এবার লেখো দেহমঙ্গল, অশোকলিপিতে

গুচ্ছ কবিতা

।। তুহিন খান ।।



ফুল্লরাকে, ভোরে

এই ভোর, বেদনাবাহিত। কম্পমান ঠোঁটের ফাঁটলে, কুসুমিত সূর্য কামুকী। পিঠার মতন একা গালে, থই থই শবনমি তিল, রোদ্দুরে ফুলে ওঠা— লাল। মৃদু লাল, কুসুমকুসুম। হাফ বয়েলড নিঃশ্বাসগুলা, নূরের রেহেল থেকে ধূলা, উড়ায়। কেমন তাপে সখী, পাখি পরিযায়ী হয়ে যায়?

এ ভোরের নাম হোক সুবা। উদিত আকাশে লাল হোক, সানফ্লাওয়ারের মত যুবা। গোলাপি, মেরুন আর ঘিয়া, রাতজাগা বাসি ছদরিয়া, উড়ুক। সাবানগোলা জলে, বুদ্বুদে বিম্বিত হোক, চরাচরব্যাপ্ত শীৎকার! নিউজপেপার কেটে কেটে, জোড়া দেওয়া গ্লোবাল ভিলেজে, ফুল্লরা, তোমার ক্লিভেজে, সূর্যোদয় হবে নাকি? হোক। আধাসেদ্ধ ভাতের বলক, উপচায়ে পড়ুক এশিয়ায়। এই ভোর ভাসায়ে দেও প্রিয়া, দুর্বিনীত ফ্যানের শাদায়।


ফুল্লরাকে, যোহরে

সূর্য হেলে যায়, অতলস্পর্শে। শব্দে ভারি হয়ে, ঘুমায় অভিধান। ঘুঘুর ছায়া বাড়ে, সম্প্রসারণের এহেন ব্যাকরণ, তুমি কি জানতে? জানো বা জানোও না, তবুও যোহরের, ওপাশে হেলে পড়া আলোকরশ্মিতে, তোমার ছায়ারাও দ্বিগুণ হচ্ছে। তোমার ছায়ারাও দ্বিগুণ হচ্ছে, তোমার আব্বার, জায়নামাজ ঘিরে, জান্নাতের ঘোড়া যেন-বা ছুটছে, নম্র খুরে তার জ্বলছে ওয়াক্ত! কবুতরের খোপে, ডাকে কি হুদহুদ? সাবার রানী তুমি, নিথর জানালায়, বাকবাকুম হাওয়া, ঘূর্ণিসমবায়— সাবার রানী তুমি, পাপে ও পূণ্যে! ডাকছে কবুতর, এ মহাশূন্যে, জান্নাতের ঘোড়া পাঁচশো পাঁচদিন, শুধুই ছুটছে, তোমার আব্বার তসবি খুঁটছে, কপোত-কপোতীর তপ্ত চঞ্চু! আলমে আরওয়ার দেজা ভ্যু হচ্ছে, যেন সে নফস তুমি, যেন সে লগ্ন! মগ্ন সময়ের সে ভগ্নাংশেই, হেলছে সূর্য; প্রতিটি রুহ আজ মুতমায়িন্না, তোমার ছায়ারাও দ্বিগুণ হচ্ছে! হাসছে বু হানিফা, হে নারী ফুল্লরা, প্রেমের অক্তও, ফুরিয়ে যাচ্ছে!

ফুল্লরাকে, কামে

সুনিরাভরণ হও, গতরের ছতর সরাও। গন্দম খাওয়ায় কোন ইবলিশ? কে শিখায় মিথ্যা ক্যামোফ্ল্যাজ? দ্যাখো এই শস্যের ভেতর থেকে গজিয়ে ওঠা অঙ্কুরের ঘ্রাণে মাতাল যে ফ্লোটিং সন্ধ্যাতারা তোমার রুহের চারপাশে, কলমিলতার মত জড়িয়ে ধরেছে তোমার প্রাকৃত বুনির বৃত্তপট, তারে মাড়িও না। তারে বুকে তুলে নেও, তার কানে দেও জুলেখার শিস! জন্মেছ ব্যাধের ঘরে ছায়া, ফুল্লরা, রক্তের ভিতরে তার গেঁথে দাও কামের টোটেম, তারে সমূহ সুন্দর করো। বিসমিল্লাহ বলে তারে চুমা খাও। মাইয়ের ব্যাপ্তিতে ঘিরে রাখো বেদনায়।

অনার্য শ্যামলী, দ্যাখো, কৌমার্যের আর্তনাদ, কুমারী মেরির পেটে জিব্রিলের নিঃশ্বাস, ঈসা! হায় কলঙ্কিনী সেমেটিক, চুপ থাকো রোজার উসিলায়। অথচ হারুনের বোন জানে না সঙ্গম, পুরুষ ছোঁয়নি তারে। শরীর বিদীর্ণ করা নাজাতের ফেনা-নম্র পথ, চেনে না সে; বোঝে না সে, রুহের কৌমার্যছেঁড়া লোহিতাভ শীৎকারে-শ্বাসে, সিদরাতুল মুনতাহার পাতা নড়ে, মাটির আদম পায় রুহু; নফসের গহ্বরে বেদনার সেই প্রতিধ্বনি, শোনেনি সে কোনদিন। তুমিও কি হবা তার মতো? কুমারী কলঙ্কিনী, অনার্য শ্যামল মাগি, ঈশ্বরী হবা? অথচ তো জন্মেছো ব্যাধের ঘরে ছায়া, ফুল্লরা! কালো মাইয়ে লেগে আছে সান্ধ্যভাষা, নিঃশব্দ যুগের অন্ধকার। ছাড়ো মিথ্যা জাতিস্মর, চণ্ডীর আদেশ ও দ্বেষ, স্বর্গের স্মৃতি! মেলে ধরো শুধু এই ত্রিকোণ জ্যামিতি, শরীর বিদীর্ণ করা নাজাতের পথ। রতির বিরতি কেন? ওই দ্যাখো, স্বর্গ হতে নেমে আসে ঈশ্বরসকল। ফুল্লরা, এবার লেখো দেহমঙ্গল, অশোকলিপিতে। মেলে ধরো মসলিনের ভাঁজ। সেলফে তুলে রেখে দেও ফুকোদের যৌনইতিহাস।


বদর, বদর

আমার ভিতরে ফোটে টগবগাইয়া শব্দের কোরক,
আমি কেন হবো কও
মৃত্তিকায়া, তোমার উপাসক?
ছইয়ের ভেতরে ছায়া,
ছায়ার ভিতরে বাড়িঘর—
দক্ষিণসমুদ্র ডাকে
গেলাম আমি, বদর বদর!


পিওরিটান

কুয়াশায় ভাসতেয়াছো মুখ, তুমি কার?
মেবি গ্রামে আছি। দেখতেয়াছি
কতো যে শিশিরে ধরা গাবগাছ, চাইলতার পাতা
খিরইর মাচার নীচে ঝুলতেয়াছে নস্টালজিক চাইল্ডহুড
মা-চাচি-খালা-হুবু— আলাদা করতে পারতেয়াছি না কোনো মুখ বা এটলিস্ট, সম্পর্কগুলি
হলক তেমন নাই, চারিদিকে
বেপরোয়া কুহইল; ফগি চুলাহাল, আইতনা
খালি দেখতেয়াছি মুখ, ভেজা কুহইলে
পাকা ধানের মতন প্রেম আর নাই,
ঠোঁটের ফাটলে
খালি ঝরতেয়াছে শিশিরের পানি
আধখাওয়া ডউয়ার মত, ভাঙা আর নরম চোয়ালে
ঝোলতেয়াছে কালিটালি, গোবরের গন্ধ গায়, একটু আগে ডোয়া লেপছে মেবি—
ও ডোয়া-লেপা কালি-লাগা মুখ
কুয়াশায় ভাসতেয়াছ, জ্যামিতিক আকৃতিবিহীন
তুমি কার?
খাটাশের মুখে ধরা আম্মার মুরগীর মত
বাসের জানলা দিয়া দেখতেয়াছি, শীতের সন্ধায়
সেই কার মুরগীহারা ভুগাইত্যা চেহারা
বাতাসে উড়তেয়াছে ডানার ঝাপটানি
মাগরিবের আজানের ভেতরে পাক খায়া ঘুরতেয়াছে
খাটাশের মুখে ধরা আম্মার মুরগীর
ট্রাজিক ফেদার!



প্রচ্ছদের ছবি: জয়নুল আবেদিন

তুহিন খান


জন্ম ১৯৯৫ সনে। জীবনের মৌলিক শিক্ষা ঢাকার মাদ্রাসাতুল কাওসার আল ইসলামিয়ায়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ সোশাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিসার্চে অধ্যয়নরত। রাজনীতি ও নন্দনের গোপন আঁতাতে আগ্রহী; ধর্ম, ইতিহাস ও সাহিত্যের ছাত্র। প্রকাশিতব্য অনুবাদ: ইতালো কালভিনোর ‘ইনভিজিবল সিটিজ’।

Share