গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৩)

ধারাবাহিক উপন্যাস

।। সম্বিত বসু ।।

 এ কাহিনীর নামে গোলাপী থাকতেই হতো, সে ‘ঝালাক এ গুলাবী মানজার’-ই হোক আর ‘গোলাপী দৃশ্য বারংবার’ই হোক। গোলাপ বলতে লাল বুঝলেও কোনো ভাবে সাদা মিশে তা গোলাপী হয়ে যায়। আবেগের রঙ গোলাপী, গোলাপী উন্মাদনা, গোলাপী আবির; বুড়ির মাথার পাকা চুল থেকে শুরু করে ঘুমের বড়ি, যাবতীয় সম্মোহনীতে গোলাপীর আভা।

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-৩)

“And humans are no fool  
Gravity happens to pull!”

ছেলেটা ছোট একটা টিলার ওপর বসে বাসি পাঁউরুটি আর কলা খাচ্ছে যদিও সে জানে না সে যা খাচ্ছে তাকে পাঁউরুটি আর কলা বলে। সে নাম না মনে রেখেই এরকমই যা পায় তাই খায়, মাটি জমা চুলে তেল মাখে, তেলচিটে ময়লা মাথা সাবান দিয়ে ধোয়ও কখনও-কখনও আয়া নদীর ঘাটে। তার চোখে লাল আছে, মাথায় উকুন, টাকার যত্ন না করেই সে টাকা জমায়, একটু পরেই সে ট্যাঁক থেকে খুচরো বার করে গোল করে পয়সাগুলো সাজিয়ে গুনবে কত হয়েছে। এ ওর রোজের কাজ, সময় হলে ব্ল্যাক জাপান আর তারপিন কিনবে আঙুলের ইশারাতে। দিনদয়াল, দিনদয়াল ভবসিয়া। সব পাগল পৌঁছোয় না পাগল-খানায়; রুখা-সুখা, ভুখা পাগল ছড়িয়ে আছে রাস্তায়, রাস্তায়। ‘রাখো তোমার ভালোগিরি, পয়া ছাড়ো দাও বিড়ি’— ভাবও পেরিয়ে গিয়ে দিনু যে ঠিক কোন পর্যায়ে আছে বলা মুশকিল কিন্তু পাগালপানের লাচাকে-মাচাকে রোজকার করা পুরোপুরি লোপ পায়নি। এখনও গুরচরণের হোটেলে ঝাঁটা হাতে দাঁড়ালে গুরুর দয়ায় দিনে পনেরো-বিশ টাকা কামিয়ে নেয়। গুরচরণ জানে ক’দিন পর আসা বন্ধ করে দেবে, কিন্তু ছেলেটা যখন কারো অনিষ্ট করে না, মন দিয়ে কাজ করে, আর কাজের দিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়েই আসে তখন তাকে বহাল করতে আপত্তি কিসের এই তারাসাং-দারাসাং-এর আজীব সার্কাসে? টাকা গোনার পর ঝোলা কাঁধে নিয়ে দিনু নদীর দিকে যায়। আয়া নদীর ধারে বসে। সে তার ঝোলা থেকে একটা করোটি বার করে পাশে রাখে। দু’পিস পাঁউরুটি বাঁচিয়ে রেখেছিল সে, সেগুলো টুকরো টুকরো করে কাকেদের খাওয়াতে লাগে। যারা নদীর ধার দিয়ে যাতায়াত করছে তারা দিনুর পাশ দিয়ে গেলেই সে তাদের দিকে খুলিটা বাড়িয়ে দেয়; কেউ বিরক্ত হয়ে সিঁটিয়ে যায়, আবার কেউ ইতস্তত করে অথবা সোৎসাহে থুতু দেয় সেই খুলিতে, তারপর তার দিকে একটা টাকা ছুঁড়ে দিয়ে যে যার মতো চলে যায়। নিরুত্তাপ দিনু সেই থুতু মাখিয়ে পালিশ করে খুলিটাকে, আবার কেউ এলে এগিয়ে দেয় খুলি। ঘন্টা দু-তিন বাদে যা টাকা তার সামনে পড়েছে তা তুলে নিয়ে খুলি ঝোলায় পুরে হাঁটা দেয় সেখান থেকে। ততক্ষণে কাকেরা সমস্ত রুটির টুকরো সাবাড় করে দিয়েছে, হেলদোলহীন আয়া নদীতে একই ছলাৎছল।

গুরচরণের হোটেলের কোনো নাম নেই। গলি দিয়ে ঢুকে দরজা, বাইরে সাইড করে টাঙানো সাইনবোর্ডের ‘হোটেল’ লেখাটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। হোটেলের অফিসে আজ দুই বুজুর্গ হামলা করেছে সকাল থেকে; পোয়া-পাত্তি চা দফায়-দফায়, চরসের ফরমাস, রাজীব আর জ্ঞানীর জ্ঞানের ঠেলায় গুরচরণের প্রাণ ওষ্ঠাগত, কিন্তু না পারছে তাদের মুখের ওপর কিছু বলতে, না পারছে কাজে বেরোতে। তিন দফা চরস খেয়ে মেজাজ শরিফ করে বুজুর্গরা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করছিল যে তারাসাং-দারাসাং স্রেফ ঢপে চলছে। তারাসাং-দারাসাং-এর নিজস্ব কী আছে কতগুলো আদ্দিকালের গাল-গল্প ছাড়া? কিছু একটা তো থাকতে হয় যা দিয়ে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে রাখা যায়; সেরকম তো কিছুই নেই এখানে। বর্ডারপার, পেট্রল পাম্প, হোটেল, ধাবা, জুয়ার ঠেক, এসবের কোনটা চাইলে করা যাবে না আসপাশের গ্রামগুলোয়? পেট্রল কি এখানে মাটি থেকে ওঠে নাকি? গাড়ির পিঠে চেপে যে পেট্রল আসে গাড়ির ট্যাঙ্কে করে সেটাই চলে যায়। যদি পেট্রল আসা বন্ধ হয়ে যায় কিছু করতে পারবে, মিনিমাম কিছু করতে পারবে গুরচরণরা? জ্ঞানী ছিলাম পরিষ্কার করতে করতে এই সব বুকনী ঝাড়ছিল আর রাজীব থম্ মেরে বসে মাঝে মাঝে টিপ্পুনী কাটছিল, “ইয়ে বাত লাখো মে এক হ্যায় জ্ঞানীভাই, অ্যায়সা কেয়া হ্যায় যিসে গার্ব কে সাথ হামলোগ আপনা ক্যাহে সাকে? আসলী-নাকলি কা মিলাওয়াট মে হামারা জিন্দেগি গুজার রাহা হ্যায়। নকলী নোট অর কিরায়া কা কফি মাসিনসে অর কিতনা দিন চালেগা? গুরচারাণ তুহি বোল আগার নাজদিকি গাঁও মে পাম্প ব্যাগায়রা চালু হো জায়েগা তো তু পহলে জ্যায়সা বিজনেস কার পায়েগা?” গুরু নিরুত্তর, সে সু্ঢ্ঢাগুলোকে বিদায় করতে পারলে বাঁচে কিন্তু জ্ঞ্যানীরা ওঠার নাম করে না। রাজীবের তালে চেগে গিয়ে জ্ঞানী বলতে থাকে, “ নোট গিনতি কা মাসিন দেখা গুরচারাণ, ভাগবান কা লাখ সুকার যো উয়ো আভি তাক তারাসাং মে নেহি আয়া। জিসদিন মার্কেটমেঁ উও মাসিন আ গায়া তো সামঝো নাকলী নোট কা কারোবার পুরিতারা খাতাম। বিলকুল দি এন্ড, হ্যায় কি নেহী?”  “সাহি কাহা জ্ঞ্যানী ভাই, আলোপী দেবী কি দায়া সে পলুসান মিটারভি আভিতাক চালু নাহি হুয়া। ভার্না কিতনা ভেকেল ব্যায়েঠ যাতা উষ্কা গিনতি কারনা মুশকিল হ্যায়…” এই সব হচ্ছিল গুরচরণের হোটেলের অফিসে, জানলা দিয়ে আসা তেরচা রোদে চরসের অলস ধোঁয়া এলিয়ে-বেলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল হাওয়ায়, মালানা ক্রিমের উগ্র-মধুর গন্ধ যেন আততায়ী ধূপ, দেয়ালে টাঙানো ফ্যাকাশে পোস্টারে শিশুর চোখে জল, শিশুর ঝাপসা দৃষ্টিতে নিছক টাইম-পাস, এরই মধ্যে চরম দোটানায় পড়েছে গুরচরণ, রাজীবদের মুখের ওপর চলে যেতে বলে পাম্পে যাবে নাকি এবেলা এই ফাঁকা হোটেলের অফিসে বসে দুই প্রত্নজীবের বাকতাম শুনবে আর বোঝার চেষ্টা করবে সত্তরের কোঠায় কেমন দেখায় হিমালয়ী গুজরান। ওরা সকাল-সকাল কাজ নিয়েই এসেছিল, অচল হওয়ার আগেই জমানো হাজার টাকার নোটগুলো পাল্টাতে, বিশ হাজারে উনিশ দিয়েছে গুরুচরণ, তাতে গুরুজনরা সন্তুষ্ট, সঙ্গে আবার চরস, চা আর আড্ডা ফাউ। মন্দ কি, চরসে মাথা আলগা করে সকাল-সকাল গুলতানী আর জ্ঞান দেওয়া? কিন্তু মেঘে মেঘে বেলা গড়িয়ে দ্বিপ্রহর, হন্তদন্ত হয়ে উদভ্রান্তের মত অফিসে দিনুর প্রবেশ। তাকে দেখেই রাজীবের ঠাট্টা পেলো, মুচকি হেসে বলে, “আরে পাধারিয়ে মাহারাজ। আপ খামোকা আনেকা তাকলিফ কিঁউ উঠায়ে, হামে বুলা লেতে তো আজাতে” তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে এবার জ্ঞানীর জোক মারার পালা, “ইধার আ দিনু। ব্যায়েঠ”, সোফা দেখিয়ে বসতে বললো, দিনদয়াল সোফায় না বসে মেঝেতে ধুপ করে বসে পড়লো। জ্ঞানী হেসে বলে, “তু পাগাল হ্যায় দিনু? তু পাগাল হ্যায় কেয়া? তু পাগাল নেহী সেয়ানা হ্যায়, পাগাললোগোকা তুঝ জায়সা রুপায়া কা লালাচ নেহি হোতা…কিতনা কামায়া আজ? পুরা শ?” গুরুচরণ আর এই ভাঁট সহ্য করতে না পেরে বলেই ফেলে যে এবার তাদের ওঠা হোক, তাকে পাম্পে যেতে হবে। দিনুকে বলে যদ্দিন কাজ করবি তদ্দিন দৈনিক কুড়ি টাকা, গাব্বারকে তাহলে কদিন কিচেনে লাগিয়ে দেবে, অনেক কাঠ জমেছে, কাটতে হবে। দিনু নীরবে সম্মতি জানায়। বেল বাজিয়ে গব্বরকে ডাকে গুরচরণকে। দিনুকে ন্যাতা-ফিনাইল দিতে বলে কাজ শুরুর আগে দিনুকে আচ্ছাসে সাবান মাখিয়ে চান করিয়ে দিতে বলে, যদিও সাফ সুতরা হয়েই সে এসেছে তবু ব্যাটা কোন্‌-কোন্‌ বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, মড়ার খুলিতে থুতু মাখায়, চান না করানোর প্রশ্নই ওঠে না। টুক-টাক কয়েকটা কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রাজদূতের রাজকীয় ভট্ভটে মহল্লা কাঁপিয়ে পেট্রল পাম্পে অভিমুখে মটর-সাইকেল হাঁকায় গুরচরণ।  পাম্পে গিয়ে দেখে সাইকিয়ার সঙ্গে এক দশাসই চেহারার মহিলার ঝগড়া লেগেছে। মহিলা সাড়ে বারোটার বাসে এসেছে বোধহয়। পুছতাছ করে গুরুচরণ জানতে পারে তার এক সঙ্গী বাস থেকে নেমেই বাথরুমে ঢুকেছে। সাইকিয়ার বক্তব্য, বাথরুম ইউজ করে করুক কিন্তু একবার অন্তত বলে তারপর যাবে তো। সে বারবার বলছে, “বহনজী ঠিক হ্যায় মগর একবার পার্মিশান লেনা চাহিয়ে থা” আর মহিলা চিৎকার করছে, “টাট্টি চাড়েগা তো আপনে বাপকো ভি না পহেচানোগে, বড়ে আয়ে পার্মিশান দেনেওয়ালা…” গুরুচরণ মিষ্টি কথায় ঝগড়া থামিয়ে দেয়, বলে, “সাইকিয়া তুম ভি। হামারা শহের কা মেহমান হ্যায়, মেহমান কে সাথ ইস তারা বার্তাও করতে হো! যাও, জালদিসে চায় লাও” নিজের হোটেলের কাস্টমার এই ভাবেই লোটে গুরু, বাথারুম থেকে একটা রুগ্নপানা মেয়ে বেরিয়ে এসে মহিলার হাত ধরে। এতদিন পরেও গুরুওচরণের চিনতে অসুবিধে হয় না যে এ ছেদীর মেয়ে সায়েরী। চিনতে পারলেও কিচ্ছুটি বলে না সে। সেলজাকে ভজিয়ে-ভাজিয়ে নিজের হোটেলে নিয়ে যায় ভাড়া করা ধ্যাড়ধ্যাড়ে অ্যাম্বাসাডরে (চার চাকা)। হোটেলে পৌঁছে সেলজাকে সে ঘর ভাড়া বুঝিয়ে দেয়, সব ঘরই এক রকম, কিন্তু গেস্টরা নিজে পরিস্কার করবে না হোটেলের লোক পরিস্কার করে দেবে ঘর সেই অনুযায়ী রেট দুরকম, বিন-সাফাই দুশো, সাফ-সুত্রা আড়াইশো। তারাসাং-এ ঢোকামাত্র সায়েরী চাঙ্গা হয়ে গেছে, মিচকি হেসে বারবার তাকাচ্ছে সে সেলজার দিকে। সাফ-সুত্রা ঘরে ঢুকে সেলজা জানলা খুলে, যগের থেকে দু গেলাস জল গড়াতে গড়াতে বলে যে আজ বিকেলে তারা বাজার যাবে, জামা-কাপড়, ব্যাগ, মাজন-ব্রাশ ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হবে, হ্যান্ড-ব্যাগ থেকে পেন আর এক টুকরো কাগজ খুঁজে বার করে সায়েরীকে দিয়ে কী কী কিনতে হবে তার ফর্দ বানাতে বলে। সায়েরী তার দিকে পেছন করে জানলার কার্নিসে কাগজটা রেখে লিস্ট বানিয়ে দুষ্টু-দুষ্টু, লাজুক-লাজুক, মুখ করে সেটা সেলজাকে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। সেলজা আলিঙ্গন বদ্ধ অবস্থায় বেকায়দায় সেই লিস্টে চোখ বোলাতে গিয়ে দেখে সেখানে চোখ-মুখ আঁকা দুটো ফুলের তলায় সায়েরীর বিদিগিচ্ছিরি হাতে লেখা: “ইলু! ইলু!” 

 এ কাহিনীর নামে গোলাপী থাকতেই হতো, সে ‘ঝালাক এ গুলাবী মানজার’-ই হোক আর ‘গোলাপী দৃশ্য বারংবার’ই হোক। গোলাপ বলতে লাল বুঝলেও কোনো ভাবে সাদা মিশে তা গোলাপী হয়ে যায়। আবেগের রঙ গোলাপী, গোলাপী উন্মাদনা, গোলাপী আবির; বুড়ির মাথার পাকা চুল থেকে শুরু করে ঘুমের বড়ি, যাবতীয় সম্মোহনীতে গোলাপীর আভা। রোজ লেডি সেলজা সুক্লা এই যে এখন আসাইলাম থেকে পালিয়ে শহরে না গিয়ে প্রফেশনাল এথিক্স-এর মাথা খেয়ে সায়েরীকে সমানে তাতিয়ে যাচ্ছে, এই একটু আগেই সায়েরীর হাতে একটা কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে সিগারেট আর চকলেট আনতে পাঠালো যে লাপারওয়াইতে তার রংও সেই গোলাপী। এখন সেলজা চুপটি করে বসে ভাবছে জিনিয়ার কথা, কত বার জিনিয়া তাকে বলেছে বদলানো সময়ের খবর রাখতে, সেই বদলের সঙ্গে নিজেকে বদলে নিয়ে চলতে, প্রাইভেট ক্লিনিক, প্রাইভেট প্র্যাকটিস, মেট্রপলিটনে ‘ওয়ার্ক হার্ড, পার্টি হার্ডার’, ‘ডেট টু মেট’ করেও নগর-ফকিরি, নগর-গালিবী, ‘হাজারো খোয়াইসে অ্যায়সি কে হার খোওয়াইস পে দাম নিকলে বহত নিকলে মেরে আরমা লেকিন ফির ভি কম নিকলে…’,  সেতু ভেঙে সাঁতার শেখা, ঘর ভেঙে পদ্য লেখা, দে মা পাগোল করে আমায় দে মা পাগোল করে। টান ওঠে সেলজার, অচেনা শহরের অচেনা অলি-গলি সে পায়ে হেঁটে চষতে চায়। কিন্তু সায়েরী এত দেরী করছে কেন? পালিয়ে বা হারিয়ে গেলো না তো? যাওয়ার আগে গা ছুঁয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার দিব্যি করিয়ে নেওয়া উচিত ছিল? এই তো টেবেলে তার ইতস্তত ‘ইলু ইলু’ আর এর মধ্যেই সব ভুলে ধাঁ! সেলজা টেনশানে সায়েরীকে খুঁজতে বেরবে বলে সবে ঠিক করেছে, অমনি সায়েরী হাজির ‘গোল্ড ফ্লেক লাইটস্’ আর ‘আমুল’ চকোলেট নিয়ে। ঘরে ঢুকেই আবদার, “বহুত জোর সে ভুখ লাগা হ্যায় দিদি, লাঞ্চ-টাইম কাবকা হো চুকা! লাঞ্চ-টাইম শুনেই সেলজার গতকাল এই সময় সিমলা ভিলার লফড়ার কথা মনে পড়ায় সে কিঞ্চিত উত্তেজিত হয়ে পড়ে। গতকালের ঘুমের ওষুধে দুজনেই ধুঁকছে, চান করে গুরচরণের রসুইয়ের গরমাগরম ফাউল কারি দিয়ে প্রচুর পরিমাণে ভাত সাঁটিয়ে লেপের তলায় জড়াজড়ি করে ভাত ঘুমে বেলা কাবার। 

তারাসাং-এ ঢোকামাত্র সায়েরী চাঙ্গা হয়ে গেছে, মিচকি হেসে বারবার তাকাচ্ছে সে সেলজার দিকে। সাফ-সুত্রা ঘরে ঢুকে সেলজা জানলা খুলে, যগের থেকে দু গেলাস জল গড়াতে গড়াতে বলে যে আজ বিকেলে তারা বাজার যাবে, জামা-কাপড়, ব্যাগ, মাজন-ব্রাশ ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হবে, হ্যান্ড-ব্যাগ থেকে পেন আর এক টুকরো কাগজ খুঁজে বার করে সায়েরীকে দিয়ে কী কী কিনতে হবে তার ফর্দ বানাতে বলে। সায়েরী তার দিকে পেছন করে জানলার কার্নিসে কাগজটা রেখে লিস্ট বানিয়ে দুষ্টু-দুষ্টু, লাজুক-লাজুক, মুখ করে সেটা সেলজাকে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। সেলজা আলিঙ্গন বদ্ধ অবস্থায় বেকায়দায় সেই লিস্টে চোখ বোলাতে গিয়ে দেখে সেখানে চোখ-মুখ আঁকা দুটো ফুলের তলায় সায়েরীর বিদিগিচ্ছিরি হাতে লেখা: “ইলু! ইলু!” 

সন্ধ্যেবেলায় সেলজার প্রথমে ঘুম ভাঙে। দিনান্তের গোলাপী আকাশের চুরি যাওয়া আলোতে সে দেখে একটা খর্বকায় লোক ঘরের এক কোনে থুম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে পড়ে যায় যে দুপুরে প্রচন্ড ঘুম পেয়ে যাওয়ায় দরজা দিতে ভুলে গেছিল। “কৌন? কৌন ওঁহা?” বলে ধড়মড়িয়ে উঠে মাথার কাছের সুইচ বোর্ডে এলোপাথাড়ি হাত চালিয়ে আলো জ্বেলে দেখে যে একটা ছেলে ঝাঁটা হাতে দাঁড়িয়ে আছে মেঝের দিকে চেয়ে। মুখ তুলতে সেলজা দেখলো সায়েরীর দোসর; একটা রুগ্ন ছেলে, চোখের তলায় কালি, পরনে বুকের বোতাম খোলা একটা নোংরা বুশ শার্ট, কন্ঠার হাড় ঠেলে বেরিয়ে আসছে। ব্যাপার বুঝতে পেরে সেলজা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “সাফাই কারনে আয়া?” ছেলেটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। “তো কিঁঊ বুলায়া নেহি?” ছেলেটা নিরুত্তর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এই ভাবে ন’-দশ সেকেন্ড কাটার পর সেলজা বিরক্ত হয়ে বলে, “খাড়ে খাড়ে মু কেয়া দেখ রাহে হো?  সাফাই কারো অর চলে যাও”। বলতে না বলতেই ছেলেটা মহা উদ্যমে ঝাঁট-পোঁচ শুরু করে দেয় আর সেলজার আফশোস হয় এই ভেবে যে ছেলেটা তো তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল না তাহলে ‘মু কেয়া দেখ রাহে হো’ বলা অনুচিত হয়েছে। ছেলেটার কাজ শেষ হলে সেলজা তার হাতে দশ টাকা গুঁজে দিয়ে বলে, “নাম কেয়া তুমহারা?” সায়েরী এতক্ষণ লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিল, হঠাৎ লেপ সরিয়ে উঠে বসে, ঘুমে ফোলা চোখে বলে, “ইন্দার”। সেলজার গা ছমছম করে, সে সায়েরীকে জিজ্ঞেস করে, “তুঝে ক্যায়সে মালুম? তু ইসে প্যহচান্তা হ্যায়?” সায়েরী কোনো উত্তর না দিয়ে আবার লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। সেলজা পারেশান হয়ে ছেলেটাকে বলে, “ওয়ে! তু ইন্দার হ্যায়?” ছেলেটা মাথা নেড়ে অসম্মতি প্রকাশ করে উত্তর দেয়, “জী দিনদায়াল।”

সম্বিত বসু

পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের গল্পকার, কথাসাহিত্যিক। নিবাস কলকাতার ভবানীপুরে। চলচ্চিত্রবিদ্যায় পড়াশুনা। গল্পপত্রিকা ‘পরিধি’তে নিয়মিত লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে কলকাতাকেন্দ্রিক বহু সমান্তরাল পত্রিকায় নিয়মিত গল্প লিখেছেন। প্রকাশিত উপন্যাস, ‘গৃহস্থগীতি’।

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-২)

গোলাপী দৃশ্য বারংবার (পর্ব-১)

Share