোকানে আবার “সেলজা আবসে তুম সির্ফ জিন্স-টি সার্ট প্যাহনোগি”, “চুড়িদার-হুড়িদার ভুল যাও” এসব বলছিল, হোটেলে ফিরে আমতা-আমতা করে বলছে, “দিদি মুঝে ঘার জানা হ্যায়। কাব হোগি মেরি ছু্টটি?” সময়ের সাথে হেলে-দুলে আচানক আগু-পিছু-ডাইনে-বাঁয়ে হাবুডুবু খেয়ে দুজন কিচ্ছু খেয়াল করছে না, কিচ্ছু দেখছে না, এখানকার মানুষগুলো তাদের কেমন করে মাপছে, দোকানীরা অন্য বহিরাগতদের মতো তাদের খাতিরদারী করছে কিনা, এখানকার কাকগুলো সব দাঁড় কাক, বৃষ্টি হবো-হবো করেও হচ্ছে না, গাছের পাতাদের নড়ে-চড়ে ওঠায় বাতাসের ঝামরানি, কী ঝাল এখানকার লঙ্কায়-এসবের কোনো কিছুই দাগ কাটছে না সেলজার মনে, সায়েরীর কি হচ্ছে হোম্-টাউনে ফিরে তা বলা দুস্কর। নদীতে যাওয়ার রাস্তাটার দুধারে গাছ, কনিফার নয় এমনি গাছ, গাছ-গাছড়া। লোকে বলে এই গাছগুলো নাকি দুশো তিনশো বছর বয়স; সেই রাজা-রাজরাদের আমলে লাগানো হয়েছিল, বৃটিশ যৌবন পেরিয়ে এখন গণতান্ত্রিক বার্ধক্য। জাম গাছের নীচটা জাম পড়ে পড়ে কালচে বেগুনী হয়ে গেছে, রাস্তার কালো দেখে সায়েরী ওপর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে যায়। পাতার ফাঁকে সূর্য না থাকলেও সায়েরী হাতের তালুর ছায়ার নীচে চোখ কোঁচকায়। আলো পড়তে শুরু করেছে মালুম হয় রাস্তা পেরিয়ে আয়া নদীর ধারে এসে জনমানববর্জিত ঘাট দেখে। সায়েরীর মুখে হালকা হাসির আভাস। সেলজার মনে হয় নদীদের বৃথাই নাম দেওয়া আর সায়েরীর মনে হয় নৌকা চড়ি।
সেলজা ব্যাগ থেকে বার করে একটা সিগারেট ধরায়। চন্দ্রমিতার কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে তার প্রেমিক আর্তর কথা জাকে সে তাপস বাগচি বর্ণিত আর্ত রায় সন্দেহ করেছিল এবং তথ্য অনেকটা মিলেও যায়। তাহলে আর্তর গল্প পুরোটাই তাপসের মন গড়া নয়, আসাইলামে কিভাবে মানুষের সত্য-মিথ্যে একাকার হয়ে যায় সেই ভেবে সেলজার নদী ছুঁতে ইচ্ছে করে। সে সায়েরীর হাত ধরে ঘাটের চার-পাঁচটা সিড়ি ভেঙে নদীর জলে পা ভেজায়। সায়েরী জানায় যে সে সাঁতার পারে, নৌকো পারে, ট্রাউট মাছের জলাশয়গুলোয় সে সাঁতার, মাছ-ধরা শিখেছে, সেলজাকে সে জিজ্ঞেস করে যে সেলজা সাঁতার কাটতে, মাছ ধরতে পারে কিনা? দূরের ঘাটটায় একটা ডিঙি বাঁধা আছে দেখে তারা সেই দিকে হাঁটতে শুরু করে আয়া নদীর জলে হাত-মুখ ধুয়ে। বারবার চন্দ্রমিতার প্রেমিক সেই ডাক্তারির ছাত্রর কথা মনে পড়ছে যে নানা রঙের কালিতে মরফিন মিশিয়ে কলমে ভরে নিজেকে পঞ্চাশাধিক জায়গায় আঘাত করেছিল, তার বিচিত্র কালিমাখা লাশ|টা থেকে থেকে ভেসে ওঠে সেলজার মনে। অস্বীকারের অন্তিম পর্যায়ে স্বেচ্ছামৃত্যু, যে অস্বীকার সেও করতে শুরু করেছে সিমলা স্টেট আসাইলাম থেকে পেসেন্টকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে, যে অস্বীকারে মৃত্যু আসতে পারে, তবে মৃত্যুর আগে পুলিশ।
সেলজার হঠাৎ মনে হয় পাথারে-পাথরে পা দিয়ে নদী পেরোলেই আর পুলিশ নেই। কিন্তু তার পালানো শেষ হয়েছে, ঘুরে দাঁড়িয়ে সব কিছুর মোকাবেলা করতে সে বদ্ধপরিকর, নিজেদের দিকে দেখে সে, সে আর সায়েরী, সায়েরী হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একটিবারের জন্যও তেমন ঝামেলা পাকায়নি; ডাইনিং-এ চন্দ্রমিতাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে টেবেল উঠে ‘জুলমি সাং আঁখ লাড়ি’ গানটা গাওয়া ছাড়া, কিন্তু টেবেল আছে, সায়েরী সেটাকে স্টেজ করে নিয়েছে, এতে কি আর এমন অস্বাভাবিক? পাহারাদারীর মধ্যে থাকতে থাকতে সেলজাও চৌকিদার হয়ে গেছে, দাড়ি না থাকলেও ‘খবরদার!’ হাঁকায় সমান পারদর্শী হয়ে উঠছিল সে অচিরেই, সঙ্গীতা আসান্থ-এর গা-জ্বালানো দখলদারীতেই কি অবশেষে মুক্তি হলো সেলজা ও তার সায়েরীর, ত্রাসেই কি পরিত্রাণ অথবা বিকট ক্রোধে?
অন্ধকার না নামলেও ঝিঁঝি ডাকতে শুরু করেছে, ডিঙিটার ঘাটের কাছাকাছি আসতেই ওরা দেখতে পেলো, ঘাটের এক ধারে একটা ছেলে বসে আছে, অতি কষ্টে ওরা বুঝতে পারে যে ছেলেটি দীনদয়াল, চারদিকে তার ভাত ছড়ানো, গুচ্ছের দাঁড় কাক এসে সেই চাল খাচ্ছে, দীনদয়ালের সামনে একটা করোটি রাখা। সেলজা ইশারায় সায়েরীকে থামতে বলে। এই ঘাটের পাশ দিয়ে এখন বেশ লোক যাতায়াত করছে, সন্ধ্যে নামলে যে সব মানুষ বেরোয় নিজ-নিজ ধান্দায়, তাদের আনাগোনা নদীর পাড় বরাবর। সেলজারা দূর থেকে দেখে যে যখনই কোনো মানুষ দীনদয়ালের সামনে দিয়ে যাচ্ছে তখনই দিনু সেই খুলিটা তাদের দিকে বাঁ হাতে বাড়িয়ে দিচ্ছে; কেউ ‘যত্তোসব’ ভাব করে বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় তো কেউ সেই খুলিতে থুতু দিয়ে, কপালে আঙুল ঠুকে নমষ্কার করে, একটা টাকা দিনুর দিকে ছুঁড়ে চলে যায়। বেশ কিছুক্ষণ এই ড্রামা দেখার পর সেলজারা দিনুর সামনে এসে এটা সে কি করছে জিজ্ঞেস করার আগেই দিনু তাদের দিকে খুলিটা বাড়িয়ে দেয় আর তৎক্ষনাত সায়েরী সেটায় স্বশব্দে থুতু ফেলে সেলজাকে বলে তাকে একটা টাকা ছুঁড়ে দিতে। সেলজা হক্চকিয়ে গিয়ে ব্যাগ থেকে টাকা বার করে সায়েরীর হাতে ধরিয়ে দিলে, সায়েরী সেটা দিনুর দিকে ছুঁড়ে দেয়। দিনু কোনো কথা বলবে না বুঝতে পেরে ওরা নদীর পারে দিনুকে ফেলে রেখে হোটেলে ফেরে। ফেরার পথে ওরা প্রথম ঘাটটায় ফিরে এসেছিল।
সেলজা পাহাড়ি নদীর ঘাট এই প্রথম দেখছে, নিয়ম করে নিয়ম ভাঙায় তারাসাঙ্গীদের জুড়ি মেলা ভার। অন্ধকারে গাছেদের দেহ-জ্ঞান লোপ পেয়েছে, মোবাইলের টর্চ জ্বেলে বীথি বরাবর হাঁটতে হাঁটতে সেলজা সায়েরীর কাছে জানতে চায় নদীর ঘাটে বসে দিনু ওটা কি করছিল, খুলিতে থুতু দেওয়ার রহস্যটা কী, সায়েরী সুর করে উত্তর দিয়েছিল, “ম্যায় কেয়া জানু?” সবাই যা করছে সায়েরীও সেই দেখে তাদের অনুকরণ করেছিল কোনো কিছু না জেনে-বুঝে। এই ব্যাটাই তাদের ঘরে আসবে একটু পরে ঝ্যাঁটা হাতে, যাকে ভূতে ভর করেছে তার হাতেই ঝ্যাঁটা, এরই নাম তারাসাং-দারাসাং, যার গোটাটাই আস্ত এক আতুরাশ্রম! স্থান মাহাত্ম্য বুঝে অন্ধকারে মাথা নত করে সেলজা। দূরের জঙ্গলে তখন ‘জল পড়ে পাতা নড়ে, পাগলা হাতি মাথা নাড়ে!’
সম্বিত বসু
পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের গল্পকার, কথাসাহিত্যিক। নিবাস কলকাতার ভবানীপুরে। চলচ্চিত্রবিদ্যায় পড়াশুনা। গল্পপত্রিকা ‘পরিধি’তে নিয়মিত লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে কলকাতাকেন্দ্রিক বহু সমান্তরাল পত্রিকায় নিয়মিত গল্প লিখেছেন। প্রকাশিত উপন্যাস, ‘গৃহস্থগীতি’।