পিটার ফ্রাঙ্কোপানের ‘প্রথম ক্রুসেড ।। পূবের ডাকে’

।। বিশ্বেন্দু নন্দ ।।

‘THE BELKNAP PRESS OF HARVARD UNIVERSITY PRESS’ Cambridge, Massachusetts’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত পিটার ফ্রাঙ্কোপানের ‘প্রথম ক্রুসেড (পূবের ডাকে)’ নামক ইংরাজি ভাষার গ্রন্থটির বাঙলা তর্জমা ‘গ্রন্থিক’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে। বাঙলা ভাষায় বইটি অনুবাদ করেছেন বিশ্বেন্দু নন্দ। অনুবাদক কী বলছেন গ্রন্থের ভূমিকায়, তা প্রতিপক্ষের সাপ্তাহিক ‘কেতাবি’ আলাপে প্রকাশ করা হলো। ক্রুসেডের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে শুরুতেই অনুবাদক কর্তৃক কয়েকটি উদ্ধৃতি তুলে ধরে তারপর গ্রন্থটির বিষয়ে অনুবাদকের ক্রিটিক্যাল পর্যবেক্ষণ ও সেই অনুযায়ী বইটির ভূমিকা রচনা। আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতার সঙ্গে ক্রুসেড ও তাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দুনিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির পর্যালোচনায় বইটি ও তার অনুবাদ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করছি। তাই বইটির ভূমিকা পাঠকের দরবারে পেশ করা হলো।


‘‘জেরুজালেম এবং কনস্টান্টিনোপল শহর থেকে খুবই বিরক্তিকর সব আসতে থাকা খবর সারাক্ষণ আমাদের ব্যস্ত রাখছে – পারসিক জাতিরা, বিদেশি এবং সর্বশক্তিমান বর্জিত… খ্রিষ্টিয়দের বাসভূমি আক্রমন করে হত্যা, লুঠ আর ডাকাতির ফলে জনসংখ্যা হ্রাস হচ্ছে’’
রেইমের রবার্ট

‘‘কন্সট্যান্টিনোপলের সম্রাটের দূত চার্চের সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে মহান হুজুর পোপ এবং খ্রিষ্ট বিশ্বাসীদের অনুরোধ করলেন পবিত্র চার্চ সুরক্ষার জন্য বিধর্মীদের বিরুদ্ধে সাহায্য দেওয়ার জন্যে, পূর্বের চার্চ এবং কনস্টিন্টোনপলের দেওয়ালও অবিশ্বাসীদের কবলে বর্তমানে প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি। আমাদের হুজুর পোপ এই সেবা দেওয়ার জন্যে আহ্বান জানিয়ে বললেন সর্বশক্তিমানের ইচ্ছায় শপথের প্রতিশ্রুতি নিয়ে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে [যুদ্ধ] অভিযানে অংশ নিয়ে সম্রাটকে সব থেকে বিশ্বাসী সাহায্য করতে হবে।’
কন্সট্যান্সের বারনোল্ড

‘‘বিভিন্ন প্রান্তের কেল্টরা ঘোড়া এবং যুদ্ধের নানান অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে একের পর এক এসে জড়ো হলো। চূড়ান্ত উৎসাহ এবং উদ্দীপনায় তারা প্রত্যেকটি রাজপথ ভরিয়ে দিলো, এবং যোদ্ধাদের সঙ্গে এলো অসামারিক জনগণ, যেন তটভূমির বালি আর স্বর্গের তারার সংখ্যা ছাপিয়ে, হাতে গদা এবং কাঁছে ক্রুশ নিয়ে …ঠিক যেমন করে উপনদী নানান দিক থেকে একে নদীতে মেশে, তারা আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে চললো।’’
আন্না কোমনেনে

‘‘মোদ্দা কথা সম্রাট বৃশ্চিকের মত, মুখ দেখে ভয় লাগবে না, কিন্তু তার লেজের আঘাত থেকে দূরে থেকো।’’
– উইলিয়ামজ অব টায়রে


অনুবাদকের ভূমিকা

বইটি অতীব সুখপাঠ্য। উপমহাদেশীয় পরম্পরার ব্যাখ্যাকার ধরমপাল ইউরোপীয়দের সম্পর্কে মূল্যায়ণ করতে গিয়ে তাদের এক কথায় খুনি আখ্যা দিয়েছিলে। পিটারের বর্ণনায় বিশদে এন্টিওক, জেরুজালেমজুড়ে ইউরোপিয় গণহত্যার বর্ণনা উঠে আসে। তিনি দেখিয়েছেন আলেক্সিওস যেভাবে কিলিজ আরসালানের মত তুর্কি আমীরদের সঙ্গে, বাগদাদের সুলতানতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, ধর্মান্ধ ইসলামোফোবিক পশ্চিম ইউরোপ সেটা ভালভাবে নেয়নি। আলেক্সিওস নানাভাবে ইউরোপে আজও ব্রাত্য। তাছাড়া পরোক্ষে পশ্চিমা রোমক খ্রিষ্ট ধর্মের সঙ্গে পূর্বের চার্চের বিরোধের বিষয়টিও তুলে এনেছেন পিটার। সার্বিকভাবে সেই পশ্চাদপদ ইউরোপকে, মরিয়া হয়ে ব্যর্থ সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টার সময়কে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি ইউরোপিয় জাতিরাষ্ট্র বিকশিত ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চার মানদণ্ডে। জ্ঞানচর্চার এই সীমাবদ্ধ ব্যর্থাতাকে মাথায় রেখেই সুখপাঠ্য বইটি নতুন করে ভাবনার খোরাক জোগাতে পারে।

অনুবাদকের ভূমিকায় ক্রুসেডের সঙ্গে পশ্চিম গোলার্ধের দেশগুলির সঙ্গে পূর্ব গোলার্ধের দেশগুলির কয়েক হাজার বছরের চলতে থাকা প্রায় অচর্চিত ঘাটতি বাণিজ্য বিষয়ে কলমপাত করার আগে একটা গুরুত্বপূর্ব ঐতিহাসিক বিষয় ধরিয়ে দিতে চাই, প্রথম ক্রুসেডের সময় থেকেই কিন্তু আমরা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলির ইসলাম বিদ্বেষের প্রাতিষ্ঠানিক রেণু খুঁজে পাই— যে ক্রুসেড শুরু হয়েছিল কিন্তু মূলত ফরাসী আর কিছুটা ইতালীয় উদ্যগে – যে জন্যে মুঘলেরা অদক্ষিণ এশিয় বোঝাতে ফিরঙ্গি কথাটা ব্যবহার করেছে, কারণ, ফরাসীদের সঙ্গে প্রথম তুর্কিদের লড়াই শুরু হয়। ইসলামবিদ্বেষ যে ক্রুসেড সময়জাত এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রিচার্ড ঈটন বাংলা সীমান্তে ইসলামের আবির্ভাব সংক্রান্ত বইতে ছুঁয়ে গিয়েছেন। নয়শো বৎসরের প্রাতিষ্ঠা পশ্চিমা প্রাচ্যবাদীরা বহুকাল ধরে চর্চা করে পলাশীর সৌজন্যে ক্ষমতা লাভের পর বাংলায় প্রাতিষ্ঠনিক রূপ দেবেন এবং নিরীশ্বরতা চর্চাকারী ঔপনিবেশিকতায় নিষিক্ত ভদ্রলোকেদের হাতে ইসলামবিদ্বেষ এবং হিন্দুত্ববাদ যৌথভাবে তুলে দেবেন সাম্রাজ্য রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। এই গুপ্ত লুকোনো বিষয়টি নিয়ে খুব সম্প্রতি চর্চা চালাচ্ছেন উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা। আজকের বিশ্বজোড়া যে ওয়ার অন টেরর বা ইসলামবিদ্বেষ লক্ষ্য করি, সেটির চর্চা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কিন্তু শুরু হয় প্রথম ক্রুসেড আমলেই, পোপ দ্বিতীয় আরবান এবং বাইজান্টাইন সম্রাট প্রথম আলেক্সিওসের সময় এটা আবারও মনে করিয়ে দেওয়া গেল।

কয়েক হাজার বছর ধরে চলতে থাকা পূর্ব গোলার্ধের দেশ যেমন দক্ষিণ এশিয়া, চিন পারস্যের কারিগরি উৎপাদনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এবং পশ্চিমের দেশগুলির বাণিজ্য ঘাটতি হেঁটমুণ্ডঊর্ধ্বপদ হল পলাশীর চক্রান্তের সাফল্যে। ১৭৫৭’র বর্ষার রাতে মুর্শিদাবাদের (পলাশী এখন নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত) গঙ্গা-পাড়ের আমবাগানে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর বাংলার নবাবি সরকারের মধ্যে লড়াই অভিনয়ের প্রভাব হলো সুদূর প্রসারী, এশিয়া আগামী অন্তত ২৫০ বছর ধরে আর্থিকভাবে অধমর্ণ হবে আর ইউরোপ হবে উত্তমর্ণ। দীর্ঘকালব্যাপী সোনা রূপো এবং দামি ধাতু মশলার বিনিময়ে এশিয়া আর এশিয় ব্যবসার প্রাণকেন্দ্রে বসে থাকা বাংলায় যে ব্যবসা করতে হতো ইউরোপকে, পলাশীর এক ধাক্কায় তিন বছরে কোম্পানি আইনি, বেআইনি পথে সম্পদ লুঠের পরে আর ইউরোপকে বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপকে আর্থিকভাবে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলায় যে উপনিবেশের সূচনা করলো, সেটি ঔপনিবেশিক উদ্যমে চাষী, পশুপালক আর কারিগরদের উচ্ছেদ করে, তাদের কারখানার শ্রমিক বানানোর মধ্যে দিয়ে। পলাশী চক্রান্তের উত্তর সময়ে এক প্রজন্ম কাটতে না কাটতেই বাংলার আর্থিক সম্পদ আর আমেরিকার শ্রম সম্পদ ১৭৮০তে ইংলন্ডে এবং তারপরে গোটা ইউরোপে আবির্ভূত হবে কাপড়ের কল, কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থা। পূর্ব থেকে পশ্চিমে যে লুঠ সম্পদের যাত্রা শুরু হলো। সেই প্রবণতা পলাশীর ২৫০  বছর কেটে যাওয়ার পরে আরও গভীর আরও ব্যপ্ত হচ্ছে। সেই চক্রান্তে কোভিড-১৯ খুব বড় পথ বাঁকানো হাতিয়ার। গণমৃত্যুর অবাস্তব  জুজু দেখিয়ে পূর্বের দেশগুলোর চাষী, কারিগর, ক্ষুদ্র ও পথব্যবসায়ীদের  যতটুকু কোমরের জোর ছিল, তাকেও ধ্বংস করে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে।

ইসলামবিদ্বেষ যে ক্রুসেড সময়জাত এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রিচার্ড ঈটন বাংলা সীমান্তে ইসলামের আবির্ভাব সংক্রান্ত বইতে ছুঁয়ে গিয়েছেন। নয়শো বৎসরের প্রাতিষ্ঠা পশ্চিমা প্রাচ্যবাদীরা বহুকাল ধরে চর্চা করে পলাশীর সৌজন্যে ক্ষমতা লাভের পর বাংলায় প্রাতিষ্ঠনিক রূপ দেবেন এবং নিরীশ্বরতা চর্চাকারী ঔপনিবেশিকতায় নিষিক্ত ভদ্রলোকেদের হাতে ইসলামবিদ্বেষ এবং হিন্দুত্ববাদ যৌথভাবে তুলে দেবেন সাম্রাজ্য রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। এই গুপ্ত লুকোনো বিষয়টি নিয়ে খুব সম্প্রতি চর্চা চালাচ্ছেন উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা। আজকের বিশ্বজোড়া যে ওয়ার অন টেরর বা ইসলামবিদ্বেষ লক্ষ্য করি, সেটির চর্চা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কিন্তু শুরু হয় প্রথম ক্রুসেড আমলেই, পোপ দ্বিতীয় আরবান এবং বাইজান্টাইন সম্রাট প্রথম আলেক্সিওসের সময় এটা আবারও মনে করিয়ে দেওয়া গেল। …

পলাশী বা কোভিড পরিবেশ তৈরি করাকে শুধুমাত্র পশ্চিমের তাৎক্ষণিক চক্রান্ত হিসেবে গণ্য করাকে ইতিহাসবোধের ঘাটতি হিসেবে ধরে নিতে হিবে। এন্থনি পাগডেন ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাট ওয়ার টু থাউজেন্ড অ্যান্ড ফাইভ হানড্রেড ইয়ার স্ট্রাগল বিটুইন দ্য ইস্ট এন্ড ওয়েস্ট’-এ বলছেন আড়াই সহস্রাব্দ ধরে পশ্চিম চেষ্টা চালাচ্ছে পূর্বের সম্পদ আর ভূমি দখলের। ইউরোপ জানতো সে কৃষি অযোগ্য অনুর্বর খুব বেশি হলে বছরে একটিবার ফসল ফলাতে পারে আর অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদেও তার ভাণ্ডার অল্প। উল্টোদিকে এশিয়ায়(সঙ্গে আফ্রিকা আমেরিকার) বিপুল উর্বর চাষযোগ্য ভূমির ফসল, ভূমির তলার সম্পদ দখল এবং অগণিত বাহু আর পশুবল। ২৫০০ বছর আগে বাংলার নীলাম্বরীর আমদানিতে রোমের বিপুল সোনা ব্যয়ের ক্ষোভের প্রতিফলন দেখি ১৭০০’য় লন্ডন, প্যারিস, আমস্টার্ডামে দক্ষিণ এশিয় কাপড় আমদানি বন্ধ এমন কী প্রাণ হরণের আইনে। হাজার হাজার বছর ধরে যে বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছিল সেই প্রবণতাকে ইউরোপ পাল্টাবার নানান উদ্যম নিয়েছে নানা সময়ে।

এই বাণিজ্য ঘাটতি মিটিয়ে উপনিবেশ তৈরি করার দীর্ঘকালের পরিকল্পনার অন্যতম ব্যর্থ উদ্যম সামগ্রিক ক্রুসেড। ১০৯৯তে জেরুজালেমে দখল করে উপনিবেশ স্থাপন করেও প্রথম ক্রুসেডের সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি ইউরোপ তুর্কি আর মোঙ্গলদের উত্থানে। ক্রুসেড, বিশেষ করে প্রথম ক্রুসেডের সাফল্যের ব্যাখ্যা জিইয়ে রাখতে নয়শো বছর ধরে যে ক্রুসেডের ইতিহাস আঙ্গিক ইউরোপে বিকাশ লাভ করেছে, সেই আঙ্গিকের শেষতম ঐতিহাসিক পিটার ফ্রাঙ্কোপানের প্রথম ক্রুসেড পূবের ডাকে বা ‘দ্য ফার্স্ট ক্রুসেড – দ্য কল ফ্রম দ্য ইস্ট’। এই বইটির মূল উদ্দেশ্য প্রথম ক্রুসেড আয়োজনে ইউরোপ নিন্দিত বাইজান্টাইন সম্রাট প্রথম আলেক্সিওসের ভূমিকার পুণর্মূল্যায়ন এবং স্বমহিমায় উপস্থাপন, প্রাথমিকভাবে পূর্ব পশ্চিমের বাণিজ্য লড়াই বা উপনিবেশ স্থাপনের ভাবনা ব্যাখ্যা নয়। কিন্তু পিটারের ইউরোপকে ঊর্ধ্বে তোলার ব্যাখ্যার মাঝেও পাঠক দেখবেন কীভাবে পশ্চিম ইউরোপের ভেনিসের মতো ইতালির শহর রাষ্ট্রগুলির বাণিজ্য উদ্যম রাজনৈতিক গোলোযোগের মাঝে এশিয়ায় বাণিজ্য কামড় দেওয়া শুরু করেছে। বিশ্বের কারখানা দক্ষিণ এশিয়া, চিন আর পারস্যের বৈচিত্রময় বিকেন্দ্রিভূত কারিগরি উৎপাদন ব্যবস্থাজাত বিপুল পণ্য এশিয় প্রধানতম বাণিজ্যপথ (যাকে ইউরোপের ভাষায় রেশম পথ বলি) মারফত পরিবাহিত হয়ে ইউরোপে পৌঁছনোর আগে ফরাসী আর ইতালিয় বণিকদের সঙ্গে হাতবদল হতো পূর্বভূমির শেষ বিন্দু সেদিনকার বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সট্যান্টিনোপলে বসফরাস প্রণালীর বাজারে। পিটার ফ্রাঙ্কোপ্যান বাইজান্টাইন নায়কের পুণর্মূল্যায়ন করার মাঝে শুধু ছুঁয়ে যান আলেক্সিওসের সিংহাসন রাখতে ভেনিসিয় বণিকদের বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের বিপুল এশিয়া মাইনর এলাকায় ব্যবসার ছাড় দেওয়া এবং দখল হওয়া জেরুজালেমে, খ্রিষ্টিয় গণহত্যায় নিহত এবং পালিয়ে যাওয়া মুসলমান কারিগর বণিকশূন্য খ্রিষ্টিয় উপনিবশ জেরুজালেমে ইতালিয়দের ঘাঁটি গেড়ে বসার উদাহরণ। এশিয়া মাইনর এলাকায় ইউরোপের পক্ষ্ম বিস্তারের চেষ্টা প্রথম ক্রুসেডের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে শুরু করেছিলেন আলেকজান্ডার, কিন্তু তিনিও চরম ব্যর্থ হন বাঙলার গৌরবের কথকতায়। তবুও ইউরোপের জেরুজালেম দখল এশিয়ায় ইউরোপের দ্বিতীয় উপনিবেশ, প্রথম উপনিবেশ আফগানিস্তান অঞ্চলে এশিয়ায় থেকে যাওয়া গ্রিক সেনানীরা।

…বাংলায় যে উপনিবেশের সূচনা করলো, সেটি ঔপনিবেশিক উদ্যমে চাষী, পশুপালক আর কারিগরদের উচ্ছেদ করে, তাদের কারখানার শ্রমিক বানানোর মধ্যে দিয়ে। পলাশী চক্রান্তের উত্তর সময়ে এক প্রজন্ম কাটতে না কাটতেই বাংলার আর্থিক সম্পদ আর আমেরিকার শ্রম সম্পদ ১৭৮০তে ইংলন্ডে এবং তারপরে গোটা ইউরোপে আবির্ভূত হবে কাপড়ের কল, কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থা। পূর্ব থেকে পশ্চিমে যে লুঠ সম্পদের যাত্রা শুরু হলো, সেই প্রবণতা পলাশীর ২৫০  বছর কেটে যাওয়ার পরে আরও গভীর আরও ব্যপ্ত হচ্ছে। সেই চক্রান্তে কোভিড-১৯ খুব বড় পথ বাঁকানো হাতিয়ার। গণমৃত্যুর অবাস্তব  জুজু দেখিয়ে পূর্বের দেশগুলোর চাষী, কারিগর, ক্ষুদ্র ও পথব্যবসায়ীদের  যতটুকু কোমরের জোর ছিল, তাকেও ধ্বংস করে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে।

বইটি অতীব সুখপাঠ্য। উপমহাদেশীয় পরম্পরার ব্যাখ্যাকার ধরমপাল ইউরোপীয়দের সম্পর্কে মূল্যায়ণ করতে গিয়ে তাদের এক কথায় ‘খুনি’ আখ্যা দিয়েছিলে। পিটারের বর্ণনায় বিশদে এন্টিওক, জেরুজালেম জুড়ে ইউরোপিয় গণহত্যার বর্ণনা উঠে আসে। তিনি দেখিয়েছেন আলেক্সিওস যেভাবে কিলিজ আরসালানের মত তুর্কি আমীরদের সঙ্গে, বাগদাদের সুলতানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, ধর্মান্ধ ইসলামোফোবিক পশ্চিম ইউরোপ সেটা ভালভাবে নেয়নি। আলেক্সিওস নানাভাবে ইউরোপে আজও ব্রাত্য। তাছাড়া পরোক্ষে পশ্চিমা রোমক খ্রিষ্ট ধর্মের সঙ্গে পূর্বের চার্চের বিরোধের বিষয়টিও তুলে এনেছেন পিটার। সার্বিকভাবে সেই পশ্চাদপদ ইউরোপকে, মরিয়া হয়ে ব্যর্থ সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টার সময়কে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি ইউরোপিয় জাতিরাষ্ট্র বিকশিত ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চার মানদণ্ডে। জ্ঞানচর্চার এই সীমাবদ্ধ ব্যর্থাতাকে মাথায় রেখেই সুখপাঠ্য বইটি নতুন করে ভাবনার খোরাক জোগাতে পারে।

পোপ আর্বানের নির্দেশে, আলেক্সিওসের ব্যবস্থাপনায় যে বাহিনী সর্বশক্তিমানের উদ্দেশ্যে শপথ নিয়ে ফ্রান্স থেকে জেরুজালেমকে মুসলমান অধিকার মুক্ত করতে অভিযান করেছিল সেই অভিযানটি সফল হলেও, ভবিষ্যতে ক্রুসেড অভিযান অবলম্বন করে বাণিজ্য এবং বিস্তৃত সাম্রাজ্য তৈরির উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। প্রথম ক্রুসেডের ৪৫০ বছর পর কন্সট্যান্টিনোপল খ্রিষ্টিয়দের থেকে এশিয়দের হাতে আসায় ইউরোপিয় এশিয় বাণিজ্যের রাশ এশিয়দের হাতে থেকে যায়। স্থলপথে এশিয় উপনিবেশ তৈরির উদ্যম বিনষ্ট হলে জলপথে এশিয়ায় আসার চেষ্টা নেয় ইউরোপ। ক্রুসেড ব্যর্থতায় ১৪০০ শতাব্দ থকে নতুন করে পোপের নির্দেশ আলাদা আলাদা করে কর্পোরেট কোম্পানি তৈরি করে পর্তুগাল, ডাচ, ইংলন্ড, ফ্রান্স, ডেন ইত্যাদিদের এশিয়া দখলের ভাবনা শুরু হয়। ক্রুসেডিয় বাণিজ্য ঘোমটা রূপান্তরিত হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামের মধ্যে। এই ঘোমটা যুদ্ধ, বাণিজ্য এবং রাজনীতি চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আজও ক্রিয়াশীল। বিভিন্ন বহুপাক্ষিক আলোচনায় এশিয়ায় ইউরোপিয় স্বার্থ চাপানোর কাজ হয়ে চলেছে। এই প্রেক্ষিত মাথায় রেখে বইটি পড়া দরকার।


লেখক পরিচিতি
বিশ্বেন্দু নন্দ
লেখক, গবেষক, সংগঠক। উপনিবেশপূর্ব সময়ের সমাজ অর্থনীতিতে  কারিগরদের ইতিহাসের খোঁজে সর্বক্ষণের কর্মী। হকার, কারিগর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক। বাংলায় পরম্পরার উৎপাদন বিক্রেতাদের বিষয়ে লিখেছেন নিরন্তর। বাংলার উপনিবেশপূর্ব সময়ের পরম্পরার চাষী-হকার-কারিগর-ব্যবস্থা বিষয়ে খোঁজ করছেন। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। ‘পরম’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। অড্রে ট্রুস্কের আওরঙ্গজেব, ম্যান এন্ড দ্য মিথ, স্বেন বেকার্ট এম্পায়ার অব কটন, যদুনাথ সরকারের মুঘল এডমিনিস্ট্রেসন, আহকমই আলমগিরি অনুবাদ করেছেন। পলাশীপূর্বের বাংলার ৫০ বছর, পলাশীপূর্বের বাংলার বাণিজ্য দুটি মৌলিক পুস্তকের রচয়িতা। 

Share