।। ইমরান আল হাদী ।।
পাখিওয়ালা তার পাখিরে খাঁচা থেকে তার ছোট লাঠি দিয়া বের করে আর ছাইড়া দেয় সারি করা খামের পাশে। পাখি একটা খাম বের করলে পাখিওয়ালা খাম খেকে কাগজ বের করে পাখির সামনে ধরে যেন পাখিরে দিয়া কাগজ পড়াবে। রুহি দ্যাখে, লাল কালিতে কাগজে কী যেন ল্যাখা। ল্যাখাটা পরিষ্কার আর সুন্দর আর অবশ্যই হাতে ল্যাখা। তবে রুহি বুঝতে পারেনা এইটা কোন ভাষা। কিছুক্ষণ বাদে পাখিওয়ালা রুহিরে কয়, আপনে একলা মানুষ পৃথিবীর সীমিত কিছু মানুষ একলা হইতে পারে, আপনের একলা জীবনের প্রতি আমার লোভ হয়। কিছুদিন বাদে আপনে আরও একলা হইয়া যাবেন। রুহি পাখিওয়ালার কথার কোনও আগামাথা খুঁইজা পায়না। সে ভাবে, এইটা আবার কেমন ভাগ্য গণনা যদিও তার এতে বিশ্বাস নাই। রুহি বিশ টাকার একটা নোট পাখিওয়ালার সামনে রাইখা আর কোনও কথা না বাড়াইয়া তার পথে হাঁটতে থাকে।
শহরে পাখি হাতে একজন
যতটা সরু হইলে দুই জন মানুষ পাশাপাশি হাঁটতে পারে গলিটা তার চেয়েও কম প্রস্থ। রুহি ভাবে, মানুষ ক্যামনে হাঁটে এই সরু গলি দিয়া। যদিও সে এই গলি দিয়া হাঁটে বহুদিন। তাতেও সে অভ্যস্ত হইতে পারে নাই। যদিও রুহি কদাচিৎ তার রুম থেকে বাহির হয় এমন কী জরুরি কাজ হইলেও আইলসামি করে সে। দিনের বেলা সে সাধারনত বাহির হয় না। তবে সে রোজ রাত এগারোটার দিকে বাহির হইয়া গলির মুখে মতিনের চায়ের দোকানে চা খায়। এ নিয়মের কোনও ব্যত্যয় হয় না। তবে মাঝে মাঝে মতিন দোকান খোলে না, তাতে রুহি বিরক্ত হইয়া ‘হারামি’ বইলা গালি দেয়। গালি দিলে তার মনে হয় য্যানো নিজেরেই সে গালি দিল বা ‘বড় হারামি’টা সে নিজেই।
রুহি গলিটার শেষ মাথার বাড়িতে থাকে। সে ঐ বাড়ির কেয়ারটেকার। আজ সে দিনের বেলায় বাহির হইছে জরুরি কাজে। জরুরি কাজ বলতে পানি,বিদ্যুৎ বিল জমা দিতে হবে। তার কেয়ারটেকারের কাজ ভালোই লাগে শুধু বিল দিতে বিভিন্ন অফিসে গেলে তার খুব অসহায় লাগে। রুহি আধা অন্ধকার গলি দিয়া বের হইলে গ্রীষ্মের রোদ তার মুখে পড়লে চোখ কুঁচকে যায়। একটু স্বাভাবিক হইয়া হাঁটতে থাকে। রুহি সাধারণত হাঁইটা হাঁইটা বিভিন্ন অফিসে যায়। হাঁটতে কষ্ট হইলেও বাস রিকশা পাল্টাপাল্টিতে তার ঝামেলা মনে হয়। তাই সে হাঁটতে থাকে।
হাঁটতে হাঁটতে রুহি পেরিয়ে যায় বিভিন্ন জনমানুষ ভবন আর ডান দিকের ব্যস্ত রাস্তা। রুহি বেখেয়ালে আরও কত কী রাইখা যায়। এই বেখেয়ালে সে পেরিয়ে যায় ভাগ্য গোণে এমন এক শালিক পাখি আর তার মালিকরে। রুহি কিছু দূর গিয়া দাঁড়ায়, সে ব্যাপারটা দেখতে আবার ফিরে আসে। ভাগ্যগণনা করে যারা, তারা টিঁয়াপাখি দিয়া ভাগ্য গণে। শালিক পাখিদিয়া এই কাজ করতে কখনও দ্যাখে নাই রুহি।
সে গিয়ে দাঁড়ায় পাখির সামনে। পাখিটা শালিক পাখির মতই তবে সাইজে একটু বড়। রুহি শালিক পাখিরে দেখতে থাকলে তার মালিক রুহিরে জিগায়, ভাই ভাগ্য গুনবেন নাকি ? তাতে রুহি দ্বিধায় পইড়া যায় আর বলে, না ভাগ্য গোণাব না, আপনার পাখিরে দেখি সে সুন্দর আছে। এইটা শালিক পাখি না? রুহি পাখিওয়ালারে জিজ্ঞাসা করলে সে কয়, পাখি তো পাখিই তার আবার নাম কী! মানুষে কত জিনিসরে কত নামে ডাকে। আপনে আমার পাখিরি যে কোন নামে ডাকতে পারেন। শালিক ময়না অথবা শুধুই পাখি।রুহি ভাবে সে কি ভুল বললো এটা কি শালিক না ময়না?
রুহি তার ভুল ঢাকবার জন্য কয়, না মানে আপনার পাখি সুন্দর আছে। রুহির একটা শখ ছিল পাখি অথবা বিড়াল পালনের। রুহি পাখিওয়ালারে কয়, আপনে কী পাখি বেচেন? এই পাখির মত সুন্দর একটা পাখি হইলে আমি কিনতে চাই। এই অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে পাখিওয়ালা আশ্চর্য হয় নাকি চমকাইয়া যায় তা রুহি ঠাওর করতে পারে না। পাখি ওয়ালা নীচু স্বরে কয়, পাখিরে আপনার পছন্দ হইলে ভালোলাগলে নিতে পারেন। চাইলে এই পাখিরেই আপনে নিতে পারেন।
রুহির কথায় পাখিওয়ালা এত সহজে রাজি হইবে তা রুহি ভাবতে পারে নাই। রুহি পাখিওয়ালা লোকটারে খোয়াল কইরা দ্যাখতে থাকে। লোকটারে তার সাধারণ লোকের মতোই লাগে শুধু কথা একটু আস্তে ধীরে বলে। আর নজর পড়ে পাখিওয়ালার কালো চশমার দিকে। লোকটা একটা কালো চশমা পইরা আছে। রুহির মনে হইলো সে তার দিকে না তাকাইয়া পাখির দিকে তাকাইয়া কথা বলতেছে। তাতে রুহির মনে হইলো, সে হয়ত তারে পছন্দ করতেছে না তাই অন্যদিকে চাইয়া কথা বলতেছে। রুহি পাখিওয়ালারে জিগায়, পাখি বেচবেন ক্যান। তাতে পাখিওয়ালা কয়, বেচবো না আপনেরে এমনি দিবো। পাখিরে আপনার ভালোলাগছে তাই আপনারে দিতে চাই, যদি আপনে নিতে চান। রুহি তারে জিগায়, তাইলে আপনার চলবে ক্যামনে? তাতে পাখিওয়ালা কয়, আমার অন্য পাখি আছে।
রুহি দ্বিধায় পইড়া যায়। সে ভাবে, মাগনা একটা পাখি পাইলে খারাপ কিছু না। একলা মানুষ সময় ভালো কাটবে। তবে তার হঠাৎ সন্দেহ হয়, পাখিওয়ালার কোন মতলব আছে নাকি। রুহি পাখিওয়ালারে জিগায় আপনের পাখির কী কোনও সমস্যা আছে? হঠাৎ আমারে দিতে চাইছেন। তাতে সে কয় সমস্যা কিছু না সে ভালোই আছে। আপনার ভালোলাগছে তাই দিতে চাইছি আমার আরও পাখি আছে। নিলে নিবেন না নিলে না আমি তো আপনারে সাইধা দিতে চাই নাই। আমি আরো দুই এক জনরে পাখি দিছি। যারা পাখি পছন্দ করে তাদের পাখি দেওয়া তো কোন দোষের না। এই কথায় রুহির সন্দেহ কাইটা গেলে সে কয়, তাইলে আমারে আপনার পাখি দেন। তাতে পাখিওয়ালা কয়, এখন দেওয়া যাবেনা। রুহি কয়, কখন দিবেন? তাতে পাখিওয়ালা কয়, আমার লগে আপনারে আমার বাসায় যাওন লাগবে। রুহির সন্দেহ হয়, আবার হয়ও না। রুহি কয়, আপনের লগে আমি এখন যাইতে পারবো না। পরে আপনের লগে দ্যাখা করব। পাখিওয়ালা কয়, সমস্যা নাই আমি এইখানে সপ্তাহে দুই দিন বসি সোমবার আর বুধবার। পড়ে মনে চাইলে আইসেন, পাখি পাইবেন তয় আপনারে আমার লগে যাইতে হবে। আমি বুজছি আপনে ডরাইছেন। ডরাইয়েন না পাখি নিতে আপনার সুবিধা মতন সময়ে আইসেন। তয় একলা আসবেন ডরাইয়েন না বুঝেন তো কিম্মাতি পাখি হাত বদলের একটা নিয়ম আছো। এখন চাইলে ভাগ্যখান গুণতে পারেন আমার কুড়িটা টাকা রোজগার হয় সকাল হইতে রুজি রোজগার হয় নাই। রুহি পাখিওয়ালার এই কথায় রাজি হয়। পাখিওয়ালা তার পাখিরে খাঁচা থেকে তার ছোট লাঠি দিয়া বের করে আর ছাইড়া দেয় সারি করা খামের পাশে। পাখি একটা খাম বের করলে পাখিওয়ালা খাম খেকে কাগজ বের করে পাখির সামনে ধরে যেন পাখিরে দিয়া কাগজ পড়াবে। রুহি দ্যাখে, লাল কালিতে কাগজে কী যেন ল্যাখা। ল্যাখাটা পরিষ্কার আর সুন্দর আর অবশ্যই হাতে ল্যাখা। তবে রুহি বুঝতে পারেনা এইটা কোন ভাষা। কিছুক্ষণ বাদে পাখিওয়ালা রুহিরে কয়, আপনে একলা মানুষ পৃথিবীর সীমিত কিছু মানুষ একলা হইতে পারে, আপনের একলা জীবনের প্রতি আমার লোভ হয়। কিছুদিন বাদে আপনে আরও একলা হইয়া যাবেন। রুহি পাখিওয়ালার কথার কোনও আগামাথা খুঁইজা পায়না। সে ভাবে, এইটা আবার কেমন ভাগ্য গণনা যদিও তার এতে বিশ্বাস নাই। রুহি বিশ টাকার একটা নোট পাখিওয়ালার সামনে রাইখা আর কোনও কথা না বাড়াইয়া তার পথে হাঁটতে থাকে।
রুহি পাখিওয়ালার কথা প্রায় ভুইলা গেছিল। যদিনা সে এই ভয়টা না পাইতো। রুহি ভয় পায় মতিনের দোকানে চা খাইয়া ফেরার পথে। সরু গলি দিয়া হাঁটার সময় রুহি শুনতে পায়, তার মাথার উপরে কিছু একটা উড়ার শব্দ। রুহি উপর দিকে তাকাইলে অন্ধকারে বুঝতে পারে কোনও একটা পাখি তার মাথার উপরে উড়ছে। এর পর থেকে প্রায়ই পাখি উড়ার শব্দটা পায় বা তার মনে হয় কাছে কোথাও একটা পাখি উড়ছে। সে তার ঘরে থাকলেও মনে হয় একটা পাখি উড়াউড়ি করছে। তবে সরাসরি কোনও পাখি দ্যাখেনা সে। আর তাতে সে কেবল ভয়ই পায়।
রুহির পাখি উড়ার বিষয়টা তীব্র হইলে তার মনে হয় ভাগ্য গনা পাখিওয়ালার কোনও হাত থাকতে পারে। পাখিওয়ালা তারে হয়ত কোন তুকতাক করছে। হয়ত এইটা তার ধান্দার অংশ। আবার চিন্তা করে, পাখিটারে তার মনে হয় বেশি পছন্দ হইছে। তাই মন থেকে সরাতে পারছে না। রুহি পরের বুধবার পাখিওয়ালার খোঁজে বাহির হয়। তারে ঠিক আগের জায়গায় পায়। পাখিওয়ালারে রুহি নরম ভাবে কইতে থাকে, মিয়া ভাই আমি নিজেই নিজের ফান্দে পড়ছি। আপনে এর থিকা আমারে মুক্তি দেন পয়সাপাতি যা লাগে দিমু তয় আমারে মুক্তি দেন। রুহির কথা শুইনা পাখিওয়ালা কয় আমারে খুইলা কন কি বিষয়। তাতে রুহি তার বৃত্তান্ত সব কইলে পাখিওয়ালা কয়, আপনে আমার পাখি পছন্দ করছেন তাই হয়ত সে আপনেরে দ্যাখা দেয়। আপনের খোয়াবের মধ্যে সে ঢুইকা পরে। তারে আপনে নিয়া নেন। তাতে রুহি কয় আমি কোন খোয়াব দেখি নাই বাস্তবে পাখির উড়া টের পাইছি। পাখিওয়ালা কয় সে যাই হউক আপনার তারে ভালোলাগছে আপনে তারে লন। বুঝেন তো কিম্মাতি পাখি। চলেন আমার লগে পাখি আপনারে দিব।
রুহি পাখিওয়ালার পিছনে হাঁটতে থাকে। পাখিওয়ালার এক হাতে পাখির খাঁচা অন্য হাতে ছোট লাঠি। পাখিওয়ালা হাতের খাঁচাটা সামনে একটু আগাইয়া ধরে হাঁটতে থাকে যেমন কইরা আন্ধার রাইতে মানুষে লাইট ধরে পথের মধ্যে। রুহি খেয়াল করে পাখিওয়ালা একটু নিচু হইয়া ঝুঁইকা হাঁটে আবার কখনও খাঁচাটা উপর নীচু ডাইন বাম করে য্যান সে তার পথ খাঁচারে দিয়া দেইখা লইতেছে বা পাখিই তারে পথ দ্যাখাইয়া নিয়া যাইতেছে। রুহির মনে হয়, লোকটা হয়তো চোখেই দ্যাখেনা! আন্ধা।
পাখিওয়ালা একটা ঘনবসতি আর গরিব লোকেরা থাকে এমন জায়গায় পৌঁছায় রুহি। কিছুক্ষণ হাঁটনের পর দিক গুলাইয়া ফ্যালে কোন পথে আইছে তা হারাইয়া ফ্যালে। সে এক মানুষের কোলাহলপূর্ণ গোলকধাঁধাঁর মধ্যে গিয়া পড়ে। যার চতুর দিকে কেবল ছোট খুপরি ঘর। যেগুলি শিশু, মহিলা আর পুরুষে ঠাসা। পাখিওয়ালা হাঁটতে থাকলে রুহি তারে জিগায়, আপনের বাসা আর কত দূর? আমি তো পথ হারাইয়া ফ্যালছি। পাখিওয়ালা কয় ,আর একটু হাঁটেন। আপনেরে বের করার দায়িত্ব আমার, চিন্তা নিয়েন না।
তারা একটা কানাগলির শেষ মাথায় গিয়া দাঁড়ায়। রুহির মনে হয়, সে য্যানো পৃথিবীর শেষ মাথায় দাঁড়াইয়া আছে। য্যানো এরপরে আর কিছু নাই। পাখিওয়ালা একটা দরজার সামনে গিয়া দরজাটা খুইলা ফ্যালে রুহি দেখতে পায়, দরজাটা ভেজানো ছিল। তারা ঘরের ভিতরে ঢুকলে রুহি দেখতে পায় একটা চৌকি একটা টেবিল আর একটা চেয়ার। টেবিলের উপর অনেকগুলা বয়াম তাতে কী সব ভরা। রুহি খেয়াল কইরা দ্যাখে, বয়াম গুলায় বিভিন্ন ধরনের ডাল চাল গম সহ নানান শস্য বীজে ভর্তি। রুহি ভাবে, হয়ত পাখির খাওন। লোকটা পাখির খাঁচাটা একটা বাঁশের আড়ায় ঝুলাইয়া দ্যায়। বাঁশের আড়ায় আরো কয়টা খালি খাঁচা ঝুলানো আছে তাতে পাখি নাই। রুহি লোকটারে জিজ্ঞাসা করে, খাঁচাগুলা খালি ক্যান আপনার না আরও পাখি আছে? লোকটা কয়, আছে তারা সময় হইলে চইলা আসবে, আপনে বসেন। রুহিরে চেয়ারে বসতে বইলা সে গিয়া বসে চৌকির উপর। লোকটা বলে, আপনের একটু কষ্ট হইবে গরম লাগবে। বিদ্যুতের লাইন নাই বোঝেন তো পাখি নিয়া থাকি। হেগো এগুলার দরকার হয় না। আর জানেন তো পাখি গো রাইতের বেলা আলোর দরকার হয় না। রুহি খেয়াল কইরা দ্যাখে, লোকটা বইসা আছে দুই পা ভাঁজ কইরা। আর সে যে চৌকিতে বইসা আছে সেখানে আসন বা গদির মত কিছু পাতা। গদিটা গোল কইরা বসানো। সেই আসন বা গদির মধ্যে লোকটা পা ভাঁজ কইরা বইসা আছে। তার এই বসার ধরন আর তার গদিরে রুহির চেনা মনে হয় কিন্তু সে মনে করতে পারেনা কীসের সাথে মিল আছে।
রুহি লোকটারে জিজ্ঞাসা করে, আপনার লগে তো আপনার বাসা পর্যন্ত আসলাম কিন্তু আপনার নাম তো জানা হইলো না। আপনের নাম কী? তাতে লোকটা কয়, নাম কিছু তো একটা হইতেই পারে সে বিষয়ে পরে কথা বলা যাইবে। এখন আপনারে পাখির বিষয়ে কিছু বলি। আপনেরে আগেও বলছি, পাখিরা রাইতে বেলা আলো পছন্দ করেনা, রাইতে তারে আন্ধারে রাখবেন। শুধু তারে আপনার খাওন দেওয়া লাগবে। খাওন দিবেন চাল ডাল গম পানি,পাখিরা যা খায়। তবে সে খাঁচায় হাগবে না। দেখছেন তো খাঁচায় দরজা নাই সে তার ইচ্ছা মত বাহির হইতে পারে আবার ফিরে আসবে। আপনে তারে পছন্দ করছেন সে আপনারে ছাইড়া যাবে না। আর একটা বিষয়ে আপনারে বলি, তার চোখের দিকে তাকাবেন না। একটা কালো চশমা পইরা থাকবেন সব সময়। এই কথায় রুহি কিছুটা ভয় পায়। বিষয়টা পাখিওয়ালা বুঝতে পাইরা কয়, ডরাইয়েন না। কিছু পাইলে তো কিছু দিতে হয়। ভাগ্য মানুষরে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ফ্যালে। তারে মাইনা নিতে হয় ডরাইলে চলে না। এখন আপনার জীবন আরও সহজ হইবে। হয়তো আমিও আপনার মতো কেউ। আর আমারে আপনে খুঁজতে আইসেন না। আমি এক জায়গায় বেশি দিন থাকিনা আমারে পাইবেন না। তবে যদি বিশেষ দরকার পড়ে দক্ষিণ দিকে যাইবেন শহরের বাহিরে। খুঁজবেন একাকী কোনও বৃক্ষ যা আপনে অনেক দূর থেকেই দেখবেন। সেখানে কোন সমাধান পাইতে পারেন। কৌতূহলী হইয়া যাবেন না। কোনও উপায় না থাকলে সেখানে যাবেন। সে সমাধান আপনার জন্য কঠিন হইতে পারে।
রুহি পাখি নিয়া বাহির হয়। তারে একটা নতুন পথ দিয়া মেইন রাস্তায় পৌঁছে দেয় লোকটা। য্যানো ভোজবাজির মতো ফুরাইয়া যায় পথ। রুহি কিছু বলেনা তার বাসায় ফেরার দরকার। রুহি মনে মনে ভাবে, কোনও সমস্যায় পড়লো নাকি। কোনও কিছু তো স্বাভাবিক না। কিছু পাইলে কিছু দিতে হয় এই কথার মানে কী? রুহি বুঝতে পারে না তাকে কী দিতে হবে। পথে হাঁটতে হাঁটতে রুহির মনে পড়ে, পাখিওয়ালার চৌকির উপরের আসনটা বড় একটা পাখির বাসার মতো। তার বসার ধরন যেন পাখির মতো যেন বড় পাখি বইসা আছে তার বাসায়। রুহি তার চিন্তা অন্য দিকে সরায় আর ভাবে তার চিন্তায় ভুল আছে।
রুহি সব সময় কালো চশমা পইরা থাকে। পাখি নিয়া আসার প্রথম দিকে সে চশমা পড়তো না। সে পাখির কাছে প্রায়ই বইসা থাকতো। পাখিরে রাখছে রুমের এক পাশে। পাখিরে খাওন পানি দেওয়ার সময় সেখান থেকে কিছু চাল অথবা গম রুহি মুখে দিত। রুহির পাখির খাবার ভালোলাগতে থাকে। রুহি মাঝে মধ্যে খেয়াল কইরা দেখতো পাখি কী করে। তেমন কিছু দেখতো না স্বাভাবিক পাখির মতোই খাঁচার মধ্যে হাঁটতো ঠোঁট দিয়া পালক খুঁটতো। রুহি তারে দেখলে সেও ঘাড় বাঁকাইয়া রুহিরে দেখতো।
রুহি কিছুটা শারীরিক সমস্যায় পড়ে। একটা হইলো শরীরে কম জোর অনুভব করে যা তার ক্ষুধামন্দা কারণে। আর চোখে কম দেখতে পায়। রুহির মনে পরে পাখিওয়ালা তারে কালো চশমা পরতে বলছিল। রুহির খাদ্য অনীহা দেখা দেয়। ভাত ডাল-সহ অন্যান্য খাবারে তার রুচি উঠে গেলে সে দুর্বল হয়। তার খাবার আগ্রহ হয় কাঁচা চাল ডাল গম শস্যবীজে। তার মনে পড়ে, পাখিওয়ালার শস্যভরা বয়াম গুলার কথা। রুহি দানাদার শস্য খাওয়া শুরু করে। রুহি ভাত তরকারি মাছ খাওয়া ছাইড়া দেয়। সে দিনে দিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে পাখির খাবারে। রুহি আরেকটা বিষয় বুঝতে পারে পাখির দিকে চাইলে স সব স্পষ্ট কইরা দেখতে পারে। তা ছাড়া সে সব ধোঁয়া দ্যাখে। রুহির পাখিরে ছাড়া চলা দুষ্কর হইয়া পড়লে হাতে তুইলা নেয় পাখিরে আর মাইনা নেয় তার কিসমত-রে।
রুহি বাহিরে বের হইলে হাতে থাকে খাঁচা সমেত পাখি। সে পাখি ওলার মত ঝুঁকে-ঝুঁকে হাঁটতে থাকে। কিছু দ্যাখার হইলে সামনে বাড়িয়ে দ্যায় পাখিরে। সে কী এর থেকে বের হইতে চায় না? চাইলেও তার কি করা দরকার তা সে বুঝত পারে না। ফলে সে পাখি নিয়া শহরে ঘুরতে থাকে। মূলত সে পাখিওয়ালারে খুঁজতে থাকে। রুহি যেখানে পাখিওয়ালারে পাইছিল সেখানেও যায় সোমবার আর বুধবার।
রুহি তারে আর না পাইলে চইলা যায় পাখিওয়ালার আস্তানার দিকে। অনেক খোঁজার পর সেই গরিব মানুষের জায়গাটা পায়। আর খুঁইজা পায় পাখিওলার কানা গলিটা। গলির শেষ মাথায় কোনও ঘর খুঁইজা পায়না। এমন কী সেখানে কোন ঘর ছিল তেমনও মনে হয়না। একটা পরিত্যক্ত জায়গা। য্যানো কোন মানুষ কখনো আসে নাই। জায়গাটার এক কোনে পাঁচিল ঘেঁষা অপরিচিত একটা গাছ দেখতে পায় রুহি। রুহি গাছের কাছে গেলে দেখতে পায় গাছের নিচে বড় বড় শাদা রঙে পালক পইরা আছে। রুহি গাছের উপরের দিকে তার পাখিরে ধরলে সে দেখতে পায় গাছের মধ্যে বড় একখান পাখির বাসা। বাসাটা একটু ভাঙা তাতে রুহির মনে হইলো বাসাটা পুরানো আর কোনও পাখিও থাকেনা হয়তো।
রুহি তার পাখি জীবনের লগে মানিয়ে নিলেও, তার মনে এক প্রশ্ন ঘুরতে থাকে এর শেষ কি। এই প্রশ্নের সমাধানে সে শহর হইতে বের হইয়া পড়ে। পাখি ওয়ালার কথা মত সে দক্ষিণ দিকে যাইতে থাকে হাতে নিয়া খাঁচা সমেত পাখি। সে কোনও বাহনে না গিয়া হাঁটতে থাকে। শহর থেকে বাহিরে এই পথটায় যানবাহন কিছুটা কম তবুও কিছু যান্ত্রিক বাহন চইলা যায় রুহির পাশ দিয়া। রুহি হাঁটতে থাকে সরল একটা পথ দিয়া যা বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠের মধ্য দিয়া চইলা গেছে। রুহি দূরেই একটা গাছ দেখতে পায়। সে তার হাঁটার গতি বাড়ালেও গাছের কাছে পৌঁছাতে পারেনা। যদিও সে কিছুটা পথ আগায়। তখন প্রায় সন্ধ্যা নামে মাঠের চারপাশ দিয়া। গাছটা কালো ঢিবির মতো জাইগা আছে শুধু। রুহি গাছটার আরো কাছে গেলে একটা শব্দ আর তার সাথে আলো আসতে দেখে। রুহি চিনতে পারে শব্দ আর আলোরে। মোটর সাইকেলের আলো গাছের উপর পড়লে রুহি গাছটারে চিনতে পারে। রুহি দ্যাখে, কানা গলির সেই অপরিচিত গাছটারে। সে আরও ভালো কইরা দ্যাখার জন্য হাতের খাঁচাটা বাড়াইয়া দেয় সামনে। তখন খাঁচা থেকে পাখিটা উইড়া গেলে রুহি কেবল অন্ধকার দ্যাখে। আর শেষবার দেখতে পায়, পাখিটা গিয়া বসে অপরিচিত গাছটার উপর বিরাট এক পাখির বাসার মধ্যে। আর তখনই তীব্র একটা ধাক্কা লাগে রুহির শরীরে। মটর সাইকেল থাইমা যায়। চালক তার মোটর সাইকেল থেকে নেমে দেখতে পায় বিরাট এক শাদা পাখি তার মোটর সাইকেলের লগে ধাক্কা লাইগা মইরা পরে আছে পথের মধ্যে। চালকটা মনে মনে ভাবে, এই পাখি এমনে মরলো ক্যান? পাখিরা মরার আগে নাকি কোনও দূর গহীন বনে চইলা যায়, আর মইরা যায় একা একা?
ইমরান আল হাদী
কবি, কথা সাহিত্যিক। জন্ম ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সাল। বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানাধীন বোয়ালিয়া গ্রামে। সে গ্রামেই বসবাস। প্রকাশিত বই ‘হায়াতুননেছা’ (কবিতা ২০২১)