মঞ্চ থেকে জীবনের থিয়েট্রিক্যাল কবিতার কিয়ারোস্কুরো

।। অতনু সিংহ ।।

ব্রাত্য বসুকে আমরা মূলত চিনি নাট্যকার, অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে। তাঁর দ্বিতীয় যে পরিচয়ের সঙ্গে মানুষ পরিচিত, তা হল তিনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু তাঁর এসব পরিচয়ের বাইরেও যে আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় রয়েছে, তা আমার মতো অনেকেই জানতেন না। কিন্তু ২০২২ সালে সিগনেট ব্রাত্য বসুর কাব্যগ্রন্থ ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা’ প্রকাশ করে আমাদের কাছে তাঁর কবি পরিচিতিকে প্রকাশ করেছে। এ জন্য, সিগনেট প্রকাশনাকে ধন্যবাদ। অবশ্য, কবিতা তো বাঙালি মাত্রই লেখেন। নন্দনতত্ত্বের জগত ও শিল্পকলার অন্য কোনো মাধ্যমে কারও যদি উজ্জ্বল উপস্থিতি থাকে তাহলে তিনি যে কবিতা লিখবেন এটা অস্বাভাবিক নয়। এমনকী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরও কবি হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করার খায়েশটাও নতুন কিছুই নয়। চিনের সবচেয়ে উজ্জ্বল চেয়ারম্যান মাও সে তুং তো তাঁর কবিতার কাব্যগুণ বিচারে সাচ্চা কবিই ছিলেন। কিন্তু কাব্যগুণের কথা বাদ দিলেও বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে নিজের কবিসত্তাকে পাঠক সমাজে তুলে ধরার চেষ্টায় খামতি রাখেননি। সে দিক থেকে হয়তো অনেকের মনে হতে পারে, ব্রাত্য বসু একে তো একজন নাট্যকার, চলচ্চিত্রী ও অভিনেতা, দ্বিতীয়ত তিনি সংসদীয় রাজনীতির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তাই হয়তো কবিতার প্রতি ভালোবাসায় ও কিছুটা শখের বশে কবিতা লিখতে চেয়েছেন। এমন মনে হওয়ার মধ্যে কোনো অপরাধ নিশ্চয়ই নেই। কিন্তু ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা নামক প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটি নিবিড় পাঠ করলে যে কোনো মগ্ন কবিতা পাঠক টের পাবেন, এই নাট্যকারের মঞ্চের কাব্যিক গুণাবলী থেকে শুরু করে তাঁর সকল নন্দনতাত্ত্বিক ও শৈল্পিক প্রকাশের অন্দরে আসলে একজন সাচ্চা কবি নিভৃতে বসে রয়েছেন। তারপর খোঁজ নিয়ে জানা যাবে, নাটকের জগতে, মঞ্চে নিজেকে প্রকাশের অনেক আগে থেকেই, মানে সেই ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি নীরবে কবিতা লিখছেন। একসময় একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনাও করেছেন। অবশ্য এসব কথা নেহাত স্তুতিবাক্য মনে হতে পারে অনেক দিগ্‌গজের। তাই বরং ব্রাত্য বসু সম্পর্কিত আলাপ না বাড়িয়ে তাঁর কাব্যগ্রন্থ বিষয়েই কিছু কথা বলা যাক।

কবি ব্রাত্য বসু প্রণীত ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা’

প্রতিটি শিল্পীই তাঁর স্থান-কাল সীমানা নির্ধারিত অস্তিত্বকে অতিক্রম করে যেতে চান। যেহেতু সকল শিল্পমাধ্যমের সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম মাধ্যম কাব্য ও কবিতা, তাই অস্তিত্বের সীমারেখা অতিক্রমণের তাগিদ হয়তো কবির মধ্যেই সবচেয়ে বেশি করে দেখা যায়। একই সঙ্গে নাট্যকার-মঞ্চশিল্পী এবং কবি ব্রাত্য বসুর মধ্যে এই তাগিদ ও অতিক্রমণের চেষ্টা আর রণ-রক্ত-সফলতার ঘেরাটোপে আটকে যাওয়ার বিষণ্ণতা লক্ষ্য করতে পারেন কোনো মগ্ন পাঠক। একদিকে প্রসেনিয়ামের ঘেরাটোপ ভেঙে নাট্যকার ও কলা-কুশীলবরা মঞ্চ থেকেই মঞ্চের বাইরের বাস্তবতা এমনকী পরাবাস্তবিক অবস্থানে দর্শকদের নিয়ে যেতে চান, কিন্তু সেই মঞ্চ কেবল পেশার দায়দায়িত্ব ও নিয়মরীতির ঘেরাটোপে আটকে ফেলে তখন রিপিটেশনের ক্লান্তি কুড়ে খায় শিল্পীকেও, তেমনই জীবনের প্রসেনিয়ামে নানাবিধ ভূমিকায় অভিনয় তথা দায়িত্বের নিয়মানুবর্তিতায় আটকে পড়া ব্যক্তিকেও ভুলে যেতে হয় সত্তা, হাততালি আর বাহবা কুড়ানোর পর গ্রিনরুমের একান্তে কুশীলবের আর মেক-আপ ওঠে না। ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা’র সূচনা হয় এভাবেই, মেক-আপ কবিতায়। কবি লিখে ফেলেন, ‘শো-এর পর আজকাল আর মেক-আপ ওঠে না।’

নারকেল তেল আর স্নো মিশিয়ে,
তুলো দিয়ে গাল রগড়ালাম দু’হাতে বারবার
গোলাপি রঙের সর, দু’দিনের না-কাটা কড়া দাড়ির ওপর
তার কাঁকড়াবিছের মতো আঙুল দিয়ে আরও লেপটে গেল।
ভয় পেয়ে আয়নার দিকে তাকালাম আবার।
দেখলাম এমনকী নাকের চেরিফলের মতো টুকটুকে
পিংপং বলটি পর্যন্ত অবিকৃত আছে।

শো-এর পর আজকাল আর মেক-আপ উঠছে না।

‘মেক-আপ’, ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা’

এই কাব্যগ্রন্তটি দুটি অংশে বিভক্ত। তার মধ্যে প্রথম অংশে বাংলা থিয়েটারে, মঞ্চ ও গ্রিনরুমের আলো-আঁধারির জগত, থিয়েটার প্রোডাকশনের ভিতরের নাটক, ভিতরের ফিকশনের ভিতর দিয়ে নিজের অন্তর্জগতকে কবিতার ভাষায় প্রকাশ যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা থিয়েটারের প্রাতঃস্মরণীয়দের কথা স্মরণ করে লেখা কয়েকটি কবিতা, যেমন শিশিরকুমার ভাদুড়ি, শম্ভু মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত। বাংলা থিয়েটারের এই তিন প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কবির কাব্যিক মোলাকাতের ভিতর দিয়ে যেরকম বঙ্গের থিয়েটারের আধুনিক ইতিহাসকে স্মরণ, তেমনই নিজের পোয়েটিক আকাঙ্খার ভিতর দিয়ে স্থানকালের গণ্ডি পার হয়ে তাঁর পূর্বসূরীদের সঙ্গে শব্দ-আয়োজনে মুহূর্তযাপন করছেনে এই অংশে। থিয়েটারের মতোই এই অংশটি যেমন ড্রামাটিক, তেমনই তার মধ্যে গল্পের আয়োজন ঠাসা, আর ক্রমগতি কাব্যিক। ‘শিশিরকুমার’ পড়তে গিয়ে আমরা অনায়াসে চলে যেতে পারি থিয়েটারের স্বর্ণযুগে এবং সময়ের এই ফ্লাসব্যাকে পেয়ে যাই উত্তর ও মধ্য কলকাতার আলো-আঁধারিকে।

আমরা যারা কেবল শুনেই গেছি, থিয়েটারের এই কালপুরুষদের কথা, কিন্তু ব্যক্তিমানুষ হিসেবে তাঁদের তো দূরের কথা, নিদেনপক্ষে তাঁদের নাট্যপ্রযোজনাও মঞ্চে কখনও দেখার সুযোগ হয়নি, কেননা, আমাদের চৈতন্য যখন কিছুটা হলেও সজাগ, তখন বিশ্বায়িত দুনিয়ায় মঞ্চ, পথ, অঙ্গন এসবের নাট্যজাদুর স্বর্ণযুগ শেষ, ইন্টারনেট না এলেও টেলিভিশন, ডিডি-মেট্রো, উদার অর্থনীতি, পণ্যবাদ ইত্যাদি তখন খলবল করতে শুরু করেছে, তবুও হয় ক্যাসেটে কিংবা টেলিভিশনে কয়েকবার চোখে পড়েছে শম্ভু-তৃপ্তি জুটির রক্তকরবী, নেপথ্য থেকে শম্ভুবাবুর সেই কণ্ঠ… কিংবা লাল টুকটুকে পতাকা নিয়ে আমাদের যেসব ‘বোকা বোকা’ পূর্বসূরীরা পেরেস্ত্রৈকার খপ্পড়ে না পড়েই স্বপ্নে বুঁদ হয়েছিলেন, আর তাঁদের স্বপ্নের মাঝেই মফঃস্বল-গাঁ-গঞ্জে আলোড়ন তুলেছিল যে উৎপলীয় ‘কল্লোল’– সেসবের কথা শুনেছি, বা বড়জোড় পড়েছি আমরা মুক্তবাজার দুনিয়ার প্রজন্ম, কিন্তু চাক্ষুষ করা হয় নাই, সেই আমাদের মতো অনেক না-দেখা, অনেক কিছু মিস করে আসা প্রজন্মের অনেকেই কবিতায় থিয়েটারের আলাপ সূত্রে সেইসব দিনক্ষণ ও ব্যক্তিত্বকে পোয়েটিক ফিকশন মারফৎ পেয়ে গিয়েছি, ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা’র প্রথমাংশে। শুধু তাই নয়, থিয়েটারের ও রাজনীতির কালেক্টিভ ব্রাত্য বসু তাঁর কবিতায় নাট্যজগতে তাঁর পূর্বসূরীদের গল্পকবিতায় হাজির করে তাঁদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন নিজেকে। গল্পের আয়োজনের অন্দরে কবিতায় কবিতায় চলেছে নিজের অস্তিত্বকে ঝালিয়ে নেওয়ার কৌশল। এমনকী স্বপ্নভঙ্গের অশ্রু আর রক্তক্ষরণ রয়েছে ভীষণভাবে। আর তাই ‘তাঁহাদের কথা’ অংশে ‘শম্ভুবাবু’ কবিতায় তিনি লিখে ফেলেন–

আমার মনে হল আমি তো ঠিক ‘রক্তকরবী’র রঞ্জন নই, আর আমার জীবনে কোনও নন্দিনীও এখনও আসেনি, ফলে যদি রাজার বাতায়ন-এর যবনিকা উঠে গেলে, যদি দেখি রাজার পেছনে পড়ে আছে আমারই মতো দেখতে সারি সারি স্বপ্নের মৃতদেহ!
নন্দিনীরা বাঁচে, রঞ্জনরা মরে।
সর্দাররা মরে, রাজা বাঁচে,
ফাগুলাল বাঁচে, বিশুপাগুলরা মরে।
এই বিরাট হেঁয়ালি যে মুহূর্তে আমার সামনে তার অগ্নিবর্ণ রূপ নিয়ে প্রতিভাত হল, আমার গলা চিরে একটা আর্তকণ্ঠ বেরিয়ে এল। একেই বোধহয় বলে আন্তেনিন আর্তোসুলভ আর্তমিশ্রিত আর্তনাদ।
আমি হুড়মুড় করে নেমে এলাম।
আমি নামতেই থাকলাম।
আমি নামতেই থাকলাম।
আমার সেই নামতে থাকা এখনও চলছে।
কারণ রাজা রাজাই থাকে।
ঘাতক থাকে ঘাতক।
আর পলাতক থাকে পলাতক।

‘তাঁহাদের কথা’র ‘শম্ভুবাবু’, ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা’

তবে কি কবি কলা ও কাব্যের দর্পনে নিজেরে ‘পলাতক’ প্রতিপন্ন করলেন? কিন্তু আমরা তাঁকে পালিয়ে যেতে দেখছি না। না তো থিয়েটারে, না তো সাহিত্যে, কাব্যে, না তো রাজনৈতিক অবস্থানে। রাজনৈতিক অবস্থান বলতেই তাঁর সংসদীয় রাজনৈতিক জীবনের কথা এসে পড়ে নিশ্চয়ই, অবশ্যই তা তাঁর শিল্প ও মতাদর্শীয় রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গেও সম্পর্কিত। কিন্তু অস্তিত্বের সামগ্রিক রাজনীতিতে আমরা তাঁকে যেভাবে থিয়েটারে সদা-দ্বন্দ্বময় ভূমিকায় দেখি, কবিতার নাটকীয়তাতেও আমরা লক্ষ্য করলাম সেই রাজনৈতিক বাহাসকে ‘টিকরমবাজি’র ভঙ্গিতে হাজির করলেন ‘তাঁহাদের কথা’ অংশের ‘উৎপল ও ইন্দীবর’ কবিতায়। বাংলা থিয়েটারের কালপুরুষ তথা কালচারাল অ্যাক্টিভিস্ট তথা র‍্যাডিক্যাল কমিউনিস্ট উৎপল দত্তকে পোয়েটিক ফিকশনের অন্দর থেকে প্রশ্ন করলেন–

স্যার, আমি বাংলা থিয়েটারে মার্কসের জন্মের আগে মার্কসবাদের প্রভাব নিয়ে জানতে চাইছিলাম। মানে ধরুন, চৈতন্যের লীলায় বা কানাহরিদত্তের কথকতায় বা শ্রীকর নন্দীর পারবফরম্যান্সে। এসবের মধ্যে মার্কস সাহেবের কিছু প্রভাব আছে কি?

‘তাঁহাদের কথা’ অংশের ‘উৎপল ও ইন্দীবর’ কবিতা। ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা’, ব্রাত্য বসু

এই প্রশ্নের উত্তরে, পোয়েটিক ফিকশন থেকে থিয়েটারের সিংহপুরুষ উৎপল দত্ত সবার আগে ‘স, শ, ষ-এর উচ্চারণ’ শিখতে বলছেন। তারপর নির্জন এক দুপুরে নিজের ড্রইং রুমে কবিকে বসিয়ে রেখে থিয়েটার ও রাজনীতি বিষয়ক টানা ৪৫ মিনিটের জ্ঞানগর্ভ ক্লাস নিচ্ছেন কমরেড উৎপল দত্ত। কিন্তু একইসঙ্গে ‘টিকরমবাজি’র প্রশ্নটি আর ‘স, শ, ষ-এর উচ্চারণ’ শেখার বিষয়গুলো থেকে যাচ্ছে।

রাজনৈতিকভাবে এই অংশটি খুবই ইন্টারেস্টিং। আমরা স্মরণ করতে পারি, ‘মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান’ স্লোগান দেওয়ালে লিখে এবং মহামতী মার্কসের নামাবলী পরা সিপিএম সবচেয়ে বেশি করে অ্যান্টি মার্ক্সিস্ট পজিশন নিয়ে কীভাবে গণবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। যারা তাদের ক্যাডারদের শিখিয়ে ছিল, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অর্থই হল সিপিএম! এবং মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান অর্থাৎ সিপিএম সর্বশক্তিমান। আর এই সিপিএমকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় নকশালবাড়ি বিদ্রোহ পার হয়ে আসা সময়ে যে কজন তরুণ র‍্যাডিক্যাল লেফট পজিশন থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, তাঁদের মধ্যে ব্রাত্য বসুর নাম বলাটা মোটেও বাড়াবাড়ি কিছু নয়। যাঁর ছাত্রজীবন কেটেছে ডিএসসি নামক একটি র‍্যাডিক্যাল লেফট ছাত্র সংগঠনের অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে। আর উৎপল দত্তও হলেন তিনি, যিনি নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রারম্ভে সামনের সারিতেই ছিলেন। যিনি সংশোধনবাদী কিংবা সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের বৃত্তে বা ভুয়া মার্কসবাদীদের গোষ্ঠে নিজেকে জড়াতে চান নাই। তো চিন্তা-চেতনে বাংলা থিয়েটারের কালপুরুষ উৎপল দত্তের উত্তরসূরী হিসাবে ব্রাত্য সাহেবের নাম চলেই আসে। এবং তিনিও নিজেকেই সেই সিংহপুরুষের উত্তরসূরী হিসেবেই দেখার আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছেন। তাই তিনি চিন্তার গতিময়তাকে বজায় রেখে প্রশ্নই করতে চান, কখনই ডগমার স্থিতাবস্থায় মার্কসসাহেব বা তাঁর চিন্তাকাঠামোকে ফেলতে চান না। অতএব তিনি স্মরণ করিয়ে দিতে চান, ইওরোপের বহু আগেই বড় বাংলা-সহ ভারতীয় উপমহাদেশে দর্শন জগত থেকে নন্দনতত্ত্বে এমন বড় বড় কিছু ঘটেছে, যার সামগ্রিক নির্যাস আমরা মার্ক্সীয় চিন্তাপরিকাঠামোর মধ্যে পরে লক্ষ্য করি। কারণ মার্কস ইওরোপের ইতিহাসের বিবর্তনকে নমুনা করে তাঁর দূরদৃষ্টি দিয়ে বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করেছেন। হেগেলে উত্তরসূরী হিসেবে তাঁর দার্শনিক অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। মার্ক্সীয় বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বকে থিয়েটারের নন্দনতত্ত্বে প্রয়োগ করে বের্টল্ট ব্রেখট যে বিপ্লবসাধন করেছিলেন, সত্যি কথা বলতে বাংলা থিয়েটারের আদি তো সেই পথ ও অঙ্গনের পরম্পরা ধরে এগিয়ে তারপর ইওরোপীয় প্রসেনিয়ামে ক্ষণিক স্থিত হয়েছে, আবার বাদল সরকারদের হাত ধরে ফের অঙ্গনে মিশেছে বাংলা থিয়েটারের একটা ধারা। এই সামগ্রিক জায়গা থেকে ব্রাত্য বসু তাঁর কবিতার পোয়েটিক ফিকশন থেকে স্থা-বিরোধী কমরেড উৎপল দত্তকে প্রশ্নটি করলেন। এবং আন্দাজ করলেন হয়তো উৎপল সত্যিই তাঁকে অমনই বলতেন যে এসব কড়া-কড়া, কঠিন কথা না বলে আগে স, শ, ষ-এর ফারাকটা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করতে শেখা দরকার। অর্থাৎ আগে নিজেরে জানো, নিজেরে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখো, তারপর পরেরটা। যদিও তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এই নিজের ভাষা, নিজের উচ্চারণ, নিজের স্বর-ব্যঞ্জন ইত্যাদি না বুঝেই, নিজের ভাণ্ডকে না চিনেই আমরা ব্রহ্মাণ্ডকে বুঝতে চেয়েছি। তাই বাংলা থিয়েটারের পারম্পরিক ঐতিহ্যকে যেভাবে মার্কসের চিন্তার ফলিত ক্ষেত্রে বের্টল্ট ব্রেখটের মধ্যে প্রকাশ পাওয়ার জায়গাটা এক ফাঁকে মস্করার ভঙ্গিতে তুলে এনে নিজের পারিপ্বার্শের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গটা ব্রাত্য বসু কবিতার পোয়েটিক ফিকশনে হাজির করলেন। এবং সেটির গোড়ার কথা মনে করিয়ে দিলেন তাঁর উত্তরসূরী উৎপল, যে আগে বেসিক উচ্চারণটাই শিখতে হবে আমাদের। অন্য দিকে আত্মবিশ্বাসী কবিকেও বলতে শোনা গেল, ‘শুধু আমি আর উনি। আর কেউ ছিল না।’

পাশাপাশি শিল্পীর পলিটিক্যাল স্ট্রাগেল তথা ব্যক্তির যাপিত জীবনের দৈনন্দিন রাজনীতির আঙিনায় ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে ‘অজিতেশ কবিতায় ব্রাত্য বসু মহাশয় লিখে ফেলেন-

…৫০-এ মরে যেতে আমি রাজি নই। শিশুর সামনে শিশুমন দেখাব। দালালের সামনে মুৎসুদ্দি। ধূর্ত-র সামনে চতুর। সরলের সামনে অকপট। হিংস্রর সামনে বাঘনখ। অসহায়ের সামনে সকাতর। আমি বস্তুত একটি আয়না হতে চাই…

‘তাঁহাদের কথা’ অংশের ‘অজিতেশ’। ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা’, ব্রাত্য বসু।

কবি আয়না হতে চাওয়া আকাঙ্খার মধ্যেই বারবার নিজেকেও পরখ করে নেন দর্পনে। তিনি তাঁর কানের ভিতরে ঠিক শুনতে পান কিঁচকিঁচ শব্দ। তিনি জানেন তিনি কে! তিনি জানেন তাঁর এবং তাঁর মাটির ইতিহাস, মাটির চরিত্র। তাই ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা’ বইটির প্রথমাংশের শেষ কবিতার একবারে শেষে গিয়ে তিনি বলেন-

আমি সেই ব্রাত্যজন। সাপের বিষ আর ইঁদুরের ধবল দাঁত উপড়ে আসছি গাঙুড়ের তীর থেকে। আবহমান কাল ধরে কোঁচ ছুঁড়ে বাণমাছ ধরি আমি। পুড়িয়ে খাই। আমার পূর্বপুরষ সেই সহজযানী দর্শনের ব্রহ্মসাধক ছিলেন। গৌড় থেকে ব্যাধের হাত থেকে বাঁচতে চলে এসেছিলেন সমতট। মার্গ সাধনা করেছিলেন হরিকেলে বসে।। শেক-শুভোদয়া পড়ে আরাকান পর্বতে বারেন্দ্র পরিচয় ত্যাগ করে হরিণ শিকার করতেন আমার আরেক পূর্বপুরুষ। আমিও মূষিক শিকার করেছি বহুবার। সূর্যাস্তের লাল আভার মধ্যে। অন্ধ হয়ে গেলেও আমার থাকবে সেই ‘থ্রি নট থ্রি’– সেই নিশ্চিন্ত টিপ– আমি আমার কানের ভেতর ঠিক শুনতে পাচ্ছি ঘূর্ণায়মান,
কিঁচ কিঁচ কিঁচ কিঁচ কিঁচ।
কিঁচ কিঁচ কিঁচ কিঁচ কিঁচ।

শেষ এপিটাফ, ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা’।

নির্ধারিত বিরতির পর

এই কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয়াংশের শিরোনাম ‘ফিরে আসছি নির্ধারিত বিরতির পর’। প্রথমাংশ গল্পকবিতা, পোয়েটিক ফিকশন পরিপূর্ণ কবিতা হলেও দ্বিতীয়াংশে প্রতি কবিতা ও শুদ্ধ কবিতার উভয় স্বর লক্ষ্য করা যায়। এই অংশে ইশারা ও আবছায়ার কারুকাজের মধ্যেই বিষণ্ণতা ও প্রেম হাজির থেকেছে। থিয়েটার এই অংশের কাব্যের মেটান্যারেটিভের আধার, তবু তারই ফাঁকে উঁকি মারে ব্যক্তির অস্তিত্ব। কবির অন্দরজগত। মোট কথা এই অংশের কবিতাসমূহে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। লক্ষ্য করা যায় বেপরোয়া হয়ে ওঠার আকাঙ্খা, ভুলের রিপিটেশনের ভেতর ভিজে যাওয়ার আকাঙ্খা।

একদিন আমার কাছে এসো
আকর্ষণ তৈরি হোক আবার বুনো ক্যাকটাসের মতো
তোমার আমার মাঝে আবার সেই বর্ষাঋতু আসুক
ভিজে যাই দু’জনে একত্রে নারকেলডাঙায়
শরীরে আবার সেই ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব আসুক
আমার জামার বোতাম ছিঁড়ে গড়িয়ে পড়ুক
মাথা মোছার আগেই।
কথা দিচ্ছি তার বদলে ওইসব ভুল
আমি বারবার একইরকভাবে করে যাব।
আজীবন।

‘অসময়’। ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা’

এই অংশের অনেক কবিতাতেই আছে প্রকট ও প্রচ্ছন্ন হিউমার। সামাজিক আর অসামাজিকতার দোলাচলের গার্হস্থ্যযাপন। তার মায়া, তার সন্ধ্যাপ্রদীপ। যেমন একদিকে তিনি লেখেন–

দু’হাতে জড়িয়ে গলা, কাছে রাখা ঠোঁট।
কুঞ্জবনে মন, এবার বাড়ির দিকে ছোট।।

ধর্ম-অধর্মের দোলা দিল সেই সঞ্চালন।
একবার জড়ালে জানি ভবিষ্যৎ ঘোর উচাটন।।

মধ্যবয়সে এই গূঢ়তত্ত্ব নত্বষত্ব জ্ঞান।
সমস্ত সামাজিকতা কেন খানখান।।

অতঃপর ফিরে আসা হয়ে উলোঝুলো।
কমবয়সী নগ্নরায় মাখামাখি ধুলো।।

কোন সে কাঙাল আছে শূন্য হাতে রয়।
দিনে কি রেতেরবেলা পেলে বউয়ের ভয়।।

‘ভয়’। থিয়েটার বিষয়ক কবিতা।

আবার তিনিই ‘পুঁতির মালা’ কবিতায় পৌলমীকে (স্ত্রী) লেখেন-

অভ্যাসে সত্য মরে জেগে থাকে তবু
বিকেলে পড়ন্ত রোদে মুখখানি ভাসে।
ঝগড়া করেছি কত প্রেম দ্রবীভূত
তোমাকে হারাব ভাবলে শিরা কাঁপে আজও।।

ওই একই কবিতায় তিনি আরও বলছেন-

সারল্য এখনও বাঁচে প্রশ্রয়বশত
কারা যেন অকারণ প্রতারক ক্ষয়।
প্রবৃত্তি একগামী হবে না কখনও
এ যেন দু’জনের ক্ষেত্রে নির্বিশেষ হয়।।

স্বীকারোক্তি, হারানোর ভয় আর মায়ার এহেন প্রকাশে রাজনৈতিক বাদ-প্রতিবাদের দ্বন্দ্বময় এক শিল্পীর কোমল এক অন্তর্জগতই শুধু উন্মুক্ত হয় না, বরং ‘দু’জনের ক্ষেত্রে নির্বিশেষ’ ধরনের চাওয়ার মধ্যে মাচো-পৌরুষের বদলে বাঙালি পুরুষের স্ত্রীবান্ধব বা নারীর অধীনস্থ থাকার ভঙ্গিই প্রকট হয়।

এই কবিতার বইয়ের দ্বিতীয় অংশটির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ‘কাবাব’ সিরিজটি। কবিতা সিরিজ যদিও বইয়ের দ্বিতীয়াংশে পরপর স্থান পায়নি। বরং মাঝে মধ্যে তা ওই সিরিজের কবিতাগুলি প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে তিনি লিখছেন-

কসাইরা তাকিয়ে আছে, দেখছে তোমাকে আমাকে
ভাবছে কবে কেটে নেবে
প্রাচীরের গায়ে লেপটে থাকা বটগাছ
তার শিকড় আর মগডাল।
ভাবছে, কবে যে এর শুরু হবে মিডিয়া ট্রায়াল।

‘কাবাব ৩’, ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা’

কাবাব, পোড়া মাংসের স্বাদ। মশলার ব্যঞ্জনা। আবার এই কাবার তো কায়স্থ-বাহ্মণ-বৈদ্য মিলিয়ে ভদ্রবিত্ত বাবু সমাজও। এঁরাই জ্ঞান ও চারুজীবী হওয়ার ভান করে। আর তার দ্বারা কখনও রাজনৈতিক ‘পরিবর্তন’ প্রক্রিয়াতেও অংশ নেন। আবার পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে নিজেকে পরিপুষ্ট করেও নিতে চায়, হয়ে ওঠে গেরুয়া ফ্যাসিস্টের হাতের পুতুল। এদের রঙ্গব্যাঙ্গ আর খেউড়ে জমে নিউজ চ্যানেলে ওঠে সান্ধ্য টক-শো। ব্রাত্য বসু লিখছেন-

হোর্ডিং বিখ্যাত হয় বিস্তৃত বদন
সারি সারি প্রতারক ছলনা ও দ্বেষ।
ভান করা রুদালিরা বিশিষ্টজন
নির্বোধের মাংস খাওয়া পশু ছদ্মবেশ

জন্ম থেকে জরায়ুতে চুঁইয়ে পড়া কাম
পিচগলা রাস্তায় শিল্পযোনি বাড়ে
পরম্পরে উদ্যত ভোজালির ঘাম
উড়ন্ত মধ্যমেধা আস্তাকুঁড়ে সব ভাই ভাই
এরা বলত একদিন পরবর্তন চাই।

‘বিরোধীদের চোখে’, ‘থিয়েটার বিষয়ক কবিতা’

বইয়ের প্রথম অংশে থিয়েটার, থিয়েটারের কালপুরুষদের স্মরণ, মেক-আপ, প্রম্পটার, মঞ্চ ইত্যাদির পর বিরতি শেষে দ্বিতীয়ার্ধে জীবন, জীবনের রাজনীতি, তার রণ-রক্ত বাস্তবতা এবং তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা প্রেম, কাম, স্বপ্ন, আকাঙ্খা ও স্বপ্নভঙ্গ হওয়া, বিষণ্ণতা, মায়া, সংসার- এসব মিলেমিশে গিয়েছে। যেমন নাটকে-পালায় যেমন এসব কিছুই ঘুরে ফিরে আসে। তবে থিয়েটার বিষয়ক কবিতা বলেই হয়তো ড্রামা ও তার উত্থান-পতনের ব্যাঞ্জনা ছড়িয়ে রয়েছে কবিতায়। যেকোনো শিল্পের সর্বোত্তম মাধ্যম যদি হয় কবিতা, সেক্ষেত্রে যেকোনো শিল্পমাধ্যমকে পোয়েটিক করে তোলাও বড় চ্যালেঞ্জ। ব্রাত্য বসু যা তাঁর নাটকে হরদম করছেন। কিন্তু থিয়েটারকে কেন্দ্র করে একটা গোটা কবিতার বই লিখে ফেলা (যেখানে মঞ্চ থেকে জীবনমঞ্চের সকল উপাদানই কম-বেশি কাব্যিক গুণ নিয়েই হাজির) কম কথা নয়। আর যেহেতু কবিতা, তাই বারবার নিজের অস্তিত্বের আলো-আধাঁরির সঙ্গে নিয়ত দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হওয়ার, নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মোক্ষম সুযোগ পেয়েছেন এবং যথাযথভাবে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। ‘কে তুমি তন্দ্রাহরণী’ কবিতায় তিনি লিখছেন-

কে যেন এসে বেঁচে গেল আমার ভেতরে
তার সঙ্গ-নিঃসঙ্গতাকে সত্য-মিথ্যার মতোই
আজও চিনিনি…

জংশনে বুরবাক দাঁড়িয়ে ট্রেন মিস করা আমি
বসে বসে শুধু নিবিষ্ট জলছবি এঁকেছি।
লোকটা যে এতবার চেনাতে চাইল কর্ণপাতও করিনি।

কিন্তু অবশেষে তিনি তাঁকে চিনছেন। চিনতে পারছেন কবিতায়

আজকাল তাকে একটু একট চেনা লাগে
ওই বুঝি সে মুচকি হাসছে ঘোমটা খুলে আরও স্পষ্ট হয়ে।
কে যেন এসে বেঁচে গেল আমার ভেতরে।
তার কারুকার্য আমি আজও চিনি না।

হ্যাঁ ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে ঘোমটা উন্মুক্ত হওয়া অবয়ব, আর তার যাত্রাপথ। সে পথেই হয়তো কবি ব্রাত্য বসুর পদচারণা অব্যাহত থাকবে।

আমি একটু বাদে আসছি।
তোমরা এগিয়ে যাও।
ধল্ভূমগড়ের রানওয়ের জঙ্গলে যাও আগে।
গিয়ে দেখ কারা ঘুরে বেড়াচ্ছে আজও
এই সম্ভাবনামাখা উজ্জীবিত সকালে?
দূর থেকে কোন ছেলেমানুষি প্রতারিত চোখ
পরিত্যক্ত রানওয়্যে থেকে কাল্পনিক বিমানের
উড়ে যাওয়া দেখে
বাহ্যত হতভম্ব হয়ে গোপনে মুগ্ধ হতে থাকে।

সেই মাঠ, সেই রানওয়ে, সেই নিষিক্ত অভিমান
গমরঙা সবেদাফলে আজো টলমলে হয়ে আছে।

‘ধলভূমগড়ের রানওয়ে’, ‘থিয়েটার বিষয় কবিতা।

এই প্রত্যাবর্তন কিংবা এই শুভ সূচনার সম্ভাবনা কবিতায় ভাসিয়ে দিয়েছেন কবি। থিয়েটার থেকে কবিতায়। কবিতা থেকে অস্তিত্বের পোয়েটিক অন্বেষণে।

থিয়েটার বিষয়ক কবিতা
সিগনেট প্রেস, কলকাতা, ২০২২


Share