পতাকাটা নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলাই একমাত্র রাজনৈতিক কার্যক্রম

।। প্রত্যুষ বন্দ্যোপাধ্যায়।।

আর তুমি সব দেখছ আর অকথ্য গালাগালগুলো গিলে ফেলছ
আর বমি করছ

যেন গলগল বমি করা
অনুন্নত শিশ্ন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেচ্ছাপ করা
হদহদ করে হেগে দেওয়া
যেন এগুলোই অস্ত্র তোমার

আর তারপর ল্যাম্পপোস্টে ঝোলানো
পতাকাটা ছিঁড়ে মুখ পোঁদ মুছে
নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলাই
একমাত্র রাজনৈতিক কার্যক্রম।

সম্প্রচার

৪:৪৭
গুলি খেলো সে

ফুটপাত ঘেঁসা নর্দমায় পড়ে রইল
পাশ দিয়ে হেঁটে গেল লোক
পাশ দিয়ে চলে গেল গাড়ি

৫:১২
ক্যামেরা এলো আর ছবিতে এলো সে

৫:১৮ পুলিশ এলো

আপনারা টিভি খুললেন
৬টার নিউজ

সে ভেসে ভেসে ঢুকে পড়লো
আপনাদের ড্রয়িংরুমে

৬টা থেকে ৭টা অবধি
সে চরে বেড়ালো আপনাদের কথা বলায়

৭:০২ যখন
টিভি বন্ধ করল এই সম্প্রচার
পরিবর্তে ভেসে উঠলো ক্রিকেট

এখন রাত ৯
টিভি চলছে
চায়ের দোকান সরগরম
পানশালা উন্মত্ত
মন্দিরে ভিড়

সে কোথাও নেই

একটি নিহিলিস্ট কবিতা

এইভাবে ব্যক্তিগত কথারা ফুরোবে
তুমি ভেবেছিলে ?

বাইরের চিৎকারগুলো
ক্রমশ ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে
জাঁকিয়ে বসছে
আর তুমি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছ এতোটাই
যে নিজেকেও সহ্য হচ্ছে না আর

কালা-বোবা আর কানা হবার প্রতিযোগিতায়
মেতে উঠছে স্বদেশ তোমার
চারদিকে ধার্মিক ডিজে বক্স
চারদিকে আমোদগেঁড়ে উল্লাস
লেজার রশ্মিকণাগুলো
সবুজ চাদর ঢাকা বস্তির ওপর পড়ে ঝলকাচ্ছে
শিউরে উঠে কাঁপতে কাঁপতে মরে যাচ্ছে
বেওয়ারিশ কুকুর বাচ্চাগুলো
তার পাশ দিয়ে তীব্র গতির সাইরেন
জলপাই পোশাক আর কালো বুটের সতর্ক চোখ
একটাও আধন্যাংটা মানুষ যেন
এই ঝাঁ চকচকে রাস্তা আর আলোর বৃত্তে
ঢুকে না পড়ে
এই বিশাল জাঁকজমক যেন পণ্ড না হয়
প্রত্যেকটা হাততালি যেন ফিরে আসে কানে

আর তুমি সব দেখছ আর অকথ্য গালাগালগুলো গিলে ফেলছ
আর বমি করছ

যেন গলগল বমি করা
অনুন্নত শিশ্ন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেচ্ছাপ করা
হদহদ করে হেগে দেওয়া
যেন এগুলোই অস্ত্র তোমার

আর তারপর ল্যাম্পপোস্টে ঝোলানো
পতাকাটা ছিঁড়ে মুখ পোঁদ মুছে
নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলাই
একমাত্র রাজনৈতিক কার্যক্রম।

ঘুণ

কে কোথায় সরে গেছে
জানা নেই

একলা হাঁটার দিন। একলা শহরে।
অবশ্য সাথে আছে প্রেত। নিজেরই ছায়ার।
স্মৃতিখেকো। মগজের সারবত্তা ঘেঁটে
যেটুকু পেয়েছে। শুষে খায়।
তুমিও অবশ। সায় দাও। ক্ষয়ের পতাকা
ধরে হোঁচট ফেরাও।
কাঁধ থেকে খসে পড়া হাত। তুলে নাও।
পকেট গোছাও। ফুটো থাকে ফুটোর মতোই।
ধাপ্পা বয়েস। টুকি দেয়।
আয়নার চিড় চুঁয়ে পারদ ঘনায়।
পুড়ে যায়। গলে যায়। হাড়তন্তু কৃমি ও কেলাস।
গেলাসে গেলাস ঠুকে। স্বাস্থ্যপানের রাত।
কবন্ধ হেসে ওঠে। নরকের সাত দোর থেকে।
গরল মাখানো কোন খামে। লিখেছিলে চিঠি।
উইপোকা জানে। হরকরা ভুলে গেছে।
ঠিকানার মানে। চৌকাঠ রয়ে গেছে।
মাঝপথে। শূন্য স্টপেজে বাঘ।
থাবা চাটে। এখনি নামবে কেউ।
তাকে খাবে। জিভের লালায়। মৃত মাছিদের
সন্ততি ভিড় করে। ভনভন সোহাগ জানায়।
এরই ফাঁকে। সিগারেট পোড়ে।
বারুদের টেন্ডারে শিশুদের নাম।
কবর চিতার সাথে কফিনের। ঝগড়ার ফাঁকে।
শকুন নেমেছে। দূর মাঠে।
ইঁদুরের সাথে কিছু মানুষ পালায়।
তক্ষক ডেকে যায়। প্রহরে প্রহর।
আগুন পাড়ার থেকে। পাড়ায় ছড়ায়।
বাইরের লাশ। ঘরে ঢুকে। কী জানতে চায়।
আর কী জানাতে চায়।
প্রশ্নের মুখোমুখি হবার বদলে। তুমি ঘাড় নাড়ো।
দাঁতের অসুখে। বোবা হাসো।
চোখের পিঁচুটি। চোখ। ঢেকে দেয়।
সান্নিপাতিক জ্বর। আসর জমায়।
শ্লেষ্মায়। বুক ও পিঠের সাথে। বেদনার।
চর্বির বদান্যতায়। ভোর হয়।
এতো কালো। আকাশের কথা। ছিলো নাতো।
তারা লেপা। চাঁদ লেপা। নিকষ। নিরেট।
হাতড়ে হাতড়ে। তুমি কাকে খোঁজো।
কে তোমাকে খুঁজে পাবে। কে বা পায় কাকে।
হাওয়াও তো নেই। জলে ঢেউ।
অন্তঃসার কিছু বাতুলতা। ঢাক পেটাপিটি।
বামন স্বভাব নিয়ে। সেজেগুজে।
কবিতা কবিতা বলে। চেঁচায় মাইক।
পাইকের ড্রেসকোড। লেখক বিলাস।
অবিরত অসূয়ার। আবিলতা। ঝরে।
গাছের চামড়া ছিঁড়ে। কাগজের অপচয়।
নর্দমা গিলে নেয়।
আমোদগেঁড়েরা জোটে। মোচ্ছব জমে ক্ষীর হয়।
শিরদাঁড়া জুড়ে ঘুণ। বেবাক ছড়ায়।

এতদিন গোপন

কপাল নামক আশ্চর্য গোপালের নাড়ু
হাতে নিলে নেই
না নিলে আছে

অরণ্যে যে কাঁদে
তার চোখ নেই জল নেই
একটা গোঙরানো ভেসে বেড়ায়

তুমি তাকে চেনো
তার শরীর নিয়ে সে কাছে এলে
তুমি আরও একা হও

কোন বিপন্নতার কাছে রাখবে তোমার স্মৃতি
কোন বিহ্বলতার কাছে তোমার বিস্মৃতি
খরাক্লান্ত মেধা তোমার
আঠালো লোভ আর
অন্তর্লীন অসূয়া

দগ্ধতার সময় এসে গেছে
পারষ্পরিক কাদা শানানো ঢিলের মত
তোমাকেই তাক করে তুমি ছুঁড়ছো
আহত হচ্ছে অন্য কেউ

গলন্ত সময় এসে গেছে
ভেঙে যাচ্ছে সাবেকী চৌকাঠ
খসে পড়ছে শৌখিন পলেস্তরা
সাজানো সংলাপ

ঐ দ্যাখো
সভ্যতার সম্রাট আর অসভ্যতার ভাঁড়
ল্যাঙচানো বিদুষকের ফেলে দেওয়া শালপাতা
চাটতে চাটতে
নরকের কবন্ধ অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে

তুমিও এসো
লাইনে দাঁড়াও
ফালাফালা খুলে ফেলো এতোদিনের চামড়া

অথবা চামড়া বলতে তুমি যে সব ফোস্কার প্রহার
এতদিন গোপন রেখেছ

পোকাদের মাঝখানে

বব ডিলান একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, সকালে উঠে যা ইচ্ছে করতে পারার নামই স্বাধীনতা। আমি করব করব ভাবতে গিয়ে দেখেছি আমার কোনও ইমাজিনেশনই নেই। বড়জোর ফাইভ স্টার মদ, সারাদিনরাত ল’কার মাঠ বা সামনাসামনি হারানের বৌ।
ব্যস, আমার অবচেতন খতম। অবশ্য এর মধ্যে আর খুনটুনগুলো ধরছি না, মুখে বমি বা ছরছর মুতে দেওয়াও নয়। ওগুলো তো একবার করা হয়ে গেলে আর তাগদে কুলোবে না। আর যাই হোক, আমি তো আর ইস্রায়েল নই যে সারাদিন ধরে খুন করে যাবো।

অবশ্য চকচকে চোখগুলো আর লকলকে জিভগুলো দেখে আজকাল আর রাগ হয় না বরং ইতস্তত করুণা হয়।
ঢ্যামনামো কম তো হল না যদিও অধিকাংশই নিরামিষ পদবাচ্যের। তুমিও ইতরামোর দিকে তাকাচ্ছো আর ইতরামোও তোমার দিকে। তারপর তুমি জল খাচ্ছো চা খাচ্ছো সিগ্রেট ফুঁকছ আর ইতরামোও তোমার সাথে চেপ্টে চ লেপ্টে ল। অনেক ভুল হয়ে গেল, অনেক ভুল হয়ে গেছে, পায়ে পায়ে অনেক ছায়ার ফাঁদ, রাতের কথা সকালে না রাখা, অনেক অনেক মনস্তাপ। বড় আশা করে এসেছিলাম কালক্রমে সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল।

সাংকেতিক অবিনশ্বরতার দিকে তোমার নৌকা পাল তুলেছে এখন। বেমালুম হেরে গেছ, সব দান চৌপাট, সব প্রেম বাতাসিয়া লুপ। অহংকারী দুর্গপরিখা সব ধুলো মাঠ, মেধাবী স্মৃতির সব আত্মগরিমা আজ রাতমৃগী, ইঁদুর ও করোটি লুকোচুরি। ফাঁকা ফাঁকা শব্দেরা দেখো কত নির্ভার, দেখো কত সারশূন্য ভাসিয়ে দিয়েছে তোমার কলমের দায়। আজ তাই শ্মশানের উপাচারে এসো, চলো, রপ্ত হই, অভ্যাস করি পিছুটান। কাঁধের পাথর ঝেড়ে, দায়িত্ব মুছে ফেলে এড়িয়ে এড়িয়ে যাই আরও কিছু লাশের প্রহর। পটল তোলার আগে বেগুন কাঁটার মত পোকাদের মাঝখানে পোকা হয়ে বসি।

প্রত্যুষ বন্দ্যোপাধ্যায়

জন্ম ১৯৬০, নিবাস, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, ভবানীপুর। স্বাক্ষর। সম্পাদিত পত্রিকা – শব্দ, ক্যানেস্তারা। প্রকাশিত কবিতার বই – অব্যয় সংহিতা (ধানসিড়ি) ‘ক্যাজুয়াল স্বৈরতন্ত্রী (অক্ষরযাত্রা)। প্রকাশিতব্য, ‘চালচিত্র’ (অক্ষর যাত্রা)

Share