।। জহির হাসান ।।
আমার সোমবার রাতের ঘুম
আমি যতবারই স্বপ্নের ভিতর মরছি
কোনোবারই আমারে
কবর দেওয়া হয় নাই!
আমার লাশগুলি একটা অন্ধকার ঘরে
পরপর সাজানো থাকে তো!
গতকাল যখন দেখলাম একটা বাঘ
আমার ঘেটি ধরি টানতে টানতে
একটা পাহাড়ের নিচে আনছে
আমারে খাবে!
আমার ভয় আর ছটফটানি
প্রাণের মৃত্যুর কাছে কাকুতি
আমি দেখলাম স্বপ্নের ভিতর!
প্রতি সোমবার সকালবেলা
আমার ঘুমেরতে দেরিতে উঠার কারণ
স্বপ্নের ভিতর আমার লাশগুলি
গোলাপবনের মধ্যে সাজায়ে রাখি
যাতে গন্ধ না বার হয়!
পথের ক্রোড়ে
যে পথে মিলায়ে গেছ কুয়াশা হেরেমে
পদচিহ্ন, তোমার সুবাস মুছি গেছে একবারে
ভালোই তো হইলো খোঁজা যাবে টানা বছর বছর
এইটা একটা না-খবর
হদিসবিহীন কেউ ভুলে আমারে
মজনু কউক আর না কউক
ছাড়ব না এ পথের ক্রোড়!
কুয়াশা দি সারলাম ওজু যবে
পড়লাম সালাত যে-আয়াতে
আমারে কেহই আর না দেখিতে পায়
কায়াতে!
আমি ধরিই নিছি নিদান আমার কুয়াশাই
এবে করতেছি হদিস কোন কুয়াশাটা উচাটন
তোমার মুখের প্রকৃত তোরণ তিল
ঐ তিলের জাকাত আমি দিতে চাই আজীবন!
দূর হইতে একবার শুধু দেখছি
তোমার চুলের বাড়ি খাই
জ্ঞানহারা হই পড়ি গেছে কিছু আলো
শ্যামা ঘাসের ভিতর!
আমার মতন তারও দশা কুয়াশার ডালে
সেই আলো আর আমি
করতেছি মাতুম মহাকালে
তুচ্ছ সব বাহাদুরি
হায়! হায়! কী দেখলাম, মরি মরি!
কী দেখলাম! কোন রূপ কোন সাজ
মাঠের ভিতর
আমরা দুই মনসুর হাললাজ!
সোমবারের মেঘ ওরা
সোমবারের মেঘ ওরা
ওরা মঙ্গলবারের মেঘের সাথে মিশে না!
যুদা যুদা তারা আলাহিদা ঘোরে আকাশে!
সোমবারে আমি পাহাড়ে উঠি তাহার চূড়ায়!
অনেকক্ষণ সঙ্গ দেয় তারা আমারে!
ব্যস্ত যে ছিল তারা আমারে বুঝতে দেয় না!
কথা হয়। আসল কথাই হয় না!
বলি যে আকাশের কোন কোন ঠিকানায় সায়ের করো তোমরা?
পুরাকালের সেই সারভিসটা বন্ধ করি দিছো নাকি তোমরা?
এই যে অত্যাচারিতের লহু ও বুক-মুখচাপা যত কথা
আসমানের জায়গা মতো দরবারে
এক ফাঁকে কয়ে আসতে যেইভাবে!
এমনি কপাল আমাদের এইকালে!
আমাদের সোমবারের মেঘও যায় উড়ি
আমাদের মঙ্গলবারের মেঘও যায় উড়ি!
বাড়ি ফিরার গানা
কোথায় ছিলাম কনে আলাম
বেগুন তলায় হাট বসালাম
যারে চিনার তারে নাই টানলাম কাছ
ভাই রে, ধরলাম কষে পাকাল মাছ!
ফসকে গেছে দিনের বেলায় যা
কইচড়ির তলে ফোলই ধরা
আমার হইলো না!
সারাদিন তাকাই রলাম
শালার আকাশ ভালোই ছিল
সন্ধ্যেবেলা আন্ধার আইসে
ঢেইকে দিলো!
কোথায় ছিলাম
কনে আলাম
সকল কিছু ভাসা ভাসা
মিছাই তবে আমার আসা!
মাছের দেখা হইলো না
খালি খালই খালিই রইল
মাঝখানতে
বাড়ি ফিরতি দেরি হইল!
কোনতে আমি
কনে ফিরলাম
আমি এক জম্মের কানা
মাঝখানতে ধান্দা করতে
নাই পারলাম
কোনো হিসেব বুঝলাম না!
আব্বা আপনে আসি কয়ে দেন
সন্ধ্যা নামে
রাত নামে
বিকাল ঝাড়ে ডানা
আমার ভিতর নড়ে চড়ে
দুধ-সাদা বাপের কাফন খানা
উঠেন আব্বা শিখায়ে দেন
কোন নিয়তে
কোন দোয়াতে
পাবোনে ত্বরা নতুন ভোর!
আব্বা আপনে আসি কয়ে দেন…
আপনে ছাড়া রঙরা সব
বুঝিনি আগে
হয় তামা।।
রংধনুদের কবর!
একটা নরম বিলাই পাবো
এ জগতের শেষে
সেই লালসে নাচি
সে আশেতে
শজারু কোলে করি
নিত্য বসি আছি!
আব্বা আপনে আসি কয়ে দেন…
বুঝলাম কিনা
টেরাই করি
একটু দেখেন
আমরা পোলাপান
বেহুঁশ কিছু ভ্রম
নিভু নিভু
কাঁদো কাঁদো
অন্তর্ধান
নইলে আমরাও
করবানে ক্রম!
আব্বা আপনে আসি কয়ে দেন…
সন্ধ্যা নামে
লহমা নিড়ায়ে
অখণ্ড একিন
করতেছে ভিড়
জাগতেছে না
যে তিমিরে
ছিলাম আগেই
সেই সে-তিমির!
আব্বা আপনে আসি কয়ে দেন…
আমার আলামত নাই
গোরের মাটির মধ্যে আমারে খুঁইজতে যাইও না
খুঁইজো, বিলফিরা দুপারে ঝিমানো খড়ের গাদার কাছে হাঁসের মইধ্যে
খুঁইজো, দোয়েল-বসা ডালভাঙা অর্জুন গাছের কুয়াশার আগেভাগে ভাঙার আগে
খুঁইজো, গরু বান্ধা কিবলামুখী তালগাছটার কালা কালা চামড়ার তলে
পিপড়াগের চলা ফেরার ভিতর
খুঁইজো, ধানের শীষের মধ্যে আটকা পড়া ঠাণ্ডা বৃষ্টি ফোঁটার নিচের দিকে
খুঁইজো, কলার পাতার তল দি তল দি তায়াম্মুমের মাটির যোগ্য মাটির মইধ্যে
খুঁইজো, আইল ঘাসের মধ্যে আটকা পড়া কারো পায়ের
শব্দে ভীত বাঙের বাচ্চার হাঁপানি জিন্দেগিতে
খুঁইজো, দ্বিপ্রহরে পাতাবাহারের গোড়ায় জিরানো মুরগির বাচ্চাদের চুপচাপে
খুঁইজো, শেষ রাতে কানাকুয়ার ডাকগুলিরে তালাক দেওয়ার সময়ে
খুঁইজো, ঘুঘুর গভীর বনের আড়ালে
খুঁইজো, রসুনের খ্যাতে বোনার একটু আগে
খুঁইজো, সাদা কপড়ের দাদির যোহরের নামাজের সালাম ফিরানোর মধ্যে
খুঁইজো, বোখারী শরীফের ইউসুফের গল্পের ইশারাগুলিতে
খুঁইজো, পাহাড়ে হারানো শেষ পাতিহাঁসের পালকের পরবর্তী উড়ার সম্ভবনার মইধ্যে
আমারে মোটেও খুঁইজো না
কারণ আমি তো কোনোমতেই কোনোদিনই কেহই ছিলাম না!
অলঙ্করণ: জহির হাসান
জহির হাসান
জন্ম: 1969
যশোর জেলায় মাতুলালয়ে
প্রকাশিত কবিতার বই: পাখিগুলো মারো নিজ হৃদয়ের টানে (২০০৩), গোস্তের দোকানে (২০০৭), ওশে ভেজা পেঁচা (২০১০), পাতাবাহারের বৃষ্টিদিন (২০১২), খড়কুটো পাশে (২০১৪), আয়না বিষয়ে মুখবন্ধ (২০১৬) ও আম্মার হাঁসগুলি(২০১৭), বকুলগাছের নিচে তুমি হাসছিলি(2018), আমমার আরও হাঁস(2019)।
অনুবাদ : এমে সেজেরের সাক্ষাৎকার ও আধিপত্যবাদ বিরোধী রচনাসংগ্রহ (২০১১) । সাক্ষাৎকার পুস্তিকা (কবি উৎপলকুমার বসুর সাক্ষাৎকার) : কথাবার্তা (সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৬)