আজ বৃহস্পতিবার, ১লা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মাতৃভাষায় শিক্ষা, ভাষা বৈচিত্র্য ও বহুভাষিকতা

।। সম্পাদকীয় প্রতিবেদন ।।

আসলে কয়েক কিলোমিটার অন্তর একই ভাষার কিঞ্চিৎ রুপান্তর ঘটে। নদী যেমন এক বাঁক থেকে অন্য বাঁকে যাওয়ার আগে নতুন নতুনভাবে ধরা দেয়। বৈচিত্র‍্যকে ধারণ করেই ভাষার ঐক্য সম্ভব। তা না করে যখন ফোর্ট উইলিয়ামজাত কলোনিয়াল কৃত্রিম বাংলাকে আধুনিক কলকাতা ‘মান্য ভাষা’ ‘প্রমিত ভাষা’ বলে চিহ্নিত করে তখন ভাষার ঐক্যে ফাটল ধরে। সম্ভবত এই ফাটলের জেরেই কলকাতার বাংলার সঙ্গে ঐক্য সুদৃঢ় নয় মেদিনীপুর কিংবা চট্টগ্রামের বাংলা ভাষার। মাতৃভাষায় শিক্ষা যেমন জরুরি তেমনই প্রতিটি উচ্চারণবিধি সমান গুরুত্ব দাবি করে। যেভাবে বাংলা ভাষার মতোই সমান গুরুত্ব দাবি করে বঙ্গের অন্যান্য নিজস্ব ভাষাগুলো।…

পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার অধিকারের দাবিতে মিছিল

বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে ইউনেস্কো তাদের কর্মসূচি প্রণয়নের দিক থেকে মাতৃভাষায় শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার অধিকারএবং বহুভাষিক শিক্ষা পরিসর গড়ে তোলার উপর জোর দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ২০২১ সাল থেকে শুরু করে এবছর অবধি মোটামুটিভাবে  ইউনেস্কোর ডিরেক্টার জেনারেল অর্ডে আজুরে তাঁর ভাষণে এই বিষয়গুলোর ওপরেই জোর দিয়েছেন। শুধু তাই নয় সরকারিভাবেই ইউনেস্কো এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে যে বিষয়গুলোর উপর জোর দিয়েছে, সেগুলো হল মাতৃভাষায় শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা অধিকার এবং বহুভাষিক শিক্ষা। এবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ইউনেস্কোর থিম, ‘Multilingual education is a pillar of intergenerational learning‘, অর্থাৎ বহুভাষিক শিক্ষা আন্তঃপ্রজন্মীয় শিক্ষার একটি স্তম্ভ। ইউনেস্কো বলছে, গোটা বিশ্বের ২৫০ মিলিয়ন শিশু-কিশোর ও তরুণ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারে না। ৭৬৩ মিলিয়ন মানুষের প্রাথমিক শিক্ষাটুকুও নেই। এহেন পরিস্থিতিতে প্রথম মাতৃভাষায় শিক্ষাপ্রসার এবং দ্বিতীয়ত মাতৃভাষা ছাড়াও অন্যান্য ভাষাশিক্ষার সুযোগ তৈরি করার উপর জোর দিচ্ছে ইউনেস্কো। এখন ইউনেস্কোর এই লক্ষ্য এবং ওয়াদার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের নিজস্ব ভাষা ও দেশীয় পরিসর পর্যালোচনা ভাষাদিবসের বিশেষ কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।

আমরা যদি উপমহাদেশের সবকটি বঙ্গীয় পরিসরের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব এখানকার বৃহৎ ভাষিক জনগোষ্ঠির বাঙলা ভাষায় শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার বিষয়টি ক্রমশই কোণঠাসা হচ্ছে। উপমহাদেশ তথা গোটা বিশ্বে বৃহৎ বঙ্গীয় পরিসর বা বড় বাংলার মধ্যে বাঙালি বা বাংলাভাষাভাষি মানুষ সবচেয়ে বেশি যে রাষ্ট্রে বসবাস করে, সেটি হল বাংলাদেশ। ভাষার জন্যে যে জাতি ১৯৫২তে প্রাণ দিয়েছিল, ভাষাকে সামনে রেখে যে জাতি একাত্তরে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েম করে ফেলেছিল, বাঙালির সেই বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত শিক্ষার সুযোগ ও চল কেমন? সকলেই জানেন বাংলা মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের পড়ানোর চল বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে খুবই কম। এ কারণে একতরফা অভিভাবকদের দোষ দিয়েও লাভ নাই। কেননা এরকম একটা প্রোপাগান্ডা প্রায় সত্য আকারে আমাদের মনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে যে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও ভবিষ্যত পেশাজীবনে গোটা বিশ্বের প্রায় তিরিশ কোটি মানুষের মুখের জবান বাংলায় বিরাট কোনও সম্ভাবনা নাই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বাংলা মাধ্যমে শিক্ষালাভের সুযোগ থাকলেও সে কারণেই হয়তো বা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল অভিভাবকেরা ইংরাজি মাধ্যমের কনভেন্ট স্কুলে তাঁদের সন্তানদের পাঠান। আর উচ্চশিক্ষায় তো ইংরাজি ছাড়া কয়েকটি বিষয় বাদে পড়াশুনার তেমন সুযোগও নাই। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের ভাষা ব্যবস্থায় ভিন্ন একটি রাজনৈতিক হুমকি ও আধিপত্য থাকার কারণে ( সে বিষয়ে পরে আসছি} সেখানে বাংলা ভাষা, বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা নানাভাবে কোণঠাসা হলেও বাংলাদেশে কিন্তু এরকম অবস্থা তৈরি হওয়ার কোনও কারণই ছিল না। আমাদের পূর্বপ্রজন্মের বিদ্বজ্জন, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, গবেষক, প্রকৌশলি, ব্যারিস্টার-সহ সমাজের সকল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের বেশিরভাগ মানুষ কিন্তু প্রাথমিক থেকে নিদেনপক্ষে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমেই পড়াশুনা করেছেন। আসলে বাংলা মাধ্যম সন্তানকে পড়ালে ইংরাজি ভাষা তারা শিখতে পারবে না, এ জাতীয় প্রচারের পিছনে ভুবনায়িত সমাজব্যবস্থা, নয়া উদার অর্থনীতির সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ নয়া শিক্ষাব্যবস্থা সম্পৃক্ত। সেটা কেমন? সেটা হল শিক্ষার পণ্যায়ন। পণ্যবাদী অর্থনীতি সেই গত শতাব্দীর আটের দশকের শেষ দিক থেকেই শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরিত করার যে চেষ্টা চালিয়েছে, আজ তা অনেকাংশেই বাস্তবায়িত। দিকে দিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বাণিজ্যিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সে সাক্ষ্যই দেয়। বাংলাদেশের ঢাকা-সহ সবকটি মেট্রোসিটিতেই এইসব মুনাফাখোর বাণিজ্যিক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের রমরমা। এবং তাদের মুনাফাবাণিজ্যের সুযোগ করে দিয়েছে খোদ রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন শাসক। যদিও বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল শ্রেণির মানুষের কাছেই শিক্ষালাভ ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসাবে আজও বাংলা ভাষা গুরুত্বপূর্ণ।

এবার আসা যাক বাংলাদেশের বাইরে থাকা উপমহাদেশের বৃহৎ বঙ্গের অন্যান্য বঙ্গীয় অঞ্চলগুলোর প্রসঙ্গে। অর্থাৎ ভারতীয় য়ুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে থাকা বাংলা অঞ্চলগুলোর কথা এক্ষেত্রে বোঝানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবার প্রথমেই চলে আসে পশ্চিমবঙ্গের কথা। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা একদিকে ‘মান্য’ ভাষা বা ‘প্রমিত’ বাংলার নিরিখে সামগ্রিকভাবে বাংলা ভাষার উপর খবরদারি করেছে। তথাকথিত নবজাগরণের বদৌলতে বাবু বাঙালিরা উপনিবেশপূর্ব ও বঙ্গে তথাকথিত উচ্চবর্ণের আগমনপূর্ব সময়কার বাংলা ভাষার ঐতিহ্যকে একপ্রকার পাশ কাটিয়ে ‘তৎসম’, ‘তদ্ভব’ শব্দের আধিক্য ঘটিয়ে অকাতরে বিযুক্ত করেছে দেশিয় শব্দ ও আরবি-ফার্সির উপাদান। বঙ্গে সুলতানি শাসনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার যে প্রসার ঘটেছিল তা নবজাগরণি কলকাত্তাইয়া সম্প্রদায় খুব সহজেই মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু এটা করতে গিয়ে আজ নয়া সঙ্কটে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি তথা বাংলাভাষিরা। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি জাতিবাদী শাসক গোটা ভারতে বাঙালি ও বাংলা ভাষার ওপর নামিয়ে এনেছে বিরাট হামলা। একদিকে ভারতীয় যুর্করাষ্ট্রে সাংবিধানিক ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রসারে রাজ্যগুলোর অধিকারকে ক্রমাগত খর্ব করে নয়া শিক্ষানীতির নামে হিন্দি ও ইংরাজিতে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রশাসনিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় শিক্ষার বদলে হিন্দি অথবা ইংরাজি বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বঙ্গের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা চালিয়ে উত্তর ভারতীয় হিন্দু-হিন্দি চেতনা কায়েম করছে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসকবর্গ তথা জাতিবাদী সংঘ পরিবার। এছাড়াও রয়েছে বাংলাভাষীদের ওপর ভারতের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। বাংলা ভাষায় কথা বললেই ‘বিদেশী’ ও অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া ২০১৯ থেকে চালু রয়েছে ভারতে। প্রথমে ঈশানবঙ্গে বা অসমের বঙ্গীয় অঞ্চলে ১২ লাখ বাঙালি হিন্দু ও পাঁচ লাখ বাঙালি মুসলিমের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে ভারত রাষ্ট্র। এরপর এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বেশ কিছু জেলার বহু মানুুষের ভারতের নাগরিকত্বের আবশ্যক নথি আধারকার্ড বাতিল করছে! মূলত নিম্নবর্গের বাঙালির ওপর এই রাষ্ট্রীয় হামলা শুরু হলেও অচিরেই তা পশ্চিমবঙ্গের সব অংশের মানুষের দিকেই প্রসারিত হবে। কারণ, ভারতের নাগরিকত্ব প্রমাণ দিতে ভারতের বঙ্গীয় অঞ্চলগুলোর মানুষকে যেসব নথিপত্র জমা দিতে বলা হচ্ছে তা পশ্চিমবঙ্গের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষের কাছে নেই। অসম ও ত্রিপুরার ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা আরও বেশি। এর দায়, এড়িয়ে যেতে পারে না কলকাতার ভদ্রবিত্ত বাবু সমাজ। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে তাদের কাছে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় পরিচিতি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ভাষিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়টা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং একসময় তাদের কাছে ইংরাজি ছিল ভাষার ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বপূর্ আর এখন সর্বভারতীয় পরিসরে নিজেকে শাসকের দৃষ্টিকোণ থেকে মানানসই করতে হিন্দি হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। পশ্চিমবঙ্গের গণমানুষের বড় অংশ্য বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চা ও বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাপ্রসারের ওপরে নির্ভরশীল, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তাঁরা সমাজের এমন একটা অংশে বিচরণ করে যে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ থেকে ছলবলে কৌশলে তাঁদের বঞ্চিত রাখা হয়েছে। উল্টে হিন্দুত্বের জাতিবাদী রাজনীতি ও হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি রাজনীতির আফিম তাঁদের গণমগজে ইঞ্জেক্ট করে সমাজের বুনিয়াদি প্রশ্নগুলো থেকে তাঁদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। এর বিপরীতে প্রতিরোধের য়ে রাজনৈতিক চেতনা তৈরি হওয়ার দরকার ছিল, তা নানাভাবে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ জীবন থেকে গায়েব।

অসমের কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু সেথানে মুশকিল হচ্ছে, বাংলা ভাষা ও বাঙালির ওপর নিদারুণ হামলা-আক্রমনের পরেও বাঙালি হিন্দুদের বড় এখনও বিজেপির ভোট ব্যাঙ্ক। এমনকী তাদের একটা অংশ বাঙালি মুসলিমকে ‘বাঙালি’ হিসাবে স্বীকার করতে চায় না আজও। এর ফলশ্রুতিতে অসমের বা ঈশানবঙ্গের বাঙালি মুসলিমের বড় অংশ নিজের পরিচয়সত্তাকে ‘মিঞা’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। আর এসবের ফলে এত কিছু হওয়ার পরেও হিন্দু-মুসলিম বিভাজনে ঈশানবঙ্গে বাংলাভাষী তথা বাঙালিদের মধ্যে ঐক্য মজবুত নয়। যার খেসারত দিতে হচ্ছে বাঙালিদেরই। একের পর এক বাংলা স্কুল বন্ধ হচ্ছে সেখানে। ফলে বাংলা ভাষায় শিক্ষাপ্রসার ও জ্ঞানচর্চার সুযোগ ক্রমেই স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে ঈশানবঙ্গ জুড়ে। মনে রাখা দরকার এই ঈশানবঙ্গেই বাঙালি দ্বিতীয়বার ভাষা প্রশ্নে রক্ত দিয়েছিল। ১৯৫২ সালে ঢাকার পর, ১৯৬১ সালের ১৯ মে ঈশানবঙ্গে বাংলা ভাষার অধিকারের দাবিতে রক্ত দিয়েছিল বাঙালি। শাহাদত বরণ করেছিলেন কমলা ভট্টাচার্য। আজও সেখানে বাঙালির রক্ত-অশ্রু ঝরছে, ঝরেই চলেছে। এর বিরাম নাই। এবার আসা ত্রিপুরা প্রসঙ্গে। ত্রিপুরা ঐতিহাসিকভাবে বাঙালিদের বসতক্ষেত্র অনেক পরে। ত্রিপুরার বাঙালিরা অধিকাংশই কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের। ভারতের কলকাতার পরেই আগরতলায় বাংলা ভাষায় শিক্ষাপ্রসার, সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চায় বাংলাই ছিল প্রধান মাধ্যম। কিন্তু বিজেপির হিন্দু জাতিবাদী রাজনীতি সেখানেও ছোবল বসায় এবং গণমগজ ধোলাই করে অবলীলায়। এক্ষেত্রে বাঙালিদের দায়ও কম নয। এক সময় ত্রিপুরার নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠিগুলোর ওপর যো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়েছিল বাঙালি, সেই ইতিহাসেরকথা স্মরণ করিয়ে বিজেপি ও সংঘ পরিবার আজ সেখানকার আদিসাবীদের মধ্যে সুকৌশলে বাঙালি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। আদিবাসী বনাম বাঙালি বাইনারিকে সামনে রেখে ত্রিপুরার সমাজবিন্যাস পাল্টে দিয়েছে, যার অস্ত্র হিসাবে কাজ করেছে হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানি আফিম। ফলে ত্রিপুরাতেও এখন বাংলা ভাষায়য় শিক্ষা ও বাংলা জ্ঞানচর্চাও এখন সঙ্কটের মুখে।

এবার আসা যাক ভাষার বৈচিত্র্য ও বহুভাষিকতা প্রসঙ্গে। এটা প্রথমেই মনে রাখা দরকার, বাংলা বা যেকোনও সচল ভাষা কোনওভাবেই একমাত্রিক নয় বরং বহুমাত্রিক। সিলেটের বাংলাও বাংলা, পুরুলিয়ার বাংলাও বাংলা। পুরানো কলকাতা বা উত্তর বাংলাও বাংলা, পুরান ঢাকার বাংলাও বাংলা। মেদিনীপুরের বাংলাও বাংলা, চট্টগ্রামের বাংলাও বাংলা। আসলে কয়েক কিলোমিটার অন্তর একই ভাষার কিঞ্চিৎ রুপান্তর ঘটে। নদী যেমন এক বাঁক থেকে অন্য বাঁকে যাওয়া আগে নতুন নতুনভাবে ধরা দেয়। বৈচিত্র্যকে ধারণ করেই ভাষার ঐক্য সম্ভব। তা না করে যখন ফোর্ট উইলিয়ামজাত কলোনিয়াল কৃত্রিম বাংলাকে যখন আধুনিক কলকাতা ‘মান্য ভাষা’ বা‘প্রমিত ভাষা’ বলে চিহ্নিত করে তখন ভাষার ঐক্যে ফাটল ধরে। সম্ভবত এই ফাটলের জেরেই কলকাতার বাংলার সঙ্গে ঐক্য সুদৃঢ় নয় মেদিনীপুর কিংবা চট্রগ্রামের বাংলা ভাষার। মাতৃভাষায় শিক্ষা যেমন জরুরি তেমনই প্রতিটি উচ্চারণবিধি সমান গুরুত্ব দাবি করে। যেভাবে বাংলা ভাষার মতোই সমান গুরুত্ব দাবি করে বঙ্গের অন্যান্য নিজস্ব ভাষাগুলো। যেমন সাঁওতালি, কুরমালি, অম্পুরি, রাজবংশী, মুরুংয়ের মতো ভাষা। যে্গুলো বাংলা ভাষার মনতোই বড় বাংলায় সমান গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গের বহুভাষিকতা এই ভাষাগুলোকে কেন্দ্র করেই সম্ভব। সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু, আরবী, ফার্সি, ইংরাজি, জর্মান, রুশ, ফরাসি ইত্যাদি বিজাতীয় ভাষার থেকে সবার আগে জরুরি বাংলা ভাষার সঙ্গে বঙ্গের অন্যান্য ভাষাগুলোর সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা।

অতনু সিংহ

কলকাতা, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top