আজ রবিবার, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আমার এক নদীর জীবন (সপ্তম পর্ব)

।। রওশন সালেহা।।

রওশন সালেহার ‘আমার এক নদীর জীবন’ বাংলা আত্মজৈবনিক সাহিত্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অধীন অবিভক্ত বাংলা এবং পাকিস্তান আমলের পূর্ব বাংলার নানা খণ্ডচিত্র উঠে এসেছিল এই গদ্য সাহিত্যে। বিশেষত অবিভক্ত বাংলায় নোয়াখালী, ঢাকা ও কলকাতার সমাজ জীবন, রাজনীতি, শিক্ষাপ্রসার ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ, ইতিহাসের নানা বাঁক ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বাঙালি মুসলিম পরিবারের ভিতর থেকে আত্মজৈবনিক কথনের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছিলেন রওশন সালেহা। এই রচনার দ্বারা বাংলা সাহিত্যে রওশন সালেহা শক্ত স্থান দখল করে নেন। এছাড়াও ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত। আমরা ‘আমার এক নদীর জীবন’ নামক আত্মজৈবনিক এই গদ্য সাহিত্যকে কয়েকটি পর্বে ধারাবাহিকভাবে ‘প্রতিপক্ষ’-এ পুণরায় প্রকাশ করছি। এই পর্বে রয়েছে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক স্তরের দলতন্ত্র, পরিবারতন্ত্রের নানা দৃষ্টান্ত থেকে শুরু করে একইসঙ্গে পেশাক্ষেত্রে শাসনকাঠামোর পুরুষতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের সঙ্গে এক পেশাজীবী নারীর টক্কর ও তাঁর ব্যক্তিজীবনের সংগ্রামের দিনগুলির নানা প্রসঙ্গ।

আমার এক নদীর জীবন (সপ্তম পর্ব)

আবারও বিপর্যয়ের মুখোমুখি

বিনা মেঘে বজ্রাঘাত— কথাগুলো নিছক প্রবাদ নয়। তাহলে এমনও হয়! আমার হাতে স্পেশাল বাহক মারফত প্রেরিত বদলিপত্র। ঢাকার বাইরে মফস্বলের একটি জাতীয়করণকৃত স্কুলে সাতদিনের মধ্যে যাওয়ার হুকুম। কোথায় ছিলাম, যাব কোথায়— এই স্কুলের এক শতাংশও নয় যার পরিচিতি আর কাজকর্ম— সেখানে আমাকে ঠেলে দেয়া বজ্রাঘাত নয় তো কি! সেদিন ছিল উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ। হেডমিস্ট্রেসের রুমের দরজায় দাঁড়ালেই একাত্তরের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িটি চোখে পড়ে। মানসচোখেও দেখতে পাই। কী বিকট শব্দ ছিল বিস্ফোরণের। চারদিকে অন্ধকার আর ধোয়ায় আমরা বুড়ো, তরুণ, বালক, শিশু সকলেই আল্লাহর রহমতে অক্ষত অবস্থায় মৃত্যুকূপ থেকে বেরিয়ে এসেছি।

ভাল খবর কেউ শোনে, কেউ শোনে না। কিন্তু খারাপ খবর বাতাসে ছড়ায়। কয়েকজন টিচার, যাদের সাথে নিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারির ‘স্মরণ’ পত্রিকা ছাপানোর প্রুফ দেখছিলাম, দুটো ছাত্রীও ছিল। ওরা খবরটা শোনামাত্র হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠলো, আপনি যেতে পারবেন না। আমরা যেতে দেব না। সহকারী প্রধান শিক্ষিকা সেলিমার ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ আরও বেদনার-‘বড়র পীরিতি বালির বাঁধ’। এই এক সপ্তাহ আগের ঘটনা-শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী, তাঁর সাথে ডি. পি.আই সাহেবও ভিজিট করে গেলেন। ভিজিট বুকে পর্যন্ত লিখে দিলেন বাংলাদেশের সেরা স্কুল আর সেরা প্রধান শিক্ষিকা … ওদের মনে তাহলে কী ছিল? ছাত্রীরা দল বেঁধে আসে, আমরা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে যাব। এ আদেশ বাতিল করতে হবে তাকে। এ অন্যায়!

ওদের বুঝিয়ে দিলাম। তোমাদের এসব করার বয়স হয়নি। আঠার বছর না হলে কোন প্রতিবাদ আইনের আওতায় আসে না। তোমরা নিজ নিজ কাজ যা আমি করতে বলেছি, শিখিয়েছি-সেগুলো করলেই আমার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হবে। তোমরা আমাকে ভালবাস, শ্রদ্ধা কর, সেটা আমি পেয়েছি। সহকর্মীদেরও তাই বললাম, আমরা টিমওয়ার্কে ছিলাম। আমি না থাকলে আপনারা ছাত্রীদের সেভাবেই গড়ে তুলবেন। বিশেষ করে সৃজনশীল কাজ করতে শিখেই এ স্কুলের মেয়েরা জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কবি, সাহিত্যিক, খেলোয়াড় কোথায় নেই আমাদের ছাত্রীরা? মতিঝিল স্কুল বলতেই এরা, গার্জেনরা কেমন পাগলের মত হয়ে যায় এই স্কুলে মেয়ে ভর্তি করানোর জন্য। এ তো গর্ব করার বিষয়।

সকলকে প্রবোধ দিতে আমার কষ্ট হলো না। শুধু হল নিজের বেলায়। সেখানে কত প্রশ্ন। অন্য স্কুলের প্রধানরা আমার উপর রুষ্ট, ঈর্ষাকাতর। আমি তাদের ফিল্ড নষ্ট করছি। এত বাড়াবাড়ি ভাল নয়। বদলির কাগজ আবার হাতে নিই। কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া বদলি করলে কি যথার্থ হয়! আমার ফিল্ড নষ্ট করার জন্য এ কার স্বার্থজনিত কাজ। অনুসন্ধানে সেটাই প্রমাণিত হল। তখন আওয়ামী লীগের সরকার। একজন মন্ত্রীর স্ত্রীকে মফস্বল শহরে রাখা যায় না। তাকে ঢাকার সেরা স্কুলে আনা চাই। মতিঝিল স্কুল শিক্ষামন্ত্রী দেখে গেছেন, আমরা স্বাধীনতা পেলাম মাত্র চার বছর। যোগ্যতা আর বিচারের বাণী কি এখন থেকেই নিরবে নিভৃতে কান্না শুরু করে দিয়েছে? স্বজনপ্রীতির কারণে একজন যোগ্য ব্যক্তিকে উৎখাত করতে হবে?সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় এরা কেউ তো কোয়ালিফাই হয়নি, আমি হয়েছি এবং তালিকার শীর্ষে। এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে প্রথমে গেলাম ডি. পি, আই আবু রুশদ মতিন উদ্দিন সাহেবের কাছে। তিনি একজন সাহিত্যিকও বটে। নিশ্চয়ই আমার প্রতিবাদ শুনবেন এবং প্রতিকার করবেন।

তখনও আমার জ্ঞান পাওয়ার অনেক বাকি। মাননীয় জনশিক্ষা পরিচালক বাহাদুর শিক্ষা পরিচালনার সর্বোচ্চ আসনে বসা। আমায় দেখে সহাস্যে অভ্যর্থনা করলেন, উঠে দাঁড়ালেন পর্যন্ত। তার পিয়ন ট্রে সাজিয়ে, চা-বিস্কুট সামনে এনে দিল। এতসব দেখে ক্ষোভ বুঝি বেড়েই গেল, গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালছেন কেন? আমি বললাম, স্যার! আমাকে যদি বদলি করবেন তবে সেদিন এত প্রশংসা লিখে এলেন কেন? আমি আপনাদের প্রশংসাকে সম্মান করি। সেই উদ্ধৃতি দিয়ে বদলি প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে এসেছি। আমার কথার পর উনি করুণ হাসিমুখে বললেন, আজ না হলেও অন্য সময় এর মূল্য পাবেন। আপনার বদলি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হুকুমে দেয়া হয়েছে। আমি যা করতে পারবো, তা হচ্ছে ঢাকায় অন্য কোনো স্কুলে দেখতে পারি কিনা। আপনার পারিবারিক অসুবিধার কথা জানি। আপনার স্বামী পি. জি. হাসপাতালে, অপারেশনের রোগী। আপনি সে রকম তথ্যসহ একটা দরখাস্ত রেখে যান।

 আমার উচিত ছিল তার সীমাবদ্ধতার মধ্যে যা তিনি করতে চাচ্ছেন, তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মেনে নেয়া। করলাম না উল্টো প্রতিবাদমুখর হলাম। পারিবারিক সমস্যা আমার নিজের। আপনাদের লিখতে যাব। কেন? একটা ফার্স্ট গ্রেড স্কুলকে পরিচালনার কাজ অভিজ্ঞ ব্যক্তির হাতে রাখা উচিত। আপনাদের মন্ত্রীর স্ত্রীকে আনা স্বজনপ্রীতি ও আমলাতান্ত্রিক শাসন। আমরা কি এজন্য দেশ স্বাধীন করলাম! জানেন! আমি বার বার কোন নিষ্ঠুর কশাঘাতের, অযথা দুঃখ-কষ্টের শিকার হই। কিন্তু আমার ক্ষতি কেউ করতে পারে না। কারণ আমি কখনও নিজের জন্য ভাবি না, স্কুলের ছাত্রীদের নিজের মেয়েদের মতো ভালবাসি। ওদের মানুষ হওয়ার পথে আমিও পরিশ্রম করি। রাত জেগে চিন্তা করি, কী করলে ওদের ভবিষ্যত জীবন অর্থবহ হবে। আমার প্ল্যান থাকে।

আমার একনাগাড়ে কথার মধ্যে উনি চুপ থাকলেন, একটুও রাগলেন না। একজন সহকারী পরিচালক (রাজ্জাক সাহেব পরে ডি. পি. আই হয়েছেন)কে ডেকে আদেশ দিলেন, এঁকে চেনেন? মতিঝিল স্কুল উনি ছাড়বেন না, আর যদি না ছাড়েন, আপনার আর আমার গদি যাবে। মন্ত্রীর স্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, তিনি নতুন জায়গায় জয়েন করতে পারছেন না।

আমার জন্য তাহলে বেশ একটা তোলপাড় হচ্ছে? হোক। আশার বাণীও শুনলাম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে আমাকে পোস্টিং দেয়া হবে। ঐ অফিস সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। ডি. পি, আই অফিসের লাইনে খাদ্য ভবনের সাত তলায় অফিস। ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী এডিটর জেনারেল। অফিসটি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অধীন। জেলা গেজেটিয়ার লেখা হয় এখানে। আগে ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট বাংলাদেশের শাসক থাকাকালীন সময়ে জেলার বিবরণাদি ভ্রমণ করার পর লিখতেন। আমি ভাল জায়গায় এসে পড়লাম। ১৮৮৬ সালের কয়েকটি জেলার গেজেটিয়ার পড়ে আনন্দ অনুভব করি। এখানে না এলে জীবনেও এগুলোর সন্ধান পেতাম না। দিনাজপুরের আদিবাসি সাঁওতাল; সুন্দরবনের পোঁদ, ময়মনসিংহ-এর গারো এবং তাদের নিয়ে খ্রিস্টান মিশনারিদের শিক্ষা ও সভ্যতা শেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা পড়ে কত বিস্ময়বোধ করেছি। শেষে নিজেও লেখা শুরু করি। দিনাজপুর, নোয়াখালী ও খুলনা নিয়ে লিখেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকগণ মিলে বোর্ড অব এডিটরস এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রিন্ট করার অনুমোদন দিলেন। সৈয়দ মুরতজা আলী এবং আব্দুল্লাহ ফারুক উভয়েই আমার বইগুলোর এত প্রশংসা করলেন যার ফলে ডঃ সিদ্দিকী পরে আমাকে তার অফিস থেকে আর রিলিজ দিলেন না। ছাড়পত্র পেতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। বদলি হয়েছিলাম ব্যবস্থাপনা ও সংগঠন বিভাগে।

কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া বদলি করলে কি যথার্থ হয়! আমার ফিল্ড নষ্ট করার জন্য এ কার স্বার্থজনিত কাজ। অনুসন্ধানে সেটাই প্রমাণিত হল। তখন আওয়ামী লীগের সরকার। একজন মন্ত্রীর স্ত্রীকে মফস্বল শহরে রাখা যায় না। তাকে ঢাকার সেরা স্কুলে আনা চাই। মতিঝিল স্কুল শিক্ষামন্ত্রী দেখে গেছেন, আমরা স্বাধীনতা পেলাম মাত্র চার বছর। যোগ্যতা আর বিচারের বাণী কি এখন থেকেই নিরবে নিভৃতে কান্না শুরু করে দিয়েছে? স্বজনপ্রীতির কারণে একজন যোগ্য ব্যক্তিকে উৎখাত করতে হবে?সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় এরা কেউ তো কোয়ালিফাই হয়নি, আমি হয়েছি এবং তালিকার শীর্ষে। এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে প্রথমে গেলাম ডি. পি, আই আবু রুশদ মতিন উদ্দিন সাহেবের কাছে। তিনি একজন সাহিত্যিকও বটে। নিশ্চয়ই আমার প্রতিবাদ শুনবেন এবং প্রতিকার করবেন।

তখন আমি অফিস করতাম পি. জি হাসপাতাল থেকে। স্বামী প্রায় চারমাস ছিলেন চিকিৎসাধীন। প্রথমে পুরো কামরার দুটো সীট পাইনি বলে নিচে বিছানা পেতে শুয়েছি। তাকে দেখাশুনা করার আর লোক কোথায়? ছোট ছেলেও আমেরিকার নিউইয়র্কে বড় বোনের কাছে পড়তে চলে গিয়েছে। ছোট মেয়ে আঁখি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল। পড়ার চাপ, আর সেজ ছেলে কেমিস্ট্রির ফাইনাল ইয়ার, উভয়েই নার্ভাস, রক্ত দেখতে পারে না। তখনই অজ্ঞান হয়ে যায়। ওরা বাসায় থেকে আমাদের খাওয়া তৈরি করে নিয়ে যেত। টিফিন টাইমে এসে রোগীর পরিচর্যা সেরে ফিরে যেতাম অফিসে। তখনকার কষ্ট আমার জীবনের নতুন অভিজ্ঞতা, রোগীর খাটের পাশে নিচে খাতাপত্র মেলে অফিসের কাজ করতে হয়েছিল, রাত জাগা অভ্যেস ছিল বলে পেরেছিলাম। আমার কষ্ট পি, জি হাসপাতালের ডক্টর আশেকুর রহমানকে বিব্রত করে তোলে, শেষমেষ তিনি আমাকে রুমের দুটো সীট বরাদ্দ করে দিলেন।

নিজের আগ্রহে আমি একজন ট্রেন্ড নার্স হয়ে গেলাম। আমার সুখ আর দুঃখের সাথী অবুঝ আর রুগ্ন মানুষটাকে সারিয়ে তুলতে হবে যে! তিন তিনটে অপারেশন তার ঐ শুকনো শরীরের উপর দিয়ে হয়েছে। কিডনি হলো আগে। অতঃপর প্রস্টেট গ্ল্যান্ড। সর্বশেষ পাইলস। অবিরাম প্রস্রাব ঝরে বিছানাপত্র নষ্ট, নামাজ পড়তেও পারেন না।

পাইলসের রক্তে পায়জামা, লুঙ্গি ভিজে যাওয়া; তারপর কোথায় যে ব্যথা বলতে পারে না। এতসব রোগ দেহে কবে থেকে, কেমন করে প্রবেশ করলো জানি না। বিপদ তো একা আসে না। স্কুলের বদলি, তার অসুস্থতা আমাকে দিশেহারা করে তুলেছিল। ভাইবোনরা আমার ছোট, সকলেরই নিজ নিজ সংসার। তার ভাইপো-ভাইঝিরাও কে কোথায়! আমাকে একা দুঃসময় সামলাতে হয়েছিল। একদিন দেখি তার চোখ থেকে পানি ঝরছে, কাঁদছেন। আমাকে তুমি মাফ করে দেবে? আমি মরে গেলেই যে ভাল ছিল! কেন ভাল করে তুলছ?

তুমি না নামাজী, আল্লাহর পথে চল! আমি কিছুই করিনি। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তুমি এত কষ্ট পাও কেন, আমার মনে কেবল সেই দুঃখ। কবে তোমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে যাব। কিন্তু সবসময় এমনতর ভাল কথা আমাদের মধ্যে হতো না, তাকে কেবল ডাক্তার ও নার্সদের কাজের ফাঁকে অনিয়ম করার নালিশ করতে শুনতাম। আমি অফিস থেকে আসলে এরকম একশটা নালিশ। আপনি ভাল হয়ে গিয়েছেন। এবার বাড়ি যান। ডাক্তার এসব বললে তিনি রাগ করতেন। শরীরের এত অসুখ কি সহজে সারে! আজ ভাল কাল খারাপ এই ছিল তার কথা। চারমাস হাসপাতালে থেকেও আরও থাকতে চায়, পরে জোর করে নিয়ে আসি।

আল্লাহর থেকে পুরস্কার অবশ্য এর জন্য আমার ভাগ্যে এসেছে বলতে হবে। অতঃপর তার অসুখ তেমন সিরিয়াস ছিল না। আমারও সেক্রেটারিয়েটের ভেতর এসাইনমেন্ট অফিসারের চাকরি হল। একমাত্র মহিলা। সাথের অফিসাররা ছিলেন সকলেই সি. এস.এস ও বি.সি.এস ক্যাডারের। সেক্রেটারি ছিলেন লতিফুল বারী। সকলেই তাকে ভয় করে, মেজাজী। আমার সম্পর্কে তার ধারণা-ফুল টিচার। কাজ করতে পারৰে? সে এল কেমন করে? ব্যবস্থাপনা ও সংগঠন কাজ যাকে তাকে দিয়ে হয়! বয়স কত?এসব শুনে অপমানে, দুঃখে ঠোট কামড়িয়েছি। একজন মহিলার বুঝি সম্মান নিয়ে কাজ করার অধিকার এই দেশে নেই। এরা দেবে না?এরা (আমলাতন্ত্র) মেয়েদের অন্তঃপুরে, বড়জোর স্কুল-কলেজে দেখতে চায়?দেশ স্বাধীন হয়েছে এর পরেও?কত মা-বোনদের ইজ্জত লুট হয়েছিল। সৰই বিফলে যাবে? আমি রি-এক্ট করলাম। অফিসে যাওয়া-আসার কোনো পাড়ি ছিল না। আমি সকালে কমলাপুর থেকে পাবলিক বাসে করে তোপখানা রোডে নেমে যেতাম।

সেক্রেটারিয়েট সেকেন্ড গেট দিয়ে ঢুকতাম। আমাকে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রবেশপত্র করে নিতে হয়েছে। বাসায় ফিরতাম রিকশায়। ভাড়া দিতাম দেড় টাকা। দু’বেলা রিকশার ভাড়া বহন করলে সংসারে অন্য খরচের টান পড়তো। বিশেষত স্বামীর চিকিৎসা ও বলকারক পথ্য আমাকে সবসময় সংসারের সকল খরচের আগে বিবেচনায় রাখতে হয়েছে। ছেলেমেয়েরা বিদেশ থেকে শাড়ি, শার্ট, টাকা দিয়ে প্রায় প্রায় সাহায্য করছিল। তাই সংসার চলছিল। ঐ সময় জিনিসপত্রের দাম আগের থেকে বেড়ে যায়। ফলে বেতন বাড়লেও সংসারে সব খরচ কুলিয়ে নেয়া বেশ কষ্টকর ব্যাপার ছিল। সামান্য সঞ্চয় করার ইচ্ছা আমার প্রবল থাকলেও সম্ভব হয়নি। বিদেশ থেকে টাকা পেলে সেটাই ভবিষ্যত বিপদ-আপদের জন্য জমিয়ে রেখেছি। স্বামীর অসুখ না থাকলেও তিনি চাইতেন সপ্তাহে দু-একবার ডাক্তার এসে তাকে দেখে যাবে। না হলে তার ইচ্ছাকে আমরা অবহেলা করছি মনে করতেন তিনি এবং ঘরে মেজাজ করতেন। তাছাড়া আমার অফিসের চাকরি করা কিছুতেই সমর্থন করতে পারতেন না। মানসিক অশান্তিতে ছিলেন।

সাহিত্যের অঙ্গনে যাতায়াত প্রায় থেমে গেছে, তথাপি কিছু তরুণ সাহিত্যগোষ্ঠি আমার সন্ধান নিত। স্বাধীন বাংলায় সে সময় অন্য এক সমস্যা বেড়ে যাচ্ছিল, তা হচ্ছে যৌতুক । মেয়ের বাবা যেমন ভাল বর কিনতে চাইছে টাকা দিয়ে, তেমনি বর পক্ষ দাম চড়িয়ে দিচ্ছে নিজের। সামাজিক ব্যাধি হয়ে দেখা দিয়েছে। আমি একদম এই যৌতুক দেয়া-নেয়ার বিপক্ষে। কিছু লেখাও সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছিল। ঐ সময় আমার ঘরে যে এক দামী বিবাহযোগ্য ছেলে আছে, সে বিষয়ে দেশের কয়েকজন ধনাঢ্য পিতার খোঁজ ছিল। তারা আমার সহজ-সরল স্বামীকেও প্রলোভনে ফেলতে চেষ্টার কম করলো না। মেজো ছেলে ‘টি এন্ড টি’তে সবে এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। আগে ছিল চাটগাঁ জি, এম প্লান্টে। কিন্তু যে মন-মানসিকতার আদর্শে আমি সন্তানদের তৈরি করেছি, তারা নিজেরা অর্থ ও জাঁকজমকে লালায়িত নয়। আমাদের পরিবারের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক সঙ্গতিপূর্ণ একটি শিক্ষিতা মেয়েই জামি ঘরে এনেছি। টেলিভিশনের ‘অভিমত অনুষ্ঠান তখন সবেমাত্র চালু হয়েছে; ‘যৌতুক বিষয়ক অতিমত অনুষ্ঠানে আমি বক্তব্য দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম তখন। বলতে চেয়েছি, আমাদের সময়ে সমাজে মুসলমানদের মধ্যে যৌতুক প্রথার মোটেও প্রচলন ছিল না। বর পক্ষ প্রচুর দিয়ে ধুয়ে বৌ সাজিয়ে নিতো, যে যার সাধ্যমত। বরঞ্চ দেখতাম কনের বাবার দাপট বেশি। সেদিন কেন আমরা হারিয়ে ফেলছি। হিন্দু সমাজে মেয়েরা পিতার সম্পত্তি পায় না। সেজন্যে কন্যা পার করার সময় তার হিস্যা পিতা নিজে বুঝিয়ে দিয়ে দেন। সেটা এমনই ছিল, বর পক্ষের দাবি মেটাতে গিয়ে বাপকে ভিটেমাটি পর্যন্ত বেচতে হয়েছে। তাই দেশে প্রবাদও ছিল, ‘খেয়ে যায়, নিয়ে যায়, আরো যায় চেয়ে-ঐ যায়, ঐ যায় বাঙালি মেয়ে।

এই সত্তর দশকে যৌতুক স্বাধীন দেশে দুগ্রহের মতো সমাজকে গ্রাস করছে; এর কুফল অত্যন্ত ভয়াবহ। এখনও সময় আছে যৌতুকের আগ্রাসন থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হবে। পিতা তার কন্যাকে লেখাপড়া শেখাবেন। একজন মেয়েকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে দেয়াই তার জন্য শ্রেষ্ঠ যৌতুক। উনিশ শ পঁচাত্তরের আগষ্ট কি সেপ্টেম্বর হবে-ঐ অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছিল। অতঃপর মেয়েদের তরফ থেকে আমি বেশ কয়েকটি অভিনন্দনপত্র পেয়েছি। আমার এসাইনমেন্ট অফিসারের কাজ সহজে হাতে পাইনি, সেক্রেটারি একটা রচনা ‘Less meeting more work, how you can assign লিখতে দিলেন। আমি অন্য অফিসারদেরকে এটি লিখতে দেয়ার প্রস্তাব করলে লতিফুল বারী সাহেব আমাকে সমর্থন করেন। মিঃ এস. কে. দাস রচনাগুলো পরীক্ষা করে আমাকে বেশি নাম্বার দিয়েছিলেন, একজন হেডমিস্ট্রেসকে Organisation & management অবশ্যই ভাল জানতে হয়। আমার সে বিদ্যা ছিল। সেটাই ঐ পরীক্ষায় সদ্য প্রমাণিত হয়ে গেল। সেক্রেটারি সাহেবের আমলাটে মনোবৃত্তি তাতেও পরিতৃপ্ত হল না, তিনি আমাকে Rules of Business, B. S. R পড়তে বসিয়ে দিলেন। সে সাথে পুরো সেক্রেটারিয়েটের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর কেরানিদের ট্রেনিং দেয়ার কাজ চাপিয়ে দিয়ে অবশেষে তিনি অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে যান।

সেখানকার অভিজ্ঞতা আজও আমাকে দুঃখ দেয়। মেয়ে অফিসার বলতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ২ জন গবেষণা অফিসার আর আমি। স্বাধীনতার পর যে সব মহিলা চাকরি করতেন-সব দুঃস্থ পরিবারের, অধিকাংশ স্বামীহারা, পিয়ন, টাইপিস্ট, সেকশান কেরানি এসবের চাকুরে। কোনো টয়লেট ছিল না। কো্নো সম্মান তাদের কেউ দিত না। পুরুষ সহকর্মীরা টাকা ধার চাওয়া আর বিয়ে করার জন্য ফুসলানো এসব করতো বলে অল্পবয়সী মেয়েরা (দু-একটা সন্তানও আছে) আমার কাছে নালিশ দিত। দু’জন আয়ার তো একজন কেরানি সাহেবের, একজন বড় সাহেবের পিয়নের খপ্পরে পড়ে বিয়েও হয়ে গেল। পরিণামে ভাল হয়নি। ওদের কষ্ট চরমে উঠেছিল, দেখতাম। দুই মাস না যেতেই মারধোর। ঘরে বৌ আছে, শুধু বাড়তি আয়ের জন্য সরলমনা ঘরের বৌ (যারা একাত্তরের যুদ্ধে স্বামী হারিয়েছিল)দের বিয়ে করা কত পাষণ্ড চরিত্রের পরিচয়—নিজ চোখে দেখলাম। যে ছেলেমেয়েদের খোরপোষ, লেখাপড়ার জন্য চাকরি করতে এল, সেই তারাই বঞ্চিত। অর্ধাহার ও নির্যাতনের মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছিল ওদের। হায় আল্লাহ-কার মুখের গ্রাস কে কেড়ে নেয় ! এই নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং অশিক্ষিত সম্প্রদায় তো নির্যাতিত সন্দেহের অবকাশ নেই, আমিও ঐ দলের মধ্যে অবস্থাদোষে ঠ্যালা খেলাম।

অফিসার হলে যা যা সুবিধা, আমার ছিল। আলাদা কামরা, পর্দা দেয়া, স্টেনো টাইপিস্ট, পি, এ, সুন্দর টেবিল, চেয়ার (কার্পেটও পেলাম)। তবুও কি পার পেয়েছি? সমাজের বুকে আমলাতন্ত্রের নিষ্পেষণ একজন অফিসার নারীকে বাদ দেয়নি তাদের করাল হাত থেকে। কী সুন্দর কথা! আপা, বৌ-আজ নাস্তা দেয়নি; শুকনা রুটি, আন্ডা ভি দেয় নাই। আপনি কি আনছেন দেখি? লজ্জা পেতাম, সকালবেলা তাড়াহুড়োয় ঘর থেকে বের হই, আসি বাসে, এরা আসে গাড়িতে। ওদের কি করে আমার রুটি আর আলু ভাজি দেখাই! ওরাই হুকুম করতো আমার কদম আলীকে, ক্যাফেটেরিয়া থেকে চিকেন স্যান্ডউইচ আনার; পরে দেখতাম-তারা চলে গেছে-দামটা আমার ঘাড়ে। টাকা ধার চাওয়ার কাকুতি দেখলে আমার হাসি পেত… তবুও তারা কয়েকজন নাছোড়বান্দা– ধার দিয়ে কী কষ্ট করে, নির্লজ্জ হয়ে উসুল করেছি, সে আমি বলতে পারবো না।

আমাদের মধ্যে তর্ক বাধতো, মেয়েরা কেন সব কাজে এগিয়ে আসবে; পুরুষদের ভাত মারা-– এ হতে দেয়া যায় না। সমাজে একজন পুরুষ, একটা গোটা পরিবার (মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা) দশ বার জন সদস্যসহ চালায়-আর মেয়েরা … নিজের শাড়িগহনা। তখন মেয়েদের চাকরির কোটা ছিল দশ পারসেন্ট । এতেই ছেলেদের যেন বাড়াভাতের কমতি হয়েছে-তাই ওদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখে অবাক হতাম। পুরুষদের এই আগ্রাসন থেকে কবে রেহাই পাব? তবে আমিও কম ছিলাম না। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি,ভদ্র পরিবারের মেয়েরা অফিসে পরিবার পালনের জন্য কেরানি,আয়া– কী কাজ বাদ দিয়েছে। যা পাচ্ছে তা নিচ্ছে। এদের লেখাপড়া করার ব্যবস্থা নিন। আর পৌরুষ ভেঙ্গে খাবেন না। সমাজের আয়-উন্নতির দিকে নজর দিন। এই অফিসারদের মধ্যে সকলেই মধ্যবয়সী ক্যাডার সার্ভিসের লোক,আমার সহকর্মী এসাইনমেন্ট অফিসার ডি.এস– এরা ছিলেন। আমি এমন কথাও শুনতাম (কৌতুক কিনা বুঝিনি) স্বামীকে অসুস্থ, নিজের এমন স্বাস্থ্য রাখছেন কিভাবে?

‘অসুস্থ স্বামীর সেবা করা পুণ্য। আপনারা চোখ টাটাবেন না।আপনি ভেবেছেন অন্যের সেবা করি? আপনার স্ত্রীও তাই করে নাকি? মেয়েদের সম্মান কবে দেবেন আপনারা! অথচ দেশের প্রশাসন আপনারাই দখল করে আছেন। ‘তর্ক-বিতর্ক অবশ্য হালকা ছিল।আমি কোনো বিপদ গুনিনি।এতজন ছেলেপুলের মা,বাঘেও খায় না।অনেক পরে একদিন আমি সরাসরি জয়েন্ট সেক্রেটারির কাছে বললাম,স্যার ছয় মাসের ছুটি লাগবে,ছেলেমেয়েরা টিকিট পাঠিয়েছে।আমেরিকায় যাব।আপনি আমার এপ্লিকেশনে সই ও সুপারিশ করে দিন।দাশ বাবু (জয়েন্ট সেক্রেটারি) আমার পারমিশন পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। ফিরে এসে জোর তদবির চালিয়ে শিক্ষাভবনে সহকারী জনশিক্ষা পরিচালক হয়ে বদলি হয়ে চলে এলাম। কিন্তু সেই ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতা ব্যর্থ হয়নি। পরবর্তী সময়ে কাজে লেগেছিল।

সুখের সাথে আমার বিবাদ

বাসে চড়ে অফিস করলাম, তার জন্য স্বামীর দুঃখ প্রকাশ দেখে মন উথলে উঠতো। আমার জন্য কত মায়া। পুরনো কথা মনে পড়তো। কলকাতায় কোনোদিন বাসে উঠতে দিতেন না। রিকশাতেই যাওয়াআসা করতাম। তবে ট্যাক্সিও কম চড়িনি। ট্রামে ওঠার শখ করলে বকতেন, কেন ভিড়ের মধ্যে ঠ্যালাঠেলিতে যেতে চাও! রিকশায় না চড়লে ট্যাক্সি নেব। কিন্তু শিক্ষা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক হয়ে যাওয়া-আসার সুবিধা পেলাম। একখানা মাইক্রোবাস আমার নিয়ন্ত্রণে। তবে একার নয়, শাহজাহানপুর এবং এদিকের এলাকার যে সব অফিসার আছেন, সকলের জন্য এই ট্রান্সপোর্ট। এখানেই তার অপছন্দের ব্যাপার। চোখ মুখ চড়িয়ে রাগ দেখান, ও তোমার কি আর স্কুলে ফিরে আসার ইচ্ছে নেই? সরকার তো বদল হয়েছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর বেগম গদি ছাড়বে না? অফিসের চাকরিতে খুব মজা পেয়েছ তাই আর স্কুলে আসতে চাও না …

বুঝতে অসুবিধা হতো না তিনি এতসব পুরুষ মানুষের সাথে অফিস যাওয়া, কাজ করাকে ভাল চোখে দেখছেন না। স্ত্রীকে অনেক ছাড় দিয়েছেন, আর কেন! সংসারে এখন ছেলেমেয়েরা রোজগারি, আগের মতো অভাব নেই। এখন আমি ঘরে থাকি, তার সঙ্গ দিই। স্কুলের চাকরিতে মেয়েদের মানায়। অফিস তাদের জন্য ভাল জায়গা নয়। অথচ আমি যদিও গলাধাক্কা খেয়ে স্কুল থেকে বের হলাম, তখন তিনিও চুপ ছিলেন। কিন্তু এখন আমি সেই স্কুলের সীমার মধ্যে নেই, বাইরের পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা পেয়েছি, বুঝে নিয়েছি মেয়েদের রুজি-রোজগার করলেও তাতে তাদের অধিকার নেই। (সেক্রেটারিয়েটের ঘটনাগুলো) মেয়েদের জন্য কেউ জায়গা ছেড়ে দেবে না। যুদ্ধ করে নিতে হবে। কিন্তু অসুস্থ এবং বাইরের সকল দিক থেকে গুটিয়ে আসা আমার উপর একান্ত নির্ভরশীল স্বামীকে আমি এতসব বুঝাতে গেলাম না; বুঝাতে গেলে সংঘর্ষ হবে। অবস্থার চাপে পড়ে তার সম্মতির চেয়ে বেশি অসম্মতির মধ্য দিয়ে একটা কেরিয়ার গড়ে তুলেছি। তার দেহে জমিদারি রক্ত টগবগ করছিল। আমাকে সেই মেজাজে নির্যাতন করেছেন। একজন মেয়ের ভাগ্যে এর চেয়ে বেশি নির্যাতন থাকে, সেই কথা মনে করে সব সহ্য করে এ পর্যন্ত এলাম, আমি কেন তবে নিজ পথ থেকে সরে আসবো!

অতএব ধৈর্য আর সহনশীলতা দিয়ে অপমানসূচক ব্যবহারগুলোকে মেনে নিতাম। বুঝিয়ে বলতাম, আমি বড় অফিসার হয়েছি, একটা স্কুলের দায়িত্ব নয়, পুরো বাংলাদেশের স্কুলগুলো দেখার দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছি। আমাদের জন্য এটি অতি আনন্দের ও গর্বের বিষয়। তোমার সেবা করেছি বলেই যে আমার এত উন্নতি; তুমি যে শেখ ইজ্জতের বংশধর, তোমার দেহে একদিকে জমিদারির দাপট, অন্যদিকে পীরফকিরের রহস্য। আমি সবটাই দখল করে নিলাম। তার ভেতরে যে ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স কাজ করতো, এতে কিছুটা কাজ হয়েছিল অবশ্য। তার বংশের প্রশংসা। তার মনের উদারতা, পবিত্রতা নিয়ে বললে খুব খুশি হয়ে যেতেন। বলতেন, ‘মরা হাতি লাখ টাকা। আজকাল দিনকাল খারাপ, মানুষ এসব বুঝতে চায় না। তোমাকে আল্লাহতায়ালা যেমন জ্ঞানবুদ্ধি দিয়েছে, তেমন বিনয়ী ও ধৈর্যশীলা বানিয়েছে। শাশুড়ি আম্মার কথা খুব মনে হয়। তিনি আমাকে জামাতা করে এনেছিলেন, যত্নও করতেন। তুমিও সেইরকম যত্ন কর। কিন্তু তোমাকে আমার বড় ভয়; আমাকে ফেলে চলে যাবে না তো! আমি স্বামী হিসেবে তোমার অযোগ্য।’ এমন দুর্বল চিত্তের কথা শুনতে আমার কখনও ভাল লাগেনি। শেষে বুদ্ধি করে অফিস যাওয়ার ব্যবস্থায় একটু তোষামোদি করলাম তাকে। অফিস তো দূরে নয়, অন্যদের নামিয়ে দিয়ে আমাকে নেয়ার ব্যবস্থা করে একা যাওয়া-আসা করতাম।

ঘরে বৌ আনলাম, তাও ছাত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অংকশাস্ত্রে অনার্স ক্লাসের। অনেককে প্রশ্ন করতে শুনতাম, আপনি চাকরি করেন। পাস করা, চাকরি করছে এমন মেয়ে আনলেন না কেন? তাহলে কি আপনি চাকুরে মেয়ে পছন্দ করেন না? উত্তর আমার ছিল একটাই, কেন করবো না? এই মেয়েকে পড়িয়ে তৈরি করে নেব,আমার সংসারে অসুস্থ স্বামী,দেবর-ননদ মিলে বড় সংসার মানিয়ে চিনে চলতে পারার মতো মেয়ে দেখে আমি বৌ আনি। আমার মধ্যে মানুষ গড়ার নেশা আছে, তাই এমন করি।

এদিকে তখন অফিসের কাজে কোনো সময়-অসময় ছিল না। সারাদিন কাজ করেও শেষ করতে পারতাম না। আমি যে ভাগ্য নিয়ে জন্ম নিলাম, তার জন্য একটা উদাহরণই যথেষ্ট; ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। স্কুল লাইন থেকে উঠে এলাম, কলেজের প্রফেসরদের মধ্যে। (তাদেরকে বিদ্বান মনে করে সবাই সম্মান দেয় এবং তারাও নিজেদের সেই স্তরের মনে করেন) কিন্তু জনশিক্ষা পরিচালক সাহেব (ডক্টর হাফেজ আহমদ) আমাকেই দায়িত্ব দিলেন এ. ডি. জেনারেলের। পুরো অফিস গোছগাছ করা আর সারা বাংলাদেশের শিক্ষা প্রশাসনের ঝামেলার মধ্যে নিরিবিলি কাজ করে যাওয়া। ঐ ভাঙা কুলো ছাড়া আর কাউকে দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। Organisation and  managment বিদ্যা দিয়ে ঘর সাজাতে হুকুম দিলেন ডি. পি. আই সাহেব। স্কুলের থেকে শিখে আসা সার্ভিস রুলস আর হিসাবরক্ষণ করার অভিজ্ঞতা এ সময়ে খুব কাজে দিয়েছিল।

 কষ্ট হয়েছিল দুটো কাজের জন্য ব্রিটিশ ভারতের সুইপার নাথুরাম ও তার পরিবারকে নিয়ে। ওরা স্বামী-স্ত্রী আর পুত্রবধূ মিলে ঐ পাঁচতলা। অফিস ঝাড়ু দিত, টয়লেট ধুতো। পানি সাপ্লাই যেমন অনিয়মিত, তেমন যারা এখানে অফিস করতো এবং বাইরের থেকে আগত লোকের কিছু অংশ অপরিচ্ছন্ন অভ্যাসের। অতএব অফিস পরিচ্ছন্ন রাখার মত কঠিন কাজ আমাকে ভাবিয়ে তুললো। একজন প্রশাসনিক অফিসার আছেন, নারায়ণগঞ্জ কি ফরিদাবাদ থেকে দু পায়ে সাইকেল ঠেঙিয়ে বিরাট ভুড়িঁ টেনে অফিসে আসতে প্রত্যহ তার দেড় ঘন্টা লেট। তারপর জিরিয়ে নিতে লাগতো আরও সময়। তার প্রশাসন দেখার কাজও তেমনি ঝিমানো।

প্ল্যানিং সেকশানের কেরানিদের বেতন দিতে পারে না অফিস। ওদের শুকনো মুখ, যেখান থেকে হোক ধারের ব্যবস্থা করে দিন, না হলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। দেখলাম ওদের আনাহার ক্লিষ্ট ছাপোষা করুণ মুখ কতকগুলো। কাঁচের জানালা, আমি বসি তেতলায়, পর্দা ছিল না। দূরে কার্জন হলের লাল ইট চোখে পড়ে। সেখানে পড়তে না পারার ব্যথা নিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছি। ওদের উপলক্ষে কেমিস্ট্র আর ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপকদের সাথে দেখা করেছি।নিজের বিদ্যা নিয়ে কখনও দীনতার সম্মুখীন হইনি,এ চাকরিতে এসে হচ্ছি;দেখছি। আমার জীবন কি একটা নদীর স্রোত? উৎস থেকে নেমে সে তার পথ রচনা করে নিয়েছে। এ পথ তার জন্য সুগম ছিল?সেই মফস্বল শহরের এম.ই স্কুলের দায়িত্ব নিয়ে নিজের লেখাপড়াকে ঠেলে রেখেছিলাম। পথ এঁকেবেঁকে আজ আমি এখানে! এই জীবন-স্রোতে কত জল গড়িয়ে গেল।

অন্যমনস্ক কতক্ষণ আর থাকতে পারি! নাথুরামের বৌ নালিশ নিয়ে এসেছে, মরদ আদমি তাড়িখোর আছে! কাম নেহী কর সেকতে! হামাক ওসকা কাম করতা …বহুস জুলুম আছে মাইজি! এতনা বড়া অফিস … মেরা গতর দেখিয়ে … ও কোমর ভাঙ্গা দেখিয়ে ফ্লোরে বসে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, ছেলে মাধব করবে,বাপের কাজ, তুমি করবে কেন! এবার সতীমা চুপ। ছেলেকে খাটাতে চায় না। সব মরে ধরে সবে একটা। মেথর হলে কি সে তো মা, মায়া তো দিল ভর। অন্য একজন মায়ের সামনে সেটি দেখিয়ে অপরাধ মাফ চাচ্ছে। কিন্তু অফিসের পরিচ্ছন্নতা যে সবার উপর; আমি কর্তব্যপরায়ণ না হয়ে উপায়! বড় সাহেবের পিয়ন আবুলকে ডেকে পাঠালাম। তার সেই ‘জো হুকুম চেহারা।তবে গায়ে পাঞ্জাবি-পায়জামা,পায়ে রাবারের স্যান্ডেল। অথচ প্রফেসর শামছুল হক সাহেবের সময় ওর ড্রেস ছিল পাগড়ি মাথায়,শাদা চোপকান,তাতে লাল বেল্ট, পিতলের তকমা আঁটা,পায়ে সু। ওকে ডিঙ্গিয়ে ডি.পি.আই সাহেবের কাছে যাওয়া রীতিমত ভয়ের ব্যাপার ছিল। এই বুঝি ধরে জেলে পুরবে। পুরনো স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে ওকে জিজ্ঞেস করি,অফিসের ড্রেস পরনি কেন? তার সোজা উত্তর,দেশ স্বাধীন অইছে,এখন ঐগুলোর দরকার নেই। ড্রেস যত্ন কইরা তুইলা রাখছি, ব্রিটিশ সাহেব আর পাকিস্তানি সাহেবদের আমলের জিনিস জাদুঘরে দিমু।

আমার মাথায় এমন দামী কথা কখনও আসবে না। মনে মনে ওকে প্রশংসা করেছি। কিন্তু আমার ঘাড়ে যে এ.ডি.জেনারেলের দায়িত্ব।এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসারকে তুমি বলে দাও যে এ.ডি.আপা সেক্রেটারিয়েট থেকে এসেছেন,বড় কড়া; কাজ না করলে তারও বেতন হবে না। পেছনের মাঠে গরু চরছে কেন? বাগানের জন্য দুটো মালি। টয়লেট থেকে গন্ধ বের হচ্ছে; তার তো চাকরি থাকবে না। ঐ গরু ছিল আবুলের। তার জন্যই বাগান হতো না। সে স্বাধীন হয়েছে। ইউনিফর্ম ছেড়েছে। আমি আর কী বলতে পারি ওকে! সে একদিন আমাকেও খাঁটি গরুর দুধ খাইয়েছে। পয়সা নেয়নি। এক সময় আবুল আমাকে বললো, আপনার পোস্টে যারা আসেন এই দুধ তারা ফ্রি খায়। বাগানের কথা কেউ বলে না। আপনি বলেছেন যখন বাগান আমি করে দেখিয়ে দেব। গরু সামলানো যাবে, সারও হবে বাগানের। সে তার কথা পালন করেছিল। আশ্চর্য সে আমাকে আম্মা ডাকতে শুরু করেছে। বলে, বড় বংশের মেয়ে আপনি, বড় বংশের বৌ, আমি শামছুল হক সাহেবের মা থেকে শুনেছি। আপনার সম্মান অন্যরকম।

আসলে পিয়ন, মেথর, মালি, কেরানি এদের জন্য আমি যেমন ভাবতাম, ওদের সুখে-দুঃখে এগিয়ে গিয়েছি, তাতে ভাল কাজ পেতাম। অফিস একটা সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। এখানেও আমি স্কুলের মত ছোট-বড় ভেদাভেদ না করে টিম ওয়ার্কের স্পিরিটে কাজ করেছি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লোকজনকে আমার কাছেই আগে আসতে হতো, নানাবিধ সমস্যা। এরা অযথা হয়রানির শিকার যাতে না হয়ে পড়েন, আমাকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হতো। একসময় মনে হতো বিপদে পড়ে কলেজের শিক্ষকরা আমার কাছে যেভাবে মাথা নরম করে কথা বলে এ যাত্রা শোধ তুলবো…।

কিন্তু আমি স্বভাবতই অনেক ঘাত-প্রতিঘাতে গড়ে পিটে মানুষ। হয়েছি; অন্যের কষ্টে নরম হয়ে পড়ি। রাগ করাতো ছাড়, নিজে উঠে পড়ে কাজ সমাধান করে দিয়েছি।  ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’! স্কুলের থেকে ডি.পি. আইতে জেনারেল পদে কাজ করলেও জাতে আমি যে শিক্ষক, একথা তো ভোলা যায় না।

অফিস থেকে দেরি করে ফেরার কত যে কৈফিয়ত দিয়েছিলাম ঘরে। ফিরে, কেন দেরি হয়-কাজের ফিরিস্তি দিতাম। কিন্তু ভবি যে ভোলার নয়। স্বামীর দাবি চুল পরিমাণ কমাতে রাজি নন তিনি। আক্ষেপ করতেন, ছেলেমেয়েগুলো সব আমেরিকায়, রূপালী ভাবীও চলে গেল। তুমি থাক অফিসে … কে দেখে আমাকে। হোম ইকনমিক্সে এম. এ রূপালী হাতের রান্নাও মজাদার আমেরিকা চলে গেল। খুকুটা ছিল (আমার খালাতো বোন), তাও নেই! দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য কি ছেলেমেয়েরা দেশ ছেড়ে চলে যাবে? কেন দেশে থাকতে পারে না।

তুমিও বৈরুত থেকে কি জাদু শিখে এসেছ… সবাই তোমাকে পছন্দ করে— আমি একা পড়ে থাকি।

ব্যাপার হলো এই বাইরে আমি আলো জ্বালাচ্ছি, আমার ঘরে অন্ধকার। ঘরের দরজা, জানালার পর্দাগুলো লেইসের ঝালর দেয়া, নোংরা-হেঁড়া, ধোয়ার কথা বলে যাই না। ঘরে কাজের লোক সেই বুড়ি শরবত আলীর মা, কাপড় ধোয়ার জন্য একটা ঠিকে ঝি, সময়মত আসেও না। ছোট মেয়ে তখনও আমাদের কাছেই ছিল; ওর পড়া সবে শেষ … বিয়ের আয়োজন করছি … ফলে বাসায় সময় দেয়া দরকার … তাও হচ্ছে না। সে সময়টা এত ব্যস্ততার ছিল। যখন ত্রৈমাসিক সরকারী অনুদান দেয়ার কিংবা বাজেট তৈরি, আমাকে সন্ধ্যায়ও অফিস করতে হতো। কয়েকজন রিসার্চ অফিসার মহিলা ছিলেন বলে রক্ষা, নচেৎ ঘর কি বাইরে আমার এই সন্ধ্যায় কাজ করার অর্থ নানাবিধ অনর্থ সৃষ্টি করেই ছাড়তো।

কাজকে সুন্দর করে সামাল দিতে গিয়ে লোকনিন্দার খপ্পরে যে পড়িনি, তা বলা যাবে না। নিন্দুকেরা আমাকে রেহাই দেয়নি। কিন্তু আমার মনের বল ভাঙতে কেউ পারেনি। সাতঘাটে জল খাওয়া, পোড় খাওয়া শরীর, সব নির্বিচারে সয়ে নিয়েছিল। আগুনে পুড়ে সোনাকে খাঁটি করা হয়, আমাকে নানান পরীক্ষার মধ্য দিয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে তাই ইস্পাত কঠিন হওয়ার শক্তিও অর্জন করতে পেরেছিলাম। এই অফিসে অনেক মহিলাকে কাজে যোগদান করা এবং কাজ করতে পারার পথ সৃষ্টি করতে যেতে এত কষ্ট ও পরিশ্রম করেছিল। উনিশ’শ উনআশি সালের সাক্ষরতার অভিযান চালাতে গিয়ে আমার এক মনাজ্ঞো অভিজ্ঞতা হয়েছে। সরকারী হুকুম (তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান), স্বাক্ষর ছাড়া কেউ বেতন নিতে পারবে না। টিপ সই চলবে না। আমার বিপদ হল নাথুরামকে নিয়ে। ‘সতী’ কোনোমতে একটা কিছু আঁকাজেঁকা করে স্বাক্ষর করলো—কিন্তু নাথু বলে, ইংরাজ সাহাব থেকে বড় কে? টিপসই লাগানো ভুল কি?

ও টিপসই লাগিয়েই বেতন নেবে। রাজা যায়,রাজা আসে,নাথুরা বংশ পরম্পরায় অফিস ঝাড়ু দেয়, আঙ্গুলে কালি লাগিয়ে ছাপ মেরে বেতন নেয়– তাড়ি খেয়ে গান গায়– কিন্তু এ.ডি.জেনারেল আমি, ঝামেলা সামলাই কোন্‌ উপায়ে! সেই সমাধান নাথুই করে দিয়েছিল।অতিরিক্ত তাড়ি গিলে গান নয়, মুখে ফেনা তুলে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছিল। শেষে চাঁদা তুলে আমাকেই তার শ্মশান যাত্রার খরচ তুলে দিতে হয়েছিল।

উনিশ’শ উনআশি সালের সাক্ষরতার অভিযান চালাতে গিয়ে আমার এক মনাজ্ঞো অভিজ্ঞতা হয়েছে। সরকারী হুকুম (তখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান), স্বাক্ষর ছাড়া কেউ বেতন নিতে পারবে না। টিপ সই চলবে না। আমার বিপদ হল নাথুরামকে নিয়ে। ‘সতী’ কোনোমতে একটা কিছু আঁকাজেঁকা করে স্বাক্ষর করলো—কিন্তু নাথু বলে, ইংরাজ সাহাব থেকে বড় কে? টিপসই লাগানো ভুল কি?

কী অবাক ঘটনা! ঐ মানবেতর জীবনধারী নাথুকে আমি আবারও মনে করলাম। সেই উনিশ শ ছিয়াশি সালে, তখন UNESCO-তে Primary Education Consultant. ধনবাড়ি উপজেলায় স্কুল দেখতে গিয়ে এক বৃদ্ধার দেখা পাই। উনি স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সদস্যা এবং ঐ নিরক্ষরতা অভিযানের সময়কার স্বর্ণ বিজয়িনী। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কেমন করে এই অসাধ্য কাজ সাধন করলেন আমি তো ব্যর্থ হয়েছি– একজনকে স্বাক্ষর দিয়ে বেতন নেবার আদেশ অগ্রাহ্য করে। সে মেনে নিল না, জীবন বিসর্জন দিয়ে স্বর্গে গিয়েছিল, সেখানে চিরকাল ঝাডুধরার তার শক্ত আঙ্গুলগুলোকে নিয়ে কেউ পরিহাস করবে না।

ঐ বৃদ্ধা গভীর সমবেদনার সাথে শুনলেন এবং বললেন, আগ্রহের একটা ব্যাপার আছে। আমার ভাগ্য ভাল, এই উপজেলার সকল মহিলার এ বিষয়ে এত আগ্রহ ছিল যে, তারা রান্না করার সময় চুলার ওপর পাটখড়ির টুকরা সাজিয়ে তাতে কয়লার দাগ কেটে নিজের নাম লেখা শিখে নিয়েছিল। তবে সময়ও কম লাগেনি।

 উনিশ’শ একাশিতে আমার পদোন্নতি, ডেপুটি ডাইরেক্টর হলাম। এতদিন বেশি ট্যুর করিনি। এখন যেতে হয়। সংসারে আরেক ঝামেলা সে সাথে। স্বামী মনমরা হয়ে পড়েন। ছোট মেয়ে, মেজ বৌ ঘরে, তাছাড়া বড় বৌও তখন ঢাকায়। বাড়িতে সকলেই আছে তবুও . . . । প্ল্যানিং-এর দায়িত্ব নিয়েছি; স্কুল এবং কলেজ যেগুলো ডেভেলপমেন্টে নেয়া হবে, সেসব সরে জমিনে দেখে আসার জন্য না গেলে নয়। সেই কথা বুঝবার লোক তিনি নন, সুন্দর করে সুগন্ধী সাবান মেখে তিনি গোসল করতে পারেন, পরিচ্ছন্ন জামা পরতে পারেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, শুধু খাওয়ার সময় তার অসন্তোষ; শরীর মন ভাল থাকলেও এখানে তার একটা বাতিক, স্ত্রীর উপস্থিতি।

এক সময় রসিকতা শুনতাম তার মুখ থেকে। আল্লাহ আমাকে মেয়ে আর তোমাকে ছেলে করে দুনিয়ায় পাঠালেন না কেন? তার নিজের আক্ষেপ ভরা এই কথাগুলো পরিহাস হয়ে আমার কানে এসে ঠেকতো। আমি পাশ কাটাতেই বলতাম, আমাকে আল্লাহ সে রকম করেই যে সৃষ্টি করেছেন। মোটাসোটা হাত আর পায়ের গড়ন নিয়ে। আমি ইউরোপের মদ্দা মেয়ের আখ্যা আগেই পেয়ে গিয়েছি। তুমি সেটি মেনে নিলেই নিষ্পত্তি হয়ে যায়। আক্ষেপ করা ভাল নয়।

বাবা বলেছেন, কাজ ফেলে রাখন ভাল নয়

‘কাজ ফেলে রাখন ভাল না’– কথা কয়টি বাবার, মারা যাওয়ার মাত্র ছয়দিন আগে আমাকে বলেছিলেন। জীবনে এমন অভিজ্ঞতা আমার নেই যে তা নয়, কিন্তু ‘ওহি’ নাজেল করলেন বুঝি বাবা। সে রকমটি তিনি প্রমাণ করে যাবেন কথাগুলোর, সে কি তখন ভেবেছিলাম? না। বাবার বয়স একাশি বছর হলেও তিনি কর্মক্ষম, ভগ্নস্বাস্থ্য নন। সেবার আমি নোয়াখালী গিয়েছিলাম সরকারী দায়িত্ব নিয়ে। নোয়াখালী গভঃ গার্লস হাইস্কুলের বিজ্ঞান ভবনের ভিত্তিফলক উন্মোচন করতে এসেছেন জনশিক্ষা পরিচালক ডক্টর হাফেজ আহমদ। আমি এবং কয়েকজন ছিলাম তার সফরসঙ্গী। আমি বাবার কাছে উঠেছি, কাজের উপলক্ষে বাবাকে দেখে যাওয়ার একটা সুযোগ করে নিলাম। বাবা কয়েকদিন থেকে জ্বর কাশিতে ভুগছিলেন। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ, নোয়াখালীতে একটানা কয়েকদিন থেকে বৃষ্টি, সেখানে দেখতাম একবার বৃষ্টি শুরু হলে আর থামাথামি নেই, কাদামাটি আর পানিতে সবখান একাকার। তখনও তাই, উঠান ভর্তি কাদা, একবার পিচ্ছিল হয়ে পড়লে কোমর ভাঙার দশা। জোড়া ইঁট বসিয়ে, দেখলাম রাস্তা পর্যন্ত যাতায়াত ব্যবস্থা।

একটু ভাল বোধ করছিলেন তিনি। কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। বাবা ডাকলেন, “রৌশন, তোমার মনে পড়ে, উনিশ’শ তেপ্পান্ন সালের একটা কথা !” আমি ভাবছিলাম মায়ের মৃত্যু কথা কি তার এখন আমাকে দেখে মনে পড়লো। আশ্চর্য, যা আমার মনে নেই, ঠিক সেটি বললেন বেশ ফলাও করে। ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট পানাউল্যা সাহেব নোয়াখালীর উকিল-মোক্তারদের গাল পাড়লেন। “মামলামোকদ্দমা করে আপনারা নিজ স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বোঝেন না। এখন এই তরুণ হেড মিস্ট্রেস থেকে শিখে নিন। তুই, সেদিন কেমন সুন্দর বলেছিলি, উমা গার্লসের চারটে ক্লাস আপনারা চালাতে পারছেন না। সরকারী মিডল ইংলিশ স্কুলটি তুলে দিয়ে সেই টাকায় ক্লাস ওয়ান টু টেন চালাবেন অসম্ভব। তার চেয়ে সরকারের কাছে দাবি করছেন না কেন মেয়েদের জন্য একটা সরকারী হাই স্কুল করে দাও, মাত্র তো চারটে ক্লাস। ছেলেদের জন্য তো আছে! নেগেটিভ না হয়ে আমরা পজিটিভ এপোচ দিই না কেন?” বাবা এতটুকু বলে জিরুতে লাগলেন। জুর কাশিতে ভুগে দুর্বল শরীর। আমি বললাম,“মনে আছে আব্বা। জোর একটা ফাইট দিতে পেরেছিলাম বলে আজ ঐ স্কুলের কত ছাত্রী বি. এ, এম. এ. পাস করার সুযোগ পাচ্ছে। এখন বিজ্ঞান প্রযুক্তির দিকে ওদের যাওয়ার বেশি সুযোগ হলো। আপনি আমাকে দোয়া করেছেন বলেইতো এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি আসতে পারলাম।” বাবা চট করে আমার হাতখানি টেনে বুকে রাখলেন নিজের।

আমি বড় ঘরে ঢুকে মুষড়ে পড়লাম। সত্যি তো! পাঁচজন জুনিয়র উকিলের হাতে কাগজপত্রের মোটা ফাইল এবং বাবা তাদের একের পর এক ডিক্টেশন দিয়ে যাচ্ছেন, অনর্গল বাক্য বেরুচ্ছে, ঝরঝরে ভাষা। যেমন ইংরেজি, তেমন বাংলা। পাঁচজনকে পাঁচরকম মামলার বিষয় বাবা একাধারে কী করে বলে যাচ্ছেন, এমন পয়েন্ট বাই পয়েন্ট! উনি তিন চারটা বালিশে ঠেস দিয়ে খাটের কিনারায় মাথা রেখে আধা শোয়া। শরীর থেকে জ্বর মাত্র একদিন আগে রিমিশন হয়েছে। ভাত আর সিঙ্গি মাছের ঝোল পথ্য খেলেন। এই শরীরের বিশ্রাম না দিয়ে কী করে যাচ্ছেন, মা যে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন, তা তো নিছক ভাবনা নয়। সাংঘাতিক কিছু ঘটতে পারে এই আশংকায় আমাকে তাড়া করে তার বিছানার পাশে নিয়ে এলেন। কোনোমতে বললাম, এদের চলে যেতে বলেন আব্বা, আপনাকে এখন রেস্ট নিতে বলেছে ডাক্তার। ঐ হেলান অবস্থা থেকে একটু নড়লেন। “এই পাঁচটা কেসের টাকা যে নেয়া হয়ে গেছে আম্মা, দায়টুকু শেষ করতে দিন, কোনো কাজ ফেলে রাখন ভাল না।”

— আপনার বুড়ো বাপকে মাফ করে দিন আম্মা… (ইমোশনের সময় তিনি আমাদের আপনি বলতেন)। আমরা না বুঝে এমন সব কাজ করি, যার জন্য ভাল মানুষেরা কষ্টে পড়ে,জীবনে যুদ্ধ করতে করতে হয়রান হয়। কিন্তু আপনি টিকে গেলেন আম্মা, ছোট বয়সে বিয়ে দিয়েছিলাম। বড় বাড়ি, নামকরা বংশ। সৎ পাত্র। ভেবেছিলাম আপনার কোনো অভাব থাকবে না। কিন্তু দেখলাম, কী কষ্ট করেছেন-আল্লাহ জানেন…”।
— ও আব্বা, সবাই বলে আমি আপনার মতো হয়েছি, বাপগড়া মেয়ে। ভাগ্যবতী…

আমার কথা শেষ হলো না। প্রশস্ত ললাট শেষে বয়সের চাপে গর্তে নামা। চোখ দুটো থেকে তিনি হাত দিয়ে কেবল পানি মুছে নিচ্ছেন, স্নেহের ধারা তবুও কি শেষ হয়! শেষে আমি আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে এলাম।

তার পরদিন আমার চলে আসার পালা। কাজ শেষ করে বাবার কাছে এলাম। তার বিছানার কাছে যাওয়ার আগে বিমাতা ইশারায় তার কাছে রান্নাঘরে ডাকলেন।
— আপনার বাপজীরে মানা করেন তো, তিনি কি আমাদের অকুলে ভাসিয়ে চলে যেতে চান! মোকদ্দমার কাজ নিয়ে বসেছেন উনি। আমাদের কারও কোন কথা শুনছেন না।
আমি বড় ঘরে ঢুকে মুষড়ে পড়লাম। সত্যি তো! পাঁচজন জুনিয়র উকিলের হাতে কাগজপত্রের মোটা ফাইল এবং বাবা তাদের একের পর এক ডিক্টেশন দিয়ে যাচ্ছেন, অনর্গল বাক্য বেরুচ্ছে, ঝরঝরে ভাষা। যেমন ইংরেজি, তেমন বাংলা। পাঁচজনকে পাঁচরকম মামলার বিষয় বাবা একাধারে কী করে বলে যাচ্ছেন, এমন পয়েন্ট বাই পয়েন্ট! উনি তিন চারটা বালিশে ঠেস দিয়ে খাটের কিনারায় মাথা রেখে আধা শোয়া। শরীর থেকে জ্বর মাত্র একদিন আগে রিমিশন হয়েছে। ভাত আর সিঙ্গি মাছের ঝোল পথ্য খেলেন। এই শরীরের বিশ্রাম না দিয়ে কী করে যাচ্ছেন, মা যে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন, তা তো নিছক ভাবনা নয়। সাংঘাতিক কিছু ঘটতে পারে এই আশংকায় আমাকে তাড়া করে তার বিছানার পাশে নিয়ে এলেন। কোনোমতে বললাম, এদের চলে যেতে বলেন আব্বা, আপনাকে এখন রেস্ট নিতে বলেছে ডাক্তার। ঐ হেলান অবস্থা থেকে একটু নড়লেন। “এই পাঁচটা কেসের টাকা যে নেয়া হয়ে গেছে আম্মা, দায়টুকু শেষ করতে দিন, কোনো কাজ ফেলে রাখন ভাল না।”

মা এক বাটি বাচ্চা মুরগির সুপ ভেতর থেকে পাঠিয়ে দিলেন। আমি খেতে দিলাম। গল্প করলেন আমার সাথে। সুপটুকু সব খেয়ে নিয়ে বললেন, “আমার জন্য ভাবিও না, ভাল হয়ে উঠেছি, আল্লাহর দোয়া। আল্লাহ ভরসা, তুমি চলে যাও। পারলে আবার আসবে। তুমি আসলে খুশি লাগে। তোমার মা, ভাইবোনরাও খুশি হয়।”

বাবার কথায় আশ্বস্ত হয়ে ঢাকায় চলে এলাম। কিন্তু দশই জুলাই দুপুরে টেলিফোনে পেলাম মর্মান্তিক দুঃসংবাদ। তাঁর হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এক মহান কর্মবীরের অন্তর্ধান আমাদেরকে শোকের মধ্যে মূহ্যমান করে রেখে গেল।

অপরদিকে আমাকে অন্য একটি দুশ্চিন্তায় পড়তে হলো। শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতার জন্য শ্বশুরের জানাজা ইত্যাদিতে শরিক হতে না পেরে স্বামীর মন অনুশোচনায় কাতর। বড় জামাতা, কত আদর-যত্ন করেছেন, তার এমনটি দুর্ভাগ্য ইত্যাদি। তবে বুঝতেও পারছিলাম বাবার মৃত্যুর পর স্বামী নিজের কথা বেশি মাত্রায় ভাবছিলেন এবং ভীত চেহারা হয়ে গিয়েছিল তার। একলা বাথরুমে যেতে চাইতেন না। গেলেও দরজা বন্ধ করতেন না। মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া অনেক আগেই বন্ধ। এখন হাঁটতে চলতেও সোজা হয়ে থাকেন না। ডাক্তারের পরামর্শ হল তাকে আনন্দে রাখতে হবে। সর্বক্ষণ লোকজন নিকটে থাকা চাই। টি. ভি দেখবেন। উনি যেন একা রয়েছেন, এমনটি মনে আনতে না পারেন-— সেদিকে খেয়াল দেবেন। বিশেষ কিছু নয়-ভাল হয়ে যাবেন।

ঘর ভরা আমার মানুষজন। নাতি-নাতনিরাই মাথা তোলা হয়েছে। ওদের মজাই হল দাদাকে নিয়ে টানাটানি। হাসি-কান্নায় ওকে ব্যস্ত করে রাখলো। ছেলের মধ্যে তখন সেজ কাছে; মাস্টার্স শেষ করেছে। সর্বক্ষণ বাপের হাঁটাচলা করার সাথে থাকে। মসজিদে নিয়ে যাওয়া থেকে মনিং ওয়ার্ক সব দেখছিল। সে সময় তিনি শরীর ভালবোধ করছিলেন এবং ছোট ছেলেকে বারবার মনে করতেন। নকীবকে অনুযোগ করতেন তুই শায়েরের মতো কাছে কাছে থাকতে পারিস না, অত তাড়াতাড়ি হাঁটছিস কেন! সংসার জীবনে ছেলে কাছে থাকলে কাজে আসে, এই সুন্দর কথা বুঝতে বেশ সময় নিলেন তিনি। একদিন আমিই বললাম, ওকে রাগিও না, বিদেশ চলে যাবে; পি.এইচ.ডি করার জন্য এসিস্ট্যান্টশিপ পেয়েছে, যতদিন বাপের সেবাযত্ন করতে পারে, সেই সুযোগ দাও।

‘ছেলেমেয়ে কেন? তুমি কী করো ? একদিন ছুটি নিয়েছ? ঘরে থাক! অফিস বাড়িঘর করে নিয়েছ। আমি কে? আমি মরলেই খুশি। বেঁচে যাবে। অসুস্থ স্বামীকে আর দেখতে হবে না।’ এ জাতীয় অভিমানের। কথা শুনে কান্না পেত। পঞ্চাশোর্ধ আমি, চাকরির সুন্দর একটা পজিশনে আছি। দায়-দায়িত্ব কোথায় ঠেলে দেব? একটু অসাবধান হলে এখানে কোন্‌ বিপদে পড়ি, পদে পদে যে বিপদ। ডেপুটি ডাইরেক্টর এডমিন ও রানিং দুটোই আমি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। সারা বাংলাদেশের কত চিঠি, কত দর্শনার্থী। আমার একটা মতামত ও আদেশ পেতে ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসে। আমি মন খারাপ করতে পারি না। সাবধানে পা ফেলি। স্বামীকেও সান্ত্বনা দিই। খুব ধীর স্থির থাকি। বুঝতে পারি তার শরীর ভাল থাকলেই তিনি আমাকে নিয়ে পড়েন। ঘরের বৌ কাজ করছে-তাইতো যথেষ্ট। তাকে আবার এত ছুটাছুটি করতে হবে কেন! আমার ছোটবোন নুরজাহানকে প্রশংসা করেন, ও খুব ভাল। কলেজের চাকরি। পড়ানোর একটা ভাল কাজ মেয়েরা করবে। সংসারের কাজও দেখতে পারে। স্বামী, পুত্রকন্যার দিকে নজর দিতে পারে। আমার রাগ হতো। কোন কাজটা আমি অবহেলা করছি? চব্বিশ ঘন্টার দিন আমি কতটুকুন নিজের বিশ্রাম করার জন্য পাই? অফিস থেকে এসেই সবার আগে তোমার তালাশ করি। নিঃশ্বাস নেয়ার সময়টুকুও ব্যয় করি না-আমার চাকরি নিয়েখোটা দিলে ভাল হবে না। এই চাকরি করে তোমাকে পালছি-ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিয়েছি, বিয়ে-শাদি দিয়েছি, কারও কাছে দুটো পয়সার জন্য, হাত পাতিনি। আমার বাবা মারা গেলেন। আমি একটু শোকও করতে পারলাম না। তোমাকে নিয়ে আমার রাতদিনের ভাবনা মাথায় ঢুকিয়ে দিলে। বাবার আশির উপর বয়স হয়েছে। তোমার এত ভয় কেন, মাত্রতো পঁয়ষট্টি বছর বয়স! আমেরিকায় তোমাকে পাঠিয়ে দেব। মেয়ের কাছে থাকবে। আমারতো চাকরি। যেতে পারব না। ভাল খাবে ভাল থাকবে, কী বলো! বাবা-মাকে সহজে নিতে পারে-তুমি আগে যাও, আমি পরে যাব।

আমি এসব কথা বলে কখনও তাকে উৎসাহিত করতে পারিনি। ঐ সাত সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে যদি তার মরণ হয়, তা হলে কি হবে! কে মুখে কলমা পড়ে পানি দেবে? কাছে থাকবে কে?সুরা ইয়াছিন পড়বে কে? আমি দেশে মরতে চাই। গ্রামের বাড়িতে আমায় কবর দিও। আমার রুহের মাগফেরাত চাওয়ার জন্য প্রত্যেকদিন মুয়াজ্জিন কবর জিয়ারত করবে। আমি পাঁচ ওয়াক্ত আজান শুনতে চাই; বলে হাত বাড়িয়ে আমার দুহাত ধরে এমন করে তাকিয়ে ছিলেন, সে সময়। আমার বুকে ব্যথা ঠেলে এল। কেন অনাহূত এই অবুঝ মানুষটিকে কষ্ট দিলাম।

সংসার থেকে বরাদ্দ ছিল আমার এই তো সুখ-দুঃখ, আনন্দ আর বেদনার এক জীবন। হাসি মুখে সেটি বয়ে বেড়িয়েছি। কিন্তু সেই সময়ে চাকরি নিয়েও ফ্যাসাদে পড়তে হলে আর কি রক্ষা থাকে! প্রশাসনের সাথে প্লানিং-এর যতটুকু আঙ্গিক সম্পর্ক সেটি আমি শিখে নিয়েছি। পারিও সুন্দর করে। কিন্তু পুরো দেশটার উন্নয়ন বিষয়ক গুরুতর কর্মপদ্ধতি আমার বিশেষ জানা ছিল না। অথচ সেই কঠিন কাজটি আমি কেন করবো। কেনই বা আমাকে সেটি গুছিয়ে দেয়া। সে প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পেতাম না। আপত্তি করবো তো বিদায় নাও। বহু এফিসিয়েন্ট অধ্যাপক রয়েছেন এক পায়ে দাঁড়া, শিক্ষা পরিদফতরে আসতে চায়। স্কুলের থেকে আসা এক মহিলাকে উৎখাত করা অতি সহজ। কিন্তু বদলির অভিজ্ঞতা আমার বেশ ভালভাবে জানা হয়ে গিয়েছিল। অসুস্থ স্বামীকে ফেলে কোথায় যাব, অযথা চাকরির উপর হামলা আসবে। তাই বাধ্য হয়ে যে কাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও বিদ্যা কম ছিল, তা করতে হয়েছে। রাতভর পড়া। অঙ্ক কষা নিয়ে পড়ে থাকতাম। বিপদ কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিল।

অন্য এক প্রশাসনিক জটিলতার মধ্যেও আমাকে সে সময় পড়তে হয়েছিল। আমার সহকারী পরিচালক দুজনই কলেজ থেকে আগত, প্ল্যানিং বিষয়ক বিশেষজ্ঞ নন। কিন্তু অহংকারে ভারী হয়েই এসেছিলেন। তাদের থেকে কাজ পাওয়া আমার জন্য সহজসাধ্য ছিল না। বার্ষিক প্রতিবেদন তো সকলেরই ডি.পি, আই লেখেন। আমার মাধ্যমে শুধু যায়। এসব পোস্টে কে দায়িত্ব পালন করলেন না— এমন কথা ওদের আমি জানাব? কে বিশ্বাস করবে? উল্টো আমারই গদি নড়নচড়ন। অতএব মাথার বোঝা মাঝে মধ্যে বুকে এসেও বিধে গিয়েছে। সরকারী নিয়মে তখন প্লানিং থেকে বিদেশে ট্রেনিং-এ পাঠান হতো। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তো ছিলই, নয় মাসের কোর্স। আমার বয়সের জন্য সেটায় যাওয়া যাবে না। রিসার্চ থেকে লোক পাঠানো হল, আমারই সেকশন থেকে। তবে তিন মাসের ট্রেনিং ছিল ব্যাংককে। সেখানে আমি যেতে পারতাম। শুধু সমস্যা ছিল আমার নিজস্ব। অসুস্থ স্বামী রেখে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আত্মসম্মান বাঁচিয়ে কিভাবে । নিজেকে তৈরি করবো সেটা ছিল আমার নিজের পরিকল্পনা। কয়েকজন প্ল্যানিং সহকারীর সহায়তায় আমি কাজ করে যাই, শিখতেও থাকি। এদের মধ্যে জনাব মতিয়র রহমানকে আমি ভাল শিক্ষক পেয়েছিলাম।

আমার এই সাধন ভজনের মধ্যে সরকার থেকে নতুন পরিকল্পনা বিষয়ক কাজ এলো। দেশের সকল বেসরকারী স্কুলে যেখানে বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া হয় না, সে সব স্কুলে বিজ্ঞান শাখা খোলা হবে। প্রাকটিক্যাল ক্লাস রুম তৈরি করা হবে এবং বিজ্ঞান শেখার সরঞ্জাম দেয়া হবে। প্রজেক্ট তৈরি কর। ব্যাপক আকারে অনুসন্ধান চালানো দরকার। আমার প্ল্যানিং সেলের অবস্থা তো সঙ্কীর্ণ, লোক কম। মাথায় ফিচকে বুদ্ধি ছিল বুঝি, সুন্দর এক চার্ট করি যাতে স্বয়ং ডি. পি. আই সাহেব থেকে রিসার্চ অফিসার পর্যন্ত, ইঞ্জিনিয়ারিং সেল অন্তর্ভুক্ত করে একটি কনক্রিট টুর প্রোগ্রাম তৈরি করে নিলাম। সাথে কয়েকটি প্রশ্নমালা, পূরণ করে আনার জন্য সকলকে বিতরণ করি। ডি. পি. আই ছিলেন আর্মির লোক, ব্রিগেডিয়ার শামছুল ইসলাম। শিক্ষা কোর থেকে এসেছিলেন। আমি ভেবেছিলাম এতদিন বকুনি খেয়েছি এবার বেয়নেটের আঘাত! আশ্চর্য হলাম। উনি টুর পোগ্রাম পেয়ে উচ্চহাস্যে অভ্যর্থনা করেন আমাকে। সিলেট দিলেন আমাকে? আমি যে শিকার করতে ভালবাসি আপনি জানলেন কী করে? খুব সহজে! ডি.জিকে আসন থেকে নড়াতে হলে এট্রাক্টিভ প্লেস দিতে হবে— আমার প্ল্যানিং-এ এই বিদ্যাটুকু সম্বল।

সেই প্রোগ্রাম আশাতিরিক্ত সফল হয়েছিল এবং সাফল্যের প্রশংসা থেকে অন্য রকম বিপদের সূত্রপাত; কারও ভাল কেউ সহ্য করতে পারে না। আমি সে রকম অবস্থার শিকার হই। দুই ডি. জিতে আমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি। প্রাইমারি ডাইরেক্টরে দক্ষ অফিসার চাই। নতুন অফিস দিয়ে সরকার থেকে ডক্টর হাফেজকে সেখানে বসানো হয়েছে। অতএব তার দাবিকে প্রাধান্য দিলেন শিক্ষাসচিব কাজী জালাল সাহেব। এদিকে আর্মি কোরের ব্রিগেডিয়ার সোজাসুজি লোক; আপনি যদি না যেতে চান, আমি আপনার সঙ্গে আছি। খুব সংকট তখন আমার জন্য। আর্মি থেকে ডি.জি আসা; আমরা শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু এরশাদ সরকার। এসে শুরুতেই সেটি করেন। অপরপক্ষে প্রাইমারি পরিদফতরের জন্য ঘর গোছাতে ডি. জি ডক্টর হাফেজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আমি অমান্য করতে পারছিলাম না। আরও একটা সমস্যা আমার জন্য কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে টেনে আনলেন। আমার সহকারী এ. ডি. পি আইদের উভয়েই গণিতের প্রফেসর, সায়েন্স প্রজেক্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি এখানে সিনিয়র অফিসার। আমি সরে গেলে কাঁটা উপড়ে গেল। ওদের মধ্যে যার জোর বেশি সে প্রজেক্ট ডাইরেক্টর হবে। আমি শিক্ষা প্রশাসনের লোক, সায়েন্সে মাস্টার্স নই। এসব অজুহাত খাড়া করার লোকের অভাব ছিল না। আমার বিদ্যা এবং কাজ নিয়ে কথা কেউ বললে ভীষণ গায়ে লাগে। অনর্থক অপমান হওয়ার ঘা খেতে চাইলাম না। বদলি মেনে নিলাম— ছোট বদলি, শিক্ষাভবনের তিনতলা থেকে পাঁচতলায় গিয়ে উঠছিলাম।

সেই সময়কার (উনিশ’শ একশি-বিরাশি) কয়েকটা কটু মন্তব্য আমাকে শুনতে হয়েছিল। সবই ছিল হিংসার জ্বালা বুঝতাম। বিষ খেয়ে মানুষ যেমন বলে বিষ হজম করা– আমার মনের তখন সেই অবস্থা। আসলেই প্রাইমারির প্রশাসনের মধ্যে আমি এসে মধ্যস্থলে অবস্থান করি। বিদেশী সাহায্য সংস্থা যেমন ইউনেস্কো, ইউনিসেফ, বিশ্বব্যাংক প্রচুর সাহায্য দিচ্ছিল প্রাইমারি খাতে। এটা একটা প্রজেক্ট ছিল তখন-ইউনিভার্সেল প্রাইমারি এডুকেশন, (সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা), বিশ্বব্যাংকের আলাদা একটি প্রজেক্ট অনেক আগে থেকে চালু ছিল। তখন সেটিও পরিদফতরের অধীনে নিয়ন্ত্রিত। আমার পোস্ট ছিল অত্যন্ত লোভের, বহু প্রার্থী ছিল এর জন্য। আমি আসতে পেরেছিলাম নিজ গুণে,সততা, নিষ্ঠা এবং সুস্থ দেহ ও মনের অধিকারিণী ছিলাম তাই। প্রচুর পরিমাণ কাজ করতে পারতাম, মাথা ধরতো না, হয়রান লাগতো না। প্রজেক্ট লেখা, টাকার হিসেব মিলিয়ে দেখা, প্রাথমিক জেলা শিক্ষা অফিসারদের বেতন স্কেল একাধাপ উন্নীত করে জেলা শিক্ষা অফিসারদের সমান আনা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় পর্যন্ত ছুটাছুটি করতাম অনায়াসে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী লোকদের টিটকারি— আর জে. আর.সালেহা খানম ছাড়া আর কি কেউ ছিল না? আমরা সব বুঝি! মেয়েলোক হওয়ার সুবিধা কত।

ঐ দেখেন! ভাল কাজ করার সুনামটা আমার কেমন এবং কোনদিক থেকে এলো, শিকড় কোথায় — এটা বোঝানোর জন্যই আমি মন্তব্যটা পরিষ্কারভাবেই লিখে দিলাম। আল্লাহ মেয়ে করে এই পৃথিবীতে এবং এই বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। তাই আমার কোনো গুণ বিচারে পেল না। এক নারী ধর্মে আটকা পড়ে গেল। অথচ এযে কতখানি হাস্যাস্পদ, একটু চিন্তা করলেই অনুধাবন করতে সময় লাগে না। অফিস নয়, যে কোন স্থানে পুরুষেরা মেয়েদেরকে তাদের লালসার শিকার করতে পারে এবং করেও। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই দেখতে পাওয়া যায়। মেয়েদের নিরাপত্তা কে দেবে? হায় বিধাতা! মেয়েদের ইজ্জতের সম্মান কবে পাবে তারা?

বেশিসংখ্যক মেয়েরা যদি প্রশাসনের কাজে এগিয়ে আসে, তাহলে যদি কিছু হয়, এই ধারণা নিয়ে আমি প্রাইমারিতে সহকারী পরিচালক থেকে গবেষণা অফিসার, এসিস্ট্যান্ট, কেরানি, আয়া মেয়ে রিট করার প্রস্তাব দিলাম। শুধু এখানেই আমি মেয়েদের সীমাবদ্ধ রাখতে ইচ্ছুক নই। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা (থানা) শিক্ষা অফিসার, সহকারী শিক্ষা অফিসার-শিক্ষার মাঠ পর্যায়ে মেয়েদের চাকরির সংস্থান করার চেষ্টা চালাই। আমি যে সার্থক প্রশাসন পরিচালক, তার প্রমাণ আমি রাখতে পেরেছি। প্রাথমিক প্রশাসনে মেয়েরা আগ্রহ সহকারে এগিয়ে এসেছিল এবং অদ্যাবধি মেয়েরা সাহসের সাথে আসছে। নিজেদেরকে কাজের জন্য সদা-সর্বদা প্রস্তুত রাখছে-এটা আমার জন্য পরম পাওয়া এবং এতে করেই আমি পুরুষের কটু মন্তব্যগুলোকে মিথ্যা বলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে নিন্দুকদের দেখিয়েছি। প্রাথমিক শিক্ষা পরিদফতরে পা দিলেই তখন দেখা যেত। তবে প্রাথমিক শিক্ষাতে আমাদের ঠাঁট ঠমক তো ছিলই। স্টাইলে অফিস চালালে, অন্যদের হিংসে হবেই, নানানজনে উড়ো কথা বলবেই।

আমি গ্রামের স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে প্রায়শ শুনতাম,আপা আপনারা কেন আসেন না।স্যাররা আসেন, আমরা মেয়ে শিক্ষক বেশি।সবকথা কি স্যারদের বলা যায়? ওরা খাঁটি কথাই বলেছেন।উন্নত দেশে হিসেব নিলে দেখা যায়,পরিদর্শন ও মূল্যায়নে মেয়েরাই বেশিসংখ্যক কাজ করেন।আমাদের দেশে অবশ্য তা করতে হবে,শিক্ষিকাদের মুখ দিয়ে সে সব দাবিই এসেছিল।

আমি যে সার্থক প্রশাসন পরিচালক, তার প্রমাণ আমি রাখতে পেরেছি। প্রাথমিক প্রশাসনে মেয়েরা আগ্রহ সহকারে এগিয়ে এসেছিল এবং অদ্যাবধি মেয়েরা সাহসের সাথে আসছে। নিজেদেরকে কাজের জন্য সদা-সর্বদা প্রস্তুত রাখছে-এটা আমার জন্য পরম পাওয়া এবং এতে করেই আমি পুরুষের কটু মন্তব্যগুলোকে মিথ্যা বলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে নিন্দুকদের দেখিয়েছি। প্রাথমিক শিক্ষা পরিদফতরে পা দিলেই তখন দেখা যেত। তবে প্রাথমিক শিক্ষাতে আমাদের ঠাঁট ঠমক তো ছিলই। স্টাইলে অফিস চালালে, অন্যদের হিংসে হবেই, নানানজনে উড়ো কথা বলবেই।

সংকটের বিহবল আবর্তকে সহজ করে দেখেছি

ফুলের মধ্যে যেমন সুগন্ধ, বাতাসে পরিচ্ছন্নতা, মানুষের মধ্যে তেমন ভালাবাসা। এগুলো আল্লাহর দান। আমি মন থেকে এ দান পাওয়ার জন্য আকুল ছিলাম বৈ কি! পেয়েও ছিলাম। আমি ধন্য। আজলা ভরে মানুষের ভালবাসা নিয়েছি। সূর্যালোকে স্নান করার মতো উদ্ভাসিত হয়েছি। তখন আমার দেহের বলিরেখা স্পষ্ট দেখেছি। প্রাণের স্পর্শের সাথে সেগুলোকে জুড়ে দিয়েছি।

নিতান্তই কিশোরী এক মেয়ে, চঞ্চল পায়ে ছুটোছুটি করতাম, তার পায়ে বেড়ি পড়ল। খেলাধুলা কেড়ে নেয়া হলো, হাতে তুলে দেয়া হলো রান্নার হাতা, বটি, খুন্তি, নাকে দিল নাকচাবি, আঁচলে চাবির গোছা। বন্ধ ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে স্কুলে যাওয়া-আসার নিকুঁচি হয়ে গেল। অন্য এক জীবনের ঠাসবুনট। তবুও পেলাম যা নিলাম। তার মধ্য দিয়ে কিভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারি … সময় বের করে নিতে হবে; বাধা আসলে পিছু হটে যাব না। লড়াই করে সুন্দর আর প্রয়োজনকে প্রতিষ্ঠা করবো। আসলে কাজে নামলে তখন বুঝতে পারা যায় এ বড় কঠিন যাত্রা-শান্ত মন, ধীরস্থির অভ্যাসগুলো স্বভাবে পরিণত করা চাই, বাইরে যত মহাসংকট দেখি না কেন, ঐ গুলোকে সহজভাবে নিতে হয়। আমি ঠেকে ঠেকে এগুলো শিখেছি।

আমার কর্মজীবনের শুরুটা ছিল কী! এক অনভিজ্ঞ পড়ুয়া মেয়ের ঘাড়ে ঝুপ করে একটি লুপ্তপ্রায় স্কুলকে গড়ে তোলার বোঝা ঠেলে দেয়া। মহাসংকট, তা নিতে হলো। স্থানীয় মানুষের দাবি আমি মাথা পেতে নিলাম। নিজের দায়িত্বের ছক কেটে নিজকেই নিতে হয়; পর্দানশীল কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মুসলিম পরিবারের মেয়েদের যে করে হোক স্কুলে আনবো। তারা যেন স্কুল ছেড়ে চলে না যায় তার দিকে খেয়াল রাখবো; কিন্তু এতসব সংকট প্লান অনুসারে করলেও অন্য বিষয়ের প্রতিও মনোযোগ দিয়েছি, নিজের বি, এ পাস এবং স্থানীয়ভাবে

নিজের ইচ্ছায় যারা ঐ স্কুলে পড়াতে এসেছিলেন, তাদের ম্যাট্রিক পাস, এ দুটো বিষয়ে নিরলস সাধনা আমাকে তখন দিতে হয়েছিল। সুখের কথা আমাদের ভাগ্য প্রসন্ন ছিল। আমরা শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করলাম। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। দেশে একটা স্কুল হোক, মেয়েরা স্কুলে আসুক— এটি তখন চাইতো না— এমন লোক কিছু ছিল, তারাই শত্রু।

স্কুলটি সরকারী, আমিও সরকারী কর্মচারী। কিন্তু শিক্ষকতাকে কি কখনও পেশার মধ্যে সীমিত রাখতে পেরেছি? মেয়েদের ভালবাসা, শ্রদ্ধা নিবেদন এবং স্থানীয় লোকজনের অকুত প্রশংসার নিরিখে আমি একজন নিবেদিত সমাজসেবী। নোয়াখালীর স্কুল ছেড়ে আসার সময়। অনুভব করি, এরা আমায় অনেক ভালবাসে। তবুও চলে আসি, এখানে আমার কাজ অন্যের হাতে তুলে দিলাম। বড় জায়গায় বেশি কাজ করার সুযোগ নেয়ার জন্য আমি যাচ্ছি। কাজেই অভিজ্ঞতা, কাজেই আনন্দ। আমি সেরকম অনুভব করতাম বহু ছাত্রী, অভিভাবকের মধ্যে না গেলে নিজের শিক্ষা অপূর্ণ থাকতে পারে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সামান্য শিক্ষকতার চাকরি, বিশাল একটা পরিবার। মাথায় নিয়ে অবিচল চিত্ত আমার। শুধু মনে যা… সংকট যত বড় হোক তা সহজভাবে নিতে হবে আমাকে। অর্ধাহারে থাকতে হয়েছে, স্বামী রাগ করে বার বার গ্রামে চলে যেতেন, আবার আসতেন। চাল, ডাল, আলু ইত্যাদির বস্তা, নিজের ভাগের অংশ বাড়ি থেকে উসুল করতেন। ডাঃ খাস্তগীর স্কুলের জন্য ছাত্রী সংগ্রহ করতে হয়নি, একটি ঐতিহ্যবাহী লব্ধপ্রতিষ্ঠ স্কুল। এখানকার হিন্দু শিক্ষিকারাও কলকাতা চলে যাননি দেশ বিভক্ত হওয়ার পর। ব্যবসায়ী শ্রেণীর ধনী কন্যারা এখানে পড়ে। কিন্তু আমার ভাগ্যে কর্মযোগ। ইংরেজি পড়াও, অংক করাও, ভূগোল পড়াও … কোন্‌ ক্লাসের? ক্লাস টেনের দায়িত্ব এসে যায় কিভাবে বুঝলাম না। কী আশ্চর্য! পুরোনো দিদিদের কাছে পড়বে না মেয়েরা, রওশন আপাকে চায়। লতিফা খাতুন প্রধান শিক্ষিকা, বিরক্ত হন। নতুন পাস করা এ পড়াবে কি? তবুও তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। মেয়েদের আগ্রহ ছিল অত্যধিক। ওদের আমি খেয়ে না খেয়ে পড়িয়েছি, ওরা আমাকে দিয়েছে ভালবাসা। পরীক্ষায় উত্তম ফল করেছিল প্রত্যেকে। স্কুল সেবার নাম পেয়ে যায়। অতঃপর ঢাকার মতিঝিলে; জীবনের মধ্যাহ্ন। প্রাণপাত শ্রম, যত্ন আর নিষ্ঠা, কোনোটার কমতি ছিল না। এখানে এসে নিজে পাস করলাম এম. এ। অন্য যারা।

পড়তে চেয়েছিল (তিনজন), ওদেরকে উৎসাহ দিলাম। আমি তোমাদের কাছে আছি। তোমাদের ক্লাসগুলো আমিই নেব। স্কুলের কাজে ক্ষতি আমি হতে দেব না। তোমাদের উচ্চতর ডিগ্রির জ্ঞান। কাদের জন্য? এই ছাত্রীদের জন্যই তো? তোমরা মনোযোগ দিয়ে পড়ো। আমরা একে অন্যের জন্য না ভাবলে কেউ বাইরের থেকে এসে আমাদের জন্য ভাববে না।

কর্মযোগ কপালে প্রশস্ত এরিয়া যে বন্টন করে রেখেছিল, জানতাম না। ঘটনাস্রোত আমাকে দেশের শিক্ষার কেন্দ্রস্থল শিক্ষাভবনে ঠেলে তুলে দিয়েছে। কিছু কিছু ভাল কাজ করার মন আমাকে এখানেও উদ্বুদ্ধ করেছিল। অবস্থার চাপে পড়ে দেখতাম কেউ কেরানির কাজ করছে, নাইটে কোথাও ক্লাস করে। এদিকে অফিসে ওভারটাইম করে। অনেকেই এলাউন্স তুলতে পারে না। আমি হলাম এ. ডি. জেনারেল। নিজের পড়ালেখার স্পৃহা অন্যের মধ্যে দেখলে চুপ থাকতে পারি না। তাদের ছুটি মঞ্জুর করতে দরাজ দিল হয়েছি। তো উপরওয়ালার হাতে লাঞ্ছিত হয়েছি। তবুও এ কাজে সহায়তা করতে ছাড়িনি। দুজন বি. এ পাস করলে ওদের রিসার্চ পদে বসিয়ে গভীর তৃপ্তি পেলাম। অন্যকে লেখাপড়ার কাজে উৎসাহ দেয়া এবং সহায়তা দান করার কাজ আমি আপনা থেকেই করতাম। মুক, নিরীহ, দরিদ্র কর্মচারী যারা অবস্থার চাপে আত্মমর্যদায় আসতে পারছিল না, তাদের জন্য আমি। সহানুভূতিশীল ছিলাম। নিজের অজান্তে এই ভাল মানুষগুলো আমাকে কত যে ভালবাসে টের পেলাম। আমার ফেয়ার ওয়েল মিটিঙে একজনের পর একজন অশ্রুসজল চোখে বলে যাচ্ছিল, ছি! কি লজ্জাই করছিল আমার ডায়াসে বসে। সাথে ডি. জি, UNESCO Advisor। এবং অন্য সম্মানিত ব্যক্তিরা। মনে মনে বলি, এসবে বলার কী আছে, ওদের মধ্যে গুণ ছিল, পরিশ্রম করতে পেরেছে, আমি ওদের বেঁচে থাকার পথে সম্মানবোধকে উৎসাহ করলাম … এই তো। নিজ দায়িত্বের বাইরে কিছু করিনি। অফিসারদের থেকে এরকম ব্যবহার তারা কখনও পাবে, আশা করতে পারেনি। তাই তারা আবেগ ভালবাসায় ঐ সব কথা বলেছিল। কিন্তু অফিস চত্বরে এসব মানবিক গুণাবলীর প্রকল্প দেখতেও নেই; দেখাতেও নেই। বিপদ উভয় দিকে ঘটে। তবুও মানুষ ভুল করে, ভালবাসার কথা বলে সম্ভবত নিজের দায়ভার লাঘব করে। কৃতজ্ঞ থাকার ব্যাপারও কারও মধ্যে আছে, এরাই শেষের দলে।

আমার একটা স্বভাব, কেমন করে কখন অন্যের সাথে মিশে যেতে পারি। আসলে মানুষ তো একই জাতি। সমাজে, অফিসে উচ্চ-নিচ ভাগ আছে বলে পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকি, থাকতে হয়। কিন্তু এ থাকার মধ্যে ছায়া কষ্ট অনুভব করি। অফিস করতে এলাম, কাজ, হাঁকডাক নিজের রিভলবিং চেয়ারে টান টান বসে থেকে। জুতোর শব্দ করে কখনও টহল দেয়া সেরে অতঃপর পদমর্যদা অনুযায়ী গাড়ি হাঁকিয়ে বাড়ি এলাম। এসব দেখে দেখে ক্লান্ত। এক দুর্বুদ্ধি এল মাথায়। সংস্থাপন বিভাগের ব্যবস্থাপনা শাখাতে মিঃ এস. কে দাশসহ আমরা কো-অর্ডিনেশন মিটিঙ করতাম। মাসে একদিন সকালে অফিসে এসে সবাই এক জায়গায় মিলিত হতাম। হাস্য-কৌতুকসহ: চা-নাস্তা। নিজেদেরই আয়োজন। পালাক্রমে এক এক জন এর দায়িত্ব নিতাম। আমার খেয়াল হল এমনটি এখানে করি না কেন? এখানে যে এমন সহৃদয় ব্যবস্থার আয়োজন থাকার দরকার-এ হচ্ছে শিক্ষার জায়গা। আমরা সবাই শিক্ষক, দেশের শিক্ষার সুবন্দোবস্ত করার কাজ করতে এখানে চাকরি নিয়ে এলাম। হাঃ হতোস্মি ! এসব সুন্দর কাজ এখানে টিকবে? আমারই ভুল! কিছুকাল চালিয়ে বন্ধ করে দিতে হলো। আড্ডাবাজি করছি আমরা। ছি! আড্ডা থেকে কত কঠিন সমস্যা আমরা সমাধান করার সহজ পথ খুঁজে পেতাম-তা বোধ হয় কেউ চায় না। সমস্যা থাকুক, তোমরাও থাক। সমস্যাও নেই, তোমরাও নেই,’ সোজা কথা কে না বোঝে। আর বেশি বেশি কাজ দেখানোর জায়গা এটা নয় । হুকুম আসবে, তামিল করে যাব ব্যস, অনাহূত শত্রু বাড়িয়ে নিজের ভাত কাককে খাওয়ানো তো নিজে খাব কি? একি স্কুল ছাত্রীদের নিয়ে কাজ-কর্ম করার পরিবেশ! এ হচ্ছে প্রশাসন ঘাটি। অতঃপর আমি সাবধান হই। আমার স্কুল থেকে আসা জীবন আর। কর্মক্ষেত্র নিয়ে অন্যে তামাশা করবে, খুবই রাগ হয়, কষ্ট হয়।

একসময় এলো আমি স্বভাব চেপে সবার মত হতে চেষ্ট করি। অফিসের চাহিদার মত নিজেকে ঢেলে সাজাই। আমার যে হাত-পা বাঁধা, চাকরি রাখা চাই। প্রবোধ মানি এই বলে, এই সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সেরা জীব, সেই কিন্তু নিজের ইচ্ছায় চলতে পারে না। তাহলেই হোঁচট খাবে। জ্বলন্ত প্রমাণ আমার ঘরেই রয়েছে। স্বামীর কর্মজীবনের প্রত্যেকটি ঘটনা খুঁটে দেখলে আরও পরিষ্কার হয়— মন শান্ত রাখতে পারলেন না, মাথা গরম করেন, প্রতিবাদ করেন, কেউ তা শুনলো না। উল্টো তাকেই সরে আসতে হলো। আমি তার মতো হলাম না, নিজেকে বিসর্জন দিলাম। এ সংসারের হাল আমার ঘাড়ে, কাৎ হলে কে টেনে সোজা করবে? মেয়েরা সংসারের কর্তা হতে পারে না, কিন্তু দায় একবার কাঁধে নিলে তাকে শেষ পর্যন্ত দেখে তবে ছাড়ে। আমারও তাই। আরও যেতে চাই,আরও দেখতে চাই; এই করে করে অন্যদের মতো আমিও আছি, আমিও থাকলাম এবং রইলাম। চাকরি গেলে যাবো কোথায়? গ্রামের বাড়িতেও যে একখানা চালা নেই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাঞ্জাবি সৈন্যরা পুড়িয়ে ছারখার করে রেখে গিয়েছে। কর্নেল জাফর ইমাম পাঞ্জাব রেজিমেন্টে ছিল। অতঃপর মুক্তিযোদ্ধা, প্রাণপণ যুদ্ধ করেছে পাক সৈন্যের বিরুদ্ধে। গর্ব করি কিন্তু ঘরদোর তো নেই… কোথায় গিয়ে উঠবো। ঢাকায় বাড়ি করার কথা তখনও ভাবতে পারছিলাম না। ছেলেরা রোজগারের পথ ধরেছে সবেমাত্র,আমাকে চাকরির শেষ টানতে হবেই।

মানুষের মন যা চায় তার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে ক্ষতি আসবেই; টের পেলাম মেডিক্যাল চেক আপ করাবার সময়,বার্ষিক প্রতিবেদন লেখার সময়। রক্তে উচ্চচাপ ধরা পড়ে। ডাক্তার উপদেশ দিলেন প্রেসার কমিয়ে নর্মাল করে আসেন। যা আছে এ লিখলে চাকরি থাকবে না। মন খারাপ করে কয়েকজনকে বললাম কিন্তু শুনতে হল সেই একই বক্তব্য… ও আমারও এই অবস্থা… চিন্তার কিছু নয়, ডাক্তার যা বলেছে তা করেন, সকলেই তা করে। ডায়াবেটিস নেই তো! তাহলে আপনার স্বাস্থ্য ভাল দেখায়ও সে রকম। কেউ বলবে না আপনি পঞ্চাশ পেরিয়েছেন।এই চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। আসলে এসব সাহস যোগানোর কথা, মেয়ে অফিসারদের তোষামোদির কথাও হতে পারে। কিন্তু তোষামোদ আর তদবির এ দুটো কাজ আমি করতেও পারিনি,কেউ করলে সহ্য করতেও পারতাম না। মনে হতো, এসব ফুঁটো নৌকা,পাল তুলে কিছু দূর যাওয়া যাবে। তারপর ভরাডুবি। আমি আন্তরিকতার সাথে চলাকে পছন্দ করতাম। সেজন্য সহকর্মীদের থেকে সবরকম ব্যবহার পেতে চেয়েছি। কিন্তু এদের সংখ্যা এত কম যে,আমার কাজের ভার বেশি ছিল, নিজকে করে যেতে হয়েছে।

চাকরি গেলে যাবো কোথায়? গ্রামের বাড়িতেও যে একখানা চালা নেই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাঞ্জাবি সৈন্যরা পুড়িয়ে ছারখার করে রেখে গিয়েছে। কর্নেল জাফর ইমাম পাঞ্জাব রেজিমেন্টে ছিল। অতঃপর মুক্তিযোদ্ধা, প্রাণপণ যুদ্ধ করেছে পাক সৈন্যের বিরুদ্ধে। গর্ব করি কিন্তু ঘরদোর তো নেই… কোথায় গিয়ে উঠবো। ঢাকায় বাড়ি করার কথা তখনও ভাবতে পারছিলাম না। ছেলেরা রোজগারের পথ ধরেছে সবেমাত্র,আমাকে চাকরির শেষ টানতে হবেই।

শিক্ষা বিস্তারের জন্য কী করতে পেরেছি— এ প্রশ্ন নিজকে বহুবার করেছি। সরকারের নীতিমালা এবং নিয়ম-কানুন মেনে কাজ করলাম এই পর্যন্ত। তবুও মনের তাগিদে ছুটাছুটি করতাম বৈকি! যেমন একবার মহিলা শিক্ষিকা পাওয়া যায় না বলে এক উপজেলায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ মহিলা না নিয়ে মাত্র দু’ভাগ নিয়োগ দেয়া হলো।মেয়েরা নালিশ নিয়ে এল আমার কাছে— ওরা পরীক্ষা ভাল দিয়েছে, ইচ্ছা করে ওদের বাদ দিয়েছে। আমি কত হয়রানি হলাম, এই নালিশ তদন্ত করা এবং ওদের নিয়োগ নিয়ে। এই মেয়েদের সবদিক থেকে চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা ছিল; অথচ পেল না। ঘুষ দেয়া-নেয়া করার কাজটি সময়মত করতে পারেনি। স্যাকরার দোকানে গলার চেইন বিক্রি করেও এক মেয়ে সময়মতো টাকা যোগাড় করতে পারেনি। কিন্তু সত্য বলতে পারলাম না। শুধু কিছু একটা জানলাম।

কেন এমন করলাম? কেউ কি সত্য বলতে পারবে না? এটাই নিয়ম!নিয়ম নয়! ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়া। একটা কেস নিয়ে এত ছুটলে অন্যগুলোর সময় দিতে পারা যায় না। কথা সত্য বটে, ঐ মেয়েরা সোনার চেইন বিক্রি করতে গিয়ে কি অন্যায় করেনি?ঘুষ যে দিতে যায়, সেও দোষী। ইচ্ছা হয় তারা কোর্টে যাক। তবুও কি এই লড়াকু মন আমার প্রবোধ পেয়েছিল? না ঐ মেয়েদের ডেকে পাঠালাম, তোমরা যদি চাকরি পাওয়ার ইন্টারভিউতে টিকে থাক, তা হলে ভয় কী! কোর্টে কেস দাও, আমি তোমাদের লড়াইতে নামিয়ে আশীর্বাদ দিলাম— নাও একশ টাকা । জিতলে ফেরত দিও। কারণ আমিও ছা পোষা মানুষ। মেয়েগুলোর জিদ ছিল, ওরা আমার উৎসাহ পেয়ে ঠিক কাজটি করে চাকরি পায়। আমার একশ টাকা ফেরত দিল। সাথে এনেছিল মিষ্টি, অফিসে আমরা মিষ্টিমুখ করলাম।

এই কেসটির মতো হাজারটা ছিল। কিন্তু এটি মনে থাকার কারণটাই চমৎকার। ইউ.এন. ও (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) মানুষটি পুরুষ দরদী ছিলেন, একজন মেয়ে চাকরি পেলে তেলা মাথায় তেল দেয়া, স্বামীও চাকুরে, স্ত্রীরও চাকরি হলো। আর একজন পুরুষ চাকরি পেলে একটা সংসার খেয়ে পরে বাঁচবে। তার মানসিকতা এই ছিল এবং তিনি মেয়েদের যোগ্যতাকে ধামাচাপা দিয়ে দিব্বি নিজের গোঁফে তা দিলেন। এ ধরনের অন্য একটি কেস আমার কাছে আসে মুরাদনগর থেকে। কুমিল্লায় মেয়ে শিক্ষার অভাব? হতেই পারে না। ঐ মেয়েরা হয়রানির শিকার হয়েও থেমে থাকেনি। চাকরি নিয়ে তবে ছেড়েছে। আমি এসব মেয়েদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। ওরা বলে আপা, আপনার জন্য আমরা পেরেছি, আপনি এখানে আছেন, সাহস দিয়েছেন, আমরা জিতবো এই বিশ্বাস আপনার সগ্রামী মন থেকে অর্জন করেছি। এই মেয়েরা আনন্দে কেঁদে দিয়েছিল। আমার চেয়ে তোমরাই সগ্রামী মেয়ে— আমি মেয়েদের মাথা তুলে দাঁড়াতে যারা চায় তাদের জন্য আছি— এই মাত্র।

ঘরে ফিরে এসে অফিসের গল্প কখনও করবার সময় পেতাম না। সারাদিনের অনুপস্থিত গৃহিণী। সেই খেসারত দিতে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছি। তবুও স্বামীর শরীর ও মন ভাল থাকলে এই কথা তাকে বলতাম, ভাগ্যিস আমি আগে থেকে চাকরি করছি। কোটা সিস্টেমের বড় ঝামেলা। তুমি চাকরি করছো আর বাড়ির খরচা আমি যোগান দিচ্ছি; একথা কাউকে বলতে পারতাম বলো? তার সেই পূর্বের রসিকতা ‘আল্লাহ তোমাকে ছেলে বানিয়ে পাঠালে ঠিক ছিল। কেস করতে হতো না। সংসারে কত কাজই তো আছে; সামাজিকতার অনুষ্ঠান, ছেলেমেয়েদের চাকরি, বিয়ে করানো এসবে তার মাথাব্যথা ছিল না । আমাকে প্রচণ্ড বিশ্বাস করতেন, সংসার তোমার। কর্তার ইচ্ছায় আর আমি নেই, কত্রীর ইচ্ছায় কীর্তন। সবটাতেই সায়। আমি রেগে বলি; শেষে ঝগড়া করবে না তো? ঐ স্বভাব গুটিয়ে নিলে ভাল। অতঃপর আনন্দ; লেখাপড়াময় মোমের আলো ঘিরে থাকা আমার সন্ধ্যেবেলা রাত কেটে কখন ভোর হল? জানি না তো।

(ক্রমশ)

আমার এক নদীর জীবন (ষষ্ঠ পর্ব)

আমার এক নদীর জীবন (পঞ্চম পর্ব)

https://protipokkho.com/%e0%a6%86%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%b0-%e0%a6%8f%e0%a6%95-%e0%a6%a8%e0%a6%a6%e0%a7%80%e0%a6%b0-%e0%a6%9c%e0%a7%80%e0%a6%ac%e0%a6%a8-%e0%a6%aa%e0%a6%9e%e0%a7%8d%e0%a6%9a%e0%a6%ae-%e0%a6%aa%e0%a6%b0/

আমার এক নদীর জীবন (চতুর্থ পর্ব)

আমার এক নদীর জীবন (তৃতীয় পর্ব)

আমার এক নদীর জীবন (দ্বিতীয় পর্ব)

আমার এক নদীর জীবন (প্রথম পর্ব)

রওশন সালেহা

রওশন সালেহার জন্ম নোয়াখালী, ১৯২৯ সালী ১ জুলাই। বাবা ছিলেন আইনজীবী। কলকাতায় ম্যাট্রিক ও আইএ পড়েছেন। সাতচল্লিশে দেশভাগের পরে বিএ পড়বার সময় দেশে ফিরে এসে শিক্ষকতা শুরু করেন। বৈরুতে আমেরিকান ইউনির্ভাসিটি থেকে শিক্ষা প্রশাসন (UNESCO), দিল্লী এবং ব্যাংকক থেকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে প্রশিক্ষন নিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের জনশিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকা থেকে ডিডিপিআই পদমর্যাদায় অবসর নেন। তাঁর প্রবল সাহিত্য অনুরাগের জন্য তিনি তাঁর সমকালীন বাংলাদেশের প্রধান প্রধান অনেক কবি সাহিত্যিকদের প্রায় সকলের সঙ্গেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর ‘আমার এক নদীর জীবন’ প্রকাশিত হবার পর আত্মজৈবনিক সাহিত্য তিনি শক্ত স্থান দখল করে নেন। ‘ফিরে এসো খামার কন্যা’ উপন্যাসের জন্য তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে পরিচিত।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top