সাঁই ফাঁই বাংলা

।। অরূপ শঙ্কর মৈত্র ।।

“বাংলা কিন্তু আসলে দুটো। একটা সিন (Seen) বাংলা (দেখিয়াছি পর্বতমালা, সিন্ধু)। আর একটা আনসিন (Unseen) বাংলা (দেখা হয় নাই ধানের শীষে একটি শিশিরবিন্দু)। ইতিহাসে সিন বাংলার স্পেস অনেক বেশি। আনসিন শুধু মাঝে মাঝে উঁকি মারে। আর রিয়ালিটিতে আনসিন বাংলাই মোদ্দা। সিন সেখানে দূরের তারা মাত্র। এই সিন-আনসিন বাংলার আর একটা নামকরণ করেছি আমি। সাঁই-ফাঁই। সাঁই-বাংলা, ফাঁই-বাংলা। সাঁই মানে ভগবান, ঈশ্বর, আল্লা। ফাঁই মানে কাপড় ছিঁড়ে দু টুকরো। কথায় বলে ফর্দা-ফাঁই। আবার সাঁই মানে শমীবৃক্ষ। ফাঁই মানে ফাঁকা। শমীবৃক্ষ, সেখানে পাণ্ডবেরা গোপনে তাদের অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিল। আর ফাঁই? অসীম শূন্যতা। এখানে সাঁই শব্দের মানে ঈশ্বর-আল্লা কিছু নয়। বরং এলিট, ভদ্রবিত্ত। এখানে সাঁই হচ্ছে কলকাতার বালিগঞ্জ, ঢাকার বনানী। আমাদের হাতে যত বিশেষজ্ঞদের কাগুজে ইতিহাস এসে পৌঁছয় সবই সেই সাঁই-বাংলা ভাগের ইতিহাস। ফাঁই-এর ইতিহাসের যেকটা পাতা আসে, সবই ফাঁকা। ভাগ-পরবর্তী ফাঁই-বাংলার অভ্যুত্থান হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। তারপরেই আবার ফাঁই অদৃশ্য হয়ে গেছে। “…  

সাঁইবাংলা ভাগ হইছে, ফাঁইবাংলা ভাগ হয় নাই। একদিন ফাঁইবাংলা সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলতে থাকা ফেলানীরে ঠিক ফাঁইমাটিতে নামায়ে আনব। 

  

১৯৪৭-এ বাংলা ভাগ হয়েছিল। এবছর তার ৭৫ তম বর্ষপূর্তি। আহা, কী আনন্দ। যেন জন্মদিনের প্লাটিনাম জুবিলি। এই নিয়ে লিখতে আর ইচ্ছে হয় না। বুকে যন্ত্রণা হয়। নিজের ওপর রাগ হয়। 

বাংলা ভাগ হল। বাংলা তো অনেককিছু নিয়ে। ইতিহাস, ভূগোল, ভাষা, কৃষ্টি, সমাজ, সাম্রাজ্য, রীতিনীতি, আচারবিচার, আবহাওয়া। কোনগুলো ভাগ হল? ভূগোল আর সাম্রাজ্য অর্থাৎ প্রশাসন ভাগ হল।  (আইসিএস, বিসিএস, আদালত, সেনাবাহিনী, পুলিশ, মন্ত্রী, সান্ত্রী এইসব)। কিন্তু ইতিহাস, ভাষা, কৃষ্টি, সমাজ, রীতিনীতি, আচারবিচার, আবহাওয়া কি ভাগ হল?

ইহুদিদের নানা ক্যাম্পে বন্দী করে, কতরকম ভাবে অত্যাচার করা যায়, নৃশংসতার প্রদর্শনী করা যায়, গ্যাসচেম্বারে মৃত্যুর আগে মানুষের সাইকো ঠিক কেমন হয়, আরও নানা নির্মম পরীক্ষাগুলো হাতেকলমে করে দেখিয়ে দিয়েছিল নাৎসি বাহিনী। সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র জনগোষ্ঠি বাঙালি, যার ওপর ঠিক সেই একই এক্সপেরিমেন্টাল রিসার্চ চলেছে, চলছে, হয়তো চলতেই থাকবে, ক্যাম্প কিম্বা চেম্বারে না নিয়ে গিয়েই। এবং বাঙালি জানেও না, তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জাতি না বলে জনগোষ্ঠি কেন বললাম? বললাম কেননা, বাঙালি কি জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পেরেছে? আমি সন্দিগ্ধ। বাঙালি স্বপ্ন দেখে বাংলা ভাষায় ঠিকই  কিন্তু স্বপ্নে ‘বাংলা’ দেখেনা। বাংলা অনেকগুলি সভ্যতার মিশ্রন। কনগ্লোমারেশন অফ সিভিলাইজেশনস। যোগ থেকে গুণে এখনও পৌঁছতে পারেনি।

হাতে গোণা কিছু গোরা সেপাই নিয়ে এসে বিনা প্রতিরোধে বাংলা দখল করে ফেলল একটা বিদেশি কোম্পানি। পলাশির পাশের গ্রামও জানতে পারল না। বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে ফুয়েরার কিম্বা রাজা নয়, জাস্ট একটা কোম্পানি। তিনকোটি জন-অধ্যুষিত বাঙ্গালা নামে একটা ভূখণ্ড নিমেষে দখল হয়ে গেল। বিনা বাধায়। ১৮০০ সালে গোটা বৃটেনের রয়্যাল ইমপিরিয়্যাল আর্মির থেকে ভারতে কোম্পানির নিজস্ব সেনাবাহিনীর মোট সেপাই বেশি হয়ে গেল, অথচ সেই বাহিনীর সিংহভাগ ছিল দিশি। ১৮৫৭র আগে কোনও স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়নি। না হয়নি। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লাও স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়। সিপাহী বিদ্রোহেও বাঙালির ভূমিকা খুব কম ছিল। ফকির-সন্ন্যাসি, নীল ইত্যাদি সব বিদ্রোহ ছিল ইস্যুভিত্তিক। সেখানে স্বাধীনতার ইস্যু ছিল না। বাঙালি দিনের পর দিন নুন না খেতে পেয়েও নেমকহারামি করেনি, লাখে লাখে অনাহারে মরেছে, খুন হয়েছে, প্রকাশ্য আলোয় আপনজনের ফাঁসি দেখে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরেছে। একের পর এক মন্বন্তর সহ্য করেছে। জাহাজে গরুছাগলের মতো ঠেসেঠুসে বিদেশে দাস দাসী, বেশ্যা হয়ে সাপ্লাই হয়েছে বিনা বাধায়। ১৯৪৭এ কত অবলীলায় বাংলা ভেঙ্গে দুটুকরো হয়ে গেল। কোনও প্রতিরোধ হলনা। কেউ রুখে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলল না, গোলি মারো র‍্যাডক্লিফের দাগ। আমরা মানিনা। আমরা কেউ নড়ব না। আমরা যেমন ছিলাম, তেমনই থাকব। সকাল বিকেল আমরা সীমান্ত ভেঙ্গে এপার-ওপার করব। না, তেমন কিছু হলনা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ? সে আর এক বিষয়। আজ নয়। আজ আমাদের নজর শুধু ভাগাড়ের দিকে। ১৯৪৭-এর বাংলা চিরে দু’টুকরো করার ইতিহাস আজ ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। কয়েক হাজার ‘বিশেষজ্ঞ’ কয়েক লক্ষ পাতায় লিখে ফেলেছে বাংলা-ভাগের ইতিকথা। ভাগাড়ে খোলা হাওয়ায় পাতাগুলো উড়ছে। অমল বিমল একটা করে পাতা খপ খপ করে ধরে আর বাংলা-ভাগ বুঝে ফেলে, কামাল জামাল আর একটা করে পাতা ধরে আর এক গল্প জেনে যায়। আমিও উড়ে আসা পাতায় পাতায় সব বাসি ফুল সাজিয়ে গুলশন বানিয়ে ফেলেছি।   

অবিভক্ত  বাংলা

বাংলা ভাগ হয়ে গেছে। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘেরা কি সীমান্ত মানে? কাক, কবুতর, ময়না, টিয়া, ফিঙে, গাঙচিলরা সীমান্ত মেনেই কি ওড়ে? আমরা খবর রাখিনা। রাখিনা কেননা, কমলেশ পালের কবতে, “লোকে পাখি পোষে, আমি পুষি ভালোবাসা বুকের খাঁচায়”।

বাংলা কিন্তু আসলে দুটো। একটা সিন (Seen) বাংলা (দেখিয়াছি পর্বতমালা, সিন্ধু)। আর একটা আনসিন (Unseen) বাংলা (দেখা হয় নাই ধানের শীষে একটি শিশিরবিন্দু)। ইতিহাসে সিন বাংলার স্পেস অনেক বেশি। আনসিন শুধু মাঝে মাঝে উঁকি মারে। আর রিয়ালিটিতে আনসিন বাংলাই মোদ্দা। সিন সেখানে দূরের তারা মাত্র।

এই সিন-আনসিন বাংলার আর একটা নামকরণ করেছি আমি। সাঁই-ফাঁই। সাঁই-বাংলা, ফাঁই-বাংলা। সাঁই মানে ভগবান, ঈশ্বর, আল্লা। ফাঁই মানে কাপড় ছিঁড়ে দু টুকরো। কথায় বলে ফর্দা-ফাঁই। আবার সাঁই মানে শমীবৃক্ষ। ফাঁই মানে ফাঁকা। শমীবৃক্ষ, সেখানে পাণ্ডবেরা গোপনে তাদের অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিল। আর ফাঁই? অসীম শূন্যতা। আবার আরেকভাবে বলতে গেলে, সাঁই হচ্ছে কলকাতার বালিগঞ্জ, ঢাকার বনানী। আমাদের হাতে যত বিশেষজ্ঞদের কাগুজে ইতিহাস এসে পৌঁছয় সবই সেই সাঁই-বাংলা ভাগের ইতিহাস। ফাঁই-এর ইতিহাসের যেকটা পাতা আসে, সবই ফাঁকা। ভাগ-পরবর্তী ফাঁই-বাংলার অভ্যুত্থান হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। তারপরেই আবার ফাঁই অদৃশ্য হয়ে গেছে।  

এই সাঁই-বাংলার গল্প কেমন?

পলাশির পর বছর কুড়ির মাথায় এই বাংলার দুর্বোধ্য সমাজব্যবস্থায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে, সঙ্গে পরপর কৃষকবিদ্রোহ আর মন্বন্তরে দিশেহারা হয়ে কোম্পানীর বণিকেরা, সেইযুগের ইংলিশ বুদ্ধিজীবীদের ডেকে নিয়ে এল। স্যার উইলিয়াম জোন্সের তত্ত্বাবধানে, ওয়ারেন হেস্টিংসের সহযোগিতায় তৈরি হল, এশিয়াটিক সোসাইটি। একই সঙ্গে এদেশে দেওয়ানি ফৌজদারি আইনের কাজ আর ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ শুরু হল জোন্সের হাত ধরে। এমন এক পেগাসাস মার্কা স্পাইওয়্যার কিম্বা ভাইরাস ম্যানুফ্যাকচার করতে হবে যা এই বেঙ্গলি নিগারদের আজন্ম ভেড়া বানিয়ে রাখতে পারবে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সেই ভাইরাস তৈরি হয়ে গেল। বাস। শুরু হয়ে গেল ভ্যাক্সিনেশন। ১৯৪৭এ এসে বাঙালির ম্যাসিভ সেরেব্র্যাল অ্যাটাক। ডানদিক সম্পূর্ণ প্যারালাইজড। বাঁদিক তবু একটু নড়াচড়া করে। ডানদিকে আঘাত লাগলে বাঁদিক টেরই পায়না। বাঁদিক ব্যথা পেয়ে আর্তনাদ করে উঠলে ডানদিক শুনতে পায় না।  

৯০৫ সালে প্রস্তাবিত দুটি বঙ্গ প্রদেশের ম্যাপ

প্রথম মাইল্ড স্ট্রোক: ১৯০৫সাল। প্রশাসনিক অজুহাতে বাংলা দুটুকরো হল। বরং বলা ভালো তিনটুকরো হল। বর্ণহিন্দু বাঙালি জমিদারদের মাথায় রক্ত উঠে গেল। শুরু হল বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী তীব্র আন্দোলন। হঠাৎ জাতীয়তাবোধের বিস্ফোরণ। না, তাই বলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তওয়ালাদের বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতাযুদ্ধের এলেম ছিলনা। এই বিস্ফোরণ ছিল, সমুদ্রের ওপরে বোমাবর্ষনের মত। ফাঁই বাংলার গভীরে সমুদ্র শান্ত সমাহিতই থাকল। ডানদিকে সুরেন বাঁড়ুজ্জে, বিপিন পালদের নেতৃত্বে জমিদারদের সংগঠন কংগ্রেসের ক্রোধ। ক্রোধের দৌড় অবশ্য, টাউন হল থেকে অ্যালবার্ট হল অব্দি। আজকের যুগের ওয়েবিনার-স্টাইলে। বাঁদিকে ঢাকার নবাবের নেতৃত্বে মুসলমান জমিদার, বড় জোতদারদের মহা ফূর্তি।  সম্ভবত এদের বেশিরভাগই ছিল আশরাফি মুসলমান। আরব, পাঠান, মোগল রক্তের উত্তরাধিকার। আচকান, সেরওয়ানি, লাল-ফেজটুপিতে সূতো দিয়ে নবাবী ঐতিহ্য। হিন্দু জমিদারদের ঝাড়বাতিওয়ালা আসরের মত, একটা জমপেশ আসর চাই। তাই ১৯০৬সালে মুসলিম লীগ জন্ম নিল। সেখানেও সেই সামুদ্রিক বোমাবর্ষন। প্রকাণ্ড ঢেউ। গভীরে কিন্তু তার কোনও প্রভাব ছিল না। সাধারণ বাঙালি, আতরাফি বা দলিত নিম্নবর্ণদের কাছে এই যুদ্ধ ছিল ওই রাজবাড়ির ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া। রাজামশাই দুই ভাইয়ের অংশ ভাগ করে দিয়েছে। এতদিন বড়ভাইয়ের রোয়াব ছিল বেশি, এবার তার গোসা হল। ওদিকে ছোটভাই আনন্দে দুহাত তুলে নাচছে।

১৯৪৭-এর বাংলা চিরে দু’টুকরো করার ইতিহাস আজ ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। কয়েক হাজার ‘বিশেষজ্ঞ’ কয়েক লক্ষ পাতায় লিখে ফেলেছে বাংলা-ভাগের ইতিকথা। ভাগাড়ে খোলা হাওয়ায় পাতাগুলো উড়ছে। অমল বিমল একটা করে পাতা খপ খপ করে ধরে আর বাংলা-ভাগ বুঝে ফেলে, কামাল জামাল আর একটা করে পাতা ধরে আর এক গল্প জেনে যায়। আমিও উড়ে আসা পাতায় পাতায় সব বাসি ফুল সাজিয়ে গুলশন বানিয়ে ফেলেছি।   

সুরেন বাঁড়ুজ্যে চাঁড়ালদের নেতা গুরুচাঁদকে বলল, জাতীয়তাবোধে প্রাণীত হয়ে আমরা বিলিতি জিনিস বয়কট করছি, মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নিচ্ছি, তোমরাও নাও। গুরুচাঁদ বলল ধুস, আমরা চাষার বেটা চাষা, বিলিতি জিনিস আবার কবে নিলাম যে বয়কট করব? ওসব জাতীয়তাবোধটোধ নিয়ে তোমরা মেতে থাকো। ভুল করে সাঁই-বাংলা ওই একবারই ফাঁই-বাংলার কাছে পৌঁছে গেছিল।

এই বঙ্গভঙ্গ আসলে ছিল কার্জনের একটা মারাত্মক গোঁয়ার্তুমি। বৃটিশরা যে এই বঙ্গভঙ্গ অনিবার্য মনে করেছিল তা নয়। যদিও সরকারিভাবে ১৮৬০-৭০ থেকেই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রশাসনিক সুবিধের জন্য ভাগের চিন্তা শুরু হয়েছিল কিন্তু এ যদি অনিবার্য হত, তাহলে, ১৯১২ সালেই এতবড় সিদ্ধান্ত রদ হয়ে যেত না। ১৯১২সালে আন্দোলন এমন কিছু আহামরি হয়ে ওঠেনি যে রদ না করলে বিপদ হয়ে যেত। হ্যাঁ, স্বদেশীদের সশস্ত্র আন্দোলন ক্রমে মাথাচাড়া দিচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু সেসব ছিল ব্যতিক্রমি, আবেগসমৃদ্ধ। শুধু সেই কারণেই বঙ্গভঙ্গ রদ এবং রাজধানী দিল্লি নিয়ে গিয়ে লুটিয়েন সাহেবকে দিয়ে নয়াদিল্লী রচনা করা হয়নি। বিশ্বযুদ্ধ প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠছিল আর আসমুদ্র হিমাচল শাসনের জন্যেও দিল্লিতে যাওয়া জরুরি হয়ে পড়ছিল। কার্জন তার এক বন্ধুকে লিখেছিল, এইবার পশ্চিমভাগের বর্ণহিন্দু ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিদের আঁতলামো বন্ধ হয়ে যাবে। কোথাও একটা তার ইগো ক্রাইসিস ছিল।

কিন্তু যদি সেইসময় সেই প্রশাসনিক ভাগ উভয়পক্ষ মেনে নিত? তাহলে সেটা অবশ্যই মন্দের ভালো হত। এই প্রথম সেযুগের পেগাসাস ভাইরাসের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হল। সাঁই-বাংলার হিন্দু মুসলিম ধর্মীয় বিভেদ (আসলে ক্ষমতার অসম বন্টনের হিসেবনিকেশ) ট্রিকল ডাউন করে ফাঁই-বাংলার হেঁদু মোচলমানদের মধ্যে নেমে আসতে শুরু করল। ফাঁই বাংলায় কোনওদিনই হেঁদু-মোচলমান বিভেদ ছিল না। শেতলা,  বনবিবির থানে সবাই গিয়ে মানত করে গাছে সূতো ঝুলিয়ে আসত। চন্নামিত্যু কিম্বা ছিন্নি খেয়ে আসত। আখড়া, দরগা সবই যে খোলা আকাশের নিচে হয়। খোদা বা ভগবান বদ্ধঘরে অন্ধকারে হাঁপিয়ে ওঠে যে। হাওয়ায় হাওয়ায় বাউল ফকিরের গানের সুরে আকাশে উড়ে যাওয়া চিল বট, অশত্থর ডালে এসে বসে ঘাড় বেঁকিয়ে গান শোনে, খাঁচার ভিতর অচীন পাখি ক্যামনে আসে যায়।

সুরেন বাঁড়ুজ্যে চাঁড়ালদের নেতা গুরুচাঁদকে বলল, জাতীয়তাবোধে প্রাণীত হয়ে আমরা বিলিতি জিনিস বয়কট করছি, মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নিচ্ছি, তোমরাও নাও। গুরুচাঁদ বলল ধুস, আমরা চাষার বেটা চাষা, বিলিতি জিনিস আবার কবে নিলাম যে বয়কট করব? ওসব জাতীয়তাবোধটোধ নিয়ে তোমরা মেতে থাকো। ভুল করে সাঁই-বাংলা ওই একবারই ফাঁই-বাংলার কাছে পৌঁছে গেছিল।

সেবার বাংলা ভাগ হলনা। ইতিমধ্যে ধীরে ধীরে ইংরেজরা ক্ষমতার সামান্য অংশ দেশীয়দের হাতে তুলে দিতে শুরু করেছে। অবস্থাপন্ন মুসলিম রায়ত, জোতদার এবং প্রাচীন নবাবের বংশধরেরা এতদিন কার্যত ক্ষমতা-বঞ্চিত ছিল। নির্বাচনী গণতন্ত্রের অপভ্রংশ চালু হয়েছে। সবাই নির্বাচক হতে পারবে না। নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি থাকলে, খাজনা দিলে তবেই ভোটাধিকার। মোচলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, আবার অশিক্ষা দারিদ্রও মোচলমানদের মধ্যে বেশি। তাই বেশিরভাগ মোচলমানের ভোট দেবার অধিকার নেই। ফলে মুসলিম জননেতারা ক্ষমতার সিঁড়ির প্রথম ধাপেই পা রাখতে পারছে না। ওপরে ওঠা তো পরের কথা। এই সমস্যা কিন্তু সাঁই-বাংলার। ফাঁই-বাংলার হেঁদু-মোচলমানের এ ব্যাপারে কোনও তাপউত্তাপ ছিল না। কেননা, আতরাফ মোচলমান আর চাঁড়াল, ডোম, মালো, বাউড়িদের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা একই। রাজনীতিতে তাদের কোনও প্রতিনিধি নেই। রাজনীতিতে উৎসাহও নেই। ওসব রাজবাড়ির বৈঠকখানায় কার কোথায় বসার আসন হবে সেই নিয়ে ঝামেলি।  সাঁই-বাংলার সমস্যা বুঝতে পেরেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। বাংলায় হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ক্ষমতাবিন্যাসের অসাম্যই যে মনোমালিন্যের মূল কারণ তিনি ধরে ফেলেছিলেন। তিনি মুসলিম নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে উভয় পক্ষের মধ্যে বেঙ্গল প্যাক্ট নামে একটা চুক্তি করে ফেললেন। জনসংখ্যা মোতাবেক ক্ষমতার সমবন্টন। কিন্তু প্রবল আপত্তি উঠল বর্ণহিন্দু কংগ্রেস নেতাদের পক্ষ থেকে। হ্যাঁ, বাংলার কংগ্রেস নেতাদের বড় অংশই বেঙ্গলপ্যাক্ট মানতে রাজি নন। চিত্তরঞ্জনও একগুঁয়ের মত দাঁত কামড়ে পরে রইলেন। কিন্তু আচমকা চিত্তরঞ্জন মারা গেলেন ১৯২৫ সালে। তারসঙ্গে বেঙ্গল প্যাক্টও হারিয়ে গেল। ইতিমধ্যে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব চুপিসারে পশ্চিম ভারতে চলে গেছে। দলেও প্রাদেশিক বিকেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পূর্ণ কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। সারাদেশ জুড়ে লাল-বাল-পালদের যে ক্ষমতার ফেডারাল স্ট্রাকচার ছিল, তা শেষ। এখন থেকে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির কথাই শেষ কথা। হাইকমাণ্ড। এমনকি কার্যত প্রদেশ-কংগ্রেসের সভাপতিও স্থির করে দিচ্ছে হাইকমাণ্ড। মুসলিম লীগের নেতৃত্বও ওইদিকে পা বাড়িয়ে। জিন্না, গান্ধী দুজনেই গুজরাটি, দুজনেই ব্যারিস্টার। দুজনের কথাই তাদের সংগঠনে শেষ কথা। ১৮৮৫ সাল থেকে ১৯৩৮সাল, এই ৫৩ বছরে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি হয়েছিল ১৬জন বাঙালি। তাও ১৯৩৮এ হাইকম্যাণ্ড গান্ধীর আশীর্বাদে একবার আর পরের বছর গান্ধীর আপত্তি সত্ত্বেও আর একবার সভাপতি হয়েছিল সুভাষ। কার্যত চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর থেকেই কংগ্রেসের সর্বভারতীয় স্তরে আর বাঙালি নেতা নেই। ভাবলে অবাক লাগবে, সেই ১৯৩৯সালে সুভাষ পদত্যাগ করার পর থেকে আজ পর্যন্ত (২০২১) আর একজন বাঙালিও কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি হয়নি। ১৯২৫এ চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পরেই পেগাসাস-ভাইরাসের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। বাঙালির রক্তেই জেনেটিক ডিজেনারেশন শুরু হয়ে গেছে। ১৯২৬এ কলকাতায় বড় ধরনের দাঙ্গা শুরু হল। ‘মহেশ’-এর গফুর-আমিনার স্রষ্টা সেই ২৬-এই এক সভায় যে বক্তৃতা দিলেন, তাতে বোঝা গেল, ভাইরাসে বুদ্ধিজীবীরাও কতটা প্রভাবিত হয়েছে। শুরু হয়ে গেল সারা বাংলায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সিরিজ। প্রায় মেগাসিরিয়্যালের কায়দায় নিয়মিত। কীভাবে সামান্য কিছু হিংস্র ‘হিন্দু’ আর ‘মুসলিম’ এই দাঙ্গাগুলো এন্যাক্ট করত, প্রায় সিনেমাটিক ভিলেনের দক্ষতায় তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। ছোট, মাঝারি গোছের দাঙ্গা চলতেই থাকল। বড় আকার নিল ১৯৪৬-এ কলকাতায়। পাশাপাশি সাঁই-বাংলার মুসলিম নেতারা রাজনীতিতে ফাঁই-বাংলার মোচলমানদের সংগঠিত করায় মন দিল। ফজলুল হক মানতে পারলেন না। পৃথক দল গড়ে তুললেন। ওদিকে শ্যামাপ্রসাদ সাভারকর সরাসরি নানা জায়গায় জনসভা করে ফাঁই-বাংলার হাঁড়ি ডোম চাঁড়ালদের বোঝাতে শুরু করল তোমরা আসলে হিন্দু, হে। ভুলিও না, মুচি মেথর তোমার ভাই। প্রোসেসটা শুরু হয়ে গেছিল উনিশ শতকের শেষেই। আর্যসমাজের দলিত-শোধন প্রক্রিয়া। জাতের নামে জাত-জালিয়াতদের বজ্জাতি। কংগ্রেসের নেতারাও আড়ালে আবডালে সেটাই করে চলছিল। ‘হিন্দুত্বের’র কপিরাইট কিন্তু একজন বাঙালির। সাহিত্যিক চন্দ্রনাথ বসু ১৮৯৫ সালেই হিন্দুত্ব নিয়ে বই লিখে ফেলেছিলেন। গোলওয়ালকার, সাভারকরেরা অনেক পরে “হিন্দুত্ব” নিয়ে নাচানাচি শুরু করেন। আজ বেঙ্গল-প্যাক্ট, চিত্তরঞ্জন বিস্মৃতপ্রায়। প্রায় একশ বছর পরে ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বললেন, সেদিন চিত্তরঞ্জনের বেঙ্গল প্যাক্ট সফল হলে বাংলা হয়তো আজ দুটুকরো হতনা। তো তরী ডুবে যাবার পর জলে হাবুডুবু খেতে খেতে হাহুতাশ করে কী লাভ?  

সাঁই-বাংলার সমস্যা বুঝতে পেরেছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। বাংলায় হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ক্ষমতাবিন্যাসের অসাম্যই যে মনোমালিন্যের মূল কারণ তিনি ধরে ফেলেছিলেন। তিনি মুসলিম নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে উভয় পক্ষের মধ্যে বেঙ্গল প্যাক্ট নামে একটা চুক্তি করে ফেললেন। জনসংখ্যা মোতাবেক ক্ষমতার সমবন্টন। কিন্তু প্রবল আপত্তি উঠল বর্ণহিন্দু কংগ্রেস নেতাদের পক্ষ থেকে। হ্যাঁ, বাংলার কংগ্রেস নেতাদের বড় অংশই বেঙ্গলপ্যাক্ট মানতে রাজি নন। চিত্তরঞ্জনও একগুঁয়ের মত দাঁত কামড়ে পরে রইলেন। কিন্তু আচমকা চিত্তরঞ্জন মারা গেলেন ১৯২৫ সালে। তারসঙ্গে বেঙ্গল প্যাক্টও হারিয়ে গেল। ইতিমধ্যে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব চুপিসারে পশ্চিম ভারতে চলে গেছে। দলেও প্রাদেশিক বিকেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পূর্ণ কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। সারাদেশ জুড়ে লাল-বাল-পালদের যে ক্ষমতার ফেডারাল স্ট্রাকচার ছিল, তা শেষ। এখন থেকে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির কথাই শেষ কথা। হাইকমাণ্ড। এমনকি কার্যত প্রদেশ-কংগ্রেসের সভাপতিও স্থির করে দিচ্ছে হাইকমাণ্ড। মুসলিম লীগের নেতৃত্বও ওইদিকে পা বাড়িয়ে। জিন্না, গান্ধী দুজনেই গুজরাটি, দুজনেই ব্যারিস্টার। দুজনের কথাই তাদের সংগঠনে শেষ কথা।

লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সংযত হতে হবে। দ্রুত বাংলাভাগ করে কাজ শেষ করি। ১৯৩৭ সালের বাংলার লেজিস্লেটিভ ইলেকশনে কংগ্রেস সবচেয়ে বড় দল হলেও সরকার গঠনের গরিষ্ঠতা ছিলনা। কৃষক-প্রজা পার্টির ফজলুল হক বারবার কংগ্রেসকে মিনতি করল, এসো আমরা জোট গঠন করে সরকার গড়ি। ফজলুল হক মুসলিম লীগের সঙ্গে এককালে জড়িত থাকলেও মুসলিম লীগকে পছন্দ করতেন না। কিন্তু কংগ্রেসের হাইকম্যাণ্ড অনুমতি দিল না। ফজলুল হক মুসলিম লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গড়লেন। কিছু কিছু ভূমিসংস্কারের কাজ শুরু হল। সাঁই-বাংলার জমিদারশ্রেনী এইসব সংস্কারে ক্ষুব্ধ হল। ১৯৩৯ সালে নির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতি সুভাষকে কংগ্রেসেই কার্যত একঘরে করা হল। সুভাষ পদত্যাগ করে মুসলিম লীগের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন। শেষকালে ১৯৪১ সালে দেশ ছেড়ে চলেই গেলেন। কয়েকমাস পরে রবিঠাকুর মারা গেলেন। কিছুদিন পর নজরুল নির্বাক হয়ে গেলেন। হতাশা গ্রাস করল ফজলুল হককে। কার্যত তাঁর রাজনীতি থেকে সন্ন্যাসের শুরু এই সময়েই। আগস্ট ১৯৪২-এ গান্ধীর ডাকে ভারত-ছোড়ো আন্দোলন শুরু হতেই বেশিরভাগ কংগ্রেস নেতা গ্রেপ্তার। মার্কেট ফাঁকা। ১৯৪৩-এ মন্বন্তর শুরু হল। (যদিও এই তত্ত্ব সাঁই-বাংলার। যেন, আহা, আচমকা দুর্ভিক্ষ এসে হাজির হল, আমরা তৈরিই ছিলাম না। তা নয়। যদি ফাঁই-বাংলার ছেঁড়া কাগজ উড়ে এসে হাতে পরে, তাহলে দেখা যাবে এই দুর্ভিক্ষ, অনাহার, মন্বন্তর কিন্তু সেই ১৭৬৫ থেকে শুরু। হঠাৎ হঠাৎ এক্সপোনেনশিয়াল কার্ভের মত প্রবল বেড়ে যায়, অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমান হয়ে পরে। আমরা সেটাকে মন্বন্তর বলি। আবার কমে যায়। কিন্তু কমে গেলেও অর্দ্ধ উলঙ্গ আর অর্ধাহার চলতেই থাকে। আমাদের চোখে অদৃশ্য হয়ে যায়। এটাই ফাঁই-বাংলা। শুধু বাংলাতেই সরকার-স্বীকৃত আটটা দুর্ভিক্ষ হয়েছে। এই ৪৩-এর মন্বন্তরের লক্ষণ কিন্তু ১৯৩৫-৩৬ সালেই দেখা গেছিল। ফাঁই-বাংলা বলে আমরা দেখতে পাইনি। অদৃশ্য তো। আর এই মন্বন্তর ১৯৪৬-৪৭ অব্দি চলেছে। কমে গেলেও আজও এই একুশশতকেও চলছে। সাঁই-বাংলার ফোটোগ্রাফারদের লেন্সে মাঝে মাঝে ধরা পরে।) দুর্ভিক্ষে ৪০ লক্ষ মানুষ মারা গেল। ১৯৪৫এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল। সুভাষ নিখোঁজ। আজাদহিন্দ ফৌজের বহু সৈনিক গ্রেপ্তার। তাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার শুরু হয়েছে। ওদিকে নৌবিদ্রোহ। সারা দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু হল।

চিত্তরঞ্জন দাশ

তিরিশের দশকের মাঝামাঝি যখন, একদিকে মুসলিম নেতারা মোচলমানদের ঐক্যবদ্ধ করছেন, সাভারকার-শ্যামাপ্রসাদ নিম্নবর্ণ দলিতদের “এতদিনের অভিমান” ঘুচিয়ে হিন্দুত্বের দীক্ষা দিচ্ছেন, তখনই সাভারকার হিন্দু মুসলিম দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের কথা বলেছিলেন। পরে ১৯৪০-এ জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান দাবি করলেন। যদিও ১৯৪২-এ মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভায় শ্যামাপ্রসাদও ছিলেন। এমনতো রাজনীতিতে হয়েই থাকে। শুধু আজকের যুগেই নেতাদের ভোলবদল হয়, তা নয়। তথাকথিত স্বাধীনতার পরেও নেহেরু মন্ত্রীসভায় শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন। এইখানে অপ্রাসঙ্গিক একটা মজার তথ্য দিয়ে রাখি। কংগ্রেস একটা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে জন্ম নিয়েছিল। তাই অন্য যে কোনও সংগঠনের সদস্য কংগ্রেসের সদস্যও হতে পারত। জিন্নাও কংগ্রেসে ছিলেন। স্বরাজ্য পার্টি তৈরি করেও চিত্তরঞ্জন কংগ্রেসে ছিলেন। সুভাষ সভাপতি হয়ে হিন্দু-মহাসভার সদস্যরা কংগ্রেসে থাকতে পারবেন না এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার আগে হিন্দু-মহাসভার সদস্যদের একই সঙ্গে হিন্দুত্ব আর স্বদেশি আন্দোলন করায় কোনও অসুবিধে ছিল না। বাবু বাঙালিদের এই ঝোলে আর অম্বলে একসঙ্গে থাকা রীতিমত একটা আর্ট।

১৯৪৫-এ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ইংল্যাণ্ড থেকে এসে গেল ক্যাবিনেট মিশন। তারা তিনটি পৃথক স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যের কথা বলল। অর্থ, বিদেশ, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি কয়েকটি দপ্তর ছাড়া সমস্ত ক্ষমতা রাজ্যের হাতে থাকবে। মুসলিম লীগ সম্মত। কিন্তু কংগ্রেস গররাজি। তিনটি আলাদা আলাদা রাজ্যের ব্যবস্থার জন্য নয়। তারা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার পক্ষে। তারা সারাদেশের নির্ভেজাল ঐক্যের পক্ষে।  পিরামিডের মত স্ট্রাকচার হবে। হাইরাইজ। একই বৃত্তের মধ্যে আলাদা আলাদা বাংলো বাড়ি নয়। কাজেই ক্যাবিনেট মিশন ব্যর্থ। মুসলিম লিগ “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”এর ডাক দিল। ১৬ই আগস্ট ডাইরেক্ট অ্যাকশান ডে। কলকাতায় বীভৎস দাঙ্গা। জ্যোতিবাবুর আন্দাজ প্রায় ২০ হাজার খুন হয়েছিল। তখনও বাংলা ভাগ নিয়ে তেমন আলাপ আলোচনা শুরু হয়নি। বাংলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলা কি তাহলে পাকিস্তানে যাবে? নাকি বাংলা হিন্দুস্তানেই থাকবে? নাকি হিন্দু মুসলিম বসতি অনুসারে বাংলা ভাগ হবে? জোর বিতর্ক। সারা বাংলা জুড়ে সভাসমিতি হচ্ছে। কংগ্রেসের নেতারা বাংলা-ভাগের পক্ষে আর মুসলিম লীগের নেতারা পাকিস্তানের দাবিতে। দাঙ্গার বিরুদ্ধে গান্ধী নোয়াখালিতে সত্যাগ্রহ করছেন। ঠিক হল, বিধানসভার সদস্যরা ভোট দিয়ে ঠিক করবে বাংলার কি হবে। সেই ভোটও ভাগ ভাগ করে হবে। শেষে বাংলা ভাগের পক্ষেই রায় হল। এমনকি জ্যোতিবাবুসহ তিনজন কম্যুনিস্ট সদস্যও ভাগের পক্ষেই গেলেন। ভাবতে অবাক লাগে, একই সময়ে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির জন্ম। ২৬ বছরে এসে এখানে কম্যুনিস্টরা বাংলা ভাগে সম্মতি দিচ্ছে আর ওদিকে দুবছর পরে চীনা কম্যুনিস্ট পার্টি জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে ক্ষমতা দখল করল। মাঝে ১৯৪৭ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শরত বসু, কিরণশঙ্কর রায়, সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিমরা মাউন্টব্যাটেনের কাছে এক অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। অদ্ভুত বলছি এই কারণে যে এ ধরণের ভাবনা আগে কেউ ভেবেছে বলে জানা নেই। হিন্দুস্তান, পাকিস্তানের বাইরে স্বাধীন অখণ্ড বাংলাদেশ। বাংলা ভাগ হবে না। যেহেতু বিধানসভার সদস্যরা ইউনিভার্সাল ফ্র্যাঞ্চাইজিতে নির্বাচিত নন, তাই তাদের মতামত সমস্ত বাঙালির মতের প্রতিফলন নয়। গণভোট হোক। অখণ্ড স্বাধীন বাংলা হবে কিনা। প্রথমে মাউন্টব্যাটেন রাজি হয়েও ছিলেন। কিন্তু খবর পৌঁছে গেল বল্লভভাই প্যাটেলের কাছে। বিড়লা, প্যাটেল, নেহেরু সবাই অখণ্ড স্বাধীন বাংলার তীব্র বিরোধিতা করল। বাংলা ভাগ হয়ে বৃহৎ অংশ পাকিস্তানে চলে যায় যাক, কিন্তু স্বাধীন বাংলা অসহ্য। গান্ধী শরতবাবুদের এই স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব কানেই তুললেন না।

স্বাধীন অখণ্ড বাংলার প্রস্তাবের পক্ষে গণভোট বিপজ্জনক বুঝতে পেরে প্যাটেলরা দ্রুত প্রস্তাব পাঠালেন, এক্ষুনি স্বাধীনতা দিলে পুর্ণ স্বাধীনতার দরকার নেই, ডোমিনিয়ন স্টাটাস দিলেই হবে। তাই ১৫ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রী জহরলালকে ইংল্যাণ্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার নামে শপথ নিতে হয়েছিল। সেদিন দেশ সরকারিভাবে স্বাধীন বা মুক্তি পায়নি। পেয়েছিল ডোমিনিয়ন স্টাটাস। আজও কিন্তু সরকারিভাবে ভারত স্বাধীন নয়। ডোমিনিয়ন শব্দটা বাতিল হয়ে কমোনওয়েলথ হয়েছে। ভারত আজও কমোনওয়েলথের সদস্য। ইংল্যাণ্ডের রাণীর ভারতসফরে আসার জন্য অনুমতি লাগে না। অবিভক্ত বাংলার ম্যাপে দাগ টেনে র‍্যাডক্লিফ বাংলা দুটুকরো করে ফেলল। হাঁড়িকাঠে পাঁঠা বলির মত। ঘচাং। বাংলা ভাগ হয়ে গেল। ওপার থেকে এপারে, এপার থেকে ওপারে উদ্বাস্তু স্রোত। শুরুতে হিন্দু-মুসলিমরা সীমান্ত অতিক্রম করলেও পরে হেঁদু মোচলমানেরাও দলে দলে উদ্বাস্তু হয়েছিল। এটাই সাঁই-বাংলার ভাগ হয়ে যাবার মোদ্দা গল্প। ফাঁকে ফাঁকে আরও আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাহিনী আছে। সেগুলোও সাঁই-বাংলার। এই যেমন ১৯৪৬ সালে ১৬ই আগস্ট কলকাতার কুখ্যাত দাঙ্গার ঠিক আগের রাতে উত্তর কলকাতায় স্টার থিয়েটারে অভিনীত হয়েছিল সেযুগের বিখ্যাত অভিনেতা কমল মিত্র অভিনীত মহেন্দ্র গুপ্ত পরিচালিত টিপু সুলতান নাটক। আর সেই নাটকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য আর একাত্মবোধ, স্বাধীনতার যুদ্ধের প্রতিটি দৃশ্যে প্রবল হাততালি। কারা দিয়েছিল? সেকালে অবস্থাপন্ন বাবু ভদ্রলোকেরাই নাটক দেখতেন। অত দামি টিকিট ফাঁই-বাংলার নাগালের বাইরে ছিল।    তাহলে? দাঙ্গাটা করল কারা? এই প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা।

কিন্তু এতো গেল সাঁই-বাংলার কাহিনী। ফাঁই-বাংলা? গফুর মিয়া পরাণ মণ্ডলদের বাংলা?  সিরাজদৌল্লা নামে শচীন সেনগুপ্তর লেখা যাত্রাপালায় “বাংলা শুধু হিন্দুর নয়, বাংলা শুধু মুসলমানের নয়, মিলিত হিন্দু মুসলমানের এই বাংলা” সংলাপে হাততালির ঝড় উঠত ফাঁই-বাংলায়। ব্রজেন দে সুপারহিট পালা “বাঙালি”। কীভাবে স্বাধীন বাংলার নবাব দাউদ খাঁ দিল্লীর কাছে হেরে গেল। এইখানেই অসাধারণ মুন্সীয়ানা ইংরেজ সাহেব আর তাদের দিশি দোসরদের তৈরি করা পেগাসাস ভাইরাসের। সেই কারণেই ফাঁই-বাংলা আজও ফাঁই রয়ে গেছে। সেই অসামান্য ভাইরাসের নাম “দ্বিজাতি-তত্ত্ব”।

১৯৪৭ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শরত বসু, কিরণশঙ্কর রায়, সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিমরা মাউন্টব্যাটেনের কাছে এক অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। অদ্ভুত বলছি এই কারণে যে এ ধরণের ভাবনা আগে কেউ ভেবেছে বলে জানা নেই। হিন্দুস্তান, পাকিস্তানের বাইরে স্বাধীন অখণ্ড বাংলাদেশ। বাংলা ভাগ হবে না। যেহেতু বিধানসভার সদস্যরা ইউনিভার্সাল ফ্র্যাঞ্চাইজিতে নির্বাচিত নন, তাই তাদের মতামত সমস্ত বাঙালির মতের প্রতিফলন নয়। গণভোট হোক। অখণ্ড স্বাধীন বাংলা হবে কিনা। প্রথমে মাউন্টব্যাটেন রাজি হয়েও ছিলেন। কিন্তু খবর পৌঁছে গেল বল্লভভাই প্যাটেলের কাছে। বিড়লা, প্যাটেল, নেহেরু সবাই অখণ্ড স্বাধীন বাংলার তীব্র বিরোধিতা করল। বাংলা ভাগ হয়ে বৃহৎ অংশ পাকিস্তানে চলে যায় যাক, কিন্তু স্বাধীন বাংলা অসহ্য। গান্ধী শরতবাবুদের এই স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব কানেই তুললেন না। স্বাধীন অখণ্ড বাংলার প্রস্তাবের পক্ষে গণভোট বিপজ্জনক বুঝতে পেরে প্যাটেলরা দ্রুত প্রস্তাব পাঠালেন, এক্ষুনি স্বাধীনতা দিলে পুর্ণ স্বাধীনতার দরকার নেই, ডোমিনিয়ন স্টাটাস দিলেই হবে। তাই ১৫ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রী জহরলালকে ইংল্যাণ্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার নামে শপথ নিতে হয়েছিল। সেদিন দেশ সরকারিভাবে স্বাধীন বা মুক্তি পায়নি। পেয়েছিল ডোমিনিয়ন স্টাটাস। আজও কিন্তু সরকারিভাবে ভারত স্বাধীন নয়। ডোমিনিয়ন শব্দটা বাতিল হয়ে কমোনওয়েলথ হয়েছে। ভারত আজও কমোনওয়েলথের সদস্য। ইংল্যাণ্ডের রাণীর ভারতসফরে আসার জন্য অনুমতি লাগে না।

ধুস। দ্বিজাতি-তত্ত্ব তো সাভারকার, জিন্নাদের আবিষ্কার।

না। দ্বিজাতি-তত্ত্বের এই জাতি কিন্তু হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় জাতি নয়। এই জাতির ইংরেজি শব্দ হল রেস। কালো সাদা যেমন। রেস। রেসের বাংলা জাতি। সাহেবরা এদেশে এসে এখানকার ডেমোগ্রাফি দেখে ভড়কে গেছিল। একিরে বাবা। এত ভাষা, এত ভিন্ন ভিন্ন রীতিনীতি, আচারবিচার, ধর্ম। ঘন জঙ্গলে রাস্তা হারিয়ে যাচ্ছে। উইলিয়াম জোন্স এলেন ইতিহাস চর্চা করতে। এশিয়াটিক সোসাইটি তৈরি হল। নানা গবেষণা। মূল উদ্দেশ্য ওই। পেগাসাসের মত ভাইরাস চাই। শেষে ১৮৫৭র সিপাহী বিদ্রোহের পর বোঝা গেল এদেশে আসলে দুটি পৃথক রেস আছে। হিন্দু আর মুসলিম। রেস। জাতি।

আসলে আশরাফি, নবাবি, মোগলাই পাঠানিয়া মুসলিম আর হাফ-ফর্সা, হাফ-বেঁটে বাঙালি বামুন কায়েত বদ্যিদের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট প্লাস ধর্মীয় আচার আচরণের তফাত দেখে মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে এরা দুটো পৃথক রেস বা জাতি।

কোনও জঙ্গলাকীর্ণ দ্বীপের চারপাশে জাহাজে করে বা বিচে ঘুরলে, এমনকি কিছুটা জঙ্গলের ভেতরে গেলেও দ্বীপের প্রান্তিক এলাকার গাছগাছালিই নজরে আসে। তার থেকে ধারণা হতে পারে এই দ্বীপে শুধু বাঁশ হয়। বাস। দ্বীপের নাম হয়ে গেল বাঁশবেড়িয়া। অথচ সেই জঙ্গল হয়ত সেগুন, চন্দন, হিজলে ভর্তি। চোরকাঁটা, বাবলা, হোগলা, বিচুটি অজস্র তৃণের সমাহার। সবাই মিলেমিশেই আছে। কিন্তু ফাঁই। ফাঁকা। বাংলাও তেমনি ফাঁই, অদৃশ্য। উনিশ শতকের শেষের দিকে এই সাহেব আর উচ্চবর্ণদের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে যশোর খুলনার হেঁদু-মোচলমানেরা টানা তিনমাস অসহযোগ আন্দোলন করেছিল। ওই হাইরাইজের ওপরতলার বিরুদ্ধে। ভাত-কাপড় বন্ধ হয়ে গেছিল। সাহেবরা এসে মীমাংসা করে দেয়।

শেষে এসে আবার সাঁই ফাঁই নিয়ে একটু ক্যাচাল করা যাক। সাঁইএর অর্থ যেমন ইশ্বর, যাকে প্রণাম করতে হয়, তেমনি আবার শমীবৃক্ষও। আত্মগোপন করে থাকার সময় যার কোটরে নাকি পাণ্ডবেরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিল। দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুরে এই শমীবৃক্ষ আছে। সসম্মানে পুজিত হয়। আরও কোথাও কোথাও আছে। জায়গাটা একেবারে সেকালের গৌড় বা পুণ্ড্র অঞ্চলে। প্রাচীন যুগে যেখানে প্রথম সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল। সাঁই যারা, অর্থাৎ যারা ঈশ্বর-সদৃশ, তারা বামুন হোন বা মোগলাই, এসেছিল সেই উত্তরভারত থেকেই। পাণ্ডবদের মতোই। শমীবৃক্ষে তাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখা খুব একটা অবাক হবার মত ঘটনা নয়।

আর ফাঁই? ফাঁকা অথবা অসীম শূন্যতা? হ্যাঁ। গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা-যমুনার বাংলা সেযুগে ফাঁকাই  ছিল। ধুধু চর। খাল, বিল, উথালপাথাল নদী আর সুদুর সমুদ্দুর। পলি পরে পরে নিত্য নতুন চর গজিয়ে উঠছে, আবার ভাঙ্গছে। ভূনির্মাণশিল্প চলছে প্রকৃতির। জঙ্গলের আড়ালে মানুষ। প্রোটো-অস্ট্রিক-প্রোটো-মোঙ্গল দ্রাবিড়দের অন্য এক নির্মাণশিল্প। ধান, তাল, তুলো, মাছ, কতরকমের মশলা দিয়ে তৈরি আর এক বিচিত্র জীবনের নির্মাণ। সাঁইদের ভাষায় পক্ষীদের রাজ। পাখির ভাষায় কথা বলা একদল অদ্ভুতুড়ে জীব। যারা শূন্যতায় ভরপুর। যে শূন্যতা আজও দুর্বোধ্য।  

বাংলার বুকে সন্ধ্যা নেমে আসে সুয্যি ডুবি ডুবি আলো-আঁধারের ভালোবাসার ডালি নিয়ে। নদীর পারে তখন মরমিয়া ডাকাতিয়া বাঁশি বাজে। আত্মহারা বাঙালি হারিয়ে যায়। ‘সন্ধ্যা’, ‘ডাকাতিয়া’, ‘বাঙালি’ তিনটেই কিন্তু নদীর নাম। ওরা ফাঁই, তাই আমাদের জানা নাই। নেহাত সদ্য বাংলাদেশ হবার পর দুই বাংলার মিলিত প্রয়াসে এক বামুনের ব্যাটার হাত ধরে এক মালোর ব্যাটার জীবনযুদ্ধের ছবি তৈরি হয়েছিল। তাই তিতাস জাতে উঠেছিল।  

সাঁই-বাংলা ভাগ হইছে, ফাঁই-বাংলা ভাগ হয় নাই। একদিন ফাঁই-বাংলা সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলতে থাকা ফেলানীরে ঠিক ফাঁই-মাটিতে নামায়ে আনব।    

অরূপ শঙ্কর মৈত্র

নাট্যকার, নাট্য পরিচালক ও লেখক। নিবাস: দক্ষিণ কলকাতা।

Share