খুন

।। ফাতেমা রিয়া।।

মতিন আর মজনু কাজে গেলো। ট্রাকের ড্রাইভিং সিটের পাশে নিয়ে শোয়ালো লাশটাকে। মনে হচ্ছে মরেছে বেশিক্ষণ হয় নাই। এক কানে দুলও দেখা যাচ্ছে। মতিন কান ছিঁড়ে দুল খুলে নিল। দাঁত বের করে বললো, সোনার মনে হয়।
মজনু আশেপাশে তাকালো। দুপুরের দিকটা এই আবর্জনার ভাগাড়ের আশেপাশে কেউ আসে না। আসলেও সমস্যা নেই। এখানে এসব হয়ে থাকে। সে মতিনকে বললো, তুই সামনে দাঁড়া গিয়া। আমি ডাক দিব।
মতিন নির্দেশ পালন করলো। এমন সময়ে গেঞ্জাম চলে না।

খুন

মজনু মিয়া অনেক ক্লান্ত এখন। কাল রাতের ফেন্সিডিলের প্রভাব এখনো যায় নি। সে মনে মনে বললো, ‘কুত্তার বাচ্চা”!
কাকে বললো বুঝা গেল না। সে নিজেও বুঝলো না। সে এসেছে ময়লার ট্রাক নিয়ে। তুরাগ নদীর পাড়ে। এখানে আবর্জনা ফেলে পোড়ানো হয়। পোড়ানোর আগে অবশ্যই এই লটের ময়লাগুলো আবার ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে। একটু পরেই বজলু আর মতিন চলে আসবে। এর মধ্যে বজলু ট্রাক ড্রাইভার, আর মতিন হেল্পার। মজনু ময়লা নামানোর কাজ করে। সকাল থেকে পাঁচটা ট্রাকের ময়লা নামিয়েছে। তবে এদের সাথে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা সমস্যা। ব্যবহার্য কিছু পেলে ঝামেলা শুরু করে, ভাগ চায়। এর মধ্যে বজলু বেশি সিরিয়াস। শোনা গিয়েছে, বজলু আর মতিন দুপুরে খেতে গিয়েছে। এটাই সুযোগ।

আশেপাশে পরিচিত কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সে আবর্জনার ওপরে উঠে গেল। ট্রাক থেকে নামানোর আগে ঘাটাঘাটি করাই সুবিধা। আগে ময়লা আবর্জনা ঘেন্না লাগতো। এখন এটাই জীবন। বরং দুদিন গন্ধ না শুকলে মজনুর জান আনচান করে। তখন ফেন্সিডিল খেতে ইচ্ছা হয়। আজিব দুনিয়া।

মজনু ঘাঁটা শুরু করলো। পুতিগন্ধময় জিনিস, হাতে এরমধ্যে রক্ত লাগলো। উঠিয়ে দেখলো, মেয়েদের প্যাড।
‘খানকি মাগীরা’ এটা বলেই মজনু প্যাডের গন্ধ শুকতে লেগে গেল। ভালই লাগে। অবশ্য কাউকে দেখিয়ে সে এই কাজ করে না। একবার মতিন দেখে কি হাসাহাসি। মজনুর সেদিন মতিনকে রাতে ভাত খাওয়াতে হলো। বজলু এসব জানলে সমস্যা। ঝগড়াঝাটির সময় তুলে আনবে। পাঁচকান হবে কথা। কী দরকার!

মজনু আবার খোঁজায় মন দিল। আবারও রক্ত লাগলো হাতে। এত প্যাড কেন এখানে? সে আরো গভীরে হাত ঢুকালো। নরম কিছু একটা লাগলো হাতে। মজনু চমকে হাত সরিয়ে নিল। কেমন যেন ভয় লাগলো তার। একা দেখতে আর সাহস হলো না।

সে ট্রাক থেকে নেমে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। দূরেই বজলু আর মতিনকে দেখা যাচ্ছে।
বজলু এসেই আবর্জনার মধ্যে ঢুকে গেল। এতক্ষণে মজনু কোন্‌ সোনার মোহর উদ্ধার করে ফেলেছে কে জানে! একা রেখে ভাত খেতে যাওয়া উচিত হয় নাই।

মজনু মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো। মতিন দাঁত বের করে বললো, সোনার আংটি পাইলা নি?

– পাইলাম তর হোগা। দেখবি নাকি?
মতিন চুপ করে গেলো। মজনু রেগে আছে বোঝা গেল।
এর মধ্যে বজলু চিৎকার করে ট্রাক থেকে নেমে এলো, এক মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে আবর্জনার মধ্যে।

এস. আই মমিনুল হক। রমনা থানায় কর্মরত আছেন। গাট্টাগোট্টা মানুষ। চোখে চশমা। কুতকুতে চেহারা৷ তাকে দেখলেই মনে হয় অস্বস্তিতে আছেন। তবে এই মুহূর্তে তিনি আসলেই অস্বস্তিতে আছেন। তিনি বসে আছেন শিল্পমন্ত্রী আব্বাস উদ্দীনের বাড়িতে। মিন্টু রোডে প্রাসাদের মতো বাড়ি। ঢুকলেই প্রাচীনকালের রাজাদের কথা মনে হয়।

চোখ পিট পিট করে চারপাশ দেখছেন। বিশাল ড্রয়িং রুম। দুই সেট সোফা। এক সেট সাদা, অন্য সেট খয়েরি। দুই সেট দুইপাশে রাখা। সোফার রং এর সাথে দুইপাশের আসবাবপত্র। ড্রয়িং এর দুইপাশে দুইরকম সাজ। ঘরের চারপাশে পাথরের মূর্তির অভাব নেই। এর মধ্যে একটা ন্যাংটো মেয়ের মূর্তিও দেখা যাচ্ছে। এস আই মমিনুল মনে মনে বললো, আস্তাগফিরুল্লাহ।

একজন চাকর এসে চা দিয়ে গেছে। চায়ের কোনো স্বাদ নেই। পানি পানি চা, তবে অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ। কী নাম এর কে জানে! শিল্পমন্ত্রী সাহেবের দেখা নেই। আশেপাশে কাউকে দেখাও যাচ্ছে না। ওনার সাথে দেখা হবে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। মন্ত্রী মিনিস্টারের বাড়িতে আসা বড়ই ঝামেলা। এটা ওসি সাহেব বোঝেন বলেই ছোটখাট ব্যাপারে মমিনুলকে চাপিয়ে দেন। কিছু করার নেই।

একজন মন্ত্রীর বাসায় সার্বক্ষণিক মানুষজনের আনাগোণা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজকে নেই মনে হচ্ছে। কোনো একটা বিশেষ কারণেই নেই। বাসার সামনের পুলিশদের দেখা গেল, কয়েকজনকে সমানে ধমকাচ্ছে। দর্শনপ্রত্যাশীদের হয়তো।
আধাঘন্টা পর মিনিস্টার সাহেব আসলেন। এস আই সাহেব খয়েরি সোফায় বসে ছিলেন, মিনিস্টার বসলেন সাদা সোফায়।
এটাই মনে হয় দুই রকম সোফার রহস্য। দর্শনপ্রত্যাশীদের সাথে সামান্য শ্রেনী বিভাজন। রহস্য ভেদ করতে পেরে মমিনুল একটু আরাম পেলেন।

মন্ত্রী সাহেবের পরনে গরদের পাঞ্জাবি। মুখ মাখনের মত চকচক করছে। শরীর ঘিরে আভিজাত্য আর অহংকার। টাকা মানুষকে কী না করতে পারে! এস আই মমিনুল ছোট করে শ্বাস ফেললেন।

ওসি সাহেব কতক্ষণ চুপ করে রইলেন। তাঁর বলতে ইচ্ছা হলো, “আপনারা অন্যদের সাথে যা করে আসছেন, সেটা মাঝে মাঝে আপনাদের সাথেও হবে। এটাই দুনিয়ার নিয়ম।”

মমিনুল দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন। মন্ত্রী মাথা নেড়ে ইশারা করলেন বসার জন্য।
মমিনুল বসলেন। আব্বাস সাহেব বললেন, চা দিয়েছে আপনাকে?

– জ্বী হ্যাঁ, দিয়েছে।
– আচ্ছা বসুন।
আব্বাস সাহেব অনেক চিন্তিত আছেন বোঝা গেল।
তিনি সরাসরি বললেন, আমার মেয়েটাকে খুজে পাচ্ছি না। থানায় সরাসরি খবর দেই নি মিডিয়ার যন্ত্রণায়। তাই ডেকে পাঠিয়েছি।
– জ্বী আচ্ছা।
– ওর ছবি আর ডিটেইলস আপনাকে দিয়ে দেব। আপনারা কনফিডেনশিয়াল ভাবে এই তদন্তটা করবেন। আমি ৪৮ ঘন্টার মধ্যে রেজাল্ট চাই।
– অবশ্যই।
এর মধ্যে একজন রুমে ঢুকলো। তার হাতে বিশাল ফাইল। সে ফাইলটা মমিনুলের সামনে টেবিলে রাখলো।
এস. আই. মমিনুল তার দিকে তাকালেন। বছর ত্রিশেকের এক যুবক। কমপ্লিট স্যুট পরা।

আব্বাস উদ্দীন বললেন, সোহান, আমার বিশ্বস্ত লোক। ও এই ফাইল তৈরি করেছে। আমার মেয়ের ব্যাপারে সব বৃত্তান্ত আছে এখানে। ও আপনাকে বুঝিয়ে দেবে। কিছু সমস্যা হলে সোহানের সাথে যোগাযোগ করবেন। আমি ভিতরে চলে যাচ্ছি। দুপুরে খেয়ে যাবেন।
মন্ত্রী সাহেব দ্রুত উঠে চলে গেলেন। সোহান এস আই মমিনুলের পাশে বসলো।

বজলু কাঁপতে কাঁপতে বললো, কী করবি রে তোরা?
মজনু শুকনা মুখে বললো, আলো নিবতে দেন। লাশরে সোহাগ করবো।
বজলু কথা হারিয়ে ফেললো। সে মতিনের দিকে তাকালো। মতিন চুপ করে আছে। সে মেয়েটাকে দেখেছে। অদ্ভুত সুন্দর মেয়ে।
মরা হউক বা জ্যাতা কোনো ব্যাপার না।
মতিন এবার বললো, একটু পর জয়নাল আইবো। যা করার করেন এখন।
জয়নাল এখানের সুপারভাইজার। কড়া লোক। উচ্ছিষ্ট জিনিসের বড় ভাগীদারও। মজনুকে চিন্তিত মনে হলো।
– ট্রাকের মদ্যি কাম সাইরা ফেলাই। কী কন?
মতিন আবার বললো।
বজলু দ্রুত হেঁটে চলে গেলো। কই গেল কে জানে!

মতিন আর মজনু কাজে গেলো। ট্রাকের ড্রাইভিং সিটের পাশে নিয়ে শোয়ালো লাশটাকে। মনে হচ্ছে মরেছে বেশিক্ষণ হয় নাই। এক কানে দুলও দেখা যাচ্ছে। মতিন কান ছিঁড়ে দুল খুলে নিল। দাঁত বের করে বললো, সোনার মনে হয়।
মজনু আশেপাশে তাকালো। দুপুরের দিকটা এই আবর্জনার ভাগাড়ের আশেপাশে কেউ আসে না। আসলেও সমস্যা নেই। এখানে এসব হয়ে থাকে। সে মতিনকে বললো, তুই সামনে দাঁড়া গিয়া। আমি ডাক দিব।
মতিন নির্দেশ পালন করলো। এমন সময়ে গেঞ্জাম চলে না।
মজনু গাড়ির গ্লাসের চারপাশে দুটো গামছা ছড়িয়ে দিলো। নিজের লুংগি খুলেও দিয়ে দিল। সাবধানের মার নাই। এক ফাকে মতিনকে দেখে নিল। শালা সামনে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে।
মজনুর মনে হল, তার বিয়ে হয়ে গেছে। এই শায়িতা মৃতা মেয়েটি তার বউ। যে এখন ঘুমুচ্ছে।
মজনু ফিস ফিস করে ডাকলো, ‘ও বউ’।
মেয়েটার চেহারার দিকে তাকালো। মিস্টি চেহারা। চোখ মনে হয় বড় বড়ই ছিল। চোখের চারপাশে কালি। খাড়া নাক, ফ্যাকাসে ঠোট। মাথাভর্তি চুল।
মজনু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। স্বপ্নে এমন মেয়ে কতবার দেখেছে। কত চেয়েছে। আজ নায়িকা আসলো, কিন্তু জানটা আর নেই।
মজনু আবার ডাকলো, ‘ও বউ’।
কপালের চুল সরিয়ে চুমু খেল তার লাশ বউকে। আহা বড় লাগছে।
মজনু উঠে বসলো। মেয়েটার পরনে স্যালোয়ার কামিজ। রংটা কী সে জানে! কচি কলাপাতার মতো মনে হয়। সে কামিজের মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকালো। শরীর খসখসে হয়ে গেছে। হাত বুকের দিকে চলে গেলো।
মজনু তাকিয়ে দেখলো, লাশ চোখ মেলে দিয়েছে।

সে চিৎকার করে গাড়ি থেকে লাশ নিয়ে পড়ে গেল। মতিন দৌড়ে এলো। পাশ থেকে দুইজন মধ্যবয়স্ক লোক যাচ্ছিল, তারা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো।

মজনুর জ্ঞান হারাচ্ছিল। সে পাশ থেকে শুনতে পেল, মাইরা ফেলাইছে, খানকির ছেলে, মাইরা ফেলাইছে।

এস.আই.মমিনুল আনন্দিত। মন্ত্রীর মেয়ে হারিয়ে যাবার যথাযথ তদন্ত করা গিয়েছে। বলতে গেলে রেজাল্ট নিজ হাতে এসে ধরা দিয়েছে। ৪৮ ঘন্টাও লাগে নি।

মন্ত্রীর মেয়েকে পাওয়া গিয়েছে তুরাগ নদীর ধারে। কতিপয় আবর্জনা শ্রমিক মেয়েকে রেপ করে মেরে ফেলেছে। লাশ নিয়ে হয়তো কোথাও গুম করতে যাচ্ছিল। তার আগেই গাড়ি থেকে পড়ে গিয়েছে। উত্তেজিত জনতার পিটুনি খেয়ে মতিন নামের একজন মারা গেছে। মজনু নামের একজন মার খেয়ে মরোমরো। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তার মুখ থেকে, লাশ জিন্দা হয়ে উঠেছে। টাইপ কথা শোনা যাচ্ছে। গাজীপুর থানা পুলিশের অধীনে কেস চলছে। তবে খুব শীঘ্রই রমনা থানায় ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করা হবে।

মজনু ফিস ফিস করে ডাকলো, ‘ও বউ’।
মেয়েটার চেহারার দিকে তাকালো। মিস্টি চেহারা। চোখ মনে হয় বড় বড়ই ছিল। চোখের চারপাশে কালি। খাড়া নাক, ফ্যাকাসে ঠোট। মাথাভর্তি চুল।
মজনু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। স্বপ্নে এমন মেয়ে কতবার দেখেছে। কত চেয়েছে। আজ নায়িকা আসলো, কিন্তু জানটা আর নেই।
মজনু আবার ডাকলো, ‘ও বউ’।
কপালের চুল সরিয়ে চুমু খেল তার লাশ বউকে। আহা বড় লাগছে!
মজনু উঠে বসলো। মেয়েটার পরনে স্যালোয়ার কামিজ। রংটা কী সে জানে! কচি কলাপাতার মতো মনে হয়। সে কামিজের মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকালো। শরীর খসখসে হয়ে গেছে। হাত বুকের দিকে চলে গেলো।
মজনু তাকিয়ে দেখলো, লাশ চোখ মেলে দিয়েছে।

এস.আই নিজ হাতে মজনুকে জটিল চিকিৎসা দেবেন ভেবে রেখেছেন।
ওসি সাহেব তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এস আই মমিনুল দ্রুত চলে গেলেন। ওসি সাহেবের কামরাটা বেশ বড়। তাঁর নাম শফিকুল ইসলাম। তিনি চিন্তিত মুখে বসে আছেন। একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছেন মনে হয়। পাশে অ্যাশট্রেতে অনেক তাজা ছাই আর ফিল্টার দেখা যাচ্ছে। অ্যাশট্রে থেকে ধোঁয়া উড়ছে।

– বসেন।
শফিকুল ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন।
মমিনুল বসলেন।
– মন্ত্রীর মেয়ের কেসটা কী বলেন তো?
– স্যার, ওইটাই। রেপ কেস।
– না, রেপ না।
শফিকুল সিগারেট ফেলে দিলেন।

এস. আই মমিনুল একটু চিন্তিত হয়ে গেলেন।
– লাশের ছবি আমি দেখেছি। এই মেয়েকে রেপ করা হয় নাই।
– ও।
– মজনুরাও খুন করে নাই। করছে অন্য কেউ।
– এটা কিভাবে বুঝলেন স্যার?
– মজনুরা খুন করলে রেপ করতো। যেহেতু রেপ করা হয় নাই সেহেতু মার্ডারের কোনো ইন্টেনশন থাকতে পারে না।
– কিন্তু স্যার, রেপের আগেও তো অনেকে মেরে ফেলে।
– জ্বী। সেই হিসেবে মেয়ের শরীরে ধস্তাধস্তি, আঘাতের চিহ্ন থাকবে। জামাকাপড় ছেঁড়া নাই।
– স্যার এক কান ছেঁড়া।
– কানের দুল মজনুরা ছিড়ে নিয়েছে। ওরা এইটুক করেছে।
– স্যার, আপনি এত কিছু বুঝে ফেললেন?
– বুঝতে হয় মমিনুল সাহেব। আমি ডাক্তারদের সাথেও কথা বললাম।

এস.আই মমিনুল চুপ করে রইলেন। ভাবলেন, ঝামেলা শেষ হলো। এ দেখি নতুন করে শুরু হলো।

ওসি সাহেব বললেন, আমাদের এত ঠেকা নাই বুঝলেন? জিনিস মজনুদের কাছে পাওয়া গেছে, এর দায়ভারও ওদের। বুঝাতে পারছি?
মমিনুল তাকিয়ে রইলেন। ওসি বললেন, রিপোর্ট তৈরি করেন যেভাবে ভালো বুঝেন। মন্ত্রী মিনিস্টারের ঝামেলা ভাল্লাগে না।
মমিনুল চুপ রইলেন। ওসি সাহেব বললেন, দুপুরে খান নাই হয়তো। যান, খেয়ে নেন।

কোর্টে বেশিদিন মামলা চললো না। মজনুর ফাঁসির আদেশ হলো। সে বিরস মুখে রায় মেনে নিলো।

নিজের বলতে মজনুর একটা বোন আছে। তার নাম কমলা। সে একদিন তার বাচ্চা কোলে নিয়ে মজনুকে দেখতে এলো। তার চোখে মুখে দুঃখের তেমন ভাব নেই।
গরাদের অপর পাশে দাঁড়িয়ে সে বললো, তোর দুলাভাই রিকশা কিনছে নয়া। ওই রিকশায় আইলাম।
মজনু শুকনো স্বরে বললো, সে আইলো না?
কমলা হতাশ হয়ে বললো, কাম আছে কইল। তুই করলিডা কী?
মজনু চুপ করে রইলো।

– এত কইরা কইতাম ‘লিশা’ করিস না। বিয়া কর।
– চুপ কর কমলা।
– হ এহন তো চুপ করমু।

কোলের বাচ্চাটা ট্যা ট্যা করে কেঁদে উঠলো।
কমলা রেগে গিয়ে বললো, আরে হারামির বাচ্চা, ‘চুপ!’
একটু দূরে কনস্টেবল বসা ছিল। সে রেগে গিয়ে বললো, ‘ওই মহিলা, বাজার বসাইছেন নাকি। আস্তে কথা কন।’
কমলা চুপসে গেল। তবে বাচ্চাটা দ্বিগুণ স্বরে চেঁচাতে লাগলো।
মজনু ক্লান্ত স্বরে বললো, বাড়ি যা কমলা। শরীরডা জুইত নাই।
কমলা বললো, খাওন আনতে দিল না।
৫০০ টাকার একটা নোট বের করে দিল সে। ‘এইডা দিয়া কিছু কিইন্যা খাইস’।
মজনু হাত বাড়িয়ে টাকা নিল। জেলের মধ্যে টাকা দিলে সবই পাওয়া যায়। ফেন্সিডিল চেয়ে দেখতে হবে।

কমলা ব্যথিত হয়ে চলে গেল। মজনু ফিরে গেলো তার সেলে। তাকে একা রাখা হয়েছে। সে ঠিকমতো বুঝতে পারছে না তার কী হয়েছে, কেন হয়েছে। শুধু মাঝে মাঝে একটা মেয়ের মুখ মনে পড়ে। যে তার দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। ইদানিং মজনুর অসুস্থ লাগে। ময়লা-আবর্জনার গন্ধ পায় না বলেই। সে শুনেছে, আগস্ট মাসে ফাঁসি দেয়া হবে। এখনো দিন ১৫ বাকি।

এই ১৫ দিন কিভাবে কাটবে এটা নিয়েই সে চিন্তিত। তাছাড়া জেলে ফেন্সিডিল পাওয়া যায় না এটাও একটা সমস্যা। কনস্টেবলকে ধরে দেখতে হবে। সে দুইদিন পর মরে যাবে, ছাইপাঁশ খেলেও কী, না খেলেও কী।

তবে মার খেতে মজনুর আপত্তি আছে। পরশুও সে মার  খেয়েছে। কনস্টেবলের সাথে আরেকজন এসেছিল। কানের নিচে রামচড় দিয়েছে। দিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বললো, মজনু কিছু বুঝতে পারলো না। তবে তার বলতে ইচ্ছা হল, ‘স্যার, একটা ডাইলের বোতল ম্যানেজ করে দেন। তারপর ১০টা চড় দিলেও সমস্যা না।’
বলতে সাহস হল না। চড় খেয়ে মজনুর মাথা ঘুরছিল। কনস্টেবল তাকে পা দিয়ে ঠেলে দিল। মজনু ছোটবেলা থেকে লাথি খেয়েই মানুষ, এটা তার সমস্যাজনক মনে হল না। বরং সে ভাবলো, কনস্টেবলকে একবার ‘ডাইলের’ কথা বলে দেখবে নাকি।

ওসি সাহেব বসে আছেন শিল্পমন্ত্রী আব্বাস উদ্দীনের ড্রয়িং রুমে। আব্বাস উদ্দীন বসে আছেন তার সামনে। তার মুখ কঠিন। দেখে মনেই হচ্ছে তিনি অনেক কষ্টে রাগ চেপে আছেন।

ওসি শফিকুল নির্বিকার ভাবে বসে আছেন। এই দিন তার আসবে উনি জানতেন।

– শফিকুল ইসলাম তো নাম?
– জ্বী।
– বাড়ি কোথায়?
– বরগুনা, পাথরঘাটা।
– বরিশাইল্লা?
মন্ত্রী কাষ্ঠ হাসি হাসলেন।
– জ্বী।
– আমার মেয়ের নাম নিরা। স্কলাস্টিকায় ইলেভেন্থ স্ট্যান্ডার্ডে পড়তো। তার প্রিয় খাবার ছিল বিফ রেজালা। সে যেদিন মারা যায় বাসায় বিফ রেজালা রান্না হয়েছিল। সে আর খেতে পারে নি।

ওসি সাহেব নির্বাক রইলেন।
– আপনি বলেন আমার মেয়ের কী হয়েছিল?
– রেপ হয় নাই। মজনুরা খুন করে নাই।
– তাহলে আপনি এই রিপোর্ট দিলেন কেন? আপনার কি মনে হয়েছে আমি এটা জানবো না?

শফিকুল ইসলাম চুপ করে রইলেন। মন্ত্রীরা সচরাচর বোকা হয় এটাই তিনি জানতেন। যদিও এত বোকা ভাবা ঠিকও হয় নি।

– আমি ডিজিএফআইকে দিয়ে তদন্ত করেছি। খুন করেছে চিফ হুইপের শালা। রাকিন শাহরিয়ার নাম।
– কেন করেছে?
– আমার মেয়েকে পছন্দ ছিল, মেয়ে রিজেক্ট করছে, তাই করেছে। রাতের বেলা রেস্টুরেন্টে ডেকে নিয়ে কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার। মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন লাশ গাজীপুরের ময়লার ট্রাকে তুলে দিতে সাহায্য করেছে। রেস্টুরেন্ট পক্ষেরও সাহায্য ছিল।
শফিকুল ইসলাম বললেন, ‘হুম’।
– দেখেন ওসি সাহেব, মেয়েটা আমার আদরের ছিল। ওকে অনেক যত্নে রেখেছি। নিখোঁজ হয়েছে যখন থানায়ও সরাসরি জানাই নি, ওর সম্মানের কথা ভেবে। সেই মেয়ের নামে আপনারা কি রিপোর্ট  করলেন? ‘রেপড হয়ে খুন’!
– প্রথমে এটাই মনে হয়েছে।
-তো যখন আপনাদের ভিন্ন কিছু মনে হয়েছে তখন আপনারা মামলা কেন ঘুরালেন না?
– প্রেসার ছিল স্যার।
– কে প্রেসার দিয়েছে?
– চিফ হুইপ দিয়েছেন।
হারামজাদা’ বলে মন্ত্রী চুপ করে রইলেন।

– স্যার, আমি যখন এটা সন্দেহ করে এদিক সেদিকে খবর নিচ্ছিলাম তখন ওনারা ফোন করেছেন। আমার এই রিপোর্ট দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
-আপনি আমাকে বলেন নাই কেন?
– বলে কী হবে?

ওসি সাহেব শুকনো হাসলেন।

– শোনেন ওসি সাহেব, আসলেই কিছু হবে না। কাকের মাংস কাকে খায় না। তবে।পলিটিশিয়ানদের মাংস পলিটিশিয়ানে খায়।
– আমি চিফ হুইপের বিরুদ্ধে কোনো একশনে যেতে পারবো না।

মন্ত্রী হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলেন অন্যদিকে।
ওসি সাহেব কতক্ষণ চুপ করে রইলেন। তাঁর বলতে ইচ্ছা হলো, “আপনারা অন্যদের সাথে যা করে আসছেন, সেটা মাঝে মাঝে আপনাদের সাথেও হবে। এটাই দুনিয়ার নিয়ম।”
ওসি সাহেব কিছু বললেন না। অনেক কিছুই বলা যায় না।

@Jr Korpa from https://unsplash.com/

ফাতেমা রিয়া

তরুণ গল্পকার, উপন্যাসও লিখেছেন। জন্ম ১৯৯৫ সালে। দেশের বাড়ি বরিশাল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পড়েছেন। সাহিত্য, সঙ্গীত, দর্শন ও রাজনীতিতে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।

Share