‘গুরু’

।। ফরহাদ মজহার ।।

” শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণী গুরু বলতে বোঝে যিনি গাঁজা খেয়ে ব্যোম ভোলানাথ হয়ে বসে থাকেন, আর তার চারদিকে সেবাদাসীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবার আগে এই ধারণা ভাঙবার চেষ্টা করেছি। নিরক্ষর, উদ্বাস্তু ও উন্মূল সর্বহারা শ্রেণী, যারা আধুনিক কলকারখানায় পুঁজিপতিদের কাছে নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে রাজি না, বরং পাগল বা মাস্তান হয়ে থাকতে রাজি— তারা প্রবল আধুনিকতার হাতে হয়তো সাময়িক পরাজিত। কিন্তু আধুনিক সমাজের কাঠামোগত সন্ত্রাসের বাইরে তারাই নিজেদের স্বাধীন ও মুক্ত জীবনের সাধনা করছে, তারা পুঁজি বা রাষ্ট্রীয় ক্ষ্মতার গোলাম হয়ে জীবনযাপন চায় না। কিন্তু সমাজের ওপর তারা ভরসা হারায় নি। তারা নিজ নিজ গুরু নিয়ে অমূল্য জীবনের পরমার্থ উপলব্ধি ও চর্চার জন্য সাধনা এবং নির্জনে সমাজ গঠনে রত। এটা বুঝতে আমার বেগ পেতে হয় নি। অর্থাৎ সহজেই বুঝেছি নদীয়ার ভাবুকতা বা ‘ফকিরি’ পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সবল প্রতিরোধও বটে। সেই প্রতিরোধের ধরন ও ভাষা ধরতে না পারলে নদীয়ার ভাব বোঝা অসম্ভব। কারণ নদীয়া স্রেফ ডুগডুগি বা, নাচনকুঁদন না—  গাঁজা আর সেবাদাসী তো নয়ই। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই নদীয়া ‘গুরু’ বলতে কী বোঝে সেটা খানিক বোঝাতে হয়েছে। তবে সেটা ছিল বোঝাবুঝির শুরু। বিষয়টি গুরুতর, তাই এখন একটু নোক্তা দিয়ে রাখছি।”

‘গুরু’


ইতরপনা কার্য আমার ঘটে অহর্নিশি
আমারে  কি রাখবেন গুরু চরণদাসী

– ফকির লালন শাহ

নদীয়ার ভাবচর্চায় গুরুর দাসী হওয়া সর্বোচ্চ মনোবাঞ্ছা। অনেকে প্রশ্ন করেন নদীয়ার ভক্তির ধারা ‘দাস্যরস’ বা ‘দাস্য ভাবচর্চাকে সর্বোচ্চ ‘রস’ কিম্বা ভক্তের সর্বোচ্চ পরমার্থিক সাধ গণ্য করে কেন? বিশেষত যারা নিজেদের ‘ফকির’ বলে থাকেন? এর সহজ ও প্রাথমিক উত্তর হোল দুনিয়ায় ‘পুরুষ’ একজন— আর সবাই ‘দাসী’। তাই নদীয়ায় সবাই ‘দাসী’ হতে চায়। জীবনের পরমার্থ সেই ‘এক’-এর দাসত্বে। আরও সিধা কথা হলো,  দাস্য ভাব চর্চাকে নদীয়া ভাবচর্চার সবচেয়ে সরল ও সহজ পথ গণ্য করে। দাস্যভাব চর্চার মধ্য দিয়ে জ্ঞানের গরিমা ও বদ্ধমূল ধ্যানধারণা ভাঙে, ‘ব্যক্তিত্ব’ নাশ হয়, নিজেকে সমষ্টির অন্তর্গত ভাবা সহজ হয় এবং বড় কাজের জন্য নিজেকে তৈরি করার পথ চেনা সম্ভব হয়।  

‘দাস্য ভাব’ রসতত্ত্বের বিষয়। বৈষ্ণব রসতত্ত্ব সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে দাস্য ভাব চর্চার অর্থ সহজে ধরিয়ে দেওয়া কঠিন। প্রথমেই বোঝা দরকার নদীয়ার ভাব রসাত্মক। ভাব রসচর্চা থেকে আলাদা নয়, কিন্তু একাকারও নয়। তাই নদীয়ার ভাব বুঝতে হলে রস আস্বাদন ও ভাবচর্চার ভেদ বিচার জরুরি। নদীয়ার ভাব আর বৈষ্ণব রসতত্ত্বের মধ্যে ঐক্য ও পার্থক্য দুটোই রয়েছে। অধিকারী ভেদে শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর ইত্যাদি যে কোন রসেরই গুরুত্ব নদীয়া মানে। কিন্তু ভাবচর্চার জন্য নদীয়া দাস্যরস বা দাস্যভাব চর্চাকেই প্রশস্ত গণ্য করে।

নদীয়ায় এই তত্ত্বের গোড়ায় নিজেকে ‘আল্লার বান্দা’ বা ‘ঈশ্বরের দাস’ ভাববার প্রভাব রয়েছে, কিন্তু নদীয়ায় এই দাস্যবৃত্তির নিজস্ব বা স্বতন্ত্র রূপ আছে। কারন যে দাসের কথা বলা হচ্ছে সে কোন ঐতিহাসিক ‘দাস ব্যবস্থা’র দাস নয়। যদিও দাস্য শুনলেই আমরা রাজনৈতিক অর্থে দাসব্যবস্থা ভাবতে শুরু করি। এই ক্ষেত্রে নদীয়ার যুক্তি হচ্ছে ‘দাস্য ভাব’  একমাত্র মুক্ত মানুষের পক্ষেই চর্চা করা সম্ভব। যে দাসব্যবস্থার দাস তার পক্ষে দাস্য ভাবের রসগ্রহণ অসম্ভব। যে স্বাধীন ও মুক্ত একমাত্র সেই কর্তার পক্ষেই স্বেচ্ছায় গুরুর দাস হওয়ার রস উপলব্ধি সম্ভব।

নদীয়ার রাজনীতি ব্যক্তিতান্ত্রিক না, আধুনিকদের মতো সমাজ বা সমষ্টির বিপরীতে ব্যক্তি স্বাধীন ও মুক্ত— নদীয়া তা মনে করে না। যে মানুষ আসলেই মুক্ত, সকল প্রকার ইহলৌকিক বন্ধন থেকে স্বাধীন — একমাত্র তার পক্ষেই বোঝা সম্ভব সমাজ বা সমষ্টির বাইরে মুক্তি বা স্বাধীনতার কোন অর্থ নাই। তাই ভাবগত ভাবে সমাজ ও সমষ্টির ‘দাসী’ হওয়া সম্ভব। দাস্য ভাবের চর্চা ব্যক্তি ও সমষ্টির উভয়েরই বিকাশের শর্ত। ব্যক্তির বিপরীতে সমাজ, কিম্বা সমাজের বিপরীতে ব্যক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা নদীয়ার ভাব নয়। বরং উভয়ের বিকাশের জন্যই দাস্যভাব চর্চা জরুরী। সমাজের বাইরে ব্যক্তি হিশাবে ব্যক্তির স্বাধীন সত্তা আছে। কিন্তু তার পরমার্থ সমাজ বাদ দিয়ে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিশাবে গড়ে ওঠা নয়। বরং সমাজকেই ব্যক্তির বিকাশের ক্ষেত্র হিশাবে গড়ে তোলা আমামদের আরাধ্য হওয়া উচিত। ব্যক্তির পরমার্থ সমাজে এবং সমাজের পরমার্থ ব্যক্তির মধ্যে নিহিত।

‘গুরু’ এই ক্ষেত্রে প্রতীকী। তিনি অতীত ধারণ করে অনাগত সমাজের চিহ্ন হয়ে আগাম ‘বর্তমান’। হয়তো নদীয়ার রাজনৈতিক বাসনা এই যে মানুষ যখন সমাজের মধ্যে নিজের বিকাশ ও স্ফূর্তির সম্ভাবনা আবিষ্কার করতে শিখবে তারপর গুরুর আর কোনো ভূমিকা থাকবে না।আমার ‘ভাবান্দোলন’ বইয়ে নদীয়ার ভাবপরিমণ্ডলে ‘গুরু’ কথাটার খুবই প্রাথমিক মানে পরিচ্ছন্ন করবার চেষ্টা ছিল। সম্পূর্ণ না। এখন আরও কিছু নোক্তা পেশ করে রাখছি। পরে বিস্তৃত লিখবার আশা রাখি।।

আমি যেসব পাঠকদের কথা ভেবে ‘ভাবান্দোলন’ লিখেছিলাম তারা মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। বাংলার ভাবচর্চা সম্পর্কে তাদের আগ্রহ আছে। এই আগ্রহের স্ফুর্তি ঘটানো গেলে আমাদের রাজনৈতিক-দার্শনিক বহু জিজ্ঞাসার অভিমুখ সহজে ধরা পড়বে বলে আমার মনে হয়েছে। কিন্তু তাদের চিন্তার ব্যাকরণ, অভ্যাস বা ছকের মধ্যে বাংলার ভাবচর্চা, ঐতিহ্য বা চিন্তাসূত্রের ছিঁটেফোঁটা আবিষ্কার করা কঠিন। ব্যতিক্রম নাই তা নয়, অবশ্যই ব্যতিক্রম আছেন, কিন্তু তাঁরা প্রায় অদৃশ্য অথবা প্রান্তিক। ভাবচর্চায় কিম্বা রাজনৈতিক-দার্শনিক তৎপরতায় আমাদের দাঁড়াবার জায়গাটা ঠিক কোথায় সেটা খুঁজে নিতে হলে এমন স্থান থেকে কথা বলতে হবে যেন সকলে তা শুনতে পারে। সেটাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।

বাংলার ভাবের জগত শিক্ষিতদের জগত নয়। এটা নিম্নবর্ণ, সর্বহারা আর সাব-অল্টার্নদের জগত। নিজের আভিজাত্য ত্যাগ করে সেই জগতে ‘ডোবা’ না গেলে ভাবের ভাষা আয়ত্ব সহজ নয়। ডোবা, ডুবে যাওয়া ছিল তাই আমার নিজের জন্যও বিশাল চ্যালেঞ্জ। আমার নিজের দিক থেকে অতিশয় কঠিন কাজ। নিজের ইগো, অহংকার ও ব্যাটাগিরি ত্যাগ করা কঠিন ব্যাপার। সাধুর জীবনের জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করবার কথা আমরা শুনি।  বিষয়, অর্থ, চাকরি, সংসার ত্যাগ করা সহজ, অকাতরে ত্যাগ খুব কঠিন নয়। স্বার্থপর সমাজ যা নিয়ে খামাখা বাগাড়ম্বর করে তাকে উপেক্ষা বা ত্যাগ করে চলে আসা খুব কঠিন কোন কাজ নয়। উপমহাদেশে ত্যাগের ভুরি ভুরি নজির আছে।

কিন্তু সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে নিজেকে ত্যাগ করা, নিজেকে তুচ্ছ, হীন অর্থহীন ভাবতে শেখা। এই ত্যাগ হীনমন্যতা চর্চার জন্য নয়। নিজের বদ্ধমূল ধারণা, সংস্কার, অনুমান ও সিদ্ধান্ত সকল ত্যাগ করে নতুন করে চিন্তা করবার জন্য সাফ হয়ে যাওয়া। প্রস্তুতি নেওয়া। যা জানিনা সেই না-জানার জগতে আদৌ কিছু আছে কিনা সেটা জানবার ঝুঁকি নিতে পারা খুবই কঠিন কাজ। জীবনের একটা সময় এই প্রকার ত্যাগের একটা উগ্র বাসনা ভর করেছিল। সেই বাসনাকে বাড়তে দিয়েছি। কিন্তু ত্যাগ করতে গিয়ে টের পেয়েছি পেছনে ফিরে তাকানোর অভ্যাস পরিত্যাগ করাও ছিল দুঃসহ কাজ।

নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে ফকির লবান শাহকে ভক্তের সেবা ও ভক্তি প্রদান, ২০০৮।

ছেঁউড়িয়া ভাবান্দোলনের টাঁকশাল। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখতাম ছেঁউড়িয়ায় যারা যান, তারা কই ঠিক ‘ছেঁউড়িয়া’তে তো যান নি! তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবানরাও দেখি লালন বা ফকিরদের ব্যাপারে যতোটা না আগ্রহী তারচেয়ে অধিক আগ্রহ অন্যত্র। তরুণদের আগ্রহ রোমাঞ্চে, তৎসঙ্গে গাঁজা বা নেশাদ্রব্যে। দোষ দেবার জন্য বলছি না। এখানে দোষ খোঁজার বাহাদুরি দেখাবার দরকার নাই। জীবন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার, শ্রীচৈতন্যের ভাষায় নিজেকে নিজে ‘আস্বাদন’ করবার চেষ্টা। নিজের মজা নিজে লুটতে পারা দুর্দান্ত কাজ। কয়জনই বা তা পারে! তরুণরা নতুন অভিজ্ঞতার জন্য আকৃষ্ট হবেই।  মুশকিল হচ্ছে নিরানব্বই দশমিক নিরানব্বই ভাগ গাঁজা আর নেশা দ্রব্যে নিজেকে শৃঙ্খলিত করবার মধ্যে আনন্দ খোঁজে। শৃংখলিত হবার পর আর ফিরে আসতে পারে না। মুক্ত হবার জন্যই ঘরের বন্ধন ত্যাগ করে যে একদা বার হয়ে পড়েছিল, গাঁজা আর নেশা দ্রব্য দিয়েই নিজেকে সে আবার বেঁধে ফেলল।

এরকম ভূরি ভূরি আমি দেখেছি।

কিন্তু তারপরও মানতে হবে তরুণরা যথার্থই ফকির লালন শাহ ও নদীয়ায় আগ্রহী। এই লেখাটিও প্রধানত তরুণদের জন্যই। তবে তারা যদি  আর কিছু না হোক ‘হিতকরী পত্রিকায় ‘মহাত্মা লালন ফকীর’ নিবন্ধটি পড়তেন তাহলে দেখতেন সেখানে পরিষ্কার বলা আছে:

“সম্প্রতি সাধুসেবা বলিয়া এই মতের এক নূতন সম্প্রদায় সৃষ্টি হইয়াছে…। সাধুসেবা ও বাউলের দলে যে কলংক দেখিতে পাই , লালনের সম্প্রদায়ে সে প্রকার কিছু নাই। আমরা বিশ্বস্তসূত্রে জানিয়াছি সাধুসেবায় অনেক দুষ্ট লোক যোগ দিয়া  কেবল স্ত্রীলোকদিগের সহিত কুৎসিৎ কার্যে লিপ্ত হয় এবং তাহাই তাহাদের উদ্দেশ্য বলিয়া বোধ হয়। মতে মূলে তাহার সহিত ঐক্য থাকিলেও এ সম্প্রদায়ের তাদৃশ ব্যভিচার নাই। পরদার ইহাদের পক্ষে মহা পাপ” (হিতকরী, ১৫ কার্তিক ১২৯৭/৩১  অক্টোবর ১৮৯০)।

অর্থাৎ ‘সাধুসেবা ও বাউলের দলে’ যেসব দেখা যায় মহাত্মা লালনের অনুসারীদের মধ্যে তা নাই।  লালন নিজেকে কখনই ‘বাউল’ বলেন নি। ‘বাউল’, বা ‘বাউল দর্শন’ ইত্যাদি শুধু চর্চার দিক থেকে নয়, তত্ত্বগত ভাবে নানান বিকৃতিতে পর্যবসিত হয়েছে। এই সকল বাউল তত্ত্বে ‘তন্ত্র’, রসতত্ত্ব’ কিম্বা ‘ভাব’ ইত্যাদির কোন বিচার দেখা যায় না। বোঝাবুঝির কোন চেষ্টাও নাই। সেই বিচার ও চেষ্টা না থাকলে লালন বা ফকিরদের ভাবচর্চা বোঝা অসম্ভব।

‘তন্ত্র’ বলতে আমরা এখন যা বুঝি তার পর্যালোচনা ও বিরোধিতার মধ্য দিয়েই চৈতন্যের আবির্ভাব ঘটেছিল, কিন্তু চৈতন্যের আবির্ভাব তন্ত্রের তত্ত্বগত সারার্থ বাদ দিয়ে নয়। আমরা যাকে ‘আমি’ বলি তিনি দেহ হয়েই বর্তমান থাকেন, কিন্তু ‘আমি’, ‘আত্মা’, ‘ব্রহ্ম’ বা ‘ঈশ্বর’ দেহমাত্র নন। দেহ তাঁর আবাস মাত্র। চৈতন্যের চরণচিহ্ন অনুসরণ করে ফকিরও দেহবাদী। চৈতন্য নদীয়ার প্রথম ফকির। এই কথাটাই সহজে বোঝাবার জন্য বলা হয় আমার শরীরেই ঈশ্বরের বাস। কিম্বা মানুষের মধ্যেই আল্লাহ বিরাজ করেন। ‘

এই ‘আমি’ মানে বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ কোন ‘আমি’ না। এই আমি সেই এক বা অখণ্ডেরই অংশ। কিন্তু তিনি যদি এক বা অখণ্ড হয়ে থাকেন তাহলে তিনি খণ্ড খণ্ড আমি হয়ে নিজেকে ব্যক্ত করেন কেন? এর উত্তর আমরা সৈয়দ সুলতানের ‘জ্ঞানচৌতিসা’তে পাই। সুলতান বলছেন, তিনি অখণ্ড তাই তিনি খণ্ড খণ্ড থাকলেও তিনি অখণ্ডই থাকেন। তিনিই জগত হয়ে লীলা করছেন। আমরা তাঁর ‘অংশকারী’ মাত্র

খণ্ডিলে খণ্ডন নাহি সেই অখণ্ডন
খণ্ড খণ্ড হয়ে আছে তেঁই সেকারণ।


আমার দেহ এবং আমার ‘আমি’ কিভাবে যুগলে বাস করেন কিম্বা পুরুষ ও প্রকৃতি কিভাবে দুই নয় ‘এক’ – সেই তত্ত্ব উন্মোচনের দরকারে চৈতন্যের আবির্ভাব ঘটেছিল। কিন্তু দুইয়ের মধ্যেও ভেদ আছে। এই ভেদ ও অভেদ আস্বাদনের জন্য চৈতন্য নদীয়ায় এসেছিলেন। যদি তাঁদের মধ্যে একই সঙ্গে ভেদ ও অভেদ থাকে তাহলে তার বিচার হবে কিভাবে? চৈতন্য বলেছিলেন সেটা সম্ভব না। সেই সম্পর্কের বিচার ‘অচিন্ত্য’ — সেটা চিন্তার অতীত। চৈতন্যের দর্শনের নাম তাই ‘অচিন্ত্যভদাভেদবাদ’। চিন্তার দ্বারা সেই ভেদ বা অভেদ বোঝার সাধ্য জীবের নাই।

কিন্তু লালন চৈতন্যকে এই ক্ষেত্রে মানলেন না। বললেন, পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদ ও অভেদ বোঝার সাধ্য মানুষের অবশ্যই আছে। রসতত্ত্বে আমরা যে রস ‘আস্বাদন’ করি, তাকে আমরা জাগতিক বা ‘বর্তমান’-ও করি। সেটা করি আমাদের ভাবে এবং করণকর্মে। আল্লাহ যেমন রসবৃত্তির বিষয়, তেমনি তিনি সদাই ‘বর্তমান’ । নদীয়ার ফকিরিতে অনুমানের কোন স্থান নাই। ফকির অনুমানে আস্থা রাখে না। আল্লাহ বর্তমান, কারন আমি আছি, জগতও আছে। অতএবে তিনিও আছেন। তাই অনুমানে নয়, নিজেকে বর্তমানে জারি রাখাই ফকিরের সাধনা। লালন অচিন্ত্যভেদাভহেদবাদের নতুন পর্যালোচনা হাজির করলেন। তাঁর প্রকৃতি-পুরুষ ভেদবিচার তন্ত্র বা প্রকৃতি-পুরুষ তত্ত্বকে অস্বীকার করে নয়, বরং প্রাচীন জিজ্ঞাসাকে ধারণ ও বিচারের মধ্য দিয়েই নদীয়ার ভাবচর্চার ধারা গড়ে উঠেছে।

তাহলে লালন স্রেফ বিরোধিতার জন্য তন্ত্র কিম্বা রসতত্ত্বের বিরোধী নন। কারন তন্ত্র ও রসতত্ত্ব বাংলার ভাবচর্চার বেড়ে ওঠার ইতিহাস। কিন্তু লালনকে ‘তান্ত্রিক’ বানাবার সমূহ বিপদ আছে। সেটা ভুলও বটে। কারণ তিনি তান্ত্রিক নন, আবার বৈষ্ণবও নন। তিনি ‘ফকির’। ঠিক যেমন চৈতন্যকে তান্ত্রিক প্রমাণ করবারও কোন অর্থ নাই কারণ রসতত্ত্ব মূলত তন্ত্রেরও পর্যালোচনা। যদি আমরা বড় বাংলাকে বুঝতে চাই তাহলে বিভিন্ন সাধনার ধারা কিভাবে বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে তার ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে হবে। তন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে আমাদের প্রবেশ করে বুঝতে হবে কিভাবে আমরা তন্ত্র থেকে রসে এবং রস থেকে ভাবের যুগে প্রবেশ করেছি। এই প্রবেশের অর্থ তন্ত্র বা রস ত্যাগ করে আসা নয়, বরং ভাবের শক্তিশালী পরিমণ্ডলে দাঁড়িয়ে মানুষকে নতুন ভাবে ভাবে ভাবতে ও ভাবাতে শেখা। আমরা সহজ মানুষের যুগে প্রবেশ করেছি।

তাহলে আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে লালন এবং তাঁর অনুরাগীদের সম্পর্কে যেসকল ভুল ও বিকৃত ধারণার প্রচলন রয়েছে তাকে নস্যাৎ করা। ইসলামের দাবিদার এক ধরণের আলেম-ওলেমা রয়েছে যারা সারাক্ষণই লালন ও বাউলদের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করে বেড়ায়। তারা ‘বাউল’ হওয়া বা বাউলগিরি দেখে ভাবে লালনও ‘বাউল’। লালনের বিরোধিতা করবার জন্য তারা বাউল এবং বাউল দর্শন সম্পর্কে প্রচলিত মত ও চর্চার ধরণকে নিন্দা করে। বাউলদের ক্ষেত্রে তাদের নিন্দা অনেক ক্ষেত্রে যথার্থ। কিন্তু তারা জানেনই না যে লালন ‘বাউল’ নন। তিনি নিজেকে কোথাও ‘বাউল’ বলেন নি। কিন্তু অধিকাংশ বাউল বিরোধী মওলানা ও আলেমদের যুক্তি অদ্ভূত। সেটা এরকম: লালন একজন বাউল, বাউলেরা গাঁজা খায় এবং নানাবিধ নারীঘটিত অপকর্ম করে, অতএব ‘বাউল সম্রাট’ লালনও খারাপ। লালনকে ‘বাউল সম্রাট’ বলে সরকারি লালন একাডেমি। অথচ নদীয়ার ভাবকে বাউলগিরি ভাববার কোন সুযোগ নাই।

এখানে বলে রাখা ভাল, ফকিরদের কাজ হচ্ছে পথহারাদের জন্য ‘জায়গা’ নিশ্চিত রাখা। ফকিরের দরবারে কে পাপী কে পূণ্যবান সেটা বিচার্য নয়। ফকিরের দরবার বিচারালয় নয়, বরং ফকিরের দরবার ব্যক্তির নিজেকে নিজে বদলে নেওয়ার শক্তি বা হিম্মত অর্জনের জায়গা। আখড়ার পরিবেশ মানুষকে বদলাবার জন্য। নিজের ইগো ও অহংকার ত্যাগ করে সহজ মানুষের সন্ধানের প্রতি ব্যক্তির আকুতি তৈরি করা ফকিরদের কাজ। ছেঁড়িয়ার আশপাশে গাঁজার আসর আছে। প্রশাসন এদের টিকিয়ে রাখে কারন গাঁজা একটা ব্যবসা, ঠিক যেমন বিড়ি-সিগ্রেট বা অন্য যে কোন নেশা দ্রব্য টিকে আছে ব্যবসায়িক কারনে। কিন্তু গাঁজা বা নেশাদ্রব্যের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আলেমদের কোন শক্তিশালী আন্দোলন আমরা দেখি না। বরং তাদের আক্রমণ লালন ও ফকিরদের বিরুদ্ধে।

আমাদের শুরুর কাজ হচ্ছে ‘নদীয়ার ভাব’ পরিমণ্ডলকে যথা সম্ভব তুলে আনা, দৃশ্যমান করে তোলা। তারপর তাকে বর্তমান করে তোলা সম্ভব কিনা পরখ করে দেখা। নদীয়ার অনুমান ও সিদ্ধান্ত সকল পর্যালোচনা করা। যে পর্যালোচনার ওপর দাঁড়িয়ে পাশ্চাত্য চিন্তা এবং বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে বা বাংলার ভাবচর্চার ধারা পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে ভিন্ন ভাবে আমরা ‘মানুষ’ এমং মানুষের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের ভবিষ্যত (Planetary) নিয়ে ভাবতে পারি। জলবায়ু বিপর্যয়ের কালে গ্রহীয় বা প্লানেটারি বিপর্যয় নিয়ে কথা বলা একালে দস্তুর।

তাই চেষ্টা করেছি নদীয়া যে আসলে ভাবের জায়গা, স্রেফ বাউলগিরি, গাঁজা খাওয়া কিম্বা স্ববাদাসীর ব্যাপার না সেটা খানিকটা বোঝানো। চিন্তার চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্র হিশাবে নদীয়ার ভাব যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন ভাবে হাজির করা। নদীয়ার ভাবচর্চার ক্ষেত্র যতো স্পষ্ট করা যায় ততোই আমরা চিন্তার সদর রাস্তা খুঁজে পাব। সেই জন্য নদীয়া ‘গুরু’ বলতে কী বোঝে সে সম্পর্কে ভাবান্দোলনে প্রাথমিক আলোচনা করতে হয়েছে।

‘হিতকরী পত্রিকায় ‘মহাত্মা লালন ফকীর’ নিবন্ধটি পড়তেন তাহলে দেখতেন সেখানে পরিষ্কার বলা আছে , “সম্প্রতি সাধুসেবা বলিয়া এই মতের এক নূতন সম্প্রদায় সৃষ্টি হইয়াছে…। সাধুসেবা ও বাউলের দলে যে কলংক দেখিতে পাই , লালনের সম্প্রদায়ে সে প্রকার কিছু নাই। আমরা বিশ্বস্তসূত্রে জানিয়াছি সাধুসেবায় অনেক দুষ্ট লোক যোগ দিয়া  কেবল স্ত্রীলোকদিগের সহিত কুৎসিৎ কার্যে লিপ্ত হয় এবং তাহাই তাহাদের উদ্দেশ্য বলিয়া বোধ হয়। মতে মূলে তাহার সহিত ঐক্য থাকিলেও এ সম্প্রদায়ের তাদৃশ ব্যভিচার নাই। পরদার ইহাদের পক্ষে মহা পাপ” (হিতকরী, ১৫ কার্তিক ১২৯৭/৩১  অক্টোবর ১৮৯০)। অর্থাৎ ‘সাধুসেবা ও বাউলের দলে’ যেসব দেখা যায় মহাত্মা লালনের অনুসারীদের মধ্যে তা নাই।

গুরু বলতে শিক্ষত মধ্যবিত্তশ্রেণী বোঝে যিনি গাঁজা খেয়ে ব্যোম ভোলানাথ হয়ে বসে থাকেন, আর তার চারদিকে সেবাদাসীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবার আগে এই ধারণা ভাঙবার চেষ্টা করেছি। নিরক্ষর সর্বহারা উদবাস্তু ও উন্মূল সর্বহারা শ্রেণী যারা আধুনিক কলকারখানায় পুঁজিপতিদের কাছে নিজেদের শ্রম বিক্রি করতে রাজি না, বরং পাগল বা মাস্তান হয়ে থাকতে রাজি— তারা প্রবল আধুনিকতার হাতে হয়তো সাময়িক পরাজিত। কিন্তু আধুনিক সমাজের কাঠামোগত সন্ত্রাসের বাইরে তারাই নিজেদের স্বাধীন ও মুক্ত জীবনের সাধনা করছে, তারা পুঁজি, রাষ্ট্রের গোলাম হয়ে জীবনযাপন চায় না। কিন্তু সমাজের ওপর তারা ভরসা হারায় নি। তারা নিজ নিজ গুরু নিয়ে অমূল্য জীবনের পরমার্থ উপলব্ধি ও চর্চার জন্য সাধনা ও নির্জন সমাজ গঠনে রত। এটা বুঝতে আমার বেগ পেতে হয় নি। অর্থাৎ সহজেই বুঝেছি নদীয়ার ভাবুকতা বা ‘ফকিরি’ পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সবল প্রতিরোধও বটে। সেই প্রতিরোধের ধরন ও ভাষা ধরতে না পারলে নদীয়ার ভাব বোঝা অসম্ভব। কারণ নদীয়া স্রেফ ডুগডুগি বা, নাচনকুদন না—  গাঁজা আর সেবাদাসী তো নয়ই। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই নদীয়া ‘গুরু’ বলতে কী বোঝে সেটা খানিক বোঝাতে হয়েছে। তবে সেটা ছিল বোঝাবুঝির শুরু। বিষয়টি গুরুতর, তাই এখন একটু নোক্তা দিয়ে রাখছি।

একালে ‘তন্ত্র’ নামে গুহ্য কায়কারবারের কথা ঢাকা শহরে দীর্ঘকাল ধরেই বলাবলি হচ্ছে। আহমদ শরীফের ‘বাউল দর্শন’ পড়েছেন অনেকেই। এদের লেখালিখি বলাবলি ভাল করে শুনলে বোঝা যায় ’বাউল’ তাদের কাছে একটা বাসনাময় ‘ফিগার’ বা রূপকাল্পনিক নির্মাণ। এই ফিগারের মধ্যে এক শ্রেণীর শহুরে মধ্যবিত্তের অবদমিত কামলিপ্সা ও গুপ্ত বাসনা পাঠ করা যায়। শ্রেণী বিচারের জন্য সেটা দরকারি। কিন্তু সেটা ‘তন্ত্র’ না। দেহতত্ত্ব বললে অধিকাংশই যৌনসম্ভোগ বোঝে। তন্ত্রের দার্শনিক অনুমান, ভিত্তি, চর্চা, ঐতিহ্য বা ইতিহাস সম্পর্কে  সুস্পষ্ট ধারণা ছাড়া বাংলার ভাবান্দোলনের সঙ্গে দেহের সম্বন্ধ বোঝা কঠিন। যারা ইন্টারনেটে Tantra লিখে সার্চ দিয়ে যা দেখেছে ও পড়েছে তাদের বাংলার সাধনার ধারা সম্পর্কে বিশেষ ধারণা হবে না। তন্ত্রকে তার এক প্রকার যৌন ক্রিয়া পদ্ধতি বুঝবে। তাদের পক্ষে নদীয়ার ভাব বোঝা কঠিন বটে।

অথচ বাংলার ভাবান্দোলনের ইতিহাসকে তন্ত্র বা দেহের বিচার থেকে আলাদা করা অসম্ভব। আমরা তন্ত্র বলতে এখন যা বুঝি সেটা না। আমাদের ভাবের জগতে রেনে দেকার্তে নামক কোনো দার্শনিক আসেন নি, যিনি দাবি করেছেন দেহের চিন্তাশীল কর্তাই সত্য কারণ তিনি চিন্তা করেন, সেই চিন্তাকে সন্দেহ করা যায় না, ইত্যাদি।  চিন্তাই সত্য, দেহ বা শরীর না— এই দেকার্তীয় অনুমান মাথায় বদ্ধমূল করে রাখলে নদীয়ার ভাব বোঝা যাবে না। এটা নদীয়ার ভাব না। কারন চিন্তা হাওয়ায় বাস করে না। তার আবাস চাই। দেহ চিন্তার আবাস। তাহলে দেহের বিচার ছাড়া আমাদের নিজ নিজ দেহে যে ‘আমি’ বাস করেন তাকে চিনব কী করে? 

আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তার কারণে তন্ত্র সম্পর্কে আমাদের চিন্তার দুর্গতি ঘটেছে বিপুল। অথচ দেহতত্ত্ব মানে আমাদের ‘আমি’ কিভাবে শরীরের মধ্যে বাস করে সেই সম্বন্ধ বিচার। নদীয়া মনে করে এই শরীর যে শুধু মানুষের দেহ, তা না। পুরা জগত বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই আমাদের শরীর বা দেহ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যেই ‘সহজ মানুষ’ বাস করে, আর মানুষের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে নিজে জানেন এবং ‘আস্বাদন’ করছেন। আমরা যা জানি তা আমাদের শরীর আছে বলে জানি। যাহা ভাণ্ড তাহাই ব্রহ্মাণ্ড। আমরা জগত থেকে আলাদা কিছু না। বলা বাহুল্য এগুলো খুবই প্রাথমিক আলাপ।

বাংলার ভাবান্দোলনের ইতিহাসকে তন্ত্র বা দেহের বিচার থেকে আলাদা করা অসম্ভব। কিন্তু আমরা তন্ত্র বলতে এখন যা বুঝি সেটা না। আমাদের ভাবের জগতে রেনে দেকার্তে নামক কোনো দার্শনিক আসেন নি, যিনি দাবি করেছেন দেহের চিন্তাশীল কর্তাই সত্য কারণ তিনি চিন্তা করেন, সেই চিন্তাকে সন্দেহ করা যায় না, ইত্যাদি।  চিন্তাই সত্য, দেহ বা শরীর না— এটা নদীয়ার ভাব না। চিন্তা হাওয়ায় বাস করে না। দেহ তার আবাস। তাহলে দেহের বিচার ছাড়া আমরা আমাদের নিজ নিজ দেহে যা ‘আমি’ বাস করেন তাকে চিনব কী করে? 

‘সাধুসঙ্গ’ বলতে নদীয়া যেটা বোঝে সেটা আধুনিকেরা সামষ্টিক জ্ঞানচর্চা বলতে যেভাবে ‘সেমিনার’ বোঝে, এখানেও তাই। আজকাল সাধুসঙ্গ বলতে বাউলিয়া গানের আসর বসে। একে সাধুসঙ্গ বলে না। নদীয়ার ফকিরদের বাদশাহী শ্রুতি ও কন্ঠের সাম্রাজ্যে– বই বা ছাপাখানার জগতে তারা বিশ্বাসী না। কারণ, তারা গ্রন্থ ও শাস্ত্র বিরোধী। গ্রন্থ রক্তমাংসের মানুষকে গৌণ করে দেয়। নদীয়া বইপুস্তক, ছাপা গ্রন্থ বা যা কিছুই সার্বজনীন ও চিরায়ত সত্যের দাবি করে তার ঘোর বিরোধী। এর সহজ যুক্তি হচ্ছে গ্রন্থ নিজের ব্যাখ্যা নিজে করতে পারে না, ব্যাখ্যা করে জীবন্ত মানুষ, কিম্বা যিনি বই পড়েন তিনি। তাহলে বই বা গ্রন্থপূজা করার কোনো যুক্তি নাই, ভজনা করতে হবে জীবন্ত মানুষকে। কারণ মানুষই কথা বলে মানুষের মধ্য দিয়েই নতুন চিন্তা, নতুন ভাব, নতুন কল্পনা এবং যুগের আদর্শের উদয় ঘটে। একমাত্র জীবিত মানুষের পক্ষেই প্রথাগত, বদ্ধমূল বা বিদ্যমান চিন্তার পাথর ভেঙে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই গুরু ভজনা ব্যাপকার্থে মানুষ ভজনার ধারণা থেকে আলাদা না। গুরু জীবন্ত, তিনিই তাঁর আগে কিম্বা বর্তমানে হাজির সকল বাক্যের অর্থ প্রদানকারী।

ভক্তি। নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি। ছেঁউড়িয়া। কুষ্টইয়া। ২০০৮।

তাই ভাবের ভাষা আয়ত্ব না করলে গুরুগোঁসাইদের কথা বোঝা প্রায় অসম্ভব। শিক্ষিতদের শিক্ষার গরিমা ভেঙে সহজ সরল ভাবে ভাষার সচ্চিদানন্দ মূহূর্ত আবিষ্কার করা কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ। সম্ভবত কবিরা কাব্যপ্রতিভার গুণে ভাষার কায়কারবার সম্পর্কে কিছুটা অবহিত থাকেন। তবে নদীয়ার ভাবের অতি সাধারণ বা দৈনন্দিনের শব্দ, ধারণা, প্রত্যয় বা বিভিন্ন বর্গের তাৎপর্য বোঝাবুঝি দীর্ঘ পরিশ্রম ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

তবে একটা দিক আমি আলোচনা করবার ফুরসত পাই নি, সেটা অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন, কিন্তু আমি উত্তর দিলেও তাঁরা বুঝতে পারেন না। সেটা হলো, গুরু কি শিক্ষক? শিক্ষা দেওয়াই কি তাঁর কাজ? নদীয়ায় এর সুস্পষ্ট উত্তর হচ্ছে, না। গুরু মানে শিক্ষক না। কিন্তু কেন?

নদীয়ার ফকিরদের বাদশাহী শ্রুতি ও কন্ঠের সাম্রাজ্য– বই বা ছাপাখানার জগতে তারা বিশ্বাসী না। কারণ, বিরোধী। গ্রন্থ রক্তমাংসের মানুষকে গৌণ করে দেয়। নদীয়া বইপুস্তক, ছাপা গ্রন্থ বা যা কিছুই সার্বজনীন ও চিরায়ত সত্যের দাবি করে তার ঘোর বিরোধী। এর সহজ যুক্তি হচ্ছে গ্রন্থ নিজের ব্যাখ্যা নিজে করতে পারে না, ব্যাখ্যা করে জীবন্ত মানুষ, কিম্বা যিনি বই পড়েন তিনি। তাহলে বই বা গ্রন্থপূজা করার কোনো যুক্তি নাই, ভজনা করতে হবে জীবন্ত মানুষকে। কারণ মানুষই কথা বলে মানুষের মধ্য দিয়েই নতুন চিন্তা, নতুন ভাব, নতুন কল্পনা এবং যুগের আদর্শের উদয় ঘটে। একমাত্র জীবিত মানুষের পক্ষেই প্রথাগত, বদ্ধমূল বা বিদ্যমান চিন্তার পাথর ভেঙে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই গুরু ভজনা ব্যাপকার্থে মানুষ ভজনার ধারণা থেকে আলাদা না। গুরু জীবন্ত, তিনি তাঁর আগে কিম্বা বর্তমানে হাজির সকল বাক্যের অর্থ প্রদানকারী।

প্রথমত, শিক্ষা বলতে আমরা যা বুঝি সেটা হলো এমন এক মতাদর্শিক চর্চার জায়গা যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনরা তাদের মতো করে মানুষের মন বানায়, যেন জনগণ তাদের অনুগত থাকে। এর জন্য অনেক দার্শনিক শিক্ষাকে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রের মতার্শিক হাতিয়ার বলে গণ্য করেন। মিলিটারি, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থার মতো এটাও আধুনিক রাষ্ট্রের অঙ্গ। দ্বিতীয়ত শিক্ষার নামে যা চর্চা হয় সেটা হলো শিশুর ‘অ-শিক্ষিত’ বা কাঁচা মনগুলোর মধ্যে এমন সব কামনা বাসনা তৈরি করা যেন শিক্ষার্থী বিদ্যমান ভোগী সমাজের অন্তর্গত হতে পারে। গোলাম ও ভোগীদের সমাজের অন্তর্ভূক্ত করাকেই শিক্ষা বলা হয়। প্রতিটি মানুষ যে সকল অনন্য বৃত্তি, সম্ভাবনা ও প্রতিভা নিয়ে মায়ের পেট থেকে আসে আধুনিক শিক্ষার কাজ হচ্ছে তাকে নষ্ট করে দেওয়া। মানুষ তখন একটা কারখানায় পয়দা হওয়া পণ্য সামগ্রীর মতো শিক্ষালয় নামক কারখানা থেকে একই মানসিক মাপজোক নিয়ে বেরোয়। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার কাছে সে তার ‘মহাজনের পুঁজি’ খুইয়ে আসে।

তাহলে নদীয়ার ‘গুরু’ আর যাই হোক তথাকথিত ‘শিক্ষক’ না। নদীয়া মনে করে প্রতি মানুষেরই কিছু অনন্য গুণ আছে, এমন কিছু সম্ভাবনা আছে যার সাধারনীকরণ চলে না। আমরা প্রত্যকেই অনন্য, আমাদের সম্ভাবনাও বিভিন্ন। মানুষের সমাজ মানে এই বৈচিত্র্যের সমাজ, যেখানে সকলের মধ্যে দিয়ে ‘এক’ অনন্তকাল ধরে বয়ে যাচ্ছে:

একে বহে অনন্ত ধা্রা
তুমি আমি নাম বেওয়ারা
 ভবের পরে।।

সাধুসঙ্গ। সাধুগুরুদের সঙ্গে লেখক। নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি। ২০০৮।

গুরুর কাজ তাহলে দুইটা। প্রথমত আধুনিক জ্ঞানের গরিমা, অহংকার ও নিগড় থেকে শিশুকে মুক্তি দেওয়া যেন শিষ্য নিজের মাধুর্য, অনন্যতা এবং সম্ভাবনা বুঝতে পারে এবং এই গর্বটুকু বোধ করে যে তাকে ছাড়া তার ‘সমাজ’ অপূর্ণ। তার মধ্য দিয়ে ‘সমাজ’ বর্তমান থাকে এবং সকলের মধ্যেই তার বৃত্তি, অমন্যতা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটে।

নিজেকে একই সঙ্গে ‘সকল’ বলে ভাবতে পারা এবং সকলকে নিজের মধ্যে ধারণ করার মধ্য দিয়ে বিদ্যমান জ্ঞানশৃঙ্খলার নিগড় ভেঙে দেওয়া গুরুর কাজ। গুরু তাই নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়ে থাকেন, তিনি শিষ্যের বাইরের ভূয়া ব্যক্তিত্বের আচ্ছাদন ভাঙবার চেষ্টা করেন সবার আগে। যেন আমাদের মধ্যে যে শিশুটি মায়ের গর্ভে বসে ছিল তাকে তিনি আবার জননী গর্ভে ফিরিয়ে নিতে পারেন। যেন শিষ্যের আবাব্র নতুন জন্ম ঘটে, জগৎ আবার নতুন করে শুরু হতে পারে।

গুরু নতুন জন্ম দান করেন। তাই তিনি নবজন্মদাতা।

ইতরপনা কার্য আমা ঘটে অহর্নিশি
আমারে কি করবেন গুরু চরণদাসী।

গৌরপূর্ণিমা, নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি, ২০১৭

৯ অগাস্ট ২০২২। শ্যামলী

ফরহাদ মজহার

কবি, চিন্তক, বুদ্ধিজীবী ও কৃষক। ‘প্রতিপক্ষ’ ও ‘চিন্তা’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। জন্ম: ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশের নোয়াখালি জেলায়। পড়াশুনা করেছে ওষুধ শাস্ত্র ও অর্থনীতি বিষয়ে যথাক্রমে ঢাকা ও নিউইর্কে। পেশা সূত্রে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশের ‘নয়াকৃষি আন্দোলন’-এর প্রধান সহযোদ্ধা। লালন ধারা-সহ বৃহৎ বঙ্গের ভাবান্দোলন পরম্পরার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সমাজ ও রাজনীতি চিন্তা এবং দার্শনিক বিষয়ে বহু গদ্য রচনা করেছেন। এছাড়াও লিখেছেন নাটক। অনুবাদও করেছেন।

Share