ঐতিহ্যবাহী দশঘড়া অতীতের এক বিস্ময় (টেরাকোটা- প্রথম পর্ব)

।। মুকুট তপাদার।।

আমাদের বাংলায় পারম্পরিক শিল্পের যে বিশাল ভাণ্ডার আছে, সেসব শিল্পের বেশ কিছু নিদর্শন আজ মাটিতে ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। বড় বাংলার টেরাকোটা শিল্প এরকমই এক নিদর্শন। ঐতিহ্যবাহী এই টেরাকোটা শিল্পের বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শন নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন আলোকচিত্রী ও লেখক-গবেষক মুকুট তপাদার, সঙ্গে থাকছে তাঁরই লেন্সে উঠে আসা বড় বাংলার টেরাকোটা শিল্পের বিভিন্ন স্থাপত্যের আলোকচিত্র। প্রথম পর্বে থাকছে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার দশঘড়ার বিশ্বাস জমিদারবাড়ির গোপীনাথ মন্দির বিষয়ক তথ্য, আলাপ ও আলোকচিত্র।

ঐতিহ্যবাহী দশঘড়া অতীতের এক বিস্ময় (টেরাকোটা- প্রথম পর্ব)

‘টেরা’ শব্দের অর্থ ‘মাটি’ এবং ‘কোটা’র অর্থ হচ্ছে পোড়ানো। এটি একটি লাতিন শব্দ। দালান, আটচালা ও উপাসনালয়ের দেওয়ালে টেরাকোটার মাধ্যমে পৌরাণিক কাহিনী, লোকগাথা, যুদ্ধ, নৌকাবিহার, জীবজন্তুর দৃশ্য, সমাজ চিত্র প্রভতি নানারকম বিষয় স্থান পেয়েছে। মন্দির, মসজিদ কিংবা মাজারের গায়ে চারকোণে খাড়া করে লাগানো টেরাকোটার কাজ গুলিকে ‘কল্পলতা’ বা ‘মৃত্যুলতা’ বলা হয়ে থাকে। সাধারণত মন্দির অলঙ্করণের জন্য এই শিল্পরুপ অপরিহার্য ছিল। চালা, রত্ন, দালান এবং দেউল এই চারভাগে বাংলার টেরাকোটা স্থাপত্যকে আলাদা করা যায়। 

কাছারিবাড়ির সম্মুখভাগ

সুলতানি আমলে নির্মিত বেশ মসজিদে দেওয়ালের গায়ে টেরাকোটার নিদর্শন দেখা গেছে। মন্দিরের মতো মসজিদের অলঙ্করণেও টেরাকোটা শিল্পকে ব্যবহার করা হয়েছে দারুণভাবে। হোসেন শাহের শিল্পের প্রতি বরাবরই খুব ঝোঁক ছিল। পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোটে হোসেন শাহের ভাঙা মসজিদটিতে টেরাকোটার কাজ রয়েছে।

অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, হুগলি ছিল দক্ষিণ রাঢ় অঞ্চলের একটি অংশ। বৃহৎ বঙ্গের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, শিল্প এবং এই স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। হুগলীর টেরাকোটার সংক্রান্ত আলাপে আমরা  হুগলির দশঘড়া গ্রামের বিশ্বাস পাড়ায় বিশ্বাস জমিদারবাড়ি ও তার মন্দির নিয়ে কথা বলব। এই বিশ্বাস জমিদারের কাছারি বাড়িটি আজও অটুট। আগে এই অঞ্চলটির নাম ছিল বারোদুয়ারী। জমিদারি প্রথা আজ আর নেই তবে গোপীসায়র দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে সেকালের কাছারি বাড়ি, গোপীনাথ মন্দির, দোলমঞ্চ, রাসমঞ্চ ও আটচালা শিব মন্দির।

গোপীনাথ মন্দির

দশঘড়ার পশ্চিম প্রান্তে তাঁতের শাড়ির জন্য বিখ্যাত ধনিয়াখালি বাজার। বিশ্বাসদের গোপীসায়র দিঘির জলে শোনা যায় গুপ্তধনের গল্প। কথিত আছে, মুঘলদের হাত থেকে ধনসম্পদ রক্ষা করার জন্য দশটি ঘড়ায় করে দিঘির জলে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তাই লোককথা থেকেই অনেকেই মনে করেন দশঘড়া নামটি এখান থেকেই এসেছে। আবার এমনও হতেপারে দশটি ছোটো ছোটো গ্রাম নিয়ে গঠিত হয়েছিল বলে এর নাম হয় দশঘড়া। এই দশটি গ্রাম এখনও বর্তমান। গ্রামগুলো হল শ্রীকৃষ্ণপুর, জাড়গ্রাম, দিঘরা, আগলাপুর, শ্রীরামপুর, ইছাপুর, গোপীনগর, গঙ্গেশনগর, পাড়াম্বুয়া ও নলথোবা।

টেরাকোটার ভাস্কর্য

জানা যায়, একসময় উড়িষ্যা থেকে শ্রী জগমোহন বিশ্বাস দশঘড়ায় এসে বসবাস গড়ে তোলেন। এই জমিদার বাড়িতে চতুর্ভূজা রূপে পূজিতা হন দেবী দুর্গা। এটির আদল উড়িষ্যার দুর্গামূর্তির মতো। দশঘড়ার বিশ্বাস পাড়ায় গোপীনাথের মন্দিরটি নির্মাণ করে গ্রামের বিশ্বাস রাজবংশের সদানন্দ বিশ্বাস ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে।

টেরাকোটার ভাস্কর্য

‘পঞ্চরত্ন’ শৈলীর গোপীনাথ মন্দিরটি তিনটি খিলান বিশিষ্ট। দেওয়াল জুড়ে আছে অসংখ্য টেরাকোটার কাজ। শ্রীচৈতন্যের নগর কীর্তন, বেহালা বাদক, স্ত্রীলোক, রামায়ণের যুদ্ধ, মহাদেব, চরকায় সুতা কাটা, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এমনকি সুলতান শাসনের বেশ কিছু টেরাকোটা ভাস্কর্য রয়েছে মন্দিরটির গায়ে। তিনটি খিলান বিশিষ্ট মন্দিরের প্রধান খিলানটির উপরে রামায়ণের কাহিনী বর্ণিত আছে। গোপীনাথের মন্দিরে সামনের বিন্যাসে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য টেরাকোটার কাজ দেখা যায়। এর মধ্যে বীনাবাদনরত মহাদেব ও পার্বতী, মহাভারতে বর্ণিত নিদ্রারত শ্রীকৃষ্ণের পায়ের কাছে অর্জুন ও মাথার কাছে দুর্যোধন, রামায়ণে বর্ণিত কুম্ভকর্ণের বানর সেনা ভক্ষণ, বেহালা বাদিকা ইত্যাদি। রাজবাড়ির পাশেই অষ্ট কোণাকৃতি রাসমঞ্চ ও চারচালার দোলমঞ্চ রয়েছে। এখানে দোলমঞ্চে টেরাকোটার সুন্দর কারুকাজ দেখা যায়। গোপীনাথ মন্দিরের পশ্চিম দিকে রয়েছে একটি শিবমন্দির। শিবমন্দিরের সামনের দরজায় টেরাকোটার দুই দ্বারীপাল দেখা যায়। মন্দিরটি পশ্চিমমুখী।

শিবমন্দির

আজও বিশ্বাসবাড়ির উত্তরসূরীরা মন্দির সংলগ্ন বাড়িতেই বাস করছেন। কাছারিবাড়িটিও পরম যত্নে অক্ষত রাখা হয়েছে। ঐতিহ্যকে মুছে ফেলা কিংবা তাকে নানাভাবে বিকৃত করার যে ট্রেন্ড চারদিকে জারি রয়েছে, সেই আবহের সমান্তরালে ঐতিহ্যকে স্বযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে দশঘড়ায়।

টেরাকোটার ভাস্কর্য

পথ নির্দেশ: দশঘড়ার গ্রামে যেতে হলে হাওড়া স্টেশন থেকে কর্ড লাইনের বর্ধমান লোকাল ধরে নামতে হবে গুড়াপ স্টেশনে। স্টেশন থেকে তারকেশ্বর গামী বাসে বা দশঘড়া গামী ট্রেকারে উঠুন। নামুন দশঘড়া স্টপেজ। সেখান থেকে হেঁটে মন্দির।

মুকুট তপাদার

মুকুট তপাদার একজন ফ্রিলান্স ফটোগ্রাফার। ডিজিটাল স্টুডিও টিমে কাজ করেন। হেরিটেজ চর্চায় আগ্রহী।

Share