রাংটিয়া সিরিজ

।। জ্যোতি পোদ্দার ।।

আমার ভেতর এই অরণ্য
আমার ভেতর এই অরণ্য
হাঁটে আর হাঁটে আর হাঁটে
আমি পাখি
আমি কোচ
আমি মান্দাই
আমি পাকুড় গাছের শিবায়
বন্য শুকরের ফিনকি দেয়া রক্ত
গাছে গাছে বান্দিছি আমার পরাণ সুতার বান্ধন
এই অরণ্যের সকলের পরাণে পরাণে।

এই অরণ্য আর যুগলকিশোর কোচদের নয়।
এই অরণ্য এখন আমীন করাত কলের লিজের চাতাল।

ট্রাকভর্তি উডলগ
ট্রাকভর্তি উডলড
ট্রাকভর্তি উডলড

করাতের করালে স্লিম ফর্সা ইউক্লিপটাস ইলেকট্রিক পুল হচ্ছে।
ছোট ছোট লাকড়ির আঁটি হচ্ছে
বস্ত বস্তা কুড়া হচ্ছে
ঝিমঝিম মাথা ধরা করাতের বেসুরা সুর ছড়াচ্ছে চারদিক…

ইলেকট্রিক পুলে পুলে বাত্তি আর বাত্তি
আর বাত্তিতে বাত্তিতে বাত্তিঅলা লোকের
এবার হাট বসবে পঞ্চবটির আন্ধার করা ঝোপে।
ভোর হবার আগে বনমোরগ গলায় তুলবে ভোরের কীর্তন

ঝোপের আড়ালে আর কালো কালো ঝোপ নেই
কেবল বাত্তি আর বাত্তি আর ঘুমহীন বনমোরগ ভোরের
আগেই গলায় তুলে নিচ্ছে ভোরের কীর্তন

ওঠো ওঠো কোচনারী
তোমার মরদকে টাউনে মহাজনের মুদি দোকানে পাঠাও
গায়ে গতরে এখনও বান আছে
শরীরে শরীর ঘষলে এখনও জ্বলে আগুন

ও কোচনী মজুর খাটতে তারে টাউনে পাঠাও

আমার পাশে যুগল কোচ আমার পাশে জাসেং ঘাগ্রা
আমার পাশে রফিক মজিদ

যুগল আমার প্রাত্যিকতা জানে
জাসেং আমার প্রাত্যিকতা জানে

আমি জানি না যুগল কোচদের নিকানো উঠানে
গোল বৃত্তের ভেতর যৌথতার উদ্দাম উৎসব

রফিক মজিদও জানে না জাসেঙের ওয়ান্না
অথবা ইস্টার সান ডে কিভাবে বিনীত হয়
ক্রুশবিদ্ধ জেসাসের পাদপদ্মে

আমার ভাষা যুগলও জানে জাসেংও জানে
গড়গড়ে আমরি বাংলাভাষা
যুগল কিংবা জাসেঙের বলার ঢঙ ভালো লাগে
আহা! কী সুন্দর আচিকের সুরে বাংলাভাষা
আমাদের কানে সুধার মতো লাগে।

অথচ আমরা পড়শীর ভাষা জানি না।
আমরা পড়শীর মাটির ঘরে বাতায় ছিক্কায়
ঝুলে থাকা দরার কথা জানি না।

ঊন পড়শি সংখ্যার চাপে চিড়ে চ্যাপ্টা
কখনও সমস্তপদ কখনো ক্ষুদ্র
কোথাও কোনো পুর্ণাঙ্গ চরিত্র নেই।
কস্মিনকালেও পূর্ণ নয় আমার মতো
কস্মিনকালেও পূর্ণ নয় রফিক মজিদের মতো

জলে ভিজে ভিজে
কান্নায় ভিজে ভিজে
বিন্নী ধানের চিড়ে ফুলে ফেঁপে বেঢপ শরীরের মতো
যুগল কোচ জাসেং মান্দি মৃত নয়
মৃতবৎ
শরীর আছে রা নেই
ভাষা আছে চিৎকার নেই

নকশীর ফ্যাকাশে লাল মাটি জানে
কতগুণ কান্না ঝরে
পাহাড়ি ছড়ায় আর পড়শী বোবা কান্নায়।

আমার এক বন্ধুকে একবার মান্দারের ডাল দিয়ে খুব পিটিয়েছি।
বন্ধু শত্রু হলে পিটিয়ে আরাম।
রাগের ঝাল মিটিয়ে নিঃশেষে বিভাজ্যে পিটিয়েছি।

বন্ধুত্বের চাতাল নির্মাণ ছাড়া
বন্ধুতার উল্টাপীঠে মান্দারের ডাল কোন আঁচড় কাটে না।

রোদের ভেতর রক্তরাঙা মান্দারের ফুল
হাসতে হাসতে
নাচতে নাচতে
শরীরে গড়িয়ে পড়লেও আমি কিন্তু কাঁটা মান্দারের ডাল ভেঙে
পিটিয়ে পিটিয়ে বন্ধুতাকে নি:শেষে বিভাজ্য করেছি।

যোগের পাঠ শিখিনি বলে কোনদিন
রক্তরাঙা মান্দারের ফুল আমি তুলিনি।
লালে লালে লাল গাছতলা রক্তবর্ণা মান্দারের ফুল
আমার জন্য কেঁদেছে শুধু।

বৃক্ষের চামড়া তুলে চৌকোনা ঘরে লালে রঙে
এখনো এখানে লেখা হয়নি হাজার পঞ্চাশ
অথবা হাজার সত্তর
অথবা আবার হতে পারে হাজার নব্বুই।

এই বিটে বৃক্ষের সংখ্যা কত?
আমি জানি না।
কোনও মান্দিই জানে না।

সাহেব রেঞ্জার এই বিটের বৃক্ষশুমারীতে
যে সংখ্যা খতিয়ানে লিখে গেছেন
তার চেয়ে বাড়েনি বৃক্ষ
মানুষের পাশে মানুষ বেড়েছে উর্ধ্বমুখী
অরণ্যে কমেছে কোচ আর শুকরের পাল।

দুই বিটের মাঝে শুন্যমাঠে সারি সারি বৈদেশি গাছ।
গাছের উপনিবেশ—গজারি বৃক্ষের পাড়া।
যদিও লালমুখা সাহেব তার প্রিয়টুপি নিয়ে চলে
গেছেন বহু বছর আগে।

সাহেবের লালবাংলো এখন রেঞ্জার অফিস।
আর্দালি রাতের পাহারাদার।
বৃক্ষ জাগো বৃক্ষ জাগো বলে চৌচির করে
রাংটিয়ার প্রশস্ত বৃক্ষ বাগান।
রেঞ্জার সাহেব এখানে থাকেন না।
থাকেন টাউনে একা সরকারি ডরমেন্টরিতে।
আর ছেলেমেয়ে বউ রাজধানীতে।

এই বিটের সংখ্যা কত?
বৃক্ষের চামড়া তুলে চৌকোনা ঘরে লালরঙে
এখনো এখানে লেখা হয়নি;
হাজার পঞ্চাশ
হাজার সত্তুর
এখনো এখানে কিছু বৃক্ষ ব্যক্তিগত।
সংখ্যাহীন চিহ্নহীন।

ধুন্দল ফুল যখন গোল হলদে পাঁচ পাপড়ী নিয়ে ফুটে
আমি প্রতিদিন বৃত্তের মতো হলদে গোল
পাঁচ পাপড়ীর কাছে যাই

সবুজ ঝাকরা খাঁজকাটা পাতার কাছে যেতেই
আমাকে লতিয়ে নিয়ে
জড়িয়ে জড়িয়ে ছড়ায় আর ছড়ায়

আর আমি বাবা বাবা ডাক শুনি
ছেলের ভয়ার্ত কান্নার ভেতর বাবা বাবা ডাক শুনতে শুনতে
আমি ক্রমশ হলদে বৃত্তের মতো পাঁচ পাপড়ির
ফুলের কেন্দ্রে ডুবে যাচ্ছি আর ডুবে যাচ্ছি
আর কাঁপা কাঁপা জলের কম্পনে ভেসে যাচ্ছে
ভেসে যাচ্ছে বাবা বাবা তুমি কই তুমি কই

শিশিরে শিশিরে মাঠ ঘাট পাকা সড়কের পাড়ে দূর্বা ঘাস
একটু একটু করে স্নাত হতে হতে
ভেজা ভেজা নরম শরীরে
বুটিবুটি জলভরা বল
কোনটি ফুটছে কোনটি ঝড়ছে টুপটাপ টুপটাপ মাত্রাবৃত্ত ছন্দে।

সবুজ শাড়িতে শালগ্রাম পাথরের মতো
চকচক করছে মালতি কোচের
একহারা গড়নের পিটানো কালো গতর

ষোড়শী মালতি সাহসী।
ফাঁটাবাঁশের মতো চটাং চটাং কথা বলতে কাউকে
ছাড়ে না।
চোখ বড় বড় করে চোখের দিকে তাকিয়ে
বিস্ফারিত চোখে মুখে একটানা কথা
বলতে বলতে যেখানে থামল
সেখানে আমার ফুলস্টপ দেয় ছাড়া আর
কোনও পথ নেই।

মালতি কোচ মাধ্যমিক পাশ
কারিতাসের মাঠকর্মী
বুধবারে বুধবারে উঠান বৈঠকে
স্বাস্থঝুকি নিয়ে অল্প অল্প গল্প করে করে
স্বল্প স্বল্প ঋণ কিস্তি দিতে না পারলে
চটাং চটাং কথা বলতে কাউকে ছাড়ে না।

এই অরণ্যে এলেই আমার ভেতর কে যেন কে যেন
আড়মোড়া ভাঙে
হলুদ পাতার পতন গুঞ্জনে
হলুদ পাতার পতন গুঞ্জনে
গুতগুত করতে করতে কালো কালো বন্য
শুকরের দল আমার ভেতর গুতগুত করতে করতে
কংস পাড়ের সোঁতা থেকে
ছোপছোপ অন্ধকার গায়ে মেখে বন্য শুকরের দল
আমার ভেতর আমার ভেতর
গন্ধ শুখে শুখে খুঁজছে বিন্যস্ত গাড়ো পাহাড়ের তামাম চাতাল

আমার ভেতর হলুদ পাতার পতন গুঞ্জনে
কে যেন কে যেন আড়মোড়া ভাঙে

আমার ভেতর এই অরণ্য আমার ভেতর এই অরণ্য
হাঁটে আর হাঁটে আর হাঁটে
আমি পাখি
আমি কোচ
আমি মান্দাই
আমি পাকুড় গাছের শিবায়
বন্য শুকরের ফিনকি দেয়া রক্ত
গাছে গাছে বান্দিছি আমার পরাণ সুতার বান্ধন
এই অরণ্যের সকলের পরাণে পরাণে।

আমার ভেতর কে যেন আড়মোড়া ভাঙে
পতন গুঞ্জনে আমি উন্মাদ মাতাল
আমার ভেতর সমস্ত অরন্য টিম্বার কোম্পানির
বিটে বিটে হাঁটে
বিটে বিটে হাঁটে
আর চকিদার টিলার ঢেউ খেলানো খাঁজকাটা
উপত্যকা খোঁজে।

কোচ যুবক কারিতাসে অথবা বাঙালি মুদির
পেটেভাতে খাটা বেগার গতর
খাটতে খাটতে সাদা ফর্সা মুখ
তামা-কাঁসা-মুখ।

কোচ যুবতী বিউটি পার্লারে মাইনে বান্ধা
বিউটিশিয়ান— কর্পোরেটের মডেল।
বাঙলি নারীর আস্তা আর বিশ্বাসের প্রতীক।

কোচনারীর ভ্রু-প্লাক ফ্লেশিয়াল মশচেজার দারুণ করে
চল্লিশের নারী যেন কলেজ পড়ুয়া
শ্যামলা গতরে ফর্সা ত্বকে ফোটায় সৌন্দর্যবিলাস।

বাঙালী নারী কোচনারীর কেয়ার অফ চায়।

মান্দি তুমি বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী।
এসো কোচ আমার ঘরে
এসো কুচুনী আমার ঘরে

তোমার অরণ্য তোমার অরণ্য আমার হোক
পাহাড়ের সোঁতা জল আমার হোক
মোটা বালির মোটা লাভ
চিহিদানা বালির চিকন লাভ
লাল কাকঁড় বালির চকচকে লাভ
বিটের পর বিটে বাঙালির খামার হোক
হাইব্রীড লেবুর বাঙালি খামার হোক

মান্দি তুমি কারিতাসে থাকো
মান্দি তুমি পার্লারে থাকো

আমার গাছ প্রীতি– টবে লাগানো গাছ প্রীতি।
দুই ফ্লাটের নকশা করছি বলে
উঠানের পরিসর রাখতে পারিনি।
ঘর থেকে নেমে রাস্তা
অথবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘরে ঢুকার রাস্তা।

পর্চ দেড ফুট বাই ছয় ফুট।
সেখানেই ছোট ছোট টবে ছোট ছোট
ফুল আর ফলের বৃক্ষের বন।

রোদ আর বনের বাতাসে একটু একটু করে
বারান্দার রেলিঙে শুকাচ্ছে
ভেজা ভেজা কাপড় গামছা
আর ক্লীপে ঠাসা বাচ্চাদের
গেঞ্জি প্যান্ট পেটিকোট
আর দেয়ালের কোণে গোলাপী ব্রা।

১০

না না–ঠিকাছে ঠিকাছে যুক্তি ঠিক আছে

ওর হা তোলা দেখেছ?
হাঁটা কিংবা হাত নেড়ে নেড়ে যখন ও কথা বলে
কেমন যেন কেমন যেন তোতলা তোতলা।
থেবড়ানো নাক পিটপিট চোখ আমার একদম পছন্দ না।
আর শজারুর কাঁটার মতো ওর খাড়াখাড়া চুল দেখছো?
স্রেফ ভয়ঙ্কর। আমার বাচ্চারা ওকে দেখলে
চোখ বন্ধ করে রাখে।

টিয়ের ঠোঁটের মতো তোমার বাঁকানো নাক
তোমাকে যেমন মানিয়েছে ওর পিটপিট চোখও তেমনি।
ও ওর মতো
আমি আমার মতো
তুমি তোমার মতো

দুই চোখ মেলে দেখো অনন্যতা।
প্রত্যেকে সুন্দর।

ঠিকাছে ঠিকাছে– সব জায়গায় যুক্তি দিও না।

১১

পুরনো ঘর পুরনো বসত নব্বই ছুঁই ছুঁই বুড়ি বসে বসে হাটে
মস্ত বাড়ি এ মাথা ও মাথা ঘর।
মাঝখানের উঠান— ধান শুকাবার উঠান।
বিকেলবেলার গোল্লাছুটের উঠান।

এখনো নিকানো এখনো গোবর ছড়া সকাল বিকাল ঝাট
নব্বই ছুঁই ছুঁই বুড়ি বসে বসে হাটে।
বসে বসে হাটে।
মস্ত উঠান যেন বুড়ির থানপরা কাপড়ের মতো
ঝকঝকে তকতকে।

কোচকানো শাড়ির পাড়ের মতো উঠানের এককোনে
ময়লা পাতার ঢিপি উঁচু করে রাখা।

পুরনো ঘর পুরনো বসত ভেঙে ঝুরঝুর
কিছু শেকড় ধসে গেছে
কিছু শেকড় দেশান্তর
কিছু শেকড় ফ্লাটের কংক্রিটে দাঁড়িয়ে খোঁজে আকাশ
কিছু শেকড় নির্বীজ ভাসমান উলম্বজীবন।

আড়াআড়ির জীবন নেই কোথাও
নব্বই ছুঁই ছুঁই বুড়ি এ ঘর ও ঘর বসে বসে হাটে
আর তকতকে উঠান মুচকি মুচকি হাসে।

………….

জ্যোতি পোদ্দার

জন্ম ১৯৭৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের নয়ের দশকের কবি। বাসস্থান বাংলাদেশের শেরপুর জেলার নালিতা বাড়ি। পেশা শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত। প্রকাশিতকাব্যগ্রন্থ: ‘(a+b)2 উঠোনে মৃত প্রদীপ’ (১৯৯৭), ‘সীতা সংহিতা’ (১৯৯৯),
‘রিমিক্স মৌয়ালের শব্দঠোঁট’ (২০০২), ‘ইচ্ছে ডানার গেরুয়া বসন’ (২০১১), ‘করাতি আমাকে খুঁজছে’ (২০১৭) এবং ‘দুই পৃথিবীর গ্যালারি’ (২০১৯)।

Share