আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩রা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩রা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

চরাচরসার সরস্বতী

।। আর্য সারথী ।।

সরস্বতীই আত্মজ্ঞান, সরস্বতীই মুক্তি। ‘আত্মজ্ঞান’ শব্দটা শুনতে বেশ। এটা লাভ করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। কিন্তু আত্মজ্ঞান কি বাহ্যিকভাবে পাওয়ার বিষয়? অন্য দশটা-পাঁচটা বস্তু যেভাবে আমরা পেতে পারি আত্মজ্ঞান কি সেভাবে পাওয়া যায়? আমরা আমাদের জিজ্ঞাসাকে আরও সূক্ষ্ম তলে নিয়ে যেতে পারি৷ কিছু করা (প্রবৃত্তি) বা কিছু না করা (নিবৃত্তি)— এগুলোর সাথে আত্মজ্ঞানের সম্পর্ক কী? প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি তো একই অহং বৃত্তির দুই রূপ বা দুই ধরনের ঝোঁক। তাহলে এই দুটো জিনিস দিয়ে কীভাবে আত্মজ্ঞান সম্ভব? আত্মজ্ঞান আমাদের সহজ অভিব্যক্তি মাত্র। সকল আবরণ সরিয়ে দিলেই তা ধরা দেয়। আমরা প্রতিনিয়ত প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির দ্বন্দ্বে সবকিছু জটিল করে ফেলি। দরকার প্রবৃত্তি ও মধ্যবিন্দুতে প্রবেশ করা। সেটাই সহজাবস্থা। সহজাবস্থা হলো নির্বিশেষ অবস্থা। এই অবস্থা অন্তর ও বাহিরের মিলনস্থল বা সন্ধিবিন্দু৷ জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান অথবা দ্রষ্টা, দৃশ্য ও দর্শন এইখানে একাকার হয়ে যায়। তাই নির্বিশেষ অবস্থা যেমন সকল বিশেষের একীভূত এক নিরাকার অবস্থা তেমন সকল বিচিত্রতার মিলনে নামরূপ সম্বলিত নতুন সম্ভাবনার সাকার অবস্থা৷ অর্থাৎ নিরাকার ও সাকার দুই অবস্থাই এটা।

অলংকরণ: লুবণা চর্যা

অনন্ত শক্তির অনন্ত প্রকাশমহিমা যখন অর্থ ও ভাবের সমন্বয়ে আমাদের সামনে আসেন তখন তাঁর নাম সরস্বতী। সত্তার সমগ্র স্পন্দন ও প্রাণের সজীব অনুভূতি যখন দৃশ্যমান কাঠামোর অন্তরালে থাকা সহজ সত্য হিসেবে মূর্ত হন তখন তাঁর নাম সরস্বতী। যে শক্তি অরূপ হয়েও রূপ গঠনের মাধ্যমে চেতনাকে ‘আত্মসচেতন’ করে তোলেন তিনিই সরস্বতী। সরস্বতীই সবকিছু ধারণ করে আছেন। সকল জ্ঞান, সকল ঐশ্বর্য, সকল তেজ ও সকল দিব্য সম্পদের অধিশ্বরী তো তিনিই। সত্যের অখণ্ড কিন্তু বৈচিত্র‍্যময় প্রকাশকে আত্মীকরণ করার যজ্ঞের মূল তো তিনিই। আনন্দের তেজঘন রূপ সরস্বতী। হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বই তাঁর আভূষণ। সমস্ত শুদ্ধতা যেন তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে মিশে আছে। তাই দেবী সরস্বতী সর্বশুক্লা।

ঋগ্বেদ বলছে দেবী সরস্বতী জল বা নদী। আবার তিনি চোদয়িত্রী। ঋষি বিশ্বামিত্রের পুত্র ঋষি মধুছন্দা বলেছেন এই কথা! কত গভীর কথা বলে দিলেন তিনি। দেবী সরস্বতী জ্ঞানাধিষ্ঠাত্রী, পতিতপাবনী ও জয়প্রদায়িনীষ। তিনি শুধু প্রজ্ঞা দেন না, জাগতিক সম্পদও দেন। তিনি কর্মফলবিধায়িনী। তিনি সত্যের প্রেরণা দেন বলে চোদয়িত্রী। এর অর্থ তিনি জাগরণের দেবী, সুবুদ্ধি উন্মেষের দেবী ও বলবীর্যের দেবী। বলবীর্যের মূল তো সত্য, ধী ও প্রজ্ঞা। যার ভেতরে জাগরণ এসেছে সে বলবীর্যশালী হতে পারে। তাই বলবীর্যের মূলও সরস্বতীই। এখন প্রশ্ন হল, সরস্বতী কীভাবে আমাদের ধী শক্তি বৃদ্ধি করেন ও জাগ্রত করেন? এখনই বলতে হয় ঋষি মধুচ্ছন্দার কথা। দেবী তো নদী বা দেবী তো জল।জল বা নদীর সাথে কীসের সম্পর্ক? কোমলতা, স্নেহ ও প্রবাহের সম্পর্ক। জল বা নদী কৃষিকাজ সহ বিভিন্ন উৎপাদন কর্মের সাথে জড়িত। সভ্যতার বিকাশ নদীর তীরেই হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও জল যেন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। জ্ঞানচর্চা হোক, এবাদত হোক, ব্যবসায় হোক, কৃষি হোক বা জীবনধারণের জন্য প্রাত্যহিক জলসংগ্রহ হোক সবকিছুর সাথে জল ও নদীই জড়িত। আমাদের পরিবেশ, আমাদের ভূগোল ভাবনা, আমাদের সমাজসংগঠন, আমাদের এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি যেন নদী বা জলের সাথেই মিশে আছে। এই নদীই বিভিন্ন কারণে অসংখ্য দেশ তৈরি করে ও বিলুপ্ত করে। নদীই বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে সংযোগ তৈরি করে। নদী বা জল যেন জীবনের মূর্ত প্রতীক। আমাদের বেঁচে থাকা ও বিকশিত হওয়ার জন্য প্রদেয় শ্রম যেন জলের সাথে একাকার হয়ে থাকে। ঋষি মধুছন্দা এই নদী বা জলভাবনার সাথে সরস্বতীকে যুক্ত করছেন। সরস্বতীর সাথে প্রজ্ঞার যে সম্পর্ক বা আত্মসচেতন হওয়ার যে সম্পর্ক তা তিনি বিমূর্তভাবে ব্যাখ্যা করেননি। তিনি এমন এক উদাহরণ দিয়েছেন যেন সকলে সরলভাবে বুঝতে পারে।

ঋষি মধুচ্ছন্দা এখানে প্রচণ্ড ধীশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। তিনি চেয়েছেন আমরা যেন নিজের সম্পর্কে, আমাদের পরিবেশ সম্পর্কে ও চিন্তার সজীবতা সম্পর্কে আগ্রহী হই তথা সচেতন হই। তিনি সচেতন হওয়াকে আধ্যাত্মিক চর্চার ভিত্তিস্বরূপ বিবেচনা করেছেন।তাই সরস্বতী বোঝাতে গিয়ে জল বা নদীর কথা বললেন। তিনি বোঝাতে চাইলেন আমাদের চিন্তা-চেতনা ও চিন্তা-চেতনার বিষয়ের যে আপাত ভেদ এই ভেদ আপেক্ষিক। এই ভেদ বৈচিত্র‍্যের সহজ প্রকাশ। যখন এই ভেদকে অতিক্রম করা যাবে তখনই প্রকৃত প্রস্তাবে প্রাজ্ঞ হওয়া সম্ভব। এর অর্থ সরস্বতী কেবল বাচিক বা মানসিক তত্ত্বচর্চায় সীমাবদ্ধ নয়। ওটা যারা বলে তারা সরস্বতীকে বুঝতে ব্যর্থ। জীবনের সমস্ত সম্পর্কের সজীব প্রকাশ হলেন সরস্বতী। সরস্বতীকে পেতে হলে প্রকৃতির সব ধরনের প্রকাশকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে ও জীবনের সব রঙকে গায়ে মাখতে হবে৷ জীবনের বৈচিত্র‍্যের মূলে রস খুঁজে পেতে হবে। জীবনের রস আস্বাদন করে জীবন স্রোতে ভেসে থাকতে হবে। এর কারণ কী? সরস্বতী যে রসময়ী। তিনি যে নদী। জীবনের গহীনে গিয়ে তার সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করলেই সরস্বতীর ভুবনমোহিনী রূপের দর্শন মেলে।

আমাদের যে প্রকৃতিভাবনা, আমাদের যে বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক মনোভাব ও আমাদের যে মাতৃশক্তির তত্ত্ব তা যেন সরস্বতীর মাঝে সুচারুভাবে মিশে আছে। সরস্বতী যেন মায়ের মত স্নেহধারার বর্ষণ করেন ও সন্তানের মঙ্গলকামনা করেন। তিনি নদী কারণ তিনি অমৃতবাহিনী।তাঁর স্রোত সাধারণ কোনো স্রোত নয়।এটা স্নেহধারা।তিনি অনন্ত বিভূতির অধীশ্বরী ও অনন্ত গুণের উৎস।অথচ সন্তানের কাছে যেন স্নেহের নির্ঝরিণী। আমরা আমাদের সমগ্র কর্মযজ্ঞকে ‘এক’ হিসেবে দেখলে ও জীবনের গূঢ় রহস্যের সন্ধান করলে দেখতে পাব, মা তাঁর সন্তানকে কোলে তোলার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।

তন্ত্রচর্চা আমাদের বুঝতে শেখায়, সরস্বতী ভৌতিক দৃষ্টিতে জল, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে প্রাণ আর দৈবিক দৃষ্টিতে হয় চিন্ময় প্রকাশ।নদী, নারী, মা, দেবী সবই সরস্বতী। তাই সরস্বতীই হলেন পরা ও অপরা। সকল বিদ্যার আধার। তিনিই জগতের স্পন্দন, তিনিই বাঙ্ময়ী। সরস্বতীর সরঃ হল জল আর এই জল জল হওয়ার সাথে সাথে জ্যোতিও বটে। যিনি জল ও জ্যোতিরূপে সমগ্রবিশ্বের কারণ, যিনি জগতের শোভা, স্পন্দন ও বাকের প্রকাশ এবং জগৎকে বিদ্যার সাথে পরিচিত করিয়ে দেন তিনিই সরস্বতী। সরস্বতী নদীরূপে সারাবিশ্বে বিরাজিতা। সরস্বতী জ্ঞানের নদী, বিজ্ঞানেরও নদী। দ্বৈতে জ্ঞান আর অদ্বৈতে হয় বিজ্ঞান। বিদ্যার জ্যোতি, ব্রহ্মজ্ঞানের জ্যোতিরূপে সর্বত্রব্যাপিনী সরস্বতী হলেন আলোকময়ী। আর এই কারণে তিনি সর্বশুক্লা। বলা যেতে পারে, এগুলো তো বেদের কথা। যদি বেদের কথাই হয় তবে তন্ত্রের মৌলিকত্ব কী? এক্ষেত্রে একটা কথাই বলা যায়, তন্ত্র একটা একীভূত চর্চার প্রক্রিয়া। অনন্ত জ্ঞানরাশি ও পদ্ধতিকে সমন্বয় করার কাজ তন্ত্রের। তাই তন্ত্র তত্ত্বের সাথে সাথে সরস্বতীর বীজমন্ত্র, ধ্যানমন্ত্র, প্রণাম মন্ত্র, প্রতীক পূজা ও পূজায় প্রাণায়ামাদি যোগ করে নূতন রূপ প্রদান করেছে উপাসনার। বেদ-বেদান্ত উচ্চকোটির তাত্ত্বিকদের জন্য তত্ত্বজ্ঞানের ব্যবস্থা করেছে, তাতে সবার ‘প্রবেশাধিকার’ নেই। তন্ত্র সেই সংকট দূরীভূত করে অধিকারী-অনধিকারী সকলে যুক্ত করেছে কাজে। তাই সরস্বতী বেদের চেয়ে তন্ত্রের মাধ্যমে অধিক ভাস্বর৷ সরস্বতী তত্ত্ব তন্ত্রের মাধ্যমে যতখানি বৈচিত্র্য লাভ করেছে তা অন্য কোনো পদ্ধতিতে হয়নি। চণ্ডীর মহাসরস্বতী হোক, তন্ত্রের নীলসরস্বতী হোক, তন্ত্রের ষোড়শী হোক— কোথায় সরস্বতী নেই?

সরস্বতীর সাথে হংস, বীণা ও পদ্মের সম্পর্ক ব্যাপক। সরস্বতী বললেই এগুলো আমাদের মাথায় আসে। এই প্রতীকের অন্তরালে কোন বার্তা লুকিয়ে আছে? পদ্ম হলো অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত হবার প্রতীক। শক্তির লীলা পদ্মের মতো করেই বিকশিত হয়। পদ্ম ওপর থেকে দেখতে চক্রাকার। চক্র বা বৃত্তের শেষ বা শুরু দেখানো যায় না। শক্তিকেও শেষ বা শুরু দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আবার শক্তির ক্রিয়াকেও আদি বা অন্ত দিয়ে বিচার করা যায় না। একইসাথে আদি ও একইসাথে অন্ত হলো চক্র বা বৃত্ত। পদ্ম ও শক্তি যেন এক হয়ে আছে সরস্বতীতে। পদ্ম পাঁকে জন্মালেও এর প্রকাশ কিন্তু দ্যুতিময়। তাই পদ্মকে পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। পদ্ম জীবন, বিকাশ, উর্বরতা, পবিত্রতা ও নির্লিপ্ততার প্রতীক। তাছাড়া পদ্মের দ্যুতিময়তা সূর্যকেও নির্দেশ করে। পদ্ম এমন এক উদ্ভিদ যাতে ফুল ও ফল একত্রে হাজির থাকে। ফুল-ফলকে কার্য-কারণ মানলেই বিশাল দার্শনিক তত্ত্ব খুব সহজেই বুঝে যেতে পারি। অর্থাৎ কার্য ও কারণ একইসাথে বিরাজ করে সেই তত্ত্ব খুব সহজেই পদ্ম দিয়ে প্রকাশ করা যায়। পদ্মের পাপড়ি ফলকে বেষ্টিত করে থাকে এবং পদ্ম ফলকে বহন করে। পরমজ্ঞান লাভ করতে হলেও এই জগতে পদ্মের মত হতে হবে । শত-সহস্র আবর্জনার মধ্যে বাস করেও নিজেকে তার থেকে আলাদা রাখতে হবে, দৃঢ়তার সাথে নিজের সত্তাকে বিকশিত করতে হবে এবং নিজের সারবস্তুকে পদ্মের পাপড়ির মত কোমলতার সাথে আগলে রাখতে হবে। অর্থাৎ পদ্মকে বুঝলে আমরা সরলভাবে অনেক গূঢ় রহস্য বুঝে যেতে পারি। হংসের প্রজনন শক্তি অসাধারণ। হংস শব্দের সাথে হং ও সঃ এর সম্পর্ক ব্যাপক। আবার সোহং ও ওম্ এর সাথেও হংসের সম্পর্ক আছে। আবার অহং সঃ এর তত্ত্ব হলো হংস। আমিই যে তুমি অর্থাৎ পরমই যে বহু হয়ে জীবরূপে হাজির হয়েছেন সেই তত্ত্বও হংস৷ তাছাড়া হংসে হ-রূপী পুরুষ ও স-রূপী প্রকৃতি দুজনই আছে। হংসকে ধরা হয় বিবেকের প্রতীক। দুধ ও জল মিশিয়ে দিলে হংস দুধ বেছে খায় আর জলে থাকলেও গায়ে জল লাগে না। অর্থাৎ হংসও পদ্মের মতো অনেক গূঢ় রহস্য প্রকাশ করে।

সরস্বতীর হাতে বীণা কেন? তিনি হাতে বীণা নিয়ে শব্দব্রহ্মের অব্যক্ত তত্ত্ব আমাদেরকে দান করছেন। তিনি সৃষ্টির কারণ বলে ময়ূরের সাথে তাঁর সম্পর্ক আছে। আমরা জানি যে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের অনেক জায়গায় ময়ূরও সরস্বতীর বাহন। ময়ূরও সৃষ্টি, জ্ঞান, সৌন্দর্য ও যৌবনের প্রতীক। সৃষ্টির শুরুতে সবই অব্যক্ত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। এর পরই জ্যোতির দেখা মেলে। এই জ্যোতি সরস্বতীর দ্বারাই উদ্ভূত। তাই শুক্লা সরস্বতীর বর্ণের সাথে সৃষ্টিরও যোগাযোগ আছে। তাছাড়া পরা ও অপরা সবধরনের বিদ্যা যেহেতু তিনি দান করেন তাই তিনি কামেরও দেবী। কামের লীলা ছাড়া সৃষ্টি অসম্ভব। কিন্তু শেষ বিচারে তিনিই চরাচরের সার। তাই ধ্যানমন্ত্রে সরস্বতী হলেন সর্বাঙ্গসুন্দরী, কামসমুল্লাসবিহারিণী ও কামোদ্রেককারিণী। তাঁর কামপ্রভাব থেকে কারো নিস্তার নেই। যে কামকে অস্বীকার করতে চাইবে সেই পতিত হবে। কাম থেকেই নিষ্কামে যেতে হয়। সরস্বতীর পূজা আমরা করি শীতের শেষ ও বসন্তের শুরুতে—বসন্ত পঞ্চমীতে। অর্থাৎ আমরা যেন সরস্বতীর তত্ত্বকে খণ্ডিত না করি তাই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা ঋতুর সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন। অনেকে সরস্বতী পূজাকে প্রণয়ের দিবস বানিয়ে ফেলেছেন। যদিও এরা মাহাত্ম্য না বুঝেই বা নিজের প্রবৃত্তির তাড়নাতেই এমনটা করেছে। যথেচ্ছাচারের ফলে সরস্বতীর অমর্যাদা হয় বলে এর পক্ষে বিশেষ কিছু বলাও যায় না। তবে দার্শনিক দৃষ্টিতে এর পক্ষে কিন্তু যুক্তি আছে। সরস্বতীর কাম ও প্রেম জড়িত। সেক্ষেত্রে সরস্বতী পূজা শুধু গুরুগম্ভীর প্রজ্ঞার উৎসব নয়, কাম ও প্রেমের উৎসবও বটে। কাম ও প্রেম কি প্রজ্ঞার বাইরে কিছু? এগুলো সবই পুরাণ বা চলতি কথাবার্তার অংশ৷ আবার এগুলোর মাঝেই লুকিয়ে আছে গভীর জ্ঞান৷ আবার কত কত প্রতীক ও উপমার খেলা। তন্ত্র যদি না থাকতো তবে সবকিছুর এমন সুন্দর সমন্বয় হতো কীভাবে? ভাবলেও অবাক লাগে।

সরস্বতীই আত্মজ্ঞান, সরস্বতীই মুক্তি। ‘আত্মজ্ঞান’ শব্দটা শুনতে বেশ। এটা লাভ করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। কিন্তু আত্মজ্ঞান কি বাহ্যিকভাবে পাওয়ার বিষয়? অন্য দশটা-পাঁচটা বস্তু যেভাবে আমরা পেতে পারি আত্মজ্ঞান কি সেভাবে পাওয়া যায়? আমরা আমাদের জিজ্ঞাসাকে আরও সূক্ষ্ম তলে নিয়ে যেতে পারি৷ কিছু করা (প্রবৃত্তি) বা কিছু না করা (নিবৃত্তি)— এগুলোর সাথে আত্মজ্ঞানের সম্পর্ক কী? প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি তো একই অহং বৃত্তির দুই রূপ বা দুই ধরনের ঝোঁক। তাহলে এই দুটো জিনিস দিয়ে কীভাবে আত্মজ্ঞান সম্ভব? আত্মজ্ঞান আমাদের সহজ অভিব্যক্তি মাত্র। সকল আবরণ সরিয়ে দিলেই তা ধরা দেয়। আমরা প্রতিনিয়ত প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির দ্বন্দ্বে সবকিছু জটিল করে ফেলি। দরকার প্রবৃত্তি ও মধ্যবিন্দুতে প্রবেশ করা। সেটাই সহজাবস্থা। সহজাবস্থা হলো নির্বিশেষ অবস্থা। এই অবস্থা অন্তর ও বাহিরের মিলনস্থল বা সন্ধিবিন্দু৷ জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান অথবা দ্রষ্টা, দৃশ্য ও দর্শন এইখানে একাকার হয়ে যায়। তাই নির্বিশেষ অবস্থা যেমন সকল বিশেষের একীভূত এক নিরাকার অবস্থা তেমন সকল বিচিত্রতার মিলনে নামরূপ সম্বলিত নতুন সম্ভাবনার সাকার অবস্থা৷ অর্থাৎ নিরাকার ও সাকার দুই অবস্থাই এটা। তাই হয়ত ভারতবর্ষে সর্বোচ্চ স্তরে সাকারোপাসনা স্বীকৃতি পেয়েছে। সাকার নিম্নস্তরের জন্য স্বীকৃত সে’কথা স্বীকৃত। কিন্তু, বড় বড় ব্রহ্মজ্ঞ ঋষিরা তাও সাকার উপাসনা স্বীকৃতি দিলেন শুধু লোকশিক্ষার জন্য? একদমই নয়। বরং তাঁরা বুঝিয়ে দিলেন সাকার-নিরাকারের দ্বন্দ্ব পরমে সমাধান হয়ে যায়। এই সহজাবস্থায় যা সাকার তা নিরাকার ও যা নিরাকার তা সাকার। এইখানে সাধারণ জাগতিক সমীকরণ চলে না৷ এখানে যেমন সবকিছু মিশে এক আকারহীন অবস্থা তৈরি হয় তেমন তৈরি হয় নূতন আকার। এই সহজভাবই আত্মজ্ঞান। সাধনা কখনো এই সহজকে পাওয়ার জন্য নয় বরং অ-সহজকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য৷ সাধনা কীভাবে করতে হয়? কীভাবে সকল শঙ্কা দূরীভূত হয়? কীভাবে সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়? এই সবকিছুর উত্তর আছে জীবনে৷ জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবীই সরস্বতী।

১লা ফাল্গুন, ১৪৩০
বসন্ত পঞ্চমী, সরস্বতী পূজা

আর্য সারথী

২৯ শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪০৭ বঙ্গাব্দে গাজীপুরের টঙ্গীতে একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদিনিবাস জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার রায়দেরপাড়া গ্রামে। বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি, সঙ্গীত প্রভৃতির প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় । তাঁর ইতোপূর্বে প্রকাশিত ‘মজলুমের সহজপাঠ প্রথম পর্ব’ ও ‘ভাব সমাহার’ সুধী মহলে সাড়া ফেলেছে। বর্তমানে ইউটিউবে ভিডিও তৈরি করে থাকেন।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top