আজ বৃহস্পতিবার, ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

শ্রেণির গণ্ডিতে আটকে ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ

।। বদরুদ্দীন উমর ।।

এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই, রবীন্দ্রনাথ একজন ভারতের এবং বাংলার নব উত্থিত যে বুর্জোয়া সেটার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন। কিন্তু এর সাথে তাঁর তফাত হচ্ছে জাতীয় চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে বা দেশের উন্নতির ক্ষেত্রে, যেমন কৃষকের কথা, রবীন্দ্রনাথ কৃষকের কথা যেভাবে ভেবেছিলেন সেরকম ভাবে এই পর্যায়ের কোনো লোক ভাবেননি।

শ্রেণির গণ্ডিতে আটকে ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের যখন জন্ম তখন বাংলা এবং ভারতবর্ষে এক ধরনের জাতীয় চেতনার বিকাশ হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথও প্রথম দিকে তার দ্বারা অনেকখানি প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক যে চিন্তা, রচনা এবং তাঁর কার্যকলাপ, যদি আমরা লক্ষ্য করি, তাহলে দেখা যাবে, রবীন্দ্রনাথকে কিন্তু ঠিক জাতীয়তাবাদী বলা যাবে না। কারণ জাতীয়তাবাদ বলতে অনেক সময় যে এক ধরনের উগ্রতা থাকে এটা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল না।

জাতীয় চেতনার বিকাশ বা জাতীয় অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদির বিকাশে রবীন্দ্রনাথের বিশাল অবদান রয়েছে। কিন্তু এই ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে তিনি যেভাবে সমাজকে দেখেছিলেন বা সমাজের লোকদের দেখেছিলেন, বলা যেতে পারে এর পরিপূর্ণ মূল্যায়ন হয়নি।

যেমন, আমি একটা জিনিস বলব, রবীন্দ্রনাথের যে চিন্তা এই ক্ষেত্রে, তাঁর জাতীয় চেতনা বলতে যা বোঝায় আরকি, সেটা তার বঙ্গভঙ্গের সময় সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল। এবং তাঁর বয়সও তুলনামূলকভাবে অল্প ছিল। কিন্তু তাঁর যে মূলচিন্তা এটা জাতীয়তাবাদ বলতে সাধারণত যেটা বোঝায় সেটা ঠিক নয়, তিনি নিজেকে তো বলতেন জাত বুর্জোয়া।

এসম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই, রবীন্দ্রনাথ একজন ভারতের এবং বাংলার নব উত্থিত যে বুর্জোয়া সেটার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন। কিন্তু এর সাথে তাঁর তফাত হচ্ছে জাতীয় চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে বা দেশের উন্নতির ক্ষেত্রে, যেমন কৃষকের কথা, রবীন্দ্রনাথ কৃষকের কথা যেভাবে ভেবেছিলেন সেরকম ভাবে এই পর্যায়ের কোনো লোক ভাবেননি। এবং জাতীয় জীবনের ক্ষেত্রে, জাতির উন্নতির ক্ষেত্রে কৃষকের যে ভূমিকা থাকা দরকার, তারা যে খেটে খাওয়া লোক, তারাই যে খাওয়াচ্ছেন আমাদের এটা রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন । যেমন, রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরষ্কার পেলেন, সেটার টাকা তো তিনি বিশ্বভারতীর তহবিলে জমা দিয়েছিলেন। এই বিশ্বভারতী থেকে টাকা নিয়ে তিনি পতিসরে একটা গ্রামীণ ব্যাংক করেছিল কৃষকদের জন্য। এখন তো গ্রামীণ ব্যাংক করে অনেকে ভাঙিয়ে খাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ সেটা কৃষককে খুবই অল্প সুদে, নামমাত্র সুদে ধার দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।

ফজলুল হক সাহেবের সময় যখন ঋণ সালিশি বোর্ড হলো, তারপরে রবীন্দ্রনাথের যে নোবেল প্রাইজের টাকা, যেটা পতিসরে দিয়েছিলেন এবং কৃষকদের মধ্যে দেওয়া হয়েছিল সবই মাফ হয়ে গেল। তার ফলে পুরো টাকাটা গেল এবং সেই ব্যাংকও ফেল হলো। তো সেই সময় রবীন্দ্রনাথ বলেছিল যে এতে কোনো ক্ষতি হয়নি। আমরাতো কৃষকদেরটা খেয়েই মানুষ। কাজেই ওদের কাছে টাকাটা গেছে এতে দুঃখ বা আক্ষেপের কিছু নেই।

রবীন্গ্রনাথ ও ফজলুল হক

‘রাশিয়ার চিঠিতে’ তিনি লিখেছেন মস্কো থেকে রাশিয়াতে গিয়ে তিনি কৃষকদের যে উন্নতি দেখেছিলেন তাতে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন। তাদের যে শিক্ষা, তাদের যে সংস্কৃতি এগুলো দেখে, বলছেন যে, এসমস্ত বড় বড় থিয়েটার হাউজগুলোতে আগে যেত সব বড়বড় পয়সাওয়ালা লোক, শিক্ষিত লোক, এখন গ্রামের অল্প শিক্ষিত লোকরাও যাচ্ছে এবং দেখছে।

তিনি যখন ফিরে গিয়ে প্যারিস থেকে একটা চিঠি লিখছেন, বর্ষা এলে আমার মনের মধ্যে এক ধরনের ভাবের সৃষ্টি হয়, দারুন একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। আসলে রবীন্দ্রনাথ তো একজন বিশ্রামের কবি এবং বর্ষার কবি।  কিন্তু এই যে এখন বর্ষাকাল এখন আমার কিছুই মনে হচ্ছে না। কারণ রাশিয়ায় কৃষকদের যে উন্নতি দেখেছি তার তুলনায় আমাদের দেশের কৃষকদের যে দুরাবস্থা এর কথা স্মরণ করে আমার সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এই যে চিন্তা আরকি, এগুলো তো আলোচনায় আসে না।

সাধারণ রবীন্দ্রনাথের উপর যে আলোচনা হচ্ছে, মধ্যবিত্ত থেকে করা হয় যেটা,  তার এই সব চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করেই উপস্থিত  করা হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এমন একটা সময় জন্মেছিলেন যেটা হচ্ছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়। রবীন্দ্রনাথের নিজেরও তো এর ফলোভোগী ছিলেন। আর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে জমিদার শ্রেণি এবং তাঁর বাবা সুদ্ধ  কৃষকদের পক্ষে ছিলেন না এবং কৃষকদের উপর অনেক নির্যাতন তাঁরা করতেন। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের যে কৃষক চিন্তা, আমি মনে করি, এটা খুবই অসাধারণ একটা ব্যাপার ছিল। কাজেই জাতীয় যে চেতনার বিকাশ, জাতীয় যে উন্নতি বা জাতীয় স্বাধীনতা বলতে তার চেতনায় কিন্তু শুধু যে মধ্যবিত্তদের বা বড়লোকদের চিন্তাই ছিল না। এটা মনে করারও আবার কোনো কারণ নাই রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবী ছিলেন। সবসমই তিনি বলতেন তিনি জাত বুর্জোয়া। আসল কথা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ একটা যুগের মধ্যে, নিজের শ্রেণির গন্ডির মধ্যে আটকে থাকেননি।

শিলাইদহ কুঠিবাড়ি

সৌজনে‌্য: আলফ্রেড খোকনের নেওয়া বদরুদ্দীন উমরের সাক্ষাৎকার, এনটিভি, বাংলাদেশ

বদরুদ্দীন উমর

বৃহৎ বঙ্গের মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, লেখক, ইতিহাসবিদ ও রাজনীতিবিদ। জম্ম, অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলায়। বসবাস বাংলাদেশের ঢাকা শহরে।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top