মুঘল আমলে রঙের পরব

।। বিশ্বেন্দু নন্দ ।।

জাহাঙ্গীর হিন্দু সভাসদেরা এইদিন তাঁকে কৃষ্ণ নামে অভিহত করতেন। তাঁদের তিনি উপহারে ভরিয়ে দিয়ে যেতেন জেনানা মহলে। জ্যোতিষী, সাহিত্যিক, দার্শনিক তার কপালে চওড়া তিলক কাটতেন। জেনানা মহলের অমুসলমান জেনানারা কৃষ্ণ জাহাঙ্গীরকে মাঝখানে রেখে নিজেরা গোপী হয়ে নাচতেন আর রঙ খেলতেন।

মুঘল আমলে রঙের পরব

আজ রঙ হ্যায় হে মন রঙ হোরি রি
মোরেঁ মেহবুব মেঁ ঘর রঙ হোরি রি
সজন মিলাঁভ রে, সজন মিলাঁভ রে, মোরে অঙ্গন কো
আজ রঙ হ্যায়
মোহে পীর পায়োঁ নিজামুদ্দিন আউলিয়া
নিজামুদ্দিন আউলিয়া মোহেঁ পীর পায়োঁ
দেশ-বিদেশ মেঁ ঢুন্ড ফিরে হুঁ
তোরা রঙ মেঁ ভয়ো রি…
জাগ উজ্জারোঁ জগত উজ্জারোঁ,
ম্যায়ঁ তো অ্যায়সো রঙ অউর নেহি দেখি রে
ম্যায়ঁ তো যব দেখুঁ মোরা সুঙ হ্যায়
আজ রঙ হ্যায় হে মন রঙ হোরি রি

নিজামুদ্দিন আউলিয়ার উদ্দেশ্যে শিষ্য আমীর খসুরু


দিনকয়েক আগে আগে ভারত জুড়ে মুঘল এবং ইসলামি শাসকদের দেওয়া বিভিন্ন স্থানের নাম পাল্টে ‘ভারতবর্ষীয়’ ধারায় রাখার আবেদন খারিজ করল সুপ্রিম কোর্ট। কলকাতা থেকে প্রকাশিত এক দৈনিকে ‘বিদ্বেষের আগুণে ঠেলে দিতে চান দেশকে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘মুঘল ও মুসলিম শাসকদের নামাঙ্কিত স্থান এবং ভবনগুলির নাম পরিবর্তনের আর্জি গ্রহণ করল না সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট বিজেপি সদস্য ও আইনজীবী অশ্বিনী উপাধ্যায়ের দায়ের করা একটি জনস্বার্থ মামলা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। আদালত বলেছে যে এই ধরনের আবেদন আরও ফাটল তৈরি করবে। বিচারপতি নাগরত্ন বলেন, ‘হিন্দুত্ব হল জীবনযাপনের একটি উপায়। ভারত সবাইকে সঙ্গে নিয়েছে, সে আগ্রাসী হোক বা বন্ধু। আপনি জানেন কিভাবে ব্রিটিশরা ডিভাইড এন্ড রুল নীতি শুরু করেছিল। এই ধরনের অনুরোধের মাধ্যমে আবার করবেন না। ধর্মের কথা নয় দেশের কথা মাথায় রাখুন’। আদালত বলেছে যে ‘কোনো দেশ অতীতের কারাগারে থাকতে পারে না’ এবং ভারত শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি থাকার কারণে গণতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রে সব শ্রেণীর মানুষ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আদালত বলেছে, দেশকে একত্রে আবদ্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।’। অথচ দ্বেষপ্রেমীরা জানতেও চান না কীভাবে ভারতবর্ষের সমাজ, রাজনীতি, কৃষ্টিকে আপন করে নিয়েছিল মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় আসা মুঘল পাঠান পারসিক তুর্কিরা। এই সংশ্লেষীক্রিয়ার জরুরি উপাদান বাংলার জাফর খান গাজির গঙ্গাস্তব আর সন্তদের মাধ্যমে মুঘলদের রঙের পরব চর্চা। আমরা বসন্ত উৎসব উপলক্ষে আলোচনা করব মুঘল আমলে রঙের উৎসব পালনের কিছু উদাহরণ নিয়ে।

সুলতানি আমলের প্রথম যুগ থেকেই দিল্লিতে রঙের পরব যা কিনা উত্তর ভারতীয়দের কাছে হোলি এবং হোলির আগের দিন বঙ্গে ‘দোলপূর্ণিমা’ হিসেবে পালিত হয়, সেসবই সর্বধর্মের উৎসবে পরিণত হয়েছে পীর আউলিয়া সন্তদের অংশগ্রহণে। এই গণউৎসবে অংশ নিয়ে নির্দিষ্ট ধর্মের বেড়া ভেঙে সর্বধর্মের আঙ্গিনায় নিয়ে আসেন সুফিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান সন্ত উত্তর প্রদেশের বাদাউনে জন্মানো দিল্লির প্রখ্যাত সন্ত হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া আর তার শিষ্য দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আমীর খসুরু। উৎসব আর গুরুকে উদ্দিষ্ট করে হিন্দৌভি আর পারসিক ভাষা মিলিয়ে মিশিয়ে লিখলেন যুগ অতিক্রম করা কালাম – সে কবিতা আজও দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে গীত হয় দুই মহারথীর সম্মানে। হোলিতে ব্যবহার হওয়া নানান রঙ থেকে, উৎসব উদযাপনের প্রতীক হিসেবে তাঁরা বেছে নিলেন দুটি রঙ, গুলাব আর হলুদ। এই উৎসব পেল সর্বজনীন চেহারা।

সম্রাট বাবরও বসন্তে রঙের এই উৎসব পালন করতেন গোটা দিল্লিকে মদ্যের শরবতের চৌবাচ্চায় স্নান করিয়ে। উৎসবের মধুর আনন্দ তিনি ভাগ করে নিতেন দিল্লির প্রজাদের সঙ্গে সমস্ত আভিজাত্য, সমস্ত সামাজিক বাধাবন্ধ ঝেড়ে ফেলে। সে দিন শহরের সাধারণ মানুষের সঙ্গে রঙের উৎসবে মেতে উঠতেন কোনো এক সুপ্রভাতে ফরঘণা ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা, বিশ্বের আত্মজীবনী লেখকদের মধ্যে সামনের সারিতে থাকা চিরসবুজ সম্রাট বাবর। বাবর পুত্র সম্রাট হুমায়ুন খুব একটা সুযোগ পান নি সাম্রাজ্যের ভিত তৈরি করার। কিন্তু তিনি বলতেন মুঘল সাম্রাজ্য দক্ষিণ এশিয় চরিত্র ধারণ না করলে মুঘল হিন্দুস্তানে তার আয়ু কয়েক বছর।

অকাল প্রয়াত বাবার কথা মাথায় রেখে অসামান্য আত্মকথা লেখা সম্রাট, বাবরের নাতি শুলইকুল (সকলের জন্যে শান্তি) নীতির প্রবক্তা সম্রাট আকবর মুঘল সাম্রাজ্যকে সাজিয়ে দিলেন নতুন রঙে। তৈরি করলেন নতুন নতুন পরম্পরা। কাবুল শাসক, সৎ ভাই, মধ্য এশিয়া নির্ভর নক্সবন্দীয়া অনুগামী মির্জা হাকিমের সঙ্গে সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করার পারিবারিক দ্বন্দ্ব নিরসন করতে অনেকগুলি পদক্ষেপের মধ্যে দুটি উল্লেখযোগ্য নীতি উল্লেখ করব এই প্রবন্ধে, প্রথমটা হল মুঘল হিন্দুস্তানের সাম্রাজ্যের দেহে যতটা পারা যায় মধ্য এশিয় চরিত্র, রঙ, গন্ধ ছেঁটে ফেলে দক্ষিণ এশিয় চরিত্রের শেকড় চারিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয়টা হল প্রথম সূত্র অনুসরণ করে, অর্থাৎ শুধু সাম্রাজ্যের দেহেই দক্ষিণ এশিয়া রূপ রস গন্ধ রোপন নয়, রাষ্ট্র প্রধান স্বয়ং সম্রাটও নিজে ডুব দিলেন দক্ষিণ এশিয়ার কৃষ্টিতে। তিনি ভারতবর্ষীয় ধর্মপন্থ চিস্তি পরম্পরার অনুগামী হলেন। আকবর যেহেতু দিল্লিকে শয়তানের শহর, দুষ্টের শহর আখ্যা দিয়েছিলেন, তাই তিনি দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার অনুগামী না হয়ে দিল্লি থেকে একটু দূরে সিক্রি গ্রামের দক্ষিণ এশিয়া নির্ভর ধর্মপন্থগুরু সেলিম চিস্তির অনুগামী হলেন। মির্জা হাকিমের মুঘল হিন্দুস্তানে সাম্রাজ্য তৈরির খোয়াব আকাশে মিলিয়ে গেল। তাঁর আমলেই মুঘল দরবারে বড়ভাবে রাজস্থানী বিভিন্ন গোত্রের অভিজাত রাজপুত অংশ নিলেন, তিনি তাদের মেয়েকে বিয়েও করলেন। আকবরও, বর্ণময় বাবরের মতই হোলি উদযাপন করতেন। আবুলফজল বলছেন বছরভর তিনি শিশুদের মত জেনানার মহিলাদের জন্যে নানান আকারের রঙে আঙ্গিকের পিচকারি সংগ্রহ করতেন। আমরা জানি আকবর একটু সুযোগ পেলেই হারুন রশিদের মতো জনঅরণ্যে মিশে যেতেন জীবন নিয়েও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে। হোলির দিন ছিল ব্যতিক্রমী। তিনি রাজবেশের আগরার কেল্লার সদর দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেন তাঁর প্রিয় প্রজাদের সঙ্গে বাবরের পরম্পরার বজায় রেখে রঙ খেলতে।

বাবার ঠাকুর্দা, বাবরের মত স্মৃতিকথা লেখা জাহাঙ্গীর তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরিতে বলছেন তিনি হোলি খেলতে অসম্ভব ভালবাসতেন – নাম দিয়েছিলেন মেহফিল-এ-হোলি। বাংলার মসলিনে সেওজে ওঠা নুরজাহান আর শাহী নারীদের সঙ্গে রঙের খেলার মিনিয়েচার ছবি এঁকেছেন বহু ছবিয়াল – তাঁদের মধ্যে গোবর্ধন আর রসিক বিখ্যাততম। তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি (জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী)-তে রঙের উৎসব পালন বিষয়ে মুঘল বাদশাহ লিখছেন,

Their day is Holi, which in their belief is the last day of the year. This day falls in the month of Isfandarmudh, when the sun is in Pisces. On the eve of this day, they light fires in all the lanes and streets. When it is daylight, they spray powder on each other’s heads and faces for one watch and create an amazing uproar. After that, they wash themselves, put their clothes on, and go to gardens and fields. Since it is an established custom among the Hindus to burn their dead, the lighting of fires on the last night of the year is a metaphor for burning the old year as though it were a corpse.

জাহাঙ্গীরের হিন্দু সভাসদেরা এইদিন তাঁকে কৃষ্ণ নামে অভিহত করতেন। তাঁদের তিনি উপহারে ভরিয়ে দিয়ে যেতেন জেনানা মহলে। জ্যোতিষী, সাহিত্যিক, দার্শনিক তার কপালে চওড়া তিলক কাটতেন। জেনানা মহলের অমুসলমান জেনানারা কৃষ্ণ জাহাঙ্গীরকে মাঝখানে রেখে নিজেরা গোপী হয়ে নাচতেন আর রঙ খেলতেন।

শাহজাহানের আমলে এই রঙের পরব আরও বিচিত্র আকার ধারণ করল। তিনি এর নাম দিলেন ঈদ-ই-গুলাবি – গোলাপি ঈদ বা আব-এ-পাশি। তাঁর সময় হোলির উৎসবে অংশ নেওয়ার উন্মাদনা চরমে ওঠে। তিনি দিল্লির লাল কেল্লার ঝরোখা থেকে প্রজাদের সঙ্গে হোলি খেলতেন। ওমরাও, রাজা আর নবাবেরা একে অপরের গায়ে জলের রঙ দিচ্ছেন। উৎসবের উন্মাদনা চরমে তুলতে বেজে উঠতো শয়ে শয়ে শাহী নাকাড়া – শোনা যেত দূর বহুদূরে। আওরঙ্গজেব এই রঙ উৎসব থেকে দূরে থাকতেন। বাহাদুর শাহ জাফরও অংশ নিতেন।

বিশ্বেন্দু নন্দ
বিশ্বেন্দু নন্দ

লেখক, গবেষক, সংগঠক, প্রকাশক। উপনিবেশপূর্ব সময়ের সমাজ অর্থনীতিতে  কারিগরদের ইতিহাসের খোঁজে সর্বক্ষণের কর্মী। হকার, কারিগর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক। বাংলায় পরম্পরার উৎপাদন বিক্রেতাদের বিষয়ে লিখেছেন নিরন্তর। বাংলার উপনিবেশপূর্ব সময়ের পরম্পরার চাষী-হকার-কারিগর-ব্যবস্থা বিষয়ে খোঁজ করছেন। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। ‘পরম’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। অড্রে ট্রুস্কের আওরঙ্গজেব, ম্যান এন্ড দ্য মিথ, স্বেন বেকার্ট এম্পায়ার অব কটন, যদুনাথ সরকারের মুঘল এডমিনিস্ট্রেসন, আহকমই আলমগিরি অনুবাদ করেছেন। পলাশীপূর্বের বাংলার ৫০ বছর, পলাশীপূর্বের বাংলার বাণিজ্য দুটি মৌলিক পুস্তকের রচয়িতা। 

Share