আমার মা এবং রবীন্দ্রনাথ

কবিতাগুচ্ছ

।। নাদিয়া জান্নাত ।।

আমি যখন প্রথম রবীন্দ্রনাথ শুনি তখনও ভালোবাসা বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম মা রোজ অপেক্ষা করছে বাবার জন্য। বাবার অফিস পাঁটচায় ছুটি। বাবা বাড়ি ফিরতো রাত নটায়।
মা সন্ধ্যাবাতি জ্বালাতো। হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখতো বাবার সাদা পাঞ্জাবি…

(১)

আমার মা এবং রবীন্দ্রনাথ

আমার ছোট বেলায় মা স্লো ভলিউমে গান বাজাতো সারাদিন। আমি তখনও রবীন্দ্রনাথের মানে জানতাম না। রবীন্দ্রনাথ মানে
“চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি” – এই বোধটাও হয়নি তখনো। আমার তখন ছেলেবেলার বয়স। আমি মুখস্ত করতাম-

“চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাঁদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।”

তখন বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠতো। মনে হতো,
আমাদের গ্রামে কেন কোন  ছোট নদী নেই! অথচ বৈশাখ ভাবলেই “গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে” অনুভূতিটা সারা মন ছুঁয়ে যেতো।

আমি আমার মায়ের বাজানো গান শুনতাম। ভালো লাগতো না। আমি তখনও জানতাম না এই ভালো লাগছে না এবং ভালো লাগছে সমস্ত কিছু এ দুয়ের মাঝেই আছে রবীন্দ্রনাথ।

হলো না, হলো না, হলো না বলেই চমকে চমকি উঠি, বয়সটা আমার একটু আগেই এসেছে। পুরোনো চৌকাঠ, পুরোনো বাড়ি, এবং চোখ বন্ধ  করলে একটি ইছামতি নদী। আমি সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে নদী খুঁজতাম। বৃষ্টি চাইতাম। বৃষ্টি নামলে ছোপ ছোপ দাগ বসতো মাটিতে। আমি কারো পায়ের ছাপ খুঁজলাম।
আচ্ছা সেসময় কি বুড়ো রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাড়ি আসতো?
কিন্তু আমি তো সমস্ত দিন যা কিছু তরুণ তাকে ভালোবেসেছি।
আমি জেনেছি ভালোবাসা মানে বুকের ভেতর হুটহাট আসা জলোচ্ছ্বাস। ভালোবাসা মানে খোলা গহনার বাক্স। শাড়ি এলোমেলো পরে আছে বিছানার পাশে। ভালোবাসা মানে এক্ষুনি আসতে পারে একটা দূর্যোগ।

আমি যখন প্রথম রবীন্দ্রনাথ শুনি তখনও ভালোবাসা বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম মা রোজ অপেক্ষা করছে বাবার জন্য। বাবার অফিস পাঁটচায় ছুটি। বাবা বাড়ি ফিরতো রাত নটায়।
মা সন্ধ্যাবাতি জ্বালাতো। হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখতো বাবার সাদা পাঞ্জাবি। বাবা বাড়ি ফিরলে আমরা দু ভাই বোন দৌঁড়ে যেতাম বাবার কাছে। মা ঘরেই থাকতো। চুপচাপ হাতে নিতো বাবার বাজারের ব্যাগ। মা কি বাবাকে ভালোবাসতো?
ভালোবাসলে চুপচাপ থাকতে হয় এটা কি রবীন্দ্রনাথ মাকে শিখিয়েছিলো?


(২)

নিবেদন

তোমার পাতে কাটা লেবুর ফালি তুলে দেয় অন্যজন।
চৈত্রের হাত পাখা হয় তার আদর
ঘাম মুছে দিতে দিতে কতশত কথা হয় তোমাদের—

একলা ভাত খেতে বসে দুপুরে নিরুত্তাপ লাগে খুব
মনে হয়, আঁচলে বাঁধা কুন্দ ফুলের গিঁট ছাড়া
তোমায় আর কি দেয়ার আছে,
ভ্রমর!


(৩)

আমলনামা 

তোমারে যে দুনিয়ায় রেখে আসছি সেটা জান্নাত।

বসন্ত শেষের বাতাস
আর
হলুদ কুটুম পাখি
মাঠের মধ্যে পিঠ বাঁকায়া থাকে সেখানে

তুমি ছলনা করতে পারো জুঁই গাছের সাথে।
মখমল চুলের নারী পাশ দিয়ে গেলে তাকে
ইশারা দিতে পারো; কৌশলে

জান্নাতে থেকে হাবিয়া দোজখের কথা
মোটেও ভেবো না, লক্ষ্মীটি


(৪)

বেদনা দীর্ঘজীবী হইতেছে যেহেতু…

আধমরা শালিকরে বুকে পুষে বড় আরাম পাইতেছি।
ঝিলিক দিয়া রোদ আসতেছে।
সেই রোদে শালিকের জন্যে ধান ছিটাইতেছি
শালিকটা নাচতে নাচতে বুকের ভেতর আসতেছে,
কিন্তু কোন ধান খাইতেছে না।
আমি অবশ্য জোরাজুরি করতেছি-
সে শুনতেছে না। সে কেবল নাচতেছে আর নাচতেছে—
আমার হঠাৎ করেই মনে হইলো এটা তো অঘ্রাণ মাস।
ধানকাটা হয়ে গেছে।
এখানে সেখানে মাঠে- ঘাটে ধান শুকানোর বেলা এখন।
আধমরা শালিকটার আর ধানের অভাব নাই।
তবুও, ধানের লোভে পাখিটা যে আসতেছে, বুকের ভেতর
এইটা ভেবে প্রচুর আনন্দ পাইতেছি আমি

(৫)

স্যুররিয়াল দৃশ্য মুখোমুখি দাঁড়ানোর পর 

চাঁদ আর জোছনা সেরে নিচ্ছে রেওয়াজ, হোস্টেলের ছাদে। আমার ব্যাগ গোছানো শুরু, ট্রেনের টিকিট কেটে কোথাও চলে যাবো। কুকুর, আর বেড়ালের তাড়া খেয়ে পা ছড়িয়ে বসবো রাস্তায়; কুয়াশার দিনে কার্ডিগান রাখবো কাছে। প্রেমের আলামত দেখলে মুখোমুখি বসবো তার, ঈষৎ একান্তে; পুনরায় ঝগড়া হবে, ধাক্কা খাবো। লজিক পড়বো না, শুনতে থাকবো অডিও ক্যাসেট। সম্ভব হলে বেশি বেশি হ্যাবা হবো। কলিংবেল না চেপে দাঁড়িয়ে থাকবো। জোড়া জুতো থেকে ওলট-পালট করবো পা, পথ ভুল হলে অন্তরঙ্গ করবো আচার-নিষেধ।
মনে মনে বিবাহ ডাকবো। বিরহ এলে মাগরিবে উবু হবে মধু, সাধের বাছুর— ফুল আর ঘাস থেকে সরিয়ে নেবে মাথা।
তুমি বলবে, ফিরে তাকাবো না। ব্যাগ গোছাতে গোছাতে আমি বলবো, কোথাও যাবো না।

প্রচ্ছদের ছবি: শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নাদিয়া জান্নাত

বাংলাদেশের তরুণ কবিদের মধ্যে অন্যতম। রংপুরের মেয়ে। ইতোমধ্যে তিনটি কাব্যগ্নথ প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলি হলো যথাক্রমে, ‘বুনোফুল ও ‘ছবিওয়ালার গল্প’, ‘শালুক ফুলের যাতনা’ এবং ‘ইতি তোমার লাবণ্য’।

Share