ইসরায়েলি বিমান হামলার সময় গাজার মায়ের কী করা উচিত

।। ফিলিস্তিনি কবি মোসাব আবু তোহার গুচ্ছ কবিতা, বাংলা তর্জমা জহির হাসান ।।

কেবল একটু উষ্ণতার লাগি শীত রাতে ঝাড়বাতির
চারপাশে মাছি জড়ো হয়
যহন ক্ষেপনাস্ত্র হামলা করা হয়
গরম হই উঠে ঘর রাস্তা গাছ
কাছের পাড়াপ্রতিবেশিরে ঝলসাই ছাড়ে

ইসরায়েলি বিমান হামলার সময় গাজার মায়ের কী করা উচিত

Painting: Waeel Rabie

নিঃশব্দে ফোপাই ফোপাই কান্দো

ঘুম থাকি জাগি যদি সারাদিন বিদ্যুৎ পাইতাম।
যদি পাখিগের গান ফের শুনতাম
গুলির শব্দ আর
ড্রোনের ভন ভন যদি নাই শুনতাম।
আমার লিখার টেবিল আমারে কলম ধরতে
ডাকত আরোবার,
কিংবা দোসরা কোনো কোনো কবিতা, নাটক পড়া,
কষ্টেসৃষ্টে একটা নভেলের পাতা উলটাইতে পারতাম।
আমার চারদিকে নীরব দেয়ার ছাড়া আর কিছু না
আর লোকজন নিঃশব্দে ফোপাই ফোপাই কান্দে।

বাড়ি কারে কয়

বাড়ি কারে কয়:

উলটায়ে ফালানোর আগে
এইটা হইলো আমার স্কুলে যাওনের
পথের গাছের ছায়া

দেয়ালডা চূর্ণবিচূর্ণ করার আগে
এইটা হইল
আমার দাদা-দাদির বিয়ার সাদাকালো ছবি।

লুট করি
জাদুঘরে রাখার আগে
এইটা হইলো
আমার চাচার জায়নামাজ
যেইখানে ডজনে ডজনে পিপড়ায়
শীত রাইতে ঘুমাইত।

আমাদের ঘরটা বোমায় শ্যাষ হওনের আগে
এইটা হইলো আমার মার
আর মুরগির রোস্ট আর
রুটি সেকার চুলা।

এইটা হইলো গিয়া সেই ক্যাফে
যেইখানে আমি ফুটবল ম্যাচগুলা দেখতাম,
আর খেলাইতাম যেইখানে

আমার পোলাডা আমারে
থামায়ে জিগায়:
এত বগবগ করলা তা কি
চার অক্ষরে কোনো শব্দে তুমি
বুঝাইতে পারবা?

একজন শিশু হিসাবে আমার স্বপ্ন

একজন শিশু হিসাবে আমার স্বপ্ন
আমি এখনো খোয়াব দেখি
খেলনায় ভরা রইবে একটা ঘর
আম্মা সবসমে কবুল করি নিতেন
আমাদেরও থাকতে পারত
যদি আমরা দৌলতদার হইতাম।
প্লেনের জানালা থাকি
শরণার্থী শিবির দেখতে দেখতে
আমার এখনো স্বপ্ন আছে।
আমার এখনো স্বপ্ন আছে
প্রাণীগেরে দেখনের
আমি তৃতীয় শ্রেণিতে শিখছি:
হাতি, জিরাফ, ক্যাঙ্গারু,
আর নেকড়ে
আমি এখনো খোয়াব দেখি:
মাইলের পর মাইল দৌড়াইতেছি
সীমান্ত অবরোধ ছাড়াই
আমার পাগুলিন,
কোনো না-ফোটা বোমা
আমারে ভয় দেখায় না আর।
আমার এখনো স্বপ্ন আছে
চোখ বুজি দেখি
আমার প্রিয় দল
সৈকতে ফুটবল খেলতেছে,
আমি দাড়াই রইছি
বলের অপেক্ষায়
আমার দিকে গড়ায়ে আসবে
আর ঐটা নিয়া দিব দৌড়।
আমি এখনো খোয়াব দেখি :
আমার দাদার লগে ইয়াফায়
কমলাগাছ থাকি কত কত
পাকনা কমলা ছিড়তেছি।
কিন্তু আমার দাদাজান ইন্তেকাল করছেন,
ইয়াফা দখল হই গেছে,
তার কান্নাকাটির কারণে
কমলা আর ধরে না
গাছগুলির ঝোপে।

ইসরায়েলি বিমান হামলার সময় গাজার মায়ের কী করা উচিত

বিছানার চারদিকে থাকা
সে তার সব বালবাচ্চাদেরে জড়ো করে
যেমনি কেউ একজন জড়ো করে বা প্যাক করে
তার বই জামাকাপড় হোটেল ছাড়ার আগে।
প্রতি সেকেন্ডে সে তার বাচ্চাদের গুণে
আর তাদের চোখের দিকে তাকায়। আর সে হাসে।

সে বোমার শব্দ মাটিতে কবর দিতে
মেঘের মধ্যে ড্রোনের ঘূর্ণিঝড় মাটিতে কবর দিতে
রাতের একটা গান গায়
প্রতিটি বোমাফাটার পরপর সে তার বাচ্চাদের জড়ায়ে ধরে।

সে যেই বুঝে
আকাশ
আর ঘর একটা বোমার আলোর ঝিলিকে ফর্সা হই উঠে,
সে তার বাচ্চাদের চোখ ঢাকি রাখে
জোরে জোরে বাচ্চাদের জিজ্ঞাস করে,
‘চোখ বন্ধ করলে কি দেখতে পাস?’
আশা করি তার কম্পমান কণ্ঠ লুকায়
বোমার বধিরকারী শব্দরে।

আমার ছেলে আমার মেয়ের উপর কম্বল ছোঁড়াছুঁড়ি করতেছে

রাতে, বাড়িতে, আমরা মেঝেতে বসি থাকি,
একে অপরের কাছাকাছি
জানালা আর বোমার লাল আলো থাকি দূরে
আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকাই যেই
ঘর কাপি উঠে।
আমরা এ ওর মুখের দিকে তাকাই,
ভীত, তবুও খুশি যে আমরা ভাগ্যওয়ালা
যে আমাদের জীবন এবারের মতো রক্ষা করা হইছে।

দেয়ালগুলা ওদের বেচারা ঘুম থাকি জাগি ওঠে।
কেবল একটু উষ্ণতার লাগি শীত রাতে ঝাড়বাতির
চারপাশে মাছি জড়ো হয়
যহন ক্ষেপনাস্ত্র হামলা করা হয়
গরম হই উঠে ঘর রাস্তা গাছ
কাছের পাড়াপ্রতিবেশিরে ঝলসাই ছাড়ে ।

যতবারই আমরা F-16 বা F-35 থাকি পড়া
বোমার শব্দ শুনি
আমাদের জীবন আতঙ্ক। আমাদের জীবন জমি যায়
কোথাও না কোথাও, বিভ্রান্ত
পরে কোনখানে যাইতে হবে:
একটা গোরস্থানে, একটা হাসপাতালে,
নাকি কোনো দুঃস্বপ্নের কোলে।
আমাদের জীবন তাদের কম্পমান হাত
তাদের হাতঘড়িতে রাখে,
আঙুল ব্যাটারি খুলতে রেডি
ঠিক যেই প্রয়োজন হয়।

গোলাপী পোশাকপরা আমার চার বছরের মেয়ে ইয়াফা,
একটা বোমা ফাটার শব্দ শুনতে পায়
গভীর শ্বাস নেয় মেয়ে,
তার পোশাকের ভাজ দিই মুখ ঢাকি রাখে

ইয়াজান, তার সাড়ে পাঁচ বছরের ভাই,
তার ঘুমন্ত শরীরে উষ্ণ একটি কম্বল আঁকড়াই ধরে।
সে তার বোনের গায়ে কম্বল পাইড়া দেয়।
‘তুই এখন লুকাই থাকতে পারিস’, সে তারে আশ্বাস দেয়।
আমি এবং আমার স্ত্রী মারাম-এর জন্য, আমরা প্রার্থনা করি
যে একটি যাদুর কম্বল যদি সব বাড়িঘররে আড়াল করত
বোমা থাকি
আর আমাদেরে নিরাপদ কোথাও নিয়া যাইত।

মোসাব আবু তোহা

গাজার  একজন ফিলিস্তিনি কবি, ছোট গল্প লেখক এবং প্রবন্ধকার। থিংস ইউ মে ফান্ড হিডেন ইন মাই ইয়ার: পোয়েমস ফ্রম গাজা (২০২২, সিটি লাইটস) এর লেখক। বইটি  ২০২২ সালের প্যালেস্টাইন বুক অ্যাওয়ার্ড, আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড এবং ডেরেক ওয়ালকট কবিতা পুরস্কার জিতেছে । আবু তোহা হলেন  গাজায় এডওয়ার্ড সাইদ লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা । আমেরিকায় একজন ডায়াসপোরা প্যালেস্টাইন কবি হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলি বর্বর আক্রমণের ভিতর তিনি রাফা ক্রসিং-এর কাছে আইডিএফ কর্তৃক আটক হন, যদিও পরে ছাড়া পান। তার কবিতায় ফিলিস্তিনি মানুষের আত্মার ক্রন্দন, বাঁচার চির আকাঙ্ক্ষা, প্রতিদিন গৃহহীন হবার গল্প উঠে আসে। এককথায় ফিলিস্তিনের ভূমি ও মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে তার কবিতার ভাষা, কল্পনা, ইমেজ, সকল কাব্যবীজ।

Share