জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের স্মৃতিপটে শিক্ষার জগৎ ও সমকালীন সমাজ

।। কনকলতা সাহা ।।

ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের লেখনীতে হিন্দু সমাজের বেশ কিছু রীতি নীতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের কথা আছে । কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলে পরিবারের পৌত্তলিক অনুষ্ঠানগুলি আস্তে আস্তে তুলে দেন। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে দুই পরিবারের (জোড়াসাঁকো পাঁচ নম্বর এবং ছয় নম্বর বাড়ি) মধ্যে মতবিরোধের সূত্রপাত হয় । পরে গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী যোগমায়া দেবীর পরিবারের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের পরিবারের দীর্ঘ বিচ্ছেদ ঘটে। সৌদামিনীর স্মৃতিকথায় তাঁদের ছোটবেলার সাত্ত্বিক পূজাপদ্ধতি অনুষ্ঠানের প্রতি ভক্তি ও মিলন উৎসবের আনন্দের কথা অনেকবার এসেছে। বাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজায় দেবেন্দ্রনাথের প্রতিমা বিসর্জনে অংশ না নেওয়া এবং দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে চিরাচরিত হিন্দুপ্রথা অনুযায়ী শ্রাদ্ধক্রিয়া শেষ না করলে আত্মীয়দের বিরাগভাজন হতে হয়। গিরীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’ এবং ‘কার’- ঠাকুর কোম্পানীর পতন হলে পরিবারের বৈষয়িক দুর্গতির সময়ে দেবেন্দ্রনাথকেই ঋণশোধের দায়িত্ব নিতে হয়। প্রসন্ন কুমার ঠাকুর এই সময়ে কিছুটা অর্থ সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু নগেন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত ব্যয়ের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলে দুই ভাইয়ের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়। একদিকে দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সারদাসুন্দরী, গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী যোগমায়া, নগেন্দ্রনাথের স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরীর মধ্যে সখ্যের কথা যেমন আছে, অন্যদিকে বৈষয়িক দুর্গতির সময় পারিবারিক ভাঙনের কথাও উঠে এসেছে।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। চিত্রাঙ্কন- কনকলতা সাহা

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের স্মৃতিপটে
শিক্ষার জগৎ ও সমকালীন সমাজ

কলকাতার সাধারণ সম্ভ্রান্ত অন্তঃপুর চিত্রের ও সমাজ সংস্কৃতির রূপ তুলে ধরতে উনিশ-শতকের মেয়েদের চিন্তামূলক গদ্য, আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা গুলিকে সামাজিক দলিল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে সনাতনী প্রথায় অন্দর মহল যেমন সামলেছেন, তেমনি বৃহৎ প্রাসাদের এককোণে বসে শিল্প ও সাহিত্য-চর্চা করেছেন। একাধারে সমাজ রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন। নারী জাগরণের এক বিশেষ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল এই পরিবারের হাত ধরে। পারিবারিক ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক পরিসর যখন এই পরিবারের মেয়েদের লেখায় ধরা দিল তখন সমকালের মনোগ্রাহী বিশ্লেষণ সেই সঙ্গে উঠে এল। নব্য শিক্ষিত বাঙালি ভদ্র লোকেদের সাহচর্যে মেয়েরা শুধু বিদ্যাশিক্ষা নয়, সামাজিক ভাবে বিভিন্ন স্তরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পেয়েছিল। মৌখিক পরম্পরার সাহিত্য থেকে গদ্যচর্চার সাহিত্যে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের এগিয়ে আসতে দেখা যায়। এই পরিবারের মেয়েরা তাঁদের সমকালে স্ত্রী-শিক্ষা, পারিবারিক ও সামাজিক নানাবিধ বিষয় তাঁদের স্মৃতিকথা ও প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। পরবর্তী সময়ে এই পরিবারের কন্যা ও বধূরা নির্বিশেষে নিজেদের জীবনকথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাঁদের লেখায় ব্যক্তিগত জীবন ও সমকালের খুঁটিনাটি প্রসঙ্গগুলি থেকে তাঁদের জীবনের রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেয়েদের শিক্ষা এবং সমাজের নানা বিধিনিষেধের গণ্ডি উপেক্ষা করে তাঁদের অভিজ্ঞতাকে রূপ দেওয়ায় সহায়তা করেছিলেন সে কথা জানা যায়। স্মৃতিকথা গুলির মধ্যে নির্বাচিত কয়েকটি স্মৃতিকথার আশ্রয়ে সমকালের একটি পট নির্মাণের চেষ্টা করব।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মহিলারা তাঁদের স্মৃতিকথাগুলিতে তৎকালীন সমাজের বহুবিধ পরিবর্তনের ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে এই বাড়ির সদস্য-সদস্যারা প্রায় পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন, এ কথা আগেই বলেছি। তবে শিক্ষাচিন্তা -শিক্ষা চর্চার ক্ষেত্রে এবং সমাজে নিজেদের বিশেষ ভূমিকা নির্মাণ করার ক্ষেত্রে কিছু প্রসঙ্গ এখনো স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। স্ত্রী-শিক্ষা এবং স্ত্রী-স্বাধীনতার পক্ষে ঠাকুরবাড়ির অনেকেই কলম ধরেছিলেন। শিক্ষাচিন্তা চর্চার প্রতিচ্ছায়া আছে ‘বামাবোধিনী’, ‘তত্ত্ববোধিনী’, ‘ভারতী’, ‘প্রদীপ’, ‘পুণ্য’, ‘সাধনা’ প্রভৃতি পত্রিকায়। তৎকালীন সমাজে মেয়েদের অবস্থান ও শিক্ষার সলতে জ্বালানোর কাজ সেখান থেকেই শুরু হয়। দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকেই ঠাকুরবাড়িতে মেয়েদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল। দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখ পরিবারের মেয়েদের শিক্ষার জন্য বৈষ্ণবী মহিলা, কখনও বা বিদেশিনী মেমদের আনিয়েছেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এ ব্যাপারে আরও সচেতন ছিলেন। তিনি পরিবারের কন্যাদের বেথুন স্কুলে পাঠিয়েছিলেন, যা তখনকার দিনে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রমুখের পাশাপাশি দেবেন্দ্রনাথ স্ত্রী-শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা সৌদামিনীর লেখা থেকে সমাজ সংস্কারক দেবেন্দ্রনাথের ভূমিকার কথা পাই।

আমাদের বাল্যকালে মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়া চর্চ্চা বড় একটা ছিল না। বৈষ্ণব মেয়েরা কেহ কেহ বাংলা, এমনকি, সংস্কৃত শিক্ষা করিত— তাহাদেরই নিকট অল্প একটু শিখিয়া রামায়ণ মহাভারত এবং সেকেলে দুই একখানা গল্পের বই পড়িতে পারিলেই তখন যথেষ্ট মনে করা হইত। আমাদের মা কাকিমারাও সেইরূপ শিক্ষাই পাইয়াছিলেন।১

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা সৌদামিনী ঠাকুর

অন্তঃপুরে শিক্ষার ধারা এই পরিবারে অব্যাহত ছিল, এ লেখা থেকে বোঝা যায়। তাছাড়া জানা যায় তাঁরা তাঁদের প্রাথমিক শিক্ষা বৈষ্ণবীদের কাছে শিশুপাঠ দিয়েই শুরু করতেন। মাঝে মাঝে কলাপাতায় চিঠি লেখা অভ্যাস করতেন ও রামায়ণ পাঠ করতেন। সিমলা পাহাড় থেকে দেবেন্দ্রনাথ ফিরে এলে তাঁদের শিক্ষার প্রতি যত্ন নেন। কেশবচন্দ্র সেনের সহযোগিতায় অন্তঃপুরে মিশনারী মেমদের কাছে পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু একবার তাঁদের শেখানো পাঠের বানান ও ভাষা দেখে দেবেন্দ্রনাথ অসন্তুষ্ট হয়ে এই নিয়মের শিক্ষা বন্ধ করে দেন। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বেথুন ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা সৌদামিনী ও গিরীন্দ্রনাথের কন্যা কুমুদিনীকে পড়তে পাঠান। হরদেব চট্টোপাধ্যায় তাঁর কন্যাদ্বয়কে ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার তাঁর কন্যাদের বেথুনে পড়তে পাঠান। তাছাড়া স্বর্ণকুমারীর স্মৃতিতে অন্তঃপুর শিক্ষার চিত্রটি আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে। স্ত্রীলোকের বিদ্যাশিক্ষাকে দ্বারকানাথের সময় থেকে বিশেষ নজরে দেখা হত। তাঁদের কাছে শিক্ষাচর্চা বিষয়টি নিত্য নিয়মিত ক্রিয়া অনুষ্ঠানের মতো ছিল।

প্রতিদিন প্রভাতে গয়লানী যেমন দুগ্ধ লইয়া আসিত, মালিনি ফুল যোগাইত, দৈবজ্ঞ ঠাকুর পাঁজিপুঁথি হস্তে দৈনিক শুভাশুভ বলিতে আসিতেন, তেমনি স্নান বিশুদ্ধা, শুভ্রবসনা, গৌরী বৈষ্ণবী ঠাকুরানি বিদ্যালোক বিতরণার্থে অন্তঃপুরে আবির্ভূতা হইতেন। …ইহার চমৎকার বর্ণনা-শক্তি ছিল, কথকতা ক্ষমতায় ইনি সকলকে মোহিত করিতেন… বৈষ্ণবী আসিতেন অন্তঃপুরে চতুঃসীমাবদ্ধা মহিলাগণের জন্য; বালিকা নববধূ ও বিবাহিতা বালিকা কন্যাগণ ইঁহার কাছেই শিক্ষালাভ করিতেন। কিন্তু বাড়ির অবিবাহিতা কন্যাগণ বালকদিগের সহিত গুরুমহাশয়ের পাঠশালায় গমন করিত। ইহাতে আর কিছু না হউক, বালক-বালিকার শিক্ষার ভিত্তি সমভাবেই গঠিত হইত। ২

স্বর্ণকুমারী দেবী

তখনও বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় রচিত হয়নি। বৈষ্ণবীরা যে পুস্তক থেকে বর্ণবোধ পড়াতেন তার নাম ‘শিশুবোধক’। সেটি স্বর্ণকুমারী বড় হয়েও দেখেছিলেন, কিন্তু সেটি যে কঠিন ও দুর্বোধ্য ছিল সে কথা বলেছেন। চাণক্য শ্লোক, রামায়ণ, মহাভারত পড়ে শোনাতেন তাঁর দাদারা। তত্ত্ববিদ্যা শেখাতেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। তাছাড়া কাব্য, উপন্যাস চর্চার কথাও এসেছে। আলমারি ভরা পুতুল খেলনার সঙ্গে পুস্তক রাশির কথাও আছে। বড় হয়ে স্বর্ণকুমারী যে বইগুলি দেখেছেন তার মধ্যে মানভঞ্জন, প্রভাসমিলন, দূতীসংবাদ, কোকিলদূত, রুক্মিনীহরণ, পারিজাতহরণ, গীতগোবিন্দ, প্রহ্লাদ চরিত্র, রতিবিলাপ, বস্ত্রহরণ, অন্নদামঙ্গল, আরব্যোপন্যাস, পারস্যোপন্যাস, চাহার দরবেশ, হাতেমতাই, গোলেবকায়লি, লায়লামজনু, বাসবদত্তা, কামিনীকুমার ইত্যাদির কথা আছে। তাছাড়া স্বর্ণকুমারীর লেখা থেকে জানতে পারি, ব্রাহ্ম সমাজের প্রবীণ আচার্য অযোধ্যানাথ পাকড়াশীকে অন্তঃপুরে মেয়েদের শিক্ষার কাজে নিযুক্ত করা হয়।

বৌ ঠাকুরাণি তিনজন, মাতুলানী, দিদি ও আমরা ছোটো তিন বোন সকলেই তাঁর কাছে অন্তঃপুরে পড়িতাম। অঙ্ক, সংস্কৃত, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি ইংরাজি স্কুল পাঠ্য পুস্তকই আমাদের পাঠ্য ছিল। ৩

স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রী স্বাধীনতার প্রতি বিশেষ নজর ছিল সত্যেন্দ্রনাথের। বাড়ির মেয়েদের থিয়েটার, মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা বা কোনো বক্তৃতা শুনতে নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে। তাঁদের সার্বিক উন্নতির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। স্বর্ণকুমারী তাঁর সম্পর্কে বলেছেন,

‘‘মেজদাদার স্বভাবে স্ত্রী-সম্মান এতই ওতপ্রোতভাবে বর্তমান, কোনো ভদ্র পুরুষে যে স্ত্রী জাতির প্রতি অসম্মান দৃষ্টিতে চাহিতে পারে, ইহা তিনি অন্তরে ধারণা করিতে অক্ষম। মেজদাদার কাছে যদি বল, বুদ্ধিতে পুরুষ স্ত্রীলোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যদি বল পুরুষের ন্যায় তাহাদের উচ্চশিক্ষা অনাবশ্যক, কার্যক্ষেত্রে তাহারা পুরুষের অসমকক্ষ, অমনি তিনি গরম হইয়া উঠিবেন, মেয়েদের পক্ষ হইয়া তর্কপরায়ণ হইবেন।”৪

পারিবারিক নিয়ম-কানুনের গণ্ডী ভেদ করে তিনি তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকেও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনীর জীবনকথা থেকে জানতে পারি— ছেলেবেলায় পিতৃগৃহে প্রথমে তাঁরা তালপাতায় লেখা অভ্যাস করতেন। বিয়ের পরে সত্যেন্দ্রনাথ তাঁকে লেখাপড়ার বিষয়ে যে উপদেশ ও উৎসাহ দিতেন তার সাক্ষ্যও মেলে।

সেই সময়কার ওঁর চিঠি কখানা আমার কাছে রয়েছে। তাতে দেখি উনি আমাকে বিবি বা মেম রেখে ইংরেজী পড়তে বা বলতে শেখবার জন্য খুব উপদেশ দিতেন। নিজে কি কি বই পড়ছেন তাও লিখতেন। ৫

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

বাড়ির মেয়েদের সার্বিক শিক্ষার প্রতি হেমেন্দ্রনাথের অবদানও অনস্বীকার্য। তাঁর সম্পর্কে স্বর্ণকুমারী লিখেছেন,

বাড়ির মেয়েদের ইংরাজি বাংলায় নিজে শিক্ষাদান করিতেন। এক্ষণে সেজদাদা মহাশয় তাঁহার পত্নীকে ওস্তাদের নিকট গান শিক্ষা দিতে লাগিলেন। বাড়ির ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা গান বাজনা, লেখাপড়া সর্ব রকমে বেশ ভালো করিয়া শিক্ষা পাইতে লাগিল। দিদিরা পর্যন্ত ঘরে কাঁচিয়া ইংরাজি শিখিতে আরম্ভ করিলেন। ৬

স্বর্ণকুমারীর মতো জ্ঞানদানন্দিনীর স্মৃতিকথাতেও হেমেন্দ্রনাথের শিক্ষাব্যবস্থার কথা আছে।

বিয়ের পর আমার সেজো দেবর হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইচ্ছে করে আমাদের পড়াতেন। তাঁর শেখাবার দিকে খুব ঝোঁক ছিল। নিজের মেয়েদেরও সব লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। আমার যা কিছু বাংলা বিদ্যা তা সেজো ঠাকুরপোর কাছে পড়ে। মাইকেল প্রভৃতি শক্ত বাংলা বই পড়াতেন, আমার খুব ভাল লাগত, এখনও লাগে। উনি বিলেত থেকে সেজো ঠাকুরপোকে লিখে পাঠিয়েছিলেন আমাকে ইংরিজি শেখাতে, কিন্তু সেটা অক্ষর পরিচয়ের বড় বেশি এগোয়নি। সে জন্য পরে বম্বে গিয়ে ওঁর কাছে খুব বকুনি খেয়েছিলুম, বেশ মনে আছে। তখন বাড়ির ছেলেদের জন্যে একজন কুস্তিগির পালোয়ান মাইনে করা থাকত। ছেলেরা সকলেই কুস্তি শিখত। ৭়

হেমেন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথের কথা এঁদের লেখায় যেভাবে এসেছে তাতে এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে উনিশ শতকে মেয়েদের জগত প্রসারিত হতে শুরু করেছিল। লক্ষণীয় বিষয় এই যে তাঁদের শুধু পাঠের অভিজ্ঞতাই হয়নি, সামাজিক ভাবেও তাঁদের উন্নতি ঘটেছিল । পরবর্তী সময়ে স্ত্রীশিক্ষা, বাল্যবিবাহ সংস্কার বিষয়ে দেবেন্দ্রনাথের ভূমিকার কথা পরিবারের কন্যাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে। ঠাকুরবাড়ির অবরোধ প্রথা কিছুটা শিথিল হলেও জ্ঞানদানন্দিনী যখন বন্ধু হয়ে আসেন তখনও বাড়িতে অন্য পুরুষের বাড়ির ভেতরে আসার নিয়ম ছিল না। সত্যেন্দ্রনাথের ইচ্ছে তাঁর বন্ধু মনোমোহন ঘোষকে তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করানোর। তাই তাঁরা দুজনে পরামর্শ করে লুকিয়ে বাড়িতে আসেন এবং মশারির মধ্যে মনোমোহনকে ঢুকিয়ে দিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ শুয়ে পড়েন। এই ঘটনা সেই সময় প্রেক্ষিতে বিস্ময়ের অন্ত রাখে না।

আমরা দুজনেই মশারির মধ্যে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলুম; আমি ঘোমটা দিয়ে বিছানার এক পাশে আর তিনি ভোম্বলদাসের মতো আর এক পাশে। লজ্জায় কারো মুখে কথা নেই। ৮

কিছুক্ষণ পর অবশ্য তাঁরা দুজনেই বাইরে বার হয়ে যান। তাছাড়া বাঙালি মেয়ে হয়ে সেই সমাজকে উপেক্ষা করে জ্ঞানদানন্দিনী একাই বিলাতে যেতে সম্মত হয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের অনুমতি পেলে প্রথমে ফরাসী দোকানে ফরমায়েশ করা ওরিয়েন্টাল ড্রেস পরে পালকি করে জাহাজে উঠলেও যখন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ফিরেছিলেন তখন কোনো পালকি ছাড়াই গাড়ি করে ফেরেন। পরবর্তী সময়ে কলকাতায় এসে লাটসাহেবের বাড়িতে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে গেলে জ্ঞানদানন্দিনীকে অনেকেই ভূপালের বেগম মনে করেছিলেন। ঠাকুরবাড়ির বউ হয়ে সর্বসমক্ষে বার হয়েছিলেন বলে কটাক্ষও শুনতে হয়েছিল।

ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের লেখনীতে হিন্দু সমাজের বেশ কিছু রীতি নীতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের কথা আছে । কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলে পরিবারের পৌত্তলিক অনুষ্ঠানগুলি আস্তে আস্তে তুলে দেন। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে দুই পরিবারের (জোড়াসাঁকো পাঁচ নম্বর এবং ছয় নম্বর বাড়ি) মধ্যে মতবিরোধের সূত্রপাত হয় । পরে গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী যোগমায়া দেবীর পরিবারের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের পরিবারের দীর্ঘ বিচ্ছেদ ঘটে। সৌদামিনীর স্মৃতিকথায় তাঁদের ছোটবেলার সাত্ত্বিক পূজাপদ্ধতি অনুষ্ঠানের প্রতি ভক্তি ও মিলন-উৎসবের আনন্দের কথা অনেকবার এসেছে। বাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজায় দেবেন্দ্রনাথের প্রতিমা বিসর্জনে অংশ না নেওয়া এবং দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে চিরাচরিত হিন্দুপ্রথা অনুযায়ী শ্রাদ্ধক্রিয়া শেষ না করলে আত্মীয়দের বিরাগভাজন হতে হয়। গিরীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’ এবং ‘কার’- ঠাকুর কোম্পানীর পতন হলে পরিবারের বৈষয়িক দুর্গতির সময়ে দেবেন্দ্রনাথকেই ঋণশোধের দায়িত্ব নিতে হয়। প্রসন্ন কুমার ঠাকুর এই সময়ে কিছুটা অর্থ সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু নগেন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত ব্যয়ের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলে দুই ভাইয়ের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়। একদিকে দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সারদাসুন্দরী, গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী যোগমায়া, নগেন্দ্রনাথের স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরীর মধ্যে সখ্যের কথা যেমন আছে, অন্যদিকে বৈষয়িক দুর্গতির সময় পারিবারিক ভাঙনের কথাও উঠে এসেছে। সৌদামিনী তাঁর স্মৃতিকথায় দেবেন্দ্রনাথের উদারতার কথাও জানতে পারি—

পিতামহ তাঁহার উইলে যাঁহাদিগকে কিছু কিছু দান করিয়া গিয়াছিলেন, দেখিলাম তাঁহারা আদালতে মকদ্দমা করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক ফেল করাতে আমাদের বৈষয়িক দুর্গতির দিন উপস্থিত হইয়াছিল। তথাপি উইল অনুসারে যাহার যাহা প্রাপ্য ছিল, তাহা পরিশোধ করিয়া দিয়া পিতৃদেব নিষ্কৃতি লাভ করিলেন। তাঁহার উপর এত যে অত্যাচার গিয়াছে তিনি ধীর ভাবে সমস্ত বহন করিয়াছেন, কখনও ন্যায় পথ হইতে ভ্রষ্ট হন নাই। যাহারা তাঁহার প্রতি অত্যন্ত অনাত্মীয় ব্যবহার করিয়াছে দৈন্যদশায় পড়িয়া যখনি তাহারা তাঁহার শরণাপন্ন হইয়াছে তখনি তিনি তাহাদের চির-জীবন জীবিকার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন। ৯

পরিবারের সকলের সঙ্গে থাকা ও সকলের জন্য ভাবনার যে কথা তা অনেকের লেখাতেই আমরা পরবর্তী সময়ে পাই। কিন্তু এখন যে বিশেষ দিকটা নিয়ে আমরা আলোচনা করব সেটি হল- দেবেন্দ্রনাথ মেয়েদের শুধুমাত্র লেখাপড়া নয়, শিল্পচর্চার প্রতিও উৎসাহিত করেন। তিনি পরিবারের পৌত্তলিক প্রথাগুলি উঠিয়ে দিলেও বিবাহের স্ত্রী আচারগুলি রক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি প্রাত্যহিক উপাসনা ও মাঘোৎসবের সময় পরিবারের সকলের উপস্থিতির ব্যবস্থাও করতেন । বাইরের দালানে সত্যেন্দ্রনাথ নিজে গান রচনা করে গাইছেন সৌদামিনী আল্পনা দিয়েছেন সেকথাও বলেছেন সৌদামিনী । স্ত্রী-শিক্ষা ও স্ত্রী- স্বাধীনতা বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথের উদ্যোগের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ‘স্ত্রী স্বাধীনতা’ নামে একটি বই তিনি লেখেন,মিলের ‘সাবজেকশন অফ উইমেন’ পড়ে। তখনকার দিনে মেয়েদের বাইরে যেতে হলে ঢাকা দেওয়া পালকি চড়ে যাওয়ার রীতি ছিল। মেয়েদের গাড়ি চড়া ভীষণ লজ্জার কথা বলে গণ্য হত। শুধুমাত্র একটি পাতলা শাড়ি তাঁদের পরিধেয় ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ সমাজের বিরোধিতা করে তাঁদের পোশাকের বদল ঘটালেন ও গাড়িতে করে বাইরে অনুষ্ঠানে বা বেড়াতে নিয়ে যেতে শুরু করলেন। দেবেন্দ্রনাথের এই বিষয়ে যে মত ছিল, তা সৌদামিনী জানিয়েছেন । দেবেন্দ্রনাথের এক আত্মীয় (চন্দ্ৰমোহন চট্টোপাধ্যায়) একবার মেয়েদের বাইরের ছাদে বেড়াতে দেখে দেবেন্দ্রনাথের কাছে নালিশ করতে এলে, দেবেন্দ্রনাথ মেয়েদেরই পক্ষ নেন । মেয়েদের পোশাকের বিষয়েও ভেবেছিলেন সে কথা সৌদামিনী বলেছেন। ছোট মেয়েরা ভাল করে কাপড় সামলাতে পারত না বলে তাঁদের বাড়িতে দর্জি ডেকে পোশাক তৈরির ব্যবস্থা করেন। সে পোশাক অনেকটা পেষোয়াজ ধরণের ছিল। তাছাড়া মেয়েদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী ও শরৎকুমারীর অনেক বড় বেলা অবধি বিয়ে দেননি বলে আত্মীয়দের কাছে কথা শুনতে হয়। কিন্তু তিনি সেসব গ্রাহ্য করেননি। তখনকার দিনে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণে একসঙ্গে বসে আহারের চল ছিল না। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের এ বিষয়ে সম্মতি ছিল। তবে ব্রাহ্মণদের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিতে বিবাহে সম্মতি থাকলেও অসবর্ণ বিবাহে সম্মতি ছিল না। একসঙ্গে প্রাচীন প্রথারসংস্কার ও তার রক্ষণ এই দুইই তাঁর চরিত্রের বিশেষত্ব ছিল।

স্বর্ণকুমারীর কন্যা সরলা ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে তাঁদের ছোটবেলায় পালকি চড়ে স্কুলে যাওয়া ও পরে বাসে করে যাতায়াত করার কথা বলেছেন। দেবেন্দ্রনাথের হাফেজের কাব্য সংগ্রহ পড়ার কথাও বলেছেন। সরলা ভারতী পত্রিকায় আহিতাগ্নিক ও ঋগবেদের মন্ত্র অবলম্বনে ‘শুনঃশেফের বিলাপ’ লেখেন। সেটি দেবেন্দ্রনাথকে পড়ে শোনালে তিনি খুব খুশি হন এবং হাফেজের কবিতায় সুর দেওয়ার কাজে তাঁকে নিযুক্ত করেন। বাড়িতে একটি সভার আয়োজন করে তাঁকে পুরস্কার স্বরূপ হ্যামিল্টনের দোকান থেকে নেকলেস উপহার দেন। হাফেজের সেই গানের স্বরলিপি শতগানে আছে। তার পরের বছর কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মিস্টার সিওয়নি সাহেব যেদিন তাঁদের বাড়িতে চা খেতে আসেন সেদিন তাঁকে সেই গান শোনানো হয়। তিনি হিন্দু বাঙালি মেয়ের মুখে এমন বিশুদ্ধ উচ্চারণ শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই পরিবারে গান-বাজনা ও অভিনয়াদি চর্চার অন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। সরলার স্মৃতিকথায় সর্বসমক্ষে তাঁদের অভিনয়ের কথা আছে।

বাড়িতে গান-বাজনা ও অভিনয়াদির দিক থেকে রবি মামার প্রাধান্য ক্রমশ ফুটেছে। এর আগে নতুন মামা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সেদিককার কর্ণধার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বিলেত নিবাস কালেই আমার মায়ের রচিত বসন্তোৎসব গীতিনাট্যের অভিনয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অধ্যক্ষতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১০

সরলা দেবী চৌধুরানী

বসন্তোৎসব, মানময়ী, বাল্মীকিপ্রতিভা অভিনীত হচ্ছে সর্বসমক্ষে বাড়ির ছাদে স্টেজ বেঁধে। সঙ্গে ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুধীন্দ্রনাথ। তাছাড়া জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারী, কাদম্বরী, রবীন্দ্রনাথও যুক্ত ছিলেন। দাদাদের সঙ্গে নতুন নতুন ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করতেন বাড়ির মেয়েরাও। ওস্তাদদের কাছ থেকে সুর নিয়ে ভাঙা গান ও নিজেদের মৌলিক ধারার সুর তৈরি করা এবং শেখানোর প্রতি তাঁদের উৎসাহ দিতেন রবীন্দ্রনাথ। প্রতিভা দেবীর ওস্তাদদের সঙ্গে ১১ই মাঘের অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার প্রসঙ্গ আছে। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই বাড়িতে দেশী ও ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের চর্চা শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে সরলা নিজেও ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাকে পিয়ানোতে বাজানো শিখেছিলেন। তেমনি ‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে’, ‘চিনি গো চিনি বিদেশিনী’, ‘হে সুন্দর বসন্ত বারেক ফিরাও’ প্রভৃতি রবীন্দ্র গান সরলার হাতে ‘ইয়োরোপিয়ান্বিত’ হয়েছিল।

এইসব গান অনেকবার নানা সঙ্গীত সভায় গাওয়াও হয়। ইংরেজি স্বরলিপি প্রথায় লেখার প্রচলন করেছিলেন ইন্দিরা দেবী। তাছাড়া পারিবারিক পত্রিকার মধ্যে ‘বালক’ ও ‘ভারতী’ পত্রিকা সম্পাদনার কাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষেই যুক্ত হয়েছিলেন। ‘ভারতী’ পত্রিকা প্রকাশনা প্রসঙ্গে সরলা লিখেছেন,

‘দিদি ‘ভারতী’তে মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লিখে মায়ের সাহায্য করতেন। মৌলিক প্রবন্ধ তিনি লিখতেন না, কিন্তু প্রয়োজনীয় সাময়িক তথ্যের ইংরেজি হতে অনুবাদ করে বাঙলা পাঠকের সহজসাধ্য করা তাঁর কাজ ছিল। তাঁর নিজস্ব মৌলিক রচনা ছিল কতকগুলি সনেট। ১১

স্বর্ণকুমারীর মাদাম ব্লাভাটস্কির থিওসফির দলের যাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁদের দল ভেঙে গেলে পর তাঁদের নিয়েই একটি সমিতি স্থাপন করেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এর নাম দেন ‘সখি-সমিতি’। সে সম্পর্কে সরলা বলেছেন,

কুমারী ও বিপন্না বিধবাদের বৃত্তি দিয়ে পড়ান, পড়া সাঙ্গ হলে তাদের শিক্ষয়িত্রী রূপে বেতন দিয়ে অন্তঃপুর-মহিলাদের শিক্ষার জন্য নিযুক্ত করা, মফঃস্বলে ধর্ষিতা নারীদের জন্যে প্রয়োজন হলে উকিল, ব্যরিস্টার নিযুক্ত করে মোকদ্দমা চালান, বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে শিল্প সংগ্রহ করে মেলা করা, তাতে মেয়েদের দ্বারা অভিনয় করান প্রভৃতি নানা আয়োজনে সখি-সমিতি’ বিখ্যাত হয়ে উঠল। মায়ার খেলা’র প্রথম অভিনয় সখি-সমিতি’তেই হয়। ১২

পরবর্তী সময়ে কালের প্রভাবে সখি-সমিতি ম্রিয়মান হলে হিরণ্ময়ীর উৎসাহে তাকে সজ্জীবিত রাখার চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় বিধবা শিল্পাশ্রম। মহিলা শিল্পমেলার উদ্বোধন দিবসে বেথুন স্কুল প্রাঙ্গণে সখি-সমিতির মেলায় মায়ার খেলা গীতিনাট্য প্রথম অভিনীত হলে এই পরিবারের মেয়েরা অনেকেই অংশগ্রহণ করেন। ইন্দিরা লিখেছেন—

স্বর্ণপিসিমা বোধহয় অনুমান ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে সখী- সমিতি নামক স্ত্রী-সভা স্থাপন করেন, দুঃস্থ বিধবা ও অনাথাদের আত্মনির্ভর শিক্ষার উদ্দেশ্যে। গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলের প্রতিষ্ঠাত্রী শ্রীমতী সরলা রায় ও এক মহিলা-সমিতি পত্তন করেন,পরে তার সঙ্গে ঐ সখী-সমিতি মিশে যায়। শ্রীমতী রায়ের অনুরোধে রবি কাকা তাঁদের সমিতির সাহায্যার্থে ‘মায়ার খেলা” নামক গীতিনাট্য রচনা করেন। সেটি সখী-সমিতির মেলার সময় বেথুন কলেজে প্রথম অভিনীত হয়, আমাদের বাড়ির মেয়েরাই সব অংশগ্রহণ করে। সখী-সমিতির মেলায় আমি ফুলের পসারিণী হয়েছিলুম। ১৩

ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী

রবীন্দ্রনাথ যে বৃহৎ কর্মকাণ্ডের জগতে ঢুকে পড়েন সেকথা অনেক মহিলাদের স্মৃতিতে ধরা পড়েছে। তবে শিক্ষা ও সমাজ কল্যাণের মন্ত্রে প্রতিমাকে যে দীক্ষা দিয়েছিলেন সেকথা ‘স্মৃতিচিত্র’তে আছে। রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনি দুই ব্রাউনিং, কীটস, শেলী, ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা ব্যাখ্যা-সহ শুনেছেন। তাছাড়া বছর বাংলা ও ইংরাজি সাহিত্য পড়েছিলেন। সন্ধ্যা সম্মিলনীতে তাঁর কণ্ঠে হুইটম্যান, আইরিশ কবি এ. ই. তাঁর প্রিয় ছিল। কবি কণ্ঠে সাহিত্য সমালোচনা শুনতেন মনোযোগের সঙ্গে। মীরার ‘স্মৃতিকথা’তে জোড়াসাঁকো বাড়ি ও তার পরবর্তী সময়ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে। এছাড়াও এই পরিবারের অনেক মহিলারা এই সময়ের কথা বলেছেন সীমিত পরিসরে তা উল্লেখ করা গেল না।

তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সমাজ সমালোচনার ভয়ে এই পরিবার কখনও উৎসাহ হারায়নি। সাহিত্য চর্চা, গান লেখা ও গাওয়া, পত্রিকা সম্পাদনা, নাটক লেখা ও অভিনয় চর্চা-এ সবের মধ্যে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি একক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল। এই পরিবারের মেয়েদের লেখা স্মৃতিকথা গুলি থেকে আমরা সেকালের সমাজের এক অনন্য চিত্র ধরা পড়েছে তাও দেখতে পেলাম।


তথ্যসূত্র :
১. সৌদামিনী দেবী – ‘পিতৃ স্মৃতি’, পিতৃ স্মৃতি ও অন্যান্য রচনা, সংকলন সম্পাদনা সুতপা ভট্টাচার্য ও অভিজিৎ সেন, দেজ এবং স্কুল অব উইমেনস স্টাডিজ, ২০১১, পৃঃ ১৬
২. স্বর্ণকুমারী দেবী
‘আমাদের গৃহে অন্তঃপুর শিক্ষা ও তাহার সংস্কার’, বাঙালি মেয়ের ভাবনামূলক গদ্য, সংকলন ও সম্পাদনা সুতপা ভট্টাচার্য, সাহিত্য অকাদেমি, ২০১১, পৃঃ ১৭৩
. তদেব, পৃঃ ১৭৮
৪. তদেব, পৃঃ ১৮০-১৮১
৫. জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, ‘আমার জীবনকথা’, পুরাতনী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী
অনুলিখিত ও সম্পাদিত, আনন্দ, ২০১২, পৃঃ ২৯
. তদেব, পৃঃ ১৭৯-১৮০
৭. জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ‘আমার জীবনকথা”, পুরাতনী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী অনুলিখিত ও সম্পাদিত, আনন্দ, ২০১২, পৃঃ ২৩-২৪
৮. জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ‘আমার জীবনকথা’, পুরাতনী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী অনুলিখিত ও সম্পাদিত, আনন্দ, ২০১২, পৃঃ ৩৮
. সৌদামিনী দেবী – ‘পিতৃ স্মৃতি’, পিতৃ স্মৃতি ও অন্যান্য রচনা, সংকলন সম্পাদনা সুতপা ভট্টাচার্য ও অভিজিৎ সেন, দেজ এবং স্কুল অব উইমেনস স্টাডিজ, ২০১১, পূঃ ১৬
১০. সরলা দেবী ‘জীবনের ঝরাপাতা’, জীবনের ঝরাপাতা, সম্পাদনা ইন্দ্রনাথ মজুমদার, সুবর্ণরেখা, ২০০৭, পৃঃ ২৮
১১. সরলা দেবী ‘জীবনের ঝরাপাতা, জীবনের ঝরাপাতা, সম্পাদনা ইন্দ্রনাথ মজুমদার, সুবর্ণরেখা, ২০০৭, পৃঃ ৫৩-৫৪
১২. সরলা দেবী ‘জীবনের ঝরাপাতা’, জীবনের ঝরাপাতা, সম্পাদনা ইন্দ্রনাথ মজুমদার, সুবর্ণরেখা, ২০০৭, পৃঃ ৫১
১৩. ইন্দিরা দেবী – ‘জীবনকথা’, স্মৃতিসম্পুট, ১ম খণ্ড, সম্পাদনা অনাথনাথ দাস, রবীন্দ্রভবন, ২০০০, পৃ. ৩৬

কনকলতা সাহা

বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী, বর্তমানে বোলপুর কলেজের বাংলার অধ্যাপক, বসবাস শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লীতে। গবেষণা ও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণে বিশেষ আগ্রহ।

Share