আজ রবিবার, ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

আনন্দের বিদ্রোহ

।। লুবনা চর্যা ।।

একটা কাক মরে পড়ে আছে এই বসন্তের সকালে।
চারপাশে হরিয়াল, বউ কথা কও, শালিক, ইষ্টিকুটুম পাখির
কলরব। আম গাছে ছোট ছোট সবুজ গুটি যেন
মহাকাশে ছোট ছোট তারা। ফুলের দেবীরা
গাছে গাছে আসন গেড়ে সেজেগুজে বসে হাসছে।

কাউকে ছেড়ে আর যাবো না কেউ

আমাকে আমি ধূলায় লুটাতে দেখি
আমাকে আমি আবার শূন‍্য হতে দেখি
এবং নির্বিকার ঈশ্বরের মতো ভাবি
এসব চলতেই থাকবে। যীশুর মতো
এই পৃথিবী আমাদেরকে ক্রুশে ঝুলাবে
আর আমরা আবার হাসতে হাসতে
ফিরে আসবো। দেখবো দোল পূর্ণিমার চাঁদ
দুধের ধারার মতো আলো ঢালছে
সাধু সঙ্গে। জোনাকিরা ফিরে এসেছে
মাটির অন্ধকার গুহা ফুঁড়ে। বন্ধুরাও
এসেছে যার যার ব‍্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে।
আমাদের মনে বয়ে যাবে সবুজ ঘাসের মতো
একটা ঢেউ। কাউকে ছেড়ে আর যাবো না কেঊ।

আমরা এমন জাতি

দিন শেষে শরীরটা ভারী হয়ে আসে।
যেন একটা পাথর, ঠেলে দিলেই বিপুল পানির
স্প্ল‍্যাশ নিয়ে গড়িয়ে পড়বে অথৈ ঘুমের সাগরে।
কিংবা আমি যেন একটা পাখির গা খসা
ছোট্ট পালক। সারাদিন বাতাসের তোড়ে
এদিক সেদিক উড়ে উড়ে সন্ধ‍্যাবেলা
একটা রাস্তায় জমা বৃষ্টির পানি লেগে
ভারী হয়ে গেছি। আর উড়তে পারছি না।
শরীরটাকে আর তুলতে পারছি না
ক্লান্তির আঠা থেকে। তাই চলো পাল তুলি
কল্পনাতে। ক্ষতগুলো ফুল হয়ে যায়
সময়ের সাথে সাথে। মথ থেকে প্রজাপতি।
মুছে ফেলে আবার শুরু করি— আমরা এমন জাতি।

অগ্নিকুন্ডের অক্ষর

কিছুই করি না তবু একটু একটু এগোই
দীর্ঘক্ষণ পর তাকিয়ে দেখি
কিছু দূর এগিয়ে গেছে কচ্ছপ
সবুজ গ্রামের পথে। হাল ছেড়ে মাঝ সাগরে
জেলে দেখে অদ্ভুত তারা-খসার দৃশ‍্য।
যেমন একটা নকশিকাঁথা সেলাই করতে করতে
পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে শতবর্ষী বৃদ্ধা,
কিংবা খাবার খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ে
নির্বাক শিশু, তেমন আনমনে হারিয়ে যাই।
পথ খুঁজে ফিরে আসে বিড়াল
দিগন্তের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে। কিন্তু তুমি থাকলে
হয়তো সবকিছু অন‍্যভাবে ঘটতো। মহাকাশেও
ফুটে থাকতো বসন্তকাল। একটা কবিতা হয়তো
এভাবেই লেখা হয়, কিছু অক্ষর কুড়িয়ে
কিছু শব্দ যোগ করে। তাই করে যাই—
দীর্ঘক্ষণ পর তাকিয়ে দেখি
কিছু দূর এগিয়ে গেছে কচ্ছপ।
কিছু দূর এগিয়ে আসি আমিও
অগ্নিকুন্ডের অক্ষর দিয়ে লেখা কবিতা ছেড়ে।

আনন্দের বিদ্রোহ

একটা কাক মরে পড়ে আছে এই বসন্তের সকালে।
চারপাশে হরিয়াল, বউ কথা কও, শালিক, ইষ্টিকুটুম পাখির
কলরব। আম গাছে ছোট ছোট সবুজ গুটি যেন
মহাকাশে ছোট ছোট তারা। ফুলের দেবীরা
গাছে গাছে আসন গেড়ে সেজেগুজে বসে হাসছে।
আর এই বেচারা কাক মরে পড়ে আছে বসন্তের সকালে।
যেন বেদনা না, শোক না— সেও অংশগ্রহণ করছে
সবার সাথে এই বসন্ত উৎসবে। আমরাও
যেমন বেদনাকে বহন করে মিশে যাই আনন্দের স্রোতে।
বালুকাবেলায় সাগরের ফেনা যেমন গ্রাস করে ঝিনুকের
দেহ। মৃত কাকের দেহেও আজ আনন্দের বিদ্রোহ।

জন্মান্ধের আইফেল টাওয়ার

ক্ষেত মাঠ জুড়ে এখন মানুষের বসতঘর।
অথচ এখানে থাকার কথা ছিল সর্ষে ফুলের বাড়ি-
ধান আর বাতাসের গানের খোলা বারান্দা
টমেটো, বিট, গাজর বাঁধাকপিদের অভয়াশ্রম।
কিন্তু এখানে দৈত‍্যের মতো দাঁত কেলিয়ে
হাসছে মানুষের ঘরবাড়ি। প্রাচীন গল্পে যেমন
রাজার সবকিছু সোনা হয়ে যাচ্ছিল, এমনকী খাবার-সহ
তার খাবারের প্লেট, আর এখন সবকিছু বাড়ি, ইন্ডাস্ট্রি
শপিংমল হয়ে গেলে সেই রাজার মতো আমাদেরও
না খেয়ে থাকতে হবে। রাখতে হবে আজীবন দীর্ঘ
এক রোজা। রাজার মতোই চাইতে হবে সব আবার
ফিরে পাওয়ার বর। ছোট্ট টুনটুনি— সেও হারিয়েছে ঘর।
কেননা গাছ কাটা হয়ে গেছে। গাছের চোখে অশ্রু নদী।
তুমি একটা পাখি হতে যদি বা একটা গাছ বা মৌমাছি
তাহলে এই নগরায়নের ষড়যন্ত্রের ম‍্যাপ ভাঁজ করে
হয়তো একটা ছোট্ট নৌকা বানিয়ে ছেড়ে দিতে
বৃষ্টি জমা জলে। আর তোমার চোখকে দিতে আকাশ
দেখার অধিকার। কিছুদিন পরে এই আকাশ হবে
পূর্বপুরুষের ধারণা মাত্র। জানালা দিয়ে অন‍্য বাড়ির
জানালার গ্লাসে যে প্রতিফলন দেখা যাবে,
আকাশের দৈর্ঘ্য হবে ঠিক ততোটুকু। আর চোখ
কখনো দিগন্ত দেখতে পাবে না। তাই চোখে পরে নিই
জন্মান্ধের চশমা। যে চশমা পরলে শর্ষে ক্ষেতকে
আবাসিক প্রকল্প মনে হয় আর গরু ছাগলের
চারণভূমিকে মনে হয় আইফেল টাওয়ার।

ছবি- লুবনা চর্যা

লুবনা চর্যা

জন্ম: ৩ ডিসেম্বর, ১৯৮১, খুলনায়। বেড়ে ওঠা ওখানেই। কৈশোরে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর একসময় থিয়েটার ছেড়ে নিজের লেখা ও আঁকার দিকে মনোযোগী হন। মাস্টার্সের পর ঢাকায় বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপি রাইটার হিসাবে কাজ করেছেন। একসময় সেটাও ছেড়ে দিয়ে এখন সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনভাবে লেখালেখি করেন, ছবি আঁকেন, লুবনার বক্তব্য, “নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই…”।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top