আজ বৃহস্পতিবার, ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

অন্তরীণের পৃথকসত্তা

পরীক্ষাওমূলক কবিতার আলাপ: ছয়। Painting: Dhruvi Acharya,

।। আর্যনীল মুখোপাধ্যায়।।

প্রতিনিয়তই হাজারো প্রতীক জন্মাচ্ছে, ঝলসাচ্ছে, অনেক দিশা দেখাচ্ছে হয়তো। আমি দেখতে পাচ্ছি না। পাচ্ছি না তাকে অনুভূতিকেন্দ্রে। আর যে বাইরের দিকটা মুখোশের – তাতে ঠিক কোন জীবানু এসে সেঁটে যাচ্ছে, কোন অদৃশ্য বাস্তবতার বৃষ্টিছাঁট লাগছে জানিনা। পুতলনাচিয়ের যে হাতের কথা লিখেছিলাম, তাতে বাঁধা সুতো থেকে যারা নিচে ঝুলে থেকে দোল খায়, তারা আসলে নেই কোথাও। তারা একটা ভেসে থাকা কল্পবাস্তবতা, যাকে আমরা আজকের জীবন বলে চিনছি। ভুল এবং অতিব্যবহৃত শব্দ মার্কিন দেশে – ‘সার্‌রিয়াল’ (যার ব্যবহার অলস, উচ্চারণও ভুল, যেমন ‘ডিকন্সট্রাকশন’। যার ব্যবহার দেরিদাকে অপমান করে)। সেই ‘সুররিয়াল’ (যার ব্যবহারিক অর্থ আসলে ‘অদ্ভুত’) –এর নতুন নাম – নববাস্তব – ‘দ্য নিউ নর্মাল’। এও মার্কিনি শব্দবন্ধ। যেমন ‘লকডাউন’। গোটা পৃথিবীটাই এখন অচেতনভাবে আমেরিকার ভাষা ও সংস্কৃতির দাস হয়ে আছে। মুখোশের বাইরের দিক এটাও। মুখোশ কি তা বোঝে?

২০২০ সালে গোটা পৃথিবী জুড়ে শুরু হয় নব-করোনা ভাইরাস বাহিত অতিমারী। এরই মধ্যে যখন প্রিয় গোটা পৃথিবীটাই লক-ডাউন বা বন্দিদশায়, তখনই লেখা হয়েছিল এই গদ্য –

অন্তরীণের পৃথকসত্তা

মুখোশে-দস্তানায় মোড়া কালের ধারা এখন। এ জীবন ও তার প্রতীকিতা দ্রুত সংক্রামক এক অধিবাস্তবতার ধোঁয়া, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে। আমরা ছাদে দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি তার ছড়িয়ে যাওয়া। রাজার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, যে কেল্লার ওপরে উঠে এইরকমই এক ধোঁয়া দেখছে, যাদুকর বর্ফির বানানো টোটকা জ্বালিয়ে। সে ধোঁয়া অবশ্য শোর তুলেছিলো, বাকধ্বনির যুগশঙ্খ জাগিয়ে তুলেছিল তার অভিশপ্ত, মূক জনতার মধ্যে। বোবা মানুষেরা আবার কথা বলতে শুরু করে। আমাদের অভিশাপ অন্য। মা-প্রকৃতির অভিশাপ, অতি ‘প্রগতি’র মুখে চপেটাঘাতের উচিত শিক্ষা, সবুজের সম্মতি পুড়িয়ে, সমতা নাশ করে আক্ষেপহীন গড়িয়ে যাওয়া খেলনা গাড়িটাকে এক পা দিয়ে থামিয়ে দেওয়া। তাই এই অভিশাপের অন্তরীণ, তাই এই মুখোশে, দস্তানায় ঢাকা জীবন।

সপ্তাহে দু-তিনদিন মুখ ঢেকে বেরোবার সময় অণিমা-তনিমার কথা মনে পড়ে। অণিমা-তনিমা যমজ বোন নয়। তারা এসেছিল, একদা, আচমকা আমার বইদীর্ঘ কবিতা ‘স্মৃতিলেখা’য়। লিখেছিলাম ৭-৮ বছর আগে –

মুখোশের ভেতরদিককে বলে ‘অণিমা’। ‘তনিমা’ তার বাইরের দিকটা। কিন্তু পুতুলনাচিয়ের কোনো মুখোশ নেই। তার কোনো চেহারাই নেই। সেই নেইটাই আমরা দেখছি। যেখান থেকে নেমে আসা সুতো। ঘরের মাঝে ভেসে থাকা মাকড়শা – সেই ভাসমানতাকে বোঝাটাই তন্তুজ্ঞান। 

ভাবনাটা এসেছিলো কার্ল ইয়ুঙ-এর রেডবুক পড়ার সময়। মানবচেতনা সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে ইয়ুঙ লিখেছিলেন, চেতনার মুখোশের সাথে মিলের কথা। মুখোশের দুটো দিকের কথা। যে দিকটা মানুষের মুখ স্পর্শ ক’রে আছে সেটাই anima, আর যে দিকটা বাইরের, persona। বাংলা ‘অণিমা’ সেই আণবিক পর্যায়ের শুদ্ধতা যা ধ্যানে পাওয়া যায় আর ‘তনিমা’ এক দেহজতা। বহিরঙ্গ। আজ যে মুখোশ প’রে বেরোনো, সেই মুখোশ এই কাজই করে যাচ্ছে। আমাকে যতটা না প্রতিরক্ষা গড়ে দিতে পারছে ভেতরের দিকে, তার চেয়ে বেশি করে তুলছে আপনার – আপনার কালের, ভূমির, পরিবেশে সম্বন্ধে আত্মসচেতন। আবার বেহুঁশও। অচেতন। ভুলোমনা। প্রতিনিয়তই হাজারো প্রতীক জন্মাচ্ছে, ঝলসাচ্ছে, অনেক দিশা দেখাচ্ছে হয়তো। আমি দেখতে পাচ্ছি না। পাচ্ছি না তাকে অনুভূতিকেন্দ্রে। আর যে বাইরের দিকটা মুখোশের – তাতে ঠিক কোন জীবানু এসে সেঁটে যাচ্ছে, কোন অদৃশ্য বাস্তবতার বৃষ্টিছাঁট লাগছে জানিনা। পুতলনাচিয়ের যে হাতের কথা লিখেছিলাম, তাতে বাঁধা সুতো থেকে যারা নিচে ঝুলে থেকে দোল খায়, তারা আসলে নেই কোথাও। তারা একটা ভেসে থাকা কল্পবাস্তবতা, যাকে আমরা আজকের জীবন বলে চিনছি। ভুল এবং অতিব্যবহৃত শব্দ মার্কিন দেশে – ‘সার্‌রিয়াল’ (যার ব্যবহার অলস, উচ্চারণও ভুল, যেমন ‘ডিকন্সট্রাকশন’। যার ব্যবহার দেরিদাকে অপমান করে)। সেই ‘সুররিয়াল’ (যার ব্যবহারিক অর্থ আসলে ‘অদ্ভুত’) –এর নতুন নাম – নববাস্তব – ‘দ্য নিউ নর্মাল’। এও মার্কিনি শব্দবন্ধ। যেমন ‘লকডাউন’। গোটা পৃথিবীটাই এখন অচেতনভাবে আমেরিকার ভাষা ও সংস্কৃতির দাস হয়ে আছে। মুখোশের বাইরের দিক এটাও। মুখোশ কি তা বোঝে?

‘মুখোশ শব্দটা’ নামে একটা গল্প লিখেছিলাম বছর ১৫ আগে। তাতে ‘মুখোশ শব্দটা’কে নিয়ে নানা ভাবনা ও গবেষণা ছিল। বহুজ্ঞানশাখাব্যাপী এক আগ্রহ ও চিন্তাধারা তৈরি হতে থাকে, যেটা ছিল পরবর্তীকালের ‘পরিবিষয়ী’ কাব্যধারার ভ্রূণ, যাতে বন্ধুরা এসে তাদের যত্নআত্তি যোগ করেছিল। বহুজ্ঞানশাখাব্যপী এক কৌতূহল জন্মাচ্ছিলো সে সময়ে সত্যি, মুখোশকে কেন্দ্র করে। এপিস্টেমোলজিক্যাল । কী মুখোশ? কোন দেশে, সমাজে তার কেমন ব্যবহার ছিলো? মুখোশ কী এক সাজ? আত্মরক্ষা? প্রতীক? ইচ্ছেপূরণ? ভিন ব্যক্তিত্বে রূপান্তর?

গল্পের কথক ছিলো এক কবি, ধরা যাক আমি। আর নায়ক ‘হুই’ নামে এক মুখোশশিল্পী। সে মুখোশ বানাতো মৌলিক শিল্প হিসেবে। কিন্তু মুখোশের অজস্র ব্যবহারের কথা হুই জানতো, আর সে সব উপকাহিনী বলে যেত কবিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। যার মধ্যে ছিলো এক অদ্ভুত গল্প – তার এক সিংহলী ছাত্রের জীবন থেকে নেওয়া – প্রেম, কাম ও ট্র্যাজেডির সমন্বয় সে উপকাহিনী। বছর বারো পরে বন্ধু অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী একদিন দুপুরে অর্ধনিদ্রার মধ্যে তার খাটে শুয়ে একটা গল্প বলতে থাকে যা তার মনে গড়ে উঠছে। সেটা সে আমাকে বলে। ব’লে বলে, ‘দ্যাখ না, এর থেকে যদি একটা স্ক্রিপ্ট নামাতে পারিস! ট্রাই কর নীলু’। করেছিলাম। তার থেকে আর একটা গল্পের জন্ম–

‘ভোর হলো/ দোর খোলো/ খুকুমণি ওঠো রে’। এই খুকুমণি টোনির বলা গল্পের যুবতী নায়িকা, যে এক খবরকাগজওলার ওপর… ক্রাশ আর কী! ভোর ভোর উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কখন সে ছেলে সাইকে আসবে, এক হাতে দড়ি বেঁধে, অন্য হাতে কাগজ ছুঁড়ে দেবে ব্যালকনিতে, সাইকেল থেকে নামতেও হবেনা তাকে। খুকুমণি থাকে তার প্রায়বৃদ্ধ জ্যেঠুর সাথে। জেঠুকে আমি করেছিলাম ‘হুই’ এর মতই এক মুখোশশিল্পী। আর জেঠু বলেছিলো সেই সিংহলী ছাত্রের উপকাহিনী যার দুই চরিত্রে এই ‘খুকুমণি’ ও তার ‘কাগজওলা’ই ফিরে এসেছিলো রূপান্তরে। দুই অভিনেতার দুটো করে রোল, একই ছবিতে। ব্যুনিউয়েলের ‘সেত্‌ অবস্কুর অব্জে দু দেসির’ (‘দ্য অবস্কিওর অবজেক্ট অফ ডিসায়ার’) –এর কথা মনে পড়েছিলো লিখতে লিখতে। অনেক বিকেল বেসমেন্টের একা ফ্লোরে বসে বসে লিখেছিলাম। ঘোরের মধ্যে। পমেগ্রেনেট জুস টেকিলার সাথে মিশিয়ে খেতাম অল্প। প্রায় রোজ। ঘোর ঘন হতো। খবরকাগজওলা ছেলেটা ছিল ভদ্র স্বল্পভাষী। ওর নাম ছিলো সজল। আর খুকুমণির নাম ছিল এষা। জেঠু – অভিরূপ। সাপের জড়ানো মড়ানো সঙ্গমের মতো আমার গল্প আর টোনির কাহিনি-আভাস মিলে গিয়েছিলো ‘ভোর হলো’তে। টোনি একদিন বললো, ‘বুড়োকে নিতে হবে নীলু। একটা ছবিতেও ভালো কোনো রোল দিতে পারিনি ওনাকে। উনি অভিমান করছিলেন একদিন। তুই জেঠুর চরিত্রে ওকে ভাব’। ভেবেছিলাম। যদিও তখন ৮০ উনি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দিনে ৪-৫ ঘন্টার বেশি কাজ করেন না। তবু ওঁকে ভেবেই গড়ে উঠেছিলো ‘অভিরূপ’ চরিত্রটা। সে ভদ্রলোকের আর একটা বাতিক ছিলো। উনি ‘খাড়া খামার’ নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। সেটা তখন আমার প্রিয় বিষয় হয়ে উঠছে। ভাবী নাগরিক সভ্যতার এক সবুজচূড়ো। গল্পের এক জায়গা এরকম – 

ব্যালকনিতে বসে বসে সারাদিন অনেক পত্র-পত্রিকা ঘাঁটেন অভিরূপ। সমীক্ষা বলছে ২০৫০-এ প্রায় ৮০% মানুষ শহরে বাস করবে। vertical farming  নিয়ে ভাবনা ও কাজ শুরু হয়ে গেছে। লম্বা কাচের বহুতল গ্রীনহাউসে চাল-গম-আলু-পেয়াঁজ-সব্জির চাষ। এসব এখানে কবে হবে? অভিরূপ বলেন ‘খাড়া খামার’। তার অনেক ছবি দিয়ে একটা আস্ত কোলাজ করে দেয়ালে বাঁধিয়ে রেখেছেন।

 ‘ভোর হলো’ গল্পটা ‘আরম্ভ’ পত্রিকায় বের হয়। টোনির গল্পটা পছন্দ হয়েছিলো কিন্তু জড়ানো গল্পটা হয়নি। তাই চিত্রনাট্যের কিছুটা এগিয়ে আর লিখিনি। সৌমিত্রর আর টোনির ছবিতে কোনোদিন কাজ করা হয়নি। আমিও অন্যকাজে ফিরে আসি। কিন্তু এষা, সজল আর অভিরূপকে ভুলতে পারিনি। ওদের নিয়ে এই অন্তরীণ জীবনের ভূতলে বসে আজও ভাবি আর পৃথক হয়ে পড়ি।

Painting: Dhruvi Acharya,

নিসর্গসূত্র, দৃশ্যনেশা, স্মরণযোগ্যতা ও বিষয়হীনতার বিপক্ষে (পরীক্ষামূলক কবিতার আলাপ: চার)

জীবনশিল্পের  বাক্সবস্তু (পরীক্ষামূলক কবিতা আলাপ: ৩)

অনুবাদ ও অনুসৃজন (পরীক্ষামূলক কবিতার আলাপ: দুই)

চতুরঙ্গ ও যৌথতা (পরীক্ষামূলক কবিতার আলাপ- ১)

আর্যনীল মুখোপাধ্যায়

দ্বিভাষিক কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, চিত্রনাট্যকার ও সম্পাদক। বাংলা ও ইংরেজী মিলিয়ে ৯টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে Conversation about Withering (২০২১, ক্রিস্তিনা স্যাঞ্চেস লোপেসের সাথে), অনাম আন্দ্রেসের একক ইস্তাহার (২০২০), স্মৃতিলেখা (২০১৩, ২০১৫), সুনামির এক বছর পর (২০০৮), চতুরাঙ্গিক/SQUARES (২০০৯, প্যাট ক্লিফোর্ডের সাথে), late night correspondence (2008), হাওয়ামোরগের মন (২০০৪) ও খেলার নাম সবুজায়ন (২০০০,২০১১)। গদ্যগ্রন্থ ‘কিনারার রূপকথা’। চারটি প্রবন্ধের বই। ইংরেজী ও ইস্পানি কবিতা সংকলিত হয়েছে অসংখ্য বিদেশী কাব্য-আয়োজনে। কৌরব অনলাইন ও The MUD Proposal সম্পাদনা করেন। পেশা – কারিগরি গণিতের গবেষণা।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top