বসন্তের হসন্ত

।। পৌলমী গুহ ।।

দোষ কার? জুকারবার্গের? রাজনৈতিকদলের? পুঁজিবাদের? হবে হয়তো। অতো ভাবতে গেলে চলবে না। ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’-র ঠেলায় কচি কচি কন্ঠ রাতদিন এক করে গান গায়, নাচে। আরেকটু বড়োরা দোকান ঢুঁড়ে শাড়ি-পাঞ্জাবি গয়নার সমাহার খুঁজতে ছোটে। নব্য এলিটরা ঠান্ডা পানীয় হাতে ‘খিচিক’-এর টানে শান্তিনিকেতনে ভিড় করে। তাহলে বসন্তের আগমন হয় কখন, কারা জানে তাকে, কারাই বা আনন্দে নেচে ওঠে?

খিচিক!

এই শব্দটার ওপর নির্ভর করবে ক’গ্রাম বসন্ত এসেছে।

বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আসুন আলাপ করিয়ে দিই লাইক-দিদি ও রিঅ্যাক্ট-দাদাইয়ের সঙ্গে। আপাতত যাঁদের আশীর্বাদধন্য না হতে পারলে পরলোকগমনের পথেও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। এঁদের অনুকম্পায় ঋতুরাজ কেন থরহরি কম্প? তা জানতে হলে দেখে নিতে হবে মানবসভ্যতার উত্থানের কাহিনি। আপাতত মুখবই রেখে গল্পে আসুন।

দোল বলুন, হোলি বলুন কি হোরিই বলুন, বসন্তে এই রঙমিলান্তি খেলা প্রকৃতি থেকে মানুষ ধার নিয়েছে বেশ কয়েকশতক আগেই। ব্রজে গোপিনীদের সঙ্গে মত্ত শ্রীকৃষ্ণই হোন কি দুর্ধর্ষ বীর রাজপুতরাই হোন। দোলখেলার সঙ্গে মিশে আছে প্রকৃতি, প্রেম, বসন্তের মনোমুগ্ধকর লীলা। আজকাল যদিও উষ্ণায়নের ঠেলায় শীত বিদেয় নিলেই গরমের কামড় পড়ে, তবু তারই ফাঁকে বসন্তের একটু-আধটু উঁকিঝুঁকি চলে। বাঙালির দোল বহুদিন আটকে ছিল বসন্তোৎসবে। পাড়ার মোড়ে একখানা স্টেজ বেঁধে দোলপূর্ণিমার আগেভাগে খানকয়েক রবীন্দ্রসঙ্গীত, একটা নাটক, গুটিকয় বক্তৃতা দিলেই বসন্তের প্রতি সম্মানজ্ঞাপনা হয়ে যেত। আর আতর অথবা গোলাপ জলের ঝারির বদলে আবির, মিষ্টিতেই বাঙালির দোল শেষ হয়ে যেত।

কিন্তু দিন বদলাল দ্রুত। আর গ্লোবাল বাঙালির পশ্চিমবঙ্গীয়দের বসন্ত অভিযান রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে খোদ রবিঠাকুরের দাড়ি টানাটানিতে পৌঁছে গেলে আশ্চর্য হবার কিছু থাকল না। কিছু কলকাত্তাইয়া এলিট বাঙালি (ওই আতর-গোলাপজলের ‘বাবু’ সম্প্রদায়ের আধুনিকীকরণে প্রসূত!) শান্তিনিকেতনকেই বসন্তের ব্রজ বানিয়ে ফেললেন। তাঁদের পদধূলিধন্য বসন্তকুঞ্জ আর পড়ে থাকল না। একখানা মুখবই ও খানকতক ক্যামেরা নিয়ে ‘রে রে রে’ বসন্ত-অভিযানে যাওয়াকেই বাঙালি ঐতিহ্য ঠাউরে নিল!

এবার এই ঐতিহ্যের পেছনে কারণ খুঁজতে বসা বাতুলতা। বাগবাজারের মাছের কচুরি, গোলবাড়ির কষা মাংস, মিত্র ক্যাফের ফিশ ফ্রাই এসবই হল ঐতিহ্য। ‘বাবু’ বাঙালিদের এই  ঐতিহ্যের নামে আপনি আলুনি মাংস অথবা ঠাণ্ডা পরোটাও সোনামুখ করে খেয়ে নেবেন। তেমনই কুলকুল করে ঘেমে, কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে, লোকের বগলের গন্ধ শুঁকে একখানা হলুদ পাঞ্জাবি অথবা শাড়ি পরে শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসবেও যাবেন। না গেলেও হত। আপনি জানেন সে কথাখানা। তবু যাবেন কারণ আপনার পিসতুতো দিদির মাসতুতো খুড়শ্বশুর আপনার চাইতে লাইকদিদিয়ার বেশি প্রিয়। আপনি যাবেন কারণ না গেলে আপনি পিছিয়ে পড়বেন। আপনার রবিঠাকুরের লেখাপত্তর নিয়ে জ্ঞান ‘আমাদের ছোটো নদী’-তেই শেষ হলেও আপনি বাধ্য যেতে। লাইক-দিদি বিরূপ হলে আপনার জীবনে এই বসন্তের থাকা না থাকায় যায় আসে না; আপনাকে বসন্ত নয়, আপনাকে ছেঁকে আনতে হবে কভার পেজে সাজানো স্মৃতি। যে স্মৃতি নিজস্ব নিয়মে তৈরিই হয়নি, আপনি তৈরি করেছেন যাকে। আপনার হাতে এই অসীম ক্ষমতা থাকলে আপনি তার সদ্ব্যবহার করবেন।

তারপর আসবে ‘খিচিক!’ এই খিচিকের টানে আপনি পথচারীর গায়ে ধাক্কা দিতে পারেন, সংরক্ষিত অরণ্যে ঢুকে উদ্দাম নৃত্য করতে পারেন, ইতিহাসপ্রসিদ্ধ স্থানে গিয়ে দর্শনার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা না দেখেই সম্পূর্ণ অকারণে অঙ্গভঙ্গি করতে পারেন-কেউ কিছুই মনে করবেন না। সুতরাং আপনার বসন্ত মুখবইয়ের জোর করে আবির মাখানো ছবিতে এলেও কেউ কিছু মনে করবেন না। বরং আপনার প্রচেষ্টাকে সম্মান জানিয়ে আরও ক’জন ‘খিচিক’-এর নেশায় ভুল বানানে, ভুল শব্দচয়নে বসন্তকে টানাটানি করবেন। বেচারা ঋতুরাজ আর বনে বনে আবির ছড়িয়ে বেড়াতে পারেন না; তাঁকে নেমে আসতে হবে মুখবইয়ের বিজ্ঞাপনে।

দোষ কার? জুকারবার্গের? রাজনৈতিকদলের? পুঁজিবাদের? হবে হয়তো। অতো ভাবতে গেলে চলবে না। ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’-র ঠেলায় কচি কচি কন্ঠ রাতদিন এক করে গান গায়, নাচে। আরেকটু বড়োরা দোকান ঢুঁড়ে শাড়ি-পাঞ্জাবি গয়নার সমাহার খুঁজতে ছোটে। নব্য এলিটরা ঠান্ডা পানীয় হাতে ‘খিচিক’-এর টানে শান্তিনিকেতনে ভিড় করে। তাহলে বসন্তের আগমন হয় কখন, কারা জানে তাকে, কারাই বা আনন্দে নেচে ওঠে?

খুঁট্টিমারির জঙ্গলের পথ ধরে যেত গেলে ফরেস্ট অফিসার, রেঞ্জার, গার্ডদের কিছু বাংলো পড়ে। জঙ্গলের ভেতর ওরকম জায়গায় বানানো বাংলোগুলি হয়তো খুব আরামপ্রদ নয়, তবে সুন্দর। সামনে বোগেনভেলিয়া আবির রঙে প্রায় নুয়ে থাকে। পাতাবাহার, আর ফুলে এবং একরাশ ঝরা পাতায় সেজে থাকে সে সব বাংলোয় ঢোকার রাস্তা। বাংলোয় বসবাসকারীদের মনটিও দেখার মতোই হয়। বনের অধিবাসীদের রক্ষা করা যাদের রাতদিনের কাজ, তাঁদের মনখানার ওপর কোন বনজ বাহারি ছায়া পড়ে তা বলা অথবা শোনা যায় না। এইখানে বসন্ত এই সাতভূতের নৃত্য থেকে পালিয়ে মনের মাধুরী ঢেলে দিতে যে কার্পণ্য রাখেননি, তা আগুনে ছোপানো বোগেনভেলিয়াই প্রমাণ দেয়।

অথবা এক নাম না-জানা চা-বাগানের পাশ ঘেঁষে কুলি লাইনের রাস্তা দিয়ে আসতে গিয়ে দেখেছিলাম একবার লালপাড় হলুদ শাড়ি আর চুলে মোরগফুল গোঁজা সাঁওতাল কিশোরীদের একটি দলকে। জিজ্ঞাসা করতেই ঝর্নার মতো হেসে উত্তর আসবে, সামনে ক’পা হাঁটলেই হাট। প্রতি শনিবার। সাজ? এই একটুই সাজ তো। তাদের ওই হাসির শব্দে, চুড়ির রিনিঠিনিতেই বসন্ত আভাসে-ইঙ্গিতে জানান দেয় নিজেকে। তার খিচিকের ভরসায় তো থাকতে হয়নি!

তবে এসব গল্প যেখানে মিথ্যে ওখানে ধলেশ্বরীর দরকার পড়ে না। পড়ে লাইক দিদিয়ার খোঁজ। রিঅ্যাক্ট-দাদার ভাষণ। বসন্তোৎসব থেকে বসন্তকেই ছাঁটার যে প্রক্রিয়া শান্তিনিকেতন অভিযান দিয়ে শুরু হয়েছিল, তার ঐতিহ্য ধরে রাখতেই না এত কাঠখড় পোড়ানো। মুখবইয়ের বসন্ত এতকিছুর পরেও যদি জৌলুসে চাপা পড়ে যায়, তখন কী হবে? কেন? পরপর নিয়ে আসা হবে দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো মায় মনসাপুজোও। আপনার যেখানে খিচিক নিয়ে কথা, চরম মাথাব্যথা সেখানে এসব ভাবলে চলে না। এগিয়ে যেতে হবে। এগোতে গেলে নিজের চেহারার কাদামাটি গলে খড় বেরিয়ে এলে তার দাওয়াইও মুখবই বাতলে দেবে।

ধরুন এমন এক সময় এল যখন ঠান্ডা ঘরে বসে থাকবেন আপনি, আর একটি রেডিমেড বসন্ত আপনার মুঠোফোনে শোভা পাবে। ভাবলেই শিউরে উঠবেন কেউ কেউ। মোড়কে ভরা বসন্ত আপনাকে লাইকদিদিয়ার আশীর্বাদ দেবে, তবে সেই ঝরা পাতার এলো মেলো ওড়াওড়ি দিতে পারবে না। পারবে না আপনার ভেতর নাম না-জানা অনুভূতিকে প্রকৃতির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। আপনার মুখবইয়ে স্মৃতিকে বন্দি করার হুজুগে আপনি যে নিজের থেকেই সরে গেছেন এ সত্য সেদিন আপনি উপলব্ধি করলেও করতে পারেন। নচেৎ আপনার সঙ্গে একটি হিমঘরের আলুর মনস্তত্ত্বের বিশেষ তফাত থাকার কথা নয়!

বহু পরিচিতাকে দেখেছি দোলপূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে বড়ো উত্তেজিত থাকেন। তাঁরা যদিও ‘দোল’ বলেন না, বলেন হোলি। জানান ‘হ্যাপি’ হোলি। বলিউড মেনে পরেন সাদা পোশাক। এবং তাঁদের ভেতর বসন্ত, বাঙালিয়ানা দু’টোই অনুপস্থিত থাকে। তবে এঁদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা চলে এঁরা নিজেদের শিকড়খানাকেই উপড়ে ফেলেছেন, কুন্ঠিতও হননি। অন্তত শিকড়ের নাম করে এক বস্তাপচা হুজুগকে সার-জল দেননি। দাঁড়িপাল্লায় কোনটি অপরাধ তা জানি না। সে বিচারের ভার আপনাদের হাতেই থাকুক বরং।

তবে দুঃখের কথা এই, শান্তিনিকেতন অথবা মাছের কচুরিও একদিন না একদিন প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। নতুন হুজুগ না আসা অবধি। সে অবসরে পারলে একটু বসন্তকে চোখভরে দেখে নেবেন। উষ্ণায়ণের ভালোবাসার টানে ধীরে, অতি ধীরেও না, তিনি বিবাগী হয়ে যেতে বসেছেন। এইসব দেখলে পুরোপুরি হতে বিশেষ সময় লাগবে বলে মনে হয় না! তদ্দিন চলুক, আর কী? খিচিক।

পৌলমী গুহ

নিবাস পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে কোনো পেশায় যুক্ত নেই। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ, ‘শিশির শিকারের পর’।

Share