দর্শনের অনুপ্রস্থে দাঁড়িয়ে আছে এক টোটাল পোয়েটিসিজম ‘না মর্মরে না মর্সিয়ায়’

।। নাসরিন জে রানী ।।

“ইমুর কবিতার কাব্য সত্ত্বার প্রকাশ, স্বরূপ ও আদর্শ উপলব্ধির চেষ্টা করেছি, জীবন ও জগতের স্বরূপ আবহিত হয়ে তারই আলোকে কবির মনুষ্যজীবনের সংঘাতের কারণস্বরূপ নানারূপ অনুদার পরিবেশ ও ঘটনার ভেতরে প্রবেশ করে মুক্তদৃষ্টিটির উপলব্ধি করার ইচ্ছায় জ্ঞান ও সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে ভাবাবেগের পরিবর্তে উদার দৃষ্টিভঙ্গি, অনুধ্যান, বিচার বিবেচনা, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের বিশুদ্ধ চৈতন্যের সাধনা থেকে এই কবিতাগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। ‘না মর্মরে না মর্সিয়ায়’ বইটি মহিমান্বিত জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তাগিদের অনুভব, সাধারণ যাপনের নানা ঘটনাপ্রবাহের পেছনে প্রকৃতিলব্ধ সৌন্দর্যকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা সুষম সমুন্নতিতে শিল্পের পরমার্থ ও  সন্ধানকার্য চালিয়ে যেতে পারি। দীর্ঘ পরিক্রমায় এ তো আসলে নিজেকেই সন্ধান।”

দর্শনের অনুপ্রস্থে দাঁড়িয়ে আছে এক টোটাল পোয়েটিসিজম ‘না মর্মরে না মর্সিয়ায়’

একজন দার্শনিক হলেন একজন কাব্যিক লেখক, যিনি দর্শনের ক্ষেত্রে সাধারণ বিষয়গুলি অন্বেষণ করার জন্য কাব্যিক শস্ত্র ব্যবহার করেন। বিশেষ করে যেগুলো ভাষাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, ভাষার চারপাশে ঘোরাফেরা করে, যেমন- ভাষার দর্শন, সেমিওটিক্স, ঘটনাবিদ্যা, হারমেনিউটিক্স, সাহিত্যতত্ত্ব, মনোবিশ্লেষণ এবং সমালোচনাতত্ত্ব; ভাষার দর্শন হলো ভাষার উৎস, প্রকৃতি ও ব্যবহার নিয়ে যুক্তিভিত্তিক অনুসন্ধান। বিশ্লেষণী দার্শনিকগণ ভাষা বিষয়ক চারটি কেন্দ্রীয় সমস্যা নিয়ে চিন্তা করেন- অর্থের প্রকৃতি, ভাষার ব্যবহার,ভাষার অনুধাবন, ভাষা ও বাস্তবতার সম্পর্ক। প্রচলিত বিশ্বাসের বিপরীতে, ভাষাকে শুধুমাত্র লোকের দ্বারা ব্যবহৃত যোগাযোগের মাধ্যম বলা যায় না, ভাষার অন্যান্য মাধ্যম রয়েছে- কবিতাতে শব্দের পরে শব্দ যুক্ত করে এমন একটি ভাষা তৈরি করা সম্ভব যার রূপকতা একেক ব্যক্তির কাছে একেকভাবে ফুটে উঠতে পারে। কবিতা লিখে কবি আনন্দ দান করে আনন্দ পাবে, কবিতার পাঠকদল আনন্দের দান গ্রহণ করবে- এতে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে যদি অলৌকিক সুখ লাভ হয় পাঠের পরবর্তী পর্যায়ে তবে স্বভাবতই  সেই কবিতা ও তার পাঠ তৃপ্তির স্থান গ্রহণ করবে- লোকত্তোর এক অনুভবে। কবিতা ও দর্শনের সম্বন্ধ নিকটতম ও নিগূঢ়। কবি নৈরিৎ ইমু কবিতায় এক নতুন গ্রহের নির্মাতা। সেই গ্রহজগতের রহস্যময়তা দিয়েই তৈরি হয়েছে ওই জগতের রূপ,রস,গন্ধ,আবেগ,শরীর ও সুগন্ধী যন্ত্রনাগুলো। ইমুর কাব্যশৈলী স্বতন্ত্র, এর সুর সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার, যা বোঝা বেশ মনোযোগ ও জ্ঞান চর্চার শিসাশিস কলরবে মগ্ন; তার ‘না মর্মরে না মর্সিয়ায়’ কবিতার বইটিতে নিজস্ব এক মানচিত্রে কবি এঁকেছেন দারুন সব কথামালা। সেখানে মানুষ,পৃথিবী এবং পরমাত্মার শিল্প একেবারেই ভিন্ন এক রূপে পাঠকের সামনে  এসে আবার কোথায় যেন হারিয়ে যায়, বোঝা ভার, তবু চেষ্টা করবো এর সামান্য রেশটুকু নিচের লেখায় জমিয়ে রাখতে।

ঘুমফুল

গমন ও গন্তব্য জানা নাই
তথাপি এই অন্তর কোথাও যায়;
যায় সে মরণের পরে!

আকাশের ভেতরে সুপ্ত আকাশ
শূন্যে ভাসলাম হাওয়ায়, আহা রে হাওয়ায়-
দৃষ্টি ভেজাই, ঘুমের দেশে ওগো পাতালে
স্বর্ণকুচি, খুঁড়তে খুঁড়তে আমি
খুঁড়ে আমি আমার কংকাল।

তবু কি নিদ্রা ভালো? নিমজ্জনের পরে-
জ্যোতির্বলয়, আহা রে মরমি বলয়
জীবন এক অণুমঞ্জরী
চিরন্তন আতসী রূপ পাবে বলে ছবি আঁকে অন্ধকারে
মানুষ কি তাই খোঁজে অপরূপ ঘুমফুলে ঘুমফুলে?


ইমুর কবিতা-১

প্রত্যেক মানুষেরই তার নিজেকে জানা প্রয়োজন। নিজেকে জানার পদ্ধতিটা কী? আমি কে, কিভাবে এলাম, আমাদের জগৎ কিভাবে সৃষ্টি হলো ইত্যাদি সম্পর্কে জানা গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ বলছি- কারণ আমরা নিজেদের যেভাবে জানি, তার উপর ভিত্তি করেই জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নেই। পাশাপাশি একজন যুক্তিশীল, নান্দনিক মানুষ এবং একজন নৈতিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য এই জানার চর্চা প্রয়োজন। কাউকে পরিপূর্ণ একজন ব্যক্তি হয়ে উঠতে হলে সব ধরনের সমসাময়িক ঘটনাবলীর মধ্যে যে সংযোগ রয়েছে, সেটা ধরা শিখতে হবে। এজন্য দরকার একটি দার্শনিক মন। যে যত বেশি ভাবনার গভীরে যেতে পারে ( ক্রিটিকাল থিংকার), যে তত বড় দার্শনিক হয়ে গড়ে ওঠে। একজন কবি-দার্শনিক জটিল সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভালো নীতি অনুসরণ করতে পারেন। “জীবনের চেয়ে কল্পনা অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ”  – আইনস্টাইন বলেছেন। এই কাল্পনিক ক্ষমতা থাকাও জরুরী। বহু আগে ধারণা করা হতো কবিতার ভেতরের দর্শন শুধু বিমূর্ত ও কাল্পনিক। ধর্ম,নৈতিকতা, সমাজ, রাষ্ট্র সবকিছুর সঙ্গেই দর্শন জড়িত, এর সাথে কবিতার সম্পর্ক আছে গভীরভাবে। এই মৌলিক জ্ঞানগুলো অর্জনের জন্য দর্শন ও কবিতা উভয় পাঠ জরুরি। একেবারে শুরুর দিকে দর্শন চর্চা তারই কাজ- যার একটি বিষয় সম্পর্কে গভীরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে, আর দর্শন পাঠের মাধ্যমে গড়ে উঠে- পরবর্তীতে কবিতার কাজ হচ্ছে মানুষের আত্মবিক্ষণ ও দৃষ্টিভঙ্গির মৌল-বিধানের গুপ্ত পুস্তকের মত; জগৎ , জীবন, মানুষের সমাজ, তার চেতনা এবং জ্ঞানের প্রক্রিয়া প্রভৃতির মৌলিক আলাপের দুনিয়াতে প্রবেশ করা। মানুষের সামাজিক চেতনার বিকাশের একটা পর্যায়েই মাত্র মানুষের পক্ষে বিশ্লেষণী দৃষ্টি নিয়ে জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে চিন্তা করা সম্ভব হয়েছে। মানুষ তার নিজের উদ্ভব মুহূর্ত থেকেই চিন্তার এরূপ ক্ষমতা দেখাতে সক্ষম ছিল না। মানুষের চেতনা বিকাশের একটা স্তরে মানুষ তার পরিবেশ সম্পর্কে চিন্তা করতে আরম্ভ করে। নিজের জীবন অধিকতর নিশ্চিত করে রক্ষা করার প্রয়োজনে মানুষ প্রকৃতি জগতের রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করে। প্রকৃতি,জগৎ এবং পরবর্তীকালে মানুষের নিজেদের দেহ এবং চেতনা সম্পর্কেও সে চিন্তা করতে শুরু করে; তাই দার্শনিক ভাবনাপ্রসূত কবিতা  হলো চাক্ষুষ প্রত্যক্ষণ , জগৎ ও জীবনের স্বরূপ উপলব্ধি, জ্ঞান বা প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ। নৈরিৎ ইমুর কবিতা পাঠে তত্ত্ব দর্শন, জগৎ ও জীবনের স্বরূপ বিষয়ে উপলব্ধি ঘটে। সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি বা জীবন-তত্ত্বের সাক্ষাৎকার লাভ ঘটে; অনুদার ভাবাবেগ ও অন্ধচিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে জ্ঞান বা সত্যের অনুসন্ধানে উদার দৃষ্টিভঙ্গি, অনুধ্যান, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের মাধ্যমে সত্তা, জগৎ ও জীবনের সাথে জড়িত চিরন্তন সমস্যাবলীর সুষ্ঠু, যুক্তিসম্মত ও দৃঢ় দৃষ্টিপাত করার একটা শক্তিশালী প্রচেষ্টার মত ব্যাপার হয়ে ওঠে।

জলজগন্ধময়

জলে জন্মাবো। মাগো, পুনঃজন্ম দাও। তোমার জঠরে আছে দীঘি, জলজগন্ধময়। পদ্মফুলের পাশে মৌ, সর্পসঙ্গমে জাগে ঢেউ, মৎসপাখনার নৃত্য সারাক্ষণ। অপরাধ গুরুতর মানুষের, মাগো, শাদা পালকের হাঁস হবো, অগাধ জলে তোমার ভেতরে ভাসতে ভাসতে বাঁচবো। ঘনসন্ধ্যায় কান্না জুড়েছে পৃথিবীর পানকৌড়িদল; ঝিঁঝিঁডাক, হ্রেসারব সকল গিলেছে ভাষা দৈত্যের কন্ঠ। বাসি রক্তের সাথে কুলিয়ে উঠে না পাতার গন্ধ। মাগো, ব্যাঙ্গাচির মতো জঠর দীঘিতে সাঁতার কাটবো,জলজগন্ধময়।
এই রাক্ষস ভূমিতে তীরগাঁথা পাখির তড়পানো জীবন আমায় দিও না!


ইমুর কবিতা-

শাশ্বত ও বস্তু স্বরূপের অনুধাবন হয় কবিতা সৃষ্টির পথ ধরে। সত্ত্বা স্বরূপতা যা এবং এই স্বরূপের অঙ্গীভূত যেসব বৈশিষ্ট্য, তার অনুসন্ধান করেছেন কবি নৈরিৎ ইমু; তার কবিতাগুলোতে ফুটে উঠেছে- শ্বাশতের, ঈশ্বরের স্বরূপের এবং ঈশ্বরের স্বরূপ থেকে নিসর্গ উপলব্ধির শাব্দিক প্রকাশ। ইমুর কবিতা হলো নিছক অবভাসের পরিবর্তে বাস্তব সত্ত্বা জানার নিরন্তর প্রচেষ্টা।  দার্শনিক কবিতাগুলো যেমন হয়- পরিপূর্ণ ঐক্যবদ্ধ জ্ঞান-দর্শনের সামান্যীকরণগুলোর উপলব্ধি করা এবং তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার প্রকাশ ফু্টিয়ে তোলা। কবিতা হলো সত্যের প্রতি অনুরাগ ও বিষাদ দুই-ই, যাতে সত্য সব সময় তার মহান অখণ্ডতা দিয়ে বিষাদকে চিড়ে দিচ্ছে তান্ত্রিকের সুরে-মন্ত্রে, আওয়াজে। কিন্তু যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদিতা দিয়ে দেখলে- যা সাধারণের পাওয়া যায় না তার অস্তিত্ব স্বীকার করা সম্ভব নয়, বরং মুসকিল কাজ। বিধাতা, আত্মা, প্রভৃতি প্রত্যক্ষের অতীত, সেজন্য এইগুলো কাব্য সুষ্মা নিয়ে ফুটিয়ে তুলে তুষ্টি মেলে, তবে মেনে নেওয়া মুসকিল।  কাব্যে এমন ভাষা ব্যবহার হয় যে- কিছু প্রকাশ করতে হলে রূপ, রস, গন্ধ এইসব গুণবাচক এবং দ্রব্যবাচক শব্দের অধিক ব্যবহার হয়। যেমন, রূপ বলতে গেলেই আমরা কোনো না কোনো দ্রব্যের যেমন, ফুল, হরিণ, পাতা, মীন এইসব বোঝাই।  আসলে দ্রব্য বলে কিছু নেই। এটা আমাদের ভাষার সৃষ্টি, ভাষা জনিত বিভ্রান্তি। তাই কাব্যের ভাষা বিশ্লেষণ ও তা নিয়ে সমালোচনা করা এত সহজ কাজ নয়। আমার চেষ্টা হলো- ভাষার সমালোচনা দ্বারা কবিতা পাঠের বিভ্রান্তি দূর করা এবং তথাকথিত কাব্যের কাঠিন্য নির্ভর সমস্যাগুলোর মূল উৎপাটন করা। ইমুর কবিতার কাব্য সত্ত্বার প্রকাশ, স্বরূপ ও আদর্শ উপলব্ধির চেষ্টা করেছি, জীবন ও জগতের স্বরূপ আবহিত হয়ে তারই আলোকে কবির মনুষ্যজীবনের সংঘাতের কারণস্বরূপ নানারূপ অনুদার পরিবেশ ও ঘটনার ভেতরে প্রবেশ করে মুক্তদৃষ্টিটির উপলব্ধি করার ইচ্ছায় জ্ঞান ও সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে ভাবাবেগের পরিবর্তে উদার দৃষ্টিভঙ্গি, অনুধ্যান, বিচার বিবেচনা, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের বিশুদ্ধ চৈতন্যের সাধনা থেকে এই কবিতাগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। ‘না মর্মরে না মর্সিয়ায়’ বইটি মহিমান্বিত জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তাগিদের অনুভব, সাধারণ যাপনের নানা ঘটনাপ্রবাহের পেছনে প্রকৃতিলব্ধ সৌন্দর্যকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা  সুষম সমুন্নতিতে শিল্পের পরমার্থ ও  সন্ধানকার্য চালিয়ে যেতে পারি। দীর্ঘ পরিক্রমায় এ তো আসলে নিজেকেই সন্ধান। এ সমস্ত চিন্তা,চেতনা, শিল্পের বিবেচনা বা দর্শন একত্রে কবিতাগুচ্ছে প্রকাশ পেয়েছে বইটিতে। কবির মানসিক প্রদর্শনী বোঝাবুঝির পরিস্থিতি আমাদেরকে কিভাবে তার লেখা কবিতাগুলোর ভেতরে প্রবেশ করতে হবে ও নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার একটা উপায় সন্ধান করতে হবে- সেই সুযোগ দেয়, বিশেষ পরিস্থিতির উপর প্রতিক্রিয়া জানানোর সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা বা তথ্য দিতে পারে।

চুপচাপ ভিজলো খুব

চিত্রল হরিণ
তৃণে রাখলো মুখ,
দূরে সিংহ এক-
বুজে রইলো চোখ
সমান দূরত্বে।

বুকে জমাট ভয়
ক্ষুধা সাহস হয়

মনে দৃশ্যমান
শিকার সম্মুখে,
তবু নির্বিকার
চোখে শান্ত ভাব;
অলস ভঙ্গিমা
পেশি সংকোচন।

পাশে খাড়ির জল
জলে নিরস ঘাই-
মারে মৎসকূল,
তাতে ঢেউ ব্যাকুল।

খোলা প্রান্তরে
নামে পক্ষীরাজ,
খুটে খায় সে কীট
ফের উড়াল দেয়;
কাছে গহীন বন-
বনে পাতার দল,
মরে ঝরলো সব
ঘন হলুদতর।

জলজ আসমানে
ভাসে খন্ডমেঘ,
মেঘে কার নখর
কাটে কোমল ত্বক;
ত্বকে রক্তদাগ
সব হিংস্রতা
আর আস্ফালন
পাবে রূপান্তর
শীতল বৃষ্টিতে।

মৃত বৃক্ষটির
গুহায় সাদৃশ্য
খোলের মাঝখানে-
জ্বলে পশুর চোখ;
ঝড়ের ঝাপসাতে
খুনের নকশাটা
ভিজেই চুপসালো।

ইমুর কবিতা-৩

আমি দেখেছি- আমাদের আবেগ বিভিন্ন ধরনের পরিচর্যা করে অনুভূতির দ্রুতগতিময়তা, ক্রমাগত পরিবর্তনশীলতা, শক্তিশালী প্রকাশের মাধ্যমে জটিল দৃশ্যপট থেকে সরল ঘটনাক্রমে পৌছে জীবনকে পরিবর্তনশীল করে তুলতে পারে। এই যে আবেগের প্রকাশ- যদি তা দার্শনিকতা-দৃশ্যময় বা অনুভবের হয়ে ওঠে কবির কবিতার ভেতর দিয়ে, তবে তা আমাদের ভাবজগতের বিচিত্র পথগুলো ধরে সম্ভাব্য গন্তব্যে পৌছাতে অনুপ্রানিত করে। এভাবে আমাদের সামাজিক জগতে- অর্থপূর্ণভাবে যোগাযোগ করতে আমাদের সরঞ্জাম ও হাতিয়ার সরবরাহ বা প্রদান করতে পারে। বিজ্ঞানীদের মাঝে মানবের সৃষ্টি বিবর্তন ও জগৎ নিয়ে সবচেয়ে পুরনো গবেষণাপত্রগুলোর একটি চার্লস ডারউইন করেছিলেন, সেখানে একটি দারুন পরামর্শ ছিল এমন-  মানসিক চর্চাসহ একমাত্র মানুষই পারে জীব হিসেবে নিরাপত্তার সাথে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে। এই নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার অর্থ বহুবিধ, তার একটি হতে পারে- কবিতার চর্চা, যে-সে কবিতা নয়, দার্শনিক কবিতার চর্চা । ঠিক যেমন আমাদের নিজেদের আবেগ ও তার প্রকাশ অন্যদের সম্মুখে মূল্যবান হিসেবে আমাদের প্রকাশ্যমান হিসেবে হাজির করে, তেমন করে অন্যদেরও মানসিক অভিব্যাক্তিগুলো আমাদের কাছে সকলে মিলে সামাজিক একটি চর্চায় উদবুদ্ধ করে, কবিতা চর্চার ভেতর দিয়ে বিশুদ্ধ আবেগের চর্চা করা  সম্ভব। আর সামাজিক যোগাযোগ আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এটি আমাদের আবেগের ব্যাখ্যা ও পালটা প্রতিক্রিয়াগুলোকে যুগপৎ হাজির করে, সতেজ রাখে। কবিতাগুলো আমাদের ভেতরে যথাযথভাবে সাড়া দেওয়ার সুন্দর একটা সক্ষমতা শিক্ষার সুযোগ করে দিতে পারে- ‘নির্মমতা দিয়ে কোমলতাকে কিভাবে চিড়ে দিচ্ছে অথবা কোমল থেকে গলে জল হয়ে যাও’- এমনতর  কিছুতে রুপান্তরিত হতে পারি। আমাদের প্রিয়জন, বন্ধুদের, পরিবারের সদস্যদের সাথে এবং আত্মার নিকটজনের  সাথে আরো গভীর, অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি- সেসবে সহায়তা করে থাকে। দার্শনিকতাময় কবিতা একটি স্বতঃসিদ্ধ প্রকাশক বা ব্যবহারকারীকে এমন উপযুক্ত মানুষের সাথে সম্পর্কের যাত্রাপথে নানাবিধ মোড়গুলো পার হয়ে ভাবের বিবিধস্তরের পরিস্থিতির সম্মুখীন করে তোলে এবং সফলও করে তোলে।, শান্তি দেয়, তৃপ্তি আসে।

ভ্রম

যদি মৌমাছি
ফুলের কাছাকাছি
উড়ে;
তারে বসন্ত ভেবে-
লোকে ভুল
করে।


ইমুর কবিতা-৪

কবিতার পংক্তিতে ফুটিয়ে তোলা শারীরিক ভাষা মাধ্যমে আবেগজাত অভিব্যক্তি দিয়ে মনের ভাবের ও দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েনের প্রকাশ ঘটে যায়, যেমন- বিবিধ অলংকার বা সরল করে বললে- মুখোশের আড়াল নিয়ে আমরা আসলে কষ্ট বা আবেগের সঙ্গেই সংযুক্ত হই, মুখোমুখি দাঁড়াই, অভিব্যক্তি প্রকাশ করি।  এমন কি এমন পরিস্থিতিতে যেখানে আমরা বিশ্বাস করি যে- আমাদের সিদ্ধান্তগুলি কেবল বিশুদ্ধভাবে যুক্তি ও যৌক্তিকতা দ্বারা পরিচালিত হয়, তবু সবকিছুকে তুচ্ছ করে আবেগ-ই যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বা নিয়ে নেয়। আর আবেগপূর্ণ বুদ্ধিমত্তার প্রাথমিক প্রকাশ হলো ভাববাদি দার্শনিক কবিতা। যেখানে নিচের এই কবিতায়- এখানে আবেগ বোঝার এবং পরিচালনা করার জন্য আমাদের ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তাই দেখানো হয়েছে। 

কণ্ঠরোধ করা রাত

অপদার্থ সে, ফিরে আসে নিজগৃহে-
পরের করুণা নিয়ে, মাথা নিচু করে
মাখানো ভাতের বাসনে ডুবিয়ে হাত
অপমান লাগে, বসে থাকে চুপচাপ;
বাতিল মানুষ তার ক্ষিধে পেতে নাই
দৈন্য দশার রূপ উপহাসময়
তৃপ্তির স্বাদ পায় নি সে কোনোকালে;
কখনো আঙ্গুল চেটেও খায় নি আগে।
চিলের নখর, মনে বিদ্যুৎ নাই;
নীরব নিরীহ প্রাণীর মতোন হেঁটে
কলহ-শহরে গলিপথ ঘুরে একা-
ফিরে পরাস্ত, বিমূঢ় চেহারা নিয়ে
নিভৃতে পা রাখা, হীনমন্যতা শুধু
অপদার্থ সে, ধোঁয়ার কুন্ডলীতে-
হারিয়ে ফেলেছে জন্মকোষ্ঠীচাল
বিবাহিত ঘুম-বিছানায় শুয়ে শুয়ে
বিপর্যস্ত করে তোলা নিজেকেই;
পীড়ার অধিক মনোবৈকল্যও-
মনে বাঁধে বাসা, কাপুরুষ সেজে থাকা;
শ্বাসরোধ করা রাত কাটানো পুরুষ
চুমু তো নয়ই, আঙ্গুল চেটেও তার
হয় নি কখনো খাওয়া তৃপ্তির ভাত
গনিতে গুণনে ছলাকলা সংসার
গৌর গৌণ রমণীর পাশাপাশি
কুকুর যেমন  বিষাক্ত শয্যার-
তৃপ্তির স্বাদ পায় নি সে কোনোকালে;
কখনো আঙ্গুল চেটেও খায় নি আগে।
পাঁচটি আঙ্গুল চেটে কোণোদিন সেও-
তৃপ্তির সাথে গিলে নেবে অপমান।


ইমুর কবিতা-৫

সিদ্ধান্তের রাজনীতি ও কবিতার রাজনৈতিক দৃশ্য

আমাদের সিদ্ধান্তের উপর আমাদের আবেগের একটি বড় প্রভাব রয়েছে। যেগুলো আমরা আসলে নির্বাচন করতে চাই- তা নির্বাচনের জন্য পূর্বেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি, বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেগুলোকে আমরা রাজনৈতিক নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য নির্বাচন করি- পক্ষপাতিত্ব চলে আসে, যা ক্ষতিকর পক্ষপাতিত্ব হয়ে যেতে পারে।

কৃষ্ণডাহুকের স্বর

পাতার বিছানায় শুয়ে আছি। ফলের হলুদ ত্বকে আমার ভাগ্যরেখা আঁকি। তরুছায়ার অধিক কোনো প্রেমিকা পাবো না জানি। যৌনসংসর্গে আসা দুটো পাখি উড়ে গেলো হঠাৎ । দুটো শিস বাতাসে ভেসে বেড়ালো বহুক্ষণ। তারই ধাক্কায় ঝরে গেলো দ্বিধান্বিত কিছু ফুল। তোমাকে ভুলে যাচ্ছি প্রতারক, চোখ বুজে আসছে। হৃদপিন্ড বরাবর আমি আর আসতে দেবো না হরিণীরূপী সেইসব রাক্ষসীদের।


ইমুর কবিতা-৬

নানারকমের অনুভূতিগুলো দ্রুত কাজ করার জন্য আমাদের অনুপ্রেরণা প্রদান করে এবং আমাদের বেঁচে থাকা ও সাফল্যের সম্ভাবনার সর্বাধিক মর্যাদা প্রদান করে, এবং আমাদের জীবনে একটি অভিযোজিত ভূমিকা পালন করে। প্রকৃতিবাদী বিজ্ঞানী ডারউইন বিশ্বাস করতেন- অনুভীতিগুলির অভিযোজন বা উভয়ই মানুষ এবং পশুপাখিকে বেঁচে থাকতে ও পুনরুৎপাদন করতে দেয়। আমরা যখন রাগান্বিত হই, আমরা তখন আমাদের জ্বলন্ত ভাবের মোকাবেলা করি, বা মুখোমুখি দাঁড়াই। আমরা যখন ভয় পাই, ভীত হয়ে পড়ি। কিন্তু আমরা যখন ভালোবাসি, তখন আমরা একজন সঙ্গী বা সাথীকে খুঁজে বের করতে পারি এবং পুনরুৎপাদনে নিয়োজিত হই, করি।

ইতিবাচক আবেগ অভিজ্ঞতা ও নেতিবাচক অনুভব

আমরা ইতিবাচক আবেগগুলোর ভেতর দিয়ে নেচিতবাচক অনুভূতিগুলোর প্রবেশের সম্ভাব্যতা কমানোর ঝুঁকি নিতে পারি চাইলেই। সেটি কেমন- আপনি সামাজিক চর্চা ও সখ খুঁজে নিতে পারেন, যা আপনাকে সন্তুষ্টি ও উদ্দিপনার অনুভূতি প্রদান করে। অন্যদিকে-  আপনি সম্ভত এমন পরিস্থিতিগুলো এড়িয়ে চলতে চাইবেন- যা আপনাকে দুঃখ বা উদ্বেগের সম্মুখীন করে, হতাশাগ্রস্ত করে তুলতে পারে। তাই বলা যায়- সঠিক অনুভূতির চর্চা আমাদের বেঁচে থাকতে ও বিপদ এড়িয়ে চলতে সাহায্য করতে পারে।

কিন্তু আমরা কেন আবেগ অনুভব করি? তারা কোন ভূমিকা পালন করে?

আমাদের আবেগের স্থায়িত্বকাল ক্ষনস্থায়ী, বা দীর্ঘস্থায়ী যেকোনো প্রকারের হতে পারে। এটি ক্ষনকালের জন্য হলে বিষন্নতার কালও ক্ষনস্থায়ী হতে পারে।  আর দীর্ঘকালীন স্থিতিতে থাকলে- বিষন্নতাও তাই হবে হয়ত।  কিন্তু কিভাবে অনুভূতিগুলো আমাদের এই বিচিত্রভাবে বেঁচে থাকে উৎসাহিত করে? আমরা কি ভাবছি এবং তার প্রকাশে কি আচরণ করছি, এতে অনুভূতিগুলো চূড়ান্ত ভূমিকা রাখে। আমরা প্রতিদিন যে অনুভূতিগুলো অনুভব করি, তা আমাদের পদক্ষেপ নিতে ও আমাদের জীবনের বড় বড় , এমন কি ছোট ছোট সিদ্ধান্ত নিতেও ভীষণভাবে প্রভাবিত করে, মাঝে মাঝে বাধ্যও করে। আমরা তখন হয়ে পড়ি অনুভূতির দাস বা বশবর্তী।  কিন্তু এই আবেগ কী? কী আছে এর গঠনে?
সাধারণত তিনপ্রকারের জটিল উপাদান দিয়ে আবেগ বোঝা সহজ হতে পারে।

১। আমাদের আবেগ একটি ব্যক্তিগত উপাদান, অর্থাৎ কিভাবে আমরা আমাদের নিজস্ব আবেগ প্রকাশ করি।
২। এটি শারীরবৃত্তীয় উপাদান। অর্থাৎ আমাদের শরীরে আবেগের প্রভাব বা প্রতিক্রিয়াগুলো কেমন করে প্রভাবিত করে।
৩। একটি অভিব্যক্তিগত উপাদান। অর্থাৎ আমরা সর্বোপরি কিভাবে যেকোনো আবেগকে প্রকাশ বা মোকাবেলা করি। এরমানে হলো- আমাদের সর্বোপ্রকারের আচরণগুলো যা আবেগ নির্ভর হিসেবে প্রকাশ পায়। 

এইসবকিছুর সম্মিলনে আমাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া কাজ করে, বা ফাংশন করে। একটি উদ্দেশ্য নিয়ে ভূমিকা পালন করে।  রহস্যময় ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ উৎপাদন করা বা বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতা প্রকাশ করার জন্য কবি, লেখক ও শিল্পীরা অনুপ্রেরণা পেতে বিভ্রম/ মায়া/ বিভ্রান্তি বা ইলিউশন বা হ্যালুসিনেশনের সাহায্য নেন। 

                   মায়া বিভ্রম ঘোর বিভ্রান্তি মোহ ও ‘ঝুলন্ত আবেগ’

আমরা জানি সেরাটনিন মেজাজ, সংবেদনশীল ধারনা, ঘুম, ক্ষুধা, শরীরের তাপমাত্রা, যৌন আচরণ এবং পেশী নিয়ন্ত্রনকে প্রভাবিত করতে পারে। আর হেলুসিনেসন বা বিভ্রম মস্তিষ্কের রাসায়নিক গ্লুটামেটের কর্মকে প্রভাবিত করতে পারে।  বিভ্রান্তি বা সেনসেশনে বিচিত্র ইমেজগুলোকে বাস্তব বলে মনে হয়, যদিও তারা তা নাও হতে পারে। কিন্তু বাস্তব বিশ্বের সাথে আধ্যাত্বিক জগতের মিলিয়ে পেশ করা সেনসেশনগুলো ঝুলন্ত আবেগের মতন- কারণ তা অবাস্তবভাবে প্রদর্শিত, কখনো কখনো তা ভয়ংকর রূপের বিচ্ছিন্নতাবাদী, প্রতিবাদী, বিদ্রোহী ধরনের; বহু শতাব্দী ধরে মায়া-বিভ্রম, সাইকোডেলিয়া ব্যাপারটি-  দুনিয়ার বিবিধ দেশের সাইকোডেলিক শিল্পী ও কবিদের সৃজনশীলতায় উদ্দীপনার মাধ্যম হিসেবে বা অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা চিত্তাকর্ষক বটে।  কবিদের এই ঝুলন্ত আবেগ বা ইলিউশনকে উদ্দীপক হিসেবে নেওয়ার পেছনের কারন- বিভিন্ন হতে পারে- কিন্তু অধিকাংশ সাধারণ মানুষের জন্য হালুসিনেশন বা বিভ্রান্তি বা ইলিউশনে আক্রান্ত হওয়া পরে তাদের স্বল্প উপলব্ধি, চিন্তা ও ভোতা অনুভূতির পরিবর্তন ঘটিয়ে অন্যরকমের কিছুতে পরিনত করে দিতে পারে। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হলে, তার ঘ্রানজনিত ও স্বাদ ইন্দ্রিয়ও অত্যন্ত প্রভাবিত হতে পারে, দুর্দশায় পতিত হতে পারে। কিন্তু কবি মনের বিভ্রম বরং উলটো, তার কাব্য প্রতিভাকে বিকশিত করে- সুষমায় ভরিয়ে দিয়ে ভিন্ন স্বাদের দুর্লভ কিছু সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে।

ভগ্নাংশসমূহ

কেন যে দোদুল্যমান দ্বিধা, প্রহেলিকার দিকে ভর করে শূন্যমাত্রিক ভজন! তাকে না চেনাই, অধিক চেনার উপায়। মানুষের প্রতিজ্ঞা করার ছবি ভাসে হাতে-হাত রাখা, যেনো জ্যোৎস্নার ভেতর জ্বলজ্বলে চিতার শরীর, ভীতিসৌন্দর্যের মন। অথচ মন অনাবৃত হতে চায়। নিঃসীম পানে ধোঁয়াকুন্ডলীর প্রচ্ছায়াসম আর ঘনতর, ঘনিয়ে এনেছে বাষ্পীভূত দ্বন্দসমূহ। ফলে নিস্পৃহতায় ঝুঁকে স্পৃহার করুণা কুড়ানো। স্নানঘরে নিজেকে খুলে দেখার মতন, এতটা আপন করে পাওয়া- সমস্ত অসুস্থতার বিধৌত অবসর। গ্রীবাদেশ থেকে সিনায় আঙ্গুল বুলিয়ে দেখার শক্তিকে তখন আশ্চর্য নেশারুর মায়া বলে ভ্রম হয়!


ইমুর কবিতা-৭

ঘন ঘন ইলিউশনে আক্রান্ত হওয়া বা প্রতারনা মানে যে কেউ এমন কিছুর স্বাদ পায় যা সেখানে নেই, এইসব স্বাদ প্রাপ্তির অনুভূতি অত্যন্ত বিরল, বিভ্রান্তিতে পতিত হওয়ার কারনে হতাশা এসে ভর করে; শব্দের বিভ্রান্তি এবং শ্রবণের অভিজ্ঞতার তীব্রতা, সংগীত শোনার মত, অস্বাভাবিক সুন্দর ও বিশ্রী হয়ে ফুটতে পারে- যা অপ্রীতিকর ও স্পর্শকারত। এর ভুক্তভোগী মনে করেন যে- এইসব যন্ত্রনার সূচ তার ত্বকের উপর বা ত্বকের নিচে ছড়িয়ে আছে। এমন মানুষ যারা হঠাৎ হঠাৎ হতাশ হয় না, কিন্তু নিজেদের নরক হিসেবে দেখতে পায়, বিশ্বাসী হয়ে ওঠে,  মনে মনে বিশ্বজুড়ে যা ঘটছে তার সবকিছুই বিশ্বাসের আফিমে জুড়ে দেয়। এই দেখার বিভ্রান্তি সুন্দর বা অপ্রীতিকর হতে পারে কখনো কখনো, যেমন- মেজাজ দ্রুত এক ভাব থেকে অন্য ভাবে  পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে বা হয়, মেজাজ খুব দ্রুত শিফট হয়ে থাকে, মন এক জগত থেকে অন্য জগতে আসা-যাওয়া করে, ভাবের স্থানান্তর হয়। কবিতাতে এর সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা যায়, যা সাধারণ মানুষ পারে না, কিন্তু একজন সৃষ্টিশীল মানুষ বিভ্রান্তি থেকে দারুন কিছু সৃষ্টি করে ফেলতে পারেন।

জাহান্নাম

আমার দোযখ আমি তোমারে দেখাবো
লেলিহান শিখা কুন্ডীপাকে, জিঞ্জির পরানো
আমার পা, এই হাবিয়াহ নেক নজরে তুমি-
দেখবে কী করে? আমার কপাল ভাঙ্গা, আমি ধর্মাপেত
পঙ্ক মাখা সারা গায়, আগুনে চামড়া ঝলসানো;
দেখো এইখানে আমি থাকি, আমার দোযখবাস
পুড়ে গলে যাই, ফের প্রাণাঙ্কুর হয়ে জাগি আর পুড়ি
যেখানে ফারনেস ভাঁটি, পুড়তে পুড়তে সোনা খাঁটি হয়
সনাতন মন- সেতো সোনা নয়, অনির্বাপিত সে
তবু এই জাহান্নামে এতো আলো, এতো বিচ্ছুরণ
বিম্বপাতের কোথাও কোনো অন্ধকার পাবে তো না!


ইমুর কবিতা-৮

স্পর্শের মতন কন্ঠস্বরও শান্ত, জোর, বা হালকা ও উচ্চ হতে পারে, এর যেকোনোটিতে যাতায়াতের  মাধ্যমে একটি পরিসীমায় প্রবেশ করা সম্ভব, শ্রবণশক্তির এই মাতামাতির দরুন এই কাণ্ড আধ্যাত্বিক বা দার্শনিক কাব্যচর্চায়, উদ্দীপনায় ভরপুর এক স্পিরিচুয়াল জার্নির মতন। – এতে কবির পেরিফেরাল দৃষ্টির ভেতর দিয়ে ভিন্নভাবে সাধারণ দৃশ্যকে দেখে অসাধারণ তৃপ্তি পাওয়া যায়। যেমন কিছুক্ষন দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবনা এলো- দেওয়াল জীবন্ত, শ্বাস নিচ্ছে। আবার তা থেকে চোখ সরিয়ে যদি হাতের তালুতে তাকাই, শিরাগুলোকে মনে হতে পারে ফুটছে। বা সাপের মতন কিলবিলিয়ে হাঁটছে, জড়িয়ে আছে জলের ভেতরে একে অন্যকে । এইসব প্রাথমিক বিকৃতি থেকে কল্পনাজগতে দারুন প্রভাব চলে আসতে পারে হয়ত, এক সময় সত্যিই সব জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে, মানসে ফুটে ওঠে। দর্শন-কাব্যের এই এক সুন্দর দিক, তখন- যে কোনো রং সাধারণ থেকে প্রানবন্ত হয়ে উপস্থিত হয় ভাবনায়, বস্তুর চারপাশের দৃশ্যগুলো বিশাল বিশাল দিগন্ত জুড়ে ফুটে ওঠে, ভেসে বেড়ায় মন জগত থেকে জগতে। একজন মানুষ যখন ঘনিষ্টভাবে (অথবা বিভোর) ঘুম থেকে জেগে ওঠে; সে কোথায় আছে তা ঠাহর করতে না পেরে প্রতারিত হতে পারে, এই দ্বিপাক্ষিক জগত ও অন্যান্য জগতের মধ্যে শূন্যমুহূর্তের অবস্থান অত্যন্ত সুন্দর কিছু অনুভবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। কবির শরীর মধ্যাকর্ষণের বলে স্থির আছে এক বস্তু হয়ে কোথাও, কিন্তু মন উড়ছে সীমা- অসম্ভব দূরে বা কাছে। এই বিভ্রম এমন কিছু- যা আমরা দেখতে পাই, শুনতেও পাই, অনুভব করি, গন্ধ পাই; কিন্তু বাস্তবিক আস্বাদ করতে অক্ষম।

মাগফেরাতের ফুল
( এইটি একটি দীর্ঘ কবিতা, এর একটি ছোট্ট অংশ )


বোধ হয় কোথাও যাচ্ছিলাম- এই মীনদেশ, সরিসৃপ অঞ্চল ছেড়ে; আদিম গুহার গন্ধ পেরিয়ে, পুঁতে রাখা গুপ্তধনের উপর রাস্তা বানিয়ে, হেঁটে হেঁটে বহুদূর কোথাও। একা ভ্রমণের কালে, মন মুকুরের মতো হয়ে যায়। সেখানে দৃশ্যের পর দৃশ্য। নিজের সাথে কথায় প্ররোচিত কোনো হাওয়া ঘুরে ঘুরে সঙ্গ দেয়। ফলে নির্মিত ঘরের বাইরে মানুষের নিরুদ্দেশের গল্প, মৃত্যু সংবাদ, শোকার্ত চিৎকার সব যেনো একবেলা আস্ত কিছু গিলে তিনশ বছর ঘুমিয়ে থাকা সাপের মতো হঠাৎ সামান্য নড়ে চড়ে আবার ঘুমিয়ে যায়। সে ঘুম নিতান্ত আলস্যের পর নেমে আসে আর আড়ালে চলে যাওয়া সূর্যের কারণে যেভাবে চারপাশ তিমিরাচ্ছন্ন হয়, ক্রমে সেইভাবে ঘিরে থাকে।


ইমুর কবিতা-৯

মানুষের আচরণ তাদের অবচেতন মনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। অবচেতন মনের এইসব ভাবনা থেকে মানুষ সবসময় নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। উদ্বেগ ও বিষন্নতা দুটো ভিন্নমাত্রার ব্যাপার, এর ভেতরে পতিত হয়ে মন তার মানসিক স্থিতি হারায় চেতনা ও অবচেতনের ভেতরে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়ে। এইসব মনোবিশ্লেষণের কেন্দ্রে অবস্থান করে বিশ্বাস – যার মাধ্যমে মানুষ অবচেতন মনের ভেতর দিয়ে চিন্তা, অনুভূতি, আকাংখা ও স্মৃতিমালা অনুভব করে। অজ্ঞাতসারে মনের এইসব চেতনাগুলো এনে মনের ভেতরে কোথাও লুকিয়ে রাখে, অর্থাৎ অজ্ঞাতসারে মন উদ্যোগী ও চেতনাযুক্ত হয়ে সচেতনতার উপাদানগুলো নিয়ে আসার মাধ্যমে মানুষ তাদের বর্তমান ও জাগ্রত মনের মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করতে সক্ষম হয়। আর অহংবোধ- হলো এমন একটি প্রতিরোধক ব্যাপার – যা উদ্বেগ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মানুষরা ব্যবহার করে। অর্থাৎ যখন কিছু খুব অপ্রতিরোধ্য বা এমনকি অনুপযুক্ত বা তুচ্ছ মনে হয়- অহংবোধ প্রতিরক্ষক হয়ে সেসব সংকট সমাধানে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে। অর্থাৎ অহং হলো আবির্ভূত ব্যক্তিত্ত্বের অন্যতম দিক, যা বাস্তবতার চাহিদাগুলোকে মোকাবেলা করে সংকট দূর করে।  অহং এছাড়াও আমাদের মৌলিক অগ্রগতি, আমাদের আদর্শ এবং বাস্তবতার মাঝে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে উদ্যোগী হয়।

বিমুখ

মুখ ফিরিয়ে নাও। আমি বোদলেয়ার পড়ে ঘুমিয়ে পড়বো পাইন কাঠের টেবিলে। লুভর ইউরোপের দীর্ঘ ভবনের বারান্দা, মদ খেয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘুরবো একটা সকাল। নরম রোদের সকাল। আমার মনে পড়বে নারী মন্দিরে যায়, স্নান সেরে পূজো দেয়। ধূপের গন্ধ আর ফুলের গন্ধ মিশে বাতাসে এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়ায়।
টানেলের অর্ধেক পথ দৌড়ে এসে আমি কি হুহু করে কাঁদবো? ওক গাছের মাথার উপর দিয়ে দ্রুত উড়ে যাবে পাখি, যুদ্ধ বিমানের মতো। মুখ ফিরিয়ে নাও, তোমাদের মুখোমুখি হবার মতো মুখ আমার কোনোকালেই হবে না।

ইমুর কবিতা -১০

মনোবিশ্লেষণ মানুষের অজ্ঞান অন্বেষণ দ্বারা নিজেদের বুঝতে সাহায্য করে, যা অজ্ঞানে লুকিয়ে আছে- স্বপ্ন ও দমন হিসেবে, যার মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োগ থেকে – বাস্তব ও অবাস্তব জগতের মাঝে মানসিক বিশৃংখলার মাঝের দ্বন্দ্ব মেটায়। অথাৎ অবচেতন মনে আমাদের সচেতন মনের চিন্তার বাইরের সবকিছু সংরক্ষণ বা অন্তর্ভুক্ত করে রাখতে পারে। কিন্ত আমাদের এই অবচেতন মনের ভেতরে এমন কোনো অপ্রীতিকর ব্যাপার লুকিয়ে থাকতে পারে- যা সামাজিকভাবে গ্রহনযোগ্য নাও হতে পারে। আর যখন এইসব ঘটে- তখন তার থেকে উদ্ভুত যন্ত্রনা ও ব্যথা তৈরি হয়। তারা সচেতন মনের ভেতরে প্রবেশ না করে অবচেতনের মাঝেই কোথাও লুকিয়ে থাকে বা বাস করে, সমাহিত হয়ে যায়। যদিও এই চিন্তাধারা, স্মৃতি, অনুশোচনাগুলি আমাদের সচেতনতার বাইরেও ঘটতে পারে, তারা যেভাবে চিন্তা করে, কাজ করে, এবং আচরণ করে সেগুলিকে প্রভাবিত করে ফেলে, কিন্তু কিছুক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতার বাইরে জিনিস নেতিবাচক উপায়ে আচরণকে প্রভাবিত করে- আমাদের মনস্তাত্ত্বিক কষ্টে পতিত করতে পারে।

কবি নৈরিৎ ইমুর ‘না মর্মরে না মর্সিয়ায়’ কবিতার বইটিতে মোট পয়তাল্লিশটি কবিতা আছে, এই আলাপের প্রয়োজনে ও  আয়োজনে যে কবিতাগুলো এসেছে, তার নাম ও সংক্ষিপ্ত ভাব নিচে রেখে দিলাম-

ঘুমফুল– দর্শনের মুখোমুখি, আমি কে? ঈশ্বর কে? শক্তির রুপান্তর, শক্তির গতিময়তা, আলো-আধার, শুরু-শেষ।
ভয়– সচরাচর অভ্যস্ততা, ব্যতিক্রম না খোঁজা।
চুপচাপ ভিজল খুব– ভাষার সৃষ্টি। ইমুর ভাবের নির্মলতা ও কোমলতা, কাঠিন্য চিড়ে দেয় নরম/ কোমলতাকে – মেঘে কার নখর কাটে কোমল ত্বক, জলে নিরস ঘাই- ঢেউ ব্যাকুল।
কন্ঠরোধ করা রাত– দুনিয়ার কর্কশতা থেকে একটি বেভুল মানুষের নিশ্চুপতা, এখানে তার স্থান থাকা কিংবা না থাকা, গুরুত্বহীন হয়ে যাওয়া।
বিমুখ– টোটাল পোয়েটিসজম। একজন কবি সবচেয়ে স্বৈরাচারী প্রেমিক হতে পারে; পারে সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে নিজের ভেতরে থেকে যেতে, দুঃখী হলেও দুঃখ দেখাতে নেই হয়ত।
কুণ্ডলিনী / মহাশূন্য – উন্মাদনা, গোলক, অনেক বৃষ্টির পর- মেডিটেশন।
মাগফেরাতের ফুল– দার্শনিক ভ্রমন, বিশ্ব দেখা, জীবন দেখা, যাত্রাপথ।
জাহান্নাম–  মানুষের দার্শনিক কষ্ট-যন্ত্রনার শৈল্পিক দর্শন, এসথেটিক, চূড়ান্ত প্রকাশ- ভাবাবেশ, কিন্তু সুন্দর।
ভগ্নাংশ সমূহ– মূল আলাপ, দর্শন, আধ্যাত্ববাদ।
পাতার বিছানা– অভিমান ও ভাবালুতা, দ্ব্যর্থকতা, নিস্পৃহতা।
শেষ একটি কবিতা– দুনিয়ার দর্শন, মাটির ঘ্রাণ।

নাসরিন জে রানি

গল্পকার, ছোট ও বড় গল্প লেখেন। বাংলাদেশের সমসাম্যিক গদ্যকার ও গল্প লেখকদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৮৩-১৯৯৯ মফস্বলে থেকেছেন, ২০০০- ২০১০ বিবিধ শহরে বেড়িয়েছেন, ২০১১- বর্তমানে বিশ্বের আনাচে কানাচে ঘুরছেন; বই পড়ছেন, নিজস্ব আঙ্গিকে চরিত্র-নির্ভর, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস লেখার জন্য খুব ধীরে তৈরি হচ্ছেন।

Share