।। শেখ সাদ্দাম হোসাইন ।।
ভাব খয়রাতি রেড আর্মি চয়ার শুনেছে। রাশান আর্মিদের দলগত সেসব মিউজিক শুনে তার ভেতরে একটা আলোড়ন তৈরি হয়। সে গণসংগীত, রণসঙ্গীত শুনেছে। সে নির্জনে বসে ‘ওঁ’ ধ্বনি শুনেছে। সে শুনেছে জিকিরে বইসা ‘আল্লাহু’ ‘আল্লাহু আকবর’।
ভাব খয়রাতি
এক
ভোরের নরম রইদ শেষে ক্রমশ তেজি হয়ে ওঠা রাঙা সকালের দিকে সবুজ লকলকে পাতাগুলি নতুন বউটির মতো একমুঠো কাচের চুড়ির কচকচানি শব্দ তুলে বাতাস দিচ্ছিল। রমনা পার্কের পুকুর ধারের একটা বেঞ্চিতে এক্সারসাইজ শেষে হাত-পা ছড়িয়ে বসে ছিলাম আমি তখন। মাথাটা পেছন দিকে এলিয়ে দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম পাতার ফাঁকেফাঁকে জোনাকির মতো জ্বলতে থাকা অস্থিতিশীল আলোর দিকে। আমার মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বৃষ্টির জলের মতো ফোটা ফোটা সূর্যের আলো।
একবার মনে হয়, আমার তো নয় খালের পারে ভাসতে থাকা একটা বাঁশপাতার জীবন, আমার হইলো মানব জীবন। ঝরে পড়া বাঁশ পাতাদের গোনার জীবন। (দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া মানুষ গুনতে শিখেছে; তাই আজ সে জানে দুনিয়াতে রয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন মুরগি!)
“দিনের পর দিন জানালা দিয়া তাকায়া থাকার পর একদিন আমি চোখ বন্ধ করলাম। আর তো আমি চোখ খুলি না। সবাই মানে আমার পরিচিত জনেরা আমারে বলে, বাবা চোখ খোলো, দেখো কতো বড় দুনিয়া। আমি বলি, চোখ খুলতে পারি কিন্তু একটা শর্ত আছে। সবাই জিগায়, কী শর্ত? বলি, “আমিও একটা রিয়ালিটি দেখাইতে চাই। সবাই চোখ বন্ধ করেন।” চোখ বন্ধ করে সবাই। আমি চোখ খুলে বলতে শুরু করি:
চোখ বন্ধ করেন, সবাই। দেখুন একটি রড এগিয়ে আসছে, আপনাদের চোখ বরাবর এবং এই রডটির রঙ সবুজ। আপনারা রডটির ভেতর প্রবেশ করুন, একটা তজবীহ’র মতো এবং ধীরে মিলিয়ে যান গ্যালাক্সিতে, একটা সাপের মতো। গ্যালাক্সিতে আপনি ভেসে বেড়াচ্ছেন।
আপনি এখন যে গ্যালাক্সিতে আছেন, এখানে আপনি মরবেন না। আমরণ আপনি সজাগ থাকতে পারবেন। কী করবেন এখন?
চলেন, একটা রাইড দিয়া আসি।
কই যাবেন?
চলেন, যাই কোন একটা, নক্ষত্রে।
আচ্ছা।
আপনার আব্বা-আম্মা আছে?
জী, আছে।
তো কতদিন পরে ব্যাক করবো আমরা?
ও, আমরা তো আর হিসাব রাখি না, সময়ের।
চলেন যাই।
আপনি কি পৃথিবীর কোথাও, কেও নাক ডাকতেছে এমন শুনতে পাইতেছেন? বা, ওযু করতেছে এমন কিছু?
হ্যাঁ, পাচ্ছি।
কীভাবে?
কারণ, অইটাই রিয়ালিটি।
আপনার নাম কী?
আমি এক্সিস্ট করি না।”
অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখি গতকাল রাতে। এক্সারসাইজ করার পরেও ঘোরটা লেগে আছে যেন এখনো। ভাবলাম ঘোর কাটাইতে নেহারি দিয়া পরোটা খাই!
পার্ক থেকে বেরিয়ে নেহারি দিয়ে গরম গরম ২টা পরোটা খেয়ে গিয়ে বসি রমিজ মামার দোকানে। টঙ দোকান; চা-পান-বিড়ি বিক্রি হয়। ইদানিং ছোট ছোট বিভিন্ন বিষয় আমাকে এতো আরাম আর শান্তি দেয় যে বাঁইচা থাকার ঘটনাটা আর বাজে একটা অভিজ্ঞতার মধ্যেই আটকে রাখা যাচ্ছে না! সকাল সকাল গোসলটা শেষ করে, গায়ে সরিষার তেল মেখে রোদে দাঁড়ানোর যে শান্তি তা উপভোগ করতে আমার কেন জীবনের ৩৬ টি বছর কেটে গেল কে জানে! সকালের নাস্তা শেষ করে টং দোকানে বসে একটা রঙ চায়ে চুমুক দিতে দিতে সিগারেট টানার শান্তি উপলব্ধি করতে কেন আমার দীর্ঘ একটা জীবন কেটে গেলো কে জানে! আমার দু চোখ ভরা ছিল বড় বড় শান্তির প্রজেক্ট। যেমন: বিশাল একটা বাঙলো বাড়ি করবো, বাড়ি ভরা গাছ থাকবে, পাখি থাকবে। সে বাড়িটা থেকে দেখা যাবে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত; আরো দেখা যাবে নদী। বাড়ি ভর্তি শিশু আর নারীরা হাসবে, খেলবে, ফুলের মতো ফুটে থাকবে, সুবাস ছড়াবে…! এরকম বিভিন্ন শান্তির প্রজেক্টে আমি ডুবে থাকতাম। কীভাবে এসমস্ত শান্তির প্রজেক্টে ঢুইকা পড়ছিলাম বলতে পারি না, আর কীভাবে বাইর হইয়া আসছি তাও বলতে পারি না। খালি বলতে পারি আজকাল শান্তিটা অনুভব করা যাচ্ছে।
রমিজ মামার টং দোকানে আরো বইসা আছেন একজন রিক্সাওয়ালা যিনি দোকানের পাশেই রিক্সাটা রাইখা চায়ে পাউরুটি ভিজায়া খাইতেছেন। আমার পাশে বইসা আছেন একজন প্রায় বৃদ্ধ চাকরিজীবী আর আমার সামনাসামনি বইসা আছেন ধূলা জমা দাড়িচুলে ভরা লুঙ্গি আর সাদা কিন্তু ময়লা পাঞ্জাবী পরা এক ব্যক্তি। তিনি গল্প করতেছেন দোকানদার মামার লগে। মামা তারে জিগাইলেন, আপনে এতো বিড়ি খান কেন? তিনি বললেন, গল্পটা বলি তাইলে! গেছিলাম এক বিড়ি বাবার কাছে! তারে গিয়া জিগাইলাম, বাবা এতো বিড়ি খান কেন আপনে? তিনি চোখ খুললেন না। না খুইলাই উত্তর দিলেন, বিড়ি খাইলে দুই কান্ধে ফেরেশতা বহে না তো! এল্লাইগা অরা আমার পাপের হিসাবও লেখতে পারে না! ওরা যাতে আমার পাপের হিসাব না লেখতে পারে সেজন্যেই চব্বিশ ঘণ্টা বিড়ি ফুঁকতে থাকি রে বাজান! হে হে!
আমরা যারা বইসা আছি সবাই হাসলাম। আমি হিউমার বুঝলাম লোকটার কিন্তু প্রায় বৃদ্ধ চাকরিজীবী জিগাইলেন, এর জন্যে আপনেও বিড়ি খান বুঝি? তিনি বললেন, এক আল্লাহ্ ছাড়া নিজেরে সহ কারো জন্যে কিছু আমি করি না। বউ-পোলাপানের জন্যে চাকরিও না! বইলা সে হাসে। চাকরিজীবী জিগায়, “নিজের জন্যে খান না?”
“না খাইয়া আত্মহত্যা করুম নাকি? আত্মহত্যা মহাপাপ! আল্লার জন্যে খাই! তো পাপ করলে শাস্তি হইবো কার? আমার। তাইলে শাস্তির ভয়ে যদি খাই তবে তো নিজের জন্যেই খাইলাম! উঁহু! খিদা লাগলে খাবো এই নীতিতে চলি না বাপু। খিদা লাগলেই খাওন আমার সামনে থাকবো বা আমি খাইতে পারুম তার কোন গ্যারান্টি আছে? তাইলে আমি খিদা লাগলে খামু এরকম একটা বদ চর্চায় নিজেরে জড়ামু ক্যান কন তো? আমি কী জানি না তার কষ্ট?”
লোকটারে ভাবের লোক মনে হইলো আমার। ফলে ভাব খয়রাতের উদ্দেশ্যে আমি একটু একটু করে তার ফোকাসে আসার আয়োজন করতে লাগলাম।
ভার্সিটি শেষ করার পর প্রথম যে সিভি বানাইছিলাম আমি সেটা আমার অতি প্রিয় একজন প্রফেসরকে দেখাইছিলাম পরে তিনি বলছিলেন, যারা তোমার ইন্টার্ভিউ নেবে তাদেরকে একটু পাত্তা টাত্তা দিও! টোনটা আরেকটু ডাউন করো। তারাও তো কিছু জেনেশুনে থাকবেন! এর আগে নানার সাথে আলাপ করতে গিয়ে আমি বলে ফেলছিলাম, আমি তো আল্লারে পাইয়া গেছি! আপনে যেহেতু পান নাই, আপনে খোঁজেন গা! নানা আমারে বলছিল আরেকটু স্লো আগাইতে।
নিজেরে স্লো করতে আমি এই ২ টা ঘটনা সবসময় মনে করি। ভাবের এই লোকের ফোকাসে আসার ক্ষেত্রেও আমি তাই “সবজান্তা সমশের সিন্ড্রোম!” এর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করি এবং নিজের লেখা একটা কবিতার কথা স্মরণ করে স্থির হই।
“রাতারাতি সব বুঝে ফেলো না
দেইখা ফেইলো না সবকিছু এখনি
যদি এই পঁচিশ বছর বয়েসেই
বুইঝা ফেলবা ধর্ম কী, জীবন
কী, দর্শন কী, সংসার কী —
বিপ্লব করবা ক্যামনে? ক্যামনে
বলো লাইনের পর লাইন বকবক
করবা? ক্যামনে নিজের মহত্ত্ব
আর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করবা?
বুইঝাই যদি ফেলবা তুমি সব
বলো চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া
কী আর করতে পারবা তুমি?
তুমি কি পারবা সবকিছু বুইঝা
ফেলার পর টাকার পায়ে মাথা
ঠেকাইতে, পারবা সাম্য অথবা
দ্বীন কায়েমে তাকবীর দিতে?
যদি না তুমি নিস্তব্ধতাকে
জয় করে থাকো তবে কী
করে সবকিছু বুঝে ফেলার
দুঃসাহস করো; কী করে বইবে
তুমি এতো সুদীর্ঘ একটা জীবন?”
ভাবের মানুষ বলতে লাগলেন, এমন কতো মানুষ আসলো, হাগলো, বিয়া করলো বা করলো না, গ্রেট/বিখ্যাত হইলো বা হইলো না, টাকা–ক্ষমতা করলো বা করলো না। এমন কতো কতো মানুষ আসলো, খাইলো, গভীর চিন্তা করলো বা করলো না, বিপ্লব করলো বা করলো না — সুন্দরী বউ হইলো বা হইলো না, ল্যান্ড ক্রুজারে চড়লো বা চড়লো না, আমেরিকা গেলো বা গেলো না!
আমি ঈষৎ হাসি মুখে চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বললাম, হ্যাঁ, কিন্তু এগুলো বলার মাধ্যমে আপনে আসলে কী বলতে চাচ্ছেন?
তিনি আশ্চর্য হলেন এবং আমাকে বললেন, আপনি আমাকে প্রশ্ন করেছেন? প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আমি প্রাসঙ্গিক অন্য একটা আলাপ করে নিতে চাই।
জ্বি, অবশ্যই।
ভক্তি যিনি নেন আর ভক্তি যিনি দেন দুজনের অন্তরে দুজনের প্রতি থাকে ভিন্ন প্রেম। একই প্রেমের অনুভূতি দুইজনের অন্তরে সক্রিয় থাকতে পারেনা। কারণ, একটা হইলো নেয়া থেকে উদ্ভূত প্রেম; আরেকটা হইলো দেয়া থেকে উদ্ভূত প্রেম। ভক্তি যিনি নেন তার মানসিক অবস্থান আর ভক্তি যিনি দেন তার মানসিক অবস্থানে থাকে অনির্দিষ্ট দূরত্ব।
ভক্তি দিয়া যিনি ফানাফিল্লা হইয়া গেলেন তার প্রতি যিনি ভক্তি নিলেন তিনিও যে ফানাফিল্লা হইলেন তা তো না। ভক্ত যখন ভক্তি দেয় তার দিন দুনিয়া জুইড়া থাকে গুরু কিন্তু গুরুর দিন-দুনিয়া জুইড়া কী? আমার মনে হয় তখনই আসলে গুরু-শিষ্য প্রেম হয় যখন তারা একে অন্যের দুনিয়া জুইড়া সমানভাবে বাস করে — সমানভাবে তারা একে অন্যের এটেনশন বা সাবমিশন পায়।
গুরু তো আসলে গায়েবের প্রেমে মইজা থাকেন। গায়েবের লগে প্রেমই আসল প্রেম। গায়েবরে যতখানি প্রেম দিবেন দেখবেন গায়েবও ততখানি প্রেম দিবে আপনেরে, গায়েবেরে যতখানি এটেনশন দিবেন গায়েবও আপনেরে ততখানি এটেনশন দিবে।
গুরুর থাকে গায়েবের লগে প্রেম; শিষ্য তিনি যিনি গায়েবের খোঁজ জানেন না ফলে গুরুর প্রেমে মইজা গায়েবের সন্ধান করেন। শিষ্য যেদিন গায়েবের খোঁজ পেয়ে যান সেদিনই গুরুর লগে তার অপার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আমি মনে করতে চাই আপনি গায়েবের খোঁজ করছেন, ফলে প্রশ্ন করেছেন।
না, না। গায়েবেরই যদি খোঁজ করবো তবে আলাদা করে গায়েবেরই খোঁজ নিতাম। আমি আসলে আপনার ‘করলো বা করলো না’ টাইপের যে আলাপটা হুট করেই করলেন সে আলাপটা কোন জায়গা থেকে কেন করলেন সেটা বুঝতে চাচ্ছিলাম।
আমি কিন্তু বলেছি ‘আমি মনে করতে চাই আপনি গায়েবের খোঁজ করছেন’। কেন আমি ‘গায়েবের খোঁজ’ বিষয়টা সামনে নিয়া আসলাম? তখনই আপনার বুঝবার কথা ছিল আপনার প্রশ্নের উত্তরের সাথে গায়েবের সন্ধান বিষয়টার সম্পর্ক রয়েছে। যদি আপনি গায়েবের সন্ধান না করবেন তবে আমাদের আর প্রশ্ন আর উত্তর পর্বে প্রবেশের কী দরকার! আর যদি আপনি আমার কাছে প্রশ্ন করে বুঝতে চাইবেন তবে আমাকে আপনার ভক্তি দিতে ঠেকবে কেন?
দেখেন, কেন্দ্রে বা আলোচনায় বা প্রাসঙ্গিক থাকার নানান কায়দা আছে তো। কেবল ব্যক্তিগত কারণে যে এই সেন্টারে থাকতে চাওয়ার ঘটনাটা ঘটে তা না; মানুষের স্বার্থে বা পলিটিক্যাল কারণে বা আরো আরো জায়গা থেকে এ ঘটনা ঘটতে পারে।
তা ধরেন, দার্শনিক নীটশের জরথুস্ত্র যে কিনা বনে-জঙ্গলে ঘুইরা শেষে আম জনতার দরবারে ফিরতেছেন; বা, ভগবান অশো বলতেছেন, পাব্লিকের মাঝে থাইকাও নিজেরে হারায়েন না; বা, বুদ্ধ বা রসূলের কথাই বলেন না — উনারা পাব্লিকের দরবারে আইসা হাজির হইছেন তো।
তো প্রাজ্ঞজনদের কথাবার্তা যখন উঠতি জ্ঞান অন্বেষণকারীরা সরলভাবে নিতে থাকেন, হাজির হওয়ার এই ব্যাপারগুলি বুঝেন না তারা। যেমন ধরেন, কোন এক প্রাজ্ঞজন বলতেছেন, ‘ভালো হইতে হবে না, বুঝলা।’ তো উঠতি জ্ঞান সন্ধানী তো টাসকি খাইয়া যায়; আরে! এই লোক তো ডিফ্রেন্ট!
আর কী শুরুতেই যদি উঠতি জ্ঞান সন্ধানীরা প্রাজ্ঞজনদের হাজির হওয়ার টেকনিক আর হাজির হওয়ার মূল উদ্দেশ্য বুইঝা বুইঝা আগাইতে পারে, তবে সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তরটাও মজবুত হইতে পারে।
ঝামেলাটা হয় তখন যখন উঠতি জ্ঞান সন্ধানীরা সম্পর্কের প্রথমে না বুঝে পরে বুঝতে শুরু করে হাজির হওয়ার টেকনিক আর হাজির হওয়ার মূল উদ্দেশ্য তো এক জিনিস না। আর এইটা বুঝতে পেরে ওরা প্রাজ্ঞজনদের ফ্রড, ভুয়া এসব বলতে শুরু করে। টেকনিকের প্রেমে পড়া জ্ঞান সন্ধানীরা টেকনিক রে মেজর কইরা তোলে আর মূল উদ্দেশ্য রে মাইনর কইরা ফেলে।
ধরেন আপনে এলন মাস্ক রে সেন্টার দিতেছেন। কেন দিতেছেন? সে প্রচণ্ড পরিশ্রমী তাই? সে মোস্ট রিচেস্ট পারসন তাই? পরিশ্রম আর টাকা দিয়া যদি আপনে তারে সেন্টার দেন তবে পরিশ্রম এবং টাকা সম্পর্কিত আপনার আইডিয়া চেইঞ্জ হওয়ার সাথে সাথে আপনার সেন্টারও চেইঞ্জ হতে থাকবে। সেন্টার দেয়া এবং সেন্টার থেকে সরায়া ফেলার ব্যাপারগুলা এভাবেই ঘটে।
একারণে অনেকেই যেমন আমি সরাসরি ভক্তি তে ফোকাস কইরা থাকি। মানে আপনার সাথে আমার যোগাযোগের টেকনিকরে সেন্টার না দিয়া বরং আপনে যদি আমারে সেন্টার দিতেই চান তবে আমারে ভক্তি দেন। আপনের ভক্তি পাওয়াই আপনের সামনে আমার হাজির হওয়ার মূল উদ্দেশ্য। আপনার সাথে আমার নানান তরিকায় যোগাযোগ হইতে পারে এবং সেগুলো আপনাকে মুগ্ধ করতে পারে তবে সেগুলোকে গৌণ বিষয়ের জায়গায় স্থান দেয়াটাই উত্তম। অর্থ-অর্থহীনতার বাইরে এই ভক্তি, এই সম্পর্ক। ফলে ভক্তির সম্পর্কে টাসকি লাগাও নাই, মোহভঙ্গ হওয়াও নাই। এই সম্পর্করেই আমি বলতে চাই পরম সম্পর্ক।
আপনি হয়তো ভাবছেন কেবল একটা প্রশ্নই তো জিজ্ঞাসা করেছি। উত্তর দিলে দেন, না দিলে না দেন কিন্তু এতো প্যারা দিচ্ছেন কেন বাপু! যদিও আমি আন্দাজ করতে পারি এভাবে ভাববার পথের লোক আপনি নন। কিন্তু আমি আমার সাথে ঘটমান সকল যোগাযোগ কিভাবে নেই বা দেখি সেটা আপনাকে পরিষ্কার করে নেয়া দরকার বলে মনে করি। ৭ বিলিয়ন মানুষের দুনিয়ায় একটা সময়ে, একটা স্থানে খুবই র্যান্ডম একটা সিলেকশনের ভিতর দিয়া আপনের আর আমার এই যে সাক্ষাৎকার হইলো এইটা তো আমার লাইফের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা। আপনে তো আমার টোটাল লাইফের একটা মোমেন্টের মধ্যে জায়গা কইরা নিছেন। ফলে আপনারে মানে এই মুহূর্তটারে হালকা ভাবে অতিক্রম কইরা যাবার কোন মানে নাই তো।
আমি লোকটাকে আরো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখি। তার শারীরিক অবয়ব, বেশভূষা থেকে যতটা সম্ভব তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। ভাবের মানুষ টানা কথা বলা শেষে ১ গ্লাস পানি খান। এর মাঝে আমি আমার যোগাযোগ ও সম্পর্ক সম্পর্কিত কিছু ভাবনা ভাবের মানুষের লগে শেয়ার করতে চাইলাম।
বললাম, বুঝলেন উস্তাদ, আমি আগে ভাবতাম “স্ট্যান্ডার্ড লাইফ” টাকা দিয়ে বানানো যায়। এখন মনে হয়, যে “স্ট্যান্ডার্ড লাইফ” রে টাকা দিয়ে বানানো যায় ভাবতাম সেটা আসলে অনেকাংশেই কালচারাল বিষয় ও অবশ্যই ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত একটা বিষয়।
দেখলাম যে স্ট্যান্ডার্ড লাইফের অনেক লেয়ার। একটা লেভেলের স্ট্যান্ডার্ড লাইফ এচিভ হইলে, আর আর লেভেলগুলা সামনে উন্মোচিত হইতে থাকে। ফলে স্ট্যান্ডার্ড লাইফ অধরাই থাকতে থাকে।
আর চাহিদা কম রাখার ভিতর দিয়া মানসিক প্রশান্তি খুঁজতে যাওয়াও বেটার স্ট্র্যাটেজি মনে হইলো না। কারণ, চাহিদা কম রাখতে গেলে বারেবারেই মনে করতে হয় আমার এক্সপেক্টেশন তো আসলে কম না, কম মনে করার আফিম খাইতেছি কেবল।
পরে চিন্তা করার যে স্ট্র্যাটেজি নিলাম তা হইলো এমন, আমি আমার নিজের একটা চিন্তার জগত তৈরি করবো যেখানে আমি যারে উপরে উঠাবো সে উপরে উঠবে আর আমি যারে নিচে নামাবো সে নিচে নামবে। এই জগতে আমিই কিং! আমি আমার নিজের বানানো ভ্যালু সিস্টেমে ঈমান আনা শুরু করলাম।
এই ভ্যালু সিস্টেমে ইন্টেলিজেন্স, টাকাপয়সারে আমি প্রায়োরিটির লিস্টে ২ নম্বরে নামায়া আনলাম আর একে নিয়া গেলাম “সম্পর্ক” রে।
ইন্টেলিজেন্স আর টাকাপয়সারে আমি দেখলাম সারভাইবাল টুল হিসেবে; আল্টিমেট গোল হিসেবে এগুলিরে জায়গা দিলাম না। আল্টিমেট গোল হিসেবে জায়গা দিলাম সম্পর্ক নির্মাণ বা আপনার বয়ানে পরম সম্পর্ক রে যা আমি আমার ভ্যালু সিস্টেম দিয়া বানাইতেছি।
“বাহ!” বলে দোকানে বিল পরিশোধ করে ভাবের মানুষ চলে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। আমি তাকে বলি যদি তার অসস্মতি না থাকে তো আমি তার সাথে যতক্ষণ ইচ্ছা ঘুরে বেড়াতে চাই। তিনি চোখ দিয়ে সম্মতি জানাইলেন।
আমাদের যাত্রা শুরু হলো। আমি জানিনা কোথায়, কোন দিকে এই যাত্রা; ভাবের মানুষ জানেন কি? নো আইডিয়া। আর জীবনের যেহেতু কোন চূড়ান্ত বাস্তবতা নাই তাই চূড়ান্ত বা নির্দিষ্ট দিক সম্পর্কে জেনে সেদিকে যাত্রার কথাই বা আসছে কেন! ফানি!
ভাবের মানুষের লগে হঠাত করেই আমার এই যাত্রারম্ভে অনেকেই বিলা খাইতেছেন আমার ধারণা। তারা মনে করতেছেন, গল্পের চরিত্রগুলোকে এতো ক্লিশে হইতে হবে কেন? একটা বাউণ্ডুলে চরিত্রই তো পয়দা করতেছেন এই রাইটার — সেই হাজার বছরের পুড়নো সে চরিত্রই যে চরিত্র জ্ঞানী তাই অল্পতে সুখী, মেটেরিয়ালিস্টিক নন। যে চরিত্রের খাওয়া-পরা, বউ-পোলাপান, বাবা-মা সম্পর্কিত খুব একটা তথ্য পাওয়া যায় না। যে চরিত্র যেখানে রাইত, সেখানেই কাইত!
ওয়েট (খাড়ান)! তাহসান খান ও তিশা অভিনিত ‘মন ফড়িং এর গল্প’ নামক একটা নাটক দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কোন বিষয়ে পড়াশোনা করবো! নাটকে তাহসান আর তিশা ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি তে এন্থ্রোপলজি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছিল — ক্যান জানি ব্যাপারটা আমার কাছে খুব জোছ লাগায় পরের বছরই এন্থ্রোপলজিতে ভর্তি হয়ে গেলাম (উইয়ার্ড না?)। ৪ বছরের জায়গায় ৬ বছর এক্সট্রা টাকাপয়সা খরচ করে এন্থ্রো করলাম। এই ৬ বছরে আমি মাথাটাকে সম্পূর্ণ ভাবে তথ্যের জঞ্জালে পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হলাম।
যেহেতু পড়াশোনা করি সেহেতু টাকা কোত্থেকে আসে, কীভাবে আসে তা ভেবে দেখা আমার কাজ নয় এমন একটা এপ্রোচ ধইরা রাখছিলাম। “জ্ঞানার্জনই আমার কাজ” এরূপ একটি অবস্থান থেকে আমি একটা ভিন্ন রিয়ালিটি বানিয়ে নিয়ে সেখানে কাটিয়ে দিলাম ৬ বছর। জ্ঞানার্জনের মধ্যে যে কিভাবে উপযোগিতা উৎপাদন হচ্ছে আর ভোগ হচ্ছে এই বিনিময় সম্পর্কের দিকে আমি পূর্ণ মনোযোগ সহকারে একদিনের জন্যেও সময় দিয়েছি বলে মনে পরেনা। ঘরে যে লাইট টা জ্বলেছে তার আলো ব্যবহার করে হরেক রকমের কাজ করেছি; দৃষ্টি থেকে শুরু করে দর্শন পর্যন্ত ভেবেছি কিন্তু একদিনও লাইটটা জ্বলার প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবিনি। মানে লাইট জ্বলার জন্যে ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহৃত হইতেছে, একটা প্রতিষ্ঠান সেই ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই করতেছে, সেই ইলেক্ট্রিসিটি উৎপাদন হইতেছে, সেই উৎপাদিত বিদ্যুৎ আমরা বিল প্রদানের বিনিময়ে ভোগ করছি, সেই বিলটা প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে, সেখান থেকে কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছে, বেতন পেয়ে কর্মচারীদের সংসার চলছে এই প্রসেসটার কথা বলতেছি।
জ্ঞানার্জনের এরকম একটা ফান্ডামেন্টাল জায়গা আমি এড়ায়া গেছিলাম। পরে ভার্সিটি থিকা বাইর হওয়ার পরে মাথায় জমা হওয়া তথ্যগুলিরে স্ট্রাকচারের মধ্যে নিয়া আসতে চাইলাম। ভারি বিপদে পইড়া গেলাম একাজ করতে গিয়া। এদিকে অর্থনৈতিক দুনিয়ার লগে ডিল না কইরা কোনভাবেই আর থাকা যাইতেছিল না। অর্থনৈতিক দুনিয়ার লগে ডিল করা বলতে আমি কি ধান বুইনা ধান ফলায়া সে ধানের বিনিময়ে মাছ নেয়ার পদ্ধতিতে সারভাইব করবো, নাকি ধান ফলায়া যে বাজার ব্যবস্থা আছে সে বাজার ব্যবস্থায় ধান বিক্রি করে টাকা ক্যাশ করে সে টাকা ব্যবহার করে সারভাইব করবো, নাকি বনে-বাদাড়ে হান্টিং করে, ফলমূল সংগ্রহ করে সারভাইব করবো, নাকি ভিক্ষা করে সারভাইব করবো, নাকি চাকরি করে বা ব্যবসা করে সারভাইব করবো এগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম ও একটা সিদ্ধান্তে পৌছানোর চেষ্টা করলাম।
সিদ্ধান্তে পৌছাইতে গিয়া আমি ক্র্যাক খায়া গেছিলাম। কারণ আমি দেখতেছিলাম যে সিদ্ধান্তের উপর আমার জীবনযাপন জড়ায়া আছে। আমি খুব সচেতন একটা সিদ্ধান্ত নিতে চাইলাম। সচেতন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য স্ট্র্যাটেজি নিলাম। সহজ স্ট্র্যাটেজি — অপশনগুলি একটা একটা করে বাদ দেয়া।
প্রথম অপশনটা ছিল, ধান ফলায়া ধানের বিনিময়ে মাছ নেয়ার পদ্ধতিতে সারভাইব করবো কিনা? ইতিহাসের লোক ইউভাল নোয়াহ হারারি তার ‘স্যাপিয়েন্স’ বই তে কৃষি বিপ্লবকে দেখাইছেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ফ্রড হিসেবে। উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, ধান আর গম রে তো মানুষ ‘ডমিসটিকেট (ঘর-পোষা)’ করে নাই – ধান আর গমই মানুষ রে ঘরের ভিতর আটকাইছে। ধান আর গমের অগণিত কপি উৎপাদিত হওয়ার তালে তালে মানুষের সংখ্যা বাড়ে। ফলে হান্টিং কইরা খাওয়া মানুষেরা ধান আর গমের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে – আজকে ২০০ বছরের ক্যাপিটালিজম ছাড়া কোন অপশন দেখতে না পাওয়া মানুষের মতো তখনও এগ্রিকালচার ছাড়া কোন অপশন দেখতে পায় নাই দীর্ঘ ৭০ হাজার বছর হান্টিং কইরা সারভাইব কইরা আসা মানুষেরা। ফলে মানুষের জীবনযাপনের মান কইমা আসে কারণ কৃষি বিপ্লবের আগে মানুষের আরো ডাইভারসিফাইড ফুড চেইনের সাথে সম্পর্ক ছিল। ফলে তারা আরো বেশি স্ট্রং আর হেলদি ছিল। ধান আর গমের পেছনে যে পরিমাণ পরিশ্রম দিতে হইতো তার তুলনায় কম পরিশ্রম দিয়া মানুষ আরো ভালো জীবনযাপন করতো। আরো বেশি ডাইনামিক ছিল তাদের লাইফস্টাইল। অপশন হিসেবে কৃষি ও বিনিময় সিস্টেম রে সন্তোষজনক মনে হইলো না; বাদ দিলাম।
২য় অপশন ছিল, বর্তমান যে বাজার ব্যবস্থা আছে মানে পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থা এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকে কৃষি করবো কিনা। এক্ষেত্রে কৃষি কতোটা প্রফিটেবল প্রজেক্ট হবে সেটা নিয়ে ভাবতে বসলাম আমি। এশিয়ার মোস্ট রিচেস্ট মানুষদের মধ্যে বেশিরভাগই চীনের লোক আর বেশিরভাগেরই ব্যবসা দেখলাম টেক বাদে ফুড এন্ড বেভারেজ (পানীয়)। নি:সন্দেহে কৃষিকে প্রফিটেবল প্রজেক্ট হিসেবে দাড়া করানো পসিবল বলে মনে হলো। কিন্তু আমার যে অবস্থান ছিল সে অবস্থান থেকে কৃষি শুরু করার প্রতিবন্ধকতা ছিল অনেক। প্রথমত, আমার যে বেড়ে ওঠা তার সাথে কৃষি কাজের সরাসরি কোনো সম্পর্ক ছিল না। ফলে অভিজ্ঞতা ছিল শূন্যের কাছাকাছি। ২য়ত, আমাদের জমি ছিল না। ফলে কৃষি কাজ শুরু করতে হলে একটা বড়সড় এমাউন্ট ইনভেস্টমেন্টের প্রয়োজন ছিল। অভিজ্ঞতা শূন্য একটা প্রজেক্ট হাতে নেয়ার আর সেখানে ইনভেস্ট করার ঝুঁকি ছিল সর্বোচ্চ। তার মধ্যে আমার নিজস্ব কোনো পুঁজি না থাকায় অর্থসংস্থানের সংকট ছিল। যেহেতু আমার কৃষি কাজে পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না তাই কোন সোর্সেরই আমাকে ফান্ডিং করার ক্ষেত্রে নির্ভর করার সুযোগ ছিল না। পরিবারের সম্মতি ছিল না। সবকিছু মিলিয়ে এই অপশন টিও বাদ দেয়া হলো।
৩য় অপশন ছিল, বনে-বাদাড়ে হান্টিং করে, ফলমূল সংগ্রহ করে সারভাইব করবো কিনা। বাপ্রে বাপ এটা বাদ, এটা বাদ! ২০০ বছরের পুঁজিবাদ আর ১৩০০০ বছরের কৃষি আজকে আমাকে এমন চিন্তা করার আগে প্রথমেই ভাবিয়ে নেয় কোথায় থাকবো, কোথায় ঘুমাবো, কী খাবো এসম্পর্কিত অনিশ্চয়তার কথা! ফলে এটাকে অপশন হিসেবে যে তালিকায় রাখার সাহস করেছিলাম এজন্যেও নিজেকে একটা থ্যাংকস দেয়া যেতে পারে! তবে হ্যাঁ, লাইফের কোন একটা টাইমে এই এক্সপেরিমেন্ট টা করে দেখার ইচ্ছা আছে।
৪র্থ অপশন ছিল, ভিক্ষা করে সারভাইব করবো কিনা। প্রথমেই প্রশ্ন জাগলো মনে, উৎপাদনের সাথে কোনো সম্পর্ক না রেখে সারভাইব করা পসিবল? পরে ভাবলাম, আসলে উৎপাদন তো কৃষি বিপ্লব পরবর্তী ধারণা, যে ধারণারই পুঁজিবাদী এক্সটেনশন প্রোডাক্টিভিটি। হান্টিং করে খাওয়া মানুষের উৎপাদন নিয়া ভাবতে হয় নাই। ভিক্ষা কইরা সারভাইব করতে গেলেও উৎপাদনের সাথে সম্পর্ক না রাখলেও চলবে। কীসের বিনিময়ে মানুষ ভিক্ষা দেবে এ প্রশ্ন অবান্তর। কারণ, আমি কোন কিছুর বিনিময়ে ভিক্ষা চাইবো না। আমি হাত পাতবো, দিলে দেন, না দিলে না দেন। আপনার চয়েজ। বেশ সন্তোষজনক আইডিয়া মনে হয়েছিল এইটা। কিন্তু পরিবারের সাথে নেগোশিয়েট করার কোন পথ খুঁজে পেলাম না। ফলে বাদ দিতে হলো। এইটাও লাইফের কোন একটা সময়ে এক্সপেরিয়েন্স করার ইচ্ছা আছে। খুব শীঘ্রই হয়তো এই সিদ্ধান্তটা নিতে পারা যাবে। কিন্তু তখন পসিবল ছিল না।
এভাবে বাদ দিতে দিতে শেষে এসে প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ শিখলাম। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ফ্রিল্যান্সিং করে সারভাইব করতেছি। ফ্রিল্যান্সিং করার মজা হচ্ছে এটা ৮-৫ টা চাকরির মতো না। চাকরি থাকার বা চলে যাওয়ার কিছু নাই। ব্যাপারটা আমাকে স্যুট করলো, পরিবারের সাথেও একভাবে বনিবনা করা গেলো।
বুঝলেন তো, আমি যে চরিত্র নির্মাণ করতেছি এটা আর সব উপন্যাসিক বা গল্পকারদের নির্মিত বাউণ্ডুলে চরিত্রের মতো নয়। খালি চোখে সইরষা ফুল দেখা বা খালি পায়ে হাইট্টা বেড়ানো হাটাবাবাটিই নয় আমার চরিত্র। এবার লন আগে বাড়ি।
শহর থেকে কিছুটা দূরে বিস্তর শূন্য এক মাঠে আমি আর কান্তিলাল সাধু (ভাবের মানুষ) বসে বসে শেষ বিকালের আলো আর বাতাস উপভোগ করি। কান্তিলাল দা গান ধরলেন। গানের ফাঁকে আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বললাম। আলোচনার সামারি করলে বিষয়টা এমন দাঁড়ায়, ‘সব কাচ সূর্যের আলোয় ধরলে আগুন জ্বলে না, তবে আতশ কাচের বেলায় ব্যাতিক্রম। কারণ, যে কাচ আলোর রশ্মি একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টে একত্র করতে পারেনা সে কাচ আগুন জ্বালাতে পারেনা, যে কাজটি আতশ কাচ পারে।’ মানে কান্তিলাল দা বলতে চান, আমরা যদি আমাদের অস্তিত্বকে বিকশিত করতে চাই, আমাদের দেহ-মনে একাগ্রতা প্রয়োজন। নিজেকে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলে সেকাজ কখনোই সম্ভব নয়।
বিষয়টা এমন না যে কান্তিলাল দা’র সাথেই আমার এই ধরণের আলাপ প্রথম বারের মতো হচ্ছে। আমি নিজেই দেহ-মনে একাগ্রতার প্রয়োজনের বিষয়টি বহুবার উপলব্ধি করেছি। ও, হ্যাঁ, এইযে এখানে আমার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা লাগলো (আসলে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে নিজেকে টেনে আনা নয়, কান্তিলাল দা যাতে ওভাররেটেড না হয়ে যান সে দায় থেকেই বলা। ওভাররেটেড এবং আন্ডাররেটেড দুইটা ব্যাপারই তো সমস্যাজনক) এই ‘আমি’ নিয়েও আমাদের মাঝে আলাপ হলো। কান্তিলাল দা একটা ঘটনা বললেন — তার কাছ থেকে মেডিটেশনের একটি টেকনিক (দম ছাড়া ও নেয়াকে অনুসরণ করা) জেনে নিয়ে কোন এক লোক বেশ কিছুদিন মেডিটেশন করেছিলেন। কিছুদিন পর সেই লোক কান্তিলাল দা’র সাথে দেখা করে বললেন, ‘এ তো ভয়াবহ জিনিস। আমি রীতিমত ভয় পেয়ে গেছি। একটা সময় পর তো আমি বুঝতেই পারিনা, আমি আদৌ আছি কি নাই!’ ঘটনাটা শুনে আমরা হাসি বিনিময় করলাম আর কান্তিলাল দা বললেন, ‘নিজের অহম, হিংসা নিজেকে শূন্য হতে দেয় না। আকাশের মতো শূন্য হতে হবে যাতে অগণিত তারা সেখানে জায়গা করে নিতে পারে।’ আমি বললাম, হ্যা, শূন্য হতে হবে, যাতে হাজার মত হাজার পথ সে শূন্যে ভেসে বেড়াতে পারে।
কান্তিলাল দা দীর্ঘ নয় বছর শ্মশানে নির্বাক কাটিয়েছেন — তো আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন ৯ বছরই কথা বললেন না, কেন ৬ বছর বা ১৫ বছর নয়? কী এমন ঘটলো ৯ বছর পর যা আপনাকে কথা বলালো?’ কান্তিলাল দা সরাসরি কোন উত্তর দিলেন না। শেষে আমি বললাম, আচ্ছা, ৯ বছর ধরে তাইলে আপনে আপনার দেহ-মনে একাগ্রতা আনছেন আর একাগ্রতার ফলে যখন আলোর ঝলকানি টের পাইছেন তখন সিদ্ধান্ত নিছেন কথা বলার? কান্তিলাল দা একটু হেসে বললেন, প্রশ্ন করেছেন বুঝতে পেরেছি কিন্তু আপনার ভক্তিটা আমি এখনো টের পাইতে শুরু করি নাই।
আমরা এরপর ভাষার সীমাবদ্ধতা নিয়া আলাপ করলাম। ভাষার সীমাবদ্ধতা নিয়া আলাপ করতে গিয়া কান্তিলাল দা গৌতুম বুদ্ধের সাথে ঘটা একটা ঘটনা শেয়ার করলেন। ঘটনাটা হইলো, ‘বুদ্ধরে এক লোক ক্ষোভে থুথু ছিটিয়ে দিছিলেন। তো বুদ্ধের সহযোগী এতে খুব রুষ্ট হইলেন আর বুদ্ধের কাছে অনুমতি চাইলেন থুথু ছেটানো লোকটারে ধুলাই দেয়ার জন্য। বুদ্ধ তার সহযোগী কে শান্ত হতে বললেন আর বললেন, ভাষায় প্রকাশ করতে পারে নাই যে ক্ষোভ সে ভাষার অনুপস্থিতিতেই এই থুথু। পরেরদিন থুথু দেয়া লোকটি বুদ্ধের কাছে নত-নরম মুখে ফিরে এলেন আর কান্না জুড়ে দিয়ে লুটিয়ে পড়লেন বুদ্ধের পায়ের শিয়রে। এই কান্না ভাষায় প্রকাশ করতে পারে নাই যে ভালোবাসা সে ভাষার অনুপস্থিতিতেই এই কান্না।
আমরা একটা বাঁশের সাঁকো পার হই। পার হয়ে কান্তিলাল দা’র ডেরা দেখতে পাইলাম। কান্তিলাল দা ভাত চড়াইলেন। আমি ঝাড়ু দিয়ে কিছু পাতা একত্র করে এগিয়ে দিলাম। কান্তিলাল দা ২ টা আলু সিদ্ধ দিলেন।
কান্তিলাল দা’কে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, দাদা আপনি কি কোন নির্দিষ্ট লাইফস্টাইলের কথা বলেন?
না। ছেলে-মেয়েরা যেমন খুশি তেমন জীবনযাপন বাছাই কইরা লইতে পারে। আমি কোন নির্দিষ্ট জীবনযাপনরে চূড়ান্ত দাবি কইরা তাদের জীবনযাপনের ইচ্ছারে সীমাবদ্ধ করতে ইচ্ছুক নই।
এইটা আমার অনেকটা লিবারাল পজিশন এবং এইটারে আমি সমস্যাজনক মনে করিনা। কিন্তু এ বিষয়ে আমি আরেকটু আলাপ করতে চাই, সেটা হ’ল – সব ধরণের জীবনযাপন সবার জন্য নয় আসলে।
এক ধরণের জীবনযাপন একজনের কাছে ওকে মনে হইলে যে আরেকজনের কাছেও ওকে মনে হবে এমন না। নিজের কম্ফোর্ট জোন বুইঝা জীবনযাপন করাই উত্তম সিদ্ধান্ত। নিজের আল্টিমেট কম্ফোর্ট জোন বুঝে নিতে অবশ্যই নিজেকে জানতে হবে; ইনফ্লুয়েন্স হওয়া দিয়ে তা জানা যাবেনা। আমরা অনেক সময় অন্যের জীবনযাপন দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে সেই জীবনযাপনকে নিজের জীবনযাপনের অংশ করে তুলতে গিয়ে বিপদে পরি।
দুনিয়ায় সকলের অভিজ্ঞতা এক নয়, পরিবেশও এক নয়। আমাদের সকলের আত্মা ভিন্ন; কাজেই আমরা আমরা হই। হ্যাঁ, আমাদের একটা কমিউনিটির জায়গা তো অবশ্যই আছে, সেটা এড়াতে চাচ্ছি না – বলতে চাচ্ছি, আমাদের আত্মা কোন ধরণের রেস্পন্সে শীতল থাকে সে জায়গাগুলো আমাদেরই খুঁজে নিতে হয় আসলে। কোন একটা লাইফস্টাইলে কেও দিব্যি চলে যেতে পারে, আবার কারো প্রকৃতই অপ্রস্তুত লাগতে পারে। মানে নিজের স্বতঃস্ফূর্ত রেস্পন্সগুলিরে নিজেদের বুঝতে পারতে হবে এবং এই রেস্পন্সগুলিরে যতো বেশি লাইফে স্পেইস দেয়া যাবে জীবন ততো বেশি স্মুদ হইতে পারার কথা। দুনিয়ায় বেঁচে যাওয়ার জন্য সারভাইবালটারে স্মুদ করা তো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা বিষয়ই।
আমি যেমন, আল্লাহ্কে ভয় করি কারণ আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনকিছুকেই, কোন বিষয়েই আমি ভয় পাইতে চাইনা। আল্লাহ্কে ভয় পাওয়া মানে আমার কাছে আমার নেয়া কিছু সিদ্ধান্ত, যেসব সিদ্ধান্ত থেকে যাতে আমি কোনভাবেই টলে বা সরে না যাই সেই বিষয়টাকে ভয় করা। এবং এই সিদ্ধান্তগুলি আমি নিয়েছি অনেক ভেবে এবং মনিটর করে। এসমস্ত সিদ্ধান্তের যে ফিডব্যাক আমি মূলত চেয়েছি তা হলো আমি দিনশেষে নিজেকে আরো বেশি মজবুত মনে করতে চেয়েছি।
আমরা যে জীবনযাপন করতেছি সেই জীবনযাপনই যে আমরা করতে আসছি বিষয়টা এমন না। জীবনযাপন কাস্টমাইজ করার সুযোগ আছে। একটা জীবনযাপন আমাকে স্যুট করতেছে না তবুও আমি গোঁয়ারের মতো সে জীবনযাপনই লইয়া আছি, পুনরায় ভেবে দেখছি না কোথায়, কীভাবে সমস্যা ও অতিক্রম করার উপায় কী। এমন হলে তো সেই জীবনযাপন আমাকে ভোগাবেই। নিশ্চয় আমরা কেও স্বেচ্ছায় ভুগতে চাইনা। যে জীবনযাপন করতেছি তা যদি নিজেকে ব্যালেন্সড না থাকতে দেয় তবে আরেকবার সে জীবনযাপনের দিকে ফিরে তাকানো দরকার।
ভাত খেয়ে কান্তিলাল দা’র ডেরার দক্ষিণ দিকে গাছতলার মাচানে গিয়ে বসি আমরা। বাতাসে চোখে ঘুম নেমে আসে। আমরা দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি। ঘণ্টা খানেক আমি হয়তো ঘুমিয়েও নিই। বিকাল বিকাল হয়ে এলে কান্তিলাল দা’র কাছ থেকে বিদায় নিই। বিদায় নেয়ার কালে বলি, কিছু কিছু মানুষের সাথে হয়তো লাইফে আর ৭-৮ বার দেখা হবে। কিছু মানুষ আছে যাদের সাথে আর কোনদিন দেখাই হবে না। এই পরিচিত মানুষগুলো জীবন ভইরা আমার সম্পর্কে বা আমি তাদের সম্পর্কে কী মনে রাখবো? আসলে আমরা তো একে অন্যের সম্পর্কে খুব বেশি জিনিস মনে রাখি না। মনে রাখি কেবল তাদের করা অপমানগুলি, মহব্বতগুলি। আমরণ মনে রাখি যদি বিপদের সময় সাহায্য চাইয়া না পাই, আমরণ মনে রাখি যদি কেও এক ব্যাগ রক্ত দিয়া হেল্প করে।
আর এই মনে রাখাটুকু দিয়াই দুনিয়ায় যখন যেখানে আমরা আলাপ করি, অপমান আর মহব্বতগুলি দিয়া আমরা একে অন্যরে স্মরণ করি। পরের প্রজন্মের কাছে জানাই অমুকের কইলজাটা ভরা ভালোবাসা, তমুকে পাষাণ। আমার ভক্তি নেবেন কান্তিলাল দা। ফের দেখা হবে।
কান্তিলাল দা আমাকে কাছের একটা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দেন। তার মুখে ফুটে থাকা তৃপ্তির হাসি আমাকে জানায় তিনি আমার ভক্তি গ্রহণ করেছেন।
দুই
এশার নামাজ শুরু হওয়ার আগে আগে ইমাম দাঁড়িয়ে বললেন, ‘নামাজ শেষে আমরা যারা তিন দিনের তবলিগে যাবো তারা বসবো ইনশাআল্লাহ্। আগামীকাল ফজরের নামাজ শেষে আমরা মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা করবো বলে নিয়ত করেছি। সে বিষয়েই কথা হবে। আমরা বসি, বহুত ফায়দা হবে। কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে ভাব খয়রাতি।
নামাজ শেষ হলে পরে ইমাম দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে বললেন, আগামীকাল বাদ ফজর আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বো ইনশাআল্লাহ্। গত শুক্রবারে ছ’জন ভাই নিশ্চিত করেছেন তাদের যাওয়ার ব্যাপারে। আপনারা আর কেও যদি যেতে ইচ্ছুক হন তো এখন জানাতে পারেন; তাতে আমাদের ব্যবস্থাপনায় সুবিধা হয়। ভাব খয়রাতি হাত জাগায়। জাগিয়ে জানায় যে সে যেতে চায়। বাকি যে ছয় জন যাবে তাদের সকলেই মুরুব্বি। একজন যুবককে দ্বীনের দাওয়াতের পথে পেয়ে ইমামসহ ছয়জন মুরুব্বি খুবই আনন্দিত হলেন। সবাই একসাথে তাই বলে উঠলেন, মারহাবা, মারহাবা।
ইমামের লগে হাত মিলায়া মসজিদ থিকা বের হয় ভাব খয়রাতি। মসজিদের পাশের টঙ দোকানে তার পরিচিত ভাই-বেরাদরকে বইসা থাকতে দেইখা দোকানে ঢোকে সে – সবার লগে হাত মেলায় আর জানায় তার তবলিগে যাওয়ার খবর। সবাই খুবই খুশি হয় শুইনা আর দোয়া কইরা দেয় তারে। ভাব খয়রাতি তার ভাই-বেরাদরের দোয়া নিয়া বাসার দিকে রওনা করে।
বাসায় ঢুইকা মা’কে তবলিগে যাওয়ার বিষয়টি জানায় সে। মা হাসি মুখে বলে, ভোরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে জাগিয়ে দিস। ভাব খয়রাতিও হেসে বলে, ঠিকাছে – বইলা নিজের ঘরে গিয়ে কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে নেয়। কাপড়চোপড় ব্যাগে গুছিয়ে রেখে রাতের খাবার খেয়ে নেয় ভাব খয়রাতি। রাত তিনটার এলার্ম দিয়ে শুয়ে পরে। তিনটায় ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে সে।
সিজদায় গিয়া ভাব খয়রাতি চোখ বন্ধ করে। এরপর সে সুবহা’না রাব্বিয়াল আ’লা পড়তে পড়তে কপালের মাঝখানের জায়গাটায় দুই চোখের অন্ধ আলোর মিলন ঘটাইতে চায়। অন্ধকারে কিছু দেখতে চায় না। জাস্ট দুইটা চোখের ফোকাসরে একটা বিন্দুতে আইনা মিলিয়ে দিতে চায়। এই করতে গিয়ে ভাব খয়রাতির মনে সংশয়ের উদয় হয় সে কি চেয়ে আছে নাকি চোখ বন্ধ করে আছে? চেয়ে থাকা আর চোখ বন্ধ থাকার একটা মাঝামাঝি অবস্থায় ভাব খয়রাতি বেশিক্ষণ থাকে না। সে চোখ খুইলা তাকায়। জায়নামাজে ফুঁইটা থাকা ফুল তার চোখে পরে প্রথমে। এর আগেও হয়তো সে এই ফুলটাকে দেখে থাকবে কিন্তু লক্ষ্য করেছিল কি? হয়তো এই প্রথম বারের মতো লক্ষ্য করলো। ফুলটার ভাব জাগানিয়া কারুকাজে চোখ ও মন আটকে থাকে ভাব খয়রাতির।
ফের সিজদায় পইড়া থাকে ভাব খয়রাতি। এবার সে অদ্ভুতভাবে নিজেকে আবিষ্কার করে মহাবিশ্বের একটা গ্রহ পৃথিবী সে পৃথিবীর একটা ভূখণ্ডে গড়ে তোলা একটা বাড়ির একটা ঘরের ভেতর একটা জানালার সামনে জায়নামাজের উপর সিজদারত অবস্থায়। কেন সে এভাবে সমতলে দুই ঠ্যাং বাকা করে, দুহাতে ভর করে সমতলে কপাল ঠেকিয়ে, নাক ঠেকিয়ে সিজদারত আছে সেকথা ভাবে। সে ভাবে, নিশ্চয় এইটা একটা ফলাফল যার পেছনে কারণ আছে। সে কারণটা নিশ্চয় খোদার কাছে আশ্রয় চাওয়া মানে ডিপেন্ড করা। বা সে কারণটা নিশ্চয় লাইফের অর্থহীনতা। বা সে কারণটা নিশ্চয় ভাষার সীমাবদ্ধতা। বা সে কারণটা নিশ্চয় চিন্তার সীমাবদ্ধতা এবং একই সাথে অসীমতা যা কিনা একইভাবে সাদা অথবা কালো অসীমভাবে।
ফজরের আজান দেয়। লা ইলাহা ইল্লাল্লা শোনা যায়। নামাজ পইড়া ভাব খয়রাতি জায়নামাজে একটু বসে। বইসা ভাবে নামাজ তো তারে আল্টিমেট একটা জিরো দিতেছে। নামাজ পড়ার ভিতর দিয়া সে কিছু না করারে করতেছে। একই সূরা রোজ পড়তেছে যেমন একই নিশ্বাস রোজ নিতেছে। একই নিয়ম মাইনা নামাজ সম্পন্ন করতেছে যেমন একই নিয়মে সূর্যের চারপাশে দুনিয়া ঘুইরা যাইতেছে।
ভাব খয়রাতীর চাইনিজ দার্শনিক লাও জু-র (Lao Tzu) কথা মনে পরে, লাও জু কিছু না করারে করার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়া গ্যাছে। যা কিনা মানুষরে প্রতিযোগিতাহীন একটা সরল লাইফ দিতে পারে। নামাজের ময়দান তো প্রতিযোগিতাহীন একটা সমতল এবং সরল জায়গাই। যেখানে সবাই একসাথে একই বিন্দুতে মিলে (সবাই যেমন মৃত্যুর ভিতর দিয়া একই বিন্দুতে মেলে) সমানভাবে শুন্য থাকতে পারে।
ভাব খয়রাতির বুদ্ধের কথা মনে পরে, বুদ্ধ ধ্যানে গিয়া শুন্য হইতে পারছিলেন। বাহ্যিকভাবে শারীরিক পজিশন নানাজনে আরাম মতো নিছে কেওবা নিছে আরামের বিপরীতে। দার্শনিক নীটশে’র কথাও মনে পরে তার। সাইকোলজিক্যালি অমন ডিস্টার্বড একটা জায়গায় থাইকা তিনি জিরোর পিনিক নিছেন। মনের জায়গায়, অনুভূতির জায়গায়, যুক্তির জায়গায় সবাই একটা শুন্য আবিষ্কার করাতে তো ব্রত থাকছেনই। সায়েন্সও পাইলো, সামথিং ফ্রম নাথিং। সামথিংরে ধাওয়া করতে করতে গিয়া পাইলো আরে নাথিং তো ব্যাপারটা আসলে।
নামাজ শেষে মা’কে জাগিয়ে তোলে ভাব খয়রাতি। মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেয়। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা করে সে।
মসজিদের সামনে সবাইকে তার জন্য অপেক্ষারত দেখতে পেয়ে কিছুটা দ্রুত পা বাড়ায় ভাব খয়রাতি। সবাই প্রথমে মিরপুর দশ থেকে ইউনাইটেড বাসে গুলিস্তান যায়। গুলিস্তান থেকে তারা মুন্সিগঞ্জের বাস ধরে। দুই ঘণ্টার মধ্যে তারা মুন্সিগঞ্জ পৌছে যায়। বাস থেকে নেমে এলাকার একটি মুদি দোকানে ইমাম সাহেব জিজ্ঞাসা করেন, আজ্ঞে আলিনূর জামে মসজিদটি কোথায় কহিতে পারেন? মুদি দোকানদার জানাইলেন, মসজিদটি তার দোকানের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি চলিয়া গেছে সে রাস্তাটির মাথায়, নদীর পারে অবস্থিত। ধন্যবাদ জানাইয়া ইমাম তার সাথী ভাইদের নিয়ে হাটা শুরু করিলেন। হাটিয়া রাস্তার একেবারে শেষ প্রান্তে চলিয়া আসিলেন তারা। রাস্তাটি নদীতে আসিয়া থামিয়া গিয়াছে। রাস্তার ডান পাশেই মসজিদটিকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিতে পায় সকলে। আরো দেখিতে পায় মসজিদের পাশে একটি কবরস্থান আর কবরস্থান পেরিয়ে তাহাদের আখি যতদূর যায় তার একপাশে জংগল, আরেকপাশে বিস্তৃত নদী।
মসজিদের মুয়াজ্জিন আসিয়া তার ভাইদের ভেতরে লইয়া যান। আর কোথায় কী রাখতে হবে সেসব দেখাইয়া, বুঝাইয়া দেন। যোহরের সময় হয়ে আসে। মুয়াজ্জিন তাদেরকে জানায় তারা যদি চায় নদীতে গিয়া গোসল করতে পারেন। ঘাট বাঁধানো আছে তবে নদীতে স্রোতও আছে। যদি কেও সাতার না জানেন তবে একটু অসাবধানতায় বিপদ ঘটে যেতে পারে। একথা শুনে দুজন মুরুব্বি নদীতে গোসল করার ব্যাপারে অসম্মতি জানান।
ইমাম লক্ষ্য করেন ফজরের নামাজের সময় থেকেই ভাব খয়রাতি কেমন যেন আনমনা হইয়া আছে; যেন নিজের মধ্যে নিজে নাই, যেন ছুঁয়ে দিলে ঘুম ভেঙে যাবে। ইমাম তাই ভাব খয়রাতির পাশে গিয়ে দাঁড়ান। ভাব খয়রাতি নদীর দিকে নিবিষ্টচিত্তে তাকাইয়া আছে। খেয়ালই করছে না যে ইমাম তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ইমাম তার সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে বলিতে থাকেন, নদীটা খুব সুন্দর; অবশ্য নদী মাত্রই সুন্দর হয়। একথা বলে ইমাম ভাব খয়রাতির দিকে আড় চোখে তাকায় – তাকিয়ে দেখে খয়রাতির কোন ভ্রুক্ষেপ নাই; তার চোখ দুটো জমে বরফ হইয়া গেছে যেন। নামাজের সময় হয়ে আসে বলে খয়রাতির কাঁধে গিয়া হাত রাখেন ইমাম সাহেব – এরপর জিজ্ঞাসা করেন নদীতে গোসল করবে কিনা সে। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় খয়রাতি। যেন একটা অশরীরী আত্মা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নদী মাঝে আর সেও ঘুমে হাটা মানুষের মতো হেঁটে যাচ্ছে।
নদীতে গোসল করতে নামেন ইমাম ও তার সাথী ভাইয়েরা। পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হইবার পরে ইমাম খেয়াল করেন খয়রাতি নাই। ডরায় যান তিনি। অন্য ভাইদের জিজ্ঞাসা করেন, খয়রাতি কই? তারা কেওই কিছু বলতে পারে না খয়রাতির ব্যাপারে। সবাই মিলে খুঁজতে লেগে যায় খয়রাতিকে। এভাবে পাঁচ মিনিট কেটে যায় পরে সবাই দেখতে পায় খয়রাতি অনেক দূর থেকে সাতার কেটে কেটে কিনারে ফিরতেছে। সবার মনে স্স্তিব নাইমা আসে। কিন্তু তারা কেও কিছু বলেনা খয়রাতিকে; কারণ তাদের কেওই সাঁতার জানেনা।
আসর নামাজের শেষে তবলীগের সবাই মিলে গ্রামের মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে বের হন। খুবই সুন্দর গ্রাম। নদীর পার ধরে হাঁটার রাস্তা। সারি ধরে নারিকেল কাছ, সুপারি গাছ। গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষই বিদেশ থাকেন বলে দাওয়াত দেয়ার খুব বেশি মানুষ পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় খেলারত কিছু নাবালক শিশুদের। আর শিশুদের মতোই কিছু বুড়াদের। দাওয়াত শেষে মাগরিবের কিছু আগে নদীর পার ধরে মসজিদে ফেরে সবাই। ফেরার পথে হঠাত ভাব খয়রাতি দাঁড়িয়ে যায়। দাঁড়িয়ে সে দেখতে থাকে নদীর ওপারে সূর্যের ডুবে যাওয়া আর রক্তিম আকাশ আর দেখতে থাকে সে রক্তে রঞ্জিত নদীর পানির বয়ে যাওয়া। তার হাত দুটি উঠে আসে, সে বলতে শুরু করে, “মাফ করো আল্লাহ্। মাফ করো। মাফ করো ভ্রান্ত ধারণায় আত্মারে কলুষিত কইরা ফেলা থেকে। ভ্রান্ত ধারণাগুলিরে নির্ধারণ করার তৌফিক দাও খোদা। চিন্তায় ততখানি স্পষ্ট হইতে সহায়তা করো যতখানি হইলে পরে চিন্তাগুলি দিয়া দুনিয়ার সাথে সংশয়হীন সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। নচেৎ স্থির, শান্ত থেকে দুনিয়াদারী বোঝার মানসিকতা দান করো। যে জীবন বাঁচবার সে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগানো এবং ছড়ানো থেকে আমাদের হেফাজত করো প্রভু।”
সকলে আমিন বলে ওঠে। তাদের চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে থাকে।
ভাব খয়রাতি দুহাত তুলে বলতে থাকে, আমাদের হৃদয়ে তুমি বিজয়ের ঘণ্টা বাজায়া দাও খোদা। তুমি জানো বিজয়ের লক্ষ্যেই তোমার দিকে আমাদের যাত্রা। তুমি বিজয়ের মুকুট নিয়া আইসা বসো আমাদের রুহে। সে মুহূর্ত থেকেই কেবল আমরা আমাদের হইতে পারবো; আমরা তোমাতে লীন হইয়া যাইতে পারবো, ফানাফিল্লা হইয়া যাইতে পারবো।
সকলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আর মন দিল খুলে আমিন আমিন বলতে থাকে।
হাত নামায় ভাব খয়রাতি। শান্ত ভাবে হেটে চলে মসজিদের দিকে। সকলেই মসজিদে ফিরে যায়।
এশা নামাজের শেষে খাওয়াদাওয়া কইরা সবাই মিলে কোরআন থেকে কিছু বর্ণনা শোনেন ও জিগির করেন। এরপর ঘুমিয়ে পড়েন সকলে। কবরস্থানের পূর্ব পাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসে শিয়ালের ডাক। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এক গভীর নির্জনতায় ছেয়ে থাকে চারিপাশ। মসজিদের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় পুরনো সব গাছ কী প্রজ্ঞার সাথে যেন মহাকালের রহস্য ভেদ করে দাঁড়িয়ে আছে। রাত আড়াইটার দিকে ঘুম ভেঙে যায় ভাব খয়রাতির। মসজিদের দক্ষিণ পাশের জানালা দিয়ে নদী দেখা যায়। আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ থাকায় খেয়াল করলে নদীর স্রোত পর্যন্ত দেখা যায়। খয়রাতি মসজিদ থেকে বের হয়ে আসে। এসে একটা বড় কড়ই গাছের তলায় এসে দাঁড়ায়। কড়ই গাছের পাতার আড়াল দিয়ে চাঁদের আলো এসে পৌছায় খয়রাতির চোখে। মাটির উপর সে তার ছায়া পড়ে থাকতে দেখে।
নদীর পার থেকে কেমন যেন একটা সুর ভেসে আসে তার কানে। খয়রাতি মনে করতে চায় এসবই মায়া, ঘোর। হয়তো এ কোন গানের সুর নয়, এ নদীর জলের কলকল ধ্বনি। খয়রাতির মনে ভয় নেই কোনকিছুর, মৃত্যুর। সে নদীর পাশে গিয়ে বসে। বসে নদীর উপর পড়ে থাকা চাঁদের ছবি দেখতে থাকে। হঠাত সে যেন দেখতে পেলো তার সামনে আসলে কোন নদী নেই, সে এক যুবতী নারীর অন্তর যেখানে অনেক কান্না, অনেক প্রেম। খয়রাতি নেমে যাবে সে কান্নার দরিয়ায় এমন সময় ইমাম পেছন থেকে টেনে ধরার সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় সে।
খয়রাতিকে শিশিরে ভেজা ঘাসে শুইয়ে দিয়ে হাতে করে নদী থেকে কিছুটা পানি নিয়ে এসে চোখে ছিটিয়ে দেন ইমাম। খয়রাতি চোখ মেলে তাকায়, উঠে বসে। বসে বলতে শুরু করে, হুজুর, মাগরিবের আজান আপনারে কখনো বিষণ্ণ কইরা তুলছে? আমি ঠিক জানি না কেন আমি ‘বিষণ্ণ’ শব্দটা ব্যবহার কইরা ফেললাম! কেন’র কারণ খুঁইজা দেখা যাইতে পারে।
আমার মধ্যে একটা ফিল হইতো গ্রামের মাগরিবের আজানগুলি শুইনা। শহরের মাগরিবের আজান আমি কোনদিন ফিলই করতে পারি নাই। ফিল করা তো দূরে থাক মসজিদের শহর ঢাকায় এত এত মসজিদে মাগরিবের আজান হয় অথচ আমার কানেও পৌছায় না প্রায়। কেন ‘বিষণ্ণ’ শব্দটা ব্যবহার করলাম সেইটা খুঁজতেই এসব বলতেছি হুজুর।
আমাদের গ্রামের বাড়িটা একটা বিল্ডিং। অনেক পুরানা। অনেক বলতে একাত্তরের পরে পরেই করা। একাত্তরের আগে দাদা মগবাজার থাকতো তার পরিবার নিয়া। আমার বাবা তখন ছোট। বাবা বড় হইছিল পরে ঢাকার সব সিনেমা হলেই নাকি সে তার মামার লগে মিলা সিনেমা দেইখা বেড়াইছে। আর আব্বু নাকি আমার মতোই ‘পরে খাবো’ এই কথাটা বলতো খাইতে দিলে। আর সেই খাবারটা নাকি খাইয়া ফেলতো তার ছোট ভাই মানে আমার কাকা। ‘বিষণ্ণ’ শব্দটা কেন আমি ব্যবহার করছি এবং তার কারণ যে আমি খুঁজতে বাইর হইছি সেকথা খেয়াল আছে আমার হুজুর। খেয়াল থাকার পরেও আমি কি প্রসঙ্গের বাইরে যাইতে পারবো না বলেন! আপনে প্লিজ আমাকে কথা বলার ক্ষেত্রে সংগতিহীন ভাইবা নেবেন না হুজুর এবং দয়া করে আমার এই কথা বইলা যাওয়াটারে স্বাভাবিক ভাবে নিবেন!
তো দাদা আমাদের বিল্ডিংটার এমন একটা নকশা করছিল যেটার বাইরের দিকে সিমেন্টের কাজ করা ফুল ছিল। সেই ফুলগুলির কলি বুঝাইতে দাদা মনে হয় মার্বেল লাগাইছিল। মার্বেলগুলা পোলাপান খুইলা খুইলা নিয়া আংটিস খেইলা ফেলছিল। আমিও হয়তো দু-একটা তুইলা থাকবো। বিল্ডিং-এর এই বর্ণনা অপ্রাসঙ্গিক লাগলেও ‘বিষণ্ণ’ শব্দটার সাথে বিল্ডিংটার যোগাযোগ আছে বইলাই বলতেছি হুজুর। শব্দ তো ইমেইজ মানে ছবিও খুঁইজা বেড়ায়। তো আমাদের বিল্ডিংটায় শ্যাওলা পইড়া গেছিল। বিল্ডিংটার দিকে তাকাইলেই মনটা স্যাঁতস্যাঁতে হইয়া যাইত, এখনো যায়।
আমাদের বিল্ডিংটার পাশেই থাকে একটা মসজিদ। আরো থাকে একটা বাঁশঝাড়, থাকে দোয়ার ভরা মেহেগনি গাছ। আমাদের দোয়ারে রোদ কম আসে বা আসেনা। শীতের সময় আমি আর আমার মা পাটি লইয়া দোয়ারের এপাশ থিকা ওপাশ দৌড়াদৌড়ি করতাম মেহেগনি গাছের ফাক দিয়া আসা আলোর লগে লগে। পাটিতে বসায়া মা আমারে পড়াইত। গোসল করার পরে পাটিতে দাঁড়া করায়া তেলও মাইখা দিতো শরীরে। আমাদের দোয়ারের মাটিতেও শ্যাওলা পইড়া গেছিল। এখনো থাকবে হয়তো। যাইনা তো অনেকদিন। অই মাটিগুলির দিকে তাকাইলেও মনটা স্যাঁতস্যাঁতে হয়া উঠতো।
আমার মনে হয় স্যাঁতস্যাঁতে বিল্ডিংটা আর স্যাঁতস্যাঁতে মাটিগুলিরেই আমি বিষণ্ণ শব্দটার মধ্যে আটকাইছি। আর মাগরিবের আজান দিলে তো খেলাধুলা গুটায়া বাড়ি ফিরতে হইতো, আর মনে হইতো গিয়া পড়তে বসতে হবে এ ঘটনাগুলিরেও বিষণ্ণ শব্দটায় আটকায়া থাকবো হয়তো।
খেলা শেষে বাড়ি ফেরা ক্লান্ত শরীর নিয়া বইসা থাকতাম উঠানে হাত-পা ধুইয়া, কলচাপা একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাইয়া। তহন দুনিয়াডা পুরা ঠাণ্ডা হইয়া উঠতো আমার কাছে। তখন শান্ত তাকিয়ে থাকার কিছুটা অবসর মিলতো আমার। আমি স্যাঁতস্যাঁতে মাটিগুলিরে দেখতাম, স্যাঁতস্যাঁতে বিল্ডিংটারে দেখতাম। আর তখন মাগরিবের আজানটাও পড়তো আর তাই বুঝি মাগরিবের আজানটাও হয়ে উঠতো স্যাঁতস্যাঁতে যারে আমি আটকাইছি বিষণ্ণ শব্দটার ভিতরে।
বিষণ্ণ থাকার একটা পপুলার মিনিং আছে ‘মন খারাপ থাকা’। আমরা মনে হয় একটু চুপ কইরা থাকার, একটু স্থির তাকায়া থাকার, একটু শান্ত বইসা থাকার মধ্যে বিষণ্ণতার ‘মন খারাপ থাকা’ মিনিংটা অনেক সময় নাও থাকতে পারে।
ইসলামের কথাই কন না। বেচারা ইসলাম মজার দুনিয়ায় তার রেলেভেন্স হারাইতে বসছে না? তার মধ্যে নাকি মজা নাই, সে নাকি ম্যান্দামারা। বুঝলেন হুজুর নিওলিবারাল এই টাইমে এন্টারটেইনমেন্টে থাকার তাড়না বিকারের পর্যায়ে পৌছে গেছে। এরকম একটা কথা জিজেক নামের একজন দার্শনিকও বইলা থাকতে পারেন। মনে নাই ঠিক।
আমি যে বিষণ্ণতার কথা কইতেছিলাম সে বিষণ্ণতার মিনিং একটু ভিন্ন – আমার বিষণ্ণতা হইলো সেই স্যাঁতস্যাঁতে দালান, স্যাঁতস্যাঁতে মাটি, স্যাঁতস্যাঁতে মগরেবের আজান। ওরা আমার মন খারাপ কইরা দেয়না। ওরা আমারে খালের কিনারে নিঃশব্দে ঝইরা পরা একটা বাঁশপাতার মতো পইড়া থাকতে দেয় এই দুনিয়ার কোন একখানে।
ইমাম সাব একমনে খয়রাতির কথা শুনতে থাকে। বাধা দেয় না। খয়রাতির কথা শেষ হলে তাকে নিয়ে মসজিদে ফিরে আসে। ফজরের আজান হয়। লম্বা একটা আজান দেয় ভাব খয়রাতি। এতো দরদিয়া আজান অনেকদিন কেও শোনে নাই।
নামাজে দাঁড়ায় সকলে। হুজুর তাকবীর দেন, সূরা পড়তে থাকেন। নামাজে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ায় খয়রাতি। যেহেতু সূরা ইমাম সাবেই পড়ছেন তাই খয়রাতির তো কিছুই প্রায় করার থাকেনা দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া। তাই সে চোখ বন্ধ করে অন্ধকারের ভেতর, আরো একটা অন্ধকার খোঁজে, দুইটা চোখের আর চিন্তার ইঁদুর দৌড় বন্ধ করতে অন্ধকার খুঁড়তে থাকে আর খুঁড়তে থাকে; মাঝেমধ্যে
আলো বেরিয়ে আসে – কিন্তু কোথায় কোথায় খয়রাতি স্থীর হবে! ইমামের নির্দেশনা আসে, খয়রাতি রুকুতে যায় – এর মাঝে দুনিয়াবি কোন চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তার মন; হার্টবিট বাড়তে থাকে; না, না কোন চিন্তা করতে চায় না খয়রাতি, সে ভাবে, আমি তো এখন এই মুহূর্তে লীন হয়ে যেতে এসেছি। খয়রাতি আবার দু চোখের গভীর কূপে ক্রমশ নেমে যেতে থাকে, পথে সমুদ্র পড়ে, পড়ে অজানা একটা হাওর আর তার বুকে লেগে থাকা ঝিরিঝিরি ঢেউ – দেখে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন বসে আছেন নবী, দেখে কৈলাসে যোগাসনে বসে আছেন শিব, দেখে বোধীবৃক্ষের তলায় পদ্মাসন করে বসে আছেন বুদ্ধ, দেখে মাইলের পর মাইল শব্দহীন হাটছেন লাও জু! ইমাম সালাম ফেরান – চিন্তা আর চোখের গভীর কূপ থেকে উঠে আসে খয়রাতি, সালাম ফেরাতে ফেরাতে উচ্চারণ করে, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
জায়নামাজ থেকে উঠে পায়চারি করতে করতে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে সকাল বেলার হালকা কুয়াশার ভেতর দিয়ে হেটে যেতে থাকে খয়রাতি। ঘাসে জমে থাকা শিশিরে তার পা ভিজা যায়। তার শরীর টের পায় শীতল পানির পরশ। দীর্ঘক্ষণ খয়রাতি কুয়াশা, বাতাস, তার শরীর-মন-ভাবনা, মাটির স্পর্শ, একটা ফিক্সড নয় এমন দৃশ্য, একটা সুর নিয়া হাটতে থাকে খোলা একটা মাঠের মধ্য দিয়ে।
নয়টা-দশটার দিকে মসজিদে ফিরে আসে খয়রাতি। সুপারি গাছ দিয়ে বানানো বেঞ্চের উপর বসে ইমামকে একাকী তজবীহ গুণতে দেখে এগিয়ে যায় সে। খয়রাতিকে দেখে খুশি হন ইমাম। খয়রাতি সংস্কৃতি বিষয়ে আলাপ তোলে। হুজুর, আপনে কি মুসলমানের সংস্কৃতিরে অন্যান্য ধর্মীয় সংস্কৃতির চাইতে বেটার মনে করেন?
মুসলমান সংস্কৃতি বইলা একটা ফিক্সড সংস্কৃতি আর হিন্দু সংস্কৃতি বইলা একটা ফিক্সড সংস্কৃতি চোখের সামনে রাইখা আলোচনা করলে সমস্যা না? আমার কাছে লাগে যে মুসলমান সংস্কৃতি বা হিন্দু সংস্কৃতি বইলা এমন কিছু ফিক্সড জিনিস আমাদের চিন্তকেরা দেখেন যা তারা কোনভাবেই বিবর্তন যোগ্য বা পরিবর্তন যোগ্য বা সংযোজন যোগ্য বইলা মনে করেন না।
এক ইসলামেই হাত বুকে বান্ধে, নাভির নিচে বান্ধে, আবার কেও বান্ধেই না – তো এরকম নানানভাবে ইন্টারপ্রিটেশনের সুযোগ আছে বইলাই না এমন হইছে। এখন বাংলাদেশে যদি অন্যরকমের ব্যাখ্যার উদয় হয় যে ব্যাখ্যায় হিন্দু–মুসলমান নিয়ম-নীতি, আচরণ, জ্ঞান ও বিশ্বাসের জায়গা থেকে কমন কিছু জায়গা আবিষ্কার করে সে অনুসারে তাদের সাংস্কৃতিক চর্চা বিনির্মাণ করতে চায় সে পথ আপনি, আমি কেন রোধ করতে যাবো? মানুষ বুঝুক আর না বুঝুক ধর্ম একটা ডাইনামিক ব্যাপার না হইলে এর কোন প্রাসঙ্গিকতাই থাকতো না। ‘আল্লাহ’ হলো সবচেয়ে ডাইনামিক একটা আইডিয়া। আল্লাহ এমন একটা স্পেইস যে স্পেইসে আপনি যা কিছু আছে আর যা কিছু নাই সবকিছুর জায়গা দিতে পারবেন।
খয়রাতি বলে, হ্যাঁ, কিছুদিন আগে আমি একজন প্রফেসরের লগে আলাপ করতেছিলাম দর্শন আর বিজ্ঞান লইয়া। তিনি বারট্রান্ড রাসেল রে বিজ্ঞান আর দর্শনের মাঝখানে বসাইছিলেন।
আমার পজিশনটা ছিল এমন, আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি ব্যবহার করি বইলা দার্শনিক আলাপ ফুড়াইছে এমন না ব্যাপারটা। দার্শনিক আলাপ ফুড়াইছে বললে আল্লাহ আইডিয়াটা যে আমাদের ব্রডার স্পেইস দেয় নতুন চিন্তা করার, নতুন প্রশ্ন করার সে পথটাকেই বরং রুদ্ধ করে দেয়া হয়।
কোথায় যেন পড়ছিলাম, বিজ্ঞান বলতে পারে কোন একটা জিনিস কিভাবে ঘটে কিন্তু বিজ্ঞান এইটা বলতে পারেনা কোন একটা জিনিস কেন ঘটে। মানে কিভাবে মানুষের সৃষ্টি, দুনিয়ার সৃষ্টি এইগুলি বিজ্ঞান বলতে পারলেও (পারে নাকি?) বিজ্ঞান বলতে পারেনা কেন এইসব হচ্ছে।
দ্য মিথ অব সিসিফাস নামে একটা বইয়ে আলব্যের কাম্যু বলতেছেন একথা,
“গ্যালিলিও বৈজ্ঞানিক সত্যতার মহৎ গুরুত্ব তুইলা ধরছিলেন, এবং পরে বৈজ্ঞানিক সত্যতারে সে সর্বাধিক সাচ্ছন্দের লগেই ত্যাগ করছিলেন। কেননা, খুব শীঘ্রই ‘বৈজ্ঞানিক সত্যতা’ তাঁর জীবনরে বিপদাপন্ন কইরা তুলছিল।
একটা নির্দিষ্ট অর্থে, গ্যালিলিও ঠিক কাজই করছিলেন। ‘বৈজ্ঞানিক সত্যতা’ আসলে ততটুকু মূল্যবান নয় যতটুকু তা দাবী করেছিল। পৃথিবী অথবা সূর্য একে অপরের চারপাশে ঘুরে কিনা বিষয়টা তো আসলে গভীরভাবে উদাসীন থাকার মতো একটা ব্যাপার। সত্যি বলতে, এইটা একটা অনর্থক প্রশ্ন।
অপরপক্ষে, আমি দেখি প্রচুর মানুষ মারা যায় কারণ তারা বিচার কইরা দেখে যে জীবন অনর্থক। আমি অনেকেরে দেখি আইডিয়া অথবা বিভ্রম যা তাদের বেঁচে থাকার কারণ দেয়, অথচ আপাতবিরোধীতায় তা-ই তাদের মেরে ফেলে (যা বলা হয় বেঁচে থাকার কারণ সেটাই মৃত্যুর জন্যও দারুণ একটা কারণ)। অতএব আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে ‘জীবনের মানে’ই হল সর্বাধিক জরুরী প্রশ্ন।”
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়তে থাকার ফলে মূলত যা হচ্ছে বা হবে তা হইলো দর্শনের কান্ধে ভর কইরা ধর্ম রিশেইপ নিতে থাকবে। যেকোনো বৃহত পরিবর্তনেই আর আর জিনিসগুলা রিশেইপ নিতে বাধ্য। কাজেই “রিকন্সট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট (মোরাল ফিলসফি, পলিটিক্স, ক্ষমতা এইগুলিও জড়িত তো ধর্মের লগে)” এই ব্যাপারটা ঘটতে থাকবে।
বিজ্ঞান আর ধর্ম যে কেও কারো থ্রেট না এইটা সম্ভব হয় দর্শনের জন্যেই। একটা দর্শন বিহীন দুনিয়া আর একটা চরমপন্থি দুনিয়ায় মধ্যে কোন ফারাক থাকার কথা না।
এছাড়া আরেকটা ব্যাপার আছে যা আল্লাহর সুবিশাল স্পেইস সংকুচিত কইরা ফেলে। সেটি হলো, ইসলাম বা আর আর ধর্ম তো কেবলই স্পিরিচুয়াল রিয়ালাইজেশনের ব্যাপার না। এইটা একটা অংশ মাত্র। এই অংশটারে ওভাররেটেড করার মাধ্যমে আর আর সমান গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলিরে বিলুপ্ত কইরা ফেললে ধর্ম কেবল দুর্বলই হইতে থাকেনা, সাপের মাথাটা হইয়া নিজের লেঞ্জাটাই খাইতে থাকে।
ফলে আল্লাহ শব্দটা শুনলেই কেবল টেরেন্স মালিকের সিনেমার গাছের পাতার ফাক দিয়া আসতে থাকা বিকাল বেলার নরম আলোর সিনে হারায়া গেলে তো সমস্যাই; মানে কেবল এই স্পিরিচুয়াল রিয়ালাইজেশনরেই আল্লাহ বইলা দাবি করাটা খুব ন্যারো একটা দাবিই বলবো আমি।
আল্লাহ্ একটা আইডিয়া (চিন্তা অর্থে)। যা বর্ণবাদ, নিপীড়ন, অর্থনীতি, দুনিয়া, আখিরাত এমন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়া ডিল করছে। সমস্ত মিলাই আল্লা।
ইমাম আর ভাব খয়রাতি আলাপে মেতে ওঠেন। আলাপের মাঝে আরো ৩ জন সাথী এসে বেঞ্চের পাশেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনোযোগ সহকারে তাদের কথা শুনতে থাকেন।
ইমাম বলেন, হ্যাঁ, আল্লাহ্কে ব্রডার একটা স্পেইস থেকে আপনি খুব চমৎকার ভাবে দেখালেন। আমি আরেকটা যে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে কথা বলতেছিলাম, কোন ব্যাখ্যার কিরূপ প্রভাব পড়তেছে সোসাইটিতে সেদিকেও তো খেয়াল রাখা দরকার। আজকে সালাফি বা অন্যান্য ঘরানার ব্যাখ্যা এখানে স্ট্রং আছে বইলা চিরদিন এই ব্যাখ্যাই এখানে ডমিনেন্ট থাকবে তা তো না। হইতে পারে এখানে সুফিবাদী ব্যাখ্যা ধীরে প্রবল হইয়া উঠতেছে, হইতে পারে আলী শরিয়তির ইসলামিক মার্ক্সবাদী ব্যাখ্যা প্রবল হইয়া উঠতেছে!
ইসলামের যে ব্যাখ্যা এখন সমাজে ডমিনেন্ট আছে তা কতটুকু জুলুমের বিরুদ্ধে ও ইনসাফের পক্ষে কার্যরত আছে? যদি অতি সামান্যই থেকে থাকে তবে ধীরে এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্যতা হারাইতে থাকবে আর আরেকটা ব্যাখ্যা যেটা মানুষের ভোগান্তি কমানোর ব্যাপারে সচেতন, ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় সচেতন সেটা জনপ্রিয় হইতে থাকবে। এইটা কোন মাজহাবের বিষয় না, আমাদের রসূল আমাদের কোন মাজহাব দিয়ে যান নাই, তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন মানুষের ভোগান্তি কমানোর ব্যাপারে ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সচেতনতা।
ফলে মুসলমান মুসলমানের কাজ করুক, হিন্দু হিন্দুর কাজ করুক এরকম পার্মানেন্ট না আসলে কাজগুলা। তারা যে কাজগুলা করতেছে তারা আসলে একেকটা ব্যাখ্যারই অনুসরণ করতেছে। তো সকল ব্যাখ্যারই কেবলা যদি ইনসাফের দিকে ঘুরানো যায় বা যে ব্যাখ্যাগুলো মানুষের সাফারিংস কমানো নিয়া ভাবিত সেগুলোরে জনপ্রিয় কইরা তোলা যায় তবেই না ধর্মের চূড়ান্ত বিজয় ঘটে, নাকি?
জোহরের আজানের টাইম হয়ে আসে। আলাপের ইতি টানে দুজনে। ভাব খয়রাতি গোসল করে আজানের প্রস্তুতি নেয়।
রাতে মসজিদে জিকিরের আয়োজন হয়। আয়োজন বলতে এশা নামাজের শেষে সকল নামাজি মিলে আল্লাহকে ডাকার জন্য বসেন।
জিকিরে বইসা ভাব খয়রাতি চোখ বোজে। মসজিদের ভেতরে অনেক লোক একসাথে বইসা জিগির করে। ভাব খয়রাতি নিশ্চুপ চোখ বুজে থাকে। সবার একই সুরে ধ্বনিত হওয়া জিগিরের মাঝে বয়ে যাওয়া নদীর মতো সেও ভেসে যেতে থাকে সমুদ্রের দিকে। তার কানে পানির কলকল ধ্বনির মতো বাজে জিগিরের ধ্বনি। জিগিরের প্রতিধ্বনি হয় – এমন এক সুরের মূর্ছনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে তার শরীর শিহরিত হয়ে উঠতে থাকে। সে নিজের মাঝে এমন এক শক্তি খুঁজে পায় যে শক্তি কাওকে শাসন করে বা কাওকে অধিন করে শক্তিধর হয়ে উঠতে চায় না। সে শক্তি নিজের দুর্বলতম চিন্তাগুলিরে গুঁড়িয়ে দিয়ে শক্তিমান হয়ে উঠতে থাকে।
ভাব খয়রাতি রেড আর্মি চয়ার শুনেছে। রাশান আর্মিদের দলগত সেসব মিউজিক শুনে তার ভেতরে একটা আলোড়ন তৈরি হয়। সে গণসংগীত, রণসঙ্গীত শুনেছে। সে নির্জনে বসে ‘ওম’ ধ্বনি শুনেছে। সে শুনেছে জিকিরে বইসা ‘আল্লাহু’ ‘আল্লাহু আকবর’।
একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যায় মসজিদ জুড়ে। সকল মানুষ শিশুর মতো কাঁদছে। তারা খোদার কাছে মাফ চাইতেছে। তারা দুনিয়ার অর্থহীনতা থেকে মুক্তি চেয়ে হাত উঠিয়েছে। তারা সময়ের ভার হইতে রেহাই চাইতেছে। তারা সকলে অনুভূতির গভীরে বিচরণ করছে। তারা অস্তিত্বের সম্মুখীন হয়েছে এবং চিন্তামুক্ত হয়ে উঠছে।
ভাব খয়রাতি চোখ বুজে আছে। সে সমুদ্রে পৌছে গেছে ভেসে ভেসে। ঝুম বৃষ্টি নামছে বাইরে। জানালাগুলো এপাশ ওপাশ তোলপাড় করছে বাতাসে। ভাব খয়রাতী চোখ খোলে, আকাশে চমকানো বিজলীর আলো তে নদী দেখতে পায়।
জিকির শেষ হয়। জিকির চলাকালীন জিকিরের শব্দ আর বৃষ্টি পড়ার শব্দ যে মিলে মিশে একাকার হয়ে ছিল সেটি জিগির থামলে বেশ উপলব্ধি করা যায়। খাওয়াদাওয়া শেষ করে খয়রাতি শোয়ার বন্দোবস্ত করতে থাকে। এমন সময় ইমাম এসে বসেন তার পাশে। খয়রাতির বিছানাটা মসজিদের জানালার পাশে। জানলার বাইরে তাকিয়ে খয়রাতি হুজুরকে তার দেখা একটা স্বপ্নের কথা বলে।
বুঝলেন হুজুর আমি যে স্বপ্নগুলো দেখি এর মধ্যকার যে স্বপ্নগুলো আমার মনে থেকে যায়, পরে সেগুলো নিয়া আবার ভাবতে বসি। এরকম একটা স্বপ্নের কথা আপনে অনুমতি দেন তো আপনার লগে শেয়ার করি।
হুজুর এক গাল হেসে খয়রাতির কাঁধে হাত রেখে বলে, অবশ্যই, বলেন।
স্বপ্নে যে ঘটনাটা আমি অনেক বছর পরে দেখছিলাম সেই ঘটনাটা আসলে বাস্তবেও ঘটছিল অনেক বছর আগে। তখন আমরা গ্রামে থাকি। আমাদের গ্রামের বাড়ি ঘেঁষেই মসজিদ আর মসজিদ ঘেঁষেই একটা সরু খাল। আমার ছোট বোন তখন একেবারেই ছোট – হাঁটা শিখছে কেবল।
একদিন দুপুরে সে দাদুর পিছুপিছু খালের দিকে যায়। আমরা কেওই লক্ষ্য রাখি নাই আব্বু বাদে। এমনকি দাদুও লক্ষ্য করে নাই। সে যখন গোসল করে বাড়ির দিকে ফিরতেছিল আব্বু তখন জিজ্ঞাসা করে, “রাবিনা কই?” দাদু কয়, “আমি তো জানিনা। ও তো আমার সাথে গোসলে যায় নাই।”
আব্বু তো চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে পাইলো। দৌড়ে গেলো খালের পারে — গিয়া দেখে পানির উপরে ভাইসা থাকা একটা হাত স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। সাথে সাথে ঝাপ দিয়ে রাবিনাকে সেদিন তুইলা নিয়া আইসা তার জানটা রক্ষা করে আব্বু।
অনেকদিন পরে এই স্বপ্নটা দেইখা পরেরদিন আমি সারাদিন প্রায় চুপচাপ সময় কাটাই। ভাবতে বসি। ভাবতে গিয়া মনে হইলো, দাদু তো এইখানে আসলে সেসকল মানুষের ভূমিকা পালন করতেছে যারা ইনফ্লুয়েন্স করে (সাঁতার জানে) কিন্তু লক্ষ্য করেনা সাতার না জানা একটা শিশুও তার পেছনে পেছনে পানিতে নাইমা যাচ্ছে কিনা।
আর রাবিনা হইলো তারা যাদের পানি ভাল্লাগে, টগবগে স্রোত ভাল্লাগে, কেবলই প্রবৃত্তির অনুসরণ করে কিন্তু সাতার না জাইনাই নাইমা পড়ে আর হারায়া যায় বা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
আর আব্বু হলেন সেই লোক যিনি খেয়াল রাখেন কে কোনদিকে হাটাচলা করছে; অবুঝ শিশুকে পানিতে ডুইবা মরা থেকে রক্ষা করতেছে। আবার শিশুর মনের আনন্দ পূরণে লক্ষ্য রেখে ধরে ধরে স্রোতের সংস্পর্শ দিচ্ছে।
বুঝলেন হুজুর পুরাই সিম্বলিক একটা মিনিং পাইলাম আমি এই স্বপ্ন থেকে। আর এই মিনিংটা আমাকে আজকে হেল্প করতেছে যখন আমি দুনিয়া ও আখিরাতের কোনকিছুই গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নই — আমাকে বলতেছে বাপের ভূমিকায় দুনিয়ায় নিজের অস্তিত্বের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটাতে। কিন্তু আমি তো প্রস্তুত নই হুজুর। আমাকে প্রস্তুত হতে হবে।
খয়রাতির মানসিক অবস্থা বুঝতে পারেন ইমাম সাহেব, এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দেন আর বলেন, লাইফের মিনিং খুঁজতে যাওয়া, লাইফরে অর্থহীন মনে হওয়া এই টাইপের যত ফিলসফি আছে এইগুলি আইডিয়া হিসেবে ‘গড’ আইডিয়ার বাই-প্রোডাক্টই তো প্রধানত।
গডরে বাতিল করার চিন্তা মাথায় ঢোকার পরেই দেখা যায় যে মানুষের লাইফের মিনিং খুঁজতে বাইর হইতে হয়; লাইফরে অর্থহীন মনে হয়। মানে গড এর প্রচলিত একটা মিনিং তারে আর স্যাটিস্ফাই করে না যখন তখনি না সে আরেকটা মিনিং তৈরি করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। এক্সিস্টেনশিয়ালিজম, নিহিলিজম, এবিসার্ডিজম, মিস্টিসিজম এরকম ফিলসফিগুলো তো মনে হয় এরই ধারাবাহিতা।
ফলে দুনিয়ার যেসব জায়গায় গড ধারণা খুব একটা পপুলার হইতে পারে নাই সেসব জায়গায় লাইফের মিনিং সম্পর্কিত এসব ফিলসফিগুলিও খুব একটা গ্রো করতে পারে নাই।
গড নিয়া মইজা থাকারা গডরে বাতিল কইরা দিয়া যে এবসার্ডিটির সম্মুখীন হয় এই লইয়াই দেখা যায় তাদের মহৎ সব শিল্পকর্ম দাড়ায়া থাকে। তো মানুষের ভোগান্তি কমাইতে ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় আপনার যে জার্নি সেটা আমি মনে করি গড সেন্ট্রিক যে কেবল এস্থেটিক্স, বিরোধীতা আর আধ্যাত্মিকতার চর্চা আছে সেটাকে আরো ব্রডার স্পেইসেই নিয়ে যাবে।
কথা শেষ করে হুজুর ঘুমের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য খয়রাতীর কাছ থেকে বিদায় নেন। ভাব খয়রাতিও হুজুরকে বিদায় দিয়ে শুয়ে পরে।
রাত তিনটা বাজলে বিছানা ছাইড়া ওঠে ভাব খয়রাতি। মসজিদের পূবে নদীর পাশে সুপারি গাছ দিয়ে বানানো মাচানে গিয়ে বসে।
নদীর পাশে বসে সে যে কেবল নদীর বয়ে যাওয়া পানির মৃদু শব্দ শুনতে থাকে তেমন না। নদীর পারে বসে সে রাত ৩ টার আলো, শব্দ আর বাতাসটুকুও গায়ে মাখে। সময়ের সাথে সাথে আলো, শব্দ ও বাতাসের বেগে যে পরিবর্তন লাগে সেটা অবলোকন করে। তার মনে হয় সময় ও সত্তার নিকট উপস্থিতি এতোটা তীব্র ভাবে ধরা দেয় এমন মুহূর্ত অন্যান্য সময়ে খুব কমই হয়তো তৈরি করতে পারে পরিবেশ।
একটা শাপ নেমে যায় পানিতে — চায়ে চালভাজা ভেজার যে শব্দ সে শব্দের মতো খয়রাতীর গায়ের লোম জেগে ওঠে। সে ভাবে, পৃথিবী ছেড়ে বহুদূর থেকে ধীরে ধীরে জুম করে যদি আমাকে দেখানো হয়, যদি দেখানো হয় এই নদীর পারে রাত ৩ টা বাজে বসে আছি আমি, কী মিনিং পয়দা নেবে তাতে?
গতকাল চলে গেলেন হাজী ব্যাপারী (তারা যে মসজিদে তবলীগে এসেছেন সে এলাকার একজন মুরুব্বী)। কোথায় চলে গেলেন তিনি? খয়রাতির জানা নেই। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন এইটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারার মতো সক্ষমতা রয়েছে খয়রাতীর। খয়রাতি ভাবে, ব্যাপারী সাবের জন্ম-মৃত্যু একটা এলাকার কিছু মানুষের জন্য একটা ঘটনা হইতে পারছে। পৃথিবী ছেড়ে বহুদূর থেকে ধীরে ধীরে জুম করে যদি ব্যাপারী সাবের কবরটা দেখানো হয়, কী মিনিং দেবে সেই ইমেইজটা?
একটা কবিতা বাঁধে খয়রাতি —
ছোট একটা গ্রাম
তার ছোট একটা মসজিদ
তার আছেন একজন ইমাম
আর আছেন প্রতি ওয়াক্তের
নামাজে ফিক্সড ক’জন লোক।
ফিক্সড ক’জন লোক
বুড়া মানুষেরাই হয়;
কেবল আমার মতো জীবন
খোঁড়া লোক — অকালে
গায়েবের খোঁজ লয়, সদা
সিজদায় পইড়া রয়।
একে একে চলে যান তারা
আসেন নতুন নতুন মুখ
মসজিদটি থাকে
থাকে ছোট গ্রামটিও
মসজিদের ইমাম বদলায়
বদলায় কাতারের মানুষেরা।
সে মসজিদে ১৩.৫ বিলিয়ন ইয়ার্সের
কোন একটা সময়ে
সে সময়ের ইমাম আর মানুষগুলির
সাথে আমি নামাজ পড়ছিলাম
তাদের কারো কারো নামও জানতাম
আমি; নাম ছাড়াও তাদের আরো
কী কী যেন পরিচয় ছিল!
আমাদের ভাব খয়রাতি পরের দিন তবলীগ শেষ করে ঢাকায় ফেরে। আমাদের গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ভাব খয়রাতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেলেও তার প্রেমিকা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতে পারি নাই। একটা গল্প প্রেমটেমের ঘটনা ছাড়া শেষ হয়ে গেলে কেমন দেখা যায় না! চলেন আমরা খয়রাতির প্রেম নিয়া কিছু কথা জাইনা গল্পের ইতি টানি।
তিন
ভাব খয়রাতি তাঁর প্রেমিকা সম্পর্কে জানান,
একটা বিকালের কথা বলবো আমি। হ্যাঁ, হাজারটা প্রবলেম আমার এবং দুনিয়ার থাকার পরেও আমি একটা বিকালের কথা লেখার জন্য কিছুটা সময় নেবো। একটা বিকেল যে বিকেলকে একটা শব্দে বন্ধ করবার চেষ্টা আমি বহুদিন ধরে করেছি। পারি নি। তাই চুপ করে থেকেছি।
একটা সময়কে ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয় – জেনেশুনে একটা অপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপন করার বিড়ম্বনা বা জটিলতায় নিজেকে জড়ানোর এ অপরাধ সাংঘাতিক। তবু ভাষার এই অপূর্ণতা কে অনিশ্চয়তার মতোই অতিরঞ্জিত করা ঠিক হবে না। ভাষা যতটুকু পূর্ণতা নিয়েই আমাদের মাঝে বসবাস করছে তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্তঃ থাকার কথা নয়।
আমি তো একটা শব্দের খাঁচা পাইলাম না যার মাঝে আমি একটা বিকালরে বন্দি করতে পারি। তাই আমাকে বর্ণনা করতে হলো।
সেদিন বিকালের আকাশে মেঘ ছিল। মেঘ থাকায় যে আলো ছড়িয়ে ছিল চারপাশে, কী নাম দিবো সে রঙ এর? বরং আরো একটা সময়ের কথা বলি — মাগরিবের আজান হবে হবে এমন সময়টাতে (সাধারণত গ্রীষ্মকালে) যে আলো আর স্তব্ধতা নেমে আসে মহল্লায় তেমন একটি রঙ হবে সেই বিকেলের। বা, কাব্য করে বলা যেতে পারে, নীড়ে ফেরা পাখিদের ডানা ঝাপটানো আলো।
সেদিন বিকেলে নীড়ে ফেরা পাখিদের ডানা ঝাপটানো আলো আমার বহুদিনের তপস্যাকৃত স্থিরতার ভিত নাড়িয়ে দেয়। একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে আমি ফিরে যেতে চাই সেখানে যেখানে আমি শুয়ে আছি স্থির, অনন্তকাল ধরে। কিন্তু সেদিন সেই বিকেল আমার হাতে, পায়ে, গলায় শেকল বেধে আমাকে নিয়ে যেতে থাকে একটা নদীর পারে।
বিকেল গুলো কেন এমন নদীর পারেই নিয়ে যেতে থাকে? এতো ক্লিশে কেন ওরা? ওরা কি আমাকে ১৫ বছর পর পুরনো প্রেমিকার সাথেও দেখা করিয়ে দেবে নাকি? এতো নিচে নামতে পারবে আমার উল্লেখযোগ্য একটা বিকেল? আমি তো কম করেই ভেবেছিলাম — বিকেলটা আরো নিচে নেমেছিল সেদিন, তাই পূর্বকালীন প্রেমিকার পরনে ছিল নীল আসমান!
সময়ের নাটকীয়তার কাছে ‘আমরা’ বড় অসহায়। তাই আমাদের নিবিড় ধ্যানে আর প্রজ্ঞায় গড়ে তোলা একটা অস্তিত্বও হাঁটু গেড়ে বসে পরে হঠাৎ। মগজে হিন্ডসাইট বায়াস বা একটা সময় পরে অতীতে যা ছিলাম তা সম্পর্কে মিথ্যা ন্যারেটিভ দাঁড়া করানোর যে ভুল সে ভুল সম্পর্কে সচেতন থাকার পরেও কেন আমি সেদিন মনে করতে থাকলাম, আহা! কী রঙিন ছিল সেসব দিনগুলি, কী যে প্রেম ছিল তাহার প্রতি!
একটা বিকেল একটা নদীর পারে ফুরাইতে থাকে। সেদিন বিকালেও ভাষাচিন্তা আর ছবি ক্রমশ জায়গা করে নিতে থাকে আমার আর প্রেমিকার স্থান। ফলে আমাদের কথা হয় না। আমরা একটা সময়, একটা ছবি, একটা ঘ্রাণ ক্যাপচার করে রেখে দেই একটা বিকালের কাছে আর শেকলগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে ফিরে যেতে থাকি ধ্যান আর প্রজ্ঞার কাছে — গিয়ে শুয়ে থাকি ফের, অনন্তকাল ধরে।
ফটোগ্রাফি: মোহাম্মদ রোমেল
প্রচ্ছদের মডেল: সুদাম সাধু
শেখ সাদ্দাম হোসাইন
তরুণ গদ্যকার, কবি ও চিন্তক। জন্ম: ১৯৯৫ সালে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানায়।
পড়াশুনা: ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিং-এ বিবিএ।