আজ শুক্রবার, ২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

জলপান শব্দের শিকারি আল মাহমুদ

।। ফরহাদ মজহার।।

আস্তিকতা, নাস্তিকতা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস ইত্যাদি কবির জন্য ঠুনকা জিনিস। এহ বাহ্য। বাইরের ব্যাপার। শেষাবধি কবি ‘ধ্বনির জাদুকর’, কিংবা ‘জলপান শব্দের শিকারি’। যে কোনো সফল কবির মতোই আল মাহমুদ শব্দ শিকারি। সেই শিকার তিনি করেছেন বাঙালি মুসলমান সমাজের অভ্যস আচরণ সংস্কৃতি থেকে। কিন্তু মুসলমান কবি হবার জন্য নয়, বরং অখণ্ড বাংলা সাহিত্যে নিজের ন্যায্য হিস্যা দাবি করবার জন্য। অখণ্ড বাংলা কবিতার ইতিহাসে বাংলাভাষী কবি হিশাবে এখানে আল মাহমুদ অনন্য। পাঠক তা সহজে ধরতে পারেন না বটে, কিন্তু এই মহিমাই আল মাহমুদের স্বাতন্ত্র। অখণ্ড বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুলের পর আল মাহমুদের সজ্ঞান আবির্ভাব। এটা নিছকই আরেকজন প্রতিভাবান মুসলমান কবির আবির্ভাব, কিংবা কবিতায় স্রেফ মুসলমানি শব্দের ব্যবহার মাত্র ছিল না। আল মাহমুদের আগে এই ব্যবহার আমরা আহসান হাবিব, ফররুখ আহমদেও দেখেছি। কাব্যগুণ হিশাবে তাঁদের কবিতার মর্যাদা কম নয়। কিন্তু আল মাহমুদ সদর্পে হাজির হয়েছেন আধুনিক বাংলা কবিতায় বাংলা ভাষায় বাঙালি মুসলমান কবি হিশাবে তাঁর ন্যায্য হিস্যা আদায় করে নেবার জন্য। ঔপনিবেশিক কলকাতায় উচ্চবর্ণের হিন্দুর হাতে তৈরি সাহিত্যের বিপরীতে তিনি ‘মুসলিম সাহিত্য’ বা ‘ইসলামি সাহিত্য’ করতে আসেন নি। তাঁর মধ্য দিয়ে বরং বাঙালি বা বাংলাভাষীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের উত্থান আমরা লক্ষ্য করি। এখানেই আল মাহমুদের রাজনৈতিক তাৎপর্য।

জলপান শব্দের শিকারি আল মাহমুদ

এক

বহু বছর আগে, যখন তিনি অসুস্থ নন, তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কলকাতা থেকে ফিরছিলাম। কলকাতা এয়ারপোর্টে তাঁর সঙ্গে দেখা। কবিদের বিস্তর কথা জমা থাকে যা কেবল কবিদের পরস্পরের সঙ্গেই উজাড় হয়। তাই হল।

ঢাকায় উড়োজাহাজ নাক নীচু করে যখন নামছিলো, তখন হঠাৎ আমাকে বললেন, ”এই শহরে ফরহাদ মজহারও বাস করেন”। একটু অপ্রস্তুত হয়েছিলাম। সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন বললেন? তাঁর উত্তর ছিল, ”কবিদের ভিড় ও মঞ্চ থেকে আমি সারাজীবন দূরে থেকেছি, কিন্তু কবি ও কবিতা নিয়ে তর্কবিতর্কে আমি ঠিকই হাজির আছি। বললেন, ”আপনার সঙ্গে কদাচিৎ দেখা হলেও এই শহরে আপনি বাস করেন সেই সত্য সরবে জারি আছে”।

তবে এই কথাগুলো আমাকে বলার চেয়েও ওর মধ্যে তাঁর নিজের সম্পর্কে আক্ষেপই বরং ব্যক্ত হয়েছিল। তথাকথিত কবিদের ভিড় ও মঞ্চ থেকে তিনিও তখন দূরে। কিন্তু সেটা স্বেচ্ছায় নয়, বাংলাদেশে কবিদের দলাদলি এবং নির্লজ্জভাবে রাজনৈতিক দলের মাস্তান বাহিনীতে পর্যবসিত হবার পরিণতি তাঁকেও ভোগ করতে হয়েছিল। কিন্তু ভুল হবে যদি দাবি করি, আল মাহমুদ ‘সমাজতন্ত্রী’ থেকে ‘বিশ্বাসী’তে পরিণত হবার ফলে তাঁর সঙ্গে সেই দূরত্ব ঘটেছে। আল মাহমুদ তাঁর বিশ্বাসের কারনে জীবনের একটা পর্যায়ে সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন, একথা ঠিক নয়। আল মাহমুদ সম্পর্কে এই ভুল ভাঙাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে যে আক্ষেপ ও হাহাকার তার কোনো ভিত্তি নাই।

প্রথমত ভুলে যাওয়া উচিত নয়, আল মাহমুদ বাংলাদেশে খুবই সুবিধাভোগী একজন কবি। তিনি বঞ্চিত কবি নন। তাঁকে নিয়ে আমাদের আবেগ ও ভালবাসার মূল্য আছে। কিন্তু তিনি মারা যাবার পর তাঁকে নিয়ে আক্ষেপ করার বিশেষ কিছু ছিল না। তাঁর প্রতি ফ্যাসিস্ট সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কুৎসিত উপেক্ষা আমাদের মর্মাহত করে, কিন্তু এই ধরনের সরকার ও রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পেছনে আল মাহমুদের নিজের অবদানও কম নয়। যেমন রয়েছে শামসুর রাহমানের ভূমিকাও। এই ক্ষেত্রে তাঁদের একা দোষী করারও কোনো যুক্তি নাই। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা এবং তার মধ্যে গড়ে ওঠা সাহিত্য ও কবিতাগিরির ইতিহাসের মধ্যে এর মাজেজা বুঝতে হবে। কবিদের ব্যক্তিগত দায় আছে বটে, কিন্তু বাংলাদেশে কবিতা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের চরিত্রের মধ্যেই দলাদলি ও ইতরপনার বিস্তর আবর্জনা রয়েছে। কবি-সাহিত্যিকদের বৃহৎ অংশই এর জন্য দায়ী।

কাব্যচর্চার শুরু থেকেই আল মাহমুদ স্বীকৃত এবং প্রশংসিত। উচ্চবর্ণের হাতে কলকাতায় যে সাহিত্য সেই মহলে মুসলমান বাংলা জানে, সেটা ষাট দশকেও ছিল অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এই পরিপ্রেক্ষিতে ত্রিশের কাব্য ভাষায় বাঙালি মুসলমান কবিদের আধুনিক কবিতা লেখা ছিল অকল্পনীয় ঘটনা। বাংলা সাহিত্যে ধূমকেতুর মতো নজরুলের আবির্ভাব ঘটলেও পঞ্চাশ ষাট দশকে মনে করা হতো মুসলমান বাঙালি বড়জোর জসীম উদ্দীন হতে পারবে। ‘পল্লীকবি’ হিশাবে জসীম উদ্দীন স্বীকৃত ছিলেন, কিন্তু কখনই আধুনিক কবি হিশাবে নয়। বুদ্ধদেব বসুর কাছে নজরুল ছিলেন বালখিল্য কবি। আধুনিক কবিতা মুসলমান লিখতে পারবে এটা ষাট দশকে ভাবাও যেত না। বিশেষত বুদ্ধদেব বসু যে কবিতা তাঁর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ছাপাবার যোগ্য গণ্য করেন, একজন মুসলমান কবি সেই ভাষায় কবিতা লিখতে পারবেন বলে একসময় মনে করা হতো না। তথাকথিত আধুনিক কাব্য ভাষায় বাঙালি মুসলমান কবির কবিতা লিখতে পারা পঞ্চাশ বা ষাট দশকেও অচিন্ত্যনীয় ছিল।

এখনকার তরুণ কবি ও বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার পাঠকদের এই ইতিহাস জানা নাই। মুসলমানের দৈনন্দিন জীবন যাপনের ভাষা বা জবান বাংলা ভাষার অন্তর্গত বলেও স্বীকৃত ছিল না। পশ্চিম বাংলায় এখনও নাই। কলোনিয়ান শাসনের আগে মুঘল ও বাংলার সুলতানদের আমলে বাংলায় আরবি ফারসি শব্দ ব্যবহারের যে ধারা বহাল ছিল, সেখানে মুঘল ও সুলতানদের যুগের অবসানের মধ্য দিয়ে ছেদ ঘটে গিয়েছিল। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই উচ্চবর্ণের হিন্দুর রচিত বাংলা সাহিত্য দ্রুত বদলাতে শুরু করে। বাংলা সাহিত্য ও বাংলা আধুনিক কাব্যচর্চায় এটাই শুধু স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে যে সংস্কৃতই বাংলা ভাষার জননী। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বিরোধিতা করেছিলেন বটে, প্রাকৃত কিম্বা মাগধি প্রাকৃতের সঙ্গে বাংলা ভাষার সম্পর্কের সূত্র ডক্টর শহিদুল্লাহর গবেষণায় দেখিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সকল প্রতিবাদ ও গবেষণা গ্রহণযোগ্য হয় নি। ব্যবহারিক সাহিত্য চর্চায় সংস্কৃত বাংলা ভাষার ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। পশ্চিম বাংলার আধুনিক বাংলা সাহিত্য চর্চায় শাস্ত্রীর আপত্তি, শহিদুল্লাহর গবেষণা, মায় রবীন্দ্রনাথের ‘মুখের ভাষা’র প্রতি পক্ষপাতেরও কোন প্রভাব পড়ে নি। বরং ত্রিশের দশকে সুধীন দত্ত কিম্বা বিষ্ণু দে যখন কবিতা লিখছেন তখন তাঁদের কাব্য ভাষায় সংস্কৃতেরই প্রতাপ এবং অনুরণন। সংস্কৃত বহুল শব্দ কিম্বা তথাকথিত তৎসম রূপের বাহুল্যে বাংলা ভাষা সাধারন মানুষের ভাষা থেকে দূরে চলে গিয়েছিল। সেই মূহূর্তে আল মাহমুদ বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার সুবাদে আধুনিক বাংলা ভাষার কবি হিশাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই কাব্যভাষাও মূলত কলকাতায় তৈরি। কিন্তু এই স্বীকৃতিটাই তাৎপর্যপূর্ণ। স্বীকৃতি পেয়েছিলেন শামসুর রাহমান এবং শহিদ কাদরীও। এরপর আল মাহমুদকে কখনই আর ‘আধুনিক কবি’ হবার জন্য কারো পেছনে ছুটতে হয় নি।

আল মাহমুদ সারা জীবন নানা পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। বঞ্চনা জুটেছে, এটা তাঁর ক্ষেত্রে সঠিক নয়। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশের পদকসহ (১৯৮৭) তিনি বহু সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৮), জয় বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), সুফী মোতাহের হোসেন সাহিত্য স্বর্ণপদক (১৯৭৬), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬) ,নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক-২০০৪ প্রভৃতি। এছাড়াও রয়েছে, অগ্রনী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, লেখিকা সঙ্ঘ পুরস্কার, ফররুখ স্মৃতি, হরফ সাহিত্য পুরস্কার, প্রভৃতি। আরও পুরস্কার থাকতে পারে, আমি এই কয়টি সম্পর্কে জানি। অতএব কবি হিশাবে আল মাহমুদ নিয়ে আমাদের আক্ষেপের কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।

ঔপনিবেশিক আমল থেকেই উচ্চবর্ণের হিন্দুর রচিত বাংলা সাহিত্য দ্রুত বদলাতে শুরু করে। বাংলা সাহিত্য ও বাংলা আধুনিক কাব্যচর্চায় এটাই শুধু স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে যে সংস্কৃতই বাংলা ভাষার জননী। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বিরোধিতা করেছিলেন বটে, প্রাকৃত কিম্বা মাগধি প্রাকৃতের সঙ্গে বাংলা ভাষার সম্পর্কের সূত্র ডক্টর শহিদুল্লাহর গবেষণায় দেখিয়ে দাওয়া হয়। কিন্তু সেই সকল প্রতিবাদ ও গবেষণা গ্রহণযোগ্য হয় ন। ব্যবহারিক সাহিত্য চর্চায় সংস্কৃত বাংলা ভাষার ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। পশ্চিম বাংলার আধুনিক বাংলা সাহিত্য চর্চায় শাস্ত্রীর আপত্তি, শহিদুল্লাহর গবেষণা, মায় রবীন্দ্রনাথের ‘মুখের ভাষা’র প্রতি পক্ষপাত কোন প্রভাব পড়ে নি। বরং ত্রিশের দশকে সুধীন দত্ত কিম্বা বিষ্ণু দে যখন কবিতা লিখছেন তখন তাঁদের কাব্য ভাষায় সংস্কৃতেরই প্রতাপ এবং অনুরণন। সংস্কৃত বহুল শব্দ কিম্বা তথাকথিত তৎসম রূপের বাহুল্যে বাংলা ভাষা সাধারন মানুষের ভাষা থেকে দূরে চলে গিয়েছিল। সেই মূহূর্তে আল মাহমুদ বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার সুবাদে আধুনিক বাংলা ভাষার কবি হিশাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। সেই কাব্যভাষা মূলত কলকাতায় তৈরি। এই স্বীকৃতিটাই তাৎপর্যপূর্ণ।

আল মাহমুদ নিজেও মনে করতেন আক্ষেপের কারন নাই। তিনি ১৯৯৬ সালে লিখছেন, “কবিতা লিখে এদেশে যতটুকু ভালোবাসা আদায় করা যায়, আমার ভাগ্যে তা জুটেছে। অখ্যাতিও কম জোটে নি। মাঝে মধ্যে প্রশ্ন জাগে অপূর্ণতাটা কোথায়? না, দেখতে পাই না’ (মাহমুদ, ১৯৯৭)। নিজের জীবনকে মাহমুদ পরিপূর্ণ গণ্য করতেন। একটা পরিপূর্ণ জীবন কাটিয়ে আল মাহমুদ পরিণত বয়সেই ইন্তেকাল করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

এটা ঠিক যে তাঁর মৃত্যুর পর সরকারি বা রাষ্ট্রীয় ভাবে শোক প্রকাশ করা হয় নি। গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকাও ছিল কুৎসিত ও ভয়ংকর। কিন্তু সেটা ভিন্ন বিতর্ক। বর্তমানের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, অর্থাৎ এখনকার ফ্যাসিস্ট, খুনি ও বদমাশ সময় হঠাৎ গড়ে ওঠে নি। সেই ক্ষেত্রে রাজনীতির ভূমিকা ছাড়াও আধুনিক কবি, সংস্কৃতি কর্মী প্রভৃতিদের মধ্যে নানান দলবাজ মাস্তান বাহিনীর উৎপত্তি এবং শিল্প ও সাহিত্য বিরোধী শক্তির সামাজিক-সাংস্কৃতিক পর্যালোচনা আলাদা বিষয়।

তবে সংক্ষেপে হলেও কিছু সত্য মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। আল মাহমুদ নিয়ে আলোচনার জন্য যা জরুরি। সামরিক সরকার এরশাদের সেনা অভ্যূত্থান এবং সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আশির দশকের লড়াইয়ের প্রাথমিক পর্যায়ে জাতীয় কবিতা পরিষদ এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গড়ে ওঠে। অর্থাৎ সেটা ছিল সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ। কিন্তু এই অবস্থা খুবই স্বল্পকাল জারি ছিল। এখানে যারা যুক্ত হয়েছিল তাদের অধিকাংশই ছিল চরম সুবিধাবাদি পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির অন্তর্গত। ফলে শ্রেণিগত কারণে অচিরেই এরশাদ সরকারের পতনের পর ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে তাদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। জাতীয় কবিতা পরিষদ ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ভাবে চরম ইসলাম বিদ্বেষী ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদি শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংগঠন। অচিরেই এই দুটি সংগঠন কার্যত আওয়ামি লীগের অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়। তাদের ভূমিকা হয়ে ওঠে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে জাতিবাদি ফ্যসিস্ট সংস্কৃতির ধারণ, বহন ও প্রচার।

একে মোকাবিলা করার সম্ভাব্য পথ ছিল কবি ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের ভিন্ন সংগঠন ও তৎপরতা গড়ে তোলা। সেই ক্ষেত্রে, বলা বাহুল্য, আল মাহমুদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন। জাতীয় কবিতা পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন শামসুর রাহমান। তার বিপরীতে আল মাহমুদ হতে পারতেন গণমানুষের কাব্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি। কিন্তু আল মাহমুদ সেটা করেন নি। তিনি ক্ষমতাসীন এরশাদ সরকারের সাহায্যপুষ্ট হয়ে যোগ দিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিপক্ষ হিশাবে গড়ে ওঠা আরেকটি সংগঠনে। যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সামরিক শাসক এরশাদের বন্ধু ফজল শাহাবুদ্দিন। এরশাদের সাহায্যপুষ্ট হয়ে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক কবিতা সম্মেলনও হয়েছে।

বাংলাদেশে সামরিক শাসক এরশাদের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা নিয়েছিলেন আল মাহমুদ। হুসেন এরশাদকে কবি হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে তাঁর প্রয়াসে ঘাটতি ছিল না। তাঁর কাব্যশক্তির প্রতিভা তিনি সামরিক শাসকের কাছে বেচতে দ্বিধা করেন নি। আল মাহমুদ নিজেই জানিয়েছেন, এরশাদ বনানীতে তাঁকে একটা জমি দিয়েছিলেন এবং তিনি সেখানে বাড়ি করেছিলেন। বাড়িটা তিনি করেছিলাম লোন করে। এদিকে তাঁর ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার জন্য সব বিদেশে। মাহমুদ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তারা ফোন দিয়েই বলে আব্বা টাকা পাঠাও, আব্বা টাকা পাঠাও। বাড়ি সেই টাকার যোগান দিতেই এক কোটি ষাট লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। তাহলে বলা যায়, সামরিক শাসক এরশাদের কাছ থেকে তিনি নগদে এক কোটি ষাট লাখ টাকা ভোগ করেছেন। (দেখুন, ‘এরাই আমাকে জামাত বানিয়েছে’, প্রিয় ডট কম)

কবিরাও মানুষ এবং তাদেরও পরিবার ছেলে মেয়ে রয়েছে। এই বিচারে আল মাহমুদের প্রতি আমরা সদয় থাকবো কিনা তা নিয়ে কূটতর্ক হতে পারে। কিন্তু সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে এর কুফল আমাদের সকলকেই ভোগ করতে হচ্ছে। আরও কতোদিন ভোগ করতে হবে কে জানে!

আমরা আলোচনা করছি স্বেচ্ছায় কিম্বা অনিচ্ছায় সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কবিদের ভূমিকা নিয়ে। কিন্তু যে ভুল ভাঙতে চাই বলে এই আলোচনা, তার প্রথম সত্য হচ্ছে আল মাহমুদ ইসলামপন্থি হয়ে গিয়েছেন কিম্বা জামাতে ইসলামির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বলে গণবিচ্ছিন্ন হয়েছেন, উপেক্ষিত হয়েছে এই সব কথা ঠিক নয়। তাঁর রাজনৈতিক গণবিচ্ছিন্নতার শুরু সামরিক অভ্যূত্থান, সামরিক শাসন ও সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের শুরুতেই। জনগণের বিরোধী পক্ষে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নিয়েছিলেন। ইসলামপন্থি হওয়া বা জামায়েতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া অনেক পরের ঘটনা। তিনি নিজে বলেছেন, বারবারই দাবি করেছেন, তিনি কখনই দলীয় ভাবে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন নি। আমরা তাঁকে বিশ্বাস করি। করা উচিত। তাঁর ইসলাম প্রীতি দোষের কিছু নয়। কিন্তু এই প্রীতি গণমানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রতি অভিগমন নয়। কিম্বা সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধের অন্তর্গতো নয়। বরং তাঁর ইসলাম প্রীতি এরশাদ আমলে তাঁর গণবিরোধী রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা মাত্র।

বাংলাদেশে কবিদের ভূমিকা বিচার করতে বসলে আল মাহমুদ একা অপরাধী নন। অপরদিকে তাঁর প্রতিপক্ষরা গণতন্ত্র, প্রগতি, ধর্ম নিরপেক্ষতা ইত্যাদি বুলি আউড়িয়ে ইসলাম বিদ্বেষ ও ফ্যাসিস্ট রাজনীতি ও ফ্যাসিস্ট শক্তির লেঠেলের ভূমিকা পালন করেছে। ইতোমধ্যে শামসুর রাহমানের মৃত্যু ঘটেছে। এখন আল মাহমুদের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কবিতার একটা কালপর্বের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। জাতীয় কবিতা পরিষদের কোন তাৎপর্য আর অবশিষ্ট নাই। নব্য ফ্যাসিস্ট মাস্তান বাহিনী হিশাবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটেরও আগের রমরমা নাই। শেখ হাসিনার শক্ত শাসনের আমলেও। সবচেয়ে করুণ দিক হচ্ছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট পরিণত হয়েছে কার্যত আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের ভূমিকায়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এখন ঠিক করে দেয় মারা যাবার পরে সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের কাকে শহিদ মিনারে আনা হবে, আর কাকে আনা হবে না। সংস্কৃতির একটা চরম ক্যারিকেচার ও বিনোদন হিশাবে তারা কতোদিন আমাদের আনন্দিত রাখে সেটা এখন দেখার বিষয়।

তাহলে বাংলাদেশের সাহিত্য, কাব্য ও সংস্কৃতির বিচার আমরা সমাজ ও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে করতে পারি না। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিশাবে আল মাহমুদের সমালোচনাও আমাদের উদ্দেশ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দুটো বিকৃত রাজনৈতিক ধারা এবং বাংলাদেশের বাস্তব রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতেই তাদের পর্যালোচনা করতে হবে। ব্যক্তি হিশাবে আল মাহমুদ তাঁর কালের বিরোধ, দ্বন্দ্ব এবং করুণ রাজনৈতিক ট্রাজেডি থেকে মুক্ত নন।

আল মাহমুদ ইসলামপন্থি হয়ে গিয়েছেন কিম্বা জামাতে ইসলামির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বলে গণবিচ্ছিন্ন হয়েছেন, উপেক্ষিত হয়েছে এই সব কথা ঠিক নয়। তাঁর রাজনৈতিক গণবিচ্ছিন্নতার শুরু সামরিক অভ্যূত্থান, সামরিক শাসন ও সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের শুরুতেই। জনগণের বিরোধী পক্ষে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নিয়েছিলেন। ইসলামপন্থি হওয়া বা জামায়েতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া অনেক পরের ঘটনা। তিনি নিজে বলেছেন, বারবারই দাবি করেছেন, তিনি কখনই দলীয় ভাবে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন নি। আমরা তাঁকে বিশ্বাস করি। করা উচিত। তাঁর ইসলাম প্রীতি দোষের কিছু নয়। কিন্তু এই প্রীতি গণমানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রতি অভিগমন নয়। কিম্বা সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধের অন্তর্গতো নয়। বরং তাঁর ইসলাম প্রীতি এরশাদ আমলে তাঁর গণবিরোধী রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা মাত্র।

দুই

তাহলে গুরুতর জিজ্ঞাসা হচ্ছে, কবি হিশাবে আল মাহমুদের মহিমা কোথায়? সেটা আমরা আল মাহমুদের নিজের উপলব্ধি থেকেই উদ্ধৃত করতে পারি। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন:

“আমাদের সাহিত্যে, অখণ্ড বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কালে, মুসলমানদের সাহিত্যচর্চার প্রমাণ আমরা খুব কমই দেখেছি। আমার একটা চেষ্টা ছিলো এই যে… তখন ধর্ম নিয়ে যতটা না ভেবেছি তার চেয়ে বেশি ভেবেছি কবিতা নিয়ে। আমি যে শহরে জন্মেছি সেখানকার সাধারণ মানুষের অভ্যেস-আচরণ, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা এবং ঘৃণা, তাদের লড়াই এবং সংগ্রাম এসব আমি কবিতায় আনার চেষ্টা করেছি। তখনকার আধুনিক সাহিত্য বলতে যা বুঝেছি তার মধ্যে মুসলমানদের অভ্যেস-আচরণ, প্রেম-ভালোবাসার কথা আমি কোনো বইয়ে পড়িনি। সব সময় আমার চেষ্টা ছিলো আমি যেমন ঠিক তেমনই লিখবো। মূলত আমরা তিরিশের কবিদের কবিতা পড়ে আধুনিকতার ধারণা পেয়েছি। এটা অস্বীকার করলে ঠিক হবে না। এর সাথে আমি আমার দেশপ্রেম, সমাজ, পরিবার, ধর্ম ইত্যাদি যুক্ত করেছি। আমি আমার পরিবেশ থেকে শব্দ ব্যবহার করেছি। এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেছি যা আগে ব্যবহার করেনি। ইচ্ছাকৃতভাবে যে করেনি তা নয়। সাহিত্যে স্ট্যান্ডার্ড-এর মধ্যে এই ধরনের শব্দ প্রবেশ্য ছিলো না। বা প্রবেশ্য ছিলো কিন্তু প্রবেশ করানো হয় নি। এটা শুরু হলো নজরুল থেকে। নজরুল যখন লিখলেন: ‘গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,/ আম্মাগো পানি দাও ফেটে গেলো ছাতি মা,’ আশ্চর্য হয়ে গেলাম ‘আম্মা’ শব্দের ব্যবহার দেখে। এটা সম্ভব তাহলে! আমি চেষ্টা করলাম এর মধ্যে আমার অভ্যেস-আচরণ, আমার খাসলত — এটা প্রবেশ করানোর। আমার প্রথম কবিতা থেকেই এটা লক্ষ্য করা যাবে”। (দেখুন, ‘কবি আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার’)।

ঠিক এখানেই, অখণ্ড বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুলের পর আল মাহমুদের সজ্ঞান আবির্ভাব। এটা নিছকই প্রতিভাবান মুসলমান কবির আবির্ভাব, কিংবা স্রেফ মুসলমানি শব্দের ব্যবহার মাত্র ছিল না। আল মাহমুদের আগে এই ব্যবহার আমরা আহসান হাবিব, ফররুখ আহমদেও দেখেছি। কাব্যগুণ হিশাবে তাঁদের কবিতার মর্যাদা কম নয়। কিন্তু আল মাহমুদ সদর্পে হাজির হয়েছেন আধুনিক বাংলা কবিতায় বাংলা ভাষায় বাঙালি মুসলমান কবি হিশাবে তাঁর ন্যায্য হিস্যা আদায় করে নেবার জন্য। ঔপনিবেশিক কলকাতায় উচ্চ বর্ণের হিন্দুর হাতে তৈরি সাহিত্যের বিপরীতে তিনি ‘মুসলিম সাহিত্য’ বা ইসলামি সাহিত্য করতে আসেন নি। তাঁর মধ্য দিয়ে বরং বাঙালি বা বাংলাভাষীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের উত্থান আমরা লক্ষ্য করি। এখানেই আল মাহমুদের রাজনৈতিক তাৎপর্য। এই রাজনৈতিক তাৎপর্য বাদ দিয়ে আল মাহমুদের কবিতার বিচার সংকীর্ণ হতে বাধ্য। তাঁর কবিতার স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা এই রাজনৈতিক তাৎপর্য বাদ দিয়ে বোঝা যাবে না।

ষাট দশকের শেষের দিকে তাঁর ‘সোনালি কাবিন’ বেরোয়, তখন ‘কাবিন’ শব্দটি একটা ভূমিকম্পের মতো বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে উপেক্ষিত বা অদৃশ্য জনগোষ্ঠির সবল উপস্থিতি ঘোষণা করে। মহৎ কবিরা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা,। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাঁরা গণক। কিন্তু ‘সোনালি কাবিন’ কবিতা স্রেফ নামকরণ হিশাবেই বাঙালি মুসলমানের বাংলাভাষী ও বাঙালি হিশাবে সদর্পে হাজির হবার ঘোষণা, আধুনিক কাব্য ভাষা যাদের আয়ত্ব। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে একটি নতুন রাজনৈতিক গোষ্ঠির সম্ভাবনা হাজির হবার পর রাজনীতি তা অনুসরণ করে মাত্র।

১৯৬৩ সালে ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশিত হয়। আল মাহমুদ লিখছেন:

হে মোহান্ত, তেমন কোন শব্দ জানো কি
যার উচ্চারণকে মন্ত্র বলা যায়?
হে মোয়াজ্জিন, তোমার আহ্বানকে
কী করে আজান বলো, যা এত নির্দিষ্ট


আর হে নাস্তিক
তোমার উচ্চকন্ঠ উল্লাসকে কোন আনন্দ বলো
যা এতো দ্বিধান্বিত


তাই আমি নাস্তিক নই।
বিশ্বাসী নই।


(পিপাসার মুখ)

তাহলে কে এই কবি, যিনি নাস্তিকও নন, আবার বিশ্বাসীও নন? এর উত্তরও আমরা পাই। তাঁরই কবিতায়।

সতর্ক আত্মার ওপর কড়ির মতোন
কড়ির মতোন
দুটি চোখ অনুভবের যাদু দিয়ে
পাশাপাশি সাজিয়ে রেখেছি
নিসর্গের ফাঁকে ফাঁকে যখন বিষণ্ণ হাওয়ার রোদন


দুঃখের নিঃশ্বাস ফেলে, আমি সেই
ধ্বনির জাদুকর।
চিতল হরিণি তার দ্রুতগামী ক্লান্তির শেষ যামে
যখন প্রস্রবণে পিপাসায় মুখ নামায়


আমি সেই জলপান শব্দের শিকারি
(পিপাসার মুখ)।

আস্তিকতা, নাস্তিকতা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস ইত্যাদি কবির জন্য ঠুনকা জিনিস। এহ বাহ্য। বাইরের ব্যাপার। শেষাবধি কবি ‘ধ্বনির জাদুকর’, কিংবা ‘জলপান শব্দের শিকারি’। ওপরের উদ্ধৃতি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে কোনো সফল কবির মতোই আল মাহমুদ শব্দ শিকারি। সেই শিকার তিনি করেছেন বাঙালি মুসলমান সমাজের অভ্যাস আচরণ সংস্কৃতি থেকে। কিন্তু মুসলমান কবি হবার জন্য নয়, বরং অখণ্ড বাংলা সাহিত্যে নিজের ন্যায্য হিস্যা দাবি করবার জন্য। অখণ্ড বাংলা কবিতার ইতিহাসে বাংলাভাষী কবি হিশাবে এখানে আল মাহমুদ অনন্য। পাঠক তা সহজে ধরতে পারেন না বটে, কিন্তু এই মহিমাই আল মাহমুদের স্বাতন্ত্র।

কিন্তু আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে আল মাহমুদের পদ্য গীতিময়তা ও রোমান্টিকতার পরিচিত পরিমণ্ডলের বাইরে জীবনানন্দ দাশের মতো আধুনিক কোনো বোধ ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে কিনা সেটা গুরুতর বিতর্কের বিষয়। তাঁর জনপ্রিয় ও সফল কবিতাগুলো রোমান্টিক প্রেমের কবিতার অধিক কিছু নয়। আল মাহমুদের কবিতার জনপ্রিয়তার কারনে জীবনানন্দ দাশের পরে তাঁকে আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান কবি হিশাবে অনেকে দাবি করতে চাইছেন। সেটা আল মাহমুদের প্রতি ভালবাসা অবশ্যই। কিন্তু এই দাবি আল মাহমুদ, জীবনানদ দাশ কিংবা আধুনিক বাংলা কবিতার মূল্যায়নে কোনো কাজে আসে না। দরকার আধুনিক বাংলা কবিতার সামগ্রিক ইতিহাসে আল মাহমুদের স্থান বুঝে নেওয়া। সেটা আলাদা কাজ। কিন্তু সবার আগে বাংলাদেশে আল মাহমুদের কবিতার রাজনৈতিক তাৎপর্য বোঝাটা জরুরি।

অতএব যে কোনো সফল কবির মতোই আল মাহমুদ বাঙালি মুসলমান সমাজের অভ্যাস আচরণ সংস্কৃতির মধ্যে যে ‘শব্দ শিকারি’র ভূমিকা পালন করেছেন তার গুরুত্ব অপরিসীম। অখণ্ড বাংলা সাহিত্যে আধুনিক বাংলা কবিতায় বাঙালি মুসলমানের নিজের ন্যায্য হিস্যা দাবি করবার বিষয় আল মাহমুদে যে শক্তি নিয়ে হাজির হয়েছে তার তুলন নাই। ফলে যখন ষাট দশকের শেষের দিকে তাঁর ‘সোনালি কাবিন’ বেরোয়, তখন ‘কাবিন’ শব্দটি একটা ভূমিকম্পের মতো বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে উপেক্ষিত বা অদৃশ্য জনগোষ্ঠির সবল উপস্থিতি ঘোষণা করে। মহৎ কবিরা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা,। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাঁরা গণক। কিন্তু ‘সোনালি কাবিন’ কবিতা স্রেফ নামকরণ হিশাবেই অনন্য। সেটা ছিল বাংলাভাষী ও বাঙালি হিশাবে বাঙালি মুসলমানের সদর্পে হাজির হবার ঘোষণা, আধুনিক কাব্য ভাষা যাদের আয়ত্ব। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে একটি নতুন রাজনৈতিক গোষ্ঠির সম্ভাবনা হাজির হবার পর রাজনীতি তা অনুসরণ করে মাত্র। এই দিক থেকে বাংলা কবিতার ইতিহাসে আল মাহমুদের স্থান নির্দিষ্ট থাকবে।

আল মাহমুদ সদর্পে হাজির হয়েছেন আধুনিক বাংলা কবিতায় বাংলা ভাষায় বাঙালি মুসলমান কবি হিশাবে তাঁর ন্যায্য হিস্যা আদায় করে নেবার জন্য। ঔপনিবেশিক কলকাতায় উচ্চবর্ণের হিন্দুর হাতে তৈরি সাহিত্যের বিপরীতে তিনি ‘মুসলিম সাহিত্য’ বা ইসলামি সাহিত্য করতে আসেন নি। তাঁর মধ্য দিয়ে বরং বাঙালি বা বাংলাভাষীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের উত্থান আমরা লক্ষ্য করি। এখানেই আল মাহমুদের রাজনৈতিক তাৎপর্য। এই রাজনৈতিক তাৎপর্য বাদ দিয়ে আল মাহমুদের কবিতার বিচার সংকীর্ণ হতে বাধ্য। তাঁর কবিতার স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা এই রাজনৈতিক তাৎপর্য বাদ দিয়ে বোঝা যাবে না।

আল মাহমুদ একাত্তরে নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির আবির্ভাবের পদধ্বনি, এই কথা আমি এর আগেও বলেছি। কবিতায় আগামি ইতিহাস আগেই ধরা দিতে থাকে ‘চিতল হরিণীর জলপান’ করবার শব্দের মতো। এই জায়গায় আল মাহমুদ অসামান্য। ঠিক যে তাঁর কবিতায় ইসলামের কোন বিপ্লবী মর্মের অনুরণন আমরা দেখি না। যখন তিনি নিজেকে শব্দের জাদুকর না ভেবে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী কবি হিশাবে ভাবতে শুরু করেছেন, তখন তিনি বাঙালি জাতিবাদের বিপরীতে জাতিবাদি মুসলমানদের বাসনারই প্রতিধ্বনি করেছেন। বাঙালি বনাম মুসলিম জাতিবাদের চিপা থেকে বাংলাদেশের জনগণ কবে নিষ্ক্রান্ত হবে আমি জানি না, কিন্তু হবে বটে। কিন্তু ইসলাম এবং বাঙালি মুসলমানের জীবনযাপন ও ভাষা নিয়ে অখণ্ড বাংলা সাহিত্যে আল মাহমুদের সদর্প ও সরব আবির্ভাব বাংলা কাব্যকে যে গৌরব প্রদর্শন করেছে এবং বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিকতার অভিমুখ দেখিয়ে দিয়েছে তার তুলনা নাই।

বাঙালি জাতিবাদের বিপরীতে জাতিবাদী মুসলমানের মুকুট পরা আল মাহমুদের সাজে না। নিজের বিশ্বাস সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য দিয়ে আমরা তাঁর কবিতার মহিমা ধরতে পারব না।

এইসব তর্ক সাহিত্যের বাইরের কোলাহল, সাহিত্যে যার মূল্য সামান্যই। আল মাহমুদ সামগ্রিক অর্থে আধুনিক বাংলা কবিতার ভূগোল বদলে দিয়েছেন, সেখানেই তাঁর সবিশেষ কৃতিত্ব।

১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালি।

(লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘সিল্করুট’ বা দৈনিক বণিকবার্তার সাহিত্যপত্রে। কিছুটা পরিমার্জনা করা হয়েছে।)

ফরহাদ মজহার

কবি, চিন্তক, বুদ্ধিজীবী ও কৃষক। ‘প্রতিপক্ষ’ ও ‘চিন্তা’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। জন্ম: ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশের নোয়াখালি জেলায়। পড়াশুনা করেছে ওষুধ শাস্ত্র ও অর্থনীতি বিষয়ে যথাক্রমে ঢাকা ও নিউইর্কে। পেশা সূত্রে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশের ‘নয়াকৃষি আন্দোলন’-এর প্রধান সহযোদ্ধা। লালন ধারা-সহ বৃহৎ বঙ্গের ভাবান্দোলন পরম্পরার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সমাজ ও রাজনীতি চিন্তা এবং দার্শনিক বিষয়ে বহু গদ্য রচনা করেছেন। এছাড়াও লিখেছেন নাটক। অনুবাদও করেছেন।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top