কবিতা অধরা গলিতে রহেন!

কবিতা ভাবনা

।। জহির হাসান ।।

চিন্তার পূর্ণ প্রকাশের অংশ হিসাবে ভাষা ও নীরবতা পরস্পর কাজ করে। বাক্যের লিমিট শেষ হইলে নীরবতার লিমিট শুরু হয়। কবিতা সেই ভাষা-নীরবতার নো-ম্যানস ল্যান্ডে আসন পাতে।

কবিতা তাই সদা সীমালঙ্ঘনের একখান ঘটনা।

১.

কবিতা ভাষার না চিন্তার অনুগত নাকি তৃতীয় বা চতুর্থ কিছুর অনুপ্রেরণায় নিজেরে হাজির করে ঘুরিফুরি ভাষারই ভিতর? চিন্তা বা অন্তর্দৃষ্টি তাকায়ে রয় ভাষার দিকে। কবিতা ভাষায় নিজেরে প্রচার করে। কিংবা ভাষার কী রূপ ধরিলে আমরা তারে ‘কবিতা’ নামে তারে ডাক পাড়ি।

চিন্তা বা অন্তর্দৃষ্টির পেছনে ও কে আকুতি প্রকাশ করে? আকুতি প্রকাশকারী একটা নাম চায় নিজের। সে কভু পায় না! তখন সর্বনামে প্রচার পায়। সে সর্বনামে প্রচার হইতে গিয়া মওতের শামিল হইতে চায় না।

তাই সে নিজের কোনোমতে একটা নাম চায় যারে বিশেষ কওয়া যায়। নামপদের সর্বনাম পর্যবসিত হইলে অস্তিত্বের যে অবসান, নামহীনতার নিয়তি তৈয়ার হয়। আকুতি প্রকাশকারী একজন কেউ-না রূপে বিরাজ করে। তবু সে পায় না সেই নাম। সে কভুই একখান নাম পায় না। যা পায় তা সান্ত্বনার লাগি পায়। এইটা তার নাম না! তাই সে ঠিকানাহীনতায় ভোগে চিরকাল। ঘরহীনতার ঘোর না কাটে! তাই আকুতিই এক বহুল রস তার কাছে। সে না থাকলেও যেন সে-ই রস রয়! সেই জৈব সর্বনামের কাছে। যেন ‘আমি’ রূপে সামান্য আসি শাসন করে, বিশেষরে নিঃশেষ করি ছাড়ে। যেন কোনো বিশেষই নাই জগতে! এর পরের ধাপ জৈবসত্তার নিজের একটা আমির দরকার হই পড়ে। কিন্তু সে তাও পায় না! নিয়তি প্রবর্তিত এক সামান্য ‘আমি’র অধীন রইতে হয়। তার স্বাধীন কোনো আমি নাই। এই পরিস্থিতিতে তার দরকার হই পড়ে হুযুনময় অধ্যাত্মের। এই জটিল অবস্থা প্রকাশের লাগি কবিতায় মেটাফরের হাজিরা আপাত জ্বর ও জরার প্রকোপ কমায়!

২.

আবার অন্য একটা চিন্তা কাজ করে আমার ভিতর। ভাবি যে ভাষার একটা মেটাফিজিক্যাল নেচার আছে। ভাষায় হাজির হয় যে অভিজ্ঞান কবিতা রূপে তা বহুকাল পরে ক্ষয় ও জ্বরার প্রকোপে ইনটেনসিটি হারায়ে ফেলে। তখন ভাষা যেন চালুনির মতো। চালুনি দিয়া যেমন পানি ধরা সম্ভব না, ভাষা দিয়া যেন কবিতারেও ধরা সম্ভব না। কবিতা যেন অধরা কেবলি ভাষার বাইরে গিয়া পরমের মতো আমাদের মন বুঝতে চায়। ভাষায় যুক্তির সীমা পর্যন্ত প্রকাশ সম্ভব হয়, অযৌক্তিক অসম্ভব অংশ নীরবতা।

চিন্তার পূর্ণ প্রকাশের অংশ হিসাবে ভাষা ও নীরবতা পরস্পর কাজ করে। বাক্যের লিমিট শেষ হইলে নীরবতার লিমিট শুরু হয়। কবিতা সেই ভাষা-নীরবতার নো-ম্যানস ল্যান্ডে আসন পাতে।

কবিতা তাই সদা সীমালঙ্ঘনের একখান ঘটনা।

কবিতায় শরীরের উপস্থিতি ঘটে দৈনন্দিন এই মমতামাখা কঠিন জগৎ ও তার প্রহেলিকার হাজিরার মধ্যে- সূক্ষ্ম ও স্থূলের সীমায় গতায়াতে।

কবিতা এক তুচ্ছ দাসীর হৃদয়ের করুণ আর্তি ও ক্রন্দন।

যেন কোনো বিশেষই নাই জগতে! এর পরের ধাপ জৈবসত্তার নিজের একটা আমির দরকার হই পড়ে। কিন্তু সে তাও পায় না! নিয়তি প্রবর্তিত এক সামান্য ‘আমি’র অধীন রইতে হয়। তার স্বাধীন কোনো আমি নাই। এই পরিস্থিতিতে তার দরকার হই পড়ে হুযুনময় অধ্যাত্মের। এই জটিল অবস্থা প্রকাশের লাগি কবিতায় মেটাফরের হাজিরা আপাত জ্বর ও জরার প্রকোপ কমায়!

পড়ুন- জহির হাসানের কবিতা

জহির হাসান

জন্ম: ১৯৬৯, যশোর জেলায় মাতুলালয়ে।
প্রকাশিত কবিতার বই: পাখিগুলো মারো নিজ হৃদয়ের টানে (২০০৩), গোস্তের দোকানে (২০০৭), ওশে ভেজা পেঁচা (২০১০), পাতাবাহারের বৃষ্টিদিন (২০১২), খড়কুটো পাশে (২০১৪), আয়না বিষয়ে মুখবন্ধ (২০১৬) ও আম্মার হাঁসগুলি(২০১৭), বকুলগাছের নিচে তুমি হাসছিলি(২০১৮), আমমার আরও হাঁস(২০১৯)।
অনুবাদ : এমে সেজেরের সাক্ষাৎকার ও আধিপত্যবাদ বিরোধী রচনাসংগ্রহ (২০১১) । সাক্ষাৎকার পুস্তিকা (কবি উৎপলকুমার বসুর সাক্ষাৎকার) : কথাবার্তা (সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৬)

Share