ছায়াও তো পূর্বদিকে ঢলে

কবিতাগুচ্ছ

।। মিথুন নারায়ণ বসু ।।

এরপর বেলা যত ঢলে, আমি জানি
ছায়াও তো পূর্বদিকে ঢলে।
তাই ভাবছি বাংলাদেশ দিয়ে শুরু করি।
বরিশাল থেকে আমি বার্লিন যাব না,
বরং যাব তো বোর্নিও।
যত বেলা যাবে আরও দিগন্তে ছড়াব,
তবু ফিরে আসব ছায়ার শিকড়ে।


দুইপাখি

আমাদের বারান্দার ঘুলঘুলি জুড়ে শ্যামাপাখি থাকে
আর খাঁচার ভেতরে থাকে টিয়া।
শ্যামা কালো ছোটোখাটো পাখি, ল্যাজে সাদা দাগ;
টিয়াটি সবুজ, ঠোঁটে লাল।
চাল দিই, গম দিই, দু’পাখিই খায়।
শ্যামা খায় খুঁটে-খুঁটে, সন্ত্রস্ত, বারান্দার মেঝে থেকে খায়।
টিয়া খায় বাটি থেকে, উল্টে দেয় পছন্দ না হলে।

এত যে সবুজ টিয়াপাখি, খাঁচার ভেতরে তার সমস্ত জীবন।
খাঁচার দরজা খুলে রাখি, তবু নেই বেরনোর মন।
আর যে সবুজ মাখে রোজ, রোজ মাখে রোদ-হাওয়া-আলো
তার তো রঙের নাই খোঁজ, সে তো নিজে সাদা আর কালো।

আমি তবে কার মতো হবো, কার থেকে ধার নেব বাঁচা?
গাছের সবুজ মেখে নিয়ে নিজে হয়ে যাব সাদা-কালো,
না কি আমি বেছে নেব খাঁচা??


কালাজাদু

ছোটোবেলা সবকিছু ছাড় ছিল
ছোটোবেলা সবকিছু পেনসিলে লিখতাম
যা-ই লিখি, ভুল হ’লে
মুছতাম ক্যামেলের
ইরেজার দিয়ে ঘ’ষে-ঘ’ষে

তারপরে শুরু হ’ল পেন দিয়ে লেখা
সেই থেকে সাবধানে
লেখালেখি শুরু
কেননা তখন আর
ছাড় নেই, নেই কোনও
মোহিনী রবার
এবং হোয়াইটনার
কেনার আমার কোনও সাধ্যও ছিল না

তাই আমি কাটাকুটি
আর ভুলের ভ্রূকুটি
সব সেই থেকে সহ্য ক’রে গেছি
কখনও ভুলের থেকে জেগে উঠছে ছবি
শুধুমাত্র কাটাকুটি থাকছে কখনও

যেন ন্যাংটো বাচ্চা
ভাসানের ঠাকুরের
চালি ও কাঠামো তুলে এনে
পালেদের ঘরে দিয়ে আসি

তারপর আমিই মৃৎশিল্পী
বিশ্বকর্মার কাঠামোটি দিয়ে
জাদুবলে বানাচ্ছি কার্তিক ঠাকুর
কিংবা লক্ষ্মী-সরস্বতীকে
কালাজাদু ক’রে-ক’রে

ডাকিনী-যোগিনী…


গুবুল

চা ক’রব ব’লে রান্নাঘরে ঢুকতেই জলের ডিসপেনসার আর ড্রাম শব্দ ক`রে উঠল—
‘গুবুল’।
একদম নিজে-নিজে।
এক্ষুনি জল নেব কী ক’রে বুঝল কে জানে।
কেটলিতে জল ভ’রে ওভেনে বসাব
আবার অনেকখানি জল ওপরের ড্রাম থেকে নীচে নেমে এসে শব্দ করল— ‘গুবুল’।

চা ক’রে সবখানি চা পাতা ছাকনিতে জমিয়েছি, দেখি
রান্নাঘরে জানালার গ্রিলে ছোটো এক মাকড়সার ছানা
ছোটো এক জাল বানিয়েছে।
আমি ছাকনির সবটুকু পাতা ওই ফাঁক দিয়ে জোরে ছুঁড়ে মারি।
গরম চায়ের একফোঁটা হাতে এসে লাগতেই মনে ভারি দুঃখবোধ হ’ল।
আহা! ওইটুকু মাকড়সার ছা, অমন গরম চা’র পাতা,
আহা! ব্যাটা ম’রে গেল বুঝি।
অনুতাপে কাছে গিয়ে দেখি, খানিকটা জাল ছিঁড়ে গেছে
কিন্তু মাকড়সার পো অক্ষত, ফিরে এসে দোল খাচ্ছে জালে ব’সে-ব’সে।
আমি ভারি খুশি হ’য়ে অল্প-অল্প ঠাণ্ডা জল আঙুলের ডগা দিয়ে-দিয়ে
জালের উপর মৃদু ছিটিয়ে দিলাম।
হীরের কুচির মতো জলবিন্দু চিকচিক ক’রতে লাগল।

ফিরে আসছি, জলের ড্রাম আবার শব্দ ক’রল, ‘গুবুল’।
একদম নিজে-নিজে।
আমি আদর ক’রে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম।


কর্মশিক্ষা ক্লাস

কর্মশিক্ষা ক্লাসে আমাদের বলা হ’ল যার যা-যা কাজ বেছে নিতে।
আমি ব’ললাম, স্বর্ণকার হ’ব।
তারপর দিনরাত এক ক’রে বানালাম কত সুখের খেলেনা, দুঃখের পুত্তলি কত।
একদিন চোর এসে কর্মশালা লুঠ ক’রে গেল।

অতঃপর আমি এক কর্মকার হ’লাম।
দিনে-দিনে বেড়ে উঠল সুখের ডেগচি আর দুঃখের কড়াই।
চুরি কিছু হ’ল না তো বটে, বাণিজ্যও হ’ল না।
আমার ছোট্টো ঘরে শ্বাস ফেলি, জায়গা থাকল না।

এইবারে কাজ তাই নিই কাচকলে।
ফুঁ দিয়ে-দিয়ে বাহারি বোতল আর সুখের
পেয়ালা-পিরিচ-ফুলদানি বানাই নিমেষে।
বাতিল সামগ্রী যত ভাঙাচোরা দুঃখের বোতল রাখি ডাঁই ক’রে।
জানি ও তো লোহা নয়, ভেঙে ফেলব অকুলান হ’লে।

কিন্তু অত সস্তা নয় নিজের অতীত ভেঙে ফেলা।
হাত কাটবে, পা কাটবে, রক্তপাত হবে।
শেষে আবারও একদিন তুমি ফিরে যাবে কর্মশিক্ষা ক্লাসে।
গিয়ে ব’সবে শেষ বেঞ্চটিতে।
ভোরবেলা মিস হ’য়ে গেছে, এখন মাটির ক্লাস আবার বেলাশেষে।

তুমি দেখবে মাটি থেকে মাটি ছেনে-ছেনে
গ’ড়ে উঠছে ঘট,পট, ঘর-গেরস্থালি,
সুখের প্রদীপ কত, দুঃখের ছোটো হাতিঘোড়া।
গড়ে উঠছে, ভেঙে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে আবার মাটিতে,
মাটি থেকে তুলে চাকে ফেলে
সবকিছু গ’ড়ে তুলছে ফের, যাতে
সব ভেঙে যেতে পারে।

এতদিনে এতকিছু পরে আমি জানি, আমি কে।
আমি জানি, কী হ’তে হবে।
তাই শুধু অপেক্ষা ক’রছি ভারিক্কি স্যার
বা মৃদু দিদিমণি কখন জিজ্ঞেস ক’রবেন,
বড়ো হ’য়ে, অন্তত বুড়ো হ’য়ে
কে কী হবে, আর আমি হাত তুলে
“কুম্ভকার হ’ব স্যার কিংবা ম্যাম”
ব’লব তক্ষুনি।।


কাব্যতত্ত্ব

তুমি অন্ধজনে আলো দাও—
মৃতজনে দাও প্রাণ।
পঙ্গুকে দিয়ে লঙ্ঘন করিও গিরি,
আমি কিছু ব’লতে আসব না।
শুধু যে মূক, তাকে বাচাল ক’রো না।
আমার এই বাকযন্ত্র-
উচ্ছ্বাসে ফেনায় অশ্লীল,
বকযন্ত্র ক’রে দাও একে।
যা ব’লব, টিপে-টিপে।
চোলাই ক’রে ক’রে
বিন্দুতে বিন্দুতে ব’লব, যাতে
দেশলাই ধরালেই আগুন জ্ব’লে ওঠে।

জলপাইগুড়ির তামাক যেমন—
ভালো, কিন্তু বড়ো বিষপাতা।
তার থেকে ভালো হ’ল নদীয়ার।
জাগ দিয়ে-দিয়ে, বিষপাতা ঝেড়ে
তৈরি হয় বোতামের মতো ছোটো কলি।
আরও ভালো মালানা চরস—
কেবলই নির্যাস ব’লে তার দাম সবচেয়ে বেশি।

এই আমার স্মৃতিশাস্ত্র, চর্যাপদ,
চাণক্যের শ্লোক আর খনার বচন কিংবা
নীতিগল্প শেষ ক’রে গল্পের অন্তিম মোরাল।
এসথেটিক্স, পোয়েটিক্স- যা-ই বলো, এই-ই।
এর বেশি আমি বাবা কিছুই বুঝি না।

যে খঞ্জ তাকে পা দাও।
নুলো যে, তাকে দাও বিশ্বকর্মা হাত।
ম্লান, মূঢ় মুখে দাও ভাষা,
আমি কিচ্ছু ব’লতে আসব না।
ভাব দাও, ভঙ্গী দাও,
ছন্দের মোহে যেন পড়ে-
শুধু দেখো,
বাচাল ক’রো না…


ছায়া

সকালবেলার দিকে সততই ছায়া
পশ্চিমে হেলে।
আমিও হেলেছি।
তাই ধ্যানে কিংবা অনুধ্যানে,
মননে, চিন্তনে
পশ্চিম দিগন্তে গেছি
বারবার ছায়াপথ ধ’রে।

বেলা যত বাড়ে তত ছোটো হয় ছায়া।
আমার ও তো হ’তে চলল চল্লিশ বছর।
ছায়াখানি ছোটো হ’তে-হ’তে
একেবারে পা-র কাছে গুটিয়ে এসেছে।
ন যযৌ ন তস্থৌ হ’য়ে
আমি আর আমারই তো ছায়া
আপাতত কিছুকাল একত্র কাটাচ্ছি।

এরপর বেলা যত ঢলে, আমি জানি
ছায়াও তো পূর্বদিকে ঢলে।
তাই ভাবছি বাংলাদেশ দিয়ে শুরু করি।
বরিশাল থেকে আমি বার্লিন যাব না,
বরং যাব তো বোর্নিও।
যত বেলা যাবে আরও দিগন্তে ছড়াব,
তবু ফিরে আসব ছায়ার শিকড়ে।
বরোবুদুরের স্তুপে ব’সে বোধগয়া পাব।

তারও পরে আরও বড়ো ছায়াখানি এসে
দশখানা দিক দেবে মুছে…


চার-নম্বর আমি

মুখ থেকে ছুটে গেছে কথা।
হাত থেকে বেরিয়ে গেছে বল।
আর তুমি না চাইলেও
যেভাবে পুকুরে পড়ে বল
আর তুমি সাঁতার জানো না ব’লে
ঢিল ছুঁড়ছো বলের ওপারে,
কিন্তু তোমার টিপ নয় ভালো
আর হাতেও তেমন নেই জোর,
তাই অধিকাংশ ঢিল পড়ছে এপারে
আর ক্রমশই আরও দূরে সরে যাচ্ছে বল;
তুমিও দেখছো কথা সেভাবেই
অস্থানে-কুস্থানে গিয়ে অতর্কিতে
বোমা ফেলছে, বিষিয়ে দিচ্ছে পুকুরের
হাওয়া-মাটি-জল।

এখন তুমি কী করবে, সাক্ষাৎ এই প্রশ্ন
সোজা উঠে এলে আমি দেখি
তিনজন ‘আমি’ ব’সে আছে।
একজন ‘আমি’ ভাবে সাঁতার শিখবে আর
নিজে নেমে নিয়ে আসবে বল।
আরেকজন এককাঠি বাড়া।
ডুবুরি হবে সে ভাবে, ডুব দিয়ে
ঢেলাগুলি তুলে ফের ছুঁড়ে-ছুঁড়ে
পাড়ে টেনে আনবে সে বল, সে ভাবে।
তৃতীয় জনের কোনও তাড়াহুড়ো নেই।
পাড়ে এসে চুপ ক’রে ব’সে
একা ভাবে, গেছে বল, যাক
কতই তো গেছে।

তক্ষুনি চারনম্বর ‘আমি’-টাকে দেখি।
হেসে-হেসে হাত নেড়ে অামাকে সে ডাকে।
বলে, “আয় আয়, ওই দ্যাখ জল,
নাম জলে, তারপরে শুধুই অথই,
শুধু তুই ডুবে যাবি ব’লে…”


ডানা

ছোটোবেলা থেকে আমার কাঁধের হাড় উঁচু, সেইজন্য বাবা আমাকে ডাকত কান্ধাউঁচু ব’লে। আর বলত, কান্ধাউঁচু ছেলেরা পরিশ্রমী হয়। মা বলত, আমার কাঁধের দুটো হাড় একদিন ডানা হয়ে বেরিয়ে আসবে।

বাবার অ্যাপ্রন থেকে ড্রেসিংরুমের সাদা আলো, সাদা বেসিনে সাদা স্টিলের ছুরিকাঁচি পড়ার শব্দ আর সাদা বোতল থেকে সাদা তুলোয় ঢালা মেথিলেটেড স্পিরিট আর সাদা লিউকোপ্লাস্টের গন্ধ ম-ম করত। মায়ের পেটের পালকে মুখ গুঁজে আমি ছুরি আর কাঁচির স্বপ্ন যাতে না দেখি সেই চেষ্টা করতাম আর বাবা মাথা উঁচু করে স্বপ্ন দেখত আমি হয়ে উঠেছি কর্মঠ আর ঋজু। আর মা মাথা নীচু করে আমাকে ফিসফিস করে ওড়ার গল্প বলত।গল্পের মধ্যে স্বপ্নে অনেকসময়ই আমি উড়ি, আকাশে তুলো আর স্পিরিটের গন্ধ ভেসে থাকে।

স্বপ্ন ভাঙে। কাটা ডানা পাশে নিয়ে শুয়ে আছি দেখি। সাদা আলো, সাদা বেসিনের গায়ে লাল দাগ। তুলো, গজ, সাদা লিউকোপ্লাস্ট।আর স্পিরিটের গন্ধে চারদিক ভুরভুর করছে। আর এককোণে মা বসে নীচুস্বরে ক্লান্তিহীন গল্প বলছে। ওড়ার গল্প।

সেইথেকে রোজ কাঁধের গোড়ায় আমি জল দিই। দুধ দিই। রক্ত দিই। বীজ দিই। সেইথেকে এই একটা বিষয়ে আমি মনোযোগী হয়েছি, পরিশ্রমী হয়েছি। বলা যায় না, মায়ের চাপাগলা, ফিসফিস আওয়াজ একদিন থেমে যেতেও পারে…

ফটোগ্রাফি: মোহাম্মদ রোমেল

লেখক পরিচিতি:
মিথুন নারায়ণ বসু

পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের কবি। জন্ম:১৯৮১, ১৪ মার্চ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ, ‘লীলাবিলাখেলা’, (২০১১), পুনর্মুদ্রণ ২০১৭)। অনুবাদ করেছেন ফির্নান্দু পেসোয়া (২০১৬)। পেশায় শিক্ষক।

Share