আজ রবিবার, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আলোকচিত্রে গার্মেন্ট শ্রমিক

Author : ওয়াহিদ সুজন

কারখানা কেন বন্দি শিবির?/ জীবন কেন এতটা স্থবির?/ এত কাজ মজুরি পাই না/ বাঁচার মতো মজুরি পাই না/ বদ্ধ, দম বদ্ধ ঘরে/ আমার এ আটক/ মানি না। কফিল আহমেদের লাইন ক’টি নিয়ে পোস্টার করা হয়েছে। এই কথাগুলোরই সাক্ষী যেন তাসলিমা আখতারের তোলা ১৯ টি ছবি।

তাসলিমা বললেন, তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মী। তিনি গার্মেন্ট শ্রমিকদের সাথে প্রায় তিনবছর ধরে কাজ করছেন। তাদের কাজের পরিবেশ, জীবনযাত্রা, থাকার পরিবেশ নিয়ে তার এই কাজ। তার এই কাজ যদি তাদের জীবন ও আন্দোলনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে, তাতেই তার কাজের স্বার্থকতা।

ধানমন্ডির দৃক গ্যালারীতে ১৮ জুলাই ২০১০ এ শুরু হওয়া এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীর শিরোনাম গার্মেন্টে শ্রমিকের জীবন ও সংগ্রাম [The Life and struggle of garment workers]। চলবে ২৪ জুলাই ২০১০ পর্যন্ত। প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ, গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু এবং দৃকের জেনারেল ম্যানেজার এ এস এম রেজাউর রহমান। অনলাইনে অংশ গ্রহণ করেন পাঠশালার অধ্যক্ষ শহীদুল আলম।

মোশরেফা মিশু বলেন, গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন একমাত্রিক নয়। এর রূপ বহুমাত্রিক। এই ছবিগুলো গার্মেন্টে শ্রমিকদের সংগ্রামের কথা বলে। নিপীড়নের ধরন স্পষ্ট করে। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের বড় অংশ এই আন্দোলনকে নাশকতা মনে করে। তারা মনে করে, গার্মেন্ট শ্রমিক আন্দোলন মানেই ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড। তারা সেই অমানবিকতা নিপীড়নের কোনো খবর রাখেন না। তারা খবর রাখে না মাত্র ১৬৬২.৫০ টাকার মধ্যে তাদের সবকিছু সীমাবদ্ধ। এই শ্রমিকদের বেশির ভাগই নারী। তাদেরই বেশি নিপীড়ন সহ্য করতে হয়। এই আলোকচিত্রগুলো সে বিষয়গুলোকে তুলে ধরেছে। আমাদের সংগ্রামকে বহুমাত্রিক করেছে।

আনু মুহাম্মদ বলেন, নারী শ্রমিকদের রক্তাক্ত অধ্যায়ের বাস্তব চালচিত্র আলোকচিত্রের মাধ্যমে ধারণ করা যায় না। কিন্তু মুহূর্তগুলো হারিয়ে যায়। কেউ কেউ চায় সে মুহূর্তগুলো হারিয়ে যাক। তাই এই মুহূর্তগুলোর ছবি দরকার আছে। এগুলো সৌধ তৈরি করে। হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো রক্ষা করলে তার ওপর দাঁড়িয়ে নতুন নতুন মুহূর্ত তৈরি করা যায়।

তাসলিমার তোলা আলোকচিত্রে বিষয় হয়েছে গার্মেন্টেস শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ, থাকার ঘর, দৈনন্দিন কাজ, বিক্ষোভ-সংগ্রাম, পুলিশী-ক্যাডার হামলা, মৃতদেহ, মর্গ, স্মৃতি কাতরতা নানাবিধ খন্ড খন্ড চিত্র।

আলোকচিত্রকে সাধারণত, নান্দনিকতার মাপকাঠিতে বিচার করা হয়। সেক্ষেত্রে গার্মেন্ট শ্রমিকদের জীবন ও সংগ্রামের এই চিত্রকে মূল্যায়ন করা যায়। তাসলিমা নিজেকে রাজনৈতিক কর্মী স্মরণ করিয়ে বলেন, এটা তো মাধ্যম মাত্র। এর মাধ্যমে তিনি প্রকৃত অবস্থা জানাতে চান। এটি একই সাথে প্রতীকি আবার সরাসরি মাধ্যম বটে। যা মানুষকে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিষয়ে জানাবে, সচেতন করবে।

এত বড় একটি কাজ এত অল্প পরিসরে। তাসলিমার মতে, সংখ্যা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। ১৫টি ছবি নিয়েও একটা ভালো কাজ হতে পারে। তিনি আরো জানান, কাজটা আরো বড় পরিসরে করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আগে থেকে ভাড়া থাকায় মূল গ্যালারিতে প্রদর্শনীর আয়োজন করা যায় নি। তাই, দৃক গ্যালারীর দো’তলার করিডরে আয়োজন করা হয়েছে। ২৮শে জুলাই গার্মেন্ট শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হবে। তার আগে আগেই কাজটি করা দরকার মনে করেছেন। সেটাকে সামনে রেখেই স্বল্প পরিসরে কাজটা করতে হল। ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে কাজ করার আশা রাখেন।

পাট এবং কাগজের মতো গুরুত্বপূর্ণ বেশির ভাগ শিল্প কারখানা বন্ধ হবার পর পোষাক শিল্প একক বৃহত্তম খাতে পরিণত হয়েছে। এখানকার ৩০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৮০ ভাগই নারী। ৮০ এর দশক থেকে বিকশিত এই শিল্প খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা ৭৬ ভাগ আসে। তাসলিমার মতে, এ গুরুত্বপূর্ণ খাতকে বাঁচাতে হলে শ্রমিকদের বাঁচতে দিতে হবে। মাত্র ১৬৬২.৫০ টাকাই কি হয়? শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি হল কমপক্ষে ৫০০০ টাকা মজুরি দিতে হবে। পাঠশালার অধ্যক্ষ শহীদুল আলমের মতে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা সহ রাষ্ট্রীয় নানা সুবিধা ভোগ করছি এই গার্মেন্টস শ্রমিকদের কষ্টার্জিত বিদেশী মুদ্রায় ভর দিয়ে। আমাদের সচেতন হতে হবে। শুধুমাত্র রাজনীতিকদের ওপর ভরসা করলে কিছুই হবে না। আমাদেরকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।

উদ্বোধনী বক্তব্যে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সে শিল্পই বড় যা মানুষকে বিচলিত, সচেতন, উদ্বিগ্ন করে, ধাক্কা দেয়। এই প্রসঙ্গে তিনি কয়েকটি ছবির কথা উল্লেখ করেন। সালমা নামের এক অসুস্থ গার্মেন্টস কর্মী একটানা বাধ্যতামূলক ওভারটাইম আর ডিউটির চাপে মারা যায়, সালমার ছবি নিয়ে তার সহকর্মীরা মিছিল করছে। আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, ১৫০০ টাকায় ভাড়া এক রুমে ১১ জন সদস্যের পরিবারের একসাথে ঘুমানো। তিনি আরো বলেন, শিল্পকে নৈর্ব্যক্তিক হতে হয়। ছবি বাস্তবতাকে উন্মোচিত করে। নান্দনিকতার খাঁচায় বাস্তবতাকে তুলে ধরায় দায়িত্ববোধ আছে। তিনি গণমাধ্যমের সাথে এসব আন্দোলনের বিচ্ছিন্নতাকে উল্লেখ করে বলেন, গণমাধ্যম আর গার্মেন্টসের মালিক তো একই।

উপস্থিত ছিলেন কিছু গার্মেন্ট কর্মী। তাদের কেউ কেউ শ্রমিক আন্দোলনে স্বজন হারিয়েছেন। তারা ছুটি নিয়ে এই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন।

তাসলিমা আখতারের জন্ম ১৯৭৪ এ ঢাকায়। বর্তমানে তিনি পাঠশালায় ফটো সাংবাদিকতায় ৩য় বর্ষের ছাত্রী। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিষয়ে এমফিল ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অবস্থায় বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। বর্তমানে তিনি শ্রমিক এবং নারী সংগঠনের কাজের সাথে যুক্ত। ছবি নির্মাণের কাজকেও তিনি তার রাজনৈতিক কাজেরই অংশ মনে করেন। ম্যাগনাম এর হিউম্যান রাইটস এন্ড ফটোগ্রাফি কোর্সের স্কলারশিপের জন্য সাউথ এশিয়া থেকে তিনি এ বছর নির্বাচিত হন। তার আগ্রহের জায়গা ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি। ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে নারী-পরিবেশ-সংস্কৃতি ও সামাজিক বৈষম্য বিষয়ে কাজ করতে তিনি আগ্রহী।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top