![](https://protipokkho.com/wp-content/uploads/2022/06/rsz_জীবনশিল্পেরবাক্সবস্তু.jpg)
।। আর্যনীল মুখোপাধ্যায় ।।
প্রায় সমস্ত ভাষাসমাজেই চলমান কবিতা লেখালিখির বাইরে একটা বিকল্প কাব্যসাহিত্যধারা গড়ে ওঠে। এর অনেকটাই গড়পড়তা কবিতার আধেয়, বিষয়, রচনাশৈলি, ভাষাবিন্যাস, পদান্বয়, ছন্দগতিকে এড়িয়ে, বা তার বিরোধিতায় এক বা একাধিক সমান্তরাল ধারা নির্মাণ করে। পশ্চিমবঙ্গে এই সমান্তরাল ধারার বা পরীক্ষামূলক ধারার অন্যতম কবি আর্যনীল মুখোপাধ্যায়। নিজের ‘পরীক্ষা কবিতা’ ভাবনসমূহ ও তাঁর পরীক্ষামূলক কবিতার একাধিক প্রকল্প নিয়ে লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আর্যনীল। সেগুলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে ‘প্রতিপক্ষ’ পত্রিকায়। এটি তৃতীয় পর্ব। শিরোনাম, ‘জীবনশিল্পের বাক্সবস্তু’ শিল্পের একটা কাঠামো যে সবসময় থাকে বা দরকার তা নয় কিন্তু একটা আকৃতি থাকে। কবিতার ক্ষেত্রেও তাই। পঙক্তি পঙক্তি গড়ে ওঠে কবিতার শরীরকাঠামো। এই গদ্যে আমরা দেখব এক শিল্পীর স্মৃতিশিল্পঘর কীভাবে হয়ে উঠল আরেক কবির কবিতার উৎস।
ইউটোপিয়া পার্কওয়ে। আদর্শপথ? পৃথিবীর সেরা রাস্তা? শুনলে এমনই মনে হয়। আমারো তাই হয়েছিলো। বৃষ্টিভেজা এপ্রিলের এক সন্ধ্যায়। শহরের সমস্ত তৃষ্ণার্ত টিউলিপ সেদিন তাদের নায়িকাঠোঁটের আলোকসচেতন নম্রতা ভুলে মরুযাত্রীর মতো ক্লান্ত ও নির্লজ্জ হাঁ করেছিলো। তৃষ্ণা মিটেছিলো। আর তারা রূপ খুলে সরসতায় সর্বাণী সেদিন। এর মধ্যেই শুনেছিলাম পিটার গিৎসির (Peter Gizzi, উচ্চারণ গিৎসি বা গিসী) কবিতা। বছর দুয়েক আগে আলাপ হয়েছিলো। আন্তর্জালে। আমি নিজেই যেচে ওর ঠিকানা খুঁজে বের করে আলাপ করি। বীট ও ল্যাঙ্গোয়েজ কবিতা আন্দোলনের পর আমেরিকান কবিতার প্রাঙ্গণে নতুন কী ঘটছে তার কথা লিখতে গিয়ে মার্কিন বীট কবি অ্যান ওয়াল্ডম্যান একদল তরুণ কবির কবিতার এক সংকলনের ভূমিকা লেখেন। সেখানেই প্রথম পিটারের কবিতা পাই। তখন থেকেই তার খোঁজ।
আলাপ হবার মুহূর্ত থেকেই কোথায় যেন পিটারের সাথে সুর মিলে যায়। নিয়মিত ই-মেল দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। পিটারের কবিতার অনুবাদ বের হতে থাকে বাংলা পত্র-পত্রিকায়। ওর কবিতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের। ওঁরাও আমার সাথে পিটারের কিছু কবিতা অনুবাদ করেন। সম্পাদক প্রভাত চৌধুরীর উৎসাহে পিটারের কবিতা নিয়ে ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকা ২০০৪ সালে এক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। পরে স্বপন রায়ের উদ্দীপনায় ২০০৬ সালে ‘নতুন কবিতা’ পত্রিকায়। ২০০৬ সালের এপ্রিলেই পিটার সিনসিন্যাটির জেভিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়। শহরে আসার কয়েকদিন আগে আমাকে ইমেল করে – ‘চলে এসো, দেখা হোক’।
২০০২ সালের শেষের দিকে আলাপ যখন ঘনিয়ে এসেছে, একদিন পিটার জিজ্ঞেস ক’রে – কি লিখছো? আমি বলি – একটা পান্ডুলিপি তৈরি করছি দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের। সে বলে – তাই? আশ্চর্য! আমিও পান্ডুলিপির প্রুফ দেখছি তৃতীয় বইয়ের। নাম কী? না, Some Values of Landscape and Weather। অসম্ভব! কেন? – পিটার জিজ্ঞেস করে। আমার উত্তর – আমার বইয়ের নাম ভেবেছি – ‘হাওয়ামোরগের মন’। ‘আবহাওয়া’র থিম তার সর্বত্র জুড়ে।
নানা ধরনের কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু – পাতাপুতো, ফেলে দেওয়া খেলনা, হারানো বোতাম, মরচে ধরা পেরেক, জানলা দরজা থেকে খুলে আসা কাঠ, পুতুলের জামা, ঝিনুক ইত্যাদি দিয়ে তার বাক্স সাজাতেন। কখনো অল্প রঙ করতেন বাক্সের ভেতরটা। কবিতায় পঙক্তি যে কাজ করে বস্তু এসে তার জায়গা নিয়েছে যেন।
এপ্রিলের সেই সন্ধ্যায় সেই নতুন বই থেকেই পিটার কবিতা পড়লো। পুরনো বই থেকেও। তার আগের বইয়ের নাম – ‘কৃত্রিম হৃদয়’ (Artificial Heart)। তারই একটা কবিতা ‘ইউটোপিয়া পার্কওয়ে’। কবিতা শুরু হোক, আমরা একটু করে করে পড়ি আর আলোচনা করি, কিছু ছবি দেখি, কিছু ফিল্ম…
ইউটোপিয়া পার্কওয়ে
পিটার গিৎসি
বস্তুই সেই স্থান
যেখানে পংক্তিগুলো ধরেনি
এই যে দিন আসিয়াছে
নীল চতুষ্কোণ জুড়ে
আর হলুদ গোলকে
বড়ো আনন্দের এই দিন।
ঘরে থাকা
গাছে থাকা
৩ আর ৪
এই নম্বরগুলোকে পরীক্ষা করা।
===
ইউটোপিয়া পার্কওয়ে রাস্তার নাম তো বটেই। নিউ ইয়র্ক শহরের কুইন্স অঞ্চলের একটা রাস্তা। সেই রাস্তায় আমেরিকান শিল্পী যোসেফ কর্নেল (Joseph Cornell )-এর বাড়ি যেটা এখান ওঁর শিল্পের স্মৃতিঘরে (মিউসিয়াম) পরিণত হয়েছে। কর্নেল ছিলেন এক আশ্চর্য শিল্পী। ভাস্কর, চিত্রকর ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রকার। ৬৯ বছর বয়সে ১৯৭২ সালে প্রয়াত হন। গিসীর কবিতার শুরুতে যে নীল চতুষ্কোণের কথা আসে সেখানেই কর্নেলের শিল্পের চাবিকাঠি। চৌকো ফ্রেম, কাঠের বাক্স, খোপ। এসবের মধ্যেই তিনি তাঁর ‘বস্তু’গুলো পুরে রাখতেন। আর এই বাক্সবন্দী বস্তুসম্ভারই হয়ে উঠতো ওঁর শিল্প। বাক্সের ওপর কাঁচের পাল্লা। তার মধ্যে দিয়ে পুতুলঘর দেখার মতো করে দেখতে হয় ওঁর কাজ। কর্নেলের সেই স্মৃতিশিল্পঘর দেখতে গিয়েছিলো পিটার। সেই অভিজ্ঞতাই এই কবিতার উৎস। কর্নেলের শিল্পের এক সারসংক্ষেপ। নানা ধরনের কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু – পাতাপুতো, ফেলে দেওয়া খেলনা, হারানো বোতাম, মরচে ধরা পেরেক, জানলা দরজা থেকে খুলে আসা কাঠ, পুতুলের জামা, ঝিনুক ইত্যাদি দিয়ে তার বাক্স সাজাতেন। কখনো অল্প রঙ করতেন বাক্সের ভেতরটা। কবিতায় পঙক্তি যে কাজ করে বস্তু এসে তার জায়গা নিয়েছে যেন।
আবার কবিতায় ফিরি…
===
বস্তুই সেই স্থান
যেখানে পংক্তিগুলো ফেরে
বাড়ির ভেতরে একটা খড়ের মানুষকে
গড়ে তুলতে
ভুতুড়ে বানাতে।
মাঠের ভেতরে লেখা হয়
শব্দের পাথর দিয়ে
যেখানে তার বিভাজন হয়
আর গুঁড়ো পাথর
গড়ে কথার হাঁ-মুখ।
![](https://protipokkho.com/wp-content/uploads/2022/06/1.jpg)
===
শিল্পের একটা কাঠামো যে সবসময় থাকে বা দরকার তা নয় কিন্তু একটা আকৃতি থাকে। কবিতার ক্ষেত্রেও তাই। পঙক্তি পঙক্তি গড়ে ওঠে কবিতার শরীরকাঠামো। এখানে পিটার কবিতার সেই গড়ে ওঠার সাথে কর্নেলের শিল্পপদ্ধতির একটা তুলনা আনে। তাই লেখার পঙক্তির জায়গা নিতে আসে ‘বস্তু’গুলো, যাদের বাক্সের মধ্যে সাজিয়ে ফিরিয়েই কর্নেলের শিল্পনির্মান। কবিতায় পঙক্তির সেই অতিমৌলিক জায়গাটার গুরুত্বের কথা পিটারকে যেন বারবার ধরিতে দিচ্ছে কর্নেলের বাক্সগুলো। তার ভেতরের সমস্ত ফেলনাদের জীবনের প্রতীক মনে হচ্ছে।
![](https://protipokkho.com/wp-content/uploads/2022/06/f.jpg)
সেভাবে ভেবে দেখলে আমাদের জীবন, পরিবেশ, বাসস্থান – সবকিছুই কিন্তু বাক্সের মতো, আয়তাকার, ঘনকি এক পরিমিত স্থান যেখানে যা কিছু ছড়িয়ে আছে সেই সমস্ত বস্তুকেই জীবনের প্রতিনিধি মনে হয়, প্রতীক মনে হয়। যেমন পিটার বললো ডিমটা জীবনের প্রতীক। মাঠের ‘বাক্সের’ মধ্যে মানুষ নিজেরই ‘প্রতীক’ গড়ে তোলে – খড়ের মানুষ। তাকে ভীতিপ্রদ করে তোলে পাখিদের ভয় দেখাতে। এইভাবেই বাক্সের বস্তুগুলো যেমন জীবনের সংগৃহীত মানে।, তেমনি পড়ে থাকা পাথর মাঠের ওপর তার নিজের কবিতার লাইন লেখে। আরো পড়ি…
===
বস্তুই সেই স্থান
যেখানে যেখানে সকল গাছ বাড়ি পাখি,
সকল সূর্যের টুপি ও আলো
এসে পড়ে;
পালকের জটিলতাগুলো
মোটা সুতো, ছূঁচ, কুরুশ।
হাসি আর মেয়েটার মধ্যে একটা ছেলে।
ছেলে, বাবা আর একটা গাছ।
একটা গল্পের শুরু
না শুরুর গল্প।
কীভাবে আকাশের অনুমান।
যারা ক্ষুদ্র, কীভাবে নিশ্চুপ হয়ে গেলো
আর শিশুদের ইঙ্গিত করলো
পুরুষকে বহন করলো
কলে কেটে চললো লম্বা পেন্সিলটা
যতক্ষণ না গর্ত হলো তরুবীথিকায়
===
কর্নেলের বাক্সগুলো কে কেউ বলেছেন ‘স্মৃতিবাক্স’, কেউ ‘কবিতার মঞ্চ’, কেউ ‘কবিতার কারখানা’। আমার মনে হয়েছে জীবনের নির্বাচিত এক একটা মুহূর্তের আকার নিয়ে ঐ আয়তাকার প্রিজম বা বাক্স রচিত। রচিত জীবন ও তার পারিপার্শ্বিকের কিছু নির্বাচিত বস্তু নিয়ে। যেসব বস্তু আশেপাশে পড়ে থাকে – ভাঙা, ফেলনা, বর্জ্য, গুপ্ত, হারিয়ে ফেলা। অথচ তাদের দিয়েই জীবনের বিমূর্ত প্রতীকিতা। তারাই জীবন ও তার পারিপার্শ্বিকের সেতু। এক আদান-প্রদানের প্রতিনিধি। বাক্সগুলোর আধেয় ও অ্যারেঞ্জমেন্ট দেখতে দেখতে এমনও মনে হতে পারে যে বহু গল্পের বীজ সেখানে পোঁতা। যেমন পিটার গিসী হাস্যময় একটা মেয়ে, ছেলে, বাবা আর এক গাছের গল্প দেখতে পায়। এক ধরনের মিনিয়েচার আর্টের কথাও এখানে এসে যাবে। ভুল বললাম। মিনিয়েচার আর্ট নয়, বরং এক শিল্প যা জীবনের বনসাই রূপটা দেখায়। শব্দ বা রেখা বা রঙের মতো বিমূর্ত জিনিস দিয়ে নয়, মূর্ত বস্তু দিয়ে।
===
বস্তুই সেই স্থান
যেখানে যেখানে সকল গাছ বাড়ি পাখি,
সকল সূর্যের টুপি ও আলো
এসে পড়ে;
পালকের জটিলতাগুলো
মোটা সুতো, ছূঁচ, কুরুশ।
হাসি আর মেয়েটার মধ্যে একটা ছেলে।
ছেলে, বাবা আর একটা গাছ।
একটা গল্পের শুরু
না শুরুর গল্প।
কীভাবে আকাশের অনুমান।
যারা ক্ষুদ্র, কীভাবে নিশ্চুপ হয়ে গেলো
আর শিশুদের ইঙ্গিত করলো
পুরুষকে বহন করলো
কলে কেটে চললো লম্বা পেন্সিলটা
যতক্ষণ না গর্ত হলো তরুবীথিকায়
পিটারের কবিতা শেষের এসে আবার লেখে – ‘বস্তুই সেই স্থান/ যেখানে পঙক্তিগুলো ধরেনি’। কেন ধরছেনা ? ওঁর বাক্সবস্তুসজ্জার মধ্যে একটা অপ্রত্যাশিত বেনিয়ম ও অনিশ্চয়তা থাকতো বলে অনেকে যোসেফ কর্নেলকে অধিবাস্তববাদী (সুররিয়াল) শিল্পী বলতেন। দালি একবার বলেন কর্নেলই আমেরিকার একমাত্র সত্যিকারের সুররিয়াল শিল্পী। কর্নেল নিজে যদিও এই তকমা চাননি কখনো । বরং ম্যাক্স আর্ণস্টকে অনুপ্রেরক হিসেবে স্বীকার করেন।
( প্রথম প্রকাশ: শিলাদিত্য, ২০১৩)
অনুবাদ ও অনুসৃজন (পরীক্ষামূলক কবিতার আলাপ: দুই)
চতুরঙ্গ ও যৌথতা (পরীক্ষামূলক কবিতার আলাপ- ১)
আর্যনীল মুখোপাধ্যায়
![](https://protipokkho.com/wp-content/uploads/2022/01/aryanil-mukherjee.jpg)
দ্বিভাষিক কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, চিত্রনাট্যকার ও সম্পাদক। বাংলা ও ইংরেজী মিলিয়ে ৯টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে Conversation about Withering (২০২১, ক্রিস্তিনা স্যাঞ্চেস লোপেসের সাথে), অনাম আন্দ্রেসের একক ইস্তাহার (২০২০), স্মৃতিলেখা (২০১৩, ২০১৫), সুনামির এক বছর পর (২০০৮), চতুরাঙ্গিক/SQUARES (২০০৯, প্যাট ক্লিফোর্ডের সাথে), late night correspondence (2008), হাওয়ামোরগের মন (২০০৪) ও খেলার নাম সবুজায়ন (২০০০,২০১১)। গদ্যগ্রন্থ ‘কিনারার রূপকথা’। চারটি প্রবন্ধের বই। ইংরেজী ও ইস্পানি কবিতা সংকলিত হয়েছে অসংখ্য বিদেশী কাব্য-আয়োজনে। কৌরব অনলাইন ও The MUD Proposal সম্পাদনা করেন। পেশা – কারিগরি গণিতের গবেষণা।