ফিরে এসো খামার কন্যা (দ্বিতীয় পর্ব)

।। রওশন সালেহা ।।

আমাদের কত বছরের দাম্পত্য জীবন নেহার! এ রকম ভুল তুমি কখনও করেছ? কোনদিন আমাদের গরু-ছাগল বাড়ির আর সব প্রাণী অভুক্ত থেকে ডাক দিয়েছিল? তোমার ঘোমটায় ঢাকা চেহারার যতটুকু খোলা দেখছি, মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া কবুতরের ডানায় যে বাতাসের সুর শুনেছি, সবটাতে কেন খাপছাড়া দুঃখ আনে? আমাদের যে অল্প নিয়ে সুখে থাকার আনন্দ তা বুঝি ছিনতাই হয়ে গেল! এক ফিটফাট তরুণ সারাদিনের কর্মকাণ্ডের ব্যস্ততা দেখিয়ে শুভেচ্ছা কামনা করে দ্রুত পদে চলে গেল! পিছন ফিরে একবারও তাকায় নি, সে কি পলায়ন, নেহার? সেকি তার মায়ের আঁচল কেটেছে? ব্যথা দিয়েছে? বলো, নেহার। আমরা দু’জন দু’জনের কাছে খোলা বই -এর এ পাতা আর ওপাতা নই কি? আমি যে তোমার লুকিয়ে রাখা সেই খোলা পাতা ইতিমধ্যে পড়ে নিয়েছি।

ফিরে এসো খামার কন্যা (দ্বিতীয় পর্ব)

গ্রামে সকাল বেলার রোদ ঘাসের ডগায়, ধানের শীর্ষে আর গাছের ডালে-পাতায় রূপকথার গল্প বলে যাচ্ছে। ধূলামাটির জমিনে শেষ রাতের বৃষ্টিতে এমন ভাবটি ছড়িয়ে রেখেছে। বাচ্চু অবশ্য ঠিক অত ভোরে উঠতে পারে নি। গত রাতের ধকল তার শরীরের উপর গিয়ে কিছুটা আঘাত করে গিয়েছে। তবে ঐ ব্যথার আড়মোড়া ছাড়িয়ে উঠানে পা দিয়ে প্রথমে সে বাপ-মায়ের সেই ঐতিহাসিক ঘরকে চোখ বড় করে দেখে নিয়েছে, কত বয়স? তারাও জানেন না। কেবল শুনেছেন, মাজির নানা, এই পুরান বাড়িটা সখ করে কিনলেন। নাতনির বিয়ের পর উপহার দিলেন। বলছিলেন, মন চাইলে বশীর, তোরা দু’জন এখানটায় এসে থাকবি। বেশ নিরিবিলি। চরের মতো লোকজন এসে বিরক্ত করবে না। রসিক নানা একবার নিয়েও এসে রেখেছিলেন। তার মা-বাবার জুটি ঐ নানাই বেঁধে দিলেন। ‘হানিমুন’ করার কথাও জানেন। ব্রিটিশদের সাথে ঘোরাফেরা ছিল তাঁর। পরিষ্কার রোদ, জংধরা টিনের খামার বাড়ির ঘর, কাঠের দরজা জানালা পুরান ঐতিহ্যের চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ঝড়-বাদল তার অঙ্গে বহু আঘাতের চিহ্ন রেখে দিয়েছে। কাঠের কপাট, দরজা-জানালায় পড়ি পড়ি অবস্থা। কোন্‌ দিন এটি মুখ থুবড়ে পড়ে মা-বাপ-ভাই-বোনকে চেপে মারে, বাচ্চু ভ্রু-কুঁচকে চিন্তা করে। হাতে টুথ ব্রাশ, ঘর থেকে পেস্ট লাগিয়েই এনেছিল বাচ্চু। দাঁতে ব্রাশ ঘষতে গিয়ে মনে মনে ভাবছে, নিজে থাকার জন্যে পাকা দু’টা রুম তুলেছে সামনের দিকে। ইঁট, সুরকি মাড়িয়ে লাভ কী? মা-বাপের দায়িত্ব না নিয়ে এটা সে কি কাজ করল? খুবই অন্যায়, বড় ভাই টাকা কি ওকে দিয়েছে? রাজনীতি করার সখ ওকে এমন স্বার্থপর করল? মাথা খারাপ ছাড়া আর কী। সামনে বাঁশ কতক পড়ে ছিল, বাচ্চু ভাবছে, ওগুলো তুলে এই নড়বড়ে দালানকে ভেঙ্গে দিলে কেমন হয়। বৌকেও উচিৎ শিক্ষা দেয়া হবে। থাকার ঘর নাই, গোসলখানা, পায়খানা কোথায়? বাপের বাড়িতে থাকার যত বায়না? স্ত্রীর জন্যই সে এত নীচে নামল? বাড়ির অযত্নে পড়ে থাকা, পানাভর্তি পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে পা দিয়েই ঝাঁপ দিল বাচ্চু। বেশ ঠাণ্ডা মাথা চুবিয়ে কয়েকটা ডুব দিল সে ডুবুরির মতো।

তখনই মাগুর মাছে ঘাই দেয়ার মতো মনে জেগে ওঠে, ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য যা চাই, সেভাবে ওকে কাজ করতে হবে। আর সব এখন পড়ে থাক। পরে হবে। তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে বড় উঠান পেরিয়ে সে দালানে উঠে। কোনদিকে চোখ দেয় নি। যদি একবার জীর্ন ঘরের সাথে জোড়া দেয়া ছনের চালার মাটির দাওয়াটির দিকে তাকাত, তবে সে দেখতে পেত তার বাজানকে, মলিন চেহারার, অকালে বুড়িয়ে যাওয়া এক হতভাগ্য মানুষটিকে যার পাম্পসুতে তালি মারা, এরমধ্যে ফুটো দিয়ে বুড়ো আঙুল বের হয়ে বুঝি ছেলেকেই পরিহাস করছে। গায়ের ফতুয়ার ছেঁড়া অংশ দিয়ে ভিতর থেকে সাদা শরীর উকি ঝুঁকি দিচ্ছে। একি মাস্টার সাব? সৈয়দ বশীর আলী? বাচ্চু তাকায় নি, কারণ তার বিচিত্র চিন্তাধারায় সে প্রভাবিত। পুরানো, বসবাসের অযোগ্য খামার বাড়ির ঘর আর থাকবে না, পাকা দালান উঠবে, মার্বেল পাথরে খোদাই করে ‘সৈয়দ মঞ্জিল’ নামটি বড় করে লেখা হবে। বাপ-মা পূর্ব-দক্ষিণের ভাল ঘরটিতে উঠবেন। মা পানের বাটা নিয়ে খাটে বসবেন, বাজান হেসে হেসে বামনীর চরের গল্প করবেন। ভাল ঘরে মুক্ত হাওয়া পেলে ওঁদের দু’জনের স্বাস্থ্য ভাল হয়ে যাবে। তার নাম সৈয়দ তৌহিদ আলী। তাদের পূর্ব পুরুষ সৈয়দ ইয়াসীন আলী। সে এখন মুদি দোকানদার নয়, দোকানের নাম দিয়েছে জেনারেল স্টোর, একদিকে ঘর তুলে চায়ের স্টল খুলেছে, টাকা খরচ করলে তবে টাকা আসে। এ নীতিতে সে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে এবং তাতে ঠকছে না। চায়ের দোকানে আড্ডাও জমে বেশ। আশা তাকে তুলবে, চেষ্টা আছে-সে বড় হবে। ছনের চালায় দাঁড়িয়ে বশীর নীরবে ছেলের চলে যাওয়া দেখেন, মনের কষ্ট তাকে কাঁদায়। মনে করিয়ে দেয় চার বছরের শিশু এই বাচ্চুকে। তার বাপ পাগল কান্নাকাটি করার স্বভাবের সেই এক সুমধুর চিত্র। কোথাও যাচ্ছেন বশীর, বাচ্চু, সে যে কি কান্না, ছাগলের বাচ্চার মত তার গুঁতাগুঁতি আর মাথা পিটান রাগ কত! তারপর উঠানে গড়িয়ে চিৎকার;

 “আমাকে রেখে তুমি যেতে পারবে না।”

উঠানের যত ময়লা গায়ে তোলা-এইত করত। বড় বোন খুদুর তখন নাজেহাল অবস্থা। ওকে সামলানো কী যে কষ্ট করত মেয়েটা। স্কুল যাওয়ার সময় পেত না। গরীর বাপ আমি, টাকা-পয়সার অভাবে ওর বিয়েও ঠিকমত দিতে পারলাম না। অথচ কি দেখছি। এই ছেলে সোমত্ত জোয়ান হয়ে এখন আমাদের নিয়ে তামাসা করছে!! এ দুঃখের ভার এত বেশি বশীর সইতে পারলেন না। বসে পড়লেন দাওয়ায়, মাথা ঠেকিয়ে দেন বাঁশের খুঁটিতে। ঝিমিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। হঠাৎ শোনেন, মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখির উড়ে যাওয়ার কলতান, তাদের ডানা ঝাপটায় বেজে উঠে বাতাসে সুরের ব্যঞ্জনা। পাখিগুলো যতদূর গেল, শেষ তক বশীর দেখেন, তারপর দেখেন নিজ বাড়ির নারকেল, সুপারি গাছের পাতায় সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে, সবুজ রং বেশ ফুটে আছে। এসব বশীরের হাতে লাগান, চারাগাছ কিনে এনে বাড়ির পিছন দিকে পুঁতে ছিল, সব বেঁচেছে। শরীর ভাল লাগছে বুঝে রসুই ঘরে আসেন। তোমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় কিছু বলতে এসেছ, কোথায় ছিলে?

নেহার, ছিলাম আমার সেই প্রিয় স্থানে। ঘরের পিছনের দাওয়ায়, তোমাকে জিজ্ঞেস করতে এলাম, এই গাঁয়ে এসে একটা স্কুল দাঁড় করতে লেগে গেলাম, সাথে ছিল রফি, কী উৎসাহই না ছিল আমাদের। তখন বাচ্চু কি করত? চার বছর মাত্র বয়স। ‘ওর সাংঘাতিক জিদ’ স্কুলে যাবে, তোমার সাথে থাকবে, কেবল খুদু ওকে সামলাতে পেরেছিল। লাতুকে তুমি ডেকে সাথে নিতে, তাই ওর অমন চিৎকার, জিদ। ওকে নিতে হবে। না নিলে গলা ফাটিয়ে কাঁদবে। কিন্তু সে বাচ্চু এখন আর নেই, আমাদের সাথে থাকল না, ভিন্ন হল, এখন আমাদের দেখেও দেখে না। বশীর দুঃখ নিয়ে কথাগুলি বলল। তুমি কি ছেলেমানুষ হয়ে গেলে? বুড়ো হলে মানুষ শিশুর মত কথা বলে তা তোমাকে দেখে বুঝলাম। সকালে তোমার চিরতা ভিজানো পানিও খাও নি। মিটসেফের উপর রাখা আছে, খেয়ে নাও তো। বাচ্চুকে নিয়ে আর ভাবাভাবির কী আছে! মাতাল হয়ে এসেও মাথা ঠিক তো রেখেছিল কাল রাতে তুমি শুনেছ, মুখে দুই তালাক পর্যন্ত বলেছিল। শেষের একটা বলে নি। ছেলে বৌ নিয়ে আলাদা থাকবে, নতুন কথা নয়, কিন্তু ও আমাদের ছেড়ে কোথা যাবে? তা ভেবে মনে ভয় ভয় পাওয়া তোমার তা ঠিক নয়। মাজি আমার জন্য নাস্তা বানিয়েছ? দাও। আজ অনেক কাজ, দুপুরে খাওয়ার জন্য লোক পাঠাব। দিতে পারবে? তুই খাবি। আর আমি পাঠাব না? পাগল হলি নাকি? এত কাজ কাজ করিস না, বাচ্চু! এখন পেট ভরে রুটি আর ভুনা গোস্ত খেয়ে ওঠ, চাও খেয়ে যাস। তোর চায়ের দোকান ভাল চলছে কি না, আমি জানিও না- একদিনও ঐ গল্প বললি না তো। মাজি সব ভাল। তোমার বৌমা যদি না আসে তাহলে রাশুকে বলে দিও, নান্টুকে স্কুল থেকে আনতে। আমি এখন নান্টুকে সাথে নিয়ে যাব। বাজান কোথায়? খেয়েছেন? না, সকালে ঐ কবিরাজী ওষুধটা খায়, আজ খায় নি, তোর খোঁজে গিয়েছিল, এখন ঘরে গেল, আসবে, খাবে। তোর খাওয়া তুই খেয়ে নে, বাপু। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। কত আর খাব, অনেক খেলাম মাজি, উঠলাম, বাচ্চু উঠে গেল। হাঁসগুলো একত্রে ডেকে উঠলো বশীর চমকে উঠেন, কাকে দেখে? এই কোলাহল বয়ে নিয়ে হাঁসগুলো ডোবার দিকে ছুটছে, বশীর রসুই ঘরের সামনে এলেন। তার বুক দোল খায়, মুখ থেকে শব্দ বের হল- কে, বাচ্চু!

বাজান, কার কথা ভাবছিলে? বাচ্চু মাথা নুইয়ে পা ছুঁয়ে বাপকে সালাম করে দাঁড়ায়। মুখে হাসির ছটা। বলল, কোন্ ছেলে তোমার কাছে থাকে? লাতু না বাচ্চু। তোমার এই অধম ছেলেটার কথা মনে পড়ে না? আমি বাচ্চু, বাজান। দোয়া করে দাও, মাথায় হাত রাখো। একটা বড় কাজ পাওয়ার চান্স আছে, যাচ্ছি সেখানে। বশীর অনিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকেন, মনে আশংকা, তার সামনে কে দাঁড়িয়ে? তারুণ্যে উজ্জ্বল, সুন্দর স্বাস্থ্যবান ছেলেটি কার? বাড়িঘর জায়গা জমি হারিয়ে ছিন্নমূল পরবাসের এই গরীব মানুষটিকে কেন বাজান ডাকছে, সে-তো ভাগ্যহত বশীর, লোক চক্ষুর বাইরে এক গণ্ড গ্রামের চাষা। বন্ধু রফির উৎসাহে একটা ভাঙ্গা স্কুল ঘর পেয়ে সেটা নিজের শ্রম দিয়ে উপযুক্ত স্কুল ঘর বানিয়ে নিয়েছে। নিজের লেখাপড়া ও চেষ্টা দিয়ে ছাত্র-ছাত্রী গড়ে তুলে নামও পেয়েছিল। বাংলার সবুজ মাঠ, ক্ষেতে ধানের শীর্ষে, সরষে ফুলের হলুদ রঙে, প্রজাপতির উড়াউড়িতে স্কুলটা সুন্দর এক পরিবেশে দাঁড়িয়ে গেল। শিশুরা জামা, বই, খাতা-পেনসিল পায় স্কুল থেকে, ডাক্তার রফিক এসব সংগ্রহ করে এনে দেন। কিন্তু দূরে একটা স্কুলের শিক্ষক-ছাত্ররা হিংসায় উঠে পড়ে লাগে। এ স্কুল ভাঙা ঘরে। মাস্টারও গুরু ট্রেনিং পাস না, তার স্কুল থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়া যায় না। বশীর মাস্টার হলেন কাক পণ্ডিত। তাও-যে চাকরি হারাতে হলো, গুরু ট্রেনিং নেই। স্কুলটা উন্নয়নের আওতায় পড়েছে, সরকারি হচ্ছে। অতঃপর বশীরের নিজের থাকল চোখের সামনে খামার বাড়ি, আর সেখানকার চাষের জমি। তাই হোক, তবে তাই হোক। চাষী বশীর! আহা ভালই তো। বাজান, যাচ্ছি, নান্টু রিক্সায় উঠে গিয়েছে। বশীর হাত তুলে বিদায় জানান, ‘দেখছেন তার দুই বংশক্রম’, জেনারেশন, বর্তমান যুগের হাওয়া এই শহরতলী গাঁয়েও এলো বলে! পরিবর্তন এসেছে অনেক, বাস্তবের রাস্তাই হোক অথবা বেঁচে থাকার তাগিদেই হোক সবই বুঝি গ্রহণের ব্যাপার। স্নিগ্ধ সকাল বেশ তেতে উঠল, রোদ চারিদিকে। বশীর শুনছেন তার উঠানে ক্ষুধার্ত গৃহপালিত পশুদের হাঁকডাক। কী হলো, এগুলো দেখার লোকজন গেল কোথায়। কোনদিন এমন অবস্থায় পড়তে হবে তার চিন্তায় ছিল না। একসময় তার নিজের দায়িত্বে সংসারের এ কাজটি ছিল, করতে আনন্দও পেয়েছেন। বড় ছেলে এসে যোগ দিয়েছে, গায়েই লাগে নি গোয়ালের কাজে, দুধও দুয়েছেন, নেহারও প্রায় এসে দুধ দুয়ে দিত, এখন লোক রেখে চরম হয়রানি? কে জানত এমন বিশ্রী ঘটনায় পড়তে হবে তাকে? বশীর গোয়ালে গিয়ে মাথায় হাত দেন, গরু দু’টার সামনে গামলাগুলি শূন্য। তাদের মুখে শুকনা খড়। দুধ দেবে কিসে? সংসারের আয় আসে যাদের রেখে, তাদের উপোষ রাখা, কি অন্যায় না ?

তিনি ডাকেন, নেহার, দেখে যাও, এদিকে হায় হায় অবস্থা, গরু বায়ুর শুকনা গামলা চেটে খায়। মোস্তফার বাপ যে আসে নি, সেটা জানো না? তোমাকে সে কিছু বলে নি, তুমি এতক্ষণ বাইরে কী করছিলে, সকাল বেলায় রসুই ঘরের কাজ আগে করত আম্বুরির মা, তারপর আম্বুরিকে পেতাম, এখন ওদের শিক্ষিত করছে তোমার মেয়ে রাত, বই পড়ে, হিসাব শিখে-এদিকে আমার কাজ থাকে পড়ে। যত যন্ত্রণা আমার ঘাড়ে, গোয়ালের খবর কখন নেব, বল? মোস্তফার বাপ ছুটে এল। স্যার, আমি এখানে, ছোট সাব ডেকে কাজ দিল, না করলে লাথি মেরে, ঘাড় ধরে বের করে দেবে। ছোট সাব হুকুম দেন, আপনি দেন না। কে হুকুম দিয়েছে। গরু দুটাকে খাবার দিয়ে তবে তার কাজ করা যায় না? তোরা সবই শক্তের ভক্ত নরমের যম। আমি যেমন, আমার গরু-ছাগলও তেমন, তোদের নজরে পড়ে না। বশীর মাথা গরম করে কথা বলে অবশেষে থামেন। দিনটা শুরু হল তাল দিয়ে, তারপর এই গরু ছাগল অবোধ পশুদের গলায় দড়ি বাঁধা, তারা ছুটে বেরিয়ে ঘাস খাবে, দুঃখের কথা, সেটাও তারা করতে পারল না, কাঁদছে। দাদাবাবু, পেন্নাম হই, আমি দেরী করি নি। এ সময়েই আসি। মোস্তফার বাপ সকালে এসে গরুর কাজ করে, ছাগলের দড়ি খুলে ঘাসের জায়গায় টেনে বাঁধে। ওকে রাস্তায় লোক খুঁজতে বলে গেল ছোট সাব। আমরা সকলে তাকে ডরাই, দাদা বাবু।

বশীর নিতান্তই সহজ সরল মানুষ। তারই ছেলেকে বাড়ির কর্মচারীরা ভয় পাচ্ছে, এটাকে তিনি সহজভাবেই মেনে নিয়েছেন। বশীর সরলভাবেই এদের বলেন, আমার ছোট ছেলেকে তোমরা সাহেব বানিয়ে ও যা বলে তোমরা সরল মনে তা মেনে চল, তোমাদেরই ভাল হবে, কাজও ঠিকমত চলবে। আমি সেকালের মানুষ। গোয়াল ঘরের কাজটি সেরে আসো হারু।

নেহার ঘোমটা টেনে হাওলী বেড়ার ওপাশে এসে দাঁড়ায়। হারুকে ডেকে বললো, আজ থেকে আমাদের বাড়ির দুধের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। আমার নাতির জন্য বলছি, বাচ্চুর ছেলে নান্টু আমাদের সাথে থাকছে, দুধ খায় আবার দুধের তৈরি মিষ্টিও খেতে চায়। দু’সের বাড়িয়ে দাও, ছেলেটা পড়া লেখায় ভাল, খেলাধূলাও করে, ওর মা-বাপ কি এসবের খোঁজ রাখে। বাপ থাকে ব্যস্ত। মা যায় বেড়াতে যেন আমারই সব গরজ। হারু বলে, বৌদি আজ্ঞে, আপনি যা বলেন, দুধ নাতিকে খাওয়াবেন তো খুব ভাল। আপনাদের বংশধর। মাথা ভাল হলে সুনাম পাবেন। আর দাদাকে ‘দই’ করে খাওয়াতে পারেন। দুধের সর খেতে দেবেন না।

কেন, এতদিন তো খেয়েছে, ভালই তো আছেন, এখন উনি দুধের সর খেতে চান না। দই খাবে কেন হারু, হজমের জন্য? এটা বয়সের ব্যাপার বৌদি। আগে লোহা খেয়েও হজম করেছেন, এখন শরীরের জোর পড়ছে। দই খেলে শরীর ভাল থাকে। ‘আচ্ছা’ বলে নেহার ঘরে গেল। হারু গোয়ালে গেল দুধের ভাণ্ড নিয়ে। কাছারী হাটে ময়রা দোকানে দুধ দিয়ে বাজার দামে বিক্রি করে আসে হারু, ওকে তারা বিশ্বাস করে। নিজের পাওনা রেখে বিক্রির টাকা বশীরকে বুঝিয়ে দিয়ে যায়। এই যা, আমার খেয়াল ছুটে গেল কোন দিকে? আর একটু হলে দুধ উথলে পড়ে যেত। দুধ চুলায় দিয়ে অন্য কিছু করা যায় না, চুলা নিভিয়ে রেখে আসি। তোমাকে চিরতা ভিজান পানিটা খেতে বলেছিলাম, খেয়েছ? আমি দিই নি তো, মনে করতে পারছি না। খেয়েছি। তবে দু’বার খেলেও ক্ষতি হয় না। এখন আমাকে ঐ তিতা পানি আবার খাওয়াবে? নাকি এক বাটি গরম দুধ দেবে নেহার? আমার কপাল, আজ যে নাস্তাও খাও নি, এ কেমন করে হয়ে গেল! এ ভুল কোনদিন তো করি নি! এসো, চৌকিতে বস। আমি বসব, না বসলে স্থির থাকতে পারছি না। আমাদের কত বছরের দাম্পত্য জীবন নেহার! এ রকম ভুল তুমি কখনও করেছ? কোনদিন আমাদের গরু-ছাগল বাড়ির আর সব প্রাণী অভুক্ত থেকে ডাক দিয়েছিল? তোমার ঘোমটায় ঢাকা চেহারার যতটুকু খোলা দেখছি, মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া কবুতরের ডানায় যে বাতাসের সুর শুনেছি, সবটাতে কেন খাপছাড়া দুঃখ আনে? আমাদের যে অল্প নিয়ে সুখে থাকার আনন্দ তা বুঝি ছিনতাই হয়ে গেল! এক ফিটফাট তরুণ সারাদিনের কর্মকাণ্ডের ব্যস্ততা দেখিয়ে শুভেচ্ছা কামনা করে দ্রুত পদে চলে গেল! পিছন ফিরে একবারও তাকায় নি, সে কি পলায়ন, নেহার? সেকি তার মায়ের আঁচল কেটেছে? ব্যথা দিয়েছে? বলো, নেহার। আমরা দু’জন দু’জনের কাছে খোলা বই -এর এ পাতা আর ওপাতা নই কি? আমি যে তোমার লুকিয়ে রাখা সেই খোলা পাতা ইতিমধ্যে পড়ে নিয়েছি।

নেহারের করুণ কণ্ঠ। বললো, পড়েছ? কী পড়লে, জানতে ইচ্ছা করছে।

পৃথিবীর নিয়মই তাই নেহার, তোমার-আমার জন্যে তা উল্টাপথ ধরে আসবে না। সূর্য পূর্ব দিকে উঠবে, পশ্চিম দিকে ডুবে যাবে। সন্তানেরা মায়ের উপর চড়াও হবে, জোর জবরদস্তি করবে, অতঃপর পলায়ন। মায়েদের জীবনে স্নেহ ধারার কোন দিক পরিবর্তন হবে না। হয় না।

আহা! থামবে তো। নাস্তা সামনে রেখে এত কথা বলতে হয়। আল্লাহ গুনাহ দেয়। খাও তো। নেহার, তোমার ছেলে, পরস্পর দু’টো অকাজ নির্বিঘ্নে করে গেল কিন্তু চুপটি মেরে আছ তুমি । এমন হচ্ছে কেন! ওকে নিশ্চয়ই তুমি ভয় পাও?

ভয় তো আছেই। তা বলে কাজ হবে? কিন্তু আমার ভয় বেশি তোমাকে নিয়ে। তোমারই ডাক্তার বন্ধু আমাকে বলেছে, বশীর ভাই কিন্তু নিজেকে মনে করে সুস্থ। তার শরীর ঠিক নেই, মানতে চায় না। তোমার ব্লাড প্রেসার আছে। ‘হাই’ হলে একশ দশ উঠে যায় নিচের টা। সেটা ভাল না, আমি আগে বেলাড বলতাম, উনি ঠিক করে বলতে শেখালেন। ছেলের উৎপাত আমাদের উপর থাকবেই, তার জন্য দুশ্চিন্তা করতে হবে না। না, নেহার না। বুঝতে চেষ্টা কর, ও তোমাকে টাকার কারখানার মতো পেয়ে বসেছে, ঐ দালান তোলার জন্য যখন তখন জ্বালাতন করবে। সে যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে। ঘরে চাল-ডাল আছে, হাঁস-মুরগীও আছে, আমরা না খেয়ে মরব না, সেটা ৰাচ্চু জানে। অন্য কিছু বোঝে না। বোনের পড়া, বিয়ে, বাপ-মায়ের শরীর স্বাস্থ্য সে বুঝতে চায় না। ঐ দালান তৈরি করা আমার এক নম্বর শত্রু। ওটা আমি এখনই ভেঙ্গে মাটিতে বসিয়ে দেব। বাঁশ দিয়ে তিনবার বাড়ি দিলে ঝুরঝুর করে পড়ে যাবে। জান, আজ সে মোস্তফার বাপকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে, সিমেন্টের গাড়ি আসবে, ইট আসবে, একটা জিনিস খোয়া গেলে, ধমকে গেছে, খুন করবে ওকে। শুনলে কথা? আমি যাচ্ছি উঠানে মজবুত বাঁশ আছে, এখনই ভাঙতে হবে। নেহার আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ওসব না ভাঙতে পারি তো নিজের মাথা বাড়ি দেব। বশীরের চোখ লালচে, উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। আহা করেন কী! আপনার সেই জোয়ানকি আছে, বামনির চরের ভাঙনের সময় যা করছেন? স্টিমারে লোকের ঠেলাঠেলি এক ধমকে ফাঁকা করতে পারলেন! কে যেন বলছিল, “শালা ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান- তুই কোন আন তুন হাজির অইলি?” মাথা গরম আর চোখ লাল করে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলে ওর উপর। আমার কোলে-কাঁখে এই বাচ্চু আর খুদু। পায়ের সাথে লাতু। সব কটা কেঁদে চিৎকার করে ওঠে। হাত থেকে পড়ে যদি যায় তো চিড়ে চ্যাপ্টা হবে শিশুরা। মরিয়া হয়ে আমি আপনাকেই আগে আটকাতে চাইলাম, কারণ আপনার গায়ে। আঘাত লাগলে আমি বাঁচব না, আমার সন্তানরা বাঁচবে না। কী করেছিলে? আমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে, বীর রমণী? না, আমি অত বোকা নই। ঐ লোকটার পক্ষে কথা বললাম। বশীরের মাথা ঠাণ্ডা হতে চলেছে, চোখের রক্ত সরে গিয়েছে। ম্লান চোখে স্ত্রীকে দেখছেন। নেহার বলল, আপনাকে বকেছি এই তো। চোখ রাঙিয়ে তখন বললাম, ওরা জায়গা করে আমাদের তুলল, আপনি ওদের মারতে যান কেন? হক কথা শুনতে খারাপ লাগে, চুপ করে থাকেন। বাচ্চুরে কোলে নেন, ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিলেন, ছেলেটা ভয় পেয়েছিল। তারপর? লোকগুলি তোমাকেই দেখছিল, আর তুমি ঘোমটা টেনে পর্দা করছিলে।

না। মস্ত বড় এক ফাঁড়া কাটল, এই ভেবে ঘোমটা টেনে ঐ লোকটাকে দেখছিলাম, যে আপনাকে ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান বলেছিল। সে কিন্তু মারদাঙ্গা লোক না। ভদ্রই লাগছিল।

লোকটাকে আমি দেখি নি, শুধু লোকজনকে ভয় দেখাতে ওরকম হুমকি দিয়েছিলাম। তোমার তো এদিকে দেখাদেখ-ভাল লাগা হয়ে গেল। এতদিনে চিচিং ফাঁক করলে নেহার? তোমার ছেলে দালান তুলে বাস করছে; তারপর তোমাকে তুলবে। আমার কি উপায় আছে, না ক্ষমতা আছে, ঐ দালানের কাছে যাই! বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব? বশীর হেসে নিলেন এক চোট। টানা ছত্রিশ বছর বিয়ের পর নতুন দৃষ্টি বিনিময় হল তাদের মধ্যে। ভোরবেলায় বাড়ির আঙ্গিনায় টুপটাপ ঝরে পড়া লেবু ফুলগুলো তখনও শুকায় নি, সুগন্ধ ছড়িয়ে রেখেছে। ওদের দৃষ্টি বুঝে নেয়, দু’টো প্রাণ ভরে আছে, ফুরিয়ে যায় নি। বশীর নতুন করে জানলেন, মায়ের মমতা ও দায়িত্ববোধ রোদ বৃষ্টি-ঝড় কোন কিছুতে আটকায় না। আপন বেগে মেলে ধরে বুকের মাঝে। বাপ-আর মায়েতে আসমান-জমিন ফারাক। নির্মিয়মান সৈয়দ মঞ্জিলের দিকে তাকিয়ে অতি জীর্ণ কুটিরের পথে চলতে থাকেন বশীর। মাথার ভার কমতে থাকে। তার বুকে সাহস জমে, সেই যৌবন দিনের মত। মনের সুখে তার গলায় সুর আসে। গান ধরলেন, আমার মন কান্দেরে, কান্দেরে বামনির চরের লাইগা রে, মন কান্দেরে। বশীর এসে দাঁড়ালেন মাটির দাওয়ায়। এখানে দাঁড়ালে সে নিজেকে খুঁজে পায়। পায়ের নীচের মাটি তারই হাতে গড়া জিনিসের। ম্যাজিকের মতো ঘটনা উপস্থাপন করে তাকে নিয়ে দিব্বি মজাদার শো দেখায়। সুখ-দুঃখ আনন্দ নিয়ে বায়োস্কোপ অথবা সিনেমা করিয়ে নেয়। তার তখন এই উজবুক আর জবুথবু মনটিকেও উড়ুক্কু বানিয়ে ছেড়ে দেয়। কৌতুক করার জন্য লজ্জা পাওয়ার শো এনে দিল সামনে। বশীর খুঁটিতে পিঠ ঠেকিয়ে সামনের সুদীর্ঘ শুপারী গাছের ঘন মাথায় ভর করে তপ্ত আবেশে চোখ বুঝলেন। বেলা তখনও গাছগুলোর মাথায় ওঠে নি। আলো আঁধারির লুকোচুরি খেলা সেখানে। এর মধ্যে বামনির চর জেগে উঠেছে তার মুদ্রিত চোখে। বশীর দেখছেন চৌচালা টিনের ঘর থেকে এক তরুণ বাইরে ছুটছে। পিছনে ঘরটির সঙ্গে নক্সাকাটা লাল-সবুজ টিনের হালকা পাতগুলো বাতাসে ঝংকার তুলেছে। ঝকঝকে নীল আকাশ, রোদ চরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, জোয়ার এসে সাগরে খেলছে। তরুণ সাগরের যাওয়ার ডাক শোনে। তার সাম্পান বাঁধা আছে কূলে, এক লাফ মেরে সে সাম্পানে উঠল। মাটির সাথে খুঁটিতে বাঁধা দড়ি আলগা করে বৈঠা নিয়েছে হাতে। ঢেউ এর সাথে লড়তে তার প্রচুর আনন্দ, উন্মাদের মত ঢেউ, সেও উন্মাদের দোস্ত হয়েছে।

ঢেউ-এর উপর ফেনিল পানিতে লাল নীল সাপের খেলা চলে যেন, তার চোখমুখ শরীর ভিজিয়ে দেয়। গায়ের জামা-কাপড় সে আধা করে গুটিয়ে রাখে, তাও ভিজে একাকার। কে যেন হেসে যাচ্ছে খলখল স্রোত ধারায়। কাছে এগিয়ে এসেছে সেই মেয়েটি তার মুখ সকালের সূর্যের মত মধুমাখা। এক আশ্চর্য প্রশ্ন বেরিয়ে এল বশীরের মুখ থেকে– আরে তুমি!

কেন! আমি আসতে পারি না? আসতে নেই?
না, না, না, সে কি কথা! তা কেন- একটুও না। ভুলেও না।
তবে সাম্পান নিয়ে আসো। আমায় তুলে নাও। নেবে না?
কী যে বল! আমি কি নেব না বলেছি? এসো।

মেয়েটির কচি গলায় কুণ্ঠিত রিনঝিন সুর।

উঠব কেমন করে, কাছে আনবে তোমার তরী?
কত কাছে?
আরও কাছে। তোমার হাতে হাত ধরি।

দামাল ছেলের বুক কাঁপে, সাম্পান যত কাছে যায়, দুরু দুরু বুকে সে একটু হাসে। বলে, হাত বাড়িয়েছি, কোথায় তোমার ছোট্ট হাতখানি দুষ্টু মেয়ে, এসো হাতে হাত রাখ।

এক একজন লোক আছে এ জগৎ সংসারে যারা দাঁড়িয়ে, বসে স্বপ্ন-বিহ্বল হয়। কোন দুঃসহ অবস্থা অতিক্রম করার সময় তাদের কখনও হাসায়। বশীর তার ছেলে এবং ছেলের মাকে নিয়ে বাস্তব চিন্তায় খেই কিছুতেই ধরতে পারছিলেন না। মাটির দাওয়া আর ছনের চালার ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকতেই তার কৈশোরের এক সুখী স্বপ্ন সে দেখেছে। স্ত্রী ছিল একটু দূরে। সে তার হাঁস মুরগীকে কিছু এঁটো ভাত ছিটিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ সে দেখতে পেল বশীর ঘরে না গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। কেন দাঁড়িয়েছে, কী কথা মনে পড়ল তার আবার? নাকি দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছে। হতেও পারে, ছেলের ঘর ভেঙে দেয়ার জন্য যেভাবে রেগে ছুটছিল, মনে করেই নেহার বুঝল, মানুষটির বুকে কষ্ট এখনও আছে। দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছ নাকি? হাতের কাজ রেখে, শাড়িতে হাত মুছে নিয়ে নেহার নিঃশব্দে দাওয়ায় উঠল। চমকে উঠে লোকটা কী করে দেখি; ভয় পাবে নিশ্চয়ই। নেহার চঞ্চল নিঃশব্দ পায়ের ছন্দে স্বামীর একেবারে কাছে গেল। বুকের কাছে ঘনিয়ে শেষে সে এক অন্যরকম ঘটনা। এ যে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে, ঠোঁটে তার মিষ্টি এক পতনের হাসি লেগে আছে। এ হাসি সে কবে, কখন দেখে থাকবে। চেনা যেন মনে হয়। বহুদিন আগের হাসি, বামনির চরে। আর দেখতে পায় নি।

ভাল করে দেখতে হবে। এ রকম হাসি যে দুর্লভ, কি মিষ্টি। যেন চোখ মুখ নিয়ে হাসি। নেহার লম্বায় ছোট। ছিমছাম শরীরের। সে একখানা পিঁড়ি যা সবসময় দাওয়ায় পড়ে থাকে সেটা এনে ওতে দাঁড়ায়। পায়ের পাতা উঁচু করে খুব কাছে নিজের মুখখানা তোলে। নিঃশ্বাস চেপে রাখে যেন বশীর জেগে না উঠে। এ দুর্লভ হাসি কেন আর কার জন্যে জানতেই হবে। নেহার মনে মনে বলছিল। বশীর কিন্তু স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে। বলে, দাঁড়িয়ে ঘুমিয়েছি। সেজন্যে ছুটে এলে, যদি আমি পড়ে যাই? তাই তো! তোমার হাসি দেখতে। বলো না, কার সাথে ঐ মিষ্টি হাসি তোমার কী কথা তার সাথে! আমি যে সারাক্ষণ তোমায় ঘিরে আছি। সে কি সত্য নয়? তোমাদের হাস্য তামাসার মধ্যে ঠোনা দেয়ায় তুমি জেগে উঠলে। তোমার হাসিটা হারিয়ে আমার যত না দুঃখ, তার চেয়ে দুঃখ তোমায় জাগিয়ে। নেহারের চোখ ভিজে উঠেছে।

পাগল হলে নেহার। বুড়ো হয়ে গেলাম, এখনও আমাকে বিশ্বাস করতে পার না। শোন, একটা কথা বলি নি তোমাকে।
নিজের গোপন কথা, বলবে কেন? মুখ ফিরিয়ে নেয় নেহার।

সেই উকিলের মেয়ে ঝরণা বিদেশে থাকে। আমার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। বড়লোকের সন্তানেরা শুনি লন্ডন, আমেরিকায় পড়তে যায়, সেও যাবে নতুন কথা নয়। তারপর দেখলাম, বিদেশী খামের মধ্যে তেমন এক ঘটনা। পড়তে যাওয়ার একটা সুযোগ আমি ইচ্ছা করলে নিতে পারি। বামনীর চর তখন একদিকে পাকা ধানের আর সরষে ফুলের বাসন্তী রঙে ভেসে চলেছে, বিদেশী পাখিদেরও আসা-যাওয়া! বশীর বলে যাচ্ছেন। আর শুনতে চায় না নেহার। মুখ-চোখ লালচে, কান গরম লাগলে সে উঠে বারান্দার কোথায় রাখা মাটির কলস থেকে পানি ঢেলে ঝাপটা দিল মুখে, কানের গোড়াতে, তবুও গরম যায় না যেন। বশীর চমৎকার এক হাসি দিলেন। বলেন, না শুনেই এই অবস্থা, তাহলে বলি কি করে, তোমার পান-দোক্তা মুখে দাও। শান্ত হয়ে বস, দূরে কেন, খুব কাছে এসে খাও। শোন, ঐ চিঠিতে আমার বাইরে পড়তে যাওয়া হতেও পারত, না-ও হতে পারত, কারণ আমার ইচ্ছার অভাব। আমি চরুয়া। আমার সব কাজ পড়ে আছে, খাবেন কিনা, উঠেন না হ’লে আমি উঠে যাই। নান্টু বেড়াতে এলো, থাকতে এ্লো। তার খবর করেন আপনি? এত বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকে নাতি। শরীর খারাপও হতে পারে, ভিজে শরীরে কতক্ষণ ছিল। সে, কে জানে! তুমি কখনও আমার উপর রাগ করো নি, আজ ফর্সা মুখটাকে রাঙিয়েছ, বেশ সুন্দর লাগছে। শোনো, ঐ খামে চিঠি ছিল না, বলে বশীর হাসেন, এ হাসি তার রহস্যে ঘেরা। নেহার চোখ তুলে দেখতে থাকে, অবাক লাগছে তারও, এমনটি কবে, কখন দেখেছে স্বামীকে? সে যে বহু আগে। চট করে জিজ্ঞেস করে, প্রেমপত্র নয়? তবে কি দাওয়াত পত্র! ঐ একটা কিছু ধরে নাও নেহার। ফেরৎ দিয়েছি। ফেরৎ দিলেন? তা কি আর করা! পত্রপাঠ বিদায় দিয়েছি। বিদেশ যাওয়ার রাউন্ড টিকেট ঢাকায় গিয়ে আরব আমিরাত অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করতে হত। করি নি। করলে ভাল হত। কেন যাব, এখানেই যে আমার সব কিছু। যত স্বাদ-আহলাদী মিষ্টি একটা বৌ, লেবু ফুলের সুবাস, নারকেল আর শুপারী গাছের ঝড়ো বাতাস, শিশির ভেজা সোনালী ধানের শীর্ষ দুলিয়ে যখন সকাল বেলাতে হালকা সুর তুলে, গাছগুলি দোল যায়, তখন তারও এক নরম কোমল রূপের শোভা আমাকে পাগল পাগল করে। সে কি তোমার কেউ নয়, নেহার। আহ! মরণ আমার, কথা আর তোমার মুখে আসে না? কি বলব, চিরটা কাল আমি এই কাকপণ্ডিতের বৌ-রাণী হয়ে থাকি তবে? এতটুকু বুদ্ধি ঘটে তোমার নাই গো! একটা সার্টিফিকেট আনার এমন একটা সুযোগ! হাত থেকে মাছি মারার মত পতপত করে উড়িয়ে দিয়েছ! নেহার এই ‘কাকপণ্ডিতের বৌ রাণী’ কথা কয়টির উপর তার নারীকণ্ঠের সকল মধু যেন উপুড় করে ঢেলে দিল। বশীর মুহূর্তে ভুলে গেল তার কাঁধে জোয়াল তুলে চাষাবাদ করার কষ্ট, শরীর ক্ষয় করে চুল পাকিয়ে অকালে বুড়ো হওয়ার বেদনা। আর মনের সুখে দেখল, সামনে এক রমণী হাতের মুঠায় তুলে নেয়া পান-সুপারি দোক্তার মোড়ক চটজলদি মুখের মধ্যে ঠেলে দিয়ে লাল রসে ঠোঁট রাঙিয়ে নিয়েছে। আমাকে আল্লাহ একজন সাধারণ ঘরকন্যার মত জীবনযাপন নিয়ে চলতে নির্দেশ দেন, আমি ধর্ম পিপাসু। আল্লাহ রছুলের নির্দেশ মত আমি চলতে পারলে খুশি থাকি। মনে প্রাণে জানি, স্বামী আমার সব, তার ইচ্ছা আমার ইচ্ছা। তবে কিনা বুড়ো বটগাছের ছড়িয়ে দেয়া ঘন ডাল-পাতার মধ্যে যখন লাল লাল ফল দানা বাঁধে আর টুপটাপ ঝরে পড়ে তখন বেশি করে দোক্তা ভরে দু’খিলি পান মুখে টোবলা করে রাখি, কী হবে আমার উপায় কী! আমার মন ছটফট করে কেন? বটগাছের শক্ত শরীরে কুটির রয়েছে। সেই অন্তরালে শুক আর সারী বাস করে, শুকের চিত্ত সারীর জন্যই ক্ষুধাতুর, আর ডাকতে থাকে সারী আয় আয়। বটতলার ফলগুলা কাকে খায়, শিশুরা ঐ নিয়ে খেলা করে। তোমার আমার সে খেলার দিন বহু পিছলেন ফেলে এলাম। এখন এই ক্ষুধাতুর ব্যক্তিটিকে আর কতক্ষণ অভুক্ত রাখবে, বল?

ছোট একটা রসুই ঘর। চুলা জ্বালাতে হয় লাকড়ি, খড়ি এনে, তাও স্তূপ হয়ে আছে একদিকে। সামনের দিকে বড় এক চৌকি পাতা। খানাপিনার স্থান। চুলার উপর দু’টা হাঁড়ি, একটার উপর আরেকটা, কিছু যেন ফুটছে, নীচেরটাতে পানি। উপরে নিশ্চয়ই খাবার? রাঁধুনি যে সামনে নেই।

মনের মধ্যে একটা কথা, রন্ধন কার্য কেবল মেয়েদের উপর থাকে কেন? তিনি চিন্তা করলেন। উৎসাহ নিয়ে হাঁড়ির মুখের ঢাকনা তুলতে হাত দিয়ে বেশ চোট খেলেন বশীর। ঢাকনা হাত থেকে নীচে পড়ে ভেঙ্গে গেল। তা ছিল মাটির। উহ, বলে বেশ একটুখানি শব্দও বেরিয়ে ছিল মুখে।

 দুয়ারে নেহার। নান্টুকে এবং তার সাথে স্বামীকে চড়া গলায় সে কিছু বলছিল, নাতির কাণ্ড দেখতে পাও না? ও সুরকি আর ইঁট ভাঙতে লেগেছে, হাত আর মুখের লাল গুঁড়ো সে খেতে কেমন ওস্তাদ। স্ত্রীর কথায় হেসে বশীর উচ্চ কণ্ঠে বলে, আর একটা পেটুক মানুষের কি অবস্থা দেখেছ? চুরি করে খেতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছি। ওষুধ থাকলে দাও। হাত জ্বলছে।

খুব জ্বলছে, ফোস্কা পড়ল? তবে আর কি, এই মাটির কলসীর নীচে তলানীতে আঙুল ডুবাও, আমার কাছে এই ওষুধ, জলদি ভাল হয়ে যাবে। আমরা মেয়েজাত পুড়েও পুড়ি না, মরেও মরি না। তার শিক্ষা হাতে হাতে পেলে? এবার খুব ভাল হল। এখন চৌকিতে বসে পড়। বিন্নি চালের ভাঁপা ভাত, তাতে আছে নারকেলের দুধ। এর মধ্যে আরও দিলাম গোটা ছয় ডিম। তোমার এত খিদা, চটপট রান্না চড়িয়েছি। দুধ বের করায়ও কষ্ট কম নয়। নারকেল কুরিয়ে, পাটাতে বেটে নিলাম। গরম পানিতে নেড়ে চেড়ে ছাঁকুনিতে ছেঁকে দিতে হয়েছে। তারপর দেখছ তো পানির থেকে ওঠা ভাঁপে চাল সিদ্ধ হয়েছে। হাত পুড়িয়ে যেমন জানলে, খেয়ে বল কেমন মজা।

কথাও শেষ নেহারের, অবাকও হল, সামনের লোকটি স্বপ্নাবিষ্টের মত তাকে তাকিয়ে দেখছে। সে-ই তখন একমাত্র লক্ষ্য স্বামীর কাছে, তার কথাগুলি যাকে এক ফোঁটাও আকর্ষণ করে নি।

কী হল? খুব জ্বালা করছে? কলসীর পানি ঠাণ্ডা নয়, আসছি। ঐ কাঁদামাটি তুলে নিয়ে হাতে লেপে দিই। খেতে পারবে না? খাইয়ে দেব? ভাল কথা। দাদা নাতি বস একসাথে খাইয়ে দিই।

না নেহার, জ্বালা নাই, আমি নিজেই খেতে পারব। দেখি ফোস্কা পড়ল কি? তাও দেবে না? এ হাত তো অন্য জনকে দিয়েছ! কিন্তু আমার স্ত্রীধর্ম, আমিই দেখব তোমার হাত। আমার হাতে আজ তোমাকে খাওয়াব। তুমি আমার সারি, ও রকম করে বল কেন? নাতির সামনে আমার লজ্জা হবে না।

তা তো বটেই! বুড়ো কালের লজ্জা আর কত লুকাবে মনে মনে। শুক বলে সারী, আয় আয়। এমনই করবে—জানি। নান্টু কেঁদে বলে, আমাকে কে খাইয়ে দেবে? দাদিবুজি, মা কবে আসবে, বলো না। মন খারাপ লাগে। তোর বাপকে বল, নিয়ে আসুক, তোর জন্য ওদের কারও মায়া নাই রে, পেয়েছে তো আমাদের দু’জনকে তোর মা-বাপ, নিজেরা ইচ্ছামতো বেড়িয়ে মজা করছে! এটা ভাল না। তুই মন শক্ত কর, আমরা তোকে আদর করছি, করব, গল্প বলব, ওদেরকে ভুলে যা। ভুলব? পারি না। তোমরা সব এক সাথে হয়ে থাকো। দাদাজী, তুমিতো সবার বড়, আমাদের হেড-মাস্টার। বলবে, আমার কথা না শুনলে, তোদেরকে আমি বাড়ি থেকে বের করে দেব। বশীর তো হো হো করে হাসলেন, নেহার নান্টুর কপালে চুমুর টিপ দিয়ে বলে, আমি হাসতে পারছি না, তুই যে একদম তোর ছোটকার মত করে কথা বললি। চোখ ফেটে কান্না আসছে, আমার জাদুমন আজও ঘরে এল না। ওকে তো আমরা ঘর থেকে যেতে বলি নি। বারণ করেছি জাদু তুই যাস না। ঢাকা শহর অনেক বড়, যদি হারিয়ে যাস? তোর বন্ধুরা যদি তোকে খুঁজে না পায়। আমার জাদুকে কেউ খুঁজে পেল না, আমি যে ওর মা। আমিও খুঁজে পাই নি, নান্টু। সেজন্যে তোকেও আমি আর ফুটবল খেলার জন্য দিই না। মানা করি, ফুটবল আমার ছেলে কেড়ে নিয়েছে। এই খেলা আমার দুশমন। এরপর এমন সুস্বাদু খাওয়ার সময়টি নীরবে কাটে। ঘরের পালক বিড়ালটি দুধের হাঁড়ির কাছে একলাফে গেল, কেউ দেখল না। দেখতে পেল নান্টু, সে তাড়া দিতে উঠছে, ইতোমধ্যে বিড়ালটি ঢাকনা ফেলে দুধে মুখ ডুবিয়েছে। নান্টু বিজ্ঞের মতো বললো, ওটা বিড়াল তপস্বী। এতক্ষণ চুপ করে কাছে বসে ছিল এই দুধের লোভে। এ বিড়াল দুধ খেয়েছে, তাড়িয়ে দাও। ও শুধু তপস্বী না, নিমক হারাম। আরে কি কথা বলছিস তুই? ওটা আমাদের দু’জনের প্রিয়, কাছে শোয়, গা ঘষে। মানুষ চলে যায়, বিড়াল বিদায় হবে না। তুই নান্টু, ওকে ধরতেও পারবি না, তোরই বিপদ, দুধ খেয়ে নেবে। কিন্তু বিড়ালটা হিংস্র নয়, কামড়ায় না, আমাদের মতো নিঃসঙ্গ লোকদের এটা সঙ্গ দিচ্ছে। নেহার চুপ হল তো বশীর বলে নান্টু, বিড়াল তপস্বী হলেও সে ভণ্ড নয়। মানুষই ভণ্ড চরিত্রের হয়, বিড়াল নয়, মানুষ ওকে খাওয়া দেবে না। ঠিক আছে, দাদু ওকে আদর করব, তবে তোমার সাথে শুতে দেব না। আমি শোবো, ও আমাকে আঁচড়ে দেবে। বিড়ালটি দাদির বেশি আদরের, নাতির কথাতে না হেসে পারে নি নেহার, বলে, পণ্ডিত দাদার, চালাক নাতি। আমি এখানে ডালা ধরে খই ভাজি কেন জান্যে? উঠে বাইরের লোকজনের কাজকর্ম দেখি। বাড়ির কাজ মোস্তফার বাপ কতদূর জানে? এ লোকটা কেন ইঁট ভাঙতে বসেছে? বশীর বুঝতে পারে না, এই এক মেয়ের মধ্যে কতজন মেয়ে বাসা বাঁধে। দরজার গোড়ার দাঁড়িয়ে নেহার বলে, মাঝে মাঝে একটু দেখাদেখির কাজ তোমারও করতে হয়। নিজের কাজ।

নিজের কাজ কোনটা?
কোনটা, তা জান না? বলতে হবে যখন শোন, ঐ দালানের কাজের জন্য জোর জবরদস্তি করে বাচ্চু টাকা নিক, সে টাকা বাচ্চুর নয়, আমারও নয়, দিচ্ছে লাতু, বাড়িতে আসলে লাতু থাকবে কোথায়, ভেবেছ একবার? সেই একবার এসে বৌ নিয়ে কি হয়েছিল— মনে নেই?
তোমার সঙ্গে লাতুর এবিষয়ে কোন কথা হয়েছে? বাচ্চু যে টাকা কেড়ে নেয়– সেটা ধামাচাপা দিতে হয় দাও নেহার, অন্যকথা টেনে আনা ঠিক নয়।

 ‘এ রকম কথা শুনতে আমার ভাল লাগে না।’ নেহার চেহারা বানিয়ে উঠানে নেমে যায়। নোংরা উঠান, হাঁস মুরগীর গু’তে পা রাখার জায়গাও নাই। মোস্তফার বাপ হাওলাদার বাড়ি বাদ করে সৈয়দ বাড়ির জন্য এখন মোতায়েন! হোক, ফুটোফাটা টিনের খামার বাড়ির উঠান, আবর্জনায় থাকলে কি আর হবে! লাতু যখন বিয়ে করে প্রথমেই অনেক সখ আর আনন্দ নিয়ে এ বাড়ি বৌ-সহ এসেছিল, যা ঘটবার তা ঘটে গিয়েছিল। তা ভাবলে এখন চোখ দিয়ে পানি আসে। এখন সে পানিতে কাজ হচ্ছে, বাড়ি উঠছে। বাচ্চু দোকানটা কিনবার জন্য নগদ টাকা পেয়েছিল, ছেলেটা বেকার ছিল। মুদি দোকান নিয়ে ব্যবসায় নেমে যেতে পারল। এসবই লাতুর অবদান। বড় ছেলে বিয়ে করেছে, নতুন বৌ-নিয়ে আসছে! বশীরের মাথা খারাপ করার মতো অবস্থা! কোথায় তুলবে বৌ, ঘরের মধ্যে বাঁশের বেড়া দিয়ে রুম করা হলে, বাচ্চু কতক কাগজ দিয়ে আঠা বানিয়ে বেড়ার উপর লাগিয়ে দিয়েছিল, ওখানে একটা চৌকি ছিল। নতুন বালিশ তোষকও কিনে আনে সে। নতুন বৌ-এর ঘর বাচ্চু নিজেই সাজিয়ে ছিল। তার মুখে ছিল পূর্ণিমার চাঁদের মতো হাসি। টাকা এভাবেই লাগে।

এ দিয়ে কি সংসারের অভাব, দারিদ্র্য ও করুণ চেহারা ঢাকা যায়? চাষবাস আর দিনমজুর মানুষ, ধান তোলা আর ধান বেচে জীবিকার যাবতীয় খরচ টেনে যারা চলে, তারা কখন বাইরের খোঁজ নেবে, দুনিয়া কোনদিকে চলছে বুঝবে? চরের ভাঙ্গন থেকে যারা বেঁচে এখানে থাকা-খাওয়ার ঠাঁই পেয়েছে তাদের কাছে এ তো বেহেস্ত। লাতু এর মধ্যে বড় হয়েছে, ওর বাড়ি, ওর মা বাবা ভাই বোনের মধ্যে ওর হৃদয়ের সম্পর্ক। পরের মেয়ে, বড় লোকের মেয়ে, রাজধানীর পরিবেশে বড় হওয়া নতুন বৌ বাড়িতে পা দিয়ে ভয়ে কেঁদে দিল। সে ‘বাথরুমে যাব’র মতো কিছু কথা বলতে চেয়েছিল। ছোট বোন যার বয়স দশ-বছর মাত্র সে ছুটে নিয়ে এলো পিতলের বদনা, তেঁতুল আর নারকেলের খোলের আঁশ ঘষে ঐ বদনাকে সোনার মত ঝকঝকে করে। টিউব ওয়েল থেকে পানি তুলে আনে বৌ-এর জন্য। পুকুর ঘাটের অবস্থা খারাপ, ভাঙ্গা ইটের সোপান, পুকুরে আবর্জনার মত শ্যাওলা জমা পানি, রাশু সেদিকে তাকাতেও দেয় নি বৌকে, বলেছে, “ভাবী ঐ গাছের পাতায় ঘেরা জায়গায় গিয়ে বসেন।”
ডাবের পানি এনে দিচ্ছি ভাবী, আমি বাচ্চু, তোমার দেবর, আমি কিন্তু ছাড়ব না, খেতে হবে। এ নইলে কাতুকুতু দিলাম। সে সময় বৌটি ভূতে পাওয়ার মতো চোখ করে ঢলে পড়ে গেল।

ঘরের মধ্যে সুটকেস রেখে লাতু বাইরে এসে প্রমাদ গুণে। বিপদ দেখল। সে আনতে চায় নি। সখ করে আনু এসেছে। লাতু অনেকবার বলেও দিয়েছে, তোমাদের বাড়ির চাকরদের অবস্থাও আমাদের থেকে ভাল, বড়লোকের বাড়িতে কাজ করার জন্য তাদেরও কোয়ালিফিকেশন অবশ্য থাকতে হয়। এ হচ্ছে গণ্ড গ্রাম, একদিকে চরের ধূলামাটির বিরাণ ভূমি আর বাকী দিকগুলিতে গরীব, নিম্ন শ্রেণীর লোকদের বাস। তাদের প্রায় সকলে আমাদের বাড়ির চাষ-বাসের মানুষ জন, শিক্ষাদীক্ষার আলো এখানে এখনও নেই। আমার বাজান অনেক চেষ্টায় একটা স্কুল খুলেছে। গরীবের বাচ্চারা আসে। এলিমেন্টারী এডুকেশন এখানে, বাজান একজন ভাল শিক্ষক। ওদের দেখতেই তো আসা তোমার আনু! আমার মা-বাবা ভিতরে আছেন, ওঠ, দেখ আমার বোন রাশু আর খুদু দু’জনই কাঁদছে।

বাচ্চু ডাবের পানি খাওয়াতে চেষ্টা করে অবশেষে সফল হলো। আনু উঠে বসে। কিন্তু সেই এক কথা, আমি চলে যাব, থাকতে পারছি না।

লাতু মায়ের পায়ের উপর পড়ে কাঁদে, মাফ করে দাও মাজি, আমি চরম ভুল করলাম, তোমাদের স্নেহ-ভালবাসার গল্প এত করেছি, কিন্তু বাড়ির আর সব যা দেখে ওর চোখ অন্ধকার লাগছিল, সে সম্পর্কে বলার কথা একটুও মনে আসে নি। আমি আবার আসব আনুকে নিয়ে। ও অনেক ভাল মেয়ে, আসবে তোমাদের কাছে। বাড়ির অন্যান্য ব্যবস্থাগুলো করিয়ে নেব। বাচ্চু তো আছেই।

নেহার চোখ মোছে, কি বলেছিলেন ছেলেকে তখন, তা কি ভুলবার? তোর কি মাথা খারাপ লাড্ডু? আমার বাড়ির বড় বৌ, সে আসবে, থাকবে। গ্রামের মানুষের সাথে মিশবে আমি বিশ্বাস করি, আমার মনে কোন কষ্ট নাই। দোয়া করি পরের বার বৌ নিজের বাড়ি ঘর চিনবে।

 মা’জী… আমার এখন সত্যি মন খারাপ, মাথা খারাপ নয়। এখানে এই বাড়িতে শহরের দালান থেকেও ভাল এক বাড়ি তুলে দেবো। তোমরা এত কষ্ট করেছ আমাদের বড় করার জন্য। পড়া শেষ করতেই বিয়ে করে এক ভুল, করলাম। ছেলের কথা থামিয়ে দিলেন বশীর, ভুল করিস নি তুই, সব আল্লাহর দান। এই যে আমার বৌমা নিজের ইচ্ছায় এসেছে, তুই নিয়ে আসলি।

গৃহলক্ষ্মী আমাদের দেখতে পেলাম, আনন্দে চোখে পানি। মন বলে- এ বাড়ি আর এমন থাকবে না, বৌ থাকার মতো বাড়ির চেহারা হবে। বাচ্চু বলেছিল, ভাবীকে আর কষ্ট দিয়ে লাভ কি, রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুম রেডি রাখতে লোক পাঠিয়েছি। এদিকে পালকি খোঁজ করছি, ভাবীকে রোদে হাঁটিয়ে আনা ভাইয়ার বোকামী, রোদ মাথায় লেগেছে, রাস্তাও খারাপ। সবটা মিলিয়ে কাজটা ভাল হয়। নি। সৈয়দ বাড়ির বৌ। এ কি যেমন তেমন কথা? আট বেয়ারার পালকিতে চড়ে তিনি স্টেশন যাবেন। দশ জনে দেখে বাহবা দেবে। বাচ্চুর কথাই এমন, কান্নাচোখে হাসি ফোটাতে কম যায় না। বাড়ির উঠানে লাল মখমলের কাপড়ে সাজান আট বেয়ারার পালকি এলো। বৌকে তোলা হল, বাড়ির লোকজন এ দৃশ্যে চমকে উঠল। রাজসিক ব্যাপার। এরা কোনদিন দেখেনি, বৌ বড়লোকের মেয়ে, রাজরাণী হয়েছে। বাচ্চুর মাথায় বুদ্ধি আছে, ভাবীকে খুশি করলে তার আখের ভাল হবে, কথা ঠিক। শেষে ভাবীকে আসার জন্য সে ‘থ্যাংক ইউ’ পর্যন্ত বলেছে হেসে। আর লাতু তার বখে যাওয়া ছোট ভাইকে বুকে নিয়ে পিঠ চাপ্‌ড়িয়ে বলল, দোকানটা কিনে ফেল, নতুন করে লাইফ স্টার্ট কর ভাই, কত টাকা চাই! আমার কাছে এখন বেশি নেই। সবই দিয়ে যাই, টাকার জন্য ভাবিস না। ভাল কথা—তোর ভাবীকে খুব পটিয়েছিস বাহারী পালকি চড়ালি—এ গল্প করতে করতে ওর এ বাড়ির সব ভাল লেগে যাবে। দুঃখের অতীত সাগরের ঢেউ, সময় মত খেলে। নেহার স্বামীর উপর রাগ করে ঘর থেকে দালান তোলার কাজ দেখতে এসে কি দেখল? চোখের সামনে কতক ছেলে-বুড়ো হাতুড়ি দিয়ে ইঁট ভাঙার কাজ করছিল। তা সে একটুও দেখে নি, শব্দও শোনে নি, তাইত! এত শব্দের মধ্যে সে একলা থাকার নীরবতা পেয়েছিল সে তাতে অবাক হলো। বুকে খচখচ করে একটা কথাই আসে, আমরা কি মানুষ না? বৌ আসল, আমাদের দেখে ভূত দেখার মত ভিমরি খেল? আর দুই ছেলে? দুইভাবে তাদের ঠেলে সরিয়ে রেখে কী করল? তারাই সব- আমরা কেউ না। অপমানের জ্বালায় নেহার তার শেষ আশ্রয় স্বামীর কাছে চলে আসছিল। হাওলীর বেড়ার গণ্ডি পেরিয়েছে তো মোস্তফার বাপ, এসে গলা খাঁকারী দিল, কিছু বলবে বলে। ডাকে, ‘ভাবী’
ছোট সাবের দুপুরের খানা নিতে বলে গিয়েছিল। দুপুর হয়ে আসল, কখন নেবো?

কী রাঁধব? একটা মুরগী ধরে জবাই করো, তরকারীর ক্ষেত ঘুরে যা পাও, নিয়ে আস। ঘরে কিছু ছিল না। তোমাকে খুঁজছিলাম, এতক্ষণ কোথায় ছিলে! মোস্তফার মাকে ডেকে দেবে? উঠানে দাঁড়াতে পারছিলাম না, এত নোংরা, ঝাড় পড়ে নি আজকে? তুমি ছোট সাবের কাজে এত লেগে থাকলে এদিকের কাজ কে করে?

ছোট সাবকে বলবেন ভাবী, আমি ডাকলে কেউ আসে না। আপনি যাদের থাকবার জায়গা দিলেন, এখন গিয়ে দেখেন, সব শত্রু। তারা আপনার পিছনে কথা বলে।

তোমার বৌকে ডেকে আনো, সেটা পার তো যাও, বলবে আমি ডাকছি। নেহারের কথায় এবার কাজ হল, অল্প সময়ের মধ্যে মোস্তফার মা মরুকে আসতে দেখা গেল। চট জলদি সে উঠান ঝাড় দিতে লেগে গেল। নেহার বলল, ভাল করে ঝাড় দাও, দেখছ না, হাঁটতেও পারছি না, দু’দিন হল আস নাই। আগে কি এমন করতে? আমি এখনো বেঁচে আছি। মরি নি।

ভাবী, আপনি অনেক দিন বাঁচবেন। কি আর বলি আপনাকে, কাঁথা সেলাই-এর কাজ করি, নিজের সংসারে একা তো, মোস্তফার বাপ তো সারাদিন আপনাদের খেদমতে থাকে।

নেহার কথাগুলি আমলে নেয় না। এদের ইদানীং মুখ ফুটেছে, তাই বলে আস্কারা দিতে হবে কেন? বলল, তোমারও এ বাড়িতে কাজ আছে মোস্তফার মা, রসুই ঘরে বাঁসি, এঁটো সবই নোংরা পড়ে আছে, রাঁধন বাড়ন না হয় আমি করলাম। তরিতরকারী কুটে, রান্নার পানি তুলে দিয়ে যাও, ছোট সাবের খানা পাঠাতে হবে আজ।

তখন ক্ষেত থেকে কুমড়া ঝিঙ্গা শশা ডাঁটাশাক তুলে এনেছে মরুর স্বামী। বলল আমি মোরগটা জবাই করে দিয়ে আসছি। তুমি পারলে পাকের ঘরের সব কাজ করে দিও মরু। ভাবীর বোধ হয় শরীর খারাপ।

মোস্তফার বাপ না দাঁড়িয়ে চলে যায়, বৌকে কথা বলার সুযোগ দিলে তারই বিপদ।

নেহার পান মুখে না দিলে মেজাজও ভাল থাকে না। ঘরে এসে পানের বাটা নিল। নান্টুকে দেখছিল, সে বেশ মনযোগ দিয়ে দাদুর কাছে পড়ছে। নাতিটা বাপ ডিঙ্গিয়ে জেঠুর মত হচ্ছে। নেহারের মন খারাপির মলিনতা মুখ থেকে এবার সরে গিয়েছে। অনুচ্চ স্বরে বলে, আল্লাহর রহমত। বাচ্চুর মাথায় জ্ঞান বৃদ্ধি কম ছিল না, দুষ্টামি করে পড়ল না। ছেলেটার মধ্যে পড়ার আগ্রহ আছে। বলে, জেঠুর মত হতে হলে কি করতে হবে দাদু?

বাংলা, ইংরাজি, অংক বেশি মনযোগ দিয়ে পড়বি, শিখবি, লিখবি, বাকীগুলিতে যেমন তেমন বলে বশীর একগাল হাসেন।

দাদু-নাতির পড়ার টেবিল থেকে লাতু নিয়ে কথাগুলো সুরের মতো নেহারের হৃদয়কে আন্দোলিত করে দেয়। তার লাতু সর্বক্ষণ বাপের সাথে চরে বেড়িয়েছে। আজও বাড়ি আসলে বুঝি তেমন করে, বাপের এত নেওটা, অথচ না বলে বিয়ে করে নিল। বৌ নিয়ে ছুটেও এল! লাতুর মেয়ে হলো। বলল, একটা নাম দাও তো। বশীর দেয় কাজল, নেহার বলে সুরমা, ছেলে খুশি। তার মুখ ভরা হাসি তখন ছিল দেখার মত। খুব হেসেছিল, তবে বৌ ডাকছে ‘ডায়না’, সেটা তার পছন্দ হয় নি। তারপর ছেলে হলে সেই একই কাণ্ড, দাদু বলেন, কমল। নেহার দিল নূহ নবী। তারপর লাতুর মুখে সেই হাসি। বলে দিল বৌ হয়তো মাজির নামটা রাখতে পারে, তবে ডাকবে নোয়া (NOA)। ঢাকা থাকতে ছেলের কেবল ছুটাছুটি। মা-বাপের কথা মনে হলেই ছুটে এসেছে। কী জানি ওর বাপ কেন বড় ছেলের জন্য এত ভাবেন? তার মনের ভয়, তার এই ছেলের মন নিঃসঙ্গ, বড়লোকের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বৌ। সে কী করে লাতুকে বুঝবে? ওর মনের চাওয়া হল এই বাংলার গাঁয়ের কথা, চলা ফেরা, মুখের আহার, তার ডাল, ভাত শাকসব্জি-ছোট মাছ-শুটকি আর কচুর লতি।

নেহার এতটা মগ্ন ছিল যে মুখে পান যেমন দিয়েছিল, তেমন রয়েছে, চিবিয়ে এক ঢোক গিলতে ভুলে গিয়েছে। ওদের বাপ ছেলেতে একবার লাতুর দুই ছেলেমেয়ের ফটো নিয়ে কি যে কাড়া কাড়ি লেগে গেল।

 আমাকে দে লাতু, ছবি দু’টো আমার। ওরা আমার কাছে থাকে না, আমার মন ঠাণ্ডা করবে শিশুরা। তোকে দেব না। বশীর ছেলের পকেট থেকে ছবি ছিনিয়ে নিতেই লাতু কেড়ে নিয়েছে। এরা সব সময় আমার পকেটে থাকে। মন চাইলে দেখি।

 ওরা সবসময় তোর কাছেই আছে। আমার কাছে নেই। আমি দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাব রে লাতু! বুড়ো বাপ, তোর গাঁয়ের চাষা। বশীর মাস্টার, সে কাকপণ্ডিত।

 বাপের হৃদয় স্পর্শী কথার মধ্যে কার না অশ্রু নেমে আসে! তিনজনের সজল চোখের ধারায় মধু ঝরছিল। লাতু বলল, বাজান, এগুলো তোমার। নাও, চুমু খাও, বুকে চেপে ধর। আর কাড়াকাড়ি করব না। মাকেও দেখতে দিও।

সেদিন ছিল আষাঢ়ের মেঘলা দুপুর, রাশুর ঘরের চৌকিতে ওরা দু’জন বসেছিল, বর্ষার পানিতে রাঁধনের জন্য কিছু ঘরে ছিল না। চারিদিকে পানিতে ডুবে আছে, নিরুপায় মা পুঁটি শুটকি নিয়ে কচুর লতির পাতোড়া আর কাঁঠালের বিচির ভর্তা সামনে দিল খেতে। ডিম সিদ্ধ করতেও মনে ছিল না। দুধ ভাত খাবে পাকা কলা মেখে। আণ্ডাপাতি মুরগী ধরতে গিয়েছিল, কিন্তু লাতু দিল না, সে বলে দেয়, মাজি যা দিয়েছ এসব পেলে কি লাগে তোমার ছেলের? ভুলে গিয়েছ? ‘ডুবা হানিতে আঁত ডুবাই কচুর লতি আনতে, জোঁকের কামড় খাইছি, তাও ছাড়ি নাই, লতি টানি ছিঁড়ি আনছি, না আইনলে কিয়া খাইতাম!’ (ডুবা পানিতে হাত দিয়ে লতি টেনে এনেছি। না আনলে কি খেতাম।)

চমকে ওঠে নেহার। এক ঝলক গরম বাতাস অযাচিত উড়ে এল জানালার জাফরী দিয়ে, দুপুর? নান্টু আর তার দাদু তখনও বই-খাতার পড়ালেখায় লেগে আছে। নেহারও মনে করে লাতুকে। তখন বাড়ি আসত ঘনঘন। কত ভাল দিনগুলো তাদের লাগত, বাচ্চুও ভাই থেকে টাকা পেত, তারপর আমেরিকায় পড়তে গেল। থেকেও গেল সেখানে, কত দূর? সহজে কি আর আসা হয়?

দূর বলে নয়, সময় করতে পারে না। মাকে লাতু বলেছে, চাকুরীর কাজ সোজা, কিন্তু অন্য যা করতে হয় তা নিয়ে অনেক বইপত্র আছে। বাড়তি পড়ালেখা করতে হয়। নতুন ধরনের লেখা। রাত কেটে ভোরও করে ফেলে সে। গরীবের ঘরে এ ছেলের জন্য, কিন্তু রক্তের ভিতর যে পড়ালেখা রয়েছে। ছেলে তার কাছে আল্লাহর নেয়ামত, আমানত রেখেছে এই তো! নেহার মোনাজাত করে শেষে বলে শোকর আল হামদুলিল্লাহ।

পুকুর ঘাটে হাতমুখ ধুয়ে নিতে যাচ্ছিল সে, ‘ভাবী’ কোনানে যান, মোরগের সালন (তরকারী) আরে রাঁধেন, আই যাই গই। | আমি যাই এখন।]

তুই যাবি কেন মরু, খাবি না? মুরগী আজ তুই রেঁধে যা, আমি এখন আর রসুইঘরে যাব না রে মরু। নান্টুকে গোসল দেব, তোদের মাইর সাবকে একটু মালিশ দিতে হবে, জানিস! বড় ছেলের খবর পাতি না পেলে ওর দুশ্চিন্তা বাড়ে, আর বুকের বাঘাটাও কিলবিলায়। বাপে-ছেলে যে এমন মিশ খায়, কখনও শুনি নি, মায়ে-মেয়েতে থাকে শুনতাম, এখন শুনি মেয়েরাই মায়ের কথা শোনে না। উল্টা ঝগড়া করে। দিন আগের মতো নাই। তোর এক ছেলে, তুই বেঁচে গেলি।

ভাবী, আপনার ছেলেটা ভাল, কিন্তুক রাইত করি আইলে বুঝবেন কিছু একটা আছে-খবর হয়।

তুই মোস্তফার বাপকে ত ইচ্ছা করি পাহারার কাজে রাখলি, তুই সেটার কথা দেখি ভাল বুঝিস। এখন বাড়ি চলে যাওয়ার কথা কেন? কাঁথা সেলাই আজ না করলে হয় না! তুই কি আগের মত আছিস, সারাদিন এই বাড়িতে গড়াগড়ি দিতি এখন বাইরের কাজ করলে নগদ পয়সা। আমার বাড়ির পয়সা তোর চোখে পড়ল না?

ভাবীর মন ভাল না, ঠিকই। মরু আর কথা বাড়ায় না। রাঁধন-ধোয়া-মোছা করেই বাড়ি যাবে সে।

নান্টু ছুটে আসে। দাদি, আমি গইযুম (পেয়ারা) খাই, তুমি এক কামড় লও আমার থেকে, খেয়ে দেখ কত মিষ্টি, চিনির মত।

 তুই খা, আমার মুখে পান। তোর দাদুকে একটা কামড় দিতে বল, দেখবি, তোর গইয়ুম তুই আর খেতে পারবি না। তিনি চার কামড়ে গোটা পেয়ারা খেয়ে শেষ করবেন। তুই খেয়ে ফেল। বৃষ্টির পানি পেয়ারার গায়ে পড়লে, এগুলো যেমন বড় হয় মিষ্টিও তেমনি হবে। এখন রাতদিন বৃষ্টি, আর এই পেয়ারা গাছের চারা যে তোর দাদু আর জেঠু মাটিতে পুঁতে ছিল তাই এত মিঠা হয়েছে, ওরা দু’জন গাছ লাগাতে অনেক কেরামতি করে।

কী বুদ্ধি করে বলা না।

আমি জানি না-রে নান্টু, আমার কাজ রাঁধন-বাড়ন আর সবাই এসে বসবে, খাবে, দেখলে আমি খুশি। গাছ পালা নিয়ে তোর দাদুর কাজ, তোকে উনি একটা গল্প বলছিল না? মনে নেই তোর? গাছ তুলে ফেলছিল বলে কত দুঃখ তার। আমি যাই ভাই, রাঁধতে হবে। দাদু কোথায়?

ওমা, দেখ নি? তিনটা গরুর গাড়ি ওখানটায় এসে দাঁড়াল। দাদু শব্দ পেয়ে বের হয়ে যায়। আমি ছুট দিলাম। দেখে এলাম দাদু সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।

পেয়ারা শেষ হতেই নেহার বললো, এবার দাদুর কাছে যা ভাই, দু’জনে একটু পর পুকুর ঘাটে আসবি, গোসল করবি, কিন্তু তুই পুকুরে নামতে পারবি না। টিউব কলে দাদুকে দিয়ে চিপে পানি তোলাবি, আমার এদিকটা কাজ শেষ করতে হবে।

বুঝেছি, আব্বুর জন্য ভাত পাঠাবে, আমার আব্বুকে তুমি খুব ভালবাস, একটুও বকতে চাও না, কেন আব্বু বাড়ি এসে খেয়ে যায় না? বুজি, ওকে বলে দেবে- বাড়ি এসে ভাত খাবি, সবার সাথে বসে কথা বলবি, না শুনলে তুমি বকতে পার না বুজি। আব্বু তোমাকে ফাঁকি দিতে ওস্তাদ। আসে না। মায়ের কতা শুনতে হয়, তাই না? জেঠু তোমার কথা শুনে কত বার দেখতে আসে। আমি জেঠুর মতো হবো।

কেন ওর মত হতে যাবি! তুই তোর মত বড় হবি।
না বুজি। জেঠুর মত, আমাকে কত আদর করে, জান কি করেছে সেবার এসে। আমি মোটে সাত বছর, ক্লাশ থ্রিতে পড়ি।

নেহার হাতের কাজ রেখে উৎসুক চোখে তাকায়। নান্টু অতি উৎসাহে চোখ বড় করে বলে দিল, জেঠু আমাকে নিয়ে ধান ক্ষেতের আইল ধরে ধরে হেঁটেছেন। দু’জনই খালি পায়ে, কাদামাটি মেখে নিলাম পায়ে। আমি বলি, জেঠু একি করলে, মা যদি শুনতে পায় আমাকে ভীষণ বকুনি দেবে। শাস্তিও দিতে পারে।

বকবে? কেন? বলে জেঠু এমন অবাক হল যে আমি কি উত্তর দেব, জানি না। শেষে উনিই বললেন, ওর বোধ হয় কাদামাটিতে হাঁটতে হয় নি, জানে না। এ জন্যই তোদের সর্দি জ্বরের ভয়। ভুগতেও দেখি। ছোট থাকতে এ অভ্যাস করতে হয়, করা দরকার। মাটির মায়া। খালি পায়ে হাঁটলে, শরীর ভাল থাকে। বাংলার মাটি গায়ে যদি না নিই তবে বাঙালি হওয়াই বৃথা। নেহার হেসে উঠল, বলল, এই কথা! এত মজা পেয়েছিলি। তাই জেঠুর মত হতে এত পাগল। জানিস ওর মত হতে অনেক লেখাপড়া লাগে, জ্ঞান বুদ্ধি থাকতে হয়। স্বভাব ভাল হতে হয়। গরীব-ছোট যে ধরনের মানুষ হোক তাদের সাথে মিশতে হয়। অহংকার করতে হয় না। নেহার একটু স্নেহকাতর তো হলই, অন্যমনস্ক হতে দেরী হয় নি তার। বড় ছেলের কত গুণ! মা হয়েও কতটুকু সে বলতে পারবে, ‘আপনারে বড় বলে, বড় সে নয়/ লোকে যারে বড় বলে বড় সে হয়।’ এ হলো বশীর মাস্টারের আদর্শের কথা, তার বড় ছেলে বাপের বেটা হয়েছে। এই বুজি! আমার যে খিদা লেগে গেল। তোমার মন এখন জেঠুর জন্য কাঁদে, আমি জানি, দাদু এদিকে আসছে দেখ। গোসল করবে। তার হাতে লুঙ্গি গামছা। তোরা গোসল করে আয় ভাই, আমার রান্না শেষ। তোর বাপের খাওয়াও টিফিন কেরিয়ারে সাজিয়ে দিতে হবে এখন। বাচ্চুর খাওয়া টাইম মতো যাওয়া চাই, সাহেবদের মতো দিন দিন মতিগতি হচ্ছে। তার হল-দালান তুলব, বড়লোক হবো, সাহেব সুবার মতো চলব, আর তাকে নিয়ে যন্ত্রণার শেষ নাই এই হতভাগা মায়ের।

ছবি-লুবনা চর্চা

ফিরে এসো খামার কন্যা (প্রথম পর্ব)

রওশন সালেহা

রওশন সালেহার জন্ম নোয়াখালী, ১৯২৯ সালী ১ জুলাই। বাবা ছিলেন আইনজীবী। কলকাতায় ম্যাট্রিক ও আইএ পড়েছেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের পরে বিএ পড়বার সময় দেশে ফিরে এসে শিক্ষকতা শুরু করেন। বৈরুতে আমেরিকান ইউনির্ভাসিটি থেকে শিক্ষা প্রশাসন (UNESCO), দিল্লী এবং ব্যাংকক থেকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে প্রশিক্ষন নিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের জনশিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকা থেকে ডিডিপিআই পদমর্যাদায় অবসর নেন। তাঁর প্রবল সাহিত্য অনুরাগের জন্য তিনি তাঁর সমকালীন বাংলাদেশের প্রধান প্রধান অনেক কবি সাহিত্যিকদের প্রায় সকলের সঙ্গেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর ‘আমার এক নদীর জীবন’ প্রকাশিত হবার পর আত্মজৈবনিক সাহিত্য তিনি শক্ত স্থান দখল করে নেন। ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত।

Share