।। রেহনা সুলতানা।।
অসম জুড়ে বাঙালি তার ভাষিক ও সাংস্কৃতিক পরিচিতির জন্য নিপীড়িত। এনআরসি’তে বাদ পড়ে লাখো বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিম ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি। বাঙালি হিন্দুর তবু বাঙালি পরিচিতিটা রয়েছে কোনোক্রমে। ঈশানবঙ্গ-সহ গোটা অসমের বাঙালি মুসলমানের সঙ্কট আরও গভীরে। একে তো তারা বাঙালি, তার ওপরে মুসলিম। একদিকে অসমের বাঙালি হিন্দুরা মুসলমানের বাঙালি সত্তা স্বীকার করতে নানা সময় কুণ্ঠা বোধ করে এসেছে বলেই অভিযোগ, অন্যদিকে তারা যে আসলেই বাঙালি আর সে কারণেই অহমিয়া জাতিবাদীরা তাদের ওপর চড়াও হয়ে থাকে হামেশাই। পাশাপাশি হিন্দু জাতিবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সহিংস অহমিয়া জাতিবাদীরা অসমের বাঙালি মুসলমানের ওপর নিপীড়ন চালায় অনায়াসেই। তাদেরকে ‘বহিরাগত’, ‘বাংলাদেশী’ তকমায় জেরবার করা হয়। এই সঙ্কটে তারা নতুন এক পরিতিকে আপন করে নিয়েছে। তারা নিজেদেরকে বলছে ‘মিঞা’। এই মিঞারাই তাদের কবিতায় নিজেদের সঙ্কট, নিপীড়নের বয়ান, রাষ্ট্রচ্যুত হওয়ার ‘ভয়’ আর ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্য্য ব্যক্ত করছেন প্রমিত বাঙলার বাইরে বের হয়ে নিজস্ব উচ্চারণে, এনআরসি’র সময় থেকে তাদের এই কবিতা ‘মিঞা কবিতা’ হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে। আমরা সেইসব ‘মিঞা কবিতা’ পেশ করছি বড় বাংলার সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রতিপক্ষ’তে। আজ রেহনা সুলতানার তিনটি নাতিদীর্ঘ কবিতার মাধ্যমে সূচনা হচ্ছে ধারবাহিকভাবে ‘মিঞা কবিতা’ প্রকাশ। ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস। এই মাসব্যাপী আমাদের এই আয়োজন জারি থাকবে।
– সম্পাদকের দফতর, ‘প্রতিপক্ষ’
মা চায় আঙ্গো নিজের পরিচয় অইক
আমি মিঞা
তুমি আঙ্গো মা
তোমার কোলেই জন্ম আমার
তোমার কোলেই জন্ম আঙ্গো বাবা-দাদার
মা,
তাও তুমি কও আমি তোমার আপোন না
আমি তোমার কেও না
মা,
আমারে তুমি গিন্না করো
কারণ আমার পরিচয়
তোমার কোলে জন্ম নেওয়া
আমি সেই ‘অভিশপ্ত মিঞা’
মা,
তুমি আমারে বিশ্বাস করো না
কারণ আমার মুকে দিগলা দাড়ি
আমার পিন্ধনে লুঙ্গি
মা আমি তোমার কাছে
আমার পরিচয় দিতি দিতি
ব্যাকুল ঐয়া যায়
তাও
হাজার কষ্ট, লাঞ্চনা-বঞ্চনা সহ্য কৈরাও কৈ
মা আমি তোমারেই ভালো পায়
মা,
কোনো কোনো সময়ে আমি ভাবি
তোমার কোলে জন্ম নিয়া আমি পাইলাম কী
আইজ নাই আমার পরিচয়
নাই আমার অস্তিত্ব
আমি আরাইয়া হালাইছি নিজরে
আরাইছি আমার মুখের ভাষা
আরাইছি আমার কৃতি-কৃষ্টি-সংস্কৃতি
আমি আমার সৰ্বস্ব আরাইয়াও
মাত্ৰ তোমারেই সাইরটা নিছি
আমি কিছুই চায়না মা
চাইছি মাত্ৰ তোমার পায়ের তলে একটু জাগা
মাথা উচা কৈরা, সন্মান নিয়া
তোমার বুকে বাইছা থাকা
আমার মুক মুহি তুমি
একবার চাইয়া দেহো গো মা
কৈয়া দেও তোমার অন্য পোলাগোরেও
আমরা সবাই ভাই ভাই
আঙ্গ মধ্যে কোনো বিরোধ নাই
আবারও কৈছি মা
আমি তোমারই আরেক পোলা
না আমি কেলার মিঞা
না আমি বাংলাদেশী
থোতাই দাড়ি, পিন্ধোনে লুঙ্গির সাথে
সহজ সরল মিঞা আমি
মিঞা আমি
মিঞা আমি
ভাত দে মা
ভাত দে মা
আর তা না অইলে নিজের জীবন খাইয়া হালামু
মা, সেই তর প্যাডে জাগা নেওয়া থিকাই
আমি ভাতের খিদাই জ্বালাতন
মা, হাছা কথা ক
আমি তর প্যাডে থাকতি তুই কোনোদিন প্যাট ভইরা ভাত খাইছিলি?
না আমার তো মনে কয় না।
নইলে, প্যাডের ভিতরেই খিদাই আমি ঐরহম কলকলাইতাম ক্যা?
মা সত্যি কথা ক,
আমারে প্যাডে নিয়া কোনোদিন ভালো মন্দো খাইবার তর ভাগ্য ঐছাল?
না আমার বিশ্বাস ওয় না।
নইলে আমার চেহেরা এইরহম মিরগী রোগীৰ মতন ঐতো ক্যা?
যে বয়সে ওরা মায়ের বুকের দুদ খায়
যে বয়সে ওগো পোলাহানে হরলিক্স, কমপ্লেন খায়, চকলেট, কেক খায়
সেই বয়সে আমি ফ্যান খাইলাম
মা, আমি তো তর বুকের দুদো পাইলাম না।
না, তার জন্য তুই আমারে ভুল বুজিশ না মা
তার জন্য আমার কোনো দুক্কু নাই, কোনো অভিমান নাই,
আমি কোলের বাচ্চাৰ বয়সে থিকাই প্ৰাপ্তবয়স্ক
তৰ প্যাডের খিদাই যে আমার প্ৰাপ্য তর বুকের দুদ শুকাইয়া নিছে
আমি সেইদিনেই বুইজা উঠছিলাম।
ওৰা পিডে বেগ নিয়া, জোতা মোজা পিন্ধা
সুন্দর সুন্দর কাপড় পিন্ধা যেশুম স্কুলে গেতো
আমি চাইয়া থাকতাম
ভাবতাম ওরা বড় মানুষ
ওরা সুখী মানুষ,
ওগো দেইকা আমারও পিডে বেগ নিয়া
জোতা মোজা পিন্ধা স্কুলে জাইবার মন গেতো
আমাৰো খুব ইচ্ছা গেতো
আমি স্কুলে যামু,
পইৰা বড় মানুষ ওমু।
কিন্তু না, আমি বুইজা উঠছিলাম
আমার সেই অধিকাৰ নাই।
ভাতের খিদার আগে
কোনো কিছুই বড় না
সেই তহনি আমি বুইজা উঠছিলাম।
যে বয়সে ওরা স্কুলে যায়
আমি ভাত মাইনাই
হালিম মাষ্টারের বাইত্তে রাহাল থাকলাম।
ভাবলাম ভাত মাইনার রাহাল আমি
এহন প্যাড ভইরা ভাত খাইবার পারুম।
কিন্তু এ কী?
আমি খাইবা্র বইলে ওগো পাইল্লার ভাত শেষ অয়,
ওৰা কয় আমি না কি রাক্ষস,
মা, আমি কী দিয়া বুজাই ওগো?
সেই যে জন্ম নিয়াই ভাত-ফ্যান ছাড়া আর কিছু কফালে জুডার ভাগ্য আমার অয় নাই,
তাই ভাত আমার ভীষণ প্রিয়,
ভাত মাইনার রাহাল আমি
তাও কফালে প্যাড ভইরা ভাত নাই আমার
তাই রাহাল বিদায় জানাইয়াল।
মা,
তুই কৈলি দ্যাশে কাম নাই, তাই ভাতো নাই
তাই ভাতের নিগাই বিদাশ আইলাম।
কতো মাইনসের নাত্তি গুতা খাইয়া
দুনিয়ার কডু কতা শুইনা
মাসের শ্যাষে যেশুম আতে টেহা পায়,
তর নিগা টেহা পাডায়,
আমি ভুইলা যায় সমস্ত কষ্টেৰ কথা
ভুইলা যাই সমস্ত অপমান, গাইল-গালাজের কতা।
কিন্তু? দেখ মা, তৰ সুখ খোদার সহ্যর বাইরে
দ্যাশে বোলে মরার বেরাম আইলো
তাই কাম বন্ধ ঐলো।
ঐলাম কাম ছাড়া, আতে পইশা ছাড়া।
মা, আমি জানি আমার থিকা তর কষ্ট বেশি
আমার প্যাডে থুইয়াই বাবা মারা গেল
দুই বছর আগে গাড়ির তলে পইরা বড় ভাইডা মারা গেল
ভায়ের বৌ, পই-পোলাহানরে নিয়া
আমি জানি আমার থিকা তর জ্বালা বেশি
আমি জানি, আমি বিদাশ থিকা টেহা নাপাডাইলে
তর আইশালে পাইল্লা উডে না।
সব জাইনাও আমি যে অসহায় মা,
আমাৰে তুই মাফ করিশ।
মা, বিশ্বাস কর
আমার কাছে এক ৱক্তের চাইল কিনবার কড়ি নাই
বাইত্তে যাইবার রেলেৰ টিকেট কিনুম কি দিয়া?
ঘরের ভাড়া দিবার সামর্থ্য আমার নাই,
ঘর মালিকে ফোন কইরা হুমকি দিলো
দুই দিনের ভিতরে ঘর ছাইড়া না দিলে
পুলিশ আইনা বাইরাইয়া খেদাইবো।
তাই খোদারে শরণ কইৰা
নিজের পোড়া কপাল আতে নিয়া
আইডা মেলা দিলাম।
আমার শইল অরশ, পাও চলে না
আৰো যে শ শ মাইল দূর আমার বাড়ি।
মধ্যে মধ্যে তর কতা মনে পৰলে আমি মনে জোর পায়,
মনের জোরে আরও কিছু দূর আইগিয়া যায়,
কিন্তু এ কী?
আমার রাস্তা শ্যাষ অইনা ক্যা?
আমার পাও আইগা না ক্যা?
আমি আর পারতাছি না মা,
আমি জানি একমুঠ ভাত পাইলে
আমার অবশ শইলে শক্তি পাইবো
আমার পাও চলবো
রাস্তাও ছডো ঐবো।
তাই শেষ বারের মতো কই
ভাত দে মা
আর তা অইলে নিজের জীবনডাই খাইয়া হালামু।
আঙ্গো মা
আঙ্গো মারে আমরা ‘তুমি’ আর বাবারে ‘আন্নে’ কইতাম
যেশুম আমরা ছট্টো আছিলাম
মারে দেখছি
গরিব প্ৰজার মতো বাবার সামনে খাড়াইয়া থাকতো
বাবারে কিছু কৈবার গেতো
কিন্তু কোনোদিন বাবার ছামনে সে কতা শেষ করা হারতো না
তাৰ আগেই বাবা সেই জাগা পরিত্যাগ কৰতো
আঙ্গো মা বাবার কাছে থিকা কিছুই চাইতো না
খালি বাবার নগে কতা কৈবার চাইতো
কিন্তু বাবার কোনোদিন সময় থাকতো না
কতো সময়ে মা বাবার ছামনে আব্দার করতো
বাবার একটাই উত্তর থাকতো
তৰ মতোন আমার কাম নাই বুইলা ভাবছত নিহি
তৰ নগে বকবক কইরা থাকুম যে!
আঙ্গো মারে আমরা ‘তুমি’ আর বাবারে ‘আন্নে’ কৈতাম।
আঙ্গো বাবা বড় বড় মাইনসের নগে ঘুরতো
খুব ব্যস্ত থাকতো
খালি কাম আর কাম করতো
মেল্লা মাইনসে আঙ্গো বাবারে সন্মান করতো
মেল মিটিঙে সম্বৰ্ধনা কৰতো
আর আঙ্গো মা খালি বাইত্তে বৈয়া থাইকা বাবার নিগা অপেক্ষা করতো
তহন আঙ্গো বাবার সামনে মারে এতো তুচ্ছ দেখতাম যে মারে আন্নে বুইলা ডাকার কথা কোনো দিন মনে পরে নাই
প্ৰয়োজনো বোধ করি নাই
সেইজন্যে সেই ছট্টো বেলা থিকাই আমরা মা’রে ‘তুমি’ আর বাবারে ‘আন্নে’ কইতাম
আঙ্গো বাবা আছিলো আল্লার মতন বড়
বাবার ছেহা দেইকাও আমরা সেলাম করতাম
মাইনসেও বাবারে খুব সন্মান করতো
আর আঙ্গো মা আছিলো পিপড়ার মতোন ছট্টো প্ৰজাতির মানুষ
ঠিক আঙ্গো বয়সের পোলাহানের মতোই
আঙ্গো বাবা আছিলো বাঘের মতো
বাঘেরে দেইকা যেমনে জংঘলের অন্য জন্তু জানোবার গুণা ডরাইয়া কাপে
আঙ্গো বাবারে দেইকাও আমরা ডর কাপতাম
আর দৌড় দিয়া যাইয়া মা’র কাপড়ের আচলে পলাইতাম
যেমনে মুৰ্গির বাচ্চারা মায়ের পাকের তলে পলাইয়া থাকে
ঠিক তেমনেই
মা আঙ্গো সাইবটা দরতো
সেই ছট্টো বেলা থিকাই দেকছি
মা সব সময় ডরাইয়া ডরাইয়া থাকতো
সব সময় মার চইখ টলমল করতো
ভাবতাম মার চইখে কোনো বেরাম আছে
কোনো সময়ে মারে জিগাইতাম
মা মিছা কতা কইতো
মা কইতো
‘আর কইয়ো না মা
আইশালের দুমা চইখে যাইয়া চইখ পুইরা গেতাইছে।
জানি না আঙ্গো মা’র কিবা ব্যক্তিগত জীবন আছিলো কি না
বাড়ির সমস্ত কাম, বাবা, দাদা-দাদীর খেদমত করাই আছিলো মা’র একমাত্ৰ জীবন, একমাত্ৰ কাম।
আঙ্গো মারে কোনোদিন আঙ্গো বাবা সাইবটা দবা আমরা দেহি নাই
জানি না মা’রে কোনোদিন সাইবটা দইরা বাবা মা’র ওঁঠে চুমা খাইছে না নাই
না আমার তো বিশ্বাস অইনা
নইলে মা’র ওঁঠ দুইডা অইরহম শুকনা থাকতো না।
শুনছি আঙ্গো মা স্কুলে মাষ্টারগো প্রিয় ছাত্ৰী আছিলো
পড়া পাতিতে খুব ভালো আছিলো
আতের আখরও বোলে খুব সুন্দর আছিলো
মা বোলে খুব ভালো গানও গাইতো
রাইতে বুক্কে সাইবটা দইরা যেশুম আঙ্গো মা গুণগুণাইতো
অনুভব করতাম যেমন
মা’র বুকে মেল্লা আগুন আছে
মা’রে এহন জিগাইলে কয়
না এইন্যা এক সময়ের স্বপ্ন আছিলো
এহন আর সেই স্বপ্ন নাই
এহন খালি কঠিন বাস্তব
মইধ্যে মইধ্যে রাইতে মা আঙ্গো বুক্কে সাইবটা দইরা খুব কান্দতো
খুব জোরে আঙ্গো সাইবটা দরতো
কি জানি বাবারে খুব মিছ করতো
কি জানি বাবারে খুব ভালো পাইতো
কিন্তু না
কোনোদিন মুখ খুইলা মা প্ৰকাশ করা হারতো না মা’র ভালোবাসার কতা
কোনোদিন সময় অইনাই, বাবাৰে কাছে পাইনায়।
কিন্তু এহন সেই সময় নাই
এহন আর আঙ্গো মা’র চইকে পানি দেহি না
এহন আঙ্গো মা খুব ধীর, স্থির,
পাথরের মতো
কিন্তু আশ্চৰ্য এহনো আঙ্গো মা খুব ভয়াতুর
সব সময় ডরাইয়া থাকে
এহন মার ডর নিজেরে নিয়া না
মা এহন ডরাই আঙ্গোরে নিয়া
মা চায়না মা’র নাগাল আমরা ডরাইয়া থাকি
মা চায়না মা’র নাগাল আঙ্গো জীবন রুদ্ধ অইয়া যাইক
মা চায় আঙ্গো নিজের পরিচয় অইক
মা চায় নিজের নাম দিয়া আঙ্গো মাইনশে যানুইক
মা চায় মা যে সব স্বপ্ন দেখছিল
সেই স্বপ্ন আমরা পূরণ করি।
ডঃ রেহানা সুলতানা
সহকারী অধ্যাপক, শিবসাগর ছোরালী কলেজ, অসম।
“আঙ্গো মা”