ফিরে এসো খামার কন্যা (প্রথম পর্ব)

।। রওশন সালেহা ।।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বের, বঙ্গোপসাগরের কূলে মেঘনা নদীর মোহনায় নোয়াখালী জেলার সদর থানা। সেখানে রওশন সালেহার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এর আগে আমরা তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার এক নদীর জীবন’ ছেপেছি। এবার তাঁর একটি উপন্যাস ছাপছি। বইটির কয়েক জায়গায় নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার আছে। ঘটনার স্বাভাবিকতা বজায় রাখার জন্য।

নোয়াখালী শহর এবং তার কাছের চর ও দ্বীপের মানুষের জীবন নিয়ে সাগর ও নদীর ঢেঊয়ের খেলা চলত। তার সঙ্গে লড়াই চলত মানুষের। তবুও তাদের মনে আনন্দ এবং বুকে অপরিসীম সাহস ছিল। রওশন সালেহা তাঁর উপন্যাসে সেটা ধরবার চেষ্টা করেছেন।

যে মানুষদের জীবন নিয়ে লেখা সেখানে  যাত্রা, কবি-গানের লড়াই তো হতই। শীতে চরের উপর বোবা টকিজ, সার্কাস দেখান হত, তাঁবু খাটিয়ে। স্কুল ছিল, ছেলেমেয়েরা পড়তে যেত। রাস্তা ছিল পাকা, দু’পাশে ছিল ছায়াতরু-ঝাউ, পবন, বকুল, শিমুল আর বিদেশী গাছের সারি। মানুষ বলত, ‘অচিন গাছ’। শহরটির ছিল বড় নদীবন্দর। নানান মালপত্র বোঝাই হয়ে আসত স্টীমার, সাম্পান, নৌকা, বজরা। মন্তিয়ারঘোনা ঘাটের মতো। আসত চরের লোকজন। বেশীরভাগই আসত চর-দখলের মামলা মোকদ্দমা করার জন্য; উকিল, মোক্তার, মুহুরি, কেরানীদের কাছে। জজ জোর্ট, কালেক্টরি অফিস, দোকানপাট, বাড়িঘর ছিল পাকা, ফুলের বাগান শোভা পেত। আশ্চর্য সুন্দর ছিল জজ কোর্ট। বিদেশ থেকে আনা মার্বেল পাথরের তৈরী তিন তালা দালান। আর সাগর পারে ছিল অতি উঁচু দেয়ালে ঘেরা আলিশান ও ভয়ংকর জেলখানা।

কিন্তু এত সবের কিছুই রইল না। একে একে ডুবিল সকলই পাথরের শক্ত খুঁটি নদীর ক্ষুধিত গহ্বরে নিয়ে নোয়াখালি শহরটি  ইতিহাস গ্রাস করে প্রমত্ত মেঘনার জলরাশির ঢেউ দিয়ে। ওতঃপর চতুর্দিকে শূন্য। শূন্যতা তখন চারিদিকে। নোয়াখালীর সেই ইতিহাস লেখবার কেউ আর নাই। কিন্তু রওশন সালেহা তার সাক্ষী ছিলেন। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে খানিক ধরবার চেষ্টা করছেন। উপন্যাসের এটা একটা পটভূমি।

সময়টা ছিল ভারত থেকে ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পর। ভারত ভেঙে তখ্ন এদেশে পাকিস্তান হয়েছিল এবং এই অংশ পূর্বাঞ্চলের পূর্ব পাকিস্তান ছিল। জলে নিমজ্জিত মানুষ খড়কুটা ধরেও বাঁচতে চায়, যারা যেভাবে পেরেছে, নদীর অপর পারে, মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে। জায়গা-জমি ছিল যাদের সম্পদ, সে সব গেল ভেসে, কেবল সাহস আর শক্তি ছিল বলেই আবার তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছিল।

নোয়াখালী জেলার সদর শহরটি উঠে এল নতুন স্থানে। তার নাম ‘মাইজদি কোর্ট’। নতুন শহর, পুরানা শহরের রূপ তারা পায় নি। নোয়াখালী এখনও আছে, কিন্তু সেই শহর আর নাই। হয়তো তার কিছু ছাপ এই উপন্যাসে পাঠকের মিলতে পারে।

– সম্পাদনা বিভাগ


ফিরে এসো খামার কন্যা (প্রথম পর্ব)

ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের দাওয়ায় এসে দাঁড়ান বশীর। বহু আগে ছন দিয়ে নিজেই চালা বেঁধে, মাটির ভিটা করে, বাঁশের খুঁটিতে চালা তুলে নিয়েছেন তিনি। এখানে এসে দাঁড়ালে এক শান্ত-সুনিবিড় প্রকৃতি খুঁজে পান বশীর। তার সাথে জড়িত এই খামার বাড়ির ক্ষেত-জমি, আম, কাঁঠাল, নারিকেল, শুপারির জায়গাটির নন্দিত শোভা এবং দাঁড়িয়ে থাকা তাল গাছের সীমানা ছাড়িয়ে মাঠের পর ধূ ধূ মাঠ। যদিও তার মনে হয়েছে খামার বাড়ির বাংলো প্যাটার্নের টিনের ঘরটার সাথে একটা অঘটন তার দ্বারা হয়ে গেল এবং স্ত্রী নেহার বানুও বলে দিল, ‘মাথা খারাপ হয়েছে? কী দরকার ছিল এখানটায় ঝামেলা বাড়ানোর। তবুও টিকে গেল এই মাটির দাওয়া। গ্রামের বাড়িতে এ তো থাকেই, তাদের বাড়িতেও না হয় থাকল। লোকজন কেউ না এসে বসুক, তাকে যে দাঁড়াতে হবে এখানে, চোখ জুড়ালে যে মনও জুড়ায়।

বশীরের পরনে নীল সূতায় চেক কাটা সাদা লুঙ্গি, কাঁধে জল গামছা, গায়ে সাবান কাচা সাদা ফতুয়া, কাঁচা-পাকা চুলের বহর রয়েছে মাথায়। সিঁথি নেই। কপাল, নাক চোখ মিলে বেশ সুপুরুষ ব্যক্তিই তিনি। পায়ে ইদানীং কাল রঙের পাম্পসু পরছেন। আগের কাঠের খড়ম আর খুঁজে পান না। কেউ পরে না, হয়তো বা। পেশীবহুল দীর্ঘ শরীরের মানুষটি মাটি কুপিয়ে, হালের বলদ টেনে, ফসলের জমি ঠিক রাখেন। তার চাষ করার লোক থাকলেও পরোয়া করেন না। বলেন, ‘ওদের সাথে কাজ করে আমি অনেক জানতে পারি, শিখতে পারি। এখন যে আমি বশীর চাষী। লোকে আমার মাস্টার চাকরির কথা কেন যে ভুলে না। আমি নিজে কিন্তু ভুলে গিয়েছি।’

রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, কাঁদা-মাটি নাড়ানাড়িতে; তার গায়ের বর্ণ, হাত-পায়ের অবস্থা আর ভদ্রলোকের বলে মনে হয় না, ফর্সা বুক আর পিঠ তো কেউ দেখতে পায় না! কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে ‘আমি নিজেই রোদে পোড়া এক কর্মী মানুষ হয়ে গেলাম’- এ রকম বিস্ময় প্রকাশ করেনও। কিন্তু বাড়ির লোকদের তার জন্য দুঃখ করার শেষ নেই। পিছনে তারা লেগেই আছে। নেহার বলেন, “যথেষ্ট তেজ দেখিয়েছ, আর নয়। এবার ‘বশীর চাষী’ খেতাব পাওয়াতে আর কোনো ঘাটতি থাকল না। নানা হাওলাদার সৈয়দ বংশে বিয়ে দিলেন, বেঁচে থাকলে এই চাষাড়ে চেহারার নাতিন জামাই দেখলে কেঁদে বুক ফাটিয়ে মরতেন।” ছেলেমেয়েরা বলে, “বাজান তোমার বড় দাদা সৈয়দ ইয়াসীন আলী খোদ আরব থেকে সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বামনির চরে নামলেন আর এখানকার মানুষের ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে নিজ দেশে ফেরৎ যান নি। চিরকালের জন্য থেকে গেলেন। চরের মানুষদের সাথে ধর্ম শিক্ষা, নামায, রোজা নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। তুমি যে তাঁর বংশধর, একথা কেউ বিশ্বাসই করবে না। বলবে, গল্প বানিয়েছ। পূর্ব পুরুষদের সম্মান নষ্ট করা কি তোমার উচিৎ? গায়ের বনেদি রং আর বংশকে বিপাকে ফেলে দিতে তোমার এত সাধ কেন? তোমার সুন্দর আর বনেদী চেহারার কোনো একটা ছবিও রাখনি। কিন্তু আমাদের শিক্ষা দেয়ার জন্য প্রাণপণ খেটে শরীর কালি করছ।”

আপন মনে বশীর ভাবলেন, “ওদের মন খারাপ কেন? কেবল হারাবার ভয়? বংশ-রক্ত নিয়ে টানাটানির দুঃখ মন থেকে খুঁচিয়ে তোলা কেন? সাগরের পানিতে ভেসে থান জমিতে উঠে জায়গা পাওয়ার মত ভাগ্যও তো সবার হয়। না। বড় ছেলেটা লেখাপড়া করেই বা কী করছে? বাচ্চুর কাজের জন্য টাকা দেয়, বাড়ি উঠবে-পাকাবাড়ি, পলিটিক্স করে ভাই নাম করবে… কেবল চাই চাই।”

মাটির দাওয়ায় দু’খানা জলচৌকি রাখা, বশীর একখানা টেনে বসেন। আকাশে বিদ্যুৎ চমকানি আর মেঘের গুড়গুড় ডাক, বৃষ্টি নামবে কিনা? বাড়ির উঠান থেকে চোখ মেলে তাকান, নেহারকে খোঁজেন চারদিকে, কোথাও আটকা পড়ল? পড়ন্ত বেলায় তার তরিতরকারির ক্ষেতে ঢুঁ মেরে আসা ঝড়বৃষ্টিতেও বাধ মানে না, এত খাবে কে? ঘরে খানেওয়ালা ওরা দু’জন এখন। দুপুরের বেঁচে যাওয়া খাবার পড়ে থাক, তবু সে নতুন একটা রাঁধবেই। এই তো স্বভাব হচ্ছে দিন দিন।

অস্থিরতায় ছটফট করছিলেন বশীর। আবার গুড়গুড় শব্দ ওঠে আকাশে। একটু পরেই আকাশ ভাঙা বাজ পড়ল, মনে হল খুব কাজেই কিছু ঘটেছে। উদ্ভ্রান্ত বশীর চোখের সামনে দেখতে পেল জোড়া তাল গাছ। তারই আশেপাশে কতক তালের চারা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বাতাসে ঝাপটা খেয়ে সেগুলি টালমাটাল, ওদিকে ধোঁয়া উঠছিল যেন। ওখানেই বাজ পড়ল কি? তালগাছে ভূত থাকে, গ্রামের মানুষ একথা বিশ্বাসও করে। কী জানি, ওখানটায় বাজ পড়লে ভূত কি মরবে? ওরা পালাবে, কিন্তু মেয়ে মানুষটা যদি ঐ দিকে যায়! হায় আল্লাহ্! একা আমি কি করতে পারি? বশীর তবুও বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছেন। কিন্তু তার গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা ঠিক যেন খেজুর কাঁটার মত বিধে যাচ্ছে। শীতের দিনের মত কাঁপুনি তুলে দিল যে।

আমার যে উভয় সংকট। যেতেও পারছি না, আবার ঘরেও ফিরে যেতে মন চায় না। নেহার, তোমার কি কোনো বিপদ হল? নাকি সখ করে মরতে বেরিয়েছ?

বশীর ফিরে এসে ঘরের মাটির দাওয়ায় উঠে যান। তিনিও যে সর্দি-কাশি আর জ্বর নিয়ে ক’দিন থেকে ভুগছেন। আজও ভিজলেন। হাত-পায়ের কাঁপুনি যে থামাতে পারছেন না। রসুন-তেল গরম করে মালিশ না করলে টিকতে পারবেন? এসব দরকার কাঁপুনি থামিয়ে নেয়ার জন্য। আসল চিকিৎসার জন্য ডাক্তার বন্ধুর রসিকতাটি এমন, “মাস্টার, তুমি তো ভাবীর নরম হাতের মালিশ পেয়ে বুঁদ হয়ে আছ। আসল চিকিৎসা না হলে নিউমোনিয়ায় পড়বে। বুকে কফ বসে যাওয়া খারাপ। ঢাকা চলে যাও না, ছেলের কাছে, বিরাট বাড়ি, ইউনিভার্সিটির প্রফেসার। ডাক্তার পাবে সহজে, স্পেশালিষ্ট দেখাবে।”

“আমার ছেলে বলতে যে আমিই লজ্জা পাই। কী গুণ আছে আমার! আমি তাকে নিজের শিক্ষায় চালাতে চেয়েছি, সে চায়নি। নিজের পড়া সে নিজেই চালিয়েছে, তার পরেও সমাজ-রীতি-নীতি মানল কই? বিয়ে করে শহরের উচ্চ স্তরে গিয়েছে, আমার গ্রামীণ শিক্ষা-সংস্কৃতির কি মূল্য আছে? নাই।” মনুষ্য সমাজের নিয়মই এই শ্রেণীর বিবিধ অস্তিত্বে তার সজাগ দৃষ্টি। তাই তারও ভয়, এই ছেলে নিয়ম অতিক্রম করে ভুগছে। সেখানে তার একার সমস্যা অনেক, বশীর সেখানে গিয়ে টিকতে পারেন না। গিয়ে একবার দেখেছেন, একদম আনফিট। মনে হয় ছেলেটার স্থানই নাই। তবে ছেলে সেই বশীরের, চলনে বলনে একটুও বদলায় নি।

বশীর অনুভব করেন, তার খুব কাহিল লাগছে। মাত্র কয়েকটা কাশি, তাতেই কাবু। মনেও ভয় আসে। মৃত্যু চিন্তা মাথায় ভর করে। একাকী বিড় বিড় করে কি বলছেন। বাড়ির মাটির দাওয়ায় তার মনে আধ্যাত্মবোধ এনে দেয়, “মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব, এ গৃহ আমার। অন্তরীক্ষে হাসেন তিনি, মূল মালিকানা যার।”

“ও বাজান, হুনেন না! কি কন আনুনে। গরু ‘হাম্বা হাম্বা ডাক দেয়। বারিষ অইতেছে, বিজি শুব শুব। (বৃষ্টিতে ভিজে গরু ডাক দিচ্ছে) গোয়ালে নিয়ে বেঁধে আসি!”

বাড়ির পালক মেয়ে আম্বুরি বশীর থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে দৌড়ে এল। “কি কথা কইছেন! গায়ে জ্বর। বুকে বেদনা করে। ডাক্তার ফিরিয়ে দেন কেন? মাজিকে দেখছি না, কোথায় গেছেন!” এমন সময় বাজ পড়ল, আম্বুরি কথা বলেই যাচ্ছিল। আর বশীর কাতর মুখে তাকায়, রাগ সুরে বলল-

—তোর কী তা বলার দরকার আছে! গরুটা গোয়ালে নিয়ে বেঁধে আয়। অবলা পশুকে আর বাইরে বাতাসে ফেলে রাখিস না।
— জ্বি না বাজান, এখনই যাই, আপনাকে চা দেব?
— তোৱ দিতে লাগবে না। কোথায় ছিলি সব?
—শ্বশুরের খানা-পিনা দিয়েছি, তিনি দেরী করে আসলেন, মা-ও দুপুরের ঘুম ভাঙলে রাগেন, কী আর করব!
— তোর এত কথা শুনতে চাইনা
বশীর গায়ের গামছা নিয়ে মুখ হাত মুছে নিলেন।

জীবনেও আম্বুরি এমন মন খারাপ কথা বাজানের মুখে শোনে নাই, তিনি আদর করেন, ঠাণ্ডা কথাবার্তায়। মা কোথায়? বাড়ির বিড়ালটাও মাটিতে পড়ে ঘুমায় এত। সবই যেন গণ্ডগোল। সে শুনতে পায় বাজান আবারও বিড়বিড় করে গাইছেন, ‘মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব, এ গৃহ আমার’, কিন্তু তিনি কেন থমকে গেলেন দরজার কাছে—ভিতরে ঢুকছেন না। বন্ধ দরজায় হাত রেখেছেন। আসলে কি খিল আঁটা? না, এটা তালা দেয়া। কিন্তু বশীর তখন স্মৃতির কবলে। কেউ তাকে চকচকে একটা চাবি হাতে দিতে আসছেন, আব্দুল করিম হাওলাদার নানা শ্বশুর, বলছেন সেই অতীতের সুন্দর কথাগুলি; বশীর, চাবি নাও, তোমারা দু’জনে কয়েকদিন বেড়াও, বিয়ে করিয়ে দিলাম তোমার সাথে আমার নাতনীর। সে আমাকে চুপি চুপি বলেছিল, নানাজী। ঐ ওকে ছাড়া আর কাউকে আমার সাথে বিয়ে দিতে পারবে না। দিলে গলায় দড়ি দেব। ঠিক, তিন সত্যি।

একটা আব্দার আমার প্রিয় নেহারের। নানা বলেছেন, ‘আমি পূরণ করতে পেরে খুব খুশি। ইংলিশ কায়দায় তোমাদের আমি চরের বাড়ি থেকে খামার বাড়িতে ‘হানিমুন’ করতে ছেড়ে দিলাম। পরে তোমাদের দু’জনের সুখের সংসার নিয়ে আবারও এসো। এটি নেহারের হলেও তুমি তার থেকে ভিন্ন নও। এক সূতায় গাঁথা হয়ে গিয়েছ।

কথাগুলি বুঝিবা জীবন্ত মানুষের মুখের, সামনা সামনি বলে যাচ্ছেন। বশীরের ভীষণ আনন্দ লাগে। শরীরে উত্তেজনা হয়, শীত আর লাগছে না। তিনি বর্তমানে ফিরে আসেন। বুঝতে পারেন, চিরন্তন সেই সত্য–সময় হল গতি। সময় থেমে থাকার জন্য নয়। এক এক জনের কাছে এক একটা পথ, যা উপলক্ষ ধরে আসে। এ পথ বহু দিকে, বহু নামে, নানান রূপে আসে।

এই যে বশীর সেখানটায় দাঁড়িয়ে হতবুদ্ধি, কোথায় তার ঘর, একলা হয়ে হাতিয়ে মরছেন, বুকের ব্যথা চিড়চিড় করে মাথায় উঠছিল। ছনের চালা আর মাটির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ফুটো বেয়ে বৃষ্টির পানিতে ভিজে সেটা বেড়ে উঠেছে। তবুও আনন্দ। বামনির চর, সেই উত্তাল সাগরে কেড়ে নেয়া তার বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ, সাগরে সাম্পান নিয়ে ছুটাছুটির জন্য আকুল করে না। ভয়ংকর শব্দ তুলে মাটির যে চাপ ভেঙে পড়েছিল, মনে আতংক তোলে না। সেই শীতকালে মাঠে তাঁবু খাঁটিয়ে যাত্রা পার্টিতে যোগ দেয়ার কথা বলে দিয়ে গেল যেন। সবই সময়ের ব্যবধানে ঘটেছিল। এখন অন্য উপলক্ষ করে এসে গেল প্রকৃতির খেয়াল। বৃষ্টি, ঝড় ওঠা, বাজপড়া নিয়ে স্ত্রীকে দেখতে না পেয়ে বশীর হল এক দামাল ছেলে, সেই বামনির চরের, তার হাতে ঘরের চাবি তুলে দিয়েছে অতীত সময়। তাই দরজায় হাত দিতেই হা হয়ে গেল, বশীর ঢুকে গেল।

ভিজে কাপড় ছাড়ছিল নেহার, চটপট সেসব সামলিয়ে চেঁচায়, কি অসভ্য নির্লজ্জ মানুষ তুমি। কি হয়েছে, লাফিয়ে লাফিয়ে কাছে এসে যাচ্ছ যে! পরনের কাপড় আমার গায়ের সাথে ভিজে লেপটে গিয়েছে।
তুমি দেখতে না পাও, তাই চুপি চুপি পিছন দিকের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলাম।
তোমার হয়েছেটা কি আজকে? যাও তো এখন। আমি কাপড় ছাড়ব, নামাজ পড়ব। হাবার মত চেয়ে থাকবে না, আমার শরম লাগে। ছিঃ ছিঃ।
কেন শরম লাগে?
ৱতা আমি তোমাকে বলতে পারব না, বুঝে নাও, সরে যাও।

বশীর এক পা ও সরে গেল না। তাদের অতীত আর বর্তমান, এই দীর্ঘ সময় এক বিন্দুতে এসে স্থির। তাদের হানিমুন করার এই ঘর, নানা তাকে ঢুকিয়ে দিয়ে উধাও হলেন, সেই স্মৃতির পথ ধরে বশীর নিষেধ মানে না। ভিজে শরীরের নেহারকে জড়িয়ে ধরে। উষ্ণ নিশ্বাসে ফিসফিস করে বলে, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? আচ্ছা কথা তো। যেখানেই যাই, এই এলাম যে, তোমার কাছেই আছি। কুৎসিৎ কোনো কাজ করে আসি নি। তুমি সর, শুকনা কাপড় পরি তারপর কথা। ভিজে কাপড় থাক্ না। আমার শীত করছে। আমি গরম আছি, নেহার। তোমার জ্বর। গায়ের ফতুয়া ভিজিয়েছ। যাও বদলে নাও। চারিদিকে কেউ নেই । বৃষ্টি ভেজা বিকেল বেলা। প্রকৃতি আপন-বিভায় নিজেকে রাঙিয়েছে নেহার। এই সময় বড় দুর্লভ। এ আমি ছাড়ছি না। তুমি আমি, দু’জনায় অনেকদিন পর ভিজলাম। আস্তে আস্তে করে নেহার বলে, শুয়েই তো ছিলে, ঘর থেকে বেরিয়েছিলে কেন? ভাল করনি। তোমাকে নিয়েও আর পারি না। তোমার জানের জান ঐ মাটির দাওয়াতে বসতে এতই চাইবে, তবে সেটার মেরামতটা করাশু না কেন? নিজেও তো করতে পার। তোমার কিসের অভাব, কত মানুষকে খাটাতে পার। এ কাজ করাতে চাওনা কেন? বলছি কি শোন, ভিজে এসে তুমি এক ভূতে পাওয়া মানুষ, আর আমাকেও টেনে এনে ভূতি বানালে। ওদিকে বেলা যায় যায়, পড়ন্ত বিকেল। আকাশ মেঘকাটা, ঝকঝকে নীল বর্ণ, পুকুর ঘাটে বসে চা খাবে, আম্বুরি আসলে তখন তাকে নেহার বলে দিল। আছরের নামাজ পড়ে হাতের তসবী গলায় পরে নিয়েছে নেহার। মাজি আপনারে এখন কি যে ভাল লাগছে, ঠিক হিন্দুদের মা দূর্গার মতো। নেহার অবাক হয়। এ মেয়ে বলে কী? গোসল, নামাজ এগুলিতে নেহারের সুন্দর চেহারায় পবিত্রতা এসেছে ঠিকই। কিন্তু আম্বুরি যা বলল, ওর মন খুশি হয়নি। ‘মা ফাতেমা’ বলতে পারত। বোধ করি গলায় তসবী পরল তাই। সেটা খুলে নিয়ে বলে, এবার কী বলবি, মা ফাতেমা?
আম্বুরি সঙ্গে সঙ্গে মাথা নামিয়ে বলে, জ্বি মাজি। ‘মা ফাতেমা’ এই উদাহরণ এখন থেকে দেব। চায়ের সাথে কী দেব? ভাপা পিঠা আছে, দিই? মুড়ির মোয়াও আছে।
সব দে, ক্ষিধা পেয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজলে, বাজ পড়ার শব্দ শুনলে আমার পেটের ভাত হজম হয়ে যায়।

মাটির গড়া গোল বাটিতে বেশ কতক চা, গুড় আর ঘন দুধে মিশিয়ে খেতে বেশ পছন্দ বশীরের। ঘাটের সিমেন্ট অনেক কতক ক্ষয়া, কিন্তু এখানটায় বসে বিকেলের চা-এ বাড়িতে বেশ জমে। নারকেলের গাছের পাতার ঝিরঝিরে বাতাস, লেবু গাছের সাদা ফুলের গন্ধ, আর পুকুরের শান্ত পানিতে হাঁসের ঝাঁক চরে বেড়ায়, কখনও ডাকে। পুকুরে শাপলা ফুলও ফুটে থাকে।

বশীর চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, তোমার মনে পড়ে নেহার, সেই যে লাতু কোথা থেকে পদ্ম ফুলের লতা এনে পুকুরে লাগিয়েছিল! ফুল ফুটল যেদিন, ছেলের খুশি কী! তারপর ঐ কেউ যেন না ছিঁড়ে ফেলে তার জন্য কত পাহারা দেয়া। কোথায়ও নড়ত না লাতু।

মনে থাকবে না আবার? লতাগাছটা মরে গেল কেন! সেজন্য লাতুর উঠানে গড়িয়ে গড়িয়ে কান্না । উঠান ভর্তি কত নোংরা গায়ে মাখলো, হাঁসমুরগী-কবুতরের গু… আমি নারকেলের পাতার শলার ঝাড় দিয়ে পিটিয়ে তবে তুলি। তুমি আমাকে একটুও বকলে না, ছেলেকে আদর করে বলেছিলে, মা মারলে আল্লাহ্ দোষ ধরেন না। বরং উপকার করেছে বলে ধরে নেন সকলে। আসলে, একটা লতাগাছের পদ্ম ফুল-এর জন্য ছেলে এত কাঁদছে কেন, এত গড়িয়ে গড়িয়ে এমন পাগলামী দেখে আমার ভয় হচ্ছিল, পাগল নাকি?

আচ্ছা, ওকে সোনা-রূপা ছোঁয়ান পানি দিয়ে এত ঘষে ঘষে গোসল দিয়েছ কেন? আজও আমি বুঝলাম না। চায়ের বাটির শেষ অংশটুকু মুখে দিয়ে বশীর স্ত্রীর কাছে প্রশ্ন রাখে।

নেহারও হাসে। বলে, আমিও জানি না। কিন্তু শুনেছি তাতে ওর গায়ে যে উঠানের ময়লা লেগেছিল এগুলি সাবানে যায় না। সোনা-রুপার রঙে সাফ হয় ভাল। চামড়াতে রোগ হবে না। চরের মায়েরা এটা করত, আমার মা আমাকে সোনা-রূপার গহনা চুবিয়ে সে পানিতে গোসল দিতেন। এরমধ্যে আম্বুরি বলে, মাজি, আমার ছেলে আক্কাস ঐ রকম মাটিতে গড়ায়। ওকে গোসল দিতে সোনা-রূপা কোথায় পাব? আপনার আছে, দেবেন? থাকলে দিতাম। পানিতে সব নিয়ে গেল রে আম্বুরি। সাথে করে কিছু আনতে পেরেও রাখতে পারিনি। সংসার চালাই কী দিয়ে, স্যাঁকরার দোকানে বন্ধক দিয়েছিলাম, সেসব তোলা হয়নি, সুদে-আসলে টাকা দ্বিগুণ, দুঃখ করি না,
আমিও তোদের মতো। এ যুগে সোনা-রূপার দরকারও হবে না। গায়ে মাখা সাবান কিনে নিস। তোর ছেলেটা কোথায়, দেখছি না যে।

ওকে খুঁজতেই এদিকে এসেছিলাম। কোথায় আর যাবে বাপের লগ্ ধরে হাটে গিয়েছে। আজ হাট বার তো মাজি… চাচা ধান নিয়ে গেল যে-দুপুরে। নেহার হাসে। বলে, মেয়ে হলে ভাল, মায়ের লগ্ ধরত। তুই যেমন মায়ের লগ্ ধরে আমাদের বাড়িতে আসলি।

চায়ের পর পান মুখে পুরে নেহার হাসছিল। চুন-খয়ের আর দোক্তা দিয়ে পানের রসে তার ঠোঁট রাঙা। লাল রঙের মুক্তা বুঝি ঝরে পড়ছে সেখানে। নেহারকে এত খুশি দেখায় নি কতদিন, বশীর সেটাই ভাবছেন। লেবু গাছের ডাল বাতাসে দুলছিল, কতকফুল তলায় লুটিয়ে পড়ল। তাও বুঝি সৃষ্টির এক অপরূপ খেলা। নেহারের মুখে সেই অনাদি রূপ।

কী রাঁধব আজ মাজি! দেখলাম কুলার মধ্যে লতির গোছা, তিতা করলা, বেগুন, শশা। কবুতর দিয়ে শশার ঝোল করে দিই। বৃষ্টির পর গরম তরকারি খেতে হয়। দু’টা বাচ্চা ধরে দেবেন, বাজান? মাকে দিয়ে আসি। কুটাবাছা মা ভাল পারে।

কী বললি আম্বুরি–গরম তরকারি? আজ আর গরম চাই না, মেলা গরম গেল। কিচ্ছু রাঁধিস না, দুধ-ভাত খাব। বলে নেহার হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ার মত হল। দাঁড়িয়েছে যেন নাচের ছন্দে। স্বামীর দিকে চোখ রেখে বলে, হাট থেকে কেউ যে ফিরে এল না। গরু-বাছুর একটু সামাল দিতে পারবে! আম্বুরি তুইও যা। তোর বাজান একা পারবে না। আমাকে পানের রসে ধরেছে একটু শুয়ে আসি।

বশীর এক পা ও সরে গেল না। তাদের অতীত আর বর্তমান, এই দীর্ঘ সময় এক বিন্দুতে এসে স্থির। তাদের হানিমুন করার এই ঘর, নানা তাকে ঢুকিয়ে দিয়ে উধাও হলেন, সেই স্মৃতির পথ ধরে বশীর নিষেধ মানে না। ভিজে শরীরের নেহারকে জড়িয়ে ধরে। উষ্ণ নিশ্বাসে ফিসফিস করে বলে, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? আচ্ছা কথা তো। যেখানেই যাই, এই এলাম যে, তোমার কাছেই আছি। কুৎসিৎ কোনো কাজ করে আসি নি। তুমি সর, শুকনা কাপড় পরি তারপর কথা। ভিজে কাপড় থাক্ না। আমার শীত করছে। আমি গরম আছি, নেহার। তোমার জ্বর। গায়ের ফতুয়া ভিজিয়েছ। যাও বদলে নাও। চারিদিকে কেউ নেই । বৃষ্টি ভেজা বিকেল বেলা। প্রকৃতি আপন-বিভায় নিজেকে রাঙিয়েছে নেহার। এই সময় বড় দুর্লভ। এ আমি ছাড়ছি না…

বশীরের চোখে সেই বামনির চরের কন্যা আজ নেহার। তার পায়ে ঘুংগুর বেজে চলেছে ছন্দে ছন্দে। ওর পরনে নীল রং তাঁতের শাড়ি। সায়াহ্নকে নীলচে করে দিয়েছে। পায়ে কুমিল্লার নক্সা তোলা খড়ম। পরীর মত ও বাতাসে সুর তুলে বুঝি উড়ে গেল। ছেলে বিদেশ থেকে ফুল পাতার শাড়ী, জুতা এনে দিয়েছে। পরে নি। তার লজ্জা করে। জোর করলে কষ্ট পায়। মুখ শুকনা দেখায়। কোনদিন বলে দেয়, কামকাজের মধ্যে থাকি, অসুবিধা লাগে, গা কুটকুট করে। আমি কি এগুলি আনতে বলেছি; আমি চরের মেয়ে, খাট, মোটা কাপড়ে চলতে ফিরতে অভ্যাস। আমাকে জ্বালিও না। ভাল লাগে না। বড় ছেলে লাতু কিছু বুঝতে চায় না। বলে, “একটু পরেই দেখ। এতদূর থেকে মনে করে আনলাম মাজি….।”

‘এই যে পরলাম- দেখ, আমাকে কেমন লাগে বলে নেহার গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলবে-তুই আমার কাছে বসে থাক লাতু। মাকে দেখে চোখ জুড়াক, তারপর শাড়িটা খুলে আমি মাথার কাছে ঝুলিয়ে রাখব। দেখব আর বলব, আমার ছেলেটা আজও মাকে চিনল না। মায়ের সুখ-দুঃখের ভাগী হল না। তুই বড় হলি বাপ, আমি গর্ভধারিণী, সেটাই আমার সুখ-আনন্দ, বেচে থাক দোয়া করি।’

স্ত্রী চলে যাওয়ার পথে বশীর নিজের মনে এই নারীর অন্যরূপ নিয়ে একটু আনমনা হয়ে পড়েন। কাজের মেয়েটি চলে গেল সামনে থেকে। ছাগলটা এমন ডাকছে যে বাজান, আপনি দেখে যাবেন? আমি কিছু বুঝি না। আম্বুরি বলে। বশীরকে।

বশীর ওদিকে উঠে যান। বলেন, হাট থেকে মোস্তফার বাপ আসা পর্যন্ত এসব কাজ কে করবে? আমি আর তুই? চা খাইয়ে গা গরম করে দিলি আম্বুরি, আয় দু’জনে এদিকটা সামলাই। পশু-পাখিদের মুখে কথা না থাকলে কী, ওদের হাম্বা ডাক তো শুনেছি। কিন্তু তোর মা যে আবার এদিকে ঘুরে কি যেন বলছে। শোন কী বলে।
মা, আমাকে কিছু বলছেন? ওনাকে এই অবেলায় গরু-ছাগল টানতে ডাকলি কেন? দুপুরে ঘুমায়নি, দাওয়ায় বসে ভিজেছে আর একলা বসে থেকে মন খারাপ করেছে, তোদের কোন আক্কেল নাই, জ্ঞান-বুদ্ধি হল না। কাজ পাগল মানুষটাকে রেহাই দিবি না! কি আশ্চর্য! তুই একলা যা পারবি তা কর। সুরুজ একটু পরেই আসবে। জোয়ান ছেলে। এসেই চটপট সব সামলাবে। ওনাকে ঘাটে না বসে থেকে হাঁটাহাঁটি করতে বলছি। তুই তোর কাজ কর।

একটু থেমে পুনরায় বলে, আম্বুরি, তুই আজ কাজে যাস নাই? রাশু এখনও
– এলো না, কখন আসবে?
– বুজির আজ একটু দেরী হবে?
– কত দেরী? সবদিন দেখছি ওর দেরী হয়।
– আজ একটু বেশী হবে—পড়ছে, লিখছে ব্যস্ত আছে।
– কোথায় পড়ে? তোরা সবাই এক রকম চলবি?

মা, আপনি জানেন তো, বুজি আই. এ. পরীক্ষা দেবে। স্যার কাজ শেষ করে বসেন। বুজি ইংরাজি সাহিত্য পড়েন ওনার কাছে। স্যার খুব ভাল ইংরাজি জানেন…. অনেক লেখাপড়া জানা মানুষ। সুন্দর কথা বলেন।
আমি এর কিছুই জানি না। তোদের দেখছি হাত-পা গজিয়েছে।
আর না দাঁড়িয়ে নেহার ফিরে যান স্বামীর কাছে। বলেন, রাশু যে দেরী করে বাড়ি ফেরে, তা তুমি জান? কেন দেরী করে জান? বলেছে তোমাকে?
না, বলে নি। আমি কোনোদিন জানতে চাই নি।
যা কর নি. চাও নি, এখন থেকে তা করতে হবে। মেয়ে পাশ দিয়েছে, চাকরী করছে, গ্রামের কাজ করছে, এসব দেখিয়ে খুশি করবে-তা হবে না। এটা আমাদের সংসার, নদীভাঙা, কূলহারা লোকের। চাষবাসের কাজকর্ম করে তোমার চেহারা নষ্ট হল, তা নিয়ে কেবল দুঃখ করলে চলবে না। সেটার মর্যাদা ওদের দিতে হবে। মান-সম্মান একটা বড় জিনিস।

নেহার ডাকে আশ্বরিকে, তুই এখন বাড়ি যেতে চাস? গেলে চলে যা। তোর মা হল শাশুড়ি আর শ্বশুর হল সৎ বাপ, ওদের খেদমত তোর কাছে বড়। আমার সংসারে তোর দরকার নাই। আমি সকলের ভাল চাই। হ্যায়, মনে রাখিস।

ধুপধাপ পা ফেলে নেহার রসুই ঘরের দিকে যেতে গিয়ে থামে। মুখ ঘুরিয়ে বলে, রাশেদাকে বলবি, এ রকম দেরী করে আসলে ওর আর আসার দরকার কি! না আসলেই হবে। আমার এসব জানারও দরকার থাকবে না।

মায়ের বকুনিতে আম্বুরির কোনো রাগ হয় না। উল্টা সে ভাল পায়, ভালবাসে বলেই তো বকে। ওর জীবনকে তিনি বলতে গেলে পাঁক থেকে টেনে ধুয়ে মুছে দাঁড় করে দিলেন। ওর মনের মানুষটি ধরে সংসার করা-ও ধরিয়ে দিয়েছেন। এমন মানুষের লাথি ঝাঁটা খেতে কোনোরকমের কষ্ট আসে না। কিন্তু মাজির মাত্র এই একটু রাগারাগি, মারধোর তো না-ই। আম্বুরির কোন অভিযোগ নেই। সোনামুখ করে শুনে গিয়েছে।

পুকুর ঘাটে একটু বসে উঠে এল বশীর। বাড়িতে লোকজন না থাকলে কি করা তার? গরুর সেবা করার জন্য আম্বুরির কাছে দাঁড়ান, বললেন, এটার গা ধুইয়ে দিই আয়, এক বালতি পানি, কল টিপে নিয়ে আয়। আমি বদনাতে করে ঢালি, তুই একটুকরা চট নিয়ে ঘষে দিবি। কোথা থেকে এত মাটি কাদা মেখেছে?
বৃষ্টিতে এমন হয় বাজান, আপনি সরে দাঁড়ান, আমি যা পারি করে ফেলি। এখন কি দুধ দুইবেন? দুইলে ভাল হয়।
কেন? সকালের দুধ কি হল?
বিড়ালটা খেয়ে নিয়েছে। দেখলাম কড়াই খালি। একেবারে চেটেপুটে খেল রাক্ষসটা। আমি লাঠি তুলে তাড়াতে যাব, তাও কি পারি? ওটার ভয় ডর নাই, চোখ তুলে তাকিয়েছিল একবার।
তা না করলে বোধ হয় বিড়ালটা আধপেটা থাকত। খেয়েছে ভাল করেছে। তা তুই একটা হাঁড়ি নিয়ে আয়, দুধ যা পারি বের করি। আমি একাজ আজকাল করি না, ছেড়ে দিয়েছি।

উঠানে মাচাং দেয়া আছে, ওতে হাঁড়ি-পাতিল শুকান হয়। আম্বুরি বেছে নিল রূপা রঙের একটা পাত্র। বাছুর আলগা করে খুঁটিতে বাঁধে। বশীর আগে এক সের দুধ টেনে বের করে নিয়ে বাছুর ছেড়ে দিতে ইশারা দেন, আম্বুরি বাছুর ছাড়তেই সেটাকে মায়ের দুধ পান করতে লাগিয়ে দেন বশীর।

আপনি এখানে কী করেন স্যার, বলে মোস্তাফার বাপ হাঁক দেয়। ধানের দাম আজ ভাল ছিল। সব কিনে নিয়ে গেল আড়তদার। মোটে দু’মন ধান নিয়ে গেলাম। পঞ্চাশ টাকা নগদ ।

বশীর হাসেন। বলেন, ধান হল লাল বিরই। সার দিয়েছিলাম, ঘরে পালা গরুর গোবর থেকে তৈরী। দাম বেশী হল কেমন করে? টাকাটা নগদ পেয়ে যা একটু সুবিধা আসে একজন কৃষকের। আজ আমার নগদ পাওয়ার ভাগ্যের দিন। তোমার ভাবীকে খবরটা দিয়ে খুশি করে আস এখন। তিনি আমাদের উপর গোস্বা হয়ে আছেন।
স্যার মাফ করবেন, সেটি পারব না। আপনি চল্লিশ টাকা রাখেন। বাকি দশ টাকায় কিনলাম; গমের আটা, দশ সের।
তুই থাম। আমার মাথা গরম করিস না। আশ্বরিকে বুঝিয়ে দে, ও গুড়িয়ে তুলতে পারবে। সুরুজ আসল না কেন। ওর ছেলেটাও তো সাথে গেল, আম্বুরিকে না জানিয়ে ছেলে নিয়ে গিয়ে সে কাজটা ভাল করেনি। মায়ের মন কত অস্থির থাকে, একথা জানতে হয়, মানতে হয় ছেলের বাপের।

বাজান ঠিক কথা বলেন, কিন্তু এত নরম কথা দেখলাম কেউ এখন শুনতে চায় না। উচিৎ শিক্ষা দেয়া লাগে। আমিও আজকে ওদের ঘরে যাব না। মাজির কাছে থেকে যাব। আর বকবক করব না, বাজান, আপনি একটু হাঁটাহাঁটি করেন, বিকাল বেলায় হাঁটা ভাল, ধান ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটলে বেশী ভাল। বশীর হাঁটতে গেলেন না। ঘাটে বসেছেন।

আম্বুরি তোকে এত শিখান মাস্টার স্যার? তোর বেশী বিদ্যার জোর। এটা ভাল না। তুই পাক ঘরে গিয়ে ভাবীকে দেখ। আমি গরু-ঘর ঠিক করে বাড়ি যাব, সেই সকালে বাড়ি ছেড়ে বাইরে, তোর চাচীর শরীরটা খারাপ।
চাচা, উনি ভাল আছেন, আমি দেখে এলাম, চিন্তা করবেন না। আপনাকে এক বাটি চা এনে দিই? হাত-পা ধুইয়ে ঘাটে বসেন। বাজানের সাথে হাটবাজারের কথা বলেন। তারপর হাঁটতে গেলে এক সঙ্গে আপনিও যাবেন। ধান ক্ষেতের দিকে নিলে বাজান ভাল হবেন।

আম্বুরি আস্তে করে পাক ঘরেও ঢুকে যায়। হাতে কাঁচা দুধের হাঁড়ি, তা চুলাতে বসিয়ে দিল। বলল, মাজি, দুধটা তাজা, এখনই দুইয়ে দিলেন বাজান আপনার জন্য। দুধ-ভাত খাবেন বলছিলেন।

তুই আর কিছু বলবি? লতি কুটা শেষ করে নেহার তখন শুটকী মাছ মিশিয়ে দিয়ে কাঠের খুন্ডি দিয়ে নাড়তে নাড়তে জিজ্ঞেস করল।

হ্যাঁ মা, আপনি উঠে একটু বাতাসে যান। আমার বাইরের কাজ শেষ। এখানে আমি একাই সব করে দেব। মন খারাপ করলে শরীর খারাপ হয়। মন খারাপ করার মত কিছু হয় নাই, রাশু বুজির মত মেয়ে আর কারও নাই, কেবল আপনারই আছে। আল্লাহ আপনাকেই দিয়েছেন। চিন্তা করবেন না।

নেহারের দুশ্চিন্তার কারণ এই ফকিরনীর মেয়ে কেমন করে বুঝে নিল। ওর ঘরে বড় হয়ে, তার মেয়ের কাছে থেকে এতখানি চালাক চতুর? এক আশ্চর্য কথা। নেহার মনে মনে আম্বুরিকে ক্ষমা করে দিল। এই মেয়ে থেকে রাশুর স্কুলে বাড়তি কাজ কর্মের একটা হদিসও পেতে সহজ হবে। মাস্টারী করার মানুষটা আসলে কোন সদিচ্ছায় রাশুকে পড়ায়? মেয়েটাও মায়ের কাছ থেকে কেন লুকিয়েছে? কোন কিছুতে বাড়াবাড়ি ভাল না। রাশুকে পড়াতে হলে ঐ গ্রাম উন্নয়ন সংস্থার কাজের মধ্যে কেন থাকতে হবে। আমার এত বড় বাড়ি, এখানে জায়গা মিলবে না?

মেয়ের মা হয়ে তার যত জ্বালা। ইয়া আল্লাহ্। আম্বুরির কথা শোনা না শোনার ভান করে নেহার বলল, তোর কিছু রাঁধনের কাজ নাই, দুধটা জ্বাল দিয়ে ঢেকে দে। তারপর ওর উপর কাঠের পিঁড়িটা তুলে চাপা দিস। বিড়ালটা বড় জ্বালাতন শুরু করেছে। এতগুলি দুধ কি খেতে পারছে, ফেলে নষ্ট করল! ওটাকে ঝাঁটা মেরে বিদায় করা দরকার।
বিড়াল নিজে বিদায় না হলে ওটা শত ঝাঁটার বাড়িতেও দূর হবে না। মা, আপনার আদরের পশুটাকে এখন ঘরে গেলে দেখবেন, ওটা আপনার বিছানায় কাঁথা টেনে আরামে ঘুম দিয়েছে।
বিড়ালকে পশু বলতে হয় না। হাঁড়ি থেকে একটু দুধ খেলে পশু হয় না। ও হচ্ছে নিরীহ প্রাণী, আমি আদর করে ওকে রেখেছি। পায়ে পায়ে হাঁটে, মিউমিউ ডাকে, শুনতে কত মায়া লাগে। আর পশু বলিস না। পুষি বলবি।
ভুল করছি। আর বলব না, নামাজের পানি তুলে দিব? আমার ছেলেটা কে একটু দোয়া করে দিবেন মাজি? ওটা কেবল দুষ্টুমি করে। স্কুল থেকে পালিয়ে যায়। নালিশ আসে ওর নামে। এখন আমাকে না বলে বাপের সঙ্গে চলে গেছে, বলেও গেল না। কথা শুনতেও চায় না, এমন ত্যাড়া।

বাচ্চাটাকে নিয়ে অনেক কথা বললি, বেশী শাসন করিস না। খারাপ। এদিকে রাশুকে দেখ, এখনও ঘরে ফেরে নি। মেয়ের জন্য চিন্তা, আমারও কম নয়, বলে, নেহার রসুই ঘর থেকে উঠানে নেমে আসে। আম্বুরি তার খড়ম জোড়া এগিয়ে দিল, জলচৌকি ও এক বদনা পানি ঠিক জায়গায় এনে রেখেছে। নেহার পশ্চিম আকাশের দিকে চোখ তুলে সূর্যের অবস্থান খুঁজতে থাকল। এখানে আজান শোনা যায় না, মসজিদ সেই কাছারির হাটে, দিঘীর পাড়ে।

রাশু স্কুল থেকে এসে গেল। তার বাপ এগিয়ে গেলে দু’জন কথা বলছে। পর সালওয়ার, কামিজ, মাথায় ওড়না, গলায় আর শরীরে ভাল করে জড়ান। এই মেয়েটাকে নেহার বোরকা পরতে বলে হয়রান, পরবে তো না, উল্টা তর্ক জুড়ে দেবে। বলে কি-না, “আল্লাহ্ মেয়েদের বোরকা পরতে বলে নাই। পর্দা করতে বলেছে, আমি সুন্দর করে গা ঢেকেছি, বেপর্দা তো হয়নি।” কী যে করি এই মেয়ে নিয়ে, নেহার দুশ্চিন্তায় মন ভারি করে।

সে দেখছিল রাত বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু কাছে এলো না। পুকুর ঘাটে বাপকে দেখে ওখানটায় সোজা চলে গিয়েছে। হাত নেড়ে চোখ বড় করে কী সব কথা বলে যাচ্ছে। এমনই করে মেয়েটা, কত কি বাপকে শুনিয়ে যাবে, শ্রোতা ভাল পায় বোধ করি।

মাগরেবের নামাজের সময় কম, দেরী করলে কাজা নামাজ হবে। নেহার খড়মে খটখট শব্দ তুলে ঘরের ভিতর চলে যায়। বাপ-বেটির কথা পরে শুনে। নিলে হবে, নামাজ কাজা করা খারাপ, নেহারের বিশ্বাস।

রাশুর কথার মধ্যে জানার আগ্রহ খুব বেশী। বশীরেরও মেয়েকে দেখে মনে হয় ওর চোখে মুখে এক বিস্ময়কর চাঞ্চল্য এসেছে। তিনি বললেন, তোকে চরের মেয়ে বা ‘চরুয়া’ যদি কেউ বলে তা ঠিক নয়। তোর জন্ম এখানে, এ বাড়িতে, মনোহরদি গ্রামে। ‘চরুয়া’ বলে আমাকে কেউ সম্বোধন করুক, কী গালি দিক, আমি সানন্দে তা মেনে নিব, খুশি হব। আমার হাতের এই পেশী মজবুত করেছি সাগরের স্রোতে সাম্পান বাইয়ে। জোয়ার আসার আগ মুহূর্তে বাঁধন কেটে সাম্পানের বৈঠা ধরেছি। মাথা উঁচু করে ঢেউ এসে আমাকে চুবিয়ে, টালমাটাল করে নাচিয়ে উন্মাদ করে ছাড়ত। কি দূরন্ত সাহসে হাল ধরে রেখেছি। ডুবেছি, ভেসে উঠে নাকে মুখে, চুলে পানির ছাঁট ঝেড়ে হেসে উঠেছি। বাপ ছিলেন না, দাদা পীর-আলেম। প্রচুর জায়গাজমি আছে। লোকজন, চাষবাস চলছে। তার মধ্যে দামাল ছেলে আমি ঐ দলে মিশে মাঠে কাজ করলাম, শীতে ধান কাটার গান গাইলাম।

বাপকে থামিয়ে দিল রাশু। বলে, ঈস্! আমি তোমাকে ঈর্ষা করছি বাজান। আমি তোমার মত চরুয়া হই নি কেন! বড় ভাই চরের বাতাস একটু হলেও গায়ে লাগিয়েছিল বলেই তার মধ্যে তোমার এত গুণ আছে। পুকুর পাড়ের কলাবাগানটা তোমরা দু’জনে কি খাটুনি দিয়ে করেছিলে। মাজি বলেন, তখন কলার কান্দি দেখে মানুষ পাকবার আগেই কিনে নিয়েছে। আগাম দাম হাড়ে তুলে দিয়েছে। নতুন জায়গায় আসার পর কত কষ্ট করতে হয়েছিল, এখন সব যেন গল্প করার মতো।

তা ঠিক, গল্প করার মতো। তবে শিক্ষণীয় বিষয় অবশ্যই। জীবনে শ্রমিক, মজুর হয়ে মন-দিল লাগিয়ে কাজ করার মধ্যে একটা আশা তো থাকে। লাতুরও ছিল, সে আর আমি কিন্তু এক আশা নিয়ে কাজ করিনি। আমার ইচ্ছে ছিল তোর মায়ের এই সম্পদকে ফুলে-ফলে ভরে দিতে। আর লাতু চেয়েছে এর মধ্য থেকে নিজেকে তৈরী করে নিতে। আমাদের মধ্যে এক জিনিস মিল, আমাদের গল্পে কোনো মালমশলা মিশান নাই, অতি সাধারণ মানুষ আমরা।
না বাজান! আমি পথের পাঁচালী পড়েছি, ভাইয়াকে এই বই-এর নায়ক অপু বলতে চাই, আর তোমাকে ওর বাবা ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, লেখক বিভূতি ভূষণ।

আমি পড়ি নি, জানি না, তাই তোর কথাতে খুশি হলাম। দুঃখ কষ্টে পড়ে মানুষ খাঁটি মানুষ হতে পারে। তাদের নিয়ে লেখার খোরাক পায় সাহিত্যিক। সাধারণ মানুষকে তুই অনেক বড় করে দেখলি, রাশু, বেশ ভাল লাগছে।

শোয়ার আগে নেহার মুখে পান-জর্দা নিয়ে একটু রসিয়ে কথা বলে, এটা তার একটা অভ্যাস। বশীর ভাবে, এটি তার বিনোদনমূলক কাজ। সারা দিনের কাজ-কারবার করে যত হয়রানি তাকে পুষিয়ে নেয়ার পথ।

পানের রসে দু’ঠোঁট রাঙিয়ে, রসটুকু গিলে নিয়ে চৌকিতে বসে নেহার। এক হাতে বিছানার চাদরটি টেনে পাট পাট করে যাচ্ছে। বলছে, আজ যে রাশু এসে সোজা তোমার কাছে যাবে, তা কিন্তু আমার মনে মনে জানা হয়ে গিয়েছিল।

বশীর একটু চমকায়। ব্যাপার কি? এ দুনিয়ায় কত রহস্য আছে যা মানুষের মনকে রহস্যাবৃত করতে পারে। অবাক তিনি, এ কেমন করে ঘটে, এক ষোল বছরের মেয়ে যৌবনে পা দিয়েছে, আর পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী এক মহিলা একই ঢঙে কথা বলে। ‘কত দেখলাম’ বলে নেহার ঠোঁট বেঁকিয়েছিল।

রাশু যে আমার কাছে যাবে তুমি জানতে?
না জেনে থাকলে বলতাম না এমন করে।

কী করে জানলে, ঘরের ছোট মেয়ে, স্কুল থেকে এসে খাবে, তোমার কাছে গিয়ে বলে, খেতে দাও, পেট চোঁ চোঁ করছে। আজ কি বাপের কাছে কবুতর ‘বাক বাকুম’ ডাক দিয়েছে?
না, মনের ডাক। আম্বুরি বলেছিল, তা শুনে মন বলছিল, আজ রাশু আমার কাছে আসবে না। সত্যি হয়েছে। মনে ডাকলে তা সত্য হয়।

বিস্ময়কর রহস্যের মতো এটি এক রহস্য নেহার। সত্য কিংবা অসত্য বলে এসব রহস্যকে হাতের মুঠাতে রাখা ঠিক নয়। তুমি আর তোমার ছোট মেয়ে, তোমাদের দু’জন কি করে এক হয়ে আমাকে বিস্মিত করলে সেটাই রহস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার কাছে। রাশু আজ ষোল বছরের। কী সুন্দর, বুদ্ধিদীপ্ত, কি আবেগ, উৎসাহ তার নিজেকে জানার। আমি অবাক হয়ে ওকে দেখেছি। এখন তোমাকেও দেখছি। তুমিও তাই নেহার।

কেমন দেখছ? বলো।
তুমি খুব রোগা হয়ে গেছ?

পানের রস গিলে নিয়ে নেহার মিষ্টি মিষ্টি হাসে। বলে তোমার চোখে ছানি পড়েছে, চোখে দেখছ না। সে কথা স্বীকার করো এবার। ছেলের কাছে এবার ধরে বেঁধে তোমাকে পাঠিয়ে দেব। এখানে থাকলে কথা শুনবে না। অন্ধ স্বামীর ঘর আমি করব না। যে দিকে এই দু’চোখ যায় সেখানে চলে যাব। নেহার আরেক খিলি পান মুখে পুরে চোখ পাকিয়ে আগের মতই কথা বলে বিছানায় উঠে বালিশ মাথার নীচে রাখে। বলে দোক্তায় ধরেছে, ঘুমাই এবার।

রাত নেমেছে। ঘুমের জন্য কাতর হয়ে থাকলে যদি ঘুম আসত তবে কথা ছিল না। অন্যদিন বিছানায় পড়লেই রাত ঘুমায়, আজ এপাশ ওপাশ করে, উপুড় হয়ে শুয়েও বিনিদ্র সে। কারণ ওর একটা লেখা।

‘প্রজেক্টে’র লেখাটা তুমি টু-দি পয়েন্ট লিখেছ, কোনো স্পেলিং মিস্টেক নেই।’ কেন বলেছিলেন শহীদ স্যার? সবার সামনে এমন করে কেউ বলে। ওকে এখন সকলে হিংসা করছে। উনি হলেন বাইরের লোক, শিক্ষা-উন্নয়ন সংস্থার এক বড় অফিসার। তাদের স্কুল উন্নয়ন প্রকল্পে নিয়েছেন তারা। এখন স্কুলের ভাল রেজাল্ট হওয়া চাই। ভাল ছাত্রী হয়েও বিপদ। স্যার ইংলিশ পরীক্ষা নিলেন ছাত্রীদের। আর রাশুকে খুঁজে পেলেন। ভাইয়া বাড়ি আসলে ও বই নিয়ে বসে, তাতে যা একটু ইংরাজি ভাষা লিখতেও পারছে। এ ছাড়া আর কী এত গুণ ওর? স্যার নিজের ইচ্ছায় তার কাজের উন্নতির আশায় ওকে নিয়েছেন, পড়াচ্ছেন। অবশ্য উনি খুব ভাল একজন শিক্ষকও। রাশুর নিজেরও যে পরীক্ষায় ভাল করার খুব ইচ্ছা। ভাইয়ার মত বড় হওয়ার জন্য কী যেন এক তাড়া ওর, মনের মধ্যে অস্থিরতা আনে। নিজেকে তৈরী করার সুযোগ পেয়ে ছাড়েনি। স্যার ডাকলেই পড়তে যায়। এর মধ্যে বন্ধুদের এত হিংসা। কেউ খোঁচাও মারে! বলে, চরুয়া ‘মাইয়ার’ চোখ কত উপরে। বামুন হয়ে চাঁদ ধরতে চায়, এমনি কত কী! স্কুলে কোচিং ক্লাসে সে যায় না। মাসে ত্রিশ টাকা দেয়ার কথাও ভাবতে পারে না। তাদের কাছে এটা অবাস্তব। ভাইয়ার টাকার কত প্রয়োজন, ওর পড়ায় বাড়তি খরচ চাইতেও লজ্জা। সে দু’টা সালোয়ার-কামিজ উল্টে পাল্টে পরে। অন্যরা নিত্য নতুন সেজে আসে। তবুও তার পিছনে এরা লাগে, হিংসায় জ্বলে।

মেয়ের ছটফটানির কিছুটা বাঁশের বেড়া ডিঙ্গিয়ে মায়ের কানেও গিয়ে পৌঁছে। নেহার উঠে এসে বলে, খাস্ নাই? উপাস শুলে এমন ছটফট লাগে। নিজে নিজেই তো ভাত খাস। আমি খাওয়াতে গেলে চিৎকার শুরু করবি। তোকে নিয়ে যত জ্বালা। আয়, তোর জন্য খাওয়া তোলাই আছে, আমি বসে খাওয়াই। কি সব অদ্ভুত কথা বলে যাচ্ছ! তুমি ঘুমাও না কেন? আমার উপর রাতে দিনে সব সময় চোখ মেলে রাখবে? আমার কিছু হয়নি। ভাল আছি। পেটে দানাপানিও পড়েছে। একটু ঘুম আসছিল, এসে জাগিয়ে দিলে। এবার শুতে যাও মাজি। আমি বড় হয়েছি, তোমাকে খাইয়ে দিতে হবে না।

রাশু বিরাট এক হাই তুলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। সে ভান করে ঘুম ঘুম চোখ করে জড়িয়ে মাঝে দু-একটা কথা বলে বিদায় দিলেই যে ভাল করত। উল্টা কতক খরখরে আবোল তাবোল কথা বলেছে। নিজের কষ্ট কি সে মায়ের উপর চাপিয়ে হালকা হতে চেয়েছে? কী স্বার্থপর মেয়ে রে, ওর দু’চোখ ভেঙ্গে এসে গেল। রাশু ঘুমিয়ে গেল। ওর সাড়াশব্দ আর পাওয়া গেল না।

সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে প্রথমে রাশু মায়ের খোঁজ করে। মা ওকে এত ভালবাসে। কিন্তু প্রতিদানে সে কি করল? কাল রাতের কথা মনে হতেই নিজেরই অবাক লাগে। মনও কেমন যেন মায়ের কাছে ছুটে যেতে চায়। পরে উকি দিতেই মা ওকে দেখে ডাকে, আয়, নাস্তা নিয়ে বসে আছি। তোর বাপও যাচ্ছে না। তোর স্কুলের জন্য টিকিনও ঠিক করে রাখা।

মাজি তোমার সাথে বসে খাব। নাস্তা সামনে রাখ, আমি মুখ ধুয়ে আসি। ঘুম ভাঙ্গতে দেরী হলে খারাপ। বাজান, তুমিও বসে কেন? শুরু কর। তোমাদের ছোট মেয়েটা একটা কুম্ভকর্ণ, সেটা জান না? আমাকে জাগালে না কেন?

রাশুর কথা তার মা-বাপ শুনতে চায়; ও যা বলে তা ওদের আনন্দের খোরাক। মনে হয় বেঁচে আছে ওর জন্যেই। সাত-আসমানের তারা থেকে যেন একটা তারা ছুটে এসেছে ওদের কাছে। ও ঘরে থাকলে বেঁচে থাকার অবলম্বন পায়। জীবনের দুঃখ-কষ্ট হাসি মুখে টানতে পারছে এমন লাগে।

বাড়ির কেয়ার টেকার আসল, তার নাম মোস্তফার বাপ। বাজান হাসেন, তাকে ছোট থাকতেই মা-বাপ এই নামে ডাকতে শুরু করেছিল। ছেলের বিয়ে হবে। প্রথম বাচ্চা ছেলে হবে। ভীষণ ইচ্ছা ছিল তাদের। আল্লাহর দোয়ায় তাদের ইচ্ছা পূরণ হয়। ছেলে হয়েছে এবং নাম রাখল মোস্তফা। ছেলেটা তিন চার বছর বয়স থেকে বাপের সাথে ঘুরতে চায়। বাড়ির ছেলেমেয়েরা ওকে আদর করে ডাকে মস্তান। চাচার পর এ বাড়ির দেখাশোনা করা সে এখন থেকেই শিখে নিচ্ছে।

কী খবর মোস্তফার বাপ! বসো, চা খাও ।
রিক্সা আনতে বলছিল ছোট মা। স্যার, দেরী করলে চলে যদি যায়। রিক্সা সহজে পাওয়া যায় না, সকাল বেলায়।
আচ্ছা বলে দিচ্ছি, তুমি তাহলে রিক্সা ধরে রাখ, একটু দেরী হবে। রাশু খেতে বসেছে। সারাদিনের খাওয়া বুঝলে কিনা, বলো।

মুখখানা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ঠোঁটে এক টুকরা হাসি তুলে মোস্তফার বাপ সদর দরজায় চলে যায়। মোস্তফা এখন বড় হয়েছে, নেহার ওকে মাদ্রাসায় পড়াবার খরচ যুগিয়ে যাচ্ছে। ছেলের গায়ে পাঞ্জাবী, মাথায় টুপি। এ বাড়ির ছোটখাট কাজ যেমন, ছাগলটাকে চরিয়ে আনা, হাঁস-মুরগীর খোয়াড় খুলে ওদের খাওয়া দেয়া, ছোট উঠান ঝাড় দেয়া এসব ওকে করতে কেউ বলে না। একটা মসজিদ করার ইচ্ছা আছে, সেখানে মাদ্রাসা খুলবে একে দিয়ে। বাড়ির কেউ আপত্তি তোলেনি। তারা যে যার মত নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আল্লাহ কাজ, কোনমতে হলেও খাড়া করবেন। সুতরাং মোস্তফার সমাদর স্থায়ী হয়ে গেল এ বাড়িতে।

সকালে এ বাড়ির মেজ ছেলে বাচ্চুর সঙ্গে অন্যদের তেমন দেখাদেখি হয়। না, যে যার মতো ব্যস্ত। সে বৌ এবং শিশু সন্তান নিয়ে আলাদা থাকে। সৈয়দ বাড়িতে পাকা বাড়ি তোলার পরিকল্পনার শুরুতে বাস করার মত একটা অংশ তৈরি করে খামার বাড়ি থেকে উঠে গিয়েছে সে। তবে বাচ্চু, ওরফে সৈয়দ তৌহিদ আলী কোথাও বের হওয়ার সময় বাপ-মা দু’জনকে কদমবুচি অর্থাৎ পা ধরে দু’হাতে মাথা নুইয়ে সালাম করে এবং পরে নিজ কপাল ছুইয়ে চুমু খায়। বাচ্চু খুব সম্মানের সঙ্গে এ কাজটি করে, ভুলে না। এখনও যখন তার দেখা নেই, তবে সে ঘরেই আছে। তার ছেলে নান্টু স্কুলে গেল কিনা বশীর একটু ভাবছেন। দেখা যাক, বৌ হাসিনা নিয়ে যেতেও পারে, না গেলে রাশু এখনও যায় নি। নান্টু নিজেই এসে বলবে, ছোট মা, আমায় নেবে?

মনোহরদি একটা উন্নত গ্রাম, নোয়াখালী সদর শহর মাইজদি কোর্ট হওয়ায় লেখাপড়ার দিকে বাসিন্দাদের উৎসাহ বেড়েছে। গরীব চাষা-মজুর বলে কেউ বাদ যাবে না। শিশুরা স্কুল যাবেই। এর জন্য বশীর অবশ্য উদোক্তা, পরিশ্রম করে মাটির ভিটে তুলেছেন, পুরান ভাঙা স্কুল নতুন করে দাড় করান। মাষ্টারী করলেন। আজও তাকে লোকে মাস্টার সাব বলে ডাকে।

বাড়ি থেকে যারা বাইরে যাওয়ার তারা চলে গিয়েছে, মোস্তফার বাপকে নিয়ে বশীর বাড়ির ভিতর খুঁটিনাটি কাজ করিয়ে নেন। গরুর দুধ দুইয়ে নেয়ার জন্য হারু গোয়ালা আসে। দু’টা বিদেশী গরু তাদের। সেবা-যত্ন ছাড়া এই গরু ভাল থাকে না, দুধও বেশী দেয় না। দুধ বিক্রির জন্য হারু নিয়ে যায় কাছারীর বাজারে, মিষ্টির দোকানে মালিক কিনে রাখে। সংসারে আয়ের একটা খুঁটি।

ইতিমধ্যে বশীর বাড়ির পুকুর ঘাটের ভাঙা সিঁড়িতে নেমে হাত-মুখ ধুয়ে নেন। পানির উপর বাতাস বয়ে যাওয়ার মিহি সুর, অলস ঝিমান পাতার মধ্যে হঠাৎ করে বাতাসের শির শির শব্দ উঠছে তা বশীর কান পেতে শোনেন। আবার কখনও বাড়ির পিছনে হাঁটাপথ ধরে ধানক্ষেতে গিয়ে তার চাষাবাসের তদারকি করে নেন। আবার রসুইর ঘরে। দুয়ারে এসে ডাকেন, নেহার কি করছ। দেখে যাও, পুকুরের পানিতে একটা বড় মাছ ঘাঁই মারল। জাল ফেলতে বলব নাকি। কখনও দুয়ারে মাটিতে ঠেস দিয়ে বসে, এক বাটি চায়ের আশায়। বৌয়ের পান রাঙা মুখের মিষ্টি কথা শোনেন। চা দেব না, ডাব আছে গাছে, পাড়িয়ে নাও। আমিও আসছি, পুকুর ঘাটে বসো। ডাবের পানি খাব। গরম পড়ছে বেশ। শরীর ঠাণ্ডা করার জন্য চা কেন? দুপুর হল। শাওন, ভাদর মাসের গরম বড় তাড়ান হয়।

বশীর এ বয়সেও বৌয়ের দিকে এক একদিন স্বপ্নাবিষ্টের মত দেখতে থাকে, শরতের সোনামুখি রোদের মতো ওর গায়ের রঙ। আগেও যেমন, এখনও এত কাজ, এত দুঃখ-কষ্ট নিয়েও নেহার এত সুন্দর! অবাক কথা। তাই নেহারকে এক এক সময় মহামায়া নামে তিনি ডাকেন। শুধু মায়া করে নয়, মায়ার জালে জড়িয়ে আটকে রাখেও সে। কোথাও গেলে মন টিকে না, এমন অবস্থা হয় তার।

কয়েক বছর আগের এক কথা, তামাসা হল যেন। তার বাড়িতে পায়রার খোপে বসে কবুতর বকম বকম ডেকে যাচ্ছিল, শিমুল গাছের শাখায় কাঠ ঠোকরা এক ঘেয়ে ঠক ঠক শব্দ করছিল। বশীর অনুভব করে– উষ্ণ বাতাস সর সর করে তাকে টেনে নিয়ে গেল বড় ছেলের কাছে। এই ছেলেতে তিনি কেন। যেন নিজের প্রতিবিম্ব দেখেন। ওর সাথে রেল গাড়ি চড়ে ঢাকায় এলেন। ছেলে নিজ হাতে বাপকে শার্ট পরিয়েছে, লুঙ্গি গোছ করে গুটিয়ে পায়জামা পরিয়েছে, তিনি খুশি মনে সেজেছেন। ঢাকা পৌঁছে ট্যাক্সিতে করে ছেলে তার বাড়িতে নিয়েছে। সাজান একটা বাড়ি।

লোকজন তাকে দেখছিল, তার লজ্জা লাগছিল! সেটা বলার মতো নয়। বাজান, কেমন লাগছে। ওরা তোমাকে সালাম দিচ্ছে, আমার বাপ বলে চিনতে পেরে খুশি ওরা। এখানে এরা কাজ করে। ওদেরকে কিছু বলবে?

আমাকে ওরা ওরকম করে দেখছে কেন? চিড়িয়া সেজে এলাম? ওদের কি বলব? বুক কাঁপছে। লাতু হেসে বলেছিল- ঠিক আছে ঘরে নিয়ে যাই, চল। তোমার নাতনী পারুলকে দেখবে, তবে ওর মা ডাকে ‘ডায়না’। তুমি পারুল নাম ভালবাস, তাই না বাজান? ছেলেকে চাঁপা ডাকি, তোমার সখ ছিল। আমাকে মাঝে মাঝে চাঁপা ডাকতে। দেখবে ওকে, এক বছর বয়স।

বৌমা আমার সামনে আসবে না?
আসবে, তোমাকে অনেক শ্রদ্ধা করে, ভাল মানুষ বলে। আনু, এদিকে আসো আনু, বাজানকে সালাম করো।

বৌমা বাড়ি ছিল না। ওকে দেখিনি, ছেলে বলে, ‘তুমি আমার পাশের ঘরেই থাকবে। একটা ছেলে তোমার সব কাজকর্ম করবে, তোমার যা দরকার ওকে বলবে।’ রাতটুকু কোনমতে আধা ঘুম নিয়ে কাটল, কিন্তু সকালে লাতু কাজে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে দেখা করতে এসে সবে দাঁড়াল। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমার কি যে কান্না! চোখ ভেঙ্গে পানি আসতে লাগল। কথাই মুখে আসছিল না। ঠক ঠক করে কাঁপছিলাম। ছেলেটা শেষে নিজের ভুল বুঝল, বলে দিল। কি যে ভুল করেছি বাজান, তোমাকে এখানে এনে কষ্ট দিলাম, আনন্দ দেয়া হল না। সারারাত জেগেছিলে বুঝেছি, ‘জলের মাছ ডাঙ্গায় তুলেছিলাম।’ অন্যায় করেছি, চল একটা ট্যাক্সি নিয়ে আবার দেশে ফিরিয়ে দিয়ে আসি। মায়ের কাছে গাঁয়ের পরিবেশে তুমি নিজেকে খুঁজে পাও, এখানে ভয়ে মর।” ওকে হেসে বলেছি, আমি এখন ‘আমড়া কাঠের ঢেঁকি? এই বাকবিধির অর্থ জানিস? অপদার্থ।

বোধ করি ছেলে চমকে উঠে, বাপ কি তার কথায় দুঃখ পেলেন? তক্ষুণি সে জড়িয়ে ধরে বাপের পা। বলে, বাজান, আমাকে মাফ করে দাও। তুমি এমন শব্দ মুখেও নিও না, কখনও না। তোমারই রক্ত আমার ধমনীতে প্রতিনিয়ত ধারণ করে বেঁচে আছি।

উঠো খোকা, আমার বুকে আয়, বুকের জ্বালা নিভাই। তুই দুঃখ দিনি, দুঃখ আমার নিজের। তোকে আমি খুশি করতে পারি নি। কত আশা করে বাপকে আনলি, আবার কাজকর্ম ফেলে ছুটছিস। রেখে আসবি আমাকে। বশীর অশ্রু মোছেন।
তুমি তো পান খাও না, মায়ের জন্য ‘বাবা জর্দা’, পান, খয়ের এসব কিনে চল বাজান। আমরা রওয়ানা দেব।

আমরা যতই পথ-প্রান্তর পেরিয়ে চলছিলাম, ততই মনে হতে লাগল এমন একটি পথ যাত্রার প্রয়োজন ছিল হয়ত। বাপ আর ছেলে এত কাছে আসতে পেরেছি।

বাড়িতে গাড়ির শব্দ কেউ শুনল না। লাতু নিজেই সদর দরজায় ধাক্কা দিয়েছে। নেহার ছুটে এসে হতভম্ব! তার হাসি মুখ। বলে, এমন হবে আমি জানতাম।

বশীর তারপর থেকে এই ঘটনাকে তুচ্ছ করতে পারে না। নিয়তি, বামনির চর সাগরের পানিতে বিলীন হয়েছে, নেহার তাকে এখানে তুলেছে, অন্য কোথায়কী করে বাস করবেন তিনি। সন্তান এখানে আসবে, বড় ছেলের কথাও তাই। ‘বাজান, আমরা তোমার কাছে আসবো, তাই ভাল।’

বিকেল হয়ে গেল, নান্টু স্কুল থেকে ফিরে দাদিকে বলে, ভীষণ খিদে, খেতে দাও। মা ঘরে নেই, আমি ওদের কাছে আর থাকব না। তোমাদের ঘরে খাব, থাকব।
কেন, তোর মা কোথায় গিয়েছে? আমাকে বলে যায় নি তো, এমনই করে। নান্টু তুই দেখেছিস—সকালে ওরা ঝগড়া করেছে? তোর মা বাপের বাড়ি চলে গেল। এই তো করে বৌ।
না, ঝগড়া করে নি, মা কেবল বলেছে, নান্টুর জন্য একটা মাস্টার রাখ না কেন? ও বৃত্তি পরীক্ষা দেবে, পড়াবার লোক কোথায়, তুমি বাড়িতেই থাক না। বাপী কী বলেছে শোনো।

‘আমার বাজান এ বাড়ির বড় মাস্টার, উনি পড়াবেন। আর কোনো মাস্টার লাগবে না।’ মা সেটা পাত্তাই দিল না। চোখ পাকিয়ে বলেছিল, এ যুগের পড়া অন্য রকম, মাস্টার রাখতে হবে। তাতেই বাপীর মাথা গরম, মাকে বলে গেট আউট। নান্টু তারপর বলে…. তারপর মা চলেই গেল। ঘর বন্ধ, তালা ঝুলছে। আমার মজা, আমি দাদুর সাথে থাকব, গল্প শুনব।
স্কুল থেকে কে আনল? শার্ট ভিজিয়েছিস কিসে, ঘামে? মাঠে খেলে এলি? সার্ট, প্যান্ট দু’টাই ধূলা মাখা। এখন পরবি কী? ঘর যে তালা দেয়া।
নান্টু একটানে দড়ি থেকে দাদার লুঙ্গি টেনে বলে, এটা পরছি, দেখ। দাদি মা, কেমন লাগছে? নান্টুর শুধু মাথাটা দেখা যাচ্ছে, আর সারা শরীর লুঙ্গিতে, একটা হাত বের করে বলে, ভাত দাও না! ডিম ভেজে দাও, বেশী করে ডাল দাও।
দাদা-দাদি, দু’জন খুব আনন্দে নান্টুর দিকে তাকান।

মুরগীর বুক আছে, রান আছে, ডিম ভাজতে চাই না নান্টু।
অনেক ভাত খাব, খেলে এলাম তো! বেশী করে দাও।
কী খেলা?
ফুটবল, স্কুলের টিমে আমি অন্য স্কুলকে গোল দিয়েছি, আমরা ভাল খেলি দা’জান।

নান্টু কথা শেষ করে দাদা আর দাদির দিকে তাকায়। তার বীরত্ব তাদের কতখানি খুশি করেছে, তা দেখতে চায়। স্কুলে সবাই ‘হিরো’ বলে তালি দিয়েছে। কিন্তু এরা আঁতকে উঠছে কেন? নান্টু বুঝতে পারে না, জোর দিয়ে আবারও বলে জান ‘আমি ভাল খেলেছি, আজকে’। তখনি দাদা দাদি একসাথে চেঁচায়, না-না ফুটবল খেলবে না তুমি, লক্ষ্মী ভাই আমাদের। তুমি ছাড়া আমাদের আর কে আছে। কথা শুনবে তুমি? বল, আমি ফুটবল খেলব না।

নান্টু কী বলবে বুঝতে পারছিল না।
না দাদু, আমি একবারও পড়ে যাইনি। মাঠে গড়াগড়ি খাইনি, সত্যি ভাল খেলেছি।
না, দাদু ভাই, সেজন্যে নয়, আমরা যে বড় দুঃখী, সে কথা তুমি জান না। আমাদের অতি প্রিয় একজনকে পরিবার থেকে হারিয়েছি। এই ফুটবল পাগল আমাদের ছোট ছেলে, তার নাম জাদুমন, আমি ‘জাদু’ ডাকি তাকে।

আমি হারব না দাদু, ফুটবল আমার প্রিয় খেলা। হাত-পায়ে ব্যথা একটু পেলেও পেতে পারি। কিন্তু হারব না। সত্যি বলছি, তিন সত্যি তোমাদের দুঃখ দেব না। মানুষ কি হারায়? সেটা হল—ছেলেধরায় পেলে। মা বলেছে, কেউ ডাকলে তাদের কাছে যাবি না। সোজা বাড়ি চলে আসবি। চিৎকার দিবি, লোকজন ডাকবি।

নেহার চোখ মোছে, বারবার। এই শিশু তাদের কষ্ট বুঝবে না। ওকে কি করে ফুটবল খেলা থেকে বাদ করা যায়—সেটাই চিন্তার বিষয় হবে এখন থেকে। এক গ্লাস দুধ খাইয়ে দিয়ে নেহার বলল, অনেক কথা হয়েছে ভাই, পরে আবার আমরা তোমাকে একটা গল্প বলব। এখন দাদুর সাথে যাও, শুয়ে থাক। আমি তোমার জামা-প্যান্ট ধুয়ে শুকাতে দেব। মা ঘরে ফিরে আসলে তবে তুমি অন্য কাপড় পাবে। যদি না আসে, স্কুল যাবে কী পরে?
তোমাদের অনেক দুঃখ-তাই না দাদি! আমি তাহলে কী করব? ফুটবল খেলতে মাঠে নামব না? ফুটবল খেলবেই না। গ্রামে অন্য খেলা কি কেউ খেলে না?
কিছু নাই। আমি জেঠুর মত পড়ব, জেঠুর ভাই-এর ছেলে, বিদেশ যাবো। তোমার জন্য পকেট ভরে টাকা দেব। আব্বুকে দেবই না, ওকে চাই না। ঠিক বলেছি তো দাদু।
পানের বাটা রেখে নেহার উঠে দাঁড়ায়, বলে নান্টু, তোর দাদুকে গল্প বলতে দে। আমি তোদের জন্য পিঠা বানিয়ে আনি। আজ চিতই পিঠা খাবি। শুয়ে গল্প শোন চুপটি করে, তোর দাদুর গল্প খুব মজার।
নান্টুর পরনে দাদুর লুঙ্গি, গলা পর্যন্ত ঢাকা, শুধু তার মাথা উদাম, সে মুখ উচিয়ে বলে, জানি।
বশীর বলেন, এ বাড়িতে কত গাছ, জঙ্গল, তবুও আমার আরও বেশী গাছ লাগাবার সখ। লাতুকে সাথে নিয়ে নতুন গাছ লাগিয়েছি। কোনদিন একটা গাছও কেটে ফেলে দিই নি। একদিন আমার অজান্তে একটা গাছ কাটা হয়েছিল। আর সেজন্যে কত কষ্ট পেল ছোট ছেলে তার গল্প শোন নান্টু, বড় আজব ঘটনা ।

আমাদের জাদুমনের সাথে একটা পথের ছেলে এসে জুটল একদিন, তার কেউ নেই। বাড়ির দরজায় ওকে দেখেই ডেকে নেয় জাদুমন। ডাকে, কালু, খেলবি আমার সাথে, জাম্বুরার ফুটবল। কী আশ্চর্য, ছেলেটা দৌড়ে এসে ধরে ফেলল জাম্বুরার (বাতাবী লেবু) বল।
ছেলেটা নোংরা ছিল না? ছোটকাকে তোমরা খেলতে দিলে? কই, আমাকে যে দাও না। জানি, আমাকে তোমরা একটুও ভালবাস না।

নান্টুকে জড়িয়ে ধরে দাদু বলেন, গল্প বলছি, কথা বললে ভুলে যাব। বুড়ো দাদুকে জ্বালাস না। তুমি বুড়ো হওনি। আব্বু বলেছে তোমার বয়স মোটে সাতান্ন। পঞ্চাশ পেরিয়ে সাত বছর যুক্ত হয়েছে। ষাট-পঁয়ষট্টি হও তারপর বুড়ো বলা যাবে। তুমি বয়স হলেও বুড়ো হবে না, আমি জানি।
উহ! নান্টু এত কথা বলছিস। আমি গল্পের আগামাথা এক করে দিতে পারি, তখন কী হবে! ‘বুড়ো’ বলে গালি দিবি?

নান্টু খিলখিল শব্দে হাসে। বলে, আর কথা বলব না। চুপ থাকব। বশীর বলতে শুরু করলেন, ঐ জাম্বুরা গাছটি একদিন ঝড়ে পড়ে গেল। আমাদের জাদুমনও ফুটবল খেলা বাড়িতে আর খেলে না, স্কুলে খেলে, তাও আর হল না। তোর ছোটকা কোথায় খেলতে গিয়ে আর ফিরে এল না বাড়ি। কালুর কি যে কষ্ট? আমাদের চেয়েও বেশী। সে খাওয়া ছেড়ে দিল আর বনে ঘুরে বেড়ায়, মনে করলাম ও আর থাকবে না, চলে যাবে। কিন্তু সে লুকিয়ে পুকুর ঘাটের পাশে একটা ছোট চারাগাছ দেখে সেটাকে পানি দিত সকাল বিকাল, আর চারাটা দিনে দিনে বড় হয়ে গেল। ছয়-সাত মাসে দিব্বি ডাল পালা ছড়িয়ে সুন্দর একটা গাছ হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গেল। বছর না ঘুরতে সেটার চেহারা মোটাসোটা এমন যেন শুপারী গাছের গুঁড়ি।

তারপর ওটা লম্বা একটা গাছ হল? ওটা কি জাম্বুরার গাছ?
নান্টু, তুই শিশু, তোর মনেও এ প্রশ্নঃ আমি ওখানটায় ভুল করেছি। গাছ, জাম্বুরার গাছ হলে রেখে দিতাম। তেঁতুল গাছ ঐ
ভুল কেন?
ওটা ছিল তেঁতুল জায়গায় বাড়ির উঠানে থাকা ভাল না। বিরাট হলে বাড়ির উঠান আঁধার করে।
দেবে। আরও একটা কথা, মোস্তফার বাপ বলে, স্যার, বাড়ির অন্দরে তেঁতুল গাছ কেউ রাখে না, ভয়ের জন্য। ভূত-পেত্নিরা বাস করে এই গাছে।
তারপর?

আমি হুকুম দিলাম। এটা কেটে ফেল, দেরী করবে না। তখন বুঝিনি, কি ভুল যে করলাম! এ গাছটা কেটে ফেলতে দেরী করলাম না। এটাই হল আমার মস্ত বড় ভুল। কালুকে দেখতাম, সে গাছটাকে বেশ যত্নে বড় করছিল। বাঁশের কঞ্চি কেটে চারদিকে বেড়া দিয়েছে, প্রতিদিন গাছে পানি দিচ্ছে। জাম্বুরা ফুল আসুক, ফল বড় হলেই তারা ফুটবল খেলবে। এরপর! চারা গাছটির টুকরা করা দেখে কালুর চোখ ফেটে কান্না নামে, থামে না। সে খায় না, কথা বলে না। এক সময় বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, দেখলাম না। ছোটকাকে খুঁজতে গেল, তাই না দাদু? জানি না, তবে সে জাদুমনাকে ভীষণ ভালবাসত, জানি। গাছটা না কাটলেই ভাল ছিল। ভূত-প্রেতের ভয় করলাম, না সেটাও নয়। তবে কেন? বুঝি নি, কালুর বিশ্বাস ছিল, গাছটার জীবন আছে। সেটা কাটা ভাল না। বড় হত। জাদু ভাই আসার সাথে তার একটা যোগ আছে। শিশুর মন ফেরেস্তার মত। নান্টু তার দাদুকে জড়িয়ে ধরল; ভয়ে। নেহার শেষের অংশ শুনে ভীষণ কষ্ট পায়। বলল, এমন গল্প আর কখনও বলবে না। ভুলে গিয়েছ সেই সব গল্প? সাগরে সাম্পান ভাসিয়ে ঢেউয়ে হাবুডুবু খেয়ে উঠে আসতে? নয় তো সেই একদিনের মাস্টারির গল্প! উকিল সাবের মেয়েকে অঙ্ক শিখিয়েছিলে আর সে বৃত্তিতে একশ নাম্বার পেয়ে ফার্স্ট হয়েছিল। পোদ্দারের মেয়ে আমার ছেলের বৌ বলে, কেন, নান্টুর জন্য মাস্টার রাখবে? বশীর মাস্টার এ তল্লাটের বড় মাস্টার, লাখ টাকা ঢাললেও তার মতো শিক্ষক মিলবে না। বশীর চুপ থাকেন। নাতিকে বুকে চেপে ধরে চুমু খান। কানে কানে বলেন, ভয় করিস না। আমি তো আছি নেহার রসুই ঘরের দিকে যায়ই। নান্টুকে কি খাওয়াবে আজকে, ওর মা ফেরে নি। নাতি, আগেই বলেছে, সে আর ও ঘরে বাপ-মায়ের কাছে যাবে না। দাদির হাতে নারকেল দুধের ঝোলে গোটা ডিম। সালুন খেতে চেয়েছে। সব কাজ ফেলে রেখে সন্ধ্যার পর রাত নামলেও করতে হবে। সে করবেই, অবুঝ মন তারও। বশীর কেবল আপন মনে হাসে। তারও ভাল লাগে।

ঘরে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে নামাজে বসেছে নেহার। রাশু তখনও ফেরে নি। বাড়ির সামনেও অন্ধকার, রাস্তার লাইট পোস্টে গ্রামীণ বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিজলী বাতির সংযোজ করিয়ে নিয়েছে বাচ্চু। সেখান থেকে তার টেনে নিজের ঘরে বাতি লাগিয়েছে। বশীর গান গায়, ‘সবার ঘরে বাতি, আমার ঘরে বাতি নাই রে, কেরসিনের আলো এটাই যে ভাল।’ নেহার স্বামীকে বলে, বাচ্চু বলছিল, মাজি একটু দেরী হবে, তোমাদের ঘরেও বাতি হবে। ছেলেটার মন অত স্বার্থপর না। সময় আর সুযোগ মতো সে করে দেবে। আমরা আশা করে থাকি না কেন! নেহার মুখে পান গুঁজে ধীরে দোক্তার রসটুকু গিলে নেয়। আকাশে তখন চাঁদ ছিল না। চারিদিক অন্ধকার, অমাবস্যার কাছাকাছি সময়টা। দুপুরে এক পশলা বৃষ্টির পর বিকাল ছিল ঝরঝরা, আলোতে ভরপুর, সন্ধ্যা নামতেই বাতাস উঠল তো রাস্তার বিজলী বাতির তার এলোমেলো করে দিলে, ঐ ঘরের বাতি বুঝি নিভে গেল। নেহার চিন্তায় পড়ে। ছেলে ফিরে আসলে আঁধারে কি করবে, বৌটাও তার ঘরে নেই। “আব্বু আসছে না কেন, রাত হল দাদি! মা-ও না, আমার ভাল লাগে না’ বলে প্যান প্যান করতে থাকে নান্টু। তার গায়ে এখনও দাদার লুঙ্গি জড়ান। সে তাই নিয়ে একবার টেনে তোলে আর ছেড়ে দিয়ে এ ধরনের খেলায় মেতে আছে। রাশু ওকে এমন অবস্থায় দেখে হো হো করে হেসে উঠল। কী হল, দিগম্বর কেন রে? কাপড়-জামা ভিজিয়েছ নাকি? মায়ের কাছে না গিয়ে লুকিয়েছ? যাও চলে, সং সেজে আর কতক্ষণ থাকবে। মায়ের কথা না শুনে চললে শাস্তি খেতে হয় নান্টু। নান্টুর কাঁদ কাঁদ গলা, ছোটফু মা বাবা তো বাড়ি আসেনি। ওদের ঘরে তালা। ওরা ভাল না, আমাকে ভালবাসে না। আমি ওদের কাছে আর যাব না। এখানে থাকব। আচ্ছা ছোট ফু, তুমি তালা খুলতে পারবে?

না, কেন? জামার জন্য। তোরটা এখনও শুকাল না? তবে, এভাবেই থাক। মাজি রাঁধতে গিয়েছেন। আমাদের খেতে হবে। যে মায়ের কাছে যাইরে নান্টু, তুই বাজানের সাথে গল্প কর। নান্টুর ছলছল চোখ। রাশুর খুব মায়া হচ্ছে! ভাই ভাবীর উপর ভীষণ রাগ উঠে গেল ওর। বলল, নান্টু তোকে আমি ভীষণ ভালবাসি, আর ঐ ঘরের দিকে তাকাবি না, যাবি না। এখন রাত না হলে তোর জন্য জামা, জুতা-প্যান্ট কিনে আনতাম। নতুন সব পরতে দিতাম। এই দেখ আমার টাকা আছে। আমি বৃত্তির টাকা পেয়েছি। কিন্তু আমের দোকানদাররা সন্ধ্যা হয়ে গেলে আর দোকান খোলা রাখে না। রাতে তারা কেবল খায়, ঘুমায়, গল্প করে।

দাদাজানের সাথে ঘুমাব, আমাকে খাইয়ে দাও ছোট ফু।
 না, নান্টু, এই চৌকিটা ছোট, তিনজনের শোয়ার জায়গা নাই। তুই আমার সাথে শুলে অনেক মজা পাবি। আমি গল্প বলব। ঠাকুরমার ঝুলি থেকে এক সাহসী রাজপুত্রের গল্প। তার একটা পঙ্খিরাজ ঘোড়া ছিল। ওটা সাত-সমুদ্র তের নদী পার হতে পারে। গল্পের মজা পেয়ে নান্টু ‘মায়ের কাছে শোব’ বলে কাঁদল না, তবে করুণ সুরে বলে, ফুফু, মাকে খুব মনে পড়ছে। আববু বকেছে তো, জান পালি দিয়ে গেট আউট বলেছে। মা কিছু বলেনি। আমাকে বলে, স্কুলে যাবি তো চল শিগ্‌গির। আমাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়েছে মা। কিন্তু আনতে যায় নি। আমি কতক্ষণ যে দাঁড়িয়ে আছি, মাঠে কতক দুষ্টু ছেলে এসে আমাকে ভ্যাঙচায়, ওরে খোকা আচ্ছা বোকা, মা কেন আসবে, তুই একা যেতে পারিস না? খেলতে আয় বলে আমাকে টেনে মাঠে নামায়, গায়ে পানি ছিটায়। আমার জামা-প্যান্ট, বই সব ভিজল, গায়ে ধুলামাটি লেগেছে। দাদি ধুয়ে দিল, এখন পরার কিছু নেই আমার…। আমি ঘুমাব, তোকেও ঘুমাতে হবে নান্টু। কাল একটা ব্যবস্থা করব, আমি তোকে স্কুলে নেব আনব। তুই কাঁদিস না। তুই তো ছোট না। ক্লাশ ফাইভের ছাত্র। এই কাঁথার মধ্যে ঘুম পাড়ানি গন্ধ আছে, শুঁকে নে, ঘুম আসবে। রাশু এবং নান্টুর ঘুম আসতে দেরী হয়নি। উভয়ে কাঁথা জড়িয়ে গভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছে। কোথায়ও কোন শব্দ নাই। সারা বাড়ি নিঝুম। বাড়ির দরজায় কুকুরটাও হেলে বসে আছে। ডাকছে না। গৃহকর্ত্রী জেগে কেবল এপাশ ওপাশ করছিল। তার মন ভার। বাড়ি এত নিঝুম কেন, কার এমন চক্রান্ত এ বাড়িটার উপর শুরু হল? একটার পর একটা ঝাপটা খেয়ে তার স্বামী বুক ব্যথার অসুখে পড়ল। ছোট ছেলে বাড়িতে এল না ফিরে, ওর সাথীরা সবাই খেলা দেখে বাড়ি এল জাদুমন এল না আজও। বড় দু-ভাই মিছামিছি গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করল, টাকা-পয়সা নিয়েও না। কী নিয়ে তর্কাতর্কি? অনেক দিন লাতু বাড়ি এল না। খুদু এ বাড়ি আসে না। ওকে ঠেলে দিয়েছি পানিতে। এ কি একটা বিয়ে? লজ্জায় ওকে কেউ দেখতে যাই না। বুক ফেটে যায়, এমন কপাল নিয়ে এলাম, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব কেউ নেই। কতক কর্মচারীর বোঝা নানা দিয়েছেন বাড়িটার সাথে। শেষ কি হবে না এই সব ভাগ্যচক্রের? বাচ্চুটাকে নিয়ে কোনমতে টিকে আছি। এই শান্তিও কেড়ে নেয়া কেন? কী করলাম হায় আল্লাহ্। নেহার ফুফিয়ে কেঁদে উঠল। বশীর জেগে যান। অবাক হন। স্ত্রীকে নরম সুরে ডাকেন। কাঁদ কেন? ছেলেটা বাড়ি ফেরে নিঃ না, আসবে কেন, রাগ তার কেমন, জান না? আমাদের সালাম না করে কোনদিন বাচ্চু বাড়ি থেকে বেরিয়েছে? না। আজ বেরিয়েছে, সবার উপর তার রাগ। বৌটা অন্য সময় কোথায়ও যেতে অন্তত ‘মা যাচ্ছি’ বলে যায়, আজ ওকে দেখিই নি। কখন গেল। তা কি করব। রাত ভর জেগে থাকলে কি উপায় একটা বের হবে? দোষ সব আমাদের, আমরা ছেলে মানুষ করতে পারি নি। খারাপ সঙ্গে পড়ে এই ছেলে স্কুল ফাঁকি দিয়েছে, পরীক্ষায় নকল করেছে, ঘর থেকে পালিয়েছে। তবুও ওকে আদর দিয়েছি। আমাদের গরীবি হাল, চাষাভূষা নিয়ে চলা ওর ভাল লাগে না। শ্বশুর বাড়ির টাকা পেয়ে কতক পথে এল। ভাঙা বাড়ি-ঘরের দিকে নজর দিয়েছে। বড় ভাইকে সোজা বলে দিল, আমি তোমাদের কাছে গেলে, বিদেশে বাস করলে, মা বাপকে দেখবে কে, বাড়ি-ঘর, জমি-জিরৎ কে দেখবে রাখবে। সৈয়দ বাড়িতে ঘুঘু চরবে?

থামবে? আমাকে আর কষ্ট দিও না। অন্যদিন বাচ্চু দোকান থেকে লোক পাঠাত। সে আসতে দেরী করে। আজ খবরও দেয়নি। ওর কোনো বিপদ হয়নি তো! শত্রুর কী অভাব আছে! অনেক। এ বয়সে কত কি কাজ করছে। সবই ভাল। সুনাম করল, বড় এই রাস্তা বানিয়ে দিয়ে। ওকে কেউ যদি…. নেহার বলতে গিয়ে কেঁদে দেয়। নানান বিপদের কথা মনে আসে, কান্নার বেগ তার বাড়তেই থাকে। নেহার, শোন, ওর কিছু হয় নি, আসতে দেরী করছে। তুমি জায়নামাজে বসে আল্লাহর দরবারে কাঁদ। ছেলে তোমার ফিরে আসবে। নেহার তখনি উঠে অজু বানিয়ে জায়নামাজে বসে। কেঁদে যাচ্ছে, দোয়া পড়ছে। অসহায় পিতা বালিশ বুকে চেপে শুয়ে থাকে। তার চোখ খড়ের মত খসখসে লাগে। কুকুরটি হঠাৎ ডেকে উঠল। নেহার তখন হাত তুলে মোনাজাত শুরু করেছে। তার চোখ থেকে ঝরঝর করে বেদনার অশ্রু নামছে। সে উঠল না। কিন্তু কানে আসে বিকট শব্দ? তা কে। দরজায় লাথি মারছে এত জোরে? হায় আল্লাহ্, বাচ্চুর মুখে যে অশ্রাব্য বুলি। কাকে বকছে? কী শরমের কথা বলছে বৌকে? হারামজাদি, ছিনালমাগি আমার ঘরে তালা মারি তুই ভাগলি। তোর শরীরের এত তেজ! চোত মারানির ঝি… আজ তোরে আমি দিলাম ছাড়ি। এক তালাক, দুই তালাক। নেহার কাঁপতে থাকে। কান্না থেমে গিয়েছে। দিশেহারা হয়ে স্বামীর কাছে আছড়ে পড়ে। এত ঘুম তোমার। বাইচ্ছা সর্বনাশের কাজ করে কিনা শোনেন। আমি কানে হাত দিলাম। হায় ছেলে মদ খেয়েছে! মদখোর সন্তান আমার। আল্লাহ্… নেহার মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বশীর সব শুনেছে। কিন্তু নেহার কি মূর্ছা গেল। ঘরে বাতি নেই, আঁধারে হাতড়ে স্ত্রীর চোখমুখ দেখে নিল। না, অসহ্য হওয়ায় পড়ে গিয়েছে। মাথা টলকে নেহার বিড়বিড় করে বলছে, হোলারে ধরি লই আইয়েন ইয়ানে।

মাইনসে হুনব। কাকপক্ষি জাগনের আগে এই কাজটা করি আয়েন। কাকপক্ষী যেন না শোনে। এই পাখির গলা কর্কশ, ডাক দিলে সারা দুনিয়া জাগি যাইব। ছেলেকে ধরে নিয়ে আসেন এখানে। ওর কথা মানুষে শুনবে। কাক ডাকবার আগে এই কাজটা করে আসেন। কাকের গলা কর্কশ, সারা দুনিয়া জেগে যাবে। বশীরের চোখ রক্তের মত লাল। উঠে বসে চেঁচান, ‘হু ইজ দ্যাট, মাই সান! সো- হোয়াট টু ডু লেট মি ডাই, মাই সুইট ওয়াইফ’ নিজের রক্তের কলঙ্ক, আমার বেঁচে থাকার স্বাদ কেড়ে নিয়েছে। লেট মি ডাই। আমি আগে ওর গলা টিপে ধরব, তারপর নিজেরটা। নেহার, ডোন্ট ক্রাই। ওদিকে সব নীরব। বাচ্চুর দরজা খোলা। ওর কাছে চাবি তো ছিল, এখন মনে পড়েছে। যাক…. দরজা বন্ধ করল সে। মনে হয় মাথা এখন ঠিক। আল্লাহর মেহের বাণী সত্যি কথা, নেহার। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। আমার রক্তে যে চন্ডালি রাগ তা টগবগ করে ফুটতে পারল না, সময়ে রক্ষা পেলাম। রাত তখন শেষ প্রহরে, ভোরের আলো আসতে দেরী আছে।

ছবি- লুবনা চর্চা

রওশন সালেহা

রওশন সালেহার জন্ম নোয়াখালী, ১৯২৯ সালী ১ জুলাই। বাবা ছিলেন আইনজীবী। কলকাতায় ম্যাট্রিক ও আইএ পড়েছেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের পরে বিএ পড়বার সময় দেশে ফিরে এসে শিক্ষকতা শুরু করেন। বৈরুতে আমেরিকান ইউনির্ভাসিটি থেকে শিক্ষা প্রশাসন (UNESCO), দিল্লী এবং ব্যাংকক থেকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে প্রশিক্ষন নিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের জনশিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকা থেকে ডিডিপিআই পদমর্যাদায় অবসর নেন। তাঁর প্রবল সাহিত্য অনুরাগের জন্য তিনি তাঁর সমকালীন বাংলাদেশের প্রধান প্রধান অনেক কবি সাহিত্যিকদের প্রায় সকলের সঙ্গেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর ‘আমার এক নদীর জীবন’ প্রকাশিত হবার পর আত্মজৈবনিক সাহিত্য তিনি শক্ত স্থান দখল করে নেন। ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত।

Share