সুবিমল মিশ্র: গদ্যশিল্পের রাজনৈতিক প্রস্থানপথ

।। অর্ক চট্টোপাধ্যায়।।

সুবিমল প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বিভাজনের বাইরে, সিনেমা, পেইন্টিং ইত্যাদি নানা শিল্পমাধ্যমকে অন্তরচালিত করেছেন নিজের লেখায়। আন্তর্জাতিক সাহিত্য এবং অন্যান্য শিল্পরীতির প্রভাব পড়েছে ওঁর গ্রহণমুখী গদ্যে। তলস্তয়ের সঙ্গে বিভূতিভূষণ আর মানিক, কমলকুমার, ওয়ালীউল্লাহের সঙ্গে রেখেছেন প্রুস্ত, জয়েস, কাফকাকে। গোদারের জাম্প কাট দিয়ে গল্পের আখ্যানপথকে ভেঙে দিয়েছেন, ইউলিয়াম বারোজের অনুসরণে কাট আপ পদ্ধতি এনেছেন বাংলা উপন্যাসে। তবে ‘আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো’, ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’, ‘কীকা-কাট’  কিম্বা ‘চেটে চুষে চিবিয়ে গিলে’  জাতীয় অ্যান্টি-নভেলে আদ্যপান্ত রাজনৈতিক বিষয়বস্তুতে প্রযুক্ত হয়েছে আত্ম-বিয়োজক ফর্ম। সুবিমলের মত লেখক যারা পার্টি লাইন থেকে সরে আসলেও আজীবন সামাজিক সাম্য এবং প্রতিবাদের অধিকার রক্ষার বাম-মনস্কতা ধরে রেখেছেন, ২১ শতকের অতি-দক্ষিনপন্থী বিশ্ব-রাজনৈতিক সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের বারবার তাদের মগ্নপাঠে ফিরতে হবে, স্থূল ক্ষমতা এবং সরকারতন্ত্রের বাইরে বামপন্থাকে নতুন করে ভাববার জন্য, তাকে পুনরুদ্ধার করবার জন্য। ৭০-এর মুক্তিদশকে সুবিমল যেমন পুনরুদ্ধার করেছেন সোভিয়েত ফিল্মমেকার সেরগেই আইজেনস্টাইনের মন্তাজ টেকনিক, তাকে বাংলা গদ্যে প্রয়োগ করেছেন।

৮ই ফেব্রুয়ারি ভোর থাকতে থাকতে চলে গেলেন আজন্ম প্রতিবাদী, আমৃত্যু আপোষহীন, বাংলা সাহিত্যের ‘বাঘের বাচ্চা’, সুবিমল মিশ্র। সকাল সকাল হোয়াটসঅ্যাপে খবর পাঠালেন এক অগ্রজ, আরেক অনুজ লেখক। এভাবেই সারাজীবন জিততে না চাওয়া সুবিমল টুক করে জিতে গেলেন, যেমন ঝুপ করে একদিন মরে যেতে চেয়েছিলেন। সুবিমলকে নিয়ে বাংলায় এবং ইংরেজি ভাষায় বিশ্লেষণী লেখা লিখলেও ওঁর সঙ্গে নিবিড়তর যোগ রয়ে গেছে সৃজনী গদ্যে। লেখকের মৃত্যুর পর লেখার একপ্রকার স্বনির্ভরতা তৈরী হয়। সুবিমলের লেখার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি অনুশীলন করার প্রয়োজন রয়েছে লেখার প্র্যাকটিসে। যেমন সময়ের ঘুলঘুলিতে হারিয়ে যাওয়া এক বন্ধুর সঙ্গে বসে মধ্যরাতে সুবিমলের লেখা পাঠের যাপন, একেকটা বাক্যের স্বয়ম্ভু হয়ে ওঠার স্মৃতি রয়ে গেছে মননে: “জ্বলে যায় মাতৃঅঙ্গ”! বাগানের ঘোড়ানিম গাছে বাস করা দেখনচাচার প্যানপটিক দৃষ্টি অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে আমাদের মত পাঠকদের মনে। সুবিমল যত এগিয়েছেন তাঁর লিখনপথে, সে প্রস্থানপথ তত হয়েছে কঠিন! ক্যালিগ্রাফি দিয়ে কেবল কারিকুরি করেননি। ফন্ট সাইজ বাড়ানো বা কমানো শুধু দেখনদারি ছিল না। সুবিমল লেখাকে আঁকতে চেয়েছেন, নির্মাণ করতে চেয়েছেন ভিশুয়াল টেক্সট, পাঠককে বারবার লিখতে আহ্বান জানিয়েছেন, তার জন্য ফাঁকা রেখেছেন পাতা! নিজের বই নিজে ছেপেছেন, নিজে বহন করেছেন, নিজে ছড়িয়ে দিয়েছেন টাকার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে। পাঠকদের সঙ্গে সরাসরি কমিউনিকেট করতে চেয়েছেন, করেওছেন। ওঁকে লেখা পাঠকের চিঠি লেখার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এভাবে প্যালিম্পসেস্ট হয়ে উঠেছে ওঁর পরীক্ষামূলক টেক্সট।

একজন অগ্রজ গদ্যকার হিসেবে সুবিমল আমায় না-কাহিনী লিখতে শিখিয়েছেন। ২০১৮ সালে ‘গল্পপাঠ’ পত্রিকায় সুবিমলের বিখ্যাত ‘হারান মাঝি’ টেক্সট কাট আপ করে এক না-গল্প লিখেছিলাম। ঠিক যেভাবে সুবিমল দুটো আপাত-বিযুক্ত গল্পকে কাট আপ করে জুড়ে দিয়েছিলেন। হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়ার সঙ্গে এসে মিশেছিল আমেরিকা থেকে আসা সোনার গান্ধী মূর্তির আখ্যান। লিখতে চাইছিলাম স্ট্যাচু অফ ইউনিটি আর কেভরিয়া গ্রামের উচ্ছেদ নিয়ে। সে লেখায় সুবিমলের প্রেরণায় স্থান পেয়েছিল আরেকটি কাট আপ: মেধা পাটকরের এক লেখা: সর্দার প্যাটেলকে খোলা চিঠির ফর্মে। আর ছিল বাচ্চাদের স্ট্যাচু স্ট্যাচু খেলা, ম্যানহোল থেকে উঠে আসা এক বালকের যোগদান। লেখার রাজনৈতিক বিষয়বস্তু আহ্বান করেছিল সুবিমলের ভঙ্গুর রাজনৈতিক ফর্মকে। ২০২৩ বইমেলায় ‘কালিমাটি’র ক্ষমতা বিষয়ক সংখ্যায় যে অ্যান্টি-স্টোরি লিখেছি, তাও সুবিমল প্রদর্শিত পথে। সেখানে জাতিবিদ্বেষ এবং হিংসার রাজনৈতিক কন্টেন্ট সুবিমলের সংবাদধর্মী স্লোগনিস্ট, বিক্ষিপ্ত, অথচ সক্রিয় এক রাজনৈতিক প্রতি-আখ্যানের ফর্মকে আশ্রয় করে নিয়েছে। পুনরাবৃত্ত লাইনের মধ্যে দিয়ে গদ্যের ভিতর কিভাবে দুর্দমনীয় এক তাকত সঞ্চার করা যায় তা সুবিমলের থেকে শেখার চেষ্টা করেছি।  

সুবিমল আমার গদ্যলিখনের একজন শিক্ষক। প্রথাসম্মত গল্প বা আখ্যানকার তিনি নন। গল্পকে না ভেঙে যে গল্প লেখা যায় না, তা শিখিয়ে গেছেন তিনি। আখ্যানকে বিনির্মাণ করে আখ্যান আর প্রতি-আখ্যানের কোলাজসম বিন্যাসে সত্যের রাজনীতিকে বারবার স্পর্শ করে গেছে সুবিমলের লেখনী। ওঁর প্রথমপর্বের সব লেখাই যে প্রতি-আখ্যান বা কোলাজধর্মী তা নয় তবে সব লেখাতেই নানা ধরণের নিরীক্ষা রয়েছে। ১৯৭৩ এ লেখা ‘উট’ গল্পে সুররিয়ালিজমের দাগছাপ স্পষ্ট। কাহিনীর জায়গায় রয়েছে স্বপ্নের বিবরণ যার অন্তঃস্থলে ধূসর উট এবং ‘উদোম নারী’ আর তার সোনালী পা—এহেন পরাবাস্তববাদী চিত্রকল্পের পাশাপাশি স্থান পায় একলা মানুষের সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো আর একটা ভালো স্বপ্নের জন্য অপেক্ষা করা। লোকটা যতই ভালো স্বপ্নের জন্য অপেক্ষা করে ততই তার স্বপ্নে হানা দেয় নিজের মৃত্যু, শরীরের পচন, শকুন, উট প্রমুখেরা! একটিও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক বাক্য প্রয়োগ না করে বিষিয়ে যাওয়া স্বপ্নের ইঙ্গিতে এই গল্পের মাধ্যমে ১৯৭৩ এর অশান্ত সময়ের এক রাজনৈতিক চেতনা তুলে ধরেন সুবিমল। স্বপ্ন বিষিয়ে যেতে থাকে অথচ লোকটা ভালো স্বপ্নের অপেক্ষা ছেড়ে দেয় না। সুবিমলের ৭০-এর গল্পগুলিতে ধারাবিবরণীর আঙ্গিকে নানা সত্য ঘটনা, শৈশবের ক্রমপচন, কল্পনার বিষগন্ধ ছাড়াও বিভিন্ন পশুর রেফারেন্সে বৃহত্তর এক প্রাণ-পৃথিবীর উপর হওয়া অত্যাচারের আভাস উঠে আসে। এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা এখানে অসম্ভব, তবে এটুকু বলা যায় যে সুবিমলের রাজনৈতিক বয়ান কেবল মানবকেন্দ্রিক নয়, সামগ্রিক প্রাণমণ্ডলের এক বাচন।

সুবিমল নিজেই অনেক ক্ষেত্রে নিজের গল্পগুলিকে ‘অ্যান্টি-স্টোরি’ আর উপন্যাসকে ‘অ্যান্টি-নভেল’ বলে চিহ্নিত করেন; সে বিষয়ে ইস্তাহার লেখেন। সার্ত্র ১৯৫৫ সালে নাতনিল সরুটের উপন্যাসকে অ্যান্টি-নভেল বলে অভিহিত করেছিলেন বটে তবে তাঁর কাছে এই নিরীক্ষামূলক ফর্ম মূলগতভাবে রাজনৈতিক ছিল না। সুবিমলের লেখার ধরতাই রাজনৈতিক সন্দর্ভধর্মী। সংবাদ যেখানে কাব্য হয়ে ওঠে। ইউরোপের হিস্টোরিকাল আভা গার্দ লেখকরা যেমন শিল্প-সাহিত্য নামক প্রতিষ্ঠানটির সমালোচনার পথ বেছে নিয়েছিলেন তাদের রাজনৈতিক অবস্থান হিসাবে, সুবিমল বাংলা সাহিত্যে সেই রাজনৈতিক আভা-গার্দিজম নিয়ে আসেন। আধুনিকতার পুঁজিবাদী চেহারাকে তুলে ধরতে গেলে যে আধুনিকতার ফর্মগুলিকেও আক্রমণ করতে হবে তা সুবিমল জানতেন। তাই উপন্যাস, গল্পের আখ্যানরীতিকে ভাঙতে চেয়েছেন। এই ফর্মের রাজনীতি মিলিত হয়েছে রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর সঙ্গে। উদাহরণস্বরূপ প্রেমের মড়া জলে ডোবে না উপন্যাসে মহাভারতের যৌন হিংসার নানা কাহিনী জাক্সটাপোজড হয় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম রাজনৈতিক রেপকেস বিষয়ক বহুভাষী সংবাদপত্রের কাট-আপের সঙ্গে।

সুবিমল প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বিভাজনের বাইরে, সিনেমা, পেইন্টিং ইত্যাদি নানা শিল্পমাধ্যমকে অন্তরচালিত করেছেন নিজের লেখায়। আন্তর্জাতিক সাহিত্য এবং অন্যান্য শিল্পরীতির প্রভাব পড়েছে ওঁর গ্রহণমুখী গদ্যে। তলস্তয়ের সঙ্গে বিভূতিভূষণ আর মানিক, কমলকুমার, ওয়ালীউল্লাহের সঙ্গে রেখেছেন প্রুস্ত, জয়েস, কাফকাকে। গোদারের জাম্প কাট দিয়ে গল্পের আখ্যানপথকে ভেঙে দিয়েছেন, ইউলিয়াম বারোজের অনুসরণে কাট আপ পদ্ধতি এনেছেন বাংলা উপন্যাসে। তবে ‘আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো’, ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’, ‘কীকা-কাট’  কিম্বা ‘চেটে চুষে চিবিয়ে গিলে’  জাতীয় অ্যান্টি-নভেলে আদ্যপান্ত রাজনৈতিক বিষয়বস্তুতে প্রযুক্ত হয়েছে আত্ম-বিয়োজক ফর্ম। সুবিমলের মত লেখক যারা পার্টি লাইন থেকে সরে আসলেও আজীবন সামাজিক সাম্য এবং প্রতিবাদের অধিকার রক্ষার বাম-মনস্কতা ধরে রেখেছেন, ২১ শতকের অতি-দক্ষিনপন্থী বিশ্ব-রাজনৈতিক সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের বারবার তাদের মগ্নপাঠে ফিরতে হবে, স্থূল ক্ষমতা এবং সরকারতন্ত্রের বাইরে বামপন্থাকে নতুন করে ভাববার জন্য, তাকে পুনরুদ্ধার করবার জন্য। ৭০-এর মুক্তিদশকে সুবিমল যেমন পুনরুদ্ধার করেছেন সোভিয়েত ফিল্মমেকার সেরগেই আইজেনস্টাইনের মন্তাজ টেকনিক, তাকে বাংলা গদ্যে প্রয়োগ করেছেন। ওঁর কাছে এই নিরীক্ষা রাজনৈতিক সত্যের তত্ত্বতল্লাশ:

আমি ব্যক্তিগত ভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করি সত্যের মুখোমুখী হওয়ার, আমার সমস্ত প্রথাবিরুদ্ধ আংগিকককে ব্যবাহারিক করে, যা দ্বন্দ্বমূলক, যা অন্যতর কোণে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবার স্পর্ধার ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ, ঘনত্ব। হাঁ, নিজের মুখোমুখী হয়ে, স্পষ্ট কথায়, নিজেকে বাতিল করতে পারার স্পর্ধা তুমি কবে আর দেখাবে, দেখাতে পারবে সুবিমল, কবে এই দীর্ঘপথ—দ্বন্দ্বময়তা— কবে এর অতিক্রান্তি?

(সুবিমল বইসংগ্রহ ৩, গাংচিল)

সুবিমল বিরল সেই লেখক যিনি প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার কূটাভাস বুঝতেন আর তাই বারবার নিজের আমিত্ব অর্থাৎ ‘সুবিমল মিশ্র’ নামক প্রতিষ্ঠান-বিরোধী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লেখার চেষ্টা করেছেন। সেই লিখনপথের নাম দিয়েছেন ‘সুবিমলের বিরুদ্ধে সুবিমল’। নিজেকে বাতিল করার অপর নাম যে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতাকে যে এক ‘টোটাল’ ব্যপার হিসাবে ভাবতে হবে তা তিনি লিটল ম্যাগাজিনের অনুশীলনকে শিখিয়ে গেছেন। ফর্মের রাজনীতি যে কেবল ফর্মের নয়, বরং এক ফলিত রাজনীতি, তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বারবার:

প্রতিবাদ সমস্তরকম স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ মানবিকতার মুখোশ-ধ্বজ সব রকম অমানবিকতার বিরুদ্ধে। শেষে তা আর উপন্যাসই থাকে না, থাকে না কোনও আদি-অন্ত-যুক্ত নিটোল কাহিনি রূপ, তথাকথিত চরিত্রনির্মাণ। হয় না ইতিহাস বা ডায়েরি, প্রবন্ধও নয়, গবেষণাও নয়— অথচ সব কিছুই — কাটিং, খবরের কাগজ, প্রচার, নিউজ, লিফলেট, ইস্তাহার, রগরগে সত্য কাহিনি — কোলাজে মন্তাজে নবরূপে এক মিশ্রণ — এবং ট্র্যডিশনাল দৃষ্টিতে এক অসংশোধিত লিখনরূপ, — প্রচণ্ড বিচ্ছিন্ন, অবশ্যই আপাত ভাবে, — যা কোথাও কোন পরিণতিতে, পরিণতি কথাটা যে অর্থে, পৌঁছায় না।  

(সুবিমল বইসংগ্রহ ৩, গাংচিল)  

নানা ফর্মের ভাঙ্গাচোরা মিশেল সুবিমলের কাছে রাজনৈতিক। যাকে তিনি ‘অসংশোধিত লিখনরূপ’ বলেছেন উপরের পরিচ্ছেদে, তা-ই এক অর্থে ওঁর সাহিত্যের নির্যাস। এই লিখন অসংশোধিত বলেই তা প্রতিবাদী, অভিসন্ধিমূলক, এবং রাজনৈতিক। এই পরিচ্ছেদে কাহিনী তথা আখ্যান নয়, বরং সন্দর্ভ, প্রতি-সন্দর্ভ নির্মাণের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন গদ্যকার সুবিমল।

‘৭২এর ডিসেম্বরের এক বিকেল’ শীর্ষক লেখা শেষ হয়েছে এমন এক মন্তাজ দিয়ে:

এখন ৭২-এর ডিসেম্বরের এক বিকেল — বিহার-হরিয়ানা-গুজরাট-পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে স্ট্রাইক— ধর্মঘট বেআইনি করার আইন — ক্রিকেট সাহিত্য সিনেমা রবীন্দ্রসদনে নৃত্যনাট্য — শুধু মেট্রোর সামনে সদ্য নিহত দুটো ষাঁড় — লেনিন স্ট্যাচুর কয়েক হাত দূরে শুকিয়ে যাওয়া তাদের রক্ত — রক্তের দাগ। 

(সুবিমল বইসংগ্রহ ১, গাংচিল)  

ড্যাশ দিয়ে দিয়ে ভেঙে দেওয়া এই দৃশ্যবাক্যের দল গোদারের জাম্প কাট বা আইজেনস্টাইনের মন্তাজ টেকনিকে উদ্বুদ্ধ হলেও অন্যান্য শিল্প আঙ্গিকের মাধ্যমে তুলে ধরছে গদ্যের এক নিজস্ব শিল্পশক্তি যাকে পরিণতি বলে যদি আদৌ কিছু হয়, তা দেবে লেখক নয়, পাঠক। লেখকের কাজ শুধু ছবিগুলোকে উস্কে দেওয়া। তার কাজ জিগসোর নানা জোড়ের মত উপস্থাপন করা এই আপাত-বিযুক্ত চিত্রাবলীকে। এদেরকে পাঠক যেভাবে জুড়বেন তাতেই তৈরি হবে তার উদ্বৃত্ত রাজনৈতিক অর্থ। যেটা লক্ষণীয় তা হল এই অর্থ কেবল ফর্মের রাজনীতির জন্য রাজনৈতিক নয়, এর উপাদান তথা অভিজ্ঞতা, কন্টেন্টের দিক থেকেও রাজনৈতিক। এখানে লেনিন স্ট্যাচুর অনতিদূরে ট্রাফিক অবরুদ্ধ করে দাঁড়ানো ষাঁড়েদের রক্তদাগে পুনরলিখিত হচ্ছে “ধর্মঘট বেআইনি করার আইন”! ফর্ম-কন্টেন্টের মিলনে উৎপন্ন এই আদ্যন্ত রাজনৈতিক স্যাটায়ার হল সুবিমল মিশ্রর গদ্যশিল্প। এই গদ্য আদতে শিল্প কারণ তা আদতে রাজনৈতিক।

গল্প নয়, গদ্য নিজেই নিজেকে চালনা করে যেখানে, সে প্রস্থানপথ সুবিমলের। সুবিমলীয় প্রস্থানপথের উত্তরাধিকার সহজ নয় কারণ বাংলা সাহিত্য এখনো প্রথাগতভাবে গল্প বা কবিতাকে শিল্প ভাবে, গদ্যকে নয়।  বাংলা সাহিত্যে কাহিনিবিমুখ, আখ্যানহীন, চিন্তাগদ্য যেদিন স্বনির্ভর শিল্প বলে স্বীকৃত হবে, যেদিন মান্যতা পাবে এই ভঙ্গুর ফর্মের রাজনৈতিকতা, সেদিন সুবিমলকে পড়তে হবে সুবিমলের বিরুদ্ধে, প্রাতিষ্ঠানিকতা অতিক্রম করবার জন্য। ততদিন সুবিমলের প্রস্থানপথই হোক আমাদের যাত্রাপথ। আমরাও ওঁর মত বলিঃ “কবে এই দীর্ঘপথ—দ্বন্দ্বময়তা— কবে এর অতিক্রান্তি?”  

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

পশ্চিমবঙ্গের শূন্য দশকের কথাসাহিত্যিক। পেশায় অধ্যাপক। জন্ম ১৯৮৫ সালে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার উত্তরপাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা। আইআইটি গান্ধীনগরের মানববিদ্যা বিভাগে সাহিত্য এবং দর্শন পড়ান। পেশাসূত্রে বসবাস করেন গুজরাতের গান্ধীনগরে। সম্পাদনা করেছেন ‘অ্যাশট্রে’ পত্রিকা। প্রকাশিত বই: ‘পিং পং গন্ধ’ (গল্পগ্রন্থ, ২০০৯), ‘সাইজ জিরো’ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৫), ‘অলিখিত হ্রস্বস্বরের সন্ধানে’ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৮), ‘উপন্যস্ত’ (উপন্যাস, ২০১৮), ‘আতশবাজি ছায়াপথে ফিরে যাও’ (গল্পগ্রন্থ, ২০২১)

       

Share