নিঃসঙ্গ কাফেলা

কাব্য

।। গৌতম চৌধুরী ।।



১.

মূর্তির কি কোনো ভাব থাকে? থাকলেও, সে একটা থেমে-থাকা মুহূর্তের ভাব। মানুষ যেভাবে তাকে বানিয়েছে। সেই একটি নিবিড় মুহূর্তের ভেতর দিয়ে হুহু ক’রে বয়ে যায় সময়। বিগতদিনের পথিকের মতো পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে সে। গম্ভীর বা হস্যোদ্ভাসিত মুখে দেখে যায় সব। দ্যাখে, মানুষ তার ভাবেরও মূর্তি বানাতে চায়। পথ চলতে এটা নাকি খুব জরুরি। কিন্তু ভাব তো খলি পাল্টাতেই থাকে। কোন্‌ মূর্তি বানাবে সে? সব কালেই কিছু মানুষ একটু বেশি বুদ্ধি ধরে। তারা ফটাফট একটা জুতসই ভাবের ছবি এঁকে সেটা মুখে লটকে নেয়। গর্বে হনহন ক’রে হাঁটতে থাকে তারা। বোকার মতো পেছনে পড়ে থাকে বাকিরা। চলতে চলতে বোকার মতোই ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে যায় তাদের। পথ যে সবই দেখছে, কেউই কিছু খেয়াল রাখে না।

২.

যে-গাছ কোত্থাও হয় না, তারই ডালে বসে গল্প করছে একজোড়া পাখি। তেমন পাখিও হয় না কোত্থাও। যা হয় না, তাই নিয়েই রূপকথার গল্প। চোখের সামনে নেই বলেই কি নেই! বুকের ভেতর তো দিব্যি সব রয়েছে। মাঝে মাঝে তাই সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। এই যে বাঁকাচোরা এবড়োখেবড়ো চড়াই-উতরাই রাস্তা ধরে দিনের পর দিন চলা, এটাকেও মাঝে মাঝে মনে হয় রূপকথাই বুঝি। আসলেই কি রয়েছে অমন কোনও পথ? মানুষই বা চলেছে কীভাবে? অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে, না, দু’পাশ দেখতে দেখতে? অসহায় যুদ্ধবন্দির মতো, না, ফুর্তিতে ভরপুর প্রজাপতির মতো? মাঝে মাঝে এই যে এসে পড়ে এতসব অন্ধকার গুহা– সেসব কি তাহলে অলীক! আর ঝরনাজলের গর্জনের সেই যে সাতরঙে ভেঙে পড়া – সেও কি মিথ্যে! এই যে দিন আসছে রাত্রি হচ্ছে নক্ষত্রমালা দুলে উঠছে মাথার ওপর, ছড়িয়ে দিচ্ছে ভস্মের মতো আলো, পশুপাখিরা ধুলোয় গড়াগড়ি খেয়ে জোসনার মতো রং ধরছে, মানুষ কি চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেবে যাবে– সত্যি না মিথ্যে? আশ্চর্য, পথের কোনো চিন্তা নেই! সে কেবলই চলে যাচ্ছে হাসতে হাসতে।

৩.

বুনো মহিষের একগুঁয়েমির সাথে মাঝে মাঝে মোলাকাত ঘটে যায় ফড়িংয়ের ফরফরানির। বিশেষণগুলো নিরাপদ দূরত্বে-থাকা মানুষের দেওয়া। ফড়িংও যে আদপে একগুঁয়ে নয়, নিশ্চিত হয়ে বলা যায় কি? মহিষ ফরফরে না হতে পারে, কিন্তু দরকারে ওই ভারি শরীর নিয়ে চক্করবাজি কি কিছু কম করে!মানুষের তৈরি করা শব্দ তো। একটা কাছাকাছি ধারণায় পৌঁছে দেয় মাত্র। কখনও আবার বিলকুল ভুল দিকেও নিয়ে যায়। মহিষ যেমন রেগে উঠছে, ফড়িং তাকে টিকরমবাজি ক’রে বিরক্ত করছে বলে। ফড়িং কিন্তু সরলভাবেই উড়ছিল, সরলরেখায়। সেই রেখা বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছিল মহিষের ঝোলানো কান বা স্ফীত নাসারন্ধ্র। এর ভেতর আসলেই কোনও পরিকল্পনা নেই। ওখানে মহিষ না-থাকলে ঘাসের ডাঁটিতে গিয়ে ধাক্কা মারত ফড়িংয়ের মুণ্ডু বা ডানা। এই দৃশ্যের আয়ু বেশি নয়। বা, হয়তো অনন্তকাল ধরে চলবে। মানুষেরই হাতে সময় বড় কম। তাই যাহোক তাহোক এতসব বিশেষণ!

৪.

রাত্রির অন্ধকারের ভেতর দিয়ে চলে গেছে এক সুড়ঙ্গ। এক অদ্ভুত সুর ভেসে আসছে তার গহন থেকে। শুনে, মানুষ বুঝতে পারে, সে অতি দুর্বল প্রাণী। তার গা ছমছম ক’রে ওঠে। ইচ্ছে করে, ছুটে পালাতে। কিন্তু কোথায়? যেদিকেই তাকায়, দ্যাখে সেই সুড়ঙ্গের মুখ। চারিদিক থেকেই যেন সেই সুড়ঙ্গ ঘিরে ধরেছে। আর বেজে চলেছে সেই সুর। তাহলে বুঝি ইতিমধ্যেই সে সুড়ঙ্গটির ভেতরে। সেখানে তখন বয়ে চলেছে উন্মত্ত ঢেউ। অথচ সে ভেসে যাচ্ছে না, ঢেউয়ের খলবলানির ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে। যেন এক সিন্ধুঘোটক সে। ঢেউয়ের ফণার ওপর চড়ে পার হয়ে যাচ্ছে একটা সমগ্র রাত্রি। কেবল মাথার ওপর আকাশ আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। সুড়ঙ্গের ছাদেই যেন আঁকা রয়েছে নক্ষত্রমণ্ডলীর ঝিলমিল। ঝড়ের গতিতে উড়ে চলেছে তারা। ঝড়ের গতিতে উড়ে চলেছে রাত্রি। এরকম রাত্রি তো রোজ আসে না জীবনে! উড়ে যেতে যেতে মানুষ ভাবে। তার ভাবনা ঘিরে কেবলই বাজতে থাকে জাদুঘরের বাক্স থেকে বেরিয়ে-আসা গমগমে একটা সুর।

৫.

প্রতিসরণের যে-মোচড়, তাকে স্পষ্ট ক’রে দেখানো যায়। আঁক কষে বার করা যায়, কীভাবে কী হলো। কিন্তু স্তব্ধতা যখন ধ্বনির ভেতর দিয়ে যায়, তখন কে কতটুকু বদলায়! কাউকেই তো চোখে দেখা যায় না। কানেও কি শোনা যায়, শব্দের ভেতর দিয়ে ভেসে চলা সেই আঁকাবাঁকা স্তব্ধতার ডানার কাঁপন? ভূমিকম্পে ভয়ঙ্করভাবে বদলে যাওয়া নদীখাত হয়তো একটা দেশকালকেই দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যায়। কিন্তু প্রতিদিনের মন্থরতম বদলগুলো? তাদের তো কোনও ভাষ্যি নেই। কী বিস্তীর্ণ অজানা সব প্রান্তর! পালটে যাবে না, একটু হলেও? একটু একটু করেই, একদিন দেখা যায়, আগাপাছা চেনাই যাচ্ছে না! সবচেয়ে কঠিন হলো সেই শ্রীমানকে চেনা, আয়নায় দাঁড়ালেই যাকে দেখা যায়। কে আর পিছু নিতে পারে ভেতরের সেইসব চুল চুল বদলের!

অলঙ্করণ: বৈশালী

গৌতম চৌধুরী

বড় বাংলার অন্যতম কবি, গদ্যকার, চিন্তক। নিবাস: পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়। 
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: কলম্বাসের জাহাজ [প্রথম প্রকাশ: উলুখড়, হাওড়া,১৯৭৭, দ্বিতীয় সংস্করণ: রাবণ, কলকাতা, ২০১৬], হননমেরু [উলুখড়, হাওড়া, ১৯৮০], পৌত্তলিক [উলুখড়, হাওড়া,১৯৮৩], অমর সার্কাস [আপেক্ষিক, হাওড়া, ১৯৮৯], চক্রব্যূহ [আপেক্ষিক, হাওড়া, ১৯৯১], নদীকথা [যুক্তাক্ষর, হাওড়া, ১৯৯৭], আমি আলো অন্ধকার [অফবিট, কলকাতা, ১৯৯৯], সাঁঝের আটচালা [কীর্তিনাশা, কলকাতা, ২০০২], আধপোড়া ইতিহাস [কীর্তিনাশা,পুরুলিয়া, ২০০৪], অক্ষরশরীরে মহামাত্রা পাব বলে [কীর্তিনাশা, পুরুলিয়া, ২০০৬], আখেরি তামাশা [ছোঁয়া,কলকাতা, ২০১৩], ঐতরেয় [রূপকথা, ক্যানিং, ২০১৩], উজানি কবিতা [মনফকিরা, কলকাতা, ২০১৪], ধ্যানী ও রঙ্গিলা [চৈতন্য, সিলেট, ২০১৫], বনপর্ব [সংবেদ, ঢাকা,২০১৬], কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত? [ধানসিড়ি, কলকাতা, ২০১৬], বাক্যের সামান্য মায়া [ভাষালিপি, কলকাতা, ২০১৭], রাক্ষসের গান [চৈতন্য, সিলেট, ২০১৭], ইতস্তত কয়েক কদম [কাগজের ঠোঙা, কলকাতা, ২০১৮], বাজিকর আর চাঁদবেণে [পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি., ঢাকা, ২০১৮], দীনলিপি [শুধু বিঘে দুই, আন্দুল, ২০১৯]
প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ: গরুর রচনা [বইয়ের দোকান, ঢাকা, ২০১২ (ই-বুক)], খেয়া: এক  রহস্যময় বিপরীতবিহারের ঝটিকালিপি [কুবোপাখি, কলকাতা, ২০১৭], বহুবচন, একবচন [বইতরণী, কলকাতা, ২০১৮], সময়পরিধি ছুঁয়ে [ঐহিক, কলকাতা, ২০১৮], অবাক আলোর লিপি [অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লি, ২০১৯]।

gc16332@gmail.com

Share